#তুমি_অতঃপর_তুমিই (পর্ব ১৩)
#Taniya_Sheikh
·
·
·
ইমার ঘুম ভাঙে মিষ্টি এক স্বপ্নে বিভোর হয়ে। ঘুম ভাঙার পরও কাটে না সে রেশ। দরজা খোলার শব্দে গায়ে চাদর জড়িয়ে ফের চোখ বন্ধ করে ইমা। ট্রে হাতে রুমে প্রবেশ করল শান। ট্রে’টা সাইড টেবিলে রেখে ইমার শিওরে গিয়ে বসল। ইমার চুলে বিলি কেটে কপালে চুম্বন দিয়ে কপোলেও দেয়। দু বাহুডোরে ফের জড়িয়ে নেয় ইমাকে। বৃষ্টি শেষের বাতাস বইছে বাইরে। তার কিছুটা জানালা ভেদ করে ছুঁয়ে দিচ্ছে ওদের।স্নিগ্ধ, শীতল সমীরণ। শানের উষ্ণ আলিঙ্গনে সেই স্নিগ্ধতা যেন বহুগুন বেড়ে গেল। শান একহাতে ইমাকে জড়িয়ে অন্য হাতে ইমার চুল নিয়ে খেলছে। খেলতে খেলতে ইমার উন্মুক্ত বাহুতে অধর ছুঁয়ে বললো,
” পৃথিবীটা এতো সুন্দর, জীবন এতো সুন্দর তুমি না এলে বুঝতামই না আমি। এই জরাজীর্ণ জীবনে তুমি বহু কাঙ্ক্ষিত ছিলে আজ জানলাম। আমার আর কিছুই চাই না তুমি আছো বলে।”
ইমার অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছা করছে। অনেক অনুভূতি জাহির করার সাধ জাগছে এই মুহূর্তে । কিন্তু কেন যেন লজ্জায় মিইয়ে যাচ্ছে বারংবার। গুটিশুটি মেরে নিরবে শুধু ভালোবাসা উষ্ণ পরশ উপভোগ করছে। কিছু সময় নির্বাক থাকায় বাঞ্ছনীয়। কারণ তখন বাক ফিরে পায় ভালোবাসারা। পরশে পরশে তাদের কথা চলে। শত সহস্র বছরের অব্যক্ত অনুভূতি জাহিরের ব্যক্ততায় মগ্ন সেই পরশের উষ্ণতারা।
শানের ব্যালকনির দোলনায় বসা দু’জন। এক চাদরের আচ্ছাদনে জড়িয়ে মুড়িয়ে আছে আষ্টেপৃষ্ঠে পরস্পরকে। শানের কাঁধে মাথা রাখল ইমা। একই কাপের একই স্থান থেকে চুমুক দিচ্ছে কফিতে ওরা। ব্যালকনির গ্রিলের ফাঁক দিয়ে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ দেখা যাচ্ছে। বাতাসে দুলে দুলে উঠছে টবের অর্কিড সহ নানা গাছের পাতা,ফুল। কাঁধে অবনত মুখটির দিকে এক নিবিষ্টে চেয়ে আছে শান। মন সায়রের তরঙ্গ উত্তাল হয় এই মেয়েটির ওষ্ঠ কম্পনে। এই সাধারণ রমণী অসাধারন তার চোখের তারায়। তার মন বারংবার আওড়ায়,,
“ধীরে ধীরে তোমার রূপের আভায় উদ্ভাসিত হচ্ছে এ হৃদয়।
কী ছিলে? কে ছিলে? কেন এলে? এই সব প্রশ্ন ছাপিয়ে তুমি অতঃপর তুমিই হলে। হৃদয় জমিনের চিলতে চিলতে অংশে তোমার ভালোবাসার অঙ্কুর গজিয়েছে। দ্রুত খুব দ্রুত পরিণত হচ্ছে সেই ভালোবাসার অঙ্কুর। এতো প্রবল কেন প্রেম বলতে পারো? কেন তোমাকে এমন করে বার বার পাব বলে উন্মুখ হয়ে আছে মন আমার। আজকাল মনে হচ্ছে তোমাকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে আমার আমি। তোমাকে ছাড়া ভাবনার বুঝি নেই কিছু। এই মরুময় পাষানের বুকে সৃষ্টি হয়েছে তোমার নামের ঝিরি। ইমা, আহ! এই নামেতেই কতো প্রশান্তি। বুকজুড়ে শীতল জলের প্রস্রবন। এতো সুখী আমি কোনোদিন ছিলাম না। যতোসুখী তোমাকে পেয়ে হলাম।”
ইমা লাজুক চোখে একপলক শানের ওমন মাতাল চাহনী দেখে মুখটা আরও নুয়ে ফেলে। শান তৎক্ষণাৎ ইমার থুতনি তুলে বলে,
” এই লজ্জার শেষ কোথায় বলতে পারো? তোমার লজ্জা আমাকে, আমার মনকে বড্ড চশমখোর করে তুলছে। লজ্জাবতী ও লজ্জাবতী! তোমাকে এতো কাছে পেয়ে হারিয়েছি নিজের মতিগতি।”
দু’চোখের পাতা, দু’ঠোট অবিরাম কাঁপছে। এ যেন বসন্তে দোদুল্যমান বৃক্ষ পল্লব। দখিনা হাওয়ার বদলে হেথায় প্রেমস্পর্শের লেগেছে দোল। শান নিজের অবাধ্য ঠোঁট দু’টোকে ফের বাধ্য করতে অপারগ হয়৷ এমন মুহূর্তে বলিহারি কেই’বা পারঙ্গম হবে বাধ্য করতে?
ব্রেকফাস্ট সেরে ওরা নেমে আসল নিচে। শান যেন এক নতুন ইমাকে দেখছে। সেই মারকুটে ইমা,যাকে এতোদিন দেখে আসছিল সে কই? এ সে নয়। এ যে তার ইমা। সম্পূর্ণটাই তার। ঠিক যেমন হলে তাকে বার বার প্রেমের বাণে মারা যায়। ঠিক যেমন হলে চোখে হারায়,মন হারায় তেমনটি সে। তবে যাই হোক সে মারকুটে ইমাকেও ভালোবাসে। ইমার সব রূপ,ঢং,চলন,বলন সবকিছুকেই। ভালোবাসা এই একজনের অনেক রূপকে ঘিরে বেষ্টিত। সে যখন যেমন হবে শান তখন তেমন হয়েই ভালোবাসবে তাকে। গাড়িতে চড়ে বসল। গাড়ি ব্যস্ত সড়কের উপরে চলছে। ইমা আড়চোখে শানকে দেখতে গিয়ে ধরা খেয়ে গেল। শান মুচকি হেঁসে বললো,
” এভাবে লুকিয়ে না দেখে সরাসরি দেখো।হক তো আছেই তোমার।”
ইমা অন্যদিকে মুখ ফিরে জিহ্বা কামড়ে বললো,
” কই দেখছি? একদম দেখছি না তো।”
শান ভ্রু তুলে বললো,
” সিওর!”
” হ্যাঁ!” ইমা ঠোঁট টিপে হেঁসে জবাব দিল।
” ওকে। ওকে!” শান হাসছে।
ইমা মুখে হাত রেখে হাসি লুকানোর চেষ্টা করছে আড়চোখে শানকে হাসতে দেখে। দুজনের এই ইশারায় ইঙ্গিতের লুকোচুরি খেলা থামল ইমার বাসার সামনের গলির মুখে গাড়ি থামতেই। এদিকের স্থানটা কিছুটা নির্জন। ইমা চুপচাপ বসে আছে। এই বিচ্ছেদ পাহাড় সম কষ্ট হয়ে বুকে চেপে বসেছে দু’জনের। ইচ্ছা করছে না ইমার গাড়ি ছেড়ে নামতে। শান দৃষ্টি অন্য দিকে রেখে নিচু গলায় বললো,
” ইমা!”
” হু।” অবনত মুখ, দু’হাতে ওড়না মুষ্ঠিবদ্ধ ইমার। কন্ঠস্বর কাঁপছে। শান মৃদু গলা ঝেড়ে বললো,
” ভালোবাসি আমি তোমাকে ইমা। কতোটা পরিমাপ করিনি হয়ত করতে পারবও না৷ এই একরাতে গত কয়েকরাতের অপূর্ণতা,দ্বিধাদ্বন্দ্ব মুছে দিয়েছে। এখন অবশিষ্ট বলতে তুমিই আছ আমার মধ্যে ইমা। আর কিছুই নেই। কেউ নেই। যদি কোনোদিন মনে হয় আমার সাথে তোমার যাচ্ছে না। তবে যেনে রেখো এই আমি সেদিনই মরে যাব, চিরতরে। তোমাকে স্বাধীনতা দিলাম তুমি চাইলে গ্রহণ অথবা পরিত্যাগ করতে পারো। শুধু মনে রেখো আমার বেলায় পরিত্যাগ বলতে কিছুই নেই। যা ভালোবেসে গ্রহণ করে দু’হাতে হৃদয়ে ঢেলেছি তা অপসারণের উপায় নেই। আমার স্বেচ্ছায় গ্রহণ করা বাঁচার আশ কিংবা মৃত্যু তুমি।”
শান অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে ইমার জবাবের। সময় অতিবাহিত হচ্ছে তবুও জবাব আসছে না দেখে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল শান। করতলে মুখ ঢেকে নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছে ইমা। শান ভীত, শঙ্কিত। ইমার মাথায় হাত রাখতেই ইমা হাতটা টেনে বুকে ধরে বলে,
” আমাকে আপনি ভালোবেসেছেন এই আমার পরম পাওয়া। জীবনে যা পাবার আশা করিনি সবই দিলেন। আমি নিজেকে বদলাতে ভয় পেতাম কিন্তু বদলে গেলাম আমি। আপনি বদলে দিলেন। এই আমি এখন যা সবই আপনার, সম্পূর্ণটাই আপনার।” শানের হাতের উপর কপাল টেসে কাঁদতে লাগল ইমা। শান দু’হাতে বুকে জড়িয়ে সিক্ত স্বরে বললো,
” সৃষ্টিকর্তা সাক্ষী রইল তুমি শুধুই আমার।কেবলই আমার।”
অদূরে ইমার ছোট মামির ঝাঁঝালো গলার স্বরে ইমা চট করে শানের বুক ছেড়ে সিটে বসে। শান ভ্রুকুটি করে বললো,
” এটা কী ছিল?”
” সরি। কিন্তু এখন এ পর্যন্তই৷ আসি আল্লাহ হাফেজ। ” ইমা গাড়ি থেকে নেমে সামনে কিছুদূর দৌড়ে আবার ফিরে আসে৷ শান কপাল কুঞ্চিত করে ইমার ফিরে আসা দেখল। ইমা দরজার খোলার চেষ্টা করে বললো,
” এই দরজাটা খোলেন তো।”
শান ঝুঁকে দরজা খুলতেই ইমা টুপ করে ওর গালে চুমু দিয়ে ছুটে বাড়ির ভেতর চলে যায়। শান অভিভূত তাতে।
রুদ্ধশ্বাসে গেট পার হয়ে বাড়ির আঙিনায় এসে থামল ইমা। বুকটা এখনও দুরুদুরু কাঁপছে। উঁকি দিতেই দেখল শান গাড়ি নিয়ে এখনও সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। ইমা লাজুক হাসি হেঁসে বাড়ির ভেতর হাঁটা ধরে।
বিভা দুপুরে খাবার নিয়ে ইমার ঘরে গেল। ইমা তখন গভীর নিদ্রায়। খাবার প্লেট ওয়ারড্রবের উপরে ঢেকে মেয়ের শিওরে বসল বিভা। ঘুমন্ত ইমাকে দেখলে মনে হলো এ যেন তার সেই সদা হাস্যোজ্জ্বল, চঞ্চল বাচ্চা মেয়েটা। বাবা! বাবা বলতে বলতে সারাক্ষণ হাসির ফোয়ারা ছুটত। দোকান থেকে একটু দেরি করে এলেই তার অভিমানে নাক ফুলিয়ে রাখত ইমা। প্রচন্ড অভিমানি তার এই মেয়েটা। অভিমান পুষে মরে যাবে তবুও বলবে না মুখে কিছু। বিভা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিরবির করে,
” তোকে আমি আজও বলতে পারিনি সেই রাতে কী হয়েছিল। কেন তোর বাবা আর ভাইয়ের ওমন নির্মম মৃত্যু হলো। ছোট্ট তুই তো বাবা-ভাইয়ের লাশটা দেখেই বদলে গেলি। আমার আদুরে নরম মনের মেয়েটা ক্রমে ক্রমে হয়ে গেল কঠিন। আমি স্বামী শোক, একমাত্র ছেলের অকাল মৃত্যু শোক বুকে চেপে তোর জন্য স্বাভাবিক রইলাম। কিন্তু সবসময়ই পারি না ঠিক থাকতে। আমার উপর খুব রাগ তোর তাইনা মা? আমি কেন সব মুখ বুঝে মেনে নেই। কেন তোর পক্ষ হয়ে লড়ি না কিংবা সবাইকে উচিত জবাব দেই না। আমি যে তোর বাবা আর তোর ইমতিয়াজ ভাইকে হারিয়ে বুঝেছি সব সময় মুখ খুলতে নেই। একদম নেই। সেদিন তোর বাবা যদি ছেলের প্রতি অন্যায়ের বিচার চাইতে না যেত। তবে আজ আমরা সবাই আগের মতো হাসিখুশি থাকতাম। আমার বুকটায় এমন গভীর ক্ষত হতো না। তুই কেন বুঝিস না আমাকে? কেন আমার কথা শুনিস না ইমা? তোকে নিয়ে কত চিন্তা আমার। তুই তো বলিস মা চিন্তা করো না। কারো সাহস নাই আমার কিছু করার। এই একই কথা বলে আমাকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়েছিল তোর বাবা। দেখ কেমন ফাঁকি দিল। এখন আমার যে তাকে ছাড়া কতো কষ্ট হয় সে কী বোঝে? আমি যে তার এই একরোখা মেয়েটাকে কী করে সামলে রেখেছি সে খবর কী রেখেছে সে? সব সময় উচিত কথা বলতে নেই। চুপ থাকতে হয় মাঝে মাঝে। সহ্য করতে হয় নয়ত,, ” বিভার স্থির চোখ দিয়ে জল গড়ায়। চোখের সম্মুখে সেদিনের অপরাহ্ন ভেসে ওঠে। বসার ঘরে পড়ে আছে স্বামী ইমন চৌধুরী ও ছেলে ইমতিয়াজে লাশ। ছেলেটা সবেমাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছিল। পছন্দের কলেজটাতে। প্রতিদিনের মতো ঐ দিনের আগের দিনও তার স্বামী ছেলেকে আনতে গিয়েছিল কলেজে। এর পরদিন লাশ হয়ে ফিরল দুজন। কলেজের সাদা শার্টটা রক্তে মাখোমাখো ছেলেটার। মুখে আধো আধো দাড়ি গজিয়েছিল। এই নিয়ে কী খুনশুটি বাবা ছেলের। বিভা মৃত ছেলের ঠান্ডা মুখটায় হাত রাখল। আচ্ছা কেমন লাগে সন্তানের লাশ ছুঁয়ে দেখলে? এই অনুভূতি ব্যক্ত করার মতো কী? ব্যক্ত করা যায় কী তা? বিভা অশ্রুসিক্ত মুখে হাসল। পাগলিনীর মতো মাথা দুলিয়ে বললো,
” আব্বা, ও আব্বা, ওঠ। দেখ তোর জন্য বিরিয়ানী রান্না করে রাখছি। ইমাকে একটুও দেই নি। বলছি আমার ইমতি আসুক তারপর তোকে দেব। ও না খেয়ে আছে তোর সাথে খাবে বলে। ও আব্বা। ও ইমতি ওঠ না।” ছেলের কর্দমাক্ত মুখে চুমু খেয়ে মৃত স্বামীর বুকে হাত বুলিয়ে ফের বলে বিভা,
” শুনছ! ওঠো না। এই ইমতির আব্বা ওঠো না। তোমরা উঠছ না কেন? ওঠো তো। আমি গিয়ে খাবার গরম করছি হ্যাঁ। ওঠো। ওঠো।” স্বামী নিথর শরীরে বার কয়েক ঝাঁকুনি দিয়ে অচেতন হয়ে পড়েছিল সেদিন সে। এরপর মাস তিনেক নাওয়া খাওয়া হতো না ঠিকমতো। কথা একটিবারও বলে নি কারো সাথে। ছোট্ট ইমার অবস্থা ছিল শোচনীয়। বাকরুদ্ধ, হতবিহ্বল ছিল মায়েরই মতো। সময়ে সবার শোক কমিয়ে দেয়। তবে কিছু কিছু শোক সুচ হয়ে বুকে বিঁধে থাকে আমৃত্যু। ইমা এবং বিভারও এই শোক তেমন রইল। আপাত দৃষ্টিতে তারা স্বাভাবিক হলেও বহুবছর এই শোক তাদের পীড়া দিয়েছিল এবং এখনও দেয়।
মুখের উপর উষ্ণ নোনাজলের ফোটা পড়তেই ইমা টিপটিপ করে চোখ খোলে। তার মিষ্টি স্বপ্নের রেশ কেটে গেল মায়ের চোখে পানি দেখে। তড়াক করে বিছানা ছেড়ে বসল ইমা।
” মা কী হয়েছে? ঐ মা!” মায়ের চোখের জল মুছে কপাল কুঁচকে তাকায় ইমা। বিভা মেয়ের মুখের দিকে একনজর তাকিয়ে জাপটে ধরে দু’হাতে। ইমার বুঝতে বাকি নেই তার মায়ের কান্নার কারন। মায়ের, পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে ইমা শান্ত গলায় বললো,
” এতো কাঁদো কেন তুমি? কাঁদলে কী ওরা ফিরে আসবে? থামো বলছি। থামো।”
বিভা থামে না। শব্দ করে কাঁদছে সে। মেয়ের ধমকে তার কান্নার গতি আরও বেড়ে গেল। ইমার বুক ফেটে যাচ্ছে কষ্টে। দাঁত কামড়ে কান্না দমায় আকাশের দিকে তাকিয়ে। না আর পারছে না সে। কষ্ট তার সমস্ত দেহ মনকে দূর্বল করে দিচ্ছে। সে দূর্বল হবে না৷ কিছুতেই না। রোরুদ্যমান মা’কে ঝটকা দিয়ে দূরে ঠেলে উঠে দাঁড়ায়। এক দন্ড সেখানে না দাঁড়িয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে। হাঁটুভেঙে বসে মুখে হাত চেপে কাঁদতে লাগল। ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসে দরজার ওপারের মায়ের কান্নার শব্দ। ইমা মুখ, চোখ ধুয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। ঢোক গিলে নিরবে চোখের জল ফেলে।
“এই অশ্রু! মরার অশ্রু। একবার গতি পেলে আর থামতেই চায় না। থাম! থাম!” দু’হাতে বার বার জল মুছতে লাগল। কিন্তু কই এর শেষ? এ তো আরও বাড়ছে। ইমা বহুকষ্টে নিজেকে সামলে নিল। চোখজোড়া লালে লাল। মুখটাও তেমন। ওয়াশরুম থাকা অবস্থায় মা’কে উদ্দেশ্যে করে ক’টা কঠিন কথা শুনিয়ে দিল। দেবেই বা না কেন? এই মা তাকে সবসময়ই দূর্বল করে দেয়। কাঁদতে বাধ্য করে। কেন কাঁদবে সে?কাঁদলে কী হবে? বরঞ্চ লোকে অসহায় ভাববে। ইমা তিরিক্ষি মেজাজে রুমে পা রাখতেই চমকে উঠে। বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে আছে তার মা। ইমা ঘারের তোয়ালে ছুঁড়ে ফেলে মা’য়ের মাথাটা কোলের মধ্যে তুলে নেয়। ইরাকে চিৎকার করে ডাকতেই ইরা, সাজ্জাদ ছুটে আসে। পানির গ্লাস এগিয়ে দিল ইরা। ইমা মায়ের মুখে পানির ছিটা দেয়। দাঁত লেগেছে কী’না দেখে নিল। না দাঁত লাগে নি। আরও দুইবার পানির ছিটা পড়তেই বিভা চোখ খোলে। ইরা বিপি চেক করে৷ লো একদম। মায়ের উপর রাগে জ্বলে ওঠে ইমা। মায়ের মাথার নিচে বালিশ দিয়ে চেঁচিয়ে বলে,
” সমস্যা কী তোমার? মরতে সাধ জাগলে বলো দু’জনে বিষ খাই।”
” বালাই শাট। তুই এসব কী বলোস?” দূর্বল গলার স্বর বিভার।
” নাটক কইরো না কইলাম। তোমারে কতোবার বলছি খাওয়া দাওয়ায় অনিয়ম করবা না। সবচেয়ে বড় কথা একদম কাঁদবা না। তুমি ক্যান শোনো না আমার কথা। ভালো হইতো সেদিন যদি বাবা আর ইমতি ভাইয়ের সাথে আমিও মইরা যাইতাম।”
” ইমা!”
” আবার চেঁচাও? ইরা খাবার আর ওষুধ নিয়ে আয় মার রুম থেকে।” ইরা ফুপির করুন মুখটার দিকে তাকাতেই ইমা বিকট জোরে ধমক দেয় ইরাকে। ইরা চমকে ওঠে।
” মেয়েটাকে ওমন ধমকাচ্ছিস কেন তুই?” বিভা কাঁদো কাঁদো গলায় বলে।
” কথা বলো না তুমি। চুপ থাকো। তুই যাবি ইরা?” ইমার চোখ রাঙানো আর ধমকে ইরা রুম ছেড়ে নিচে নামে। সাজ্জাদ ইমার কথামত তেল,আর বাটি নিয়ে হাজির। ইমা তেল পানি এক করে মায়ের মাথায় দিচ্ছে। রাগে মুখ লাল করে রেখেছে ইমা। বিভা মেয়ের হাত ধরতে গেলে ইমা ছাড়িয়ে নেয়। ইরা ততোক্ষণে খাবার আর ওষুধ নিয়ে এসেছে। ইমা ভাত মাখিয়ে মায়ের মুখে তুলে দেয়। বিভা মেয়ের রাগ লক্ষ্য করে শব্দ করে কান্না থামিয়ে দিয়েছে। চুপচাপ বাধ্য শিশুর মতো মেয়ের হাতে খেতে খেতে বললো,
” কাল রাতে বাসায় ফিরিস নাই কেন তুই? কই ছিলি?”
ইমার ভাত মাখানোর হাতটা থেমে যায়। বিভা চোখ ছোট করে মেয়ের অস্থির মুখটা দেখে ফের বলে,
” তোর বাবার মতো তুই যদি ফাঁকি দিয়েছিস আমাকে,,,”
” তোমার সমস্যা কী কও তো? কিছু হইলেই বাবাকে কেন টানো?” ইমা অবনত চোখে জবাব দেয়।
বিভা মেয়ের গলার স্বর কাঁপতে দেখে ভ্রুকুটি করে বলে,
” সত্যি করে বল কোথায় ছিলি তুই? বল।”
” কোথাও ছিলাম না। চুপচাপ খেয়ে নাও তো।” ইমা ভাত মেখে মুখের সামনে ধরতেই বিভা মুখ সরিয়ে নেয়।
” মা ভাত খেয়ে নাও বলছি।”
বিভা ইমার মুখে চড় দিয়ে গলা চড়িয়ে বলে,
” আমাকে চোখ দেখাস তুই? সত্যি করে বল কাল কোথায় ছিলি? এর আগেও তুই রাতে বাড়ি ফিরছ নাই। কালকেও কেন ফিরোস নাই বল? তোর জন্য আর কতো সহ্য করব মাইনষের কথা। মেয়ে না তুই? মেয়ে হয়ে মেয়ের মতো কেন চলোস না। জবাব দে।” ভাতের থালা ঠেলে নিচে ফেলে দেয় বিভা। দাঁত কামড়ে উঠে দাঁড়ায় ইমা। হেঁটে গিয়ে দরজার কাছে থামে। সামনে দৃষ্টি অনড় রেখে থমথমে গলায় বলে,
” মাকে ওষুধ খাইয়ে দিস ইরা।” ইমা পেছন ফিরে না তাকিয়ে সোজা কড়িডোর ধরে ছাঁদে উঠে গেল। পেছনে তার মায়ের গলা শুনতে পেল। চেঁচিয়ে কাঁদছে। ইমার মাঝেমধ্যে মরে যেতে ইচ্ছা করে। শুধুমাত্র মায়ের কথা ভেবে মরতে পারে না। আর এখন তো আরও একজন জড়িয়েছে তার এই জীবনের সাথে। মাকে কী এখনই বলবে সে শানের কথা। না! এখন নয়। তার মায়ের মানসিক অবস্থা এখন ঠিক নেই। একটু স্বাভাবিক হোক তারপর বলবে। গুছিয়ে, বুঝিয়ে বলবে। তার মা নিশ্চয়ই বুঝবে তাকে। যদি না বোঝে! যদি মামিদের দিনরাত কানপড়ানির আছর তখনও থেকে যায়। কী হবে তার এই সম্পর্কের পরিণতি! ইমা আর ভাবতে পারে না। দু’হাতে চুল মুঠ করে দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়ে। অবাধে জল গড়ায় চোখ ফেটে।
বিকেলে নুসরাতের সাথে বেশখানিক্ষণ গল্প করল ইমা। ইমার একবার মনে হলো নুসরাতকে বলা যাক। পরক্ষণেই কী এক শঙ্কায় চেপে গেল ভাবনাটা। নিজেকে বার বার এমন ভীত সন্ত্রস্ত হতে দেখে বেশ বিস্মিত এবং অস্বস্তিতে ভুগছে ইমা। নুসরাত আজ ইমাকে কিছুটা আনমনা দেখে কারণ জিজ্ঞেস করল। হেঁসে প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলল ইমা। কথায় কথায় শানের কথা তুললো নুসরাত। তাতেই যেন ইমার কান গরম হয়ে উঠল। মুচকি হাসছিল সে। নুসরাত বকবক করতে করতে ইমাকে হাসতে দেখে বললো,
” হাসছিস যে।”
” কই?” ইমা অন্যদিকে ফিরে জবাব দেয়।
” এই তো হাসছিস। কী হয়েছে বলনা? কেমন যেমন চেঞ্জ চেঞ্জ মনে হচ্ছে তোকে।” নুসরাত হেঁসে গা ঘেঁষে বসতেই ইমা উঠে দাঁড়ায়,
” আরে যাহ! কী আজব কথাবার্তা তোর। আচ্ছা আমি চলি।”
” এই ইমা দাঁড়া। শোন না। ইমা।” ইমা দাঁড়ায় না। ওর কেবলই মনে হলো আরেকটু সময় থাকলেই নুসরাত সব ধরে ফেলত। তখন কী হতো? ইমা লজ্জায় মুখ নুইয়ে এলোমেলো পায়ে হাঁটছিল ভাবনায় ডুবে। খালার বাসার সিঁড়ি ডিঙিয়ে নামতেই অসতর্কতায় পা মুচড়ে যায়। ভাগ্য ভালো রেলিং ছিল, নয়ত সোজা দোতলার নিচে গিয়ে ধপাস। ইমা চাপা আর্তনাদ করে মুখ চেপে ধরে সাথে সাথে। আশেপাশে কেউ ছিল না তখন। অনেক কষ্টে বাসায় পৌঁছে বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পড়ল।
মেয়ের উপর অযথা রাগ বর্ষণ করায় সেদিন আর মেয়ের ঘরে গেল না বিভা। মনে মনে আক্ষেপ জমল তার। আক্ষেপ কার উপর এবং কেন তা জানা নেই। তবে এতোটুকুই জানে আক্ষেপ যখন বাড়তে বাড়তে আক্রোশে রূপ নেবে। বেচারী তার মেয়েটার উপরই গিয়েই পড়বে। মেয়েটা যদি বছর দু’য়েক আগেই তার কথা মেনে বিয়েটা করে নিত, তাহলে ক্ষতি কী ছিল? দিনরাত ভাই,ভাবির কটুকথা শুনতে হতো না তাকে। বিভা মেয়ের উপর রাগ করে ইরাকে দিয়ে খাবার পাঠিয়ে দেয়৷ দরজা বন্ধ করার আগে পাশের রুম থেকে সাবিহার কথা কানে এলো,
” আগে তো সারাদিন বাইরে থাকত ঐ ইমা। আজকাল রাতেও বাইরে থাকে। মা’টা হইছে মেনি বিলাই। আরে বাপু মাইয়্যা কী তোমাগো ঘরে নাই? তারা কী এমন রাত বিরাত বাড়ির বাহির কাটায়? ছি ছি! যাউক গা। বললে বলব আমি খারাপ। উচিত কথার দাম নাইগা। মা আস্কারা দিলে মাইয়্যা তো এমন করবোই। আমরা ভালো বইলা সহ্য করতাছি। অন্য কোনো মামি হইলে লাত্থি দিয়া বাড়ির বাহির করত দুইটারে।”
” ইমাকে নিয়ে পড়ে না থাকলে তোমার চলে না, তাই না ?”
ইমার বড় মামা স্ত্রীর কান থেকে মোবাইল কেড়ে ফ্লোরে ছুড়ে মারে৷ মোবাইল ফ্লোরে পড়তেই চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তোলে সাবিহা। স্বামীর সাথে চলে তার তর্ক বিতর্ক। বিভার চোখে ফের জল চলে আসে এসব শুনে। মেয়ের উপর এসব কারনেই তার যত রাগ। কী দরকার এদের চক্ষুশূল হয়ে পড়ে থাকা। দুনিয়াতে জায়গার অভাব আছে? অভাব থাকলে মরে যেত মা -মেয়ে, তবুও তো এসব দেখতে শুনতে হতো না তাকে প্রতিনিয়ত। বিভা দরজা বন্ধ করে নামাজের পাটিতে বসে। আল্লাহর কাছে দু’হাত তুলে প্রার্থনা করে মেয়ের সুবুদ্ধির।
ঘড়ি কাটা ১টা ছুঁই ছুঁই। ইমা মাত্র খেয়ে দেয়ে বিছানায় বসল। বা’পাটা ভীষণ ব্যথা করছে। ঠিকমতো হাঁটতেও পারছে না। বা’পায়ের গিঁটের দিকের তাকাতেই দেখল ফুলে উঠেছে জায়গাটা। একটা ব্যথানাশক ট্যাবলেট খেয়ে সবেমাত্র বালিশে মাথা দিয়েছিল, ওমনি মোবাইলের রিংটোন বেঁজে ওঠে। মোবাইল হাতে নিয়ে স্ক্রিনে ভাসা নামটা দেখে সেই আগের মতো বুকের ধুকপুকানি বাড়তে লাগল,ওষ্ঠ কাঁপছে সঙ্গে সমস্ত শরীরে হিমেল হাওয়া বয়ে গেল। মোবাইল ধরতেই ও’পাশে মানুষটার ভারী নিঃশ্বাস কর্ণরন্ধ্র ছেদ করে শিরায় শিরায় কাঁপন ধরিয়ে দিল ইমার। কন্ঠরোধ হয়ে গেল তৎক্ষনাৎ।
” তোমার নাম কী হওয়া উচিত জানো? ঝড়! হৃদয়পুর উত্তাল আমার তোমার নামের ঝড়ে। অবস্থা কাহিল তোমার ভালোবাসার ঝড়ে। একদন্ড শান্তি পাচ্ছি না, স্বস্তি পাচ্ছি না তোমাকে না দেখে। দ্রুত নিচে আসো অপেক্ষা করছি।” চাপা স্বরে বলে গেল শান
” উহু! আমি ঝড় আর আপনি কী? জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো? আমার অবস্থা যে আরও খারাপ করেছে আপনার ভালোবাসা। দশ নম্বর মহা বিপদ সংকেত চলছে আমার মন সায়েরের উপকূলে। যাব না, নয়ত আজ পা ভেঙেছে কাল আমি নিজেই ভেঙেচুরে ব্যথায় মরে যাব।” মনে মনে বললেও বাহ্যিক ভাবে মৌন রইল ইমা। ইমার নিরবতায় শান বিরক্তি ঝেড়ে বললো,
” কই আসছ? আচ্ছা কষ্ট হলে থাক। আমিই আসছি।”
” কী?” ইমা সোজা হয়ে বসে।
” উফ! এতোক্ষণে তাহলে বললে। আসো না বউ।”
শানের কাতর গলার স্বরে ইমা ফিক করে হেঁসে ওঠে। শান কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে হাসি শোনে। ইমার হাসি থামতেই শান বললো,
” আসছি আমি।”
” এই না না।”
” তাহলে তুমি আসো। আমি গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছি গলির মুখে।”
” পাগল আপনি?”
” এতোক্ষনে বুঝলে? কথা না বাড়িয়ে জলদি নামো। তোমাকে দু’হাতে বুকে জড়িয়ে ভালোবাসব বলে রাত থমকে আছে,দিন চাঁদের আলোয় লুকিয়ে অধীরে অপেক্ষা করছে।”
” ইশ! কী কথার ভাব।” ইমা মুচকি হেঁসে ঠোঁট বাঁকায়। শান অধৈর্য হয়ে বলে,
” ইমা!”
” আসছি! আসছি। ধরা খাইলে আপনার খবর আছে।” ইমা কল কাট করে ঠোঁট উল্টে কিছুক্ষণ বসে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দরজা খুলে বের হয়। চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলে,
” এতো শখ কেন ঐ ব্যাটার বুকে আমাকে দেখার। চোখ বন্ধ কর। অমাবস্যা হ। আল্লাহ গো! এই কী ছিল কপালে? এতো রাতে চোরের মতো বরের সাথে দেখা করতে হবে আমাকে। উফ! কপাল কপাল। ” ইমা কপাল চাপড়াতেই মোবাইলে পুনরায় রিংটন বেজে ওঠে।
” কী হইছে? একটু ধৈর্য নাই কেন?” সাবধানে নিচে নামতে নামতে চাপা স্বরে বললো ইমা।
” আসো তারপর বলছি কী হয়েছে। আমাকে ঝাড়ি দাও?”
” এমনে থ্রেট দিলে যাইতাম না। বাই।”
” আরেকবার বলো আসবা না। বলো?”
“কেমডা লাগে! আসছি মোবাইল রাখেন।”
ইমা নেকিসুরে বিরবির করে শানকে বকতে বকতে এগোতে লাগল। বুকটা ভয়ে কাঁপছে। গলির নিস্তব্ধ আলোছায়ার পথ ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগোচ্ছে ইমা। একদিকে বাড়ির লোকের ভয় অন্যদিকে শানের সান্নিধ্যে যাওয়ার মধুর শিহরণ জাগানো অনুভূতি তাকে অস্থির করে তুলছে। পায়ের ব্যথাটাও মধুর লাগছে এই ক্ষণে।
·
·
·
চলবে……………………….