জলচক্ষু পর্ব ২

#জলচক্ষু
#২য়_পর্ব
#লেখা_অনন্য_শফিক

প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে চোখ মুছতে মুছতে হোস্টেলে ফিরলাম আমি। হোস্টেলে ফিরে চোখে মুখে জল ছিটিয়ে নিজেকে ঠিক করতে চাইলাম। কিন্তু নিজেকে কিছুতেই আর স্বাভাবিক করতে পারছিলাম না।কান্না কিছুতেই থামছিলোই না। বারবার শুধু মনে হচ্ছিলো, শিমুল কী করে এমন আচরণ করতে পারলো আমার সাথে!যার জন্য বাবা মাকে ভুলে গিয়ে তাকে জীবন সাথী হিসেবে গ্রহণ করলাম আমি আর সে কি না আমায় শুকনো পাতার মতো দুমড়ে মুচড়ে ফুঁ দিয়ে বাতাসে উড়িয়ে দিলো!
আবার মাথাটা ধরে আসছে। চোখে সবকিছু কেমন ঝাঁপসা দেখাচ্ছে।মনে হচ্ছে এক্ষুনি আমি মাথা ঘুরে পড়ে যাবো ফ্লোরের উপর।
আবার বমির উদ্রেক।পেট গুলিয়ে আসছে কেমন! দ্রুত পায়ে কাতরাতে কাতরাতে গেলাম আমি বেসিনের কাছে। তারপর হড়হড় করে বমি করতে শুরু করলাম।
আমায় বমি করতে দেখে পড়ার টেবিল ছেড়ে দৌড়ে এলো মিতু।সে এসে আমায় এক হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অন্য হাতে নাভীটা চেপে ধরলো। তারপর স্বান্তনা দেবার গলায় বললো,’এক্ষুনি কমে যাবে।মনে মনে আল্লাহকে ডাক।’
কিন্তু আমার বমি কিছুতেই কমছিলো না। বমির সাথে সাথে কান্নাও পাচ্ছে খুব!
মিতু বললো,’বোকা মেয়ে। কাঁদছিস কেন এভাবে? পেটে গ্যাস করেছে বলে এমন হয়েছে।এর জন্য কী কাঁদতে হয় রে!’
মিতু খুব সরল সহজ আর ধর্মভীরু মেয়ে। জটিল পৃথিবী সম্পর্কে তার কোন ধারণা নাই। ধারণা নাই বলেই সে খুব সহজ ভাবে বলে ফেললো আমার পেটে গ্যাস করেছে।অথচ দীর্ঘ দুটি বছর যে হয়ে গেল আমার বিয়ের আর পেটের সন্তানের বয়স হয়ে গেল চারমাস তবুও সে কিছুই বুঝতে কিংবা জানতে পারলো না এসবের।মিতু তার বাবা মার কথা খুব ভাবে।বাবা মা বলে দিয়েছে বোরখা ছাড়া বাসা থেকে কখনো বের হবে না কিন্তু!
মিতুকে কোনদিন আমি দেখিনি বোরখা ছাড়া বের হতে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ তার কাজা হয়না কখনো। এমন কী নামাজের প্রতিটা ওয়াক্তে সে আমায় ডাকে নামাজের জন্য।আমি অনেক সময় তার কথা শুনে নামাজ পড়ি। অনেক সময় শয়তানের ধাঁধায় পড়ে আদায় করি না।
এই সহজ সরল এবং পবিত্র মনের মিতু যখন শুনবে তার সাথে এক বিছানায় থাকা মেয়েটা গোপনে তার বাবা মাকে ধোঁকা দিয়ে দু দু বছর আগে বিয়ে করেছে আর তার গর্ভে সন্তানও এসে গেছে এখন তখন কেমন হবে!

বমি কিছুতেই কমছে না।মিতু দৌড়ে গিয়ে রান্নাঘর থেকে লেবু কেটে নিয়ে এলো।সেই কাটা লেবুর টুকরো আমার নাকের কাছে নিয়ে ধরলো।আমি আমার শরীরের জিইয়ে থাকা সবটুকু শক্তি দিয়ে সেই কাটা লেবুর টুকরো থেকে ঘ্রাণ টেনে নিতে লাগলাম।আর মিতু আমায় শক্ত করে ধরে রেখে গুণগুণ করে কোন একটা দোয়া পড়তে লাগলো।

বমি কমলো অনেকক্ষণ পর।বমি কমার পর হাত মুখ ভালো করে ধুয়ে গিয়ে শুয়ে পড়লাম বিছানায়।মিতু তখন আমার কাছে এক গ্লাস জল আর গ্যাসের একটা ট্যাবলেট নিয়ে গেল।সে আমার কাছে গিয়ে তখন বললো,’এটা খেয়ে নে।
আমি অবাক হয়ে বললাম,’এটা খেলে কী হবে?’
‘অষুধ না খেলে কী গ্যাস কমবে তোর?পরে তো আবার বমি হবে।’
এই কষ্টের মাঝেও আমি শব্দ করে হেসে ফেললাম। ভাবলাম, এমন সহজ সরল কেন হতে পারলাম না আমি।
মিতু আমায় হাসতে দেখে বললো,’আবার হাসছিস! সারাদিন বাইরে বাইরে থাকিস।একটা মেয়ে হয়ে বাইরে অত কী তোর? বাসায় পড়াশোনা নাই? পরীক্ষা তো দরজায় কড়া নাড়ছে!আর বাবা মার কথাও একটু ভাবিস।মাস শেষে যে কষ্ট করে টাকা পয়সা দিচ্ছেন এইগুলো হালাল ভাবে ওয়েস্ট কর!’
মাথাটা এখনও চিনচিন করে ব্যাথা করছে।তাই আমি মিতুকে বললাম,’মিতু, টেবিলের উপর পানি আর ট্যাবলেট রেখে তুই চলে যা।আমি একটু পরে খেয়ে নিবো।’
মিতু তখন আমার কাছে এসে আমার হাত ধরে জোর করে টেনে তুললো আমায়। তারপর জোর করে খাইয়ে দিলো ট্যাবলেট।ট্যাবলেট খাইয়ে দিয়ে মিতু চলে গেল তার টেবিলের কাছে।মধ্যরাত পর্যন্ত সে পড়বে। তারপর তাহাজ্জুদ পড়ে শুয়ে পড়বে। আবার জেগে উঠবে ফজরের আযানের সময়।উঠে ফজরের নামাজ পড়বে। তারপর চা করবে।চা করে আমায় ডেকে চা দিবে,নিজেও খাবে। তারপর চুলোয় ভাত-শালুন ছড়াবে।ভাত-শালুন হলে গোসল করে সকালের খাবার খাবে। তারপর ক্লাস।এটা তার নিত্যদিনের রুটিন।কত সুন্দর জীবন তার!
কিন্তু আমার!
আবার চোখ ভরে উঠলো জলে। অশান্ত এবং বেহায়া জল। সেই জল টলটল করে গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে নিচের দিকে।
টেবিলের ড্রয়ার খুলে ফোনটা বের করলাম আমি। অনেকক্ষণ ধরে সাইলেন্ট করে রাখা ছিল ফোনটা এখানে। ভেবেছিলাম শিমুলের অনেক গুলো মিসড হওয়া কল বোধহয় ডিসপ্লেতে ভেসে থাকবে। কিন্তু না আমি হতাশ হলাম। শিমুল একটা কলও দেয়নি। কিন্তু একজন আমায় ঠিকই কল দিয়েছে। অনেক অনেকগুলো কল।তিন তিনটে ম্যাসেজ।কল দিয়েছেন আব্বা। তিনি আমায় কলে না পেয়ে ম্যাসেজ করেছেন,কিরে রিসিভড করস না কেন মা?
তারপর আবার লিখেছেন,তুই কী বিজি এনা?
তারপর আবার লিখেছেন, আচ্ছা যখন ফ্রি হবি তখন একটা মিসড কল দিস আমায় মা।তোর মা তোকে নিয়ে খুব টেনশন করছে!
আব্বার পাঠানো ম্যাসেজগুলো দেখে আমার চোখে ভুরভুর করে উঠলো আবার জলে। এবার আমি শব্দ করে কেঁদে উঠলাম।মিতু আবার দৌড়ে এলো আমার কাছে।কাছে এসে বললো,’কী হলো রে এনা? আবার কী হলো?’
আমি মিতুর চোখের সামনে আব্বার পাঠানো ম্যাসেজগুলো তুলে ধরলাম।মিতু দেখে মৃদু হেসে বললো,’ফোন দে এক্ষুনি।আর বাবা মায়েরা এমনি।বাবা মা আল্লাহর কাছ থেকে পাওয়া সন্তানের জন্য শ্রেষ্ঠ উপহার। কুরআনে আছে, বাবা মার সাথে তোমরা এমন আচরণ করো যেন তারা দুঃখ পেয়ে উহ্ শব্দটি পর্যন্ত না করতে পারে!

#চলবে ?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here