“ঝরা পাতার দিনগুলি পর্ব- ০৩&০৪

গল্প : ঝরা পাতার দিনগুলি
হাবিব
পর্ব- ০৩&০৪
।।
চোখ খুলতেই দেখি বিছানায় আমি। পাশে কেউ নেই। ধাতস্থ হয়ে গত রাতের কথা মনে করার চেষ্টা করলাম। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দুই প্যাকেট সিগারেট শেষ করে রুমে আসি। তারপর ফ্লোরে শুয়ে শুয়ে আরও ৪টা। তারপর আর মনে নাই। তার মানে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। আচ্ছা আমি বিছানার উপরে আসলাম কিভাবে!! ধুরো।
সকাল ১১.৩০ বাজে!!!
এতো টেনশনেও আমার ঘুম ঠিক আছে!! বাহ আমিতো লিজেন্ড।
খুশি মনে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে যেতেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো। প্রিমা বসে সাব্বিরের সাথে গল্প করছে।
লাস্ট পনেরো মিনিট ধরে ছাদের উপরে আমাকে জড়িয়ে ধরে প্রিমা কান্নাকাটি আর বিলাপ করছে।” তুই কেমনে কবুল বলতে পারলি রে মেহের!! তুই তো পাথর হয়ে গেছিস! এতো সুন্দর একটা রিলেশনশিপ!! কিভাবে কি হয়ে গেলো রে মেহের!!! তুই কেমনে সহ্য করে আছিস রে মেহেরের বাচ্চা। তোর বাবা থাকলে আজকে এইরকম কিছুই হতোনা।”
আমি ওকে বসে বসে সান্ত্বনা দিচ্ছি। অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টো!!
প্রিমার কান্না থামার পর চুপচাপ দুজন বসে আছি।
-তুই পালিয়ে গেলি না কেন? কিংবা আমার বাসাতেই চলে আসতি?
-যার ভরসায় গিয়েছিলাম সেইতো রাখতে চায়নি। তোর বাসায় গেলে ঠিক ধরে নিয়ে আসতো আমাকে।
-পালিয়ে গিয়েছিলি? তাহলে আবার আসলি কেন?
-বিয়ের আগের দিন রাত ২টা অব্দি ফুপিদের বাসায় মিটিং চলে। সকালে ভাবি ঘুম থেকে ডেকে তুলে হাতে মেহেদী দেয়ার জন্যে। তখনই জানতে পারি যে আজকে আমার বিয়ে।
-তারপর?
-বড় আপুকে ম্যানেজ করে ২ ঘন্টার জন্য বাসা থেকে বের হই। সিএনজি করে ডিরেক্ট ফয়সালের বাসায় যাই। ব্রেকাপ হবার কারণে ২দিন ধরে ফয়সালের সাথে কোনো যোগাযোগ ছিল না।
-কি বলিস? ব্রেকাপ হয়ে গিয়েছিল?
-আরে এই ঘোড়ার ডিমের ব্রেকাপ ৫ বছরে কম করে হলেও একহাজার বার হইছে। বড়জোর ৩দিন। এরপরেই ঠিক হয়ে যেত।
-ওদের বাসায় তোদের ব্যপারে না জানতো সবাই?
-হুম জানতো।
-তো তুই চলে এলি কেন?
– ফয়সাল বাসায় ছিলো না। ওর আব্বু আম্মু ওর ব্যপারে কিছুই বলে নি আমাকে । আরো অনেক কথাই বলছে। ভালো লাগছেনা এগুলো বলতে। বাদ দে।
“আর কি বলছে মেহের? বল আমাকে?”শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো ও
-বাবা মা মরা মেয়েকে নাকি তারা তাদের ছেলের বউ করবে না। আমাকে আমার ভাইবোন ঠিকভাবে মানুষ করতে পারেনি। তার ছেলে ভার্সিটির টিচার হবে তাই আমি তাকে প্রেমে ফাসিয়েছি।
জানিস প্রিমা, জীবনে প্রথম কারো পায়ে ধরেছি আমি। অনেক কান্নাকাটি করেছি আমি সবার পায়ে ধরে। এর জন্যে মনে হয় আর কাঁদতে পারছি না, চোখ ভর্তি পানি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম আমি।
আমাকে জড়িয়ে ধরে আবার কান্না শুরু করলো। কিন্তু আমি আর পারছি কই।
-তুই কান্না বন্ধ কর নারে বোন,প্লিজ!!! কান্নাকাটি করে যদি কিছু হতো তাহলে সব থেকে বেশি কাঁদতাম আমি। সবার আগে আম্মু আর আব্বুকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতাম। বাপ মা ছাড়া ভালোবাসার মানুষের কাছেও দাম নাই। তারপর চোখের পানির সাগর বানাইতাম। সেই সাগর পাড়ে আমি আর তুই বিকিনি পরে সাগরবিলাস করতাম। মাঝে মধ্যে না হয় শিশিরের মতো সুন্দর পোলা দেখে শিস দিতাম। নাহ তোরে সালয়ার কামিজ পরাতাম। তুই তো আমার চেয়েও মোডা। তোরে বিকিনি পরা দেখলে কোন পোলা আর আসবেই না।
কান্নার মাঝেও প্রিমা ফিক করে হাসি দিয়ে ফেললো।
-শোন শিশিরকে আগেই জিজ্ঞেস করে নিস যে তোর বাপ মা মারা গেলে তোরে ছেড়ে দিবে কি না।
প্রিমা ছলছল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো
-তুই ফয়সাল ভাইকে জিজ্ঞেস করবি না কেন এমন করলো?
– না।
-তাহলে আমি কথা বলবো?
– না।
– “কেনো?” ও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে
– একটু চুপ থেকে বললাম,অনেক বেশি ভালোবাসি ওকে। যদি উত্তরটা এমন কিছু হয় যেটা শুনে আমি ওকে ঘৃণা করবো সেদিন হয়তো বেচে থাকার ইচ্ছেটাই আমার মরে যাবে। আমার ভালো কিছুর জন্যে আমাকে ছেড়ে গিয়েছে এই প্রত্যাশাটা নিয়েই বাঁচতে চাই আমি।
-তাহলে তুই সাব্বির ভাইয়ার সাথে সংসার করবি?
– কি করবো জানি না। তবে সবাইকে ভালো রাখার চেষ্টা করবো।
-আর তুই?
– জানিসতো প্রিমা, আমি বাসা থেকে বের হবার সময় মেজো ভাইয়া দেখেছিল, কিন্তু কিছুই জিজ্ঞেস করেনি আমাকে। খারাপ কিছু করবো না সেই ভরসায় হয়তো যেতে দিয়েছিল।আমার ইচ্ছে ছিলো ফয়সালকে সাথে করে নিয়ে এসে সব খুলে বলবো। এইটুকু বিশ্বাস ছিলো সব শোনার পর আর যাই হোক এখন অন্তত বিয়ে দিবে না।
ভরসা রাখার জায়গাটা হারিয়ে যাবার কস্ট ওরা কেনো পাবে বলতো!! দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম আমি।
-সাব্বির ফয়সাল ভাইয়ার সম্পর্কে জানে?
– হুম। কিন্তু কতটুকু জানে তা জানি না।
– কি বললো তোকে?
আমি বিরক্ত চোখে ওর দিকে তাকালাম।
-আচ্ছা সরি সরি। আর কিছু জিজ্ঞেস করবো না। জাস্ট এইটার উত্তর টা দে, সাব্বির ভাইয়ার সাথে সব ঠিক আছে তো?
আমি অন্যদিকে তাকিয়ে হুম বললাম।
এইপ্রথম প্রিমাকে কোন মিথ্যে বললাম। একবার মনে হলো এই হুম টা সত্যি হলে হয়তো খারাপ হতোনা।
বেচারি সবটা শোনার পর কি করে বসবে ঠিক নেই। হয়তো ফয়সালের হাতে পায়ে ধরে আমাদের বাসায় নিয়ে আসবে। কিন্তু ওর কাছে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছেটা আমার মরে গিয়েছে।
“দুজনতো একসাথেই যেতে পারো। ক্যাম্পাস তো খুব বেশি দূরে না তোমাদের। ট্রেনের টিকিট কেটে দিচ্ছি চলে যাও একসাথে”। মেজো ভাইয়ার কথা শুনে আর কিছু বলতে পারি নি।
৫ বছরে ফয়সালকে ছাড়া কখনো চট্টগ্রাম আসা যাওয়া
করিনি। মনে পরতেই কেমন জানি বুকটা ভারি হয়ে গেলো। কস্টের ওজনটা মনে হয় অনেক বেশি। না হলে কি আর এতো ভার ভার লাগে! !
-আমি আর ঐ বাসায় যাবো না এখন। এখান থেকেই চিটাগং চলে যাবো। ওকে বলো যাওয়ার সময় আমাকে নিয়ে যেতে।
“হায় হায় মেয়ে বলে কি? বিয়ে করেছ শশুড় বাড়ি যাবে না? সারাজীবন কি ভাইয়ের বাড়ি থাকবে নাকি?” মেজো ভাবি খুব মিস্টি হাসি দিয়ে কথা গুলো বললো আমাকে।
-তাহলে কি আর করবো বলো ভাবি, আমাদের গ্রামের বাড়ি চলে যাবো। ঐটা তো আমার নিজের বাড়ি।
“আহ থাকতে চাইছে যখন থাক না। এতো কথা বলার কি আছে। ঠিক আছে তুই এইখানেই থাক। আমি ফুপুকে বলে দিচ্ছি।” বলে মেজো ভাইয়া ফুপুকে ফোন করার জন্য উঠে গেলো। আর মেজো ভাবি মুখ গোমড়া করে উঠে চলে গেলো।
কি অদ্ভুত ব্যাপার!! বিয়ের ২দিনের মাথায় নিজের বাসায় পর হয়ে গেলাম!!!
নিজের মাথার উপর পারমানেন্ট ছাদের ব্যবস্থা করার প্রয়োজন খুব ভালো ভাবেই বুজতে পারলাম।
চলবে……….♥
গল্প : ঝরা পাতার দিনগুলো
হাবিব
পর্ব :০৪
।।
ট্রেন কমলাপুর রেলস্টেশন ছাড়ার আগেই আমি ঘুম। ঘুম ভাঙার পরে জানালা দিয়ে দেখি ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে কোথায় জানি। ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা ৬.২০ বাজে। এতক্ষণ শান্তিতে ঘুমিয়েছি!!কি ব্যাপার!! আজকে ফয়সাল বিরক্ত করছে না কেন। ওর জন্যে কখনোও শান্তিতে ঘুমাতে পারতাম না, না বাসে, না ট্রেনে। পাশের সিটে তাকাতেই বুকটা ধক করে উঠলো। ফয়সালের সাথে আমার আর পাশাপাশি সিটে বসে যাওয়া হবে না বুঝতে পেরে চোখ আবার বন্ধ করলাম। ঠিক করলাম এবার ঘুম না আসলেও আর চোখ খুলবো না। ধরে নেব আমার পাশের সিটে ফয়সাল বসে আছে।
সারা রাস্তা একটা কথাও কেউ কারো সাথে বলিনি। রাত ৯.৩০টায় চিটাগং স্টেশনে এসে পৌছালাম। ট্রেন থামতেই সাব্বির নিজের ব্যাকপ্যাক টা কাধে নিয়ে নেমে গেলো!! খুব কস্টে লাগেজ টা উপরের তাক থেকে নামিয়ে ট্রেন থেকে নেমে দেখি সে আশে পাশেও নেই। দূরে হনহন করে হেটে চলে যাচ্ছে!!! আস্তেধীরে হেটে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম।
টিকেট চাইতেই বললাম যে টিকেট নেই।
“স্যার এই মেয়ে টিকেট কাটে নাই”, টিকেট দেখতে চাওয়া স্টাফ একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা অফিসার কে বললো।
-দেখে তো ভদ্রঘরের মেয়েই মনে হয়। তো টিকেট কাটো নাই কেনো? অফিসার এগিয়ে এসে জিগ্যেস করলো।
-বাবা মা থাকতে ভদ্রমেয়ে ছিলাম স্যার। এখন তো নাই।তাই অভদ্র হয়ে গিয়েছি।সরি স্যার।
১০০০ টাকা জরিমানা দিতে দিতে দেখলাম সাব্বির এগিয়ে আসছে এইদিকে।
-এক্সকিউজমি স্যার, আসলে ইনি আমার সাথেরই। আমরা হাসবেন্ড ওয়াইফ। একসাথেই এসেছি। এইযে আমাদের টিকেট।
অফিসার ভ্রু কুঁচকে আমাকে জিজ্ঞেস করলো এই ছেলে তোমার সাথের?
-না উনি আমার সাথের না। এই নিন টাকা। এটা বলে ১০০০ টাকা দিয়ে খুব দ্রুত হেটে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম।
রাগে দুঃখে চোখে পানি চলে আসছে বারবার।
পিছন থেকে খপ করে কেউ আমার হাত ধরলো অনেক জোড়ে। না তাকিয়েও আমি বুঝতে পারলাম সেটা কে হতে পারে।
হাত ধরে টানতে টানতে স্টেশনের বাইরে নিয়ে এসে একবার আমার দিকে রক্তগরম চোখে তাকিয়ে হাত ছেড়ে দিলো।
মেইনরোডে এসে সাব্বির সিএনজি ঠিক করতে করতে আমি সুন্দর মতো লোকাল বাসে উঠে পরলাম। রাত তখন ১০টা। বাসে আমি একা একটা মেয়ে আর প্রায় ১৫ জনের মতো পুরুষ যাত্রী। ভয় হওয়ার বদলে রাগে চোখে বার বার পানি চলে আসতেছে।
ভার্সিটির মেইন গেটের সামনে নেমে গেলাম। রাস্তা পার হয়ে মেইনগেট দিয়ে যেই ঢুকতে যাবো পিছন থেকে কেউ একজন হাত টান দিয়ে ধরে কিছু বুঝে ওঠার আগেই গালে খুব জোড়ে থাপ্পড় খেলাম!! বোকার মতো গালে হাত দিয়ে ধরে সাব্বির ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
-থাপ্পড় দিলে একসাথে দুই গালে দিতে হয়।এক গালে খেলে জামাই মরে যায়।
বলার সাথে সাথেই ঠাস!!
শান্ত গলায় বললাম আরো দেয়ার বাকি আছে? দিলে তারাতাড়ি দাও,গেটের দাড়োয়ান দেখছে।
-তোর প্রেম কাহিনি তো এই ভার্সিটির ইটের কনাও জানে। আজকে না হয় থাপ্পড় খায়ছিস সেটাও জানলো।
-এতোই যখন জ্বলে তাহলে বিয়ে করেছ কেন?
-দয়া করছি তোকে দয়া!! গিয়েছিলি না তোর নাগরের কাছে? এই দয়াটুকুও তো করে নাই।
-অনেক দয়া দেখাইছ। থাক আর দেখাইতে হবে না। মুক্তি দিয়ে দিব।
-আরে তুই কি আমাকে মুক্তি দিবি। সবার সামনে তোকে আমি ডিভোর্স দিবো।
– আচ্ছা দিও। বলেই হলের দিকে হাটা ধরলাম।
আমার প্রতি এতো রাগের কারণ বুঝতে পারলাম না।
আর আমি যে ফয়সালের বাসায় গিয়েছিলাম সেটা ও কিভাবে জানতে পারলো !!!
ভাগ্যিস কেউ নাই আশেপাশে। থাকলে এতোক্ষনে পুরো ভার্সিটি জানাজানি হয়ে যেতো। ফয়সালের গার্লফ্রেন্ড বলে কথা!!
আচ্ছা ফয়সাল এখন কই আছে? ওদের বাসায় গিয়ে তো মনে হয়নি যে ও আদৌ ঢাকায় আছে। তাহলে কি ভার্সিটিতে?
আল্লাহ!! এতো ছোট্ট একটা ক্যাম্পাস!! আমি ওর সামনে না গিয়ে থাকবো কিভাবে। তার উপর আবার একই ডিপার্টমেন্ট। দুনিয়ার সব চিন্তা মাথায় আসছে। উফ্।
আল্লাহ আল্লাহ করছি যেনো এই মুহুর্তে কারো সাথে দেখা না হয় আমার। আর টেনশন নিতে ভালো লাগছে না। আচ্ছা সবাই যখন জানবে যে আমার বিয়ে হয়ে গেছে অন্য কারো সাথে তখন সবাই তো আমাকে খারাপ ভাববে। ফয়সাল টিচার হতে পারবে না দেখে আমি অন্য কাউকে বিয়ে করে নিয়েছি!!
আর ভাবতে পারছি না। এইসব কিছুর চিন্তায় একটু আগে যে ২গালে ২ চড় খাইছি সেটা ভুলেই গিয়েছি।
উফফ যেতেও হবে ছেলেদের হলের সামনে দিয়ে। ভার্সিটি এমন ভাবে বানাইছে কেন। ভিসি কে অকথ্য গালাগাল দিতে দিতে সামনে এগিয়ে গেলাম।
এমন চোরের মতো মনে হয় ভার্সিটিতে কোনদিন ঢুকবো চিন্তাও করিনি।
কত সপ্ন ছিল দুজনের!! ও টিচার হলে এই রাস্তা দিয়ে বিয়ের পর রাতের বেলা হাটতে বের হবো। আর আজ।
হলের কাছে এসে দৌড়ে হলে ঢুকলাম। নিচের গার্ডে থাকা আপা আমাকে দেখেই চওড়া একটা হাসি দিয়ে বললেন, “আফার শরীর ভালো নি? মিস্টি খাওয়াইতেন না আফা?”
উনার কথা শুনে মনে হলো কেয়ামত হয়না কেনো এখনো? সব তাহলে জানাজানি হয়েই গেলো!!
খাওয়াবো বলেই প্রায় দৌড়ে সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতে লাগলাম।
রুমে ঢুকতেই ভার্সিটির একমাত্র বেস্ট ফ্রেন্ড জেনি হাসি দিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো আমাকে।
-তো মেহের ট্রিট কবে পাচ্ছি। আমি তো স্পেশাল ২টা ট্রিট পাবো। একটা তুই দিবি আর একটা ভাইয়া দিবে।
– আমি থতমত খেয়ে বললাম কিসের ট্রিট?
-ঢং ধরে লাভ নাই মেহের। ট্রিট হবে ট্রিট।
-আচ্ছা ঠিক আছে।
-আরে এতো ভয় পাচ্ছিস কেনো? বাসার সবার কি অবস্থা? আংকেলের কথা তো শুনলাম। দেখ মন খারাপ করিস না। খারাপ কিছুর সাথে তো ভালো কিছুও পেলি।
জেনি কোনটাকে ভালো বলছে মাথায় ঢুকছে না কিছুই।
-যা ফ্রেশ হয়ে আয়। তুই আজকে আসবি বলবি না আগে? তাহলে তো রাতের খাবার এনে রাখতাম। ভাইয়ের সাথে তো সন্ধ্যায় দেখা হলো। ভাইয়াও দেখি কিছু বললো না।
-খাবো না কিছু। ভালো লাগছে না।
– সেটা পরে দেখা যাবে। মন খারাপ করিস না আংকেলের জন্য। যা গোসল করে আয়, ভালো লাগবে।
হুম বলে গোসল করতে চলে গেলাম। ও কি বলছে আগা মাথা কিছুই ধরতে পারছি না। কার সাথে দেখা হওয়ার কথা বলছে জেনি।
শাওয়ার ছেড়ে প্রায় ৩০ মিনিট ধরে ভিজছি। ইশ এই পানি পরার সাথে যদি মাথার টেনশন গুলোও চলে যেতো!!
রুমে এসে দেখি হলের সব ফ্রেন্ডরা এসে বসে আছে। সবাই হাসি মুখে আমাকে কনগ্রাচুলেশনস জানাচ্ছে। কিছুই আমার মাথায় ঢুকছে না।
একটা ফ্রেন্ড হঠাৎ বলে উঠলো, মেহের আর কিছুদিন পর মাসটা মাস্টার্স এ ভর্তি হতি, তাহলে তো একেবারে ভাইয়ার আন্ডারে করতে পারতি, তুই খাবার বানিয়ে নিয়ে যেতি। আহ কি প্রেম!! সবগুলো একসাথে হেসে উঠলো।
আমি কিছুই বুঝতে না পেরে জিগ্যেস করলাম, কার আন্ডারে?
জেনি মুখ ভেংচিয়ে বললো, ন্যাকা সাজতেছে আরেকজন। আমাদের মুখ থেকে শুনতে চাচ্ছে আর কি যে ফয়সাল ভাইয়া টিচার হয়ে গেছে আর কি।
আমি অস্ফুটস্বরে বলে উঠলাম ফয়সাল টিচার হয়ে গিয়েছে!!!!
খুশি হবো নাকি ওকে এতো কাছে এসেও না পাওয়ার জন্য কান্না করবো, কি এক্সপ্রেশন দিব!!
ফয়সাল ছিলো ওদের ব্যাচের ফার্স্ট বয়। টিচার হবে সেই ব্যাপারে মোটামুটি সবাই শিউর ছিলো। এমনকি ম্যাক্সিমাম টিচার রাও ওকে অনেক পছন্দ করতো। ও যে ওর ব্যাচের ফার্স্ট সেটা আমি জানতে পেরেছি রিলেশনের ৭ মাস পরে। ওর বাসার ফিনানশিয়াল কন্ডিশন ভালো ছিলো না। আমি টিউশন করাতাম শুধুমাত্র ওকে হেল্প করার জন্য। বাসায় তো বলি নাই যে আমি টিউশন করাই। টানা ২ বছর টিউশন করে একটা টাকাও নিজের জন্যে খরচ করিনি। পুরো টাকা টাই ওর হাতে তুলে দিয়েছি। আর বলতাম সব সুদে আসলে নিয়ে নিবো সময় হলে।
কিন্তু কপালে না থাকলে যা হয় আরকি। একজন টিচার চাইতো না ও টিচার হোক। কারণ তার পছন্দের একটা মেয়ে ক্যানডিডেট ছিলো ওদের ব্যাচেরই। ইচ্ছে করে ওকে একটা ঝামেলায় ফাসিয়ে দেয়। খুব ছোট একটা ব্যাপার নিয়ে ওকে অনেক হ্যারেসমেন্ট করে যেটা ও করেইনি। ওকে পানিশমেন্ট দেওয়া হয় যে ও এই ভার্সিটির টিচার হতে পারবে না।
মেজোভাইয়া কে ফোনে একসাথে অনেকগুলো কথা বলে থামলাম কিছুক্ষনের জন্য। ভাইয়া কিছু না বললেও আমি জানি আমার বলার জন্যে অপেক্ষা করছে।
তারপর ফয়সাল অনেক ডিপ্রেশনে পড়ে গিয়েছিল। ও ডিসিশন নিয়েছিলো যে এইখানে মাস্টার্স করবে না। ওকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে এইখানে মাস্টার্স করতে রাজি করালাম। বললাম যে আল্লাহ একটা না একটা ব্যবস্থা করবে। সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিলো।
এরপরের কাহিনী তুমি জানো। আব্বু মারা গেলো, আমি বাসায় গেলাম এইতো।
-তাহলে সাব্বির কি চাইছে সেটাই তো চিন্তার বিষয়
-হুম।
– দেখা হয়েছে ফয়সালের সাথে?
-না আসলামই তো ২দিন হলো। আমি বের হই নাই রুম থেকে এখনো।
-সাব্বিরের সাথে সব ঠিকঠাক?
-হুম।
-মন খারাপ করিস না। কপালে যা আছে তাই হবে।
সাব্বির ঐ দিন এমনভাবে জোড় করলো, সাথে ফুপা ফুপুও। আমি চাইছিলাম আর কিছুদিন পরে হোক।
কিন্তু উনাদের জোড় জবরদস্তিতে পরেরদিনই দিতে হলো।
-হুম
-দেখ আমাকে ভুল বুঝিস নারে পাগলি। তুই ও তো জিবনে কিছু বলিস নাই। কিভাবে বুজবো বল।
আমি চুপচাপ। কি বলবো আমি!!
– সাবধানে থাকিস। আর কোন সমস্যা হলে সাব্বিরতো আছেই
– হুম। আছেইতো। একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে বললাম।
-তোর তো ঐখানে মাস্টার্স সমস্যা হবে। কি প্ল্যান তোর?
– স্কলারশিপ নিয়ে বাইরে যাওয়ার খুবভালো ভাবে ট্রাই করবো।
– হুম ভালো প্ল্যান। ঠিক আছে। ধৈর্য্য ধর, ইনশাআল্লাহ ভালো কিছু হবে। তুই তো চেষ্টার ত্রুটি করিসনি।
-হুম
-আচ্ছা ভালো থাক। পরে কথা হবে।
ফোন কেটে দিয়ে ভাবছি সবাইকে কিভাবে বলবো কথাগুলো।
জেনি হা হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কাউকে যে কিছুই বলিনি এখনো।
-তুই, তুই….. আমার পাশে বসে ফুপিয়ে কেদে উঠলো জেনি।
অনেকক্ষন জড়িয়ে ধরে রাখলাম জেনিকে। এই একটামাত্র মানুষ যে কিনা আমার আর ফয়সালের রিলেশনশিপ এর শুরু থেকে লাস্ট পর্যন্ত ছিলো।
এক সপ্তাহ হয়ে গেছে আমি হলে এসেছি। এই কয়দিনে না ফয়সাল না সাব্বির একজনও একটা ফোন দেয়নি আমাকে!! ফয়সালের ব্যাপার না হয় আলাদা। কিন্তু সাব্বির!! ওর ব্যাপারে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
-আর কয়দিন এইভাবে থাকবি রে মেহের!! নিজেকে কেন কস্ট দিচ্ছিস? ফয়সাল ভাইয়ার সাথে কথা বল। দেখ কি বলে উনি। আর সাব্বির ভাইয়ারও তো কোন খবর নেই। তুই তোর বাসায় মিথ্যা কেন বলছিস যে তোদের সব ঠিক আছে?
-এই কথা এখন বাসায় বললে আমার ছোট ফুপি আর মেজো ভাবি সবাইকে নাকানিচুবানি খাওয়াবে। এমনিতেই আমাদের বোনদেরকে উনি দেখতে পারে না।
তার উপর যদি শুনে যে আমার রিলেশন ছিলো, ভাইয়াকে অনেক বেইজ্জতি করবে।
-তো এখন তুই কি করবি?
– সাব্বিরের সাথে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবো, আর কি করবো বল। আচ্ছা আমার যে বিয়ে হয়ে গেছে সবাই জেনে গিয়েছে, নারে জেনি?
আমার অসহায় মুখটা দেখে ও কোন উত্তর দিলো না। ফ্রেন্ডদের না হয় কিছু না কিছু বলতে পারবো কিন্তু স্যারদের সামনে কিভাবে যাবো আমি!!
আরো ২দিন পার হলো আমি রুম থেকে বের হই না। ডিপার্টমেন্টে কি হচ্ছে না হচ্ছে সব কিছু জেনির কাছে খবর পাই। এখনো কেউই জানে না আমদের কথা। রাতে জেনি হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো আচ্ছা তুই কি জানতিস না যে ভাইয়া টিচার হিসেবে জয়েন করবে?
-না। আমি কিভাবে জানবো। তোরা যতদুর জানিস আমিও ততোদুরই জানি।
-এটা তো অনেক লেনথি প্রসেস। এমন না যে একদিনে হয়ে গিয়েছে। তুই কিচ্ছু টের পাসনি?
-নাহ। টের পেলে কি আর সাব্বিরের সাথে বিয়ে হয়!!
-তাও ঠিক।
-ফয়সাল জুনিয়রদের ক্লাস নিচ্ছে নারে?
-হুম। সব জুনিয়রদের মুখেই তো উনার খালি প্রশংসা। অনেক ভালো নাকি পড়াচ্ছে।
-ও
জানিসতো জেনি, আমার শশুর শাশুড়ী অনেক ভালো। অনেক বেশি ভালো। আব্বু আম্মুর পরে আমাদের ভাইবোনদেরকে একমাত্র এই মানুষদুটোই মন থেকে স্নেহ করে। কিন্তু ছোট ফুপির কথার পিঠে কিছু বলতে পারে না। হাজার হোক নিজের ছোট বোন তো। আমার বাবা তার এই দুই আদরের ছোট বোনকে নিজের কাছে রেখে পড়াশোনা করিয়েছিলেন। ফুপিদের পছন্দমতো ভালো ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। সব থেকে বেশি আদর করতেন ছোট ফুপিকে। আর সেই ফুপুই সবথেকে বেশি কস্টটা দিয়েছিলেন।
আমি সেই কাহিনী পুনরায় ঘটাইতে চাইনি। ভাইবোনদের মধ্যে আমি সবার ছোট। আদরও পেয়েছি সবথেকে বেশি।
সেদিন বাসায় ফিরে না আসলে হয়তো আমাকে সবথেকে বেশি স্নেহ করা মেজোভাইয়া টাই কস্ট বেশি পেতো।
জেনি আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি। কিন্তু বাকি সবাই কি চুপ থাকবে?
আমরা মানুষ সমাজ নিজের থেকে বেশি নিজেদের মান সম্মান কে আগলে রাখতে পছন্দ করি। যারা এই নিয়মের বাইরে যায় তারাই মনে হয় সুখি হয়!!
সাব্বির একটা ফোনও দেয়নি। বেয়াদ্দব একটা। আমি জিবনেও একে মাফ করবো না। কঠিন শীতের রাতে ওকে আমি পুকুরে ৩ ঘন্টা দাড় করিয়ে রাখবো। ফাজিল একটা ছেলে। ওকে আবার আমার ভাত বেরেও খাওয়াতে হয়!! আবার টেবিলের নিচে দিয়ে পায়ে খোঁচাও মারে!! বান্দরামির একটা লিমিট থাকা উচিত। আচ্ছা আমি বসে বসে এর কথা ভাবছি কেন। মাথার ভিতর এবং বাইরে, দুই জায়গা থেকেই এই সাব্বির নামক পোকাটাকে বের করতে হবে।
এখনো মনে আছে সেই ১৩ বছর আগের কথা!!
যেদিন সকালে সাব্বির ভাইকে আমাদের বাড়ির পিছনে পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে বলে ছিলাম, ভাইয়া তোমাকে দেখলে বুকের ভিতরে কেমন কেমন জানি করে!!! বলেই হানড্রেড মিটার স্প্রিন্ট দিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছিলাম সারাদিনের জন্যে। কারন ভাইয়ার উত্তর টা ছিলো জুতা চিনস? জুতা? তোর বুকের ব্যাথা জুতার বারি দিয়ে নামামু।
দাড়া মামিরে বলতেছি, তুই মেহনাজ আপুকে দেয়া চিঠি লুকাই লুকাই পড়স!!
কি ভয়াবহ কথা!!
..
.
চলবে ………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here