জনৈক প্রেমিক পর্ব -০৪

#জনৈক_প্রেমিক
পর্ব- ০৪

ওয়াহাবকে কী ওরা শ্রাবণ বলে ডাকে? হবে হয়তো ডাকনাম! সেটা মোটেও এখন আমার কাছে মুখ্য বিষয় নয়। আমি দুঃশ্চিন্তা করছি প্রত্নকে নিয়ে। সেদিন নিষেধ করার পরও ও এমন কেন করছে? আমি ওর ভাইকে মানি আর না-ই মানি। ও কোন আক্কেলে নিজের চাচাতো ভাইয়ের স্ত্রীর সঙ্গে পালানোর প্ল্যান করছে!
নাহ জলদি ওর সাথে আমার কথা বলা দরকার। কিন্তু এখন ওকে আমি কোথায় খুঁজব!

.
আজ বৌভাত। বিধায় পার্লার থেকে লোক এসেছে আমাকে সাজাতে। প্রথমে আমি চাইনি সাজতে। আমার শ্বাশুড়ি মা এসে জোর করলেন। ‘ এই ক’টা দিনই তো একটু সাজগোজ করবি ! ‘

আমি আর নিষেধ করিনি। আজকের দিনটাই তো। এরপর তো আমি চলেই যাব! একটা ভুলকে প্রশ্রয় দিয়ে সারাজীবন থেকে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
আমি নিজে যা ভুল করার করেছি। ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ভুলের পরিমাণটাকে আর বাড়াতে চাই না। এখান থেকে বিদায় হয়ে আমি ক্যারিয়ার গড়ায় মনোযোগ দেবো। বর্তমানে আমি অনার্স তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত। পড়াটা শেষ করি প্রথমে। এরপরে ক্যারিয়ারের দিকে এগোবো।

সেই কখন থেকে বসে বসে এটা সেটা ভাবছি। সাজানো শেষ হচ্ছেই না। এখন ভদ্রমহিলা আমার চোখে আইশ্যাডো পরাচ্ছেন। আমি বারবার করে বলেছি, হালকা সাজাতে। কি জানি কেমন সাজাচ্ছে! আমি চোখ বন্ধ রেখেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘আর কতক্ষণ লাগবে আপু?’

‘এইতো হয়ে গেছে। আর পাঁচ মিনিট! ‘

এই নিয়ে তিনবার জিজ্ঞেস করলাম। তিনবারই তিনি ‘পাঁচ মিনিট’ জবাব দিলেন। আমি তপ্ত নিশ্বাস ফেলে ভাবতে লাগলাম, প্রত্নর সঙ্গে অতি দ্রুত দেখা করা দরকার। অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর জানতে হবে ওর কাছ থেকে। ওকে সাবধানও করতে হবে, ও যেন আর কখনো আমার সঙ্গে কোনোভাবে যোগাযোগ করার চেষ্টা না করে!

অবশেষে সাজানো শেষ হলো। আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছিলাম। শ্রেয়া ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘ওয়াও ভাবি তোমাকে নীল জামদানিতে কি মানিয়েছে!’

আমি মুচকি হাসলাম। শ্রেয়া আবার বলল, ‘ভাবি ঘোমটা দাও!’

‘কেন?’

‘ অবিবাহিত, অবিবাহিত লাগছে।’

আমি শব্দ করে হাসলাম। ‘ঘোমটা দিলে বিবাহিত, বিবাহিত লাগবে?’

শ্রেয়া মাথা নাড়াল। ‘দাও না, ভাবি!’

আমি ঘোমটা টেনে নিয়ে বললাম, ‘হয়েছে?’

শ্রেয়া গাল ভরে হাসলো। ‘হ্যা! এবার বউ বউ লাগছে!’

.
এখন বাড়িতে যেসব মেহমান আছেন সবাই শ্রেয়াদের নিকটাত্মীয়। দূরের আত্নীয়-স্বজনেরা একজন দুজন করে আসতে শুরু করেছেন। ছাদে খাবার-দাবারের আয়োজন করা হয়েছে। সেখানেই বর-বউয়ের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর কিছুক্ষণ বাদেই আমাকে ওখানে নিয়ে যাওয়া হবে বোধহয়। সময় তো বেশি নেই।
চিঠি দিয়ে প্রত্ন কোথায় হাওয়া হলো কে জানে! দরকারের সময় ও সবসময় উধাও হয়ে যায়।

বলতে না বলতেই শ্রেয়া এসে গেল। ‘ভাবি, মা তোমাকে ডাকছে!’

শ্রেয়াকে অনুসরণ করে ডাইনিংরুমে যেতেই দেখলাম মা টেবিলে খাবার সামনে নিয়ে বসে আছেন। আমাকে দেখে মা হেসে বললেন, ‘বাহ কি সুন্দর লাগছে আমার মেয়েকে!’

অকস্মাৎ আমার মনে প্রশ্ন জাগলো, আচ্ছা আমার শ্বাশুড়ি মা কি জানেন বিয়ের দিনই তার ছেলে আমাকে সবার সামনে চড় মেরেছে?

মা আবার বললেন, ‘আয় আয় জলদি বোস তোদের খাইয়ে আমি আবার ওদিকটায় যাবো। অনেক কাজ বাকি এখনো!’

আমি, শ্রেয়া দুজনে দুটো চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম। মা আমাকে খাইয়ে দিতে নিলেন। আমি বললাম, ‘ আপনার কষ্ট করে খাইয়ে দিতে হবে না মা। আমি নিজে খেয়ে নেব!’

মা ভ্রু কুঁচকালেন। ‘কষ্ট কীসের? এই ভারী গয়না-গাটি নিয়ে তুই নিজে খাবি কীভাবে?’

তাও তো ঠিক। তাই আর কথা বাড়ালাম না।
মা আমাকে খাইয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘শ্রেয়া, তোর ভাবীকে একা ছাড়িস না। সাথে সাথে থাকিস। বাড়ি ভর্তি লোকজন। নতুন জায়গা কাউকে চেনে না মেয়েটা। ‘

শ্রেয়া বলল, ‘আচ্ছা, মা।’

মা আবার বললেন, ‘ শ্রাবণ কোথায় রে? অনেকক্ষণ ধরে দেখছি না!’

শ্রেয়া উত্তর দিল, ‘জানিনা, মা! ভাইয়াকে তো লাস্ট ব্রেকফাস্টের সময় দেখেছিলাম। ‘

মা’র কপালে চিন্তার ভাজ পরল।

খাওয়া শেষ হলে মা আমাকে বললেন, ‘কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে শ্রেয়ার সঙ্গে ছাদে যাস, কেমন?’

আমি সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালাম।

শ্রেয়া বলল, ‘ভাবি তুমি তোমার ঘরে গিয়ে বসো। আমি এখনি আসছি!’

‘কোথায় যাচ্ছো?’

শ্রেয়া জবাব দিল, ‘ভাইয়া কোথায় দেখতে। ভাইয়াকেও তো তোমার সাথে বসতে হবে!’

‘ওহ। আচ্ছা শ্রেয়া একটা কথা জানার ছিল!’

‘কী ভাবি?’

আমি বললাম, ‘তোমার ভাইয়ার নাম কি শ্রাবণ? ‘

শ্রেয়া উচ্চস্বরে হাসতে লাগল। যেন এর চেয়ে মজার কিছু ও কখনো শোনেনি। আমি বললাম, ‘হাসছো কেন?’

শ্রেয়া বলল, ‘ ভাবি তুমি তোমার হাসবেন্ডেরই নাম জানো না!’

আমি বললাম, ‘বলো না!’

শ্রেয়া হাসি থামিয়ে বলল, ‘হ্যা।’

‘তাহলে যে আমাদের বলা হয়েছিল ওনার নাম ওয়াহাব আহমেদ! ‘

শ্রেয়া আবার হাসল, ‘ওটা তো ভালো নাম। ওসব নাম সার্টিফিকেটে থাকে। আর শ্রাবণ ডাক নাম। আচ্ছা ভাবি জানো আমার ভালো নাম কী?’

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী?’

‘ওয়াসিয়া আহমেদ!’

‘বাহ! সুন্দর নাম।’

শ্রেয়া হেসে বলল, ‘ভাবি তোমার ভালো নাম কী?’

আমি বললাম, ‘আমার কোনো ভালো নাম নেই। আমার একটাই নাম সবখানে। হৃদি শেখ!’

‘এটাই ভালো!’ বলে শ্রেয়া আবার উচ্চস্বরে হাসতে আরম্ভ করল। তারপর হাসি থামিয়ে বলল, ‘নয়তো দেখা যেতো ভাইয়াও তার বউয়ের নাম জানে না!’

.
এখানে এসে বসেছি আধ ঘন্টা হলো। ছাদে বেশ বড়ো করেই আয়োজন করা হয়েছে। একপাশে খাওয়ার ব্যবস্থা। আরেকপাশে বর-বউয়ের বসার। আত্নীয় স্বজনরা যারা এসেছেন তারা বউ দেখার পর নিজেদের মধ্যে মন্তব্য করছেন। আমার ব্যাপারে তারা ঠিক কী মন্তব্য করছেন তা বোঝা যাচ্ছে না। ওয়াহাব ওরফে শ্রাবণ এসে বসেছেন পাঁচ মিনিট হল। এতক্ষণ কোথায় ছিলেন তিনি কে জানে।

হঠাৎ কোত্থেকে শ্রেয়া এসে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘ভাইয়া, প্রত্ন ভাইয়াকে কারা যেন মেরে হাত পা ভেঙে দিয়েছে। এখন হাসপাতালে ভর্তি! ‘

আমার ভয় ভয় করতে লাগল! কারা মারল প্রত্নকে!
এমন একটা সংবাদ শুনেও শ্রাবণের মুখভঙ্গির কোনো পরিবর্তন ঘটলো না। শুধু ছোট্ট করে বললেন, ‘তাই নাকি!’
বলে আচমকা আমার দিকে তাকালেন। ওই দৃষ্টিতে কী ছিল জানিনা, ভয়ে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল।

শ্রেয়া বলল, ‘ভাইয়া, তুমি জানো প্রত্ন ভাইয়াকে কারা মেরেছে?’

শ্রাবণ বললেন, ‘আমি কী করে জানবো!’

শ্রেয়া বলল, ‘ছোট চাচী অনেক কান্নাকাটি করছে। চাচ্চুও আমাদের ফ্ল্যাটে এসে চেঁচামেচি করছে আর বলছে যে বা যারা তার ছেলেকে মেরেছে তাদের সবাইকে জেলের ভাত খাওয়াবে।’

শ্রাবণ বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকালেন, ‘এসব কথা আমাদের ফ্ল্যাটে এসে বলার মানে কী?’

‘জানিনা ভাইয়া।’

প্রত্নকে কে বা কারা মেরেছে তা আর কেউ না বুঝলেও আমার বুঝতে বাকি নেই। নিশ্চিত হবার জন্য আমাকে নিচে শ্রাবণের ঘরে যেতে হবে। শ্রেয়া পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। ওকে ডেকে কানে কানে বললাম, ‘শ্রেয়া, আমাকে ওয়াশরুমে যেতে হবে!’

‘চলো ভাবি, ছাদের ও পাশের ঘরটাতেই একটা টয়লেট আছে।’

‘না, নিচে যেতে হবে। আমার শাড়ির কুঁচি খুলে গেছে। ঠিক করতে হবে।’

শ্রেয়া বলল, ‘ঠিকাছে, চলো।’

আমাকে উঠতে দেখে শ্রাবণ শ্রেয়াকে ইশারায় জিজ্ঞেস করল, আমরা কোথায় যাচ্ছি। আমি আড় চোখে তাকিয়ে দেখলাম।
শ্রেয়া মুখে বলল, ‘ভাবি ওয়াশরুমে যাবে।’

বাহানা দিয়ে নিচে নেমে এলাম ঠিকই। কিন্তু শ্রেয়ার সামনে কীভাবে খুঁজবো! শুধুমাত্র ওকে রুম থেকে বের করার উদ্দেশ্যেই বললাম, ‘ তোমার কাছে একটা নাপা এক্সট্রা হবে? মাথা ব্যাথা করছে খুব!’

‘মায়ের কাছে আছে বোধহয়। দাঁড়াও আমি গিয়ে দেখছি!’

শ্রেয়া যাওয়ার পর চট করে দরজা লাগিয়ে জিনিসটাকে খুঁজতে লাগলাম। না! কোত্থাও নেই! অথচ আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি চিঠিটাকে বালিশের নিচে লুকিয়ে রেখেছিলাম। এ ঘরে তেমন কেউই আসেনি আজ। সারাদিনে আমার শ্বাশুড়ি মাও আসেননি। শ্রেয়া এসেছিল দু’তিন বার। তাও আমাকে ডাকতে। শ্রাবণকে তো আমি একবারই আসতে দেখেছিলাম! পরে কি উনি আর এসেছিলেন! কোনোভাবে কি চিঠিটা ওনার হাতে লেগে গেছে আর উনি প্রত্নকে!
ব্যাপারটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ের আগে প্রেম ছিল বলে যে নিজের সদ্য বিয়ে করা বউকে চড় মারতে পারে তার মতো লোকের পক্ষে ওই চিঠিটা পড়ার পর প্রত্নকে মারা একদমই স্বাভাবিক বিষয়। নাহ আর ভাবতে পারছি না! বাবা কেন আসছে না! সেই বারোটার সময় রিহা কল করেছিল, ওরা আসছে। এতক্ষণে তো এসে পরার কথা! যেভাবেই হোক বাবাকে আজ আমি সব জানিয়ে দেবো। জানিনা বাবা কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে! বিয়ের দিনই কেন জানাইনি হয়তো সেজন্য বকবেও! বকলে বকুক! আজ না বললে আর কোনোদিনই বলা হবে না আমার! শ্রাবণ নামক বদরাগী, মানসিক রোগীর সঙ্গেই হয়তো সারাজীবন কাটাতে হবে!

চলবে…

লেখা: #ত্রয়ী_আনআমতা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here