ডাকপাড়ি পর্ব -৩০+৩১+৩২

#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৩০
#আফনান_লারা
________
জ্যাম থাকাকালীন দুজনেই নেমে পড়েছে বাস থেকে।দাদাজানকে ঠিকানা হিসেবে যেটা বলেছিল ফারাজ, তারা যাচ্ছে তার উল্টো জায়গায়।
ছুটতে ছুটতে গলির পর গলি শেষে দুজনে এসে দাঁড়ায় অন্য গন্তব্যে।এখান থেকে আনাফের বাসা বেশ দূরে।তাও কিছু করার নেই।সামনে যে বিপদ আসতে চলছিল সেটা থেকে বাঁচতে পেরে ফারাজ অনেক খুশি।
এখন তারা আছে একটা ক্যাফের সামনে,ভ্রাম্যমাণ কফি শপ।ফারাজের ইচ্ছে হলে কফি খাবে।তাই পূর্ণতাকে একটা টুলে বসিয়ে দিয়ে গেছে কফি অর্ডার দিতে।সেখানে আবার বিরাট বড় লাইন।ফারাজ গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছে।পূর্ণতা টুলে বসে বসে পা দুলাচ্ছিল হঠাৎ পাশে একজন বয়স্ক লোককে কফি হাতে বসতে দেখে পা দোলানো বন্ধ করে দিয়ে চুপ করে থাকলো।
লোকটি কফি তার পাশের টুলে রেখে পূর্ণতার দিকে চেয়ে বললেন,’তোমার বাসা কই নাতিন?’

‘মাতুয়াইল ‘

‘ওখানে আমার এক বন্ধুর বাসা।তোমাদের বাসার নাম কি?’

পূর্ণতার কাছে অপরিচিত মনে হয়েছে বলে সে ভুলভাল একটা বাড়ির নাম বলে দিয়েছে।লোকটা এবার বললো,’তুমি কিসে পড়ো?’

‘অনার্স ফাইনাল ইয়ার’

‘বিয়ে করেছো?’

‘জ্বী না’

‘করবে?’

‘বাবা মা খুঁজে দিলে করবো।’

‘আমি খুঁজে দিলে করবে?’

‘নাহ।কারণ আমি তো আপনাকে চিনিনা’

‘ঘটকের পরিচয় জেনে কি করবে?তোমার তো জানা উচিত ছেলের ব্যাপারে’

‘জানতে চাইনা’

‘আরে শুনো।ছেলে খুব ভাল।মাস্টার্স পাশ করেছে।পেশায় সে একজন চিত্রকর। খুব ভাল ছবি আঁকে।ছবিগুলো এত এত দামে বিক্রি হয়।তাছাড়া ছেলের মেধা নিয়ে কি বলবো,দারুণ মেধা’

‘তাহলে আঁকাআঁকি না করে ডাক্তার/ইঞ্জিনিয়ার হতে বলেন’

‘সেটাই তো সমস্যা। ছেলের তো ইচ্ছে চিত্রকর হওয়া।’

‘ভাল’

‘হেব্বি লম্বা।একদম বাঁশের মতন দেখতে,মোটা বাঁশ।বিদেশী বাঁশ একগুলো আছেনা? মোটা মোটা ওগুলার মতন।এত লম্বা যে মাথা উপরে করে তাকাতে হয়।তারপর ব্যবহার কি বলবো!!এত ভাল ছেলে আমি জীবনে দেখি নাই।আমার নাতিন যদি ওর থেকে পাঁচ বছরের বড় না হতো তাহলে ওরে নাতিন জামাই করে আনতাম।যাই হোক।তুমিও তো আমার নাতিনের মতনই।বলো তোমার কেমন লাগলো সব শুনে?’

‘ছবি তো দেখলাম না’

‘দাঁড়াও উদাহরণ দিচ্ছি।ঐ যে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে।সাদা পাঞ্জাবি পরা ছেলেটা।ঐ যে পাঁচ নম্বরে যে দাঁড়িয়ে আছে একদম ওর মতন দেখতে।হুবুহু!এক মিনিট!আরে এটাই তো সেই যার কথা তোমায় বলছি।খোদার কি কুদরত!!!
বলতে না বলতেই ছেলে সামনে এসে গেলো।আমার আর কষ্ট করতে হবেনা।তুমি বসো।আমি ওরে ধরে নিয়ে আসতেছি’

পূর্ণতা ফারাজকে দেখে চোখ বড় করে চেয়ে আছে।লোকটা সোজা গিয়ে ফারাজকে খপ করে ধরে ওর কাছে নিয়ে এসেছেন।

‘দেখো নাতিন।ওর কথাই বলছিলাম।কি সুন্দর তাইনা?’

ফারাজ ইশারা করে বলছে এটাই আজিজ দাদু।পূর্ণতা কপালে হাত দিয়ে চুপ করে দেখছে কেবল।
আজিজ খান এবার বললেন,’তোমার না সাইনবোর্ডে থাকার কথা ছিল?তুমি এখানে কি করো?’

‘ঐ আসলে কফি খেতে ইচ্ছে হলো তাই’

‘আমি তো সাইনবোর্ডের দিকে যাচ্ছিলাম।যাক ভালো হয়েছে এখানে দেখা হয়ে গেছে।বসো!বসে একসাথে কফি খাবো আর আলাপও হয়ে যাবে’

তিনি জোর করে ধরে ফারাজকে বসিয়ে দিয়েছেন।

অনেকক্ষণ ওদের দুজনের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে এরপর তিনি বললেন,’তোমাদের একে অপরকে কেমন লাগছে?’

এই কথা শুনে দুজনেই বলে উঠলো,’অসহ্য’

‘অসহ্য কেন?এখনও তো সংসার করলেনা।সংসারের আগের অবস্থা চলছে এখন।সংসার করার সময় অসহ্য মনে হবে।তার আগে কেন মনে হচ্ছে?তোমরা কি একে অপরকে চিনো?’

দুজনে এবার পড়ে গেলো বিপদে।কি জবাব দিবে তাই ভাবছে।সত্যিটা তো জানাতেই হবে তাই পূর্ণতাই বলে উঠলো সে ফারাজকে চিনে।

‘দ্যাটস গ্রেট।তাহলে আর কি!বিয়ে পাকা ভেবে নিচ্ছি?’
————–
সারথিকে রেখে অধরা চলে গেছে।সারথি চুপচাপ আনাফের পায়ের আওয়াজ শুনছিল।এখন আনাফ ওর থেকে খুব একটা দূরেনা।সে পা টিপে টিপে হাঁটছে সম্ভবত। সারথির ইচ্ছে হলো ধরে আচ্ছা করে পেটাই করতে পরে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে সে বললো,’আপনার বাসায় থাকলে আনাফ নামের সিসি ক্যামেরার আওতাধীন থাকতে হবে?’

আনাফ হাঁটা বন্ধ করে সারথির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।সারথি আবার বললো,’ফারাজ আসলে ওর সাথে আমি চলে যেতে বাধ্য হবো যদি আপনি নক না করে আমার রুমে চোরের মতন ঢুকে আমার দিকে চেয়ে থাকেন তবে’

‘সরি।সুন্দরকে দেখা যদি অপরাধ হয়ে থাকে তবে যাচ্ছি আমি।আসবোনা হুহ’

আনাফ চলে গেলো।এবং সারথি এটাও বুঝতে পারলো সে সত্যি সত্যি গেছে।লুকিয়ে আবারও আসার চেষ্টা করেনি।সারথি মিটমিট করে হাসছে এবার।অানাফ দূরে এসে সারথিকে হাসতে দেখে নিজেও হাসলো। আজ সে সারথিকে দুবার হাসিয়েছে।এর চেয়ে বড় কিছু আর কি হতে পারে।

সারথি উঠে দাঁড়িয়ে ওয়ারড্রবে হাত রেখে ধীরে ধীরে দরজার দিকে যাচ্ছে।একা বসে থাকতে তার কোনোদিনই ভাল লাগেনা।তাও ভাগ্যের পরিহাসে তাকে সবসময় একাই বসে থাকতে হয়।এখন অধরার কাছে যাচ্ছে সে।শুধু শুধু বসে থাকবে নাহয় গল্প করবে।আনাফ তখন ঠাণ্ডা পানির বোতল নিয়ে ঐদিকটায় যাচ্ছিল।
সারথি বের হতেই ওর সাথে বড়সড় একটা ধাক্কা খেয়ে দুজনে দুদিকে পড়ে গেছে।আনাফ নিজেও ব্যাথা পেয়েছিল তাও ব্যাথার কথা না ভেবে উঠে বসে সারথির হাত টেনে ধরে বললো,’ব্যাথা পেলেন?’

‘নিজের বাসায় কোন মানুুষ দৌড়ায়?’

‘কেউ দৌড়ায় কিনা জানিনা তবে আমি ছুটি ‘

‘আর একটুর জন্য আমাকে অন্ধর সাথে সাথে পঙ্গু ও বানিয়ে দিতেন।তাছাড়া ডাক্তার হয়ে ঠাণ্ডা পানি খাচ্ছেন?’

‘এগুলোতে মুখ ডুবিয়ে রাখবো,আমার হেভিট।খাবোনা’

‘ভাল।কথায় কথায় আমার হাত ধরতে হবেনা আপনাকে।’

আনাফ হাতটা ছেড়ে দিয়ে জিভ কামড়ে সারথির দিকে চেয়ে রইলো।সারথি নিজে নিজে হাতের কুনুই মুছতে মুছতে অধরাকে খুঁজতে চলে গেছে।আনাফ নিচ থেকে পানির বোতলটা নিয়ে আবার নিজের কাজে চলে গেছে।

অধরা তার বই খাতা সব বিছানায় বিছিয়ে বসে বসে বলছে,’হে আমার বইগণ!!বিশ্বাস করো!পরীক্ষা শেষ হলে তোমাদের কটকটি আলার কাছে বেচে দেবোনা।যত্ন করে রেখে দিবো আলমারির উপরে।দয়া করে আমার মাথায় কদিন ভাঁড়া থাকো।আমাকে ভাঁড়া দিতে হবেনা।প্রয়োজনে পাশে দাঁড়ালেই হবে।প্লিজ বই খাতা বোঝার চেষ্টা করো’

সারথি তখন বললো,’বই কথা শুনে?’

‘হ্যাঁ।আমার মতে পৃথিবীর সবকিছু সব দেখে এবং শুনে।’

‘পৃথিবীর সব কিছু সব দেখে না আবার সব শুনেও না।মাঝে মাঝে কজন এগুলো থেকে বঞ্চিত হয় ‘

অধরা বুঝতে পারলো সারথি এমনটা কেন বলেছে।তাই সে এই বিষয়টাকে আর আগায়নি।সারথি ওর কাছে এসে একটা বই সরিয়ে বসলো।অধরা ওর দিকে ফিরে হাসিমুখে বললো,’সেমাই খাবে?’

‘এখন?’

‘হ্যাঁ,আমার আনাফ ভাইয়া খুব ভাল সেমাই বানাতে পারে।ওরে দিয়া বানাই দাঁড়াও’

‘না থাক লাগবেনা’

‘আরে সে তোমার প্রেমে অন্ধ।মাঝ রাতে উঠিয়ে বিরিয়ানি রাঁধতে বললে সুরসুর করে রেঁধে দিবে’

এটা বলে অধরা আনাফকে ডাক দিয়েছে।আনাফ মুখে পানি দিচ্ছিল। অধরার ডাক শুনে দ্রুত চলে আসলো।

‘কি ভাইয়া?আমি ডাকাতে এত জোরে আসলা,সারথি আপু ডাকলে তো মনে হয় ডেকে আর দম ফেলা লাগতোনা, তার আগেই এসে পড়তে’
———–
লেভেনের বাবা সজীবকে সোজা করে বলে দিয়েছেন আগামী দু মাসের মধ্যে তাকে একশো কোটি টাকার মালিক হয়ে দেখিয়ে দিতে হবে তা নাহলে তিনি লেভেনকে তার পছন্দ করা ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দিবেন।লোকটা অত্যন্ত লোভী একজন মানুষ তা সজীব খুব ভাল করে জানে,কিন্তু লেভেনের প্রেমে সে অন্ধ বলে দিনের পর দিন পরিশ্রম করে টাকা কামিয়ে যাচ্ছে তাও কিছুতেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছেনা।
এবার তো ওনার উপর প্রচণ্ড রাগ হয়েছে সজীবের।একমাত্র লেভেনের মুখ চেয়ে সে কিছু না বলে শুধু মাথা নাড়িয়ে গেছে।
উনি চলে যাবার সময় লেভেনকেও নিয়ে গেছেন। তাই মন খারাপ করে সজীব নিজের বাসায় ফিরে এসেছিল।আসতেই মায়ের কল।মা জানায় সারথি নাকি বাসা থেকে মিসিং।
এবার মাথায় আরেক টেনসন এসে বাসা বাঁধলো।অবশ্য এর পেছনে একমাত্র কারণ সজীব নিজেই।
সারথির সাথে সে যেটা করতেছে তাতে করে সারথির নিরুদ্দেশ হওয়াটাই স্বাভাবিক।
লেভেনের পেছনে ছুটতে ছুটতে সে সারথির জীবনকে নষ্ট করে দিয়েছে।
এখন সারথিকে কোথায় খুঁজে পাবে সবাই।সে এখানে বসে থেকে কি বা করতে পারবে।ফোন খুঁজে সারথির নাম্বারে কয়েকবার কল করে সজীব।রিসিভ করেছে সায়না।তিনি জানিয়েছেন সারথি বাসা থেকে গায়েব,এরপর আবার বলেন ফারাজ নাকি সারথির খোঁজ পেয়েছে।সে যেন চিন্তা না করে।কিছুটা নিশ্চিত হয়ে সজীব দম ফেললো।তাও পুরো নিশ্চিন্ত সে হয়নি।ফারাজ যতক্ষণ না সারথিকে পাচ্ছে ততক্ষণ মনের ভয়টা যাবেনা।

সারথির যদি কিছু হয়ে যায়?সজীব তখন কি করবে?
আজীবন সে অপরাধী হয়ে থেকে যাবে?
আচ্ছা সারথি কি একা থাকবার জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে নাকি সুইসাইড করতে?

“যদি তাই হয় তবে মনে হয় আমি অনেক বড় বিপদে পড়ে যাবো।জেল খাটতে হবে তা নিয়ে ভাবছিনা,আমি ভাবছি সারথির জীবন নিয়ে।
আমি চাইনা তার কিছু হোক।ওকে তো ঘৃনা করিনা আমি,বরং ওর আমাকে ঘৃনা করা উচিত।
সজীবের মনে হলো একবার লেভেনকে না জানিয়ে বাংলাদেশ যাওয়া উচিত।সারথির সাথে আলাদা বসে কথা বলে সব ঠিক করে নিলে হয়ত আরও ভাল হবে।
তাই ভেবে ফোন নিয়ে টিকেট বুক করতে বসে সজীব, ঠিক সেসময় লেভেনের কল আসে।
যেন একটা বাধা।বিরক্ত হয়ে কল রিসিভ করেছে সজীব।লেভেন কাঁদছিল।কান্নার কারণে কিছু বলতেই পারছিলনা।
সজীব জানতে চাইলো কি হয়েছে।লেভেন জানায় সে দরকার হলে পালিয়ে আসবে তাও সজীবকে সে হারাবেনা কিছুতেই।
———–
আজিজ খান একসাথে পূর্ণতা আর ফারাজের মাথা চিবিয়ে খাচ্ছেন মশলা মিশিয়ে।প্রশ্ন করতে করতে দুজনের মাথা ঝিম ধরিয়ে ফেলেছেন।
শেষে ফারাজ পূর্ণতার কানে ফিসফিস করে বললো তাদের আরও একবার পালাতে হবে।নাহলে এমন করে চলতে থাকলে দুজনকেই ফ্যাসাদে পড়ে থাকতে হবে গভীর রাত অবধি।

বুদ্ধি করে দুজনেই একসাথে বলে উঠলো,’আজিজ দাদু ঐ দেখেন আকাশে হেলিকপ্টার!’

আজিজ খান অমনি উপরে তাকালেন আর ফারাজ পূর্ণতা দিলো এক দৌড়।দৌড়ে দৌড়ে দুজনে এক গলিতে গিয়ে গলি শেষ করে হাঁপাতে হাঁপাতে মাথা তুলে দেখলো তারা আবারও ঘুরে ফিরে আগের জায়গায় চলে এসেছে।আজিজ দাদুর সামনে বরাবর।আজিজ দাদু এখনও আকাশের দিকে চেয়ে থেকে বলছেন,’নাতি-নাতিন! কই আকাশে তো কিছু নেই, কেবল বিকেল বেলার কমলা রঙের মেঘ ভাসছে’

পূর্ণা বললো,’ভাল করে দেখেন সবুজ রঙের হেলিকপ্টার’

এটা বলে দুজনে দিলো আবার দৌড়’

চলবে♥#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৩১
#আফনান_লারা
________
‘কি জন্য ডাকলি সেটা বল,আমার অনেক কাজ আছে’

‘ওমা তাই নাকি?তাহলে আর কি করার!কাজেই যাও।ভাবলাম সারথি আপুকে তোমার হাতের সেমাই খাওয়াবো।তোমার যেহেতু সময় নেই,তবে যাও’

আনাফ হেসে বললো,’আগে বলবিনা!!তুই না বললেও আমি যাইতাম সেমাই বানাইতে।আমার নিজেরই খেতে ইচ্ছে করছিল।’

অধরা তখন তাচ্ছিল্য করে বলে,’তোমার না কত কাজ?’

‘কাজ পরে আগে সেমাই’

এটা বলেই আনাফ চললো রান্নাঘরের দিকে।

অনেকক্ষণ ধরে খালি ঠুসঠাস করে যাচ্ছে।অধরা বললো ভাইয়া রান্নাঘরের এমন অবস্থা করবে বুয়ার সেটা পরিষ্কার করতে নাকি দুইদিন লেগে যায়।
এই কথা শুনে সারথি বললো সে যেন গিয়ে আনাফকে থামতে বলে,সেমাই খাওয়ার দরকার নাই,
কিন্তু কে শোনে কার কথা।অধরাও যায়নি আর আনাফও তার রান্না করা থামায়নি।

এক ঘন্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর সেমাই টেবিলে এনে আনাফ ওদের ডাক দেয়।অধরা সেই কবে থেকে বসেছিল একটা ডাকের।
ডাক শুনেই ছুটে আসলো।এসেই খেতে বসে গেছে,সারথি দরজার সাথে লেগে দাঁড়িয়ে আছে তখনও।আনাফ ওর জন্য সেমাই বাটিতে নিয়ে বললো এসে বসতে।পরে নিজেই অধরাকে খোঁচা দিলো গিয়ে ওকে নিয়ে আসার জন্য।অধরা খাওয়া রেখে উঠে গিয়ে সারথির হাত ধরে টেবিলের কাছে নিয়ে আসলো।
চেয়ারে বসে বাটি হাতে সেমাই মুখে দিয়ে সারথি জানালো অনেক মজা হয়েছে।এই কথা শুনে আনাফ তো গলে শেষ।তার গলে যাওয়া সারথি না দেখলেও অধরা ঠিকই দেখেছে।এবং সে দাঁত কেলিয়ে বলে দিলো,সারথি আপু তোমার হবু বর তো গলে পানি হয়ে গেছে গো!!’
——-
তিনজনের সেমাই আড্ডা বেশ জমে গেলো।সেমাই খাওয়ার সাথে সাথে অনেক গল্প করেছে তারা।বেশির ভাগ ছিল আনাফের কলেজ লাইফের গল্প।তারপর অধরার গল্প।মাঝখান দিয়ে সারথি তার নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া কোনো গল্প শেয়ার করেনি।যার জীবনটাই বিষাদে ভরা তার আবার কিসের সুন্দর সুন্দর ঘটনা!

অধরার পরীক্ষা বলে সে খুব বেশি সময় ধরে গল্প করেনি।উঠে চলে গেছে মাঝ পথেই।সারথি ও উঠতে চাইছিল কিন্তু আনাফ বললো আরেকটু বসতে।সজীবকে নিয়ে তার কিছু কথা আছে সারথির সাথে।

‘বলুন কি জানতে চান!’

‘সজীব কি আপনাকে আপনার দূর্বলতার কারণে ভালবাসেনা?নাকি সত্যি সে ৩য় ব্যাক্তিতে আসক্ত?’

‘দূর্বলতার কারণেই তো মানুষ ছোট হয়ে থাকে,ওপারের মানুষটা তখন আরও একজনকে জীবনে আনতে আর ভাবেনা।আমার সাথেও তেমন হলো’

‘সজীব ডিভোর্স দিবে সত্যি?’

‘হ্যাঁ,উনি না দিলেও আমি দিয়ে দিবো।যেখানে সত্যিটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে সেখানে আর কি জোড়া লাগানোর আছে?’

‘আপনার কি মনে হয়না আপনার আর সজীবের একান্তে আলোচনা করে সব ঠিক করে নেয়া উচিত?’

‘না মনে হয়না।যে মানুষটা বিয়ের পর থেকে আমার পাশে বসে দু মিনিট সময় কাটায়নি সে এখন ডিভোর্স হওয়া নিয়ে সময় কাটাবে?দরকার বলে মনে করিনা’

‘ডিভোর্সের পর কি করবেন?’

‘নাচবো!আপনার কোনো সমস্যা আছে?’

‘রাগ করেন কেন?আমি তো এমনি জিজ্ঞেস করলাম’

‘এত জানার প্রয়োজন নেই।’

সারথি এবার রেগে গিয়ে উঠে চলে গেছে।আনাফ গালে হাত দিয়ে ভাবছে যেটার জন্য সজীবের টপিক উঠিয়েছিল সেই কথাটাই বলা হলোনা।ধুর ধুর!!
ভেবেছিল সজীবের চ্যাপটার শেষ করে বলে ফেলবে সে সারথিকে বিয়ে করতে এক পায়ে খাড়া।তা আর বলাই হলোনা।মেয়েটা হুটহাট এত রেগে যায়!!
————
ফারাজদের ছুটতে ছুটতে সন্ধ্যা নেমে গেছে।শহরে সন্ধ্যা নামতেই বসে আলোর মেলা।ফুটপাত দিয়ে চলার পথে ফারাজ পূর্ণতা হঠাৎ হেসে ফেললো,বিশ্বজয়ের হাসি।
হাসি মুখে ফারাজ জানালো শত কষ্ট শেষে তারা জিতে গেছে।
কিন্তু পূর্ণতা মুখ আবার ফ্যাকাসে করে বললো,’যদি বাসায় গিয়ে দেখি আজিজ দাদু সেখানে গিয়েও হাজির।তখন?’

‘আজ ফিরবেইনা।আনাফ ভাইয়ের বাসায় থেকে যাবো’

‘এভাবে বললেই কারোর বাসায় থাকা যায়?’

‘সারথি যদি থাকতে পারে,তবে আমরাও পারবো।বেশি কথা না বলে পথ চলুন। বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে বাস ধরতে হবে।রাত ন’টার আগে পৌঁছাতে পারলেই হলো।’

কথা শেষে দুজনে হাঁটার গতি বাড়িয়ে একটা বাসে উঠে পড়ে।সেই আগের মতন সবার পেছনের সিট।পূর্ণতা জানালার কাছে বসে মুখ ভার করে রেখেছে।গরমে তার কপাল বেয়ে ঘাম পড়ছে কিন্তু ফারাজের কারণে একটুখানিও জানালা খোলার সাহস পাচ্ছেনা সে।
বাস এবার জ্যামে পড়েনি,এক টানে সাইনবোর্ড নিয়ে এসেছে।ভাঁড়া দিয়ে দুজনে আনাফের দেয়া ঠিকানা অনুযায়ী নামলো।সমস্যা হলো একই রকম দেখতে দুটো বাড়ি।কোনটাতে আনাফ থাকে!
ফারাজ ফোন নিয়েছে ওকে কল করার জন্য দেখলো ফোন অফ হয়ে আছে।অনই হচ্ছেনা, অন না হলে নাম্বার নিয়ে পূর্ণতার ফোন দিয়ে যে কল করবে সেই উপায় ও নেই।কি মুশকিল!

ফারাজ পূর্ণাকে দাঁড় করিয়ে একটু সামনের দিকে গিয়ে একটা লোককে জিজ্ঞেস করলো ২০৩ নাকি ২০৪ নাম্বার বাসা আনাফের।
লোকটা ফারাজের কথা শুনে বললো,’আনাফ কেডা?’

ফারাজ এবার তাকে ছেড়ে আরেকজনের কাছে জানতে চাইলো আনাফের বাসা কোনটা।
লোকটি বললো,’ডাক্তার আনাফ?’

‘হ্যাঁ,হ্যাঁ’

‘ঐ তো নীল রঙের বাড়িটা’

‘ভাই ওখানে তো নীল রঙের বাড়ি দুইটা’

‘নাম দেখেন’

‘নাম থাকলে তো হতোই।নাম নেই বাড়ির’

লোকটা মাথা চুলকে বললো,’যে বাড়ি দেখলে ডাক্তার ডাক্তার ফিল আসবে সেটাই আনাফের বাড়ি হতে পারে’

ফারাজ কপাল চাপড়ে পূর্ণতার কাছে ফিরে এসেছে।ও বললো এমন খোঁজাখুঁজি না করে তারা বরং দুটো বাড়িতেই গিয়ে দেখবে কোনটা আনাফের।
তাই প্রথম যে বাড়িটা আছে ওরা আগে ওটাতেই গেলো।কলিংবেলে চাপ দেয়ার পাঁচ মিনিট পর দরজা খুলেছে একটা ছোট বাচ্চা মেয়ে,তার হাতে টেডি বিয়ার।

ফারাজ আর পূর্ণাকে দেখে সে বললো,’মাম্মা পাপা ঝগড়া করতেছে,কি চাই তুমাদের?’

‘এটা কি আনাফের বাসা?’

‘আনাফ চাচ্চু?পাশের বাসা তাদের।এটা তো আমাদের বাসা’

ফারাজ এবার বুঝে গোছে তারা প্রথমটাতেই ভুল এসেছে।চট করে পাশের বাসার দিকে ছুটলো দুজন। গিয়ে কলিংবেলে চাপ দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
অনেকক্ষণ পর আনাফের বাসার বুয়া এসে দরজা খোলে।ওদের দেখে হাসিমুখে ভেতরে আসতে বলে চলে গেছে।
ফারাজ সারথিকে খুঁজতে খুঁজতে ভেতরে ঢুকে গেলো।
কাউকে না দেখে একবার সারথির নাম ধরে ডাকলো সে।ওপাশ থেকে কোনো আওয়াজ ভেসে আসলোনা দেখে দুজনে চুপচাপ সোফায় বসে।বুয়া গেছে মনে হয় তাদের ডাকতে।বেশ কিছু সময় পর আনাফ হন্তদন্ত হয়ো ছুটে আসলো ফারাজকে দেখতে।ওকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে হাত মিলালো দুজন।

‘জানো!তোমার বোন আবারও এক্সিডেন্ট করতে গেছিলো।সেই আগের মতন আবারও বাঁচিয়ে ফেললাম।তারপর ভাবলাম আমার বাসায় নিয়ে আসি।ওনার এখন মানসিক ভাবে সুস্থ হতে হবে।এই বাসায় আমার ছোট বোন আর বুয়া থাকে।একেবারে সেফ ওনার জন্য।আমি থাকি ঢাকর বাসায় আম্মুর কাছে।’

‘ও কেমন আছে ভাই?’

‘ভালো আছে,হয়ত রাগ তোমার উপর।গিয়ে কথা বলতে পারো।সোজা গিয়ে ডানের রুমটা’

ফারাজ চট করে উঠে চলে গেলো সেদিকে।পূর্ণতা ও পিছু পিছু আসছে।তবে সে রুমে ঢোকেনি, দূর থেকেই দেখছিল।
ফারাজ পা টিপে টিপে কাছে এসে সারথির কপালে চুমু দিতেই সে মুখ ফিরিয়ে নিলো।ফারাজ এবার ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বললো,’মাফ করে দে সারথি।আর হবেনা কোনোদিন’

সারথি চুপ করে আছে,ফারাজ এবার ওর কোলে মাথা রেখে বললো,’একবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিবিনা?জানিস কত কষ্টে তোকে পেয়েছি?আমার তো জান বের হয়ে আসছিল’

সারথির নিরবতা বলে দিচ্ছে তার রাগ সহজে ভাঙ্গবেনা।ফারাজ অনেকক্ষণ ওর কোলে মাথা দিয়ে ছিল তাও কোনো নড়চড় না দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,’আমি কি চলে যাব?তুই এটাই চাস?’

সারথি আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি, ছেড়ে দিয়েছে অশ্রুর ঢল।ফারাজ আবারও ফ্লোরে বসে ওর চোখ মুছতে মুছতে বললো,’দাদাজান আমাকে জোর করে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন।কাল থেকে দুটো মেয়ের ব্যবস্থা ও করে ফেলেছেন।একটাকে দেখিয়ে দিছেন।আজ আরেকটা আসার কথা ছিল।খুব ব্যস্ত ছিলাম।আমাকে মেয়েদের মতন সাজিয়ে গুজিয়ে নিয়ে যেতো।তুই তো জানিস জীবনে আমি রঙচটা কিছু পরিনা।আর দাদাজান আমায় সাদা পাঞ্জাবি বাদ দিয়ে রঙিন পাঞ্জাবি পরিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে মেয়ে পক্ষের সামনে।
এত শত ঝামেলায় আমার মাথা থেকে একেবারে বেরিয়ে গেছিলো তুই বাসায় নেই।পরে একবার মনে হলো তুই বুঝি আমাদের সাথে রাগ করে সজীব ভাইয়ার বাসায় চলে গেছিস।এর বেশি মাথায় আসেনি তুই যে নিজরে বিপদ ডেকে আনতেই বেরিয়েছিলি’

সারথি কান্না থামিয়ে আবার নিরব হয়ে আছে।পূর্ণতা দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ভাইবোনের এই মূহুর্ত দেখে কান্না করছিল।সে আবার সারথির মতন করে নিঃশব্দে কাঁদতে পারেনা,ভ্যাঁ ভ্যাঁ করেই কেঁদে দিয়েছে।তার কান্নার আওয়াজে ফারাজ,সারথি একসাথে চুপ হয়ে গেছে।
আনাফ পেছন থেকে টিস্যুর বক্স নিয়ে এসে ওর হাতে দিলো।দিয়ে বললো,’ভাবী চোখ মুছেন’

পূর্ণতা চোখ মুছতে গিয়ে হঠাৎ মনে পড়লো আনাফ তাকে ভাবী বলেছে।মুখ তুলে কাঁদো কাঁদো স্বরে সে বললো,’ভাবী?আমি আপনার ভাবী হলাম কবে?’

‘সারথির ভাবী মানে আমারও ভাবী’

‘মানেহ!সারথি আপুর ভাবী হলাম কবে?’

‘ওমা!সারথি তো বললো আপনার সাথে ফারাজ ভাইয়ের ইটিসিটি ‘

‘ইটিসিটি কি?’

‘প্রেম-সেম আর কি’

‘এগুলো সারথি আপু বলেছে?’

‘হ্যাঁ,নাহয় বলুন আমি আর কার থেকে জানবো?’

পূর্ণতা নাক মুছতে মুছতে ফারাজের কাছের দিকে গেলো।ফারাজ উঠে দাঁড়িয়ে ওকে ইশারা করে বললো রুম থেকে যেতে।সারথির সাথে ওর আরও কথা আছে।

‘আরে আমার জরুরি কথা আছে শুনুন’

‘আপাতত সারথির চেয়ে জরুরি বলে আমার কাছে আর কিছুই নেই।’

সারথি সেসময় ঘুরে বললো,’পূর্ণাও এসেছে?’

‘হ্যাঁ।জোর করে এসেছে।নাহলে আমি জেনেবুঝে কেন ঘাড়ে করে একটা বোঝা নিয়ে আসবো?’

‘আমি বোঝা?জানো আপু!তোমার ভাই এত ন্যাকামি করে!বাসের জানালা খুলতে দেয়না আমাকে’

সারথি হেসে বললো ওর হাঁপানির সমস্যা আছে।

‘ভাল হয়েছে আমি শুরুতেই ওনাকে বিয়ে করতে না করে দিয়েছি তা নাহলে বাসর রাতে বলতো,’পূর্ণা আমার দম বন্ধ হয়ে আসতেছে।ইনহেলার আনো’

আনাফ কথাটা শুনে খিলখিল করে হেসে দিলো।সারথিও হাসছে।মাঝ দিয়ে ফারাজ রেগে গিয়ে বললো,’ম্যাচিউর মানুষদের সামনে এগুলো কোন ধরনের কথাবার্তা? ‘

‘আমিও তো ম্যাচিউর’

‘বয়স বাড়লেই ম্যাচিউর বলেনা।বয়স যে বেড়েছে তা কথাবার্তায় প্রকাশ পেতে হয়।আর আপনি যে উজবুক তার প্রমাণ দিলেন আজকে’

পূর্ণতা আরও কিছু বলতে চাইলো ওমনি সারথি ধমক দিয়ে ফারাজকে বললো,’শুরু থেকে দেখছি পূর্ণতাকে অপমান করে কথা বলিস।ও আমাদের আত্নীয় এবং মেহমান।সুন্দর করে কথা বলবি এখন থেকে’

‘বেশি সুন্দর করতে গেলে দেখা গেলো দাদাজান ধরে বিয়ে পরিয়ে দেবেন,আজ একটুর জন্য কাবিন হয়ে যেতো’

চলবে♥#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৩২
#আফনান_লারা
________
সারথি হাত বাড়িয়ে ফারাজের হাতটা খুঁজে বের করে ধরে মুচকি হেসে বলো,’মন্দ কি?পূর্ণতা কিন্তু দারুণ একটা মেয়ে’

‘সব দারুণ ফারাজের কেন হবে?’

কথাটা বলে ফারাজ চলে গেছে।পূর্ণতা মুখটাকে যতটা বাঁকাতে পেরেছে বাঁকিয়ে রেখেছে।সারথি না দেখলেও আনাফ তা দেখে হেসে বললো,’দুজন দুজনের প্রতি এত ঘৃনা রাখা ঠিক না ‘

‘কেনো?’

‘ঘৃনায় ঘৃনায় কাটাকাটি হয়ে প্রেম হয়ে যায়।জানেননা?বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমাণিত ‘

পূর্ণতা বিষয়টাকে তুচ্ছ হিসেবে ধরে রুম ছেড়ে বেরিয়ে চলে গেছে।সারথি হাসতে হাসতে পিছিয়ে যাচ্ছিল একটু একটু করে।আর একটু গেলেই পিঠে ধাক্কা খাবে ওয়ারড্রবের সাথে।ঠিক সেসময় আনাফ হাত রেখে ফেললো সেখানে।
পিঠ লাগতেই সারথি টের পায় আনাফ আগলে রাখার জন্য হাত বাড়িয়ে রেখেছে।সে সরে দাঁড়িয়ে মুখটা ফ্যাকাসে করে বললো,’আপনাকে আমার একটা কথা বলার আছে’

‘নির্দ্বিধায় বলতে পারেন,আমি শুনছি’

‘আমার আর সজীবের এখনও ডিভোর্স হয়নি।আমরা আইনত স্বামী স্ত্রী। অথচ আমি একটা অবিবাহিত ছেলের বাসায় থাকতে এসেছি এটা সমাজকে না দেখালে হয়ত দেখবেনা,কিন্তু আমি তো দেখছি।আমার বিবেক বোধ তো তা করতে দেবেনা আমায়,আর আমি চাইওনা সেটা।আমি ফারাজের সাথে ফিরে যেতে চাই।আপনার কি মত?’

আনাফ হাতটা যেভাবে ওয়ারড্রবে লাগিয়ে রেখেছিল সেভাবেই রেখেছে।সারথির বিরাট বড় ভাষণ শুনে একটু একটু করে সারথির একেবারে কাছে ঘেঁষে দাঁড়ায় সে।
গোসল করে আতর লাগিয়েছিল।সারথি সেই আতরের গন্ধটা তীব্র আকারে পাচ্ছে এখন ।সে বুঝে গেছে আনাফ তার একদম কাছে তাও সে যে জায়গায় ছিল সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল।আনাফ এবার গলার আওয়াজ হালকা করে বললো,’একদিন আমার এই হাতে এই পিঠটাই ইচ্ছাকৃত লাগবে।সেদিনের অপেক্ষায় আপনাকে যাবার অনুমতি দিলাম।সাবধানে যাবেন,তবে আর একদিন যদি শুনি সুইসাইডের চিন্তাভাবনা করেছেন তবে সেই মূহুর্তে সজীবকে কল করে বাংলাদেশে আনার ব্যবস্থা করে,ওকে আনিয়ে ডিভোর্স করিয়ে আপনাকে বিয়ে করে নিয়ে চলে আসবো।এটা আমার শেষ কথা।আপনি সজীবের না,আপনি আমার।ডাঃ আনাফের উড বি।এখন যান’

আনাফ চলে গেলো।সারথি রোবটের মতন দাঁড়িয়ে আছে শুধু।একটা মানুষকে বিয়ের পর থেকে হাজার হাজার চেষ্টা করেও সে ধরে রাখতে পারেনি আর এই মানুষটাকে কিছু না করেও নিজের করে পেয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন।

আনাফ ফারাজ পূর্ণতার কাছে না গিয়ে করিডোর ঘেঁষে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে ফেলেছে।সারথির হুশ ফিরলো ফারাজের ডাকে।ফারাজ জানতে চাইছে ও যাবে কিনা,না গেলে ফারাজ চলে যাবে।থাকলে থাকতে পারে এখানে।জোরাজুরি নাই।সব চাইতে জরুরি সারথির ভাল থাকা।
সারথি চুপচাপ ফারাজের সাথে বেরিয়ে চলে গেছে।যাবার পথে অধরাকে ধরে চোখের পানি ফেলেছিল।বাসা থেকে বের হয়ে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে রিকশা খুঁজছিল ফারাজ।সারথির শুস্ক চুলগুলো বারে বারে উড়ছিল।দমকা হাওয়ায় বারবার মনে হচ্ছিল পেছন থেকে আনাফ তাকে দেখছে।তাকে দেখার জোর নাই সারথির,কোনো ক্ষমতা নাই। আছে কেবল অনুভূতি।সেই অনুভূতির শক্তি দিয়ে সে দিব্যি বুঝতে পারছে আনাফ ডাকে দেখছে।
এবং সে জানে তার আন্দাজ সঠিক।একবার পেছনে ফিরে হাত উপরে তুলে সে নাড়ালো।বিদায় জানালো।
আনাফ সত্যি সেখানে ছিল বারান্দায় দাঁরিয়ে। এতক্ষণ ওকে দেখছিল।তাকে অবাক করে দিয়ে সারথি হাত নাড়িয়েছে বলে সে এত খুশি হলো যেটা সে প্রকাশই করতে পারছিলনা।সারথি কিভাবে বুঝলো সে ওকে দেখছে।মনের মিল এভাবে কি করে হতে পারে!
সারথি আবারও সামনে মুড়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

আনাফের চোখ দিয়ে পানি ঝরছে।একটা অন্ধ মেয়ের অনুভূতি এতটা শক্ত হতে পারে দেখে সে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছেনা।তার চয়েস করা মানুষটা যে সঠিক তার প্রমাণ পেয়ে সে খুশিতে কাঁদছে।চোখ মুছে পেছনে ফিরতেই দেখলো অধরা দাঁড়িয়ে আছে।আনাফ চোখ মুছে জানতে চাইলো কি কারণে এসেছে সে।
অধরা বললো,’সারথি আপু আবার কবে আসবে জানো?’

‘জানি ‘

‘কবে? ‘

‘আজ থেকে ঠিক দু মাস পর’

‘এতদিন কেন আসবেনা?’

‘আমি আনবোনা তাই’

‘তুমি কেন আনবেনা?’

‘ওর বিয়ের বয়সনি তাই।দু মাসে পরিপক্ব হবে তারপর আনবো,এখন যা সামনে থেকে।আমি একটু গান শুনবো, তারপর ঘুমাবো’

অধরা ভেংচি কেটে চলে গেছে।
————
সজীব লেভেনকে
শান্ত করে বাংলাদেশের টিকেট কেটে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনাও দিয়ে ফেলেছে। সারথির সাথে ডিভোর্স নিয়ে কথা বলে ডিভোর্স দিয়ে তারপর সে ফিরে আসবে একেবারে লেভেনের হয়ে।একসাথে বসে কথা বলার কারণ হচ্ছে সারথিকে বোঝানো।সে সজীবকে নিয়ে উন্মাদ হয়ে গেছে যার কারণে সজীবের অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে শুনে সে নিজের ক্ষতি করার চেষ্টা করছে।তাকে বিষয়টা নিয়ে বোঝাতে হবে।
এয়ারপোর্টে এসে ফোন বন্ধ করে ফেলেছে সজীব।মা ফোন করেও পাবেনা কারণ এই নাম্বারটা মালেশিয়ার।সে মাকেও জানাতে চায়না এ ব্যাপারে।কারণ মা জানলে কখনওই ডিভোর্স হতে দিবেন না।
——–
সারথি বাড়ি ফেরার পর থেকে একবারও ঠিক করে দম ফেলতে পারেনি।বাবা মা,দাদাজান,কাকি সহ সকলে ঘিরে ধরেছে তাকে।সে কোথায় ছিল,কি জন্যে না বলে বেরিয়েছিল সকলের একই প্রশ্ন।ফারাজ সবার থেকে ওকে বাঁচিয়ে সোজা রুমে নিয়ে দিয়ে এসেছে।এবার সবাই ফারাজকে ধরেছে মূল বিষয় নিয়ে বলার জন্য।
শেষে ফারাজ বলে দিলো সারথি তার এক বান্ধুবীর বাসায় গিয়েছিল। এর বেশি কিছু হয়নি।
তারপর সবাই শান্ত হয়ে যার যার কাজে গেছে।কিন্তু মিসেস সোনালীর মনে শান্তি আসলোনা।তার চিন্তা হয় সারথিকে নিয়ে।ওর মুখের ফ্যাকাসে ভাবটা বারবার করে বলে দেয় সে ভাল নেই,সে বড় কষ্টে আছে।
এক গ্লাস দুধ নিয়ে তিনি সারথির রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন এইসব ভেবে।ঢুকবেন কিনা তা নিয়ে সংশয়ে আছেন।সজীবের সাথে জোর করে বিয়ে দেবার পর থেকে তার আর সারথির সম্পর্কটা একেবারে কেমন যেন পানসে হয়ে গেছে।
মা মেয়ের সম্পর্ক যত ভাঙ্গাই হোক না কেন,দিন শেষে ঠিক জোড়া লেগে যায়।কিন্তু সারথির আর সোনালীর বেলায় কেন যেন মিল খাচ্ছেনা।
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তিনি মন খারাপ নিয়ে আবার ফেরত চলে যাচ্ছিলেন তখন পূর্ণতা এসে দাঁড়ায় তার সামনে।ওনার দিকে চেয়ে থেকে হাসিমুখে সে বললো,’আপনি না মা??আপনার কিসের ভয়?সারথি আপু আপনারই সন্তান।জানি, হয়ত মনমালিন্য আছে তবে সেই মনমালিন্যর কি এতই জোর যে মা মেয়ের জড়িয়ে ধরাতেও টিকে থাকতে পারবে?একবার গিয়ে জড়িয়ে ধরুন,দেখবেন যত শত বছরই হোক না কেন ঠিক সব ধুয়ে মুছে যাবে।’

পূর্ণতার থেকে সাহস পেয়ে মিসেস সোনালী দরজা ফাঁক করে সারথির নাম নিয়ে ভেতরে গেলেন।সারথি তখন জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে ছিল।মায়ের পায়ের আওয়াজ পেয়েও কোনো নড়চড় করেনি সে।
তিনি গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে একটু এগিয়ে দাঁড়ালেন।সারথি তখন পেছনে ফিরলো।বললো,’কি চাই?’

‘ভাল আছিস?’

‘যেমন মানুষ ভাল রাখছে, তেমনই বেশ ভাল আছি’

মিসেস সোনালী আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেননা।এগিয়ে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফেললেন।

সারথি অবাক হয়ে গেলো।সে ভাবেনি মা এমনটা করবে।
কাঁদতে চায়নি আজ তাও চোখ ভিজে গেলো অশ্রুতে।প্রকৃতির কি নিয়ম!
সারথি হঠাৎ বলে উঠলো,’মা আই এম সরি।অনেক কষ্ট দিয়ে কথা বলেছি তোমায়’

‘আমিও সরি রে মা আমার’

পূর্ণতা দূর থেকে দেখে মুচকি হেসে পেছন ফিরতেই ফারাজের সাথে এক ধাক্কা খেলো।ফারাজ কোমড়ে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে।ওকে দেখে পূর্ণতা থতমত খেয়ে গেছে।

ফারাজ প্রথমে রাগী লুক নিয়ে থাকলেও হঠাৎ মুখটাতে হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো,’ধন্যবাদ’

‘কেনো?’

‘মা আর সারথিকে মিলিয়ে দেয়ার জন্য’

‘বুঝতে হবে আমি যে জিনিয়াস!’

‘একটা কাজ ঠিকঠাক করলেই জিনিয়াস হওয়া যায়না।আরও পারতে হয়’

‘তো বলুন আর কার সাথে কার মেলাতে হবে?’

‘আজিজ দাদু দাদাজানের ঘরে বসে চা খাচ্ছেন, দেখে এলাম।আমাদের বিয়ে দেয়ার ফন্দি আঁটছে’

‘আপনাকে না দেখতে আসার কথা ছিল?’

‘আমি তো বাসায় ছিলাম না,আর যে মেয়ের ভাই দেখতে আসবে সে নাকি ঘুরেটুরে চলে গেছে’

‘আপনার বিয়ের দায়িত্ব আজ থেকে আমার।ঐ মেয়ের ভাইকে ঘাঁড় ধরে টেনে নিয়ে আসার দায়িত্ব ও আমার।বাই’

আঁচল ঘুরাতে ঘুরাতে পূর্ণা চলে গেলো।ফারাজ তাচ্ছিল্য করেছে ওর কথাগুলোকে।কারণ পূর্ণা যে টাইপের মেয়ে।কোনো কাজ ঠিক করে করতেই পারেনা,একটা না একটা ভেজাল বাঁধাবেই।এক শতাংশে তার নিরানব্বই ভাগই থাকে ভুল দিয়ে ভরা।ওর থেকে আর কি আশা করা যায়!
———
আজিজ খান চা খেতে খেতে রুম থেকে বের হতেই দেখলেন পূর্ণতা নাচতে নাচতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে।

‘নাতিন শুনো!’

আজিজ খানের গলা শুনে পূর্ণা পালানোর জন্য দিলো এক দৌড়।ওমনি সিঁড়িতে বেসামাল হয়ে ধপাস করে পড়ে গেলো।আজিজ খান ওখানে এসে বললেন,’গুরুজনের ডাকে সাড়া দিতে হয় তা নাহলে বিপদ হয়,দেখলে তো!কোমড় ভেঙ্গেছে?’

‘নাহ,মন ভেঙ্গেছে’

‘আহা এই টুকুন মেয়ের মন ভাঙ্গলো কেন?’

পূর্ণতা উঠে দাঁড়িয়ে কথাটাকে এড়িয়ে জানতে চাইলো উনি ডাকলেন কি জন্য।

‘আমি ডাকলাম তোমার হাত দেখতে।আমি ভাল হাত দেখতে জানি,বলতে পারো জ্যোতিষী।তোমার হাত দেখে বলে দিবো তোমার সাথে ফারাজের বিয়ে হবে কিনা’

‘এগুলা ভুয়া।আমি বিশ্বাস করিনা’

‘আমি তো করি।দেখি সোফায় বসো’

কথাটা বলে উনি পূর্ণাকে জোর করে সোফায় বসিয়ে দিয়ে ওর হাত ধরে ম্যাগনিফায়িং গ্লাস দিয়ে চেক করা শুরু করে দিয়েছেন।
অনেকক্ষণ ধরে দেখে বললেন,’হুমমমমমমম!তোমার বিয়ে হবে মিরাজুলের সাথে’

‘তার মানে ফারাজ ভাইয়ার সাথে হবেনা।আমি খুব খুশি।আপনাকে বকশিশ কত দিতে হবে?’

‘মিরাজুল ফারাজের আরেক নাম।বেলায়েত রেখেছিল এই নাম।তুমি জানোনা?বকশিশ দিতে চাও?তাহলে গরম গরম জিলাপি বানিয়ে খাওয়াও।খুব খাওয়ার ইচ্ছা জেগেছে।’

পূর্ণতা বিড়বিড় করতে করতে উঠে চলে গেছে।আজিজ খান উঠতে যেতেই মতিন এসে ফ্লোরে বসে গিয়ে হাত পেতে বললো,’দাদাভাই আমার হাতটাও দেখে দেন আপনাকে লেবুর শরবত করে খাওয়াবো’

‘তোমাদের টাংকির পানি দিয়ে না তো?’

‘না, সাপ্লাই পানি দিয়ে’

‘তাহলে দাও দেখি তোমার কপাল কেমন পোড়া ‘

অনেকক্ষণ ধরে দেখেই যাচ্ছেন তিনি।শেষে মতিন বাধ্য হয়ে জানতে চাইলো কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা।তখন আজিজ খান বলেন,’তুমি তো দেখি এই এলাকার সবগুলো কাজের বুয়ার সাথে লাইন মেরেছো।এখন আবার বানু নামের একটা মেয়ের সাথে লাইন মারতেছো!’

‘না ডাহা মিছা কথা।আপনি হাত মুছে তারপর আবার দেখেন’

আজিজ খান আবার দেখে বললেন,’তোমার সামনে বিরাট বড় লস হতে যাচ্ছে’

‘কি সেটা?’

‘তোমার তো বানুর সাথে বিয়ে হবে’

‘তাহলো লস কেন?’

‘বানুই তোমার লস করবে।কাবিনের টাকা নিয়ে পালাবে’

‘তাহলে কি বিয়ে করবোনা?’

‘বিয়ে তো করতেই হবে।লেখা আছে তোমার বানুর সাথেই বিয়ে হবে’

চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here