#তুমি_আছো_তুমি_রবে
#পর্বঃ১৯ #রেহানা_পুতুল
নিমিষেই রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলো। ঝিনুককে কিছুই বললনা। ডাইনিং টেবিলের উপর থেকে পানির বড় একটা মগ হাতে নিল। মেঝেতে জোরে আছাড় মারলো। কাচের ঝনঝন শব্দে সবার মাঝে পিনপতন নিরবতা বিরাজ করলো।
আরশাদ নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। যে যেখানে ছিল ছুটে এলো। সবাই অবাক চোখে মেঝেতে তাকিয়ে রইলো। চূর্ণবিচূর্ণ হওয়া অজস্র কাচের গুঁড়ি সারা মেঝেতে ছড়িয়ে রয়েছে।
জোবেদা বেগম,সালেহা,ঝিনুক,আরিশা বুঝতে পারলো এটা কার কাজ । তাই তারা চুপ হয়ে আছে। বড়রা ছোট বাচ্চাদের উদ্দেশ্য করে শাসনের সুরে,
এইই কে ভাঙ্গছিস স্বীকার কর বলছি? নয়তো পরে ধরতে পারলে সাজা বেশী হবে।
ছোট বাচ্চারা কেউ নিজের মাথায় হাত দিয়ে,কেউ গলা ধরে , কেউ কান ধরে বলছে, আমি না, আমি না।
জোবেদা বেগম গম্ভীর হয়ে বললেন, সবাই যার যার স্থানে চলে যাও বলছি। সালেহা খুব ভালো করে তুলে ফেল ঝাড়ু দিয়ে। তার পরে ভেজা কাপড় দিয়ে পুরো ডাইনিং রুম মুছে ন্যাকড়াটা ফেলে দিস। চিপাচাপা মুছে নিস দেখেশুনে।
সালেহা ক্ষোভে ফেটে যাচ্ছে কাজের উপর কাজের ফিরিস্তি দেখে। সবাই চলে গেলে নিজের উপর ক্ষোভ ঝাড়া আরম্ভ করলো কাচগুলো তুলে নিতে নিতে।
আরে সালেহা। আরে সাইল্লা। দুনিয়াতে আইছস বান্দী দাসীর তকদির নিয়া। বড়লোকের আজাইরা রাগ ঝাড়ে বড় বড় জিনিসের উপর দিয়া। আর আমার মতো বান্দীরা এর চাইতে বড় কিছু হইলেও রাগ ঝাড়তে পারিনা। এদের রাগ হিসেবে আমার তো শোকেস,কাচের কর্ণার, টি টেবিল সব ভাঙ্গচুর কইরা ফেলানোর কথা।
একদিন যদি ভাইজান নিজে উঠাইতো কাচের গুঁড়া। তাইলে টের পাইতো কেমন লাগে। জিন্দেগীতেও আর কাচের জিনিস ভাঙ্গতোনা।
সালেহা রান্নাঘরে গিয়ে কেবিনেটের ভিতর থেকে একটি খালি কাচের সসের বোতল হাতে নিলো। ভিতর থেকে দরজা ভিড়িয়ে দিল। আইচ্ছা, ভাইজান কি মজা পায় কাচের জিনিস ভাইঙ্গা। একবার টেস্ট কইরা দেখি। শিশিটি হাত থেকে ছেড়ে দিল টাইলসের উপরে। কাচের গুঁড়িগুলোর দিকে চেয়ে মনে মনে হেসে উঠলো। বাহ বেশ আরাম লাগতেছে দিলের ভিতরে। এখন বুঝলাম কাহিনী কি।
জোবেদা বেগম চিন্তিত হয়ে আরিশা ও ঝিনুকের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
কেন ভাঙ্গছে পানির এত বড় দামী মগটা?
আরিশা বলল,মনে হয় ভাবি আর পুলক ভাই হাত ধরাধরি করে নাচের প্রস্তুতি নিতে ভাইয়া দেখেছে।
ঝিনুক বলল,মনে হয়না। এটাই সত্যি।
জোবেদা বেগম গরম চোখে চেয়ে ভারী গলায়,
যদি জেনেই থাক তাহলে কাজটা করলে কেন?
মা, ভাবি চায়নি। আমরা সবাই বলাতে না করতে পারলোনা। আর তোমার ছেলেও খুবই মাইন্ডেড।
আমার সামনে থেকে দুজন চলে যা। তোর ভাইকে গিয়ে এবার সামলা। এমন পরিবেশে এসব উদ্ভট ঝামেলা কার সহ্য হয়।
আরিশা ঝিনুককে নিয়ে গেল। দরজা বারবার নেড়েও কোন লাভ হচ্ছেনা।
রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গলা তুলে ডাক দিলো ভাইকে। ভাইয়া আমি। গেট খোল প্লিজ। জরুরি প্রয়োজন।
আরশাদ দরজা খুলে দিলো। আরিশা ঝিনুকের হাত ধরে ভিতরে নিয়ে গেল। ঝিনুক অপরাধী চোখে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে একপাশে।
কি চাই তোদের? ককর্শ সুরে জিজ্ঞেস করলো আরশাদ।
মিনতিভরা কন্ঠে আরিশা বলল,
ভাইয়া ভাবিকে ভুল বুঝনা। আমরাই রিকুয়েষ্ট করেছি। তাই ভাবি না করতে পারেনি। তুমি সিম্পল বিষয়টাকে বিরাট ভেবে বসে আছ। সে কি অন্য পুরুষের হাত ধরেছে? কোন ক্লাবে, বারে গিয়ে এমন করছে? না একা বদ্ধ রুমে ছিল তারা দুজন? এ যুগের ছেলে হয়ে তোমার মনে এত গোঁড়ামি?
আরিশার বিয়ে, এই ভেবে আরশাদ অনেক কষ্টে নিজের ফুঁসে উঠা ক্রোধকে দমিয়ে রাখছে ছাইঁ চাপা আগুনের মতো। অন্য সময় হলে পিটিয়ে আরিশার চামড়া তুলে ফেলতো। শুধু ঠান্ডা গলায় বলল,
তুই চলে যা এখন।
আরিশা চলে গেলে ঝিনুক রুমের দরজা ভিতর থেকে আটকে দিল। আরশাদের পাশে এসে বসল নিদিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে। ভয়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে তার। আরশাদের মুখ একখণ্ড কালো মেঘ হয়ে আছে।
ঝিনুক দুহাত জোড় করে আদ্র কন্ঠে বলল,
আমি অন্য ড্যাম কেয়ার টাইপের স্ত্রীদের মতো বলবনা, নেচেছি তো হয়েছে কি? আরো এমন করবো।
আমি এটা বলছি, আমার অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য আমি খুব অনুতপ্ত। লজ্জিত। আমিতো স্কুলের অনেক অনুষ্ঠানেই এমন ক্লাসমেট ছেলেদের হাত ধরে নেচেছি। তাই সবাই রিকুয়েস্ট করার পর নরমাল মনে হলো। এখন রিয়েলাইজ করতে পারছি, সেদিন কেন ক্লাসফ্রেন্ড এর একটি হাত অন্য বন্ধুদের সাথে যৌথভাবে আমার কাঁধে দেখে আপনি রেগে গেলেন। আজ কেন আমার হাতের মধ্যে আপনার খালাতো ভাইয়ের হাত দেখে রেগে গেলেন। আপনি এসব পছন্দ করেন না।
তবে আপনার উচিত ছিলো আমাকে আগেই এসব বিষয়ে সাবধান করে দেওয়া। যেহেতু আপনি এসবে অনেক সেনসিটিভ।
তবুও আমি খুব সর্যি। আপনি রাগ করে থেকে এত আনন্দঘন পরিবেশটাকে নিরানন্দ করে তুলবেননা। আমি কথা দিচ্ছি আর কোনদিন কারো সাথে বা একাও নাচবোনা। আপনার অপছন্দের কিছুই কখনো করবোনা।
আরশাদ মুখ ভার করে বসেই রইলো। কোন প্রতিউত্তর না পেয়ে ঝিনুক দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। বুঝে নিলো আরশাদ তবুও মন খারাপ করে আছে। ঝিনুকের চলে যাওয়ার দিকে চোখ তুলে শুধু একবার চাইলো আরশাদ।
আরশাদ মোটামুটি হাসিখুশি ভাবেই বিয়ের এই কয়দিন চলল সবার সাথে। ঝিনুক বিয়ের নানা আয়োজনের বাহানায় এই সপ্তাহের প্রতিরাত অনান্য রুমে কাটিয়েছে সবার সাথে গল্পগুজব করেই। নিজেদের রুমে ভুলেও পা বাড়ায়নি। লোক দেখানো ছাড়া অতিরিক্ত উচ্ছ্বাস, সাজসজ্জা, উৎফুল্লতা তার মাঝে ছিলনা। যেন শীতের উদাম বৃক্ষ খসে ঝরে পড়া শুষ্ক প্রানহীন পত্র।
চঞ্চল ঝিনুকের এত গুটানো নিস্তব্ধ চলাফেরা আরশাদ মেনে নিতে পারছেনা। সেতো ঝিনুককে কিছুই বলেনি। চোখ ও রাঙায়নি। তার হৃদয়টা কেউ যেন চিরে দিচ্ছে চুরির ফলার মতো। অপেক্ষা করছে বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার জন্য।
বিয়ে শেষ হয়ে গেলো। আরিশার স্বশুর বাড়ি ঝিনুক যেতে না চাইলেও যেতে হলো আরিশার জন্য। আরিশাকে সে ননদ না ভেবে নিজের বোনের মতই ভাবে প্রতিটিমুহুর্তে। সব অতিথিরাও চলে গিয়েছে। ঝিনুকের পরিবার ও চলে গিয়েছে। বাসা ফাঁকা হয়ে গিয়েছে।
আরশাদ না থাকলে ঝিনুক একটু একটু করে ডায়েরি লিখতে থাকে। অনার্সে পড়াশোনার চাপ কম। তাই অতিরিক্ত চাপ নেই মনে। যা আছে তা হলো গোপন সঞ্চিত অনুযোগ। তা কারো প্রতি নয়। নিজের জীবনের উপর । তার উপর বহাল থাকা নিয়তির উপর। তা না হলে অল্পতেই এমন ক্ষ্যাপা বাঘ হয়ে উঠা মানুষটার সাথে তার গাঁটছড়া হলো কেন।
একদিন ঝিনুক তার বাবার বাসায় গেল। আরশাদ কিছুটা বেখেয়ালবশত ঝিনুককে উপহার দেওয়া ডায়রিটা হাতে নিলো। তাকে নিয়ে কিছু লিখল কিনা ঝিনুক, তা পড়ার কৌতুহল কাজ করলো মনে।
জগতে কে না ভালোবাসা চায়। আর কেইবা বাঁচতে পারে ভালোবাসা ছাড়া। ঝিনুকের ভালোবাসা , কোমল আলিঙ্গন আরশাদের প্রেমিক হৃদয়কে কতটা সিক্ত করেছে, কতটা সুখী করেছে তা কেবলমাত্র সেই অনুধাবন করতে পারে।
ডায়েরির পাতা উল্টিয়ে শেষের দিকে গেল। চোখ নিবদ্ধ হলো বিশাল সাইজের রচনাসমেত কিছু লেখায়। যা লিখা রয়েছে আট দশ পৃষ্ঠা জুডে। আরশাদ নিবিড়ভাবে প্রতিটি শব্দ প্রতিটি লাইন পড়লো। পড়া শেষে গভীর সমুদ্রসম ব্যথিত হলো।
কপাল ভাঁজ করে চিন্তা করলো,
তবে কি ঝিনুক আমাদের সংসারে সুখী নয়? তার মধ্যবিত্ত পরিবারের জীবন নিয়ে, তার নাচ,কবিতার জন্য স্বপ্ন দেখা নিয়ে, তার ক্যারিয়ার নিয়ে, নিজের আত্মপ্রতিষ্ঠা নিয়ে, কর্ম জীবন নিয়ে, ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে, আমার হঠাৎ হঠাৎ উত্তেজিত হওয়া নিয়ে এত বিপুল আক্ষেপ?
আমিতো কিছু হলে ধুমধাম প্রকাশ করে ফেলি। তা আবার খানিকপরেই হাওয়াই মিঠাইর মতো মিলিয়ে যায়। আর ঝিনুক অন্তরে জমে থাকা অভিমানগুলোকে খুব যত্ন করে লালন করে যাচ্ছে।
নারী বুঝি এমনই। এরা নিজেকে ধূপশিখার মতো পোড়াতে ভালোবাসে। এরা বুকের অতলে পুষে রাখে পুঞ্জীভূত রাশি রাশি বেদনা।
আরো কয়েকটি পাতা উল্টাতে লাগলো আরশাদ। আরেকটি পাতাজুড়েও লেখা দেখতে পেল। তবে এখানে রয়েছে অব্যক্ত আরাধনার কথা আরশাদকে নিয়ে। যার শেষাংশে এমন,
” আজকে তুমি রাগ করেছো,
দুঃখ পেলাম তাতে!
কালকে যখন মরে যাবো
রাগ দেখাবে কাকে?
কভু আমি যাবনাকো ছেড়ে তোমাকে
তুমি আছো তুমি রবে এই বুকেতে । ”
— ঝিনুক
আরশাদের বুকের ভিতর থেকে বিশাল এক পাথরখন্ড সরে গেল। যা কিনা একটু আগেও নিঃশ্বাসটাকে আটকে রেখেছিল। অভিমানমিশ্রিত চরণগুলোর উপর উষ্ণ চুমু খেল। আগের স্থানে ডায়েরিটা চুপচাপ রেখে দিলো।
পরের দিন ঝিনুক বাবার বাসা থেকে চলে এলো। রাতে পড়া শেষে বিছানায় একপাশ ফিরে শুয়ে গেলো। আরশাদ ঝিনুকের একটি হাত ধরলো। নিজ থেকেই বলল,
বিশ্বাস করো কেউ যখন তোমার একটি নখ ও ধরে। তখন আমার মনে হয়, তোমাকে স্পর্শ করলে আমার ভিতরে যেমন প্রলয়ংকরী ঝড় সৃষ্টি হয়। ঠিক তেমনি সেই মানুষটার ভিতরেও এমন অনুভব হচ্ছে। তখন নিজেকে ধরে আর রাখতে পারিনা। উম্মাদ হয়ে যাই।
আমার এ ভুবনে তুমিই প্রথম কোন নারী। যাকে ছাড়া আমার জীবনের কোন মানে খুঁজে পাইনা। মানুষকে বাঁচতে হলে যেমন প্রতি পলে পলে নিঃশ্বাস নিতে হয়। তদরূপ আমাকে বাঁচতে হলে তার বদলে তোমাকে স্মরণ করতে হচ্ছে ঝিনুক।
ঝিনুক ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরলো আরশাদের দিকে। ভাবলেশহীনভাবে আরশাদের মুখপানে চেয়ে রইলো।
কি দেখছ অমন করে? জিজ্ঞেস করলো আরশাদ।
মানুষের জীবন থেকে তার প্রিয় মানুষগুলোকে নাকি স্রস্টা কেড়ে নেয়। এটা সত্যি?
জানিনা। কিন্তু একথা কেন বলছ ?
শীতল কন্ঠে বলল ঝিনুক, আপনার এত প্রগাঢ় ভালোবাসা আমার জন্য। আমি আপনার কাছে এতটাই প্রিয়। তাই মনে হলো কোন এক কুয়াশা ভেজা ভোরে, কিংবা অবসন্ন কোন এক ঝিমিয়ে পড়া বিকেলে, নয়তো বা কোন ব্যস্ততম দুপুরে আমি হারিয়ে যাব আপনার জীবন থেকে।
চলবে…১৯