পর্ব ৭+৮
#তুই_আমার_সুরঞ্জনা
Part–7
#Arishan_Nur
প্রমিতি অসহায় হয়ে মাত্র আসা ব্যক্তিটির দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ-মুখ ফোলা ফোলা। চোখ গুলো টলমল করছে। ঠিক এই বুঝি চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়বে।
নিরব ধীর পায়ে প্রমিতির দিকে এগুলো। এতোক্ষন তার খুব তাড়া ছিল, ব্যস্ততা কাজ করছিল মনের মধ্যে। কিন্তু হুট করে কেন যেন সবকিছু থেমে গেছে। সে হঠাৎ ঘামতে শুরু করল। মনের মধ্যে কেমন যেন তোলপাড় শুরু হলো। তার কপাল বেয়ে ঘাম ছুটতে লাগলো।
সে কাপা কাপা ঠোঁটে বিরবির করে বলে, ও আল্লাহ!
প্রমিতি চোখ তুলে সামনে থাকা ব্যক্তিটার দিকে তাকালো । বেশ লম্বা ছেলেটা। কালো শার্ট পড়া। শার্ট ইন করে রেখেছে। চুল গুলো খুব সুন্দর করে গুছানো। প্রমিতি পরখ করে দেখে নেয় ছেলেটাকে।
নার্সটা নিরব কে দেখিয়ে প্রমিতির উদ্দেশ্য বলে উঠে, ওনাকে চিনতে পেরেছেন?
প্রমিতি কাদো কাদো হয়ে বলে, নাহ,,,,,,,
নাসটা আবারো বলে, ভালো করে দেখুন তো! চিনেন আপনি ওনাকে?
নিরব কি বলবে বুঝে পাচ্ছে না। মেয়েটা তো তাকে আসলেই চিনে না। কি এক মসিবত রে বাবা!
প্রমিতি আবারো নিরবের দিকে তাকালো । সোজা তার চোখে চোখ রাখল।
নিরব সেই দৃষ্টি উপক্ষে করে বরকতের দিকে তাকালো ।
বরকত ও বেশ মনোযোগ দিয়ে প্রমিতির দিকে তাকিয়ে আছে।
কিছু ক্ষন পিনপিনা নিরবরা। তার পর হুট করে প্রমিতি তার মাথা চেপে ধরে কাদতে কাদতে বলে, আমি কিছু ই মনে করতে পারছি না। মাথায় খুব ব্যথা হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি মারা যাচ্ছি। খুবই কষ্ট হচ্ছে আমার! আমার,,,, আমার কিছু ই মনে নেই।
নিরব এবার প্রমিতির দিকে তাকালো । মেয়েটা কেমন অস্থির করছে। কাদলে মেয়েটার ঠোঁট দুটি মূহুর্তের মধ্যে লাল হয়ে যায়। নিরব এক দৃষ্টিতে প্রমিতির দিকে তাকিয়ে থাকে।
আর প্রমিতি মাথা নিচু করে বসে থাকে।
এবার নিরব একটা পরীক্ষা করল। তা হলো সে বেশ জোরে করেই প্রমিতি বলে ডেকে উঠে৷
কিন্তু প্রমিতি সাড়া দেয় না। সে চুপচাপ মাথা নিচু করেই আগে যেভাবে বসে ছিল সেভাবেই বসে আছে। কোন নড়চড় নেই। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা না। বিজ্ঞান তো অন্য কিছু বলে!
নিজের নাম শুনে রেসপন্স করাকে প্রতিবর্তী ক্রিয়া বলে।
প্রতিবর্তী ক্রিয়া বলতে উদ্দীপনার আকস্মিকতা এবং তার কারনে স্বয়ংক্রিয় প্রতিক্রিয়াকে বোঝায়৷ হঠাৎ আঙুলে সুচ ফুটলে যেমন হাত আপনা আপনি সরিয়ে নিই ঠিক তেমনি নিজের নাম শুনলে আশেপাশে তাকানো বা “কি” বলে ডাকা কিংবা চোখ নাচানোও এক ধরনের প্রতিবর্তী ক্রিয়া। আর এই ক্রিয়া মস্তিষ্ক থেকে ক্রিয়েট হয় না বরং সুষুম্নাকাণ্ড নিয়ে নিয়ন্ত্রিত ।
তাই নাম ধরে ডাকলে মানুষ রেসপন্স করবেই কেননা ছোটকাল থেকেই সে তার নাম শুনে আসছে। তাই তো নিজের নামের মতো কোন নাম শুনলেও মানুষ আশেপাশে তাকাবে মূলত মস্তিষ্কে উদ্দীপনা ঘটার কারনে। কিন্তু মেয়েটা কোন সাড়া দিল না কেন? তবে কি মেয়েটার নাম প্রমিতি না ?
তবে কি সত্যিই সে সব ভুলে গেছে। কিন্তু এটা কেমনে সম্ভব? মেডিকেল সাইন্সে এমন কিছু কোন দিন সে এই জনমে শুনে নি যে এক্সিডেন্ট করে মাথায় আঘাত পেল আর নাম,ঠিকানা ভুলে গেল। এটা অসম্ভব! এমন কিছু হলো সম্পূর্ণ মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে পড়বে৷
স্মৃতি ধারনের ক্ষমতা চলে-টলে গেল নাকি!
নিরবের কানে গুনগুনিয়ে কান্না করার আওয়াজ আসল।
সে এসব চিন্তা ছেড়ে সামনে আগাতেই কালকের সেই লেডি ডাক্তারের আগমন।
উনি এসেই প্রমিতির কাছে গিয়ে বলে, এই যে মিসেস, আপনি নাকি স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন?
প্রমিতি কাদতেই থাকল। কোন উত্তর দিল না।
ডাক্তার টা বলল, আরে! কাদার কি আছে? আপনার হ্যাসবেন্ডই তো আপনার সাথে আছে। সমস্যা কোথায়? তাই না? নিরবের দিকে তাকালো ডাক্তার টা৷
নিরব ও আহাম্মকের মতো করে হেসে বলে হ্যা। আসলেই তো ! দেয়ার ইস নো সমস্যা।
–উনি হলো আপনার স্বামী! আপনার ভরসার স্থান।
প্রমিতি চোখ তুলে নিবের দিকে আবারো তাকালো।
নিরব এবার আর সেই চাউনি উপেক্ষা করতে পারল না৷ সেও প্রমিতির চোখে চোখ রাখল। তার কেমন জানি লাগতে শুরু করল। আবারো ঘামতে লাগে নিরব।
ডাক্তার টা বলল, আপনি আপনার ফ্যামিলির সাথেই আছেন।সো নো ওরিস। কোন কিছু মনে না থাকলেও চলবে। আপনার হ্যাসবেন্ড আপনাকে আগলে রাখবে৷ তাই না মিস্টার চৌধুরি?
নিরব ছোট্ট করে হু বলে।
লেডি ডাক্তার টা আগ বাড়িয়ে বলে, আপনার হ্যাসবেন্ড আপনাকে অনেক ভালোবাসে! আপনারা তো হানিমুনে যেতে চাচ্ছিলেন। মনে আছে এসব কথা?
প্রমিতি না বলল।
–সমস্যা নেই। আস্তে আস্তে মনে পড়বে।
বলে ডাক্তারটা হাটা দিল। নিরব ও তার পিছনে পিছনে এসে তাকে ডাকতে লাগে।
এবার ডাক্তারটা ভ্রু কুচকে বলে উঠে, আমি তো আগেই বলেছিলাম ওল ম্যান ইস এ ডগ। ভেবেছিলাম আপনি লয়াল। কিন্তু বউ অসুস্থ এই সুযোগে অন্য মহিলার সাথে লাইন মারতে চলে আসলেন।
নিরব মুখ বাকিয়ে বিরবির করে বলে, আমার আর খায়ে-দায়ে কাজ নাই! আপনার মতো বুড়ি আন্টির লগে লাইন মারব? এবং প্রকাশ্য বলে, আরে না আপা!ভুল ভাবছেন আমাকে। আমি তো কথা বলতে এসেছি ওর ব্যাপারেই।
এমন সময় বরকতও চলে এলো তাদের কাছে।
ডাক্তারটা বলে, কি বলবেন?
–মানে আপনি কোন দিন এমন কেস পেয়েছেন যেখানে এভাবে একজন রুগী সব ভুলে যায়? মানে স্মৃতিশক্তি?
ডাক্তার টা ভেবে বলে, না। পাইনি। তবে আজকে পেলাম।
–এই তো! মেডিকেল সাইন্স এ এমন কিছু কোন দিন হয় না।
–হয়। হয়। আই নো। এমন হয়। (ডাক্তার টা)
নিরব এবার বলল, আচ্ছা কোথায় হইসে একটু বলেন তো আমিও শুনি।
ডাক্তার টা একদন্ড না থেমে বলে, কোথায় আবার! স্টার জলসা আর জি বাংলা, স্টার প্লাসেও দেখেছি।
নিরব আকাশ থেকে পড়ল। সে কড়া গলায় বলে, স্টার জলসা আর জীবন কি এক?
ডাক্তার টা হাত গুটিয়ে বলে, স্টার জলসা আর জীবন এক না হলেও জীবন মানেই জি বাংলা!
নিরবের নিজের চুল ছিড়তে ইচ্ছা করছে৷ সে কটমট করে বলে, এইসব সিরিয়ালে হলেও বাস্তবে কোন দিন সম্ভব না। আর আপনি ডাক্তার হয়েও এমন লজিকলেস কথা কেমনে বলছেন?
ডাক্তার টা বলল, মেডিকেল সাইন্স এ সব সম্ভব। । আর জীবনের কাহিনি থেকেই সিরিয়াল বানানো হয়।
এইটুকু বলে তিনি চলে গেলেন।
এবার বরকত বলল, আমারো মনে হয় মেয়েটার সত্যি কিছু মনে নাই। দেখলি কেমনে কাদছে?
নিরব মুখ কালো করে বলে, সব ঢং! যেই না দেখছে নিরব চৌধুরি তাকে বাচাইছে,ওমনি আমাকে ফাসানোর জন্য এইসব করছে মেয়েটা।
–মেয়েটা শুধু শুধু তোকে কেন ফাসাতে যাবে?
–কেন আবার! আই আম রিচ। দ্যাটস হুয়াই।
–দেখ! টাকার গরম কম দেখা। ও তো জানেও না তুই কে। আর মনে হচ্ছে মেয়েটা তার গুরুমস্তিষ্কে আঘাত পাইসে। এজন্য ই ওর স্মৃতি শক্তি লোপ পেয়েছে৷
নিরব পকেটে হাত ঢুকিয়ে বলে, আচ্ছা। যা মেনে নিলাম গুরুমস্তিষ্কে ব্যথা পেয়েছে। তাই স্মৃতি শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। তাই যদি হয় তাহলে সে বসে আছে কেমনে? বাকি সব তো ঠিক আছে। আবার যখন ডাক্তার টা বলল, কিছু মনে আছে কিনা তখন কিভাবে না বলল?
ওর যদি কিছু নাই মনে থাকে দেন ও কেমনে জানল, ‘না’ একটা নেগেটিভ অর্থ বহন করে। বল? এটার উত্তর দে?
–দোস। ওর স্মৃতি শক্তি লোপ পেয়েছে।হয়তো পনসে লাগে নি তাই সমন্বয়, ভারসাম্য ঠিক রাখতে পেরেছে।
–দেখ। বিজ্ঞানের কোথাও এমন গাজাখরি কথা বলা নেই ।
বরকত এবার বলে, কেন রে এতো বিজ্ঞান বিজ্ঞান করছিস? তুই কি বিজ্ঞানী?
–হু।আমি বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানী নিরব। খুশি?
–আচ্ছা। লিনাকে এব্যাপারটা জানাই। দেখি ও কি বলে। ওর উত্তরের উপর ভিত্তি করে আমরা ডিসিশন নিব যে মেয়েটা সত্য বলছে কিনা৷ লিনা যদি বলে স্মৃতি শক্তি লোপ পাওয়া সম্ভব দেন মেয়েটার রেসপনসেবলিটি তোর। আর যদি বলে অসম্ভব তবে মেয়েটাকে রেখে আমরা এখনি চলে যাব।
–হো। জানা।।ও আমার মতোই কথা বলবে। আর আমরা মেয়েটাকে ফেলে রেখে চলে যাব।
বরকত লিনাকে কল লাগালো। লিনা ফোন উঠালো।
বরকত লাউডস্পিকার এ দিয়ে লিনাকে এসব কিছু জানিয়ে দিল৷
সব জানানোর পর নিরব প্রশ্ন করল,লিনা এটা কি সম্ভব যে একজন ব্যক্তি মাথায় আঘাত পেলে সব ভুলে যাবে?
লিনা ওপাশ থেকে বলে, হ্যা। সম্ভব!
নিরব বলল, তুমি এমন কাউকে দেখেছো যার স্মৃতি শক্তি লোপ পেয়েছে?
–হ্যা দেখেছি।
নিরব উত্তেজিত হয়ে বলে, কে? নাম কি?
–জুই।
নিরব প্রশ্ন করে, জুই কে?
লিনা এবার উত্তরে বলে, আরে ওই যে হিন্দি সিরিয়ালের একটা নায়িকা (কাল্পনিক )
নিরব বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। কিছু বলার নেই তার। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সিরিয়ালের লেইম কাহিনি প্রভাব ফেলে বারোটা বাজাচ্ছে সবার। মানে লিনার মতো এতো সাকসেসফুল বিসনেস ওম্যান ও এই ধরনের কথা বলতে পারল? বিজ্ঞানের এভাবে অপমান! বিজ্ঞানের চেয়ে সিরিয়াল বেশি নির্ভরযোগ্য মানুষের কাছে! সত্যিই ব্যাপার টা কষ্টজনক।
সে দিব্যি বুঝতে পারছে প্রমিতি নামের মেয়েটা তাকে ঘোল খাওয়াচ্ছে। সব কিছু তাকে ফাসানোর জন্য করছে। সব মেয়েরাই লোভী৷ টাকার জন্য এমন মিথ্যা অভিনয় করছে৷
Part–8
#Arishan_Nur
নিরব বরকতের দিকে তাকালো। বরকত তৃপ্তিময় হাসি হেসে বলে, এবার তো বিশ্বাস হলো তোর?
–না। হয় নি৷
–মানে এখনো বলতে চাস যে মানুষের স্মৃতি শক্তি লোপ পায় না?
–হ্যা। পায় না। (জোড় গলায়)
বরকত একটা শ্বাস ফেলল এবং বলল, ঘাড়ত্যাড়ামি বাদ দে। তুই ওয়াদা করেছিলিস যে লিনা যদি বলে মানুষের স্মৃতিশক্তি হারিয়ে যেতে পারে তবে মেয়েটার রেসপন্সেবিলিটি নিবি। মনে আছে তো সেই কথা নাকি ভুলে গেলি?
নিরব এবার চোখ সরু করে বলে, আমাকে একটা কথা একবার বললেই হয়। সহজে ভুলে নি।
–এবার প্রমিতিকে বাসায় নিয়ে যা। ও সুস্থ হোক। তারপর একটা ব্যবস্থা নিব।
নিরব ভ্রু কুচকে বলে, ওই মেয়েকে আমার বাসায় নিয়ে যাব?
–হুম।
–নো ওয়ে। ওই মেয়ে কেন আমার বাসায় যাবে?
–কারন মেয়েটা তোর বউ হয়। (মজা করে)
–বরকত! (রাগী গলায়)
–আচ্ছা। সর্যি। কিন্তু প্রমিতির আজকে এই অবস্থা তোর জন্য ই তো হয়েছে তাই না?
নিরব কিছু বলল না।
বরকত এবার বলে, যেহুতু তুই ভুল করেছিস, আইনের ভাষায় কিন্তু এটা অপরাধ। সুতরাং তোকে এর ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তাই প্রমিতিকে বাসায় নিয়ে যা। সেবা কর। বুঝলি?
নিরব মুখ গোমড়া করে বলে, বাসায় নিয়ে যাওয়া যাবে না৷ ওকে আমি বরং কোন হোটেলে রাখব। দরকার হলে ফাইভ স্টার হোটেলে রাখব। হোটেলে খাবে-দাবে, থাকবে। সুয়িংমিং পুলে ঘুরবে। বিল দিব আমি। নো ওরিস!
বরকত কিছু একটা ভেবে বলে, আচ্ছা। কিন্তু মেয়েটাকে কি বলবি?
–ডোন্ট নো।
–একটা মেয়ে একা হোটেলে থাকবে, এটা কি সেইভ?
–আরে হ্যা। সেইভ ই থাকবে।
–তুই প্রতিদিন অফিস করে প্রমিতিকে দেখে তারপর বাসায় যাবি ।
নিরব মেকি হাসি হেসে বলে, হ্যা। হ্যা। চল বের হই হাসপাতাল থেকে। তুই ওকে নিয়ে পাকিং লটে যা। আমি হাসপাতালের বিল মিটিয়ে বের হচ্ছি। জাস্ট দুই মিনিট লাগবে।
বরকত আচ্ছা বলে প্রমিতির কাছে গেল।
প্রমিতি এখনো মাথা নিচু করে বসে আছে।
বরকত ভেতরে ঢুকে বলে, এই যে আপু! মাথা টা একটু উচু করো।
প্রমিতি মাথা উচিয়ে দেখে নিল কে এসেছে। তারপর আবার মাথা নিচু করে বসে থাকল।
বরকত বলল, এখন আমরা বাসায় যাব। বুঝেছে? উঠো এবার। ফ্রেস হতে চাও বা ওয়াশরুমে যাবে কি?
প্রমিতি মৃদ্যু গলায় বলে, উহু।
–আচ্ছা।তোমার নাম কিন্তু প্রমিতি।
প্রমিতি মাথা তুলে তাকালো। কিন্তু কিছু বলল না। চুপচাপ বসে রইল।
বরকতের ফোনে নিরবের কল এলো। নিরব ফোনের ওপাশ থেকে বলে, তোরা পার্কিং লটে যা। আমি আসছি৷
বরকত ফোন রেখে বলে, আপু৷ চল বের হই।
প্রমিতি উঠে দাড়ালো। এবং বরকতের সাথে গুটিগুটি পায়ে হাটা ধরল। তার পরনে এখনো লাল শাড়ি টি ই আছে। সে আচলটা ঠিক করে নিল। হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকার ফলে শাড়িটা কোচড়া-মোচড়া হয়ে আছে।
সে হাত দিয়ে আচলটা ধরে মাথা নিচু করেই হেটে চলল।
বরকত কে অনুসরণ করে প্রমিতি আগালো। তারা হাসপাতালের গেটের বাইরে আসতেই দেখল একটা কালো গাড়ি তাদের সামনে দাড়িয়ে আছে।
বরকত পেছনের গেটটা খুলে দিয়ে বলে, আসো, আপু, ভেতরে গিয়ে বস।
প্রমিতি ও বাধ্য মেয়ের মতো গাড়িতে উঠে বসে। আর এদিকে বরকত গেট লাগিয়ে সামনের সিটে গিয়ে বসে পড়ে।
প্রমিতি মনে মনে সেই লম্বা, কালো শার্ট পড়া ছেলেটাকে খুজচ্ছে।ওই যে ডাক্তার টার সাথে বেরিয়ে গেল আর তো দেখা মিলল না।
নিরব ড্রাইভিং সিটে বসে আছে। তারা দুইজন গাড়ি তে উঠে বসতেই সে ড্রাইভিং শুরু করল।
তার চোখ বারবার পেছনের সিটে বসা মেয়েটার দিকে আটকে যাচ্ছে। লুকিং গ্লাস দিয়ে নিরব মেয়েটাকে কিছুটা হলেও দেখতে পাচ্ছে। সে মেয়েটার চোখজোড়া ই দেখতে পাচ্ছে কেবল৷
চোখের চাউনি টা বেশ টানছে নিরব কে। কে জানে কেন এমন হচ্ছে নিরবের সাথে? প্রমিতির চোখ ছলছল করছে। আচ্ছা সে কি কান্না করছিল বা করছে? কে জানে?
নিরব দৃষ্টি সরিয়ে নিল। বরকত বলে উঠে, আমাকে সামনের রোডে নামায় দে।
নিরব বলে উঠে, কেন?
প্রমিতি ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা লোকটার ভয়েস শুনে খানিকটা কেপে উঠে। প্রমিতি একটা ঢোক গিলল। তার দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল।
বরকত বলে, কালকে রাত থেকে বাইরে। আজকে একবারো বাসায় যায়নি। বিকেল হয়ে এলো৷ লিনা চেতে যাবে। তুই তো জানিস ও একটুতেই রেগে যায়।
নিরব হেসে দিল।
নিরবের হাসির শব্দে প্রমিতির মাথা ভোভো করতে লাগলো। এমন কেন লাগতে শুরু করেছে তার? সে যদি ভুল না হয় তবে এটাই সেই কালো শার্ট পড়া সেই ছেলেটা। প্রমিতির হাত একটু একটু করে কাপতে লাগল।
গাড়ি সামনের রোডে এসে থামল। এখন ই বরকত নেমে যাবে।প্রমিতির খুব করে বলতে ইচ্ছে করছিল, ভাইয়া প্লিজ আপনি যায়েন না। আপনি গেলে আমি একা হয়ে যাব। আর আমি একা এই ছেলেটার সাথে থাকলে দম বন্ধ হয়ে মারা যাব। যাবেন না প্লিজ। কিন্তু এই কথা গুলো প্রমিতির মুখেই আটকা পড়ল। প্রকাশ্যে কিছু বলতে পারল না সে।
একটা সময় বরকত নেমে গেল। প্রমিতি অসহায় দৃষ্টিতে জানালার বাইরে চেয়ে রইল।
বরকত নামার পর ও নিরব গাড়ি স্টার্ট দিল না। বরং যেখানে থামিয়েছিল সেখানেই গাড়ি টা থামিয়ে রাখল। সে স্টেয়ারিং এ হাত দিয়ে বলে, তোমার সিটের সামনের পকেটে পানির বোতল আছে। বোতলটা আমাকে দাও তো। (ভারী কন্ঠে)
প্রমিতি অস্থির হয়ে গেল। তাকেই কি কিছু বলা হচ্ছে? তার মাথা ঘুরাতে লাগল। সে আশেপাশে তাকাতে লাগলো।
নিরব বলেন, তোমাকেই বলছি। তোমার সামনে একটা সিট পকেটে আছে।ওই পকেটেই বোতলটা আছে। বের করে দাও। (ভরাট কন্ঠে)
প্রমিতি রোবটের মতো হাতটা সিট পকেটে ঢুকালো এবং পানির বোতল বের করে হাত বাড়িয়ে দিল।
নিতব এবার বোতল সহ প্রমিতির হাত চেপে ধরে। নিরব প্রমিতির হাত স্পর্শ করতেই প্রমিতি কেপে উঠে। শরীরে এক শিহরণ বয়ে যায়।
আর নিরব খুব শক্ত করে প্রমিতির হাত ধরে ফেলে এবং লুকিং গ্লাসে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে, প্রমিতি!
প্রমিতি চুপচাপ বসেই থাকে। এমন কি চোখ ও স্থির থাকে তার।
নিরব সেকেন্ড টাইম প্রমিতির পরীক্ষা করল। প্রথমবার যখন তার নাম ধরে ডেকেছিল তখন সে প্রমিতির চোখ দেখতে পায় নি কারন সেই সময় প্রমিতির মাথা নিচু করে রাখা ছিল৷
নিরব প্রমিতির হাতটা চেপে ধরেই মনে মনে বলে, এবার ও পাশ করল। তবে কি সত্যিই মেয়েটা সব ভুলে গেছে। নিরব নিজেই আবার মনে মনে বলে, আরো একবার পরীক্ষা করে দেখি। এবার ও যদি পাশ করে তবে মেনে নিব মেয়েটা সব ভুলে গেছে৷ আর ফেল মারলে বুঝে নিব আমাকে ফাসানোর জন্য অভিনয় করেছে তখন এমন শাস্তি দিব যে ওর রুহ কেপে উঠবে।
প্রমিতি চুপচাপ নিরবের দিকে তাকিয়ে আছে৷ সে ভয়ে কিছু বলতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে সে মিরপুরের চিড়িয়াখানার বাঘের খাজার ভেতরে ঢুকে পড়েছে।
নিরব বলল।,আমি তোমার কে হই জানো?
প্রমিতি দ্রুত মাথা আবারো নিচু করে ফেলে।
নিরব বলল, কি হলো বল? আমি তোমার কে হই?
প্রমিতি কাপা গলায় বলে, আ,,,,আপনি,,,আপনি আমা,,,আমার স্বামী হ,,হন। (এইটুকু বলতেই হাপিয়ে গেল প্রমিতি)
কথাটা বলে প্রমিতি একটা বুক ভরে নিশ্বাস নিল।
নিরব কিছু টা বিরক্ত হলো। সে বলল, তোমার না কিছু ই মনে নেই? তবে এই কথা কিভাবে মনে আছে?
প্রমিতি আবারো ভয়ে ভয়ে বলে, সবাই বলছিল।ভাইয়াটা বলেছে।
নিরব বুঝল ভাইয়া মানে সে বরকতকে মিন করছে৷ নিরব মনে মনে গালি দিল বরকত।
সে এখনো প্রমিতির হাত অনেক শক্ত করেই ধরে আছে। ছাড়ার কোন নাম-গন্ধ নেই৷
প্রমিতি ব্যথা অনুভব করছে। কিন্তু ভয়ের জন্য বলতে পারছে না হাত ছেড়ে দিতে।
প্রমিতির চোখ এখনো ছলছল করছে।
এবার নিরব তার হাত ছেড়ে দিয়ে বোতলটা নিল। এবং বোতলের মুখ টা খুলে ঢকঢক করে পানি খেয়ে নিল৷
প্রমিতি একদৃষ্টিতে নিরবকে দেখে নিল।
নিরব পানি খেয়ে বোতলটা পেছনে ছুড়ে মারল। আরেকটু হলে প্রমিতির গায়ে লাগত কিন্তু লাগে নি।
প্রমিতি সরে আসে তাই ব্যথা পাওয়া থেকে রক্ষা পেল। নিরব এবার বলে উঠে, নামো।
–হ্যা?(কিছু না বুঝেই)
–গাড়ি থেকে নামো।
প্রমিতি কিছু না বুঝে নিরবের দিকে তাকালো।
নিরব তার চোখে চোখ রেখে কিছু টা ধমকে বলে, গাড়ি থেকে নামো।
প্রমিতি এবার নিরবের কথাটা বুঝতে পারল৷ কিন্তু মানল না।
প্রমিতি এবারো চুপ থেকে মাথা নিচু করল।
নিরব ভরাট কন্ঠে বলে, মাথা নিচু করলেই সব ঠিক হয়ে যায় না। বের হও গাড়ি থেকে।
প্রমিতি হতবাক হয়ে যায়। সে আস্তে আস্তে কি যেন বলল।
কথা বলার ভলিউম এতো কম ছিল যে যেটা নিরবের কান অব্দি গেল না। সে কেবল দেখল, প্রমিতি তার গোলাপী ঠোঁট দুটি নাড়াচ্ছে। কিন্তু কি বলল শুনতে পায় নি।
–জোড়ে বল যা বলতে চাও৷
–আ,,আমি,,
–হ্যা তুমি কি? (রেগে গিয়ে চিল্লিয়ে)
প্রমিতি নিরবের ধমক খেয়ে রীতিমতো কাপতে লাগে সেই সাথে ভয় ও পায়। হুট করে তার গাল বেয়ে একটা ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে৷
নিরব সেই অশ্রু দেখতে পেল৷
এবার নিরব প্রমিতির কোন কথা বলার অপেক্ষা না করেই নিজেই গাড়ি থেকে বের হয়ে প্রমিতিকে জোর করে গাড়ি থেকে নামালো। এবং রাস্তার সামনে দাড় করিয়ে নিজে গাড়িতে উঠে গাড়ি চালাতে শুরু করল৷
প্রমিতি হতবিহ্বল হয়ে গেল। সেই সাথে বাকরুদ্ধ ও। সে কেদে দিল এবং আস্তে করে নরম গলায় বলে, চলে গেলেন উনি আমাকে রাস্তায় একা ফেলে দিয়ে?
চলবে।