ঝিলের ওপারে পদ্মফুল পর্ব -২৪ ও শেষ

#ঝিলের_ওপারে_পদ্মফুল
তন্বী ইসলাম -২৪

{অন্তিম পর্ব}

“শ্রাবণ ভাই।

মুহূর্তেই থমকে গেলো শ্রাবণ। এ কার কন্ঠস্বর শুনতে পেলো সে? তার পদ্মফুল? কিন্তু পদ্মফুল তো ওপারে, ঝিলের ওপারে!!!

মাটিতে লেপ্টে বসে কাঁদছে শ্রাবণ। সে অবস্থাতেই মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকালো ডাকের উৎসটা দেখার জন্য। মুহুর্তেই হার্টবিট বেড়ে গেলো তার। সেখানে তাকিয়ে থেকেই ধীরে ধীরে মাটিতে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো শ্রাবণ। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে, পা দু’টোও কাঁপছে। এগুতে পারছে না। তবুও এগিয়ে যাচ্ছে সে। এক পা এক পা করে এগুচ্ছে, তার পদ্মফুলের কাছে। তার থেকে কয়েক হাত দুরেই ভীত মলিন মুখখানা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। শ্রাবণ দু’পা এগুতেই ভেতর থেকে কেউ একজন গিয়ে তাকে তাগাদা দিলো। শক্ত করে বলে উঠলো, ‘এটাই সুযোগ, যা তোর পদ্মফুলের কাছে। জড়িয়ে নে নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্টে। এমনভাবে বুকের কোঠরে লুকিয়ে রাখ, যাতে কেউ চাইলেও সেখান থেকে তোর পদ্মফুলকে ছিনিয়ে নিতে না পারে।
শ্রাবণ তাই করলো। শরীরের সমস্ত শক্তি খরচ করে পদ্ম’র দিকে ছুটে গেলো।

একদম মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণ পদ্ম। শ্রাবণের চোখমুখের হতাশার রঙ সরে গিয়ে সেখানে আলোর ঝলকানি ঝকমক করছে। চোখের পানি মুছে ফেললেও চোখদুটো তীব্র লাল হয়ে আছে। পদ্ম কাঁদছে, নিরবে নিশ্চুপে। আর একদন্ড দেরি করলো না শ্রাবণ। দুহাতে টেনে বুকের সাথে চেপে ধরলো পদ্মকে। শক্ত করে ধরে রাখলো বেশ খানিক সময়। ছাড়বে না সে, ছাড়লেই তার পদ্মকে তার থেকে আলাদা করা হবে।
পদ্ম কান্নাজড়িত গলায় খুবই আস্তে করে বললো
“ছাড়ো শ্রাবণ ভাই। সবাই দেখতাছে।
“দেখুক সবাই। ভালো করে দেখুক, এরপর থেকে যেনো কেউ আমার কাছ থেকে আমার পদ্মফুলকে আলাদা করার কল্পনাও করতে না পারে সেটার জন্য হলেও তাদের দেখতে হবে। শ্রাবণের ভালোবাসা ঠুনকো নয়, শ্রাবণ তার পদ্মফুলকে নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসে, সেটা সবার জানা দরকার।

শ্রাবণের বুকে থাকা অবস্থাতেই ক্ষীন হাসলো পদ্ম। এরপর মাথা উঁচু করে শ্রাবণের মুখের দিকে তাকিয়ে আবারও মৃদু গলায় বললো
“আমি আম্মার সামনে যামু কেমনে শ্রাবণ ভাই? আমার তো শরম করবো।
“কেন লজ্জা লাগবে আমার পদ্মফুলের?
“এই যে, সবার সামনে আমারে এমনে ধইরা রাখছো তুমি। এরপর লাজুক হাসলো পদ্ম। শ্রাবণও হাসলো। পদ্ম’র কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে বললো
“এতেই এতো লজ্জা?
পদ্ম মাথা নামিয়ে নিলো। ইশারায় মাথা নাড়িয়ে মুচকি হেসে বললো
“হুহ।
শ্রাবণ হেসে আবারও শক্ত করে ধরলো পদ্ম’কে।
এমন সময় পিঠে কারো হাতের ছোঁয়া পেলো শ্রাবণ। লাফ দিয়ে উঠে ছেড়ে দিলো পদ্ম’কে। হকচকিয়ে বলে উঠলো
“কে!
আসমার হাসির আওয়াজ কানে এলো তাদের দু’জনেরই। লজ্জায় মাথা নোয়ালো পদ্ম। তবে শ্রাবণের মধ্যে তেমন কিছু লক্ষ্য করা গেলো না। আসমা হেসে বললো
“তোমাদের প্রেম পর্ব শেষ হইছে? হইলে এবার বাড়ির ভেতর আসো।
শ্রাবণ চারপাশ তাকিয়ে দেখলো ওর মা, চাচী, ফুফু, আশিক কেউই নেই সেখানে। কিছুক্ষণ আগেও তারা এখানেই ছিলো হঠাৎ গেলো কোথায়?
প্রশ্নটা মনে উদয় হতেই প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো আসমার দিকে। আসমা হেসে হেসে বললো
“তোমরা এখানে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া প্রেম করতাছো, মা চাচীরা কি সেইটা দেখবো নাকি।
কথাটা বলে আবারও হাসতে লাগলো আসমা। শ্রাবণ এবার পদ্ম’র দিকে তাকালো। পদ্ম এখনো লজ্জা পাচ্ছে সেটা তার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে।

শ্রাবণ আসমাকে উদ্দেশ্য করে বললো
“তোমার ভাই কোথায় ভাবী?
“তারে দিয়া তুমি কি করবা?
“দরকার আছে। কথাটা বলে বাড়ির ভেতর পা বাড়ালো শ্রাবণ।। যেতে যেতে আসমাকে উদ্দেশ্য করে বললো
“পদ্মফুলরে সাথে নিয়া বাড়ি আসো ভাবী।
সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করেও আশিককে খুজে পেলো না শ্রাবণ। এরপর বরপক্ষকে বসানোর জন্য প্যান্ডেল বাধা হয়েছিলো সেটাই গিয়ে ঢুকলো সে। আবছা আলোতে বরের জন্য বাধা স্টেজে কারো অবয়ব চোখে ভাসলো। পকেট থেকে ফোন বের করে সেটার ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে দেখলো আশিক গুটিশুটি মেরে বসে আছে আছে। বেশ ভয় পেয়ে আছে। রাগ দেখাতে গিয়ে দেখাতে পারলো না শ্রাবণ। নিজেকে যথেষ্ট কন্ট্রোল করে কিঞ্চিৎ রাগী গলায় বললো
“এভাবে আমার সাথে ফাইজলামি করা আমি মোটেও পছন্দ করি না আশিক। শুধু শুধু আমাকে এভাবে হয়রানি করানোর কোনো মানেই ছিলো না।।
ভয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে আশিক উঠে দাঁড়ালো। ভয়ার্ত গলায় বললো
“আমি ফাইজলামি করি নাই শ্রাবণ ভাই। শাপলা আপা সত্যি পলাইয়া গেছিলো। কিন্তু কিছুক্ষণ পর নিজে থেইকাই ফেরত আইছে। দুলাভাইয়ের সাথে নাকি কি প্ল্যান করছিলো সে। কথাটা কেমন যেনো খাপছাড়া মনে হলো শ্রাবণের কাছে। সন্দিহান দৃষ্টি নিয়ে বেরিয়ে এলো প্যান্ডেলের ভেতর থেকে। ততক্ষণে পদ্মকে নিয়ে বাড়ির মধ্যে চলে এসেছে আসমা। বাড়ির বাদ বাকিরাও একটা জটলামত বেধে সেখানে উপস্থিত হলো। শ্রাবণের কপালে কিঞ্চিৎ ভাজ পরলো।

“আমরা জানতাম না তুই পদ্ম’রে পছন্দ করিস, তাই ওর লগে আরহামের বিয়া দিতে চাইছিলাম। যেহেতু শাপলা পলাইছিলো, মান ইজ্জত বাঁচানোরও একটা ব্যাপার ছিলো। অপরাধীর মতো করে বললেন সেলিমের বাবা। শ্রাবণ ভ্রু বাকিরে বাড়ির বাদিকের দিকে তাকালো। এরপর বললো
“কেমনে কি হইলো আব্বা?
আসমা ঘরে গিয়ে এক গ্লাস লেবুর শরবত করে নিয়ে এলো শ্রাবণের জন্য। এসেই পদ্ম’র বিয়ের কথা শুনে যা চিল্লাপাল্লা করেছে, গলা বোধহয় শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। শ্রাবণ দ্বিমত না করে পুরোটা শরবত খেয়ে নিলো। সেলিমের বাবা এবার কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বললো
“যখন পদ্ম কইলো তোর আর ওর সম্পর্কের কথা, তখনই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়া নিছিলাম যা হওনের হইবো, কিন্তু তোগো দুইডার মন ভাংমু না। মনে মনে প্রস্তুতি নিছিলাম ওই বাড়ির লোকজনরে না করার লাইগা, ঠিক তখনই ফিইরা আইলো শাপলা।। হতবাক হইয়া গেছিলাম আমরা। তোর চাচী মানে শাপলার মা তো ওরে মারার লাইগা ছুইটা গেছিলো।।

শ্রাবণ উদ্বেগ নিয়ে কথাগুলো শুনছে। এর মাঝেই হুহু করে হেসে উঠলেন তিনি। বললেন
“আইজকাল কার পুলাপান। কয় কিনা তোর আর পদ্ম’র সম্পর্কটা আমাগোরে জানানোর লাইগাই সে এমনডা করছে। এই কাজে নাকি আরহাম বাবাজিরও সায় আছিলো। আমরা আরহাম বাবাজির কাছে ফোন দিয়া জিগাইলে সেও কইলো এই কথা।
“এরপর? কাঁপা গলায় বললো শ্রাবণ।
“এরপর আরকি, বিয়া হইলো। মাঝখান দিয়া আমাগোরে হেনস্থা করলো তারা। যাইহোক, এক দিক দিয়া ভালোই হইছে, সেলিমের বিয়া করাইলাম তো অনেক দিন হইলো। এখন তোরও সময় হইতাছে। বিয়ার পাত্রী দেখার লাইগা জায়গায় জায়গায় দৌড়ঝাঁপ করা লাগলো না। আবারও হেসে উঠলেন তিনি। লজ্জায় সে স্থান দ্রুত ত্যাগ করলো পদ্ম। শ্রাবণ খেয়াল করলো সবটাই। তবে শাপলার এ কাজের পেছনের ব্যাখ্যাটা এখনো তার কাছে অস্পষ্টই রয়ে গেলো। শাপলা যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। শুধুমাত্র বোনের সম্পর্কের কথা জানানোর জন্য এতবড় একটা কান্ড করার মতো মেয়ে ও মোটেও না।

বাসর ঘরের সাজানো বিছানাটার উপর বসে আছে শাপলা। পরণে লাল বেনারসি, সাজটাও বধুর সাজ। তবে অন্যান্য বধুদের মতো চোখেমুখে নেই কোনো লজ্জা, তার বদলে মুখমণ্ডল হয়ে আছে শক্ত। আরহাম এখনো রুমে আসেনি। হয়তো একটু পরেই আসবে। বাইরে লোকজনের আনাগোনা আর কথার আওয়াজ কানে আসছে। কেউ কেউ আজকের এমন কান্ডের জন্য শাপলাকে নিয়ে সামনাসামনি বাজে মন্তব্যও করছে, তাতে কিছু যায় আসছে না তার। বিনিময়ে মুচকি হাসছে শুধু।

______
বেলা এগারোটা কিংবা তারচেয়ে কিছুটা বেশি। হাতে বড় ব্যাগটা ঝুলিয়ে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আকাশের অপেক্ষায় প্রহর গুণছে। আকাশ তাকে এখানেই অপেক্ষা করতে বলেছিলো, কিন্তু সেই কখন থেকে এখানে দাঁড়িয়ে আছে, আকাশের কোনো পাত্তা নেই। সাড়ে এগারোটার দিকে ফোনের সুইচড অন করলো শাপলা। সিমে সিংন্যাল পেতেই তরতর করে দু তিনিটে মেসেজ এসে ঢুকলো। প্রথমে সেগুলো ইগ্নোর করতে গিয়েও পরক্ষণে কি যেনো মনে করে মেসেজ ওপেন করলো সে। তানির মেসেজ। মেসেজে লিখা ছিলো, ‘এভাবে বিয়ের দিন পালিয়ে না গিয়ে আগেই চলে যেতে পারতি শাপলা। কিংবা বাড়িতে তোর সম্পর্কের কথা জানাতে পারতি। এভাবে ছোটবোনের জীবনটা নিয়ে খেলা করার কোনো মানেই ছিলো না।
মেসেজটা পরে কলিজায় ধক করে উঠলো।৷ বোনের জীবন নিয়ে খেলা মানে? পরের মেসেজটা ওপেন করলো সে। সেটাও তানিই পাঠিয়েছে। সেখানে লেখা, ‘যেখানেই যাস, পদ্ম’র জন্য দোয়া করিস। তোরই তো ছোটবোন। এখনো বিয়ের বয়স পর্যন্ত হয় নি, ভাগ্য দোষে তোর জন্য ঠিক করা বরের সাথেই তার বিয়ে হচ্ছে।’

হাত থেকে ব্যাগটা ছুটে গেলো শাপলার। মাথাটা ঘুরে গেলো, মনে হলো এক্ষুনি পরে যাবে। কোনোরকমে রাস্তার ধারের ল্যাম্পপোস্টের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো সে। প্রায় বারোটা নাগাদ আকাশ এলো সেখানে। তরিঘরি করে ব্যাগটা হাতে নিয়ে বললো
“তারাতাড়ি আসো শাপলা। আমাদেরকে এক্ষুনি যেতে হবে। আমাদেরকে খোঁজার জন্য তোমাদের বাড়ি থেকে লোক লাগানো হয়েছে। কথাটা বলেই সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো আকাশ। পেছন থেকে শাপলা বলে উঠলো
“আমারে মাফ করে দিও তুমি।
থমকে গেলো আকাশ। বিস্ময়ে পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলো শাপলার চোখ বেয়ে পানি ঝরছে।৷ হন্তদন্ত হয়ে আকাশ বললো
“কাঁদছো কেন তুমি? আর হঠাৎ মাফ করার কথাই আসছে কেন?
শাপলা নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে আকাশের হাত থেকে নিজের ব্যাগটা নিয়ে নিলো। এরপর কাঁপা কাঁপা গলায় বললো
“আমার জন্য আমার ছোটবোনের জীবনটা নষ্ট হোক, সেটা আমি কখনোই চাই নি। এর আগেও অনেক বার ওদের মাঝখানে ঢুকেছি, কিন্তু এইবার বোধহয় অনেক কঠিনভাবেই ঢুকেছি। আমার বোনটা আমাকে কোনোদিনই মাফ করবে না আকাশ, আর না আমি নিজেকে মাফ করতে পারবো। তুমি চলে যাও তোমার নিজ ঠিকানায়। আমিও যাচ্ছি , বিয়ে ঠেকাতে।

কথা বলতেও যেনো ভুলে গেছে আকাশ, এমনটা হবে সে কল্পনাও করেনি। শাপলা হাঁটতে শুরু করলো উল্টোপথে। আকাশ পারেনি তাকে থামাতে। বিস্ময়ে দেখে গেছে, নিরবে। কিছুটা দূর এসে আরহামের নাম্বারে কল করে শাপলা। সে এখনো শাপলাকে বিয়ে করতে চায় কিনা জানতে চায়। আরহাম এক দুই না ভেবে সম্মতি জানায়। অনেক দিন ধরে ভালোবাসে সে শাপলাকে। এভাবে তার ভালোবাসাকে হারাতে চায় না সে। তবে শাপলা শর্ত দেয়, মিথ্যে বলার শর্ত। সে যা বলবে তার ফ্যামিলি সহ শাপলার ফ্যামিলিকেও সেটাই বলতে হবে। তবেই এ বিয়েটা সম্ভব। আরহাম রাজি হয়। বাড়িতে ফিরে আসার পরেও অনেক ঝামেলার সৃষ্টি হয়। তবে ও বাড়িতে আরহামের সাথে কথা বলার পর সব ঠিক হয়ে পূর্বের ন্যায়। বোনের হাসিমুখটা তার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করতে থাকে। খুশিতে তাকে এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে পদ্ম। শাপলার চোখ বেয়ে পানি ঝরে, তবে সেটা সবারই অলক্ষে।

_______
আকাশে আজ পূর্ণ চাঁদ উঠেছে। তারারা ঝিকমিক করছে তার আশেপাশেই। বাঁশ ঝাড় সহ যত ঝোপঝাড় ছিলো তার মধ্যে জোনাকিরা জ্বলজ্বলে আলো জ্বালিয়ে দলবেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঝিঁঝি পোকারাও সমান তালে ডেকে যাচ্ছে। তবে আজ বিরক্ত লাগছে না তাদের শব্দ, বরং মনোমুগ্ধের মতো তা উপভোগ করছে পদ্ম আর শ্রাবণ। ঝিলের ধারের মাচায় বসে আছে তারা। শ্রাবণের ঘাড়ে মাথা রেখে বসে আছে সে, হাতদুটো শ্রাবণের হাতের মুঠোয় বন্দী। মুচকি মুচকি হাসছে পদ্ম, তার খুশি দেখে আনন্দিত হচ্ছে শ্রাবণ নিজেও। পদ্ম এবার শ্রাবণের হাতের মুঠো থেকে নিজের হাত দুটো বের করে শ্রাবণের এক বাহু জড়িয়ে ধরলো। শ্রাবণ হেসে বললো
“আমার লজ্জাবতী পদ্মফুলের লজ্জা কোথায় গেলো?
পদ্ম হেসে বললো
“মেলায় হারিয়ে গেছে।
শ্রাবণ আবারও হাসলো। পদ্মকে ধরে উঠালো। মুখোমুখি পদ্মকে বসিয়ে নিজেও পদ্ম’র মুখো হয়ে বসলো। অপলকভাবে তাকালো পদ্ম’র পানে। হঠাৎ পদ্ম থমকে গেলো, আঁটকে গেলো তার শ্রাবণ ভাইয়ের গভীর দুটি চোখের মায়ায়। মনোমুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলো তার শ্রাবণ ভাইকে। মনে মনে ভাবতে লাগলো, ‘সামনে বসে থাকা মানুষটি তার, একান্তই তার। অনেক ঝড় গিয়েছে, আলাদা করে দিতে চেয়েছে তাদের। কিন্তু আল্লাহ যাদের মিলিয়ে পাঠিয়েছেন, মানুষের কি সাধ্যি তাদের আলাদা করার। ‘

আচমকা পদ্মকে জড়িয়ে ধরলো শ্রাবণ। আবেশে বললো
“একটুর জন্য হার্ট অ্যাটাক করতে বসেছিলাম রে পদ্মফুল।।
পদ্ম শ্রাবণের বুকে মুখ লুকিয়ে বললো
“আর আমিতো মরতে বসেছিলাম শ্রাবণ ভাই। ভাগ্যিস, সবাইকে বলার পর মেনে নিয়েছিলো। আর আপাও ফিরে এসেছিলো।
শ্রাবণ চিন্তিত হয়ে বললো
“শাপলা এমনটা কেন করলো পদ্ম?
“আমি জানিনা। এই চিন্তা আমার মাথাতেও ঘুরতেছে।
“ও বাড়ি থেকে যখন শাপলা দ্বিরাগমনে আসবে, তখন বেশ করে ধরবো। জেরার উপর জেরা করবো। এখন নাহয় ওসব কথা থাক। আমি আর আমার পদ্মফুলের মাঝখানে এখন তৃতীয় কোনো ব্যক্তি না ঢুকানোই ভালো। তারচেয়ে বরং তুই এখন চুপটি মেরে আমার বুকে থাক। আমি অনুভব করতে চাই আমার পদ্মফুলকে।

পদ্ম লজ্জা পেলো এবার। ওর লজ্জারাঙ্গা মুখ দেখে শ্রাবণ হেসে বললো
“এ লজ্জাবতীর মায়ায় আমি আর কতবার যে জড়াবো কে জানে। পাগল করে ছাড়ছে একদম।
“তাহলে চলে যাই।
“কেন?
“আমার শ্রাবণ ভাই পাগল হলে আমাকে ভালোবাসবে কে?
শ্রাবণ পদ্মকে টেনে আবারও নিজের সাথে চেপে ধরলো। গোল থালার মতো দেখতে রূপালী চাঁদের পানে তাকিয়ে থেকে বললো
“পাগল তো আমি সেই কবেই হয়েছি, পদ্মফুলের মায়ায় জড়িয়ে। এরকম পাগল আমি সর্বদাই থাকতে চাই, পদ্মফুলের ভালোবাসার জন্য পাগলামি করতে চাই সারাজীবন।
“ভালোবাসি শ্রাবণ ভাই।।
শ্রাবণ পদ্মকে আরেকটু কাছে টেনে মৃদুহেসে বললো
“ভালোবাসার মানুষকে ভাই ডাকতে নেই, পাপ হয় তাতে।

——-

রাত এগারোটা নাগাদ ঘরে এসে ঢুকলো আরহাম। শাপলাকে বসে থাকতে দেখে মুচকি হাসলো। দরকার খিল আঁটকে শাপলার কাছাকাছি আসতেই নড়েচড়ে উঠলো শাপলা। চোখ তুলে তাকালো আরহামের দিকে। আরহাম থেমে গেলো, ডুবে যেতে লাগলো শাপলার চোখের মধ্যে।৷ বুঝতে পেরে চোখ নামিয়ে নিলো শাপলা। মুচকি হেসে এগিয়ে এলো আরহাম৷ শাপলার মুখোমুখি বসে রইলো কিছুটা সময়। শাপলার নজর তখন অন্যদিকে, আরহামের দিকে সরাসরি তাকানোর সাহস তার নেই।
“শাপলা..
শাপলা এবার তাকালো আরহামের দিকে। কন্ঠস্বরটা প্রচন্ড রকমের মিষ্টি তার, মনে মনে ভাবলো শাপলা। আরহাম আবারও বললো
“এখন কেমন লাগছে?
“ভালো। নরম গলায় বললো শাপলা।
আবারও দুজন নিরব। খানিক বাদে আরহাম বললো
“একটা কথা রাখবে!
বিস্ময়ে তাকালো শাপলা। বললো
“কি কথা?
“আর কখনোই আমার থেকে পালানোর চিন্তা করবে না। দেখো, আগে কি হয়েছে সেটা আমি জানতে চাই না। আজ কেন চলে গেছিলে সেটাও জানতে চাই না। আবারও কেন ফিরে এসেছো তা নিয়েও আমার মাথা ব্যথা নেই। শুধু চাই পেছনের সব কিছু ভুলে তুমি আমার সাথে থাকবে। আমি হয়তো তোমাকে বার বার ভালোবাসার স্পর্ধা দেখাবো, কষ্ট করে হলেও মেনে নিবে প্লিজ।

আরহামের কন্ঠে স্পষ্ট অনুনয়, নেই কোনো অভিযোগ। শাপলা মুচকি হেসে বললো
“থাকার জন্যই তো ফিরে এসেছি। চলে যাওয়ার হলে কি আর আসতাম।
আরহাম প্রশান্তিত হাসি হাসলো। খানিক বাদে শাপলাকে টেনে নিলো নিজের কাছে, শাপলাও বাধা দিলো না। বাধা দিয়ে আর কি হবে, আল্লাহ যদি তার কপালে এই মানুষটাকেই লিখে রাখে তাহলে সেটা মেনেই তাকে চলতে হবে। আরহাম আলতো করে ঠোঁট ছুয়ালো শাপলার কপালে। শাপলা নিশ্চুপ। কয়েক মিনিট পর আরহাম বললো
“কথা বলছো না যে!
“আমাকে একটু ওই যায়গাটায় নিয়ে যাবেন, যেখানে দাঁড়িয়ে আমাদের বাড়ির ঝিলটা দেখা যায়।
আরহাম কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলো শাপলার দিকে৷ বললো
“কি করবে?
“আজ নাকি সুন্দর চাঁদের জ্যোৎস্না ফুটেছে। জ্যোৎস্নার আলোয় আমি আমাদের ঝিলটাকে একটু দেখতে চাই।

আরহাম আর কোন কথা বাড়ালো না।
বাড়ির পেছন দিকে এসে আরহামের পাশাপাশি দাঁড়ালো শাপলা। চাঁদের আলোয় ঝিলটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দুফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো চোখ থেকে। আরহামের অলক্ষে সে পানিটুকু মুছে ফেলে নিরবে হাসলো। মনে মনে ভাবলো, ‘ঝিলের এ পাড়ে নাহয় আমিই থাকলাম। শ্রাবণ ভাইয়ের পদ্মফুল শ্রাবণ ভাইয়ের সাথে সুখে শান্তিতে থাকুক না ঝিলের ওপারে। ”

_________[সমাপ্ত]_________

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here