ঝরে যাওয়া বেলীফুল পর্ব -১০

###__ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল__###
#পর্ব_১০
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

সকাল বেলা ইরফান কি যেনো মনে করে বেলীর রুমের দিকে যায় । তখন বেলী নিজের কিছু জামাকাপড় গুছিয়ে নিচ্ছিলো । মিনুও সেখানেই ছিল । তখনই ইরফান কিছু শুনতে পায় ।

– ভাবী , আপনেরা কি আইজকাই যাইবেন ?
– হু ,
– কবে আইবেন ?
– শনিবারে ,
– তাইলে আমিও কি শনিবারে আইতাম ?
– নাহ তুমি রবিবারেই এসো ।
– আইচ্ছা , ভাবী কি পইরা যাইবেন বাইত ?
– আমি তো বোরখা পরি ।
– এই ফুরান বোরখাডা নি ফরবেন ?
– নতুন পাবো কোথায় ?
– ভাইয়েরে কন ,
– নাহ থাক , যেটা আছে সেটাই পরে যাবো , টাকা অপচয় করে কি লাভ ?
– রুবি ভাবী দুইন্নার টাকা উড়ায় , আর আপনে একটা বোরখা কিনবেন তাতেও অপচয় কন । আপনে মানুষ নাকি রোবট
– তুমি কথা বেশি বলো মিনু । কারো অনুপস্থিতিতে তার সম্পর্কে সমালোচনা করা ঠিক না , কবে বুঝবে তুমি মিনু ?
– থাউক আমি আর কিছু কমু না ।

ইরফান এতক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে ওদের কথাগুলো শুনে । বেলী তেমন হাই ফাই চলাফেরা করে না । একদম নরমাল তার চলাফেরা । মেয়েটার যা প্রয়োজন তার চাইতেও কম প্রকাশ তার । সবটা চায় না সে । ইরফান আর কিছুই বলেনি । বেলীর রুমে যায় সে । বেলী তখন জামাকাপড় গুছিয়ে নিচ্ছিলো ।

– বেলী ,,,,,,?
– জ্বি ,
– তুই জামাকাপড় গুছিয়ে নে , আমি ১ টার মধ্যে চলে আসবো ।
– হুম আচ্ছা ।
– কিছু লাগবে তোর ?
– নাহ ,
– কিছুই লাগবে না তো ?
– নাহ , লাগবে না সব কিছুই আছে ।
– আচ্ছা ।

ইরফান বেলীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে , কত সহজেই নিজের চাওয়া পাওয়া গুলোকে বিসর্জন দিতে পায়ে সে । হালকা হাসি দিয়ে বেরিয়ে যায় ইরফান ।
অফিসে গিয়ে বসের সাথে কথা বলে দুই দিনের ছুটি নেয় ইরফান । আজকের দিন টা আর শনিবারের দিনটা । শুক্রবার তো এমনিতেই অফ ডে । ভেবেছিল আজকে হাফ টাইম করবে কিন্তু জরুরী কাজ থাকায় আজকেই ছুটি নিয়ে নেয় ইরফান । ছুটি নিয়ে সোজা বেরিয়ে যায় সে অফিস থেকে ।
এইদিকে বেলা সাড়ে ১২ টা । মিনুও রেডি , কিছুক্ষন পরই মিনু চলে যাবে । অনেকদিন হয়েছে সেও বাড়িতে যেতে পারেনি । তাই ইরফান এর কথা অনুযায়ী মিনুও দুইটা দিন নিজের বাড়িতে গিয়ে থেকে আসবে । ইরফান এলেই মিনু বেড়িয়ে যাবে । বেলীও গোসল করে ফ্রী হয়ে নেয় । চুলগুলো অনেক বড় তার , তাই চুলগুলো শুকানোর জন্য ছেড়ে রেখে দেয় বেলী ।
১ টা নাগাদ ইরফানও চলে আসে । ইরফান বাসায় আসলে মিনুও চলে যাবে বলে ইরফানের কাছে যায় ।

– ভাই ,,,,,,?
– মিনু আয় ভেতরে ।
– ভাই তাইলে আমি যাই ,
– এখনি যাবি ?
– হ , নাইলে বাস পামু না । আপনেরা কোন সময় যাইবেন ?
– আমরা ৪ টার বাসে যাবো , আচ্ছা এইটা রাখ । যাওয়ার সময় বাড়ির জন্যে কিছু নিয়ে যাস ।

মিনু দেখে ইরফান তাকে ১০০০ হাজার টাকার একটা নোট সাধে । ইরফানের সব কিছুই ভালো লাগে মিনুর কিন্তু যখন তার বেলী ভাবীকে মারে তখনই মিনু ইরফানের গুষ্টি এক করে । ইরফানের হাত থেকে টাকাটা নেয় মিনু । তখন ইরফান আবার বলে উঠে ,

– বেলী কি করে রে ,
– ভাবী তো রুমে , চুল শুকায় ।
– আচ্ছা তুই তাহলে বেরিয়ে যা ।
– আইচ্ছা ভাই তাইলে আসি ,
– আচ্ছা সাবধানে যা । রবিবারে চলে আসিস ।
– আইচ্ছা ।

মিনু ইরফানের রুম থেকে বেরিয়ে বেলীর রুমে যায় । সেখানে বেলীর সাথে কথা বলে বিদায় নিয়ে বিসমিল্লাহ বলে বেরিয়ে যায় মিনু । বেলী কিছুক্ষণ রুমেই ছিল , তারপর ২ টা বাজে ইরফানের রুমের দরজার সামনে যায় সে । পর্দা সরিয়ে ইরফানকে ডাকে সে ।

– শুনছেন,,,,,,?
– হ্যাঁ ,
– খেতে আসেন , ভাত বাড়ছি
– আসতেছি ,

ইরফান বেলীর ডাকে ডাইনিং টেবিলে যায় । সেখানে সব গুছিয়ে রাখা আছে । বেলী সব সময় টেবিলটা গুছিয়েই রাখে হয়তো । রান্নাঘরের দিকে উঁকি দেয় ইরফান । বেলী তখন রান্নাঘরে সব কিছু গুছিয়ে রাখছে । দুইদিন পর ফিরবে তারা , তাই সব কিছু গুছিয়ে রেখে যাচ্ছে সে । ইরফান বেলীর চুলের দিকে তাকিয়ে আছে । ভেজা চুলগুলো প্রায় অনেকটাই শুকিয়ে গেছে । হাটুর নিচ অবদি চুল বেলীর । মাশা-আল্লাহ চুলগুলো মনে হচ্ছিলো আল্লাহর নিজের হাতে বানানো ।ইরফান কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চেয়ারে বসে পড়ে । চেয়ারে বসেই বেলীকে ডাকে ইরফান ।

– জ্বি ,
– আমি কি কুকুর নাকি ?
– ছিহ ! কি সব বলেন ?
– বাসার কুকুরকে মানুষেরা এইভাবেই ভাত দেয় । ভাত পানি সামনে দিয়ে আরেক জায়গায় সরে থাকে ।

বেলী বুঝে যায় ইরফানের কোথায় সমস্যা হচ্ছে । বেলীর এই কাজটা করা হয়তো উচিত হয়নি । শত হোক কাউকে খাবার দিয়ে তার সামনে থেকে চলে যেতে হয় না
এটা অভদ্রতা করা হয় । ওই ব্যাক্তিকে অসম্মান করা হয় ।

– আসলে আমি রান্নাঘরের জিনিসপত্রগুলা গুছিয়ে রাখতেছিলাম ।
– খাওয়ার পরে কি গুছানো যেতো না ?
– আচ্ছা বসেন আপনি , আমি আছি এখানে ।
– তুই খাবি না ?
– পরে খাবো ,
– বাড়িতে গিয়ে খাবি , তাই না ?
– বাড়ি যেতে যেতে তো সন্ধ্যার পর হয়ে যাবে ।
– তাহলে কোন পরে খাবি ? নাকি আমার সামনে তোর খেতে মন চায় না ।

বেলী বুঝে যায় ইরফানের এখন প্রচুর রাগ উঠে গেছে । তাই সে চুপচাপ খেতে বসে যায় ।

– বেলী , আমি জানোয়ার না ঠিকাছে ? হ্যাঁ হয়তো আমার আচরণ জানোয়ার সুলভ কিন্তু আমিও মানুষ , জানোয়ার নই
– আপনি এইসব কি বলেন ? নেন ভাত খান ।

দুজনে এক সাথে খেয়ে নেয় । খাওয়ার সময় ইরফানের নজর বার বার বেলীর দিকে যাচ্ছিলো । বেলী বরাবরই শান্ত স্বভাবের । খাওয়ার সময়ও শান্ত হয়ে থাকে সে । খাওয়ার পর বেলী সব গুছিয়ে নিজ রুমে চলে যায় । প্রায় ৩ টার মত বেজে গেছে । আধা ঘন্টার মধ্যেই তারা বেরিয়ে পড়বে ৷ তাই কোন রকম রেডি হয়ে নিবে সে । কিন্তু এরই মাঝে বেলীর রুমের দরজায় টোকা পড়ে । বেলী দরজা খুলে দেখে ইরফান দাঁড়িয়ে আছে ।

– কিছু বলবেন ?
– হু , ভেতরে ঢুকতে দে আগে ।
– ওহ , আসেন ।

ইরফান রুমে এসে বেলীকে কিছু প্যাকেট দেয় । বেলীও অবাক ইরফানের হাতের প্যাকেট দেখে । বেশ অনেকগুলোই প্যাকেট দেখতে পাচ্ছিলো বেলী ইরফানের হাতে ।

– কিসের প্যাকেট এইগুলা ?
– খুলেই দেখ কিসের প্যাকেট এইগুলা ।

বেলী প্যাকেট গুলো খুলে বেশ খানিকটা অবাক হয় । দুটো নরমাল সুতি শাড়ি , দুটো হাফ সিল্ক শাড়ি , তার সাথে ম্যাচিং হিজাব , আর একটা দামী বোরখা , এক জোড়া দামী জুতা , তার সাথে আরেক জোড়া সিম্পল স্যান্ডেল , একটা লেডিস হ্যান্ড পার্স সহ সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আসছে ইরফান বেলীর জন্যে ।
বেলী জিনিসপত্র গুলো দেখছিল আর বারবার ইরফানের দিকে তাকাচ্ছে । এতকিছু এর আগে কখনো আনে নি ইরফান বেলীর জন্যে ।

– পছন্দ হইছে ?
-………..
– কিরে পছন্দ হইছে ?
– এত কিছু হঠাৎ করে ?
– এমনি আনতে মন চাইলো ।
– কত গুলো টাকা খরচ হলো । কি দরকার ছিল ।
– এগুলোর দাম খুবই সীমিত , টাকা নিয়ে ভাবিস না ।
-…………..
– রেডি হয়ে নে ।
– আচ্ছা ,
– কি পরবি ?
– বোরখা-ই পরি ,
– শাড়ি পরতে পারস না ?
– পারি , কিন্তু ভেজাল লাগে , বোরখা-ই পরি ।
– আচ্ছা পরে নে । তাড়াতাড়ি কর

তারপর ইরফান রুম থেকে বেরিয়ে যায় । বেলীও নতুন একটা সুতির জামা পরে নিয়ে উপরে বোরখা পরে নেয় । আর ইরফানের দেয়া একটা হিজাব পরে নেয় । বেলী অনেক সুন্দর করে হিজাব বাধতে পারে । হালকা লিপস্টিক আর একটু কাজল এটাই বেলীর সাজ । সে রং চং দিতে জানে না । এটাই তার কাছে বেশি কিছু । অন্যদিকে সব গুছিয়ে নেয়ার পর ইরফান তার জামাকাপড় নিয়ে আসে বেলীর রুমে ।

– বেলী ,,,,,,?
– জ্বি ,
– এই ট্রলিতে তোর আর আমার জামাকাপড় গুলো গুছা ।
– কেন ?
– কি কেন , আমরা কি আলাদা জামাকাপড় নিবো নাকি ।
– সব কিছুই তো আলাদা , তাহলে কাপড় এক হয়ে কি হবে ।

বেলীর কথায় ইরফান চুপ হয়ে যায় । তখন নিজেই বেলীর আর তার জামাকাপড় গুলো গুছিয়ে নেয় । বেলী তখন চুপ করে দাঁড়িয়ে ইরফানকে দেখছিল । ইরফানকে আজ দারুণ লাগছিল । কালো শার্ট আর ব্ল্যাক জিন্সে বেশ সুন্দর লাগছিল তাকে । নিজেকে বড্ড বেশি বেমানান লাগছিল ইরফানের সাথে । সত্যিই বড্ড বেশিই বেমানান লাগছিল । তার সাথে হয়তো রুবিকেই দারুণ মানায় । তাই তো সে থাকা সত্ত্বেও রুবিকে ঘরে আনা হয়েছে । নিয়তি বড্ড কঠিন জিনিস । যতই খারাপ হোক না কেন মানতে হয় ।

[ বিঃদ্রঃ একটা মেয়ে কতটা হেরে গেলে নিজেকে তুচ্ছ ভাবতে পারে । কতটা কষ্টে জর্জরিত হলে নিজেকে বেমানান ভাবতে পারে । আমরা নারীরা যতই এগিয়ে যাই না কেন , কোথাও না কোথাও আমাদের পিছিয়ে যেতে হয় । আর সেখানেই আমাদের ব্যর্থতা । কষ্ট পেতে পেতে আমরাও এক সময় ক্লান্ত হয়ে পরি । আর তারপর হাল ছাড়তে হয় এমন হাজারো বেলীকে ]

.
.

চলবে……………….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here