#তুমি_আছো_তুমি_রবে
#পর্বঃ১০ #রেহানা_পুতুল
বর্ষাকালকে নাকি আলিঙ্গনের ঋতু, রোমান্টিক ঋতু বলা হয়। এটা কি সত্যি ঝিনুক?
ঝিনুক ঠোঁট বাঁকিয়ে, হুম সত্যি। হাজার সত্যি। এবার তো ছাড়ুন প্লিজ। ঝিনুক যে জ্বর আসার রাতে তাকে স্পর্শ করার অনুমতি দিয়েছে এটা তার মনে আছে। তবে তার পরের মুহুর্তগুলা তার কাছে আবছায়ার মতো। কেননা সে রাতে প্রচন্ডভাবে জ্বরের ঘোরে ছিলো ।
আরশাদ ঝিনুকের কোমর থেকে দুহাত সরিয়ে নিলো। একি! ভিজে চুপসে গেলে যে। ভিতরে আসো। আমি তোমার ড্রেস চেঞ্জ করে দেই।
ঝিনুক কটমট চোখে চাইতেই,
ফান বুঝেনা বালিকা। অনুযোগের সুরে জানতে চাইলো আরশাদ ,
আচ্ছা আমরা আলিঙ্গনে আবদ্ধ হচ্ছিনা কেন? রোমান্স করছিনা কেন?
এটা কি আমাকে জিজ্ঞেস করছেন আপনি?
আর কাউকে বলার কথা নাকি?
ওহ! বেলা ফুরিয়ে যায়নি এখনো।
কিন্তু বর্ষাকাল তো চলে যাচ্ছে।
বর্ষাকাল মনে হয় আর আসবেনা। হেয়ালি সুরে বলল ঝিনুক।
তুমি কি আমাকে শাস্তি দিচ্ছো ইচ্ছে করেই? ভরাট কন্ঠে জানতে চাইলো আরশাদ।
ঝিনুক উত্তর দিলোনা। মুখ মলিন করে রুমে চলে গেলো। তাওয়েল নিয়ে দুহাত মুছে নিলো। বুক থেকে পিনপিনে জর্জেট ওড়নাটি নিয়ে ফ্যান বরাবর বিছানার উপর ছড়িয়ে দিলো। পূনরায় পড়ার টেবিলে মনোনিবেশ করলো। কিন্ত মন বসছেনা। আরশাদ থেকে পাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত যন্ত্রণাগুলো পোড়া দাগ হয়ে বসে আছে তার বুকের ভিতর। ক্ষত সেরে গিয়েছে হয়তো কিন্তু দাগতো মুছে যায়নি।
যারা সহজেই দুদিন আগের পাওয়া কষ্ট দুদিন পরের সুখ দেখে ভুলে যায়। তাদেরকে ঝিনুকের ভীষণ বেহায়া আর ছ্যাঁচড়া মনে হয়। সে এমন করে চলতে পারেনা। এটা তার বৈশিষ্ট্য।
যদিও আরশাদের নমনীয় ও সহনশীল আচরণ তার এখন ভালো লাগছে। তাই গ্রামে থেকে গোপনে শিক্ষা দেওয়ার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ফন্দীটা আপাতত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললো। কিন্তু নিজ থেকে আরশাদের প্রতি প্রণয় প্রকাশ করবে ঠিক সেদিন। যেদিন আরশাদ তার ভুলগুলোর জন্য তাকে সর্যি বলবে।
নয়তো পুরুষটা প্রশ্রয় পেয়ে যাবে। ধরে নিবে তাদের ঝলকানো পরিবেশে মত্ত হয়ে গিয়েছি লালায়িত কুকুরের মতো। কুকুরের স্বভাব হলো তাকে যতই মারধর করুক,খানিক বাদেই তার মুখের সামনে একপিস মাংসের হাড় ঝুলিয়ে ধরলেই সে কুপোকাত। লোভ সংবরণ করতে পারেনা। চরম বেহায়া হয়ে উঠে। সে কুকুর নয়। মানুষ। স্রস্টার শ্রেষ্ঠ জীব।
ছোটবেলা থেকেই নির্লোভী ঝিনুক নিজেকে নারী না ভেবে সবসময় একজন মানুষ ভেবেছে। সেও কোন অংশে তার চেয়ে কম কি ওই এক অর্থ ছাড়া। যে শিক্ষিত নারীগুলো স্বামীর সংসারে লাঞ্চিত, উপেক্ষিত জীবন পার করছে। তা তাদেরই দোষ ঝিনুক মনে করে। তাদের নিজের উপর নিজেরই আত্মবিশ্বাস নড়বড়ে। ঘুনে ধরা বাঁশের মতো। ভাগ্যের দোহাই দিয়ে মানিয়ে নেয়। প্রতিদিন বাঁচে আপোষ করে। মেনে নিয়ে আর মানিয়ে নিয়ে। এভাবেই সাধের নারী জনম নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় সময়ের করাতলে।
বৃষ্টি থেমে গেলো। আরশাদ খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিমর্ষচিত্তে আকাশপানে মুখ তুলে চাইলো। বিশাল আকাশের বুক চিরে মাঝে মাঝে কিছু ঝিকিমিকি তারা উঁকি দিচ্ছে। মনে হয় তারারা লুকোচুরি খেলছে। ঝিনুক এমন করেওতো একটু লুকোচুরি খেলতে পারে। নিষ্ঠুর বধু কপালে মিলেছে। গভীর নিঃস্বাস ফেলে আরশাদ চুপিসারে বারান্দার দরজা বন্ধ করে দিলো। খাটে উঠে শুয়ে গেলো। বিছানার উপর থেকে ঝিনুকের শুকিয়ে যাওয়া ওড়নাটি হাতে গুজে নিলো। ঝিনুক বুঁদ হয়ে আছে পাঠ্যপুস্তকে। আরশাদ লুকিয়ে ওড়নাটি নিজের নাকে চেপে ধরলো। জোরে নিঃশ্বাস টেনে ঝিনুকের শরীরের ঘ্রাণ নিলো।
যুবতী বধুর পরিহিত পোশাকের কোন অংশও প্রেমিক হৃদয়কে শিহরিত করতে পারে। উম্মাতাল করে দিতে পারে। এটা আরশাদ এইক্ষণে কল্পনা করতে পারলো।
নিজেই নিজেকে লুকিয়ে প্রস্ন করলো, আরশাদ বেরসিক তুই সময়ে সময়ে এত রোমান্টিক হয়ে যাচ্ছিস কেন? তুইতো ছিলি বেরসিক ছেলে। তাই মারিয়ার প্রেমকেও কাছে টানিসনি নানা ছুতোর পসরা সাজিয়ে।
ঝিনুকের আর পড়তে ইচ্ছে করছেনা। টেবিল ছেড়ে উঠে গেলো। আমার ওড়না কই? আরশাদ অন্যমনস্ক হয়ে আছে। আপনার কানে কথা যাচ্ছেনা? এই হ্যালো..শুনছেন।
কিছু বললে?
খাটে আর দ্বিতীয় কেউ আছে নাকি? এখানে আমার গায়ের ওড়না ছিলো। কই?
ওড়না দিয়ে কি করে?
আজব ত। ওড়না গায়ে দেয়। বিরক্তি নিয়ে বলছে ঝিনুক।
কেন গায়ে দেয়?
উহু! ডিজগাস্টিং! শালীনতার জন্য, সৌন্দর্যের জন্য গায়ে দেয়।
রুমের ভিতরে এত শালীনতা আর সৌন্দর্যের আদৌ প্রয়োজন আছে কি?
আলবৎ আছে। নাক লাল করে বলল ঝিনুক।
কারো ওড়নার খবর আমি জানিনা বলে আরশাদ চোখ বন্ধ করে ফেললো। গায়ের উপর পাতলা কাঁথাটা টেনে নিলো। একপাশ ফিরে রইলো।
ঝিনুক আরশাদের বালিশের নিচ থেকে তার ওড়না খুঁজে বের নিলো। শুনিয়ে বলল। চোর একটা।
ঝিনুকের কাঁথা আজ ধুয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু শুকোয়নি। তাই ভাবছে কি গায়ে দিবে আজ। বৃষ্টি হওয়ার জন্য মৃদু ঠান্ডা লাগছে। বারবার আরশাদের কাঁথার দিকে তাকাচ্ছে। নিজে নিজে বকতে লাগলো সালেহাকে। কেনো তারাতারি ধুয়ে দিলোনা। কেন ছাদে না দিয়ে বারান্দায় দিলো।
তখনি সে শুনতে পেলো, কেউ চাইলে চোরের কাঁথার নিচে আসতে পারে। এই চোরটা আবার দয়ালু আছে। অন্যের দুঃখ বেদনা সহ্য করতে পারেনা।
ঝিনুক ফিক করে নিঃশব্দে হেসে ফেললো। আস্তে করে কাঁথার নিচে নিজেকে লুকিয়ে নিলো। একটু পরই ঝিনুক উহু আহঃ করে কোঁকাতে লাগলো। এবং একসময় তা কান্নায় রূপ নিলো। আরশাদ এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার ঝিনুকের দিকে ফিরলো। উদ্বিগ্ন হয়ে, কি হয়েছে ঝিনুক? কাঁদছো কেন? এনি প্রবলেম?
ঝিনুক মুখে কিছু বলছেনা, কাঁথার নিচে একহাত দিয়ে পেট ডলাডলি করছে।
আরশাদ বুঝতেছেনা কি হয়েছে। আবার জিজ্ঞেস করলো, আরে না বললে বুঝবো কিভাবে আর সমাধান হবে কিভাবে?
ঝিনুক কান্নাজড়িত কন্ঠে, এর সমাধান নেই। আপনি ঘুমান।
অদ্ভুত। একজন মানুষ এত কাছে থেকে এমন করলে কেউ ঘুমাতে পারে?
আচ্ছা তাহলে আমি মেঝেতে গিয়ে ঘুমাচ্ছি। বলে পা নামাতে গেলেই আরশাদ হাত চেপে ধরলো, প্লিজ বলনা কি হয়েছে? কোঁকাচ্ছ কেন? আমার কাছে এটুকু বলতেও আপত্তি?
ঝিনুক দেখলো রক্ষা নেই না বলে। দূর্বল স্বরে বলল, আমার পেট ব্যথা করছে। উহু মাগো!
দিনে মনে হয় ভাজাপোড়া বেশী খেয়ে ফেলছ তাই পেট ব্যথা করছে।
আরেহ দূর। এটা অন্য পেট ব্যথা।
কিসের বলনা?
বলা যাবেনা। লজ্জা করে।
আহারে লজ্জা! তুই কবে গায়েব হবি। আচ্ছা হোয়াটসঅ্যাপে লিখে দাও প্লিজ। আরেহ আমার সকালে আরলি বের হতে হবে। গাজীপুরের খামারবাড়িতে যেতে হবে। জরুরী কাজ আছে। না ঘুমাতে পারলে কিভাবে বের হবো।
ঝিনুক লিখে দিলো। পিরিয়ড হলেই প্রথম তিনদিন এমন ব্যথা করে তলপেটে। মেসেজ পড়া শেষ করে আরশাদ কাঁথার নিচে হাত ঢুকিয়ে দিলো। ঝিনুকের কামিজ তুলে ফেললো পেটের উপর থেকে। তলপেটে হাত বোলাতে লাগলো চেপে চেপে। ঝিনুক ব্যথার চোটে চাইলেও বাধা দিতে পারলোনা।
আরাম পাচ্ছ একটু?
ঝিনুক চোখের পাতা বুঁজে স্থির হয়ে আছে। আরশাদের বলিষ্ঠ হাতের উষ্ণতায় শুধু আরাম নয় সে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। পুরুষের হাতের ছোঁয়াতেও এত স্বর্গীয় অনুভূতি হতে পারে জীবনে এই প্রথম বুঝতে পারলো। আরশাদের হাত বুকের দিকে এগিয়ে আসছে সর্পিল গতিতে ,
এটা টের পেয়েই ঝিনুক উহু করে উঠলো কৌশলে।
কি হলো ঝিনুক? ব্যথা কমছেনা?
নাহ উহু!
ওয়েট। বলে আরশাদ উঠে গেলো। কিচেনে গিয়ে ইলেকট্রিক কেটলিতে পানি গরম দিলো। গরম হলে হট ওয়াটার পটে ভরে নিয়ে এলো। নিয়ে এসে ঝিনুকের পেটের উপর জামা মেলে দিয়ে ওয়াটার পট চেপে ধরলো।
ঝিনুককে বুঝতে না দিয়ে গোপনে নিজেকে সামলে নিলো। মনে মনে বললো, এত মোলায়েম হয় মেয়েদের পেট। যদি একবার দেখতে পারতাম।
ঝিনুক ঘুমিয়ে গেলে আরশাদ পেট থেকে ওয়াটার পটটি সরিয়ে রেখে দিলো। নিজেও তন্দ্রাঘোরে ডুব দিলো।
সকালে আরশাদ ফ্রেস হয়ে নাস্তা খেয়ে বের হয়ে গেলো। আরিশাও বের হয়ে গেলও ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। সে অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। ভার্সিটিতে ক্লাস আছে আজ। এদিকে নিলমের সাথেও দেখা করা জরুরী। আরিশার পেট ব্যথা নেই এখন।
দুপুরে সবাই বাইরে থেকে বাসায় ফিরে এলো। বিকেলের অবসরে আরশাদ, আরিশা,ঝিনুক,জোবেদা বেগম টিভিতে একটি হাসির নাটক দেখছে। সালেহাও কাজের ফাঁকে ফাঁকে এসে একটু দেখেই হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। কলিংবেল বেজে উঠলো। সালেহা গেট খুলেই,আরেহ মারিয়া আপা।
মারিয়া ভিতরে এসে সবার সাথে কুশলাদি বিনিময় করলো। আরশাদের দিকে অভিমানমিশ্রিত সুরে,
কি হে বর মশাই একটা ফোন ও তো দাওনা অভাগীকে। এ নিশ্চয়ই সে? ঝিনুক আলতো হেসে মারিয়ার সাথে পরিচিত হলো।
আরশাদ কিছুই বললনা। ম্লান বদনে বসে রইলো। নাটক দেখা শেষে সবাই উঠে গেলো। আরিশা ঝিনুকের হাত ধরে নিজের রুমে নিয়ে গেলো। ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো গোপনালাপ আছে বলে। আরশাদ ছাদে গেলো বাগানের গাছগুলোর কি অবস্থা দেখার জন্য।
মারিয়াও তার পিছুপিছু ছাদে চলে গেলো। ছাদ বন্ধ করে দিলো সে। এটা আরশাদ দেখেনি। বিশাল ছাদের একপাশে ফুলের বাগান। সে আরশাদের দুহাত ধরে অনুনয় করে বলল,
আম্মুর কাছে ডিটেইলস শুনেছি। কাকে বিয়ে করেছ। কিভাবে করেছো। এখনো ঢের সময় আছে। তাকে ডিভোর্স দিয়ে দাও। সব ব্যবস্থা আমিই করে দিবো। আমি ওই দুপয়সার মেয়ের চাইতে হায়ার লেভেলে আছি। বুক ফুলিয়ে সমাজে আমাকে নিয়ে চলতে পারবে।
আরশাদ এক লহমায় রেগে গেলো আপন খালাতো বোন মারিয়ার মুখে এমন অনৈতিক প্রস্তাব শুনে।
এদিকে ঝিনুক আরিশার সব কথা শোনার পরে ছাদে গেলো বাগান থেকে ফুল আনার জন্য। কিন্তু ছাদ ভিতর থেকে বন্ধ কেন। ঝিনুক গটগট শব্দ করে ছাদের দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। আরশাদ ও মারিয়া দ্রুত এসে ছাদের গেট খুলে দিলো।
ঝিনুক বন্ধ ছাদের ভিতরে দুজনকে দেখেই হতভম্ব হয়ে গেলো। ফুল না নিয়েই ছাদের গেট থেকে ছুটে পালিয়ে আসলো বাসায়।
চলবে…১০