#তুৃমি_আছো_মনের_গহীনে 💖
#পর্ব- ৪৩
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
আশিক মেহেভীনের মুখের বাঁধন খুলে দিতেই,মেহেভীন ‘আরহাম ‘ বলে চেচিয়ে উঠে। আশিক সঙ্গে সঙ্গে মেহেভীনের মুখ চেপে ধরে বলে,
‘ এতো চিৎকার করছিস কেন তুই? আরহাম টা আবার কে রে? নতুন নাকি? সবার কাছে যেতে পারিস অথচ আমার কাছে আসলেই শুধু ছটফট করিস কেন রে? ‘ আশিকের এইসব নোংরা কথা শুনে,মেহেভীনের ইচ্ছে করছে মরে যেতে। আশিক এইবার মেহেভীনের আরেকটু কাছে এসে, মেহেভীনের গালজোড়া শক্ত করে চেপে ধরে বলে,
‘ ডার্লিং আমাকে একদম ডিস্টর্ব করো না তো।নাহলে তোমার বাচ্ছাটাকে তো মেরে ফেলবোই,তার সাথে তোমাকেও আমি মেরে মাটি চাপা দিয়ে চলে যাবো। কেউ কিচ্ছু জানতে পারবে না। ‘
আশিক কথাটি বলেই, ধারালো ছুড়ি বের করে। মেহেভীন ভয়ে ভয়ে চুপ হয়ে যায়। এখন বেশি কথা বলা যাবে না। মেহেভীন কিছুতেই তার বাচ্ছার ক্ষতি হতে দিতে পারেনা। মেহেভীন কিছু একটা ভেবে,জোড়ে জোড়ে কান্নার শুরু করে দিয়ে বলে,
‘ মাগো! মরে গেলাম গো। কেউ বাঁচাও। ‘
মেহেভীনের এমন গলা ফাটানো কান্নায় আশিক ভরকে গিয়ে বলে,
‘কি হয়েছে তোমার? এমন করছো কেন? ‘
‘আশিক আমার হাত টা প্লিয খুলে দাও। দেখো তুমি তো দরজা আটকে রেখেছো। আমি তো পালিয়ে যেতে পারবো না। আমার হাত টা অনেক্ষন বেঁধে থাকার কারণে প্রচন্ড ব্যাথা করছে। প্লিয খুলে দাও। ‘
মেহেভীন অনুনয়ের সুরে কথাটি বললো। আশিক ভাবলো সত্যিই তো মেহেভীন কী করে পালাবে? তার মতো সুঠম দেহী ছেলের সাথে হস্তাহস্তি করার শক্তিটুকুও মেহেভীনের আপাতত নেই। তাই হাতের বাঁধন খুললেও তেমন সমস্যা হবেনা। আশিক মেহেভীনের হাতজোড়া খুলে দিলো। তারপর মেহেভীনের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়তে নিলে,মেহেভীন তার হিজাবে আটকে থাকা, ছোট্ট সেফটি পিনটি হাতে নিয়ে, আশিকের ডান চোখের মনির মাঝ বরাবর ঢুকিয়ে দেয়। আশিক ব্যাথায় চিৎকার করে, মেহেভীনের থেকে ছিটকে দূরে সরে আসে। মেহেভীন কোনরকম উঠে দাঁড়িয়ে দরজা খুলে ফেলে।আশিকের চোখ থেকে অনাবরত রক্ত ঝড়ছে। তবুও আশিক ঘোলা ঘোলা দেখছে। আশিক হাতড়ে
হাতের কাছে চাকুটা মেহেভীনের পায়ের দিকে ছুড়ে ফেলতে নিলে,মেহেভীনে দ্রুত দরজা খুলে বেড়িয়ে আসে। আশিক চোখ দেখতে না পেলেও, চিৎকার করে তার লোকদের আদেশ করে যেন মেহেভীনকে আটকায়। মেহেভীন এক কোনায় গিয়ে লুকিয়ে পড়ে। আশিকের লোকগুলো চারদিকে মেহেভীনকে খুঁজতে শুরু করে দেয়। মেহেভীন ভয়ে ভয়ে কর্নারে লুকিয়ে আছে। মনে মনে মহান আল্লাহ তায়ালার নাম স্বরণ করছে। কেননা এই বিপদের মুহুর্তে একমাত্র মহান আল্লাহ তায়ালাই তাকে এবং তার বিপদ থেকে বাঁচাতে পারে। মেহেভীন মনে মনে খুব করে চাইছে আল্লাহ যেন এখন আরহামকে দূত করে তার এবং তার সন্তানের জন্যে পাঠায়। মেহেভীন আস্তে করে বিড়বিড় সুরে বলে,
‘ আরহাম সাহেব। কোথায় আপনি? আপনাকে যে আমার এখন খুব দরকার। প্লিয আসুন আরহাম সাহেব। আমি আর পারছি না। ‘
______________
আরহাম কিছুতেই স্হির হয়ে বসতে পারছে না। তার পরিচিত আছে উপরমহলের সাথে। সে তাদের উপর বার বার প্রেশার দিচ্ছে যেন, তার মেহেভীনের একটা খবর পাওয়া যায়। আরহামের বুক ফেটে কান্না আসছে। তার মেহেভীনের যদি কিছু হয়ে যায়? তখন কি হবে? আরহামের মাথায় শুধু একটা কথায় ঘুড়পাক খাচ্ছে কে বা কারা মেহেভীনের অপহরণ করিয়েছে,তাদের পেলে সে কিছুতেই তাদের ছাড়বে না। আরহাম নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে একপ্রকার। ধরা গলায় বললো,
‘ প্রেয়সী! তোমাকে দেখতে না পাওয়ার দহন যে আমার কলিজাটাকে পুড়িয়ে দিচ্ছে। তুমি কি শুনতে পারছো? তুৃমি কী আদোও বুঝতে পারো? তোমার আরহাম সাহেব যে বড্ড ভালোবাসে তোমাকে। কোথায় তুমি? আমি কোথায় খুঁজবো তোমায়?’
আরিয়ানের ও কষ্ট হচ্ছে। ভাইয়ের এই অবস্হা তার মধ্যে মেহেভীনকে পাওয়া যাচ্ছে। তার ভিতরটাও জ্বলে যাচ্ছে। কিছুক্ষন এর মাঝেই পুলিশ অফিসার
হাতে একটা ফাইল নিয়ে এসে, আরহামের উদ্দেশ্য বললেন,
‘ মিঃ আরহাম হাসান তালুকদার। আমরা মিস মেহেভীনের ফোন ট্রেক করে তিনি বর্তমানে যেখানে আছেন সেই জায়গাটি জানতে পেরেছি। এমনকি মিস মেহেভীনকে যেই গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেই গাড়ির নাম্বার টাও সিসিটিভি ক্যামরা দিয়ে আমরা দেখতে পেরেছি। যদিও যারা মিস মেহেভীনকে নিয়ে গিয়েছেন তাদের চেহারা দেখা যায়নি। কেননা তারা মাস্ক পড়ে ছিলো। সব থেকে বড় কথা হচ্ছে তারা কাজটি অনেক তাড়াহুড়োর মধ্য দিয়ে করেছেন। যার ফলে আমাদের ক্লু পেতে কিছুটা সহজই হয়েছে। ‘
পুলিশ অফিসারের কথা শুনে আরহাম এবং আরিয়ান কিছুটা শান্তি পায়। মেহেভীনকে এইবার তারা খুঁজে পাবে। আরহাম উত্তেজিত হয়ে বলে,
‘ তাহলে আমরা এখনো দাঁড়িয়ে আছি কেন অফিসার? চলুন আমাদের এখুনি যেতে হবে। ‘
‘ জ্বী চলুন। ‘
________________
অভ্রের চিৎকারে মায়রা ড্রইং রুম চলে আসে। মায়রা বর্তমানে বাসায় একা রয়েছে। তার বাবা অফিসের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে গেছে। মা ও এখন দেশের বাইরে আছে। বাড়িতে এখন শুধু কাজের লোকেরাই আছে।
অভ্রলে দেখেই মনে হচ্ছে সে এখন যথেষ্ট পরিমান রেগে আছে। রাগান্বিত হওয়ার ফলে, অভ্রের আখিজোড়া লালে টগবগ করছে। অভ্র এগিয়ে এসেই,মায়রার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
‘ আমার মেহুর অপহরন হয়েছে জানো নিশ্চই।
এই অপহরন টা তুমি করেছো তাইনা? আমি একদম হ্যান্ডেড পারসেন্ট সিউর। এই কাজ তুমি ছাড়া আর কেউ করতে পারবে না। ‘
অভ্রের কথা শুনে, মায়রা বেশ অবাক হয়ে বলে,
‘ আমি মেহেভীনের অপহরণ করিয়েছি মানে টা কি অভ্র? আমি এইসব কিচ্ছু করেনি। তাছাড়া মেহেভীন এখন প্রেগন্যান্ট। এই অবস্হায় আমি কেন মেহেভীনের ক্ষতি করতে যাবো?আমিও তো প্রেগন্যান্ট অভ্র। আমি এতোটাও অমানুষ না যে প্রেগন্যান্ট অবস্হায় একজনকে অপহরণ করবো।’
অভ্র মায়রাকে থামিয়ে দিয়ে, দম ছেড়ে বললো,
‘ হয়েছে যথেষ্ট নাটক করেছো তুমি মায়রা। মেহেভীনকে যে তুমি নিজের পথের কাটা মনে করো তা আমি ভালো করেই জানি। বাট একটা কথা তুমি মাথায় ঢুকিয়ে নাও আমার মেহুর কিছু হলে আমি তোমাকে ছাড়বো না। জাস্ট মাইন্ড ইট। ‘
‘ আমার কথাটা তো শুনো অভ্র? ‘
অভ্র শুনলো না সে বেড়িয়ে গেলো।মায়রা সোফায় বসে পড়লো। মেহেভীনকে হঠাৎ কে বা কারা অপহরণ করলো? মায়রা তো এইসব ব্যাপারে কিছুই জানে না। মায়রা গভীরভাবে তলিয়ে দেখতে গেলে,তার মাথায় শুধু একটা চিন্তা এসেই ভর করে,তা হলো এই কাজটি তার বাবা ছাড়া আর কেউ করতে পারেনা। কথাটি ভেবেই মায়রার ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে।
_____
মায়রার বাবা রুক শাহেদের সময়ের অস্হিরতা শুরু হয়ে গেছে। সে কিছুতেই শান্তিমতো কাজে মন দিতে পারছেন না। আশিক তার ফোন ধরছে। কি হলো টা কী আশিকের? মায়রার বাবা আশিকের নাম্বারে আবারো ফোন করে,কিন্তু নাম্বারটা বরাবরের মতো বন্ধ। আশিক কাজটা ঠিক মতো করতে পেরেছো তো?নাকি কোন গন্ডগোল করে ফেলেছে। রুক শাহেদের মাথা কাজ করছে না।
_________
মেহেভীন কোনায় লুকিয়ে আছে। আশিকের লোকগুলো মেহেভীনকে দেখতে না পেয়ে, ভাবলো মেহেভীন হয়তো বাইরে পালিয়ে গিয়েছে। তাই তারা বাইরের দিকে চলে গেলো।
এদিকে,,,
আরহাম পুলিশ ফোর্স নিয়ে মেহেভীনের ফোনের লোকেশন ট্রেস করে মেহেভীন বর্তমানে যে জায়গায়টায় আছে সেই জায়গাটি চলে আসলো। জায়গাটি শহরের থেকে দূরে নদীর পাশে। পুরোনো একটা বাড়ি। আরহাম,আরিয়ান এবং পুলিশ অফিস তাদের ফোর্স নিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে। আরহাম বাড়ির ভিতর ঢুকেই ‘মেহেভীন ‘ বলে চিৎকার করতে থাকে।
আরহামের অস্হিরতা সময়ের সাথে বেড়েই চলেছে।
সে এবং বাকিরা উপরের দিকে চলে যায়। উপরে চলে যেতেই তারা দেখে আশিক তার চোখে হাত দিয়ে ব্যাথায় কাতরাচ্ছে এবং তার পাশে রশি পড়ে আছে। আরহাম গিয়েই, আশিককে টেনে ধরে মারতে মারতে বললো,
‘ তুই আমার মেহেভীনকে নিয়ে এসেছিস তাইনা? তাহলে বল আমার মেহেভীন কোথায়? হেই স্পিক আইট ব্লাডি বিচ।’
আরহাম এতোটাই রেগে আছে সে একপ্রকার হুশ হারিয়ে আশিককে ধরে মারছে। পুলিশরা এসে, আরহামকে আটকিয়ে, আশিককে গ্রেফতার করে। আশিক মাথা নিচু করেই ভয়ে ভয়ে বলে,
‘ আমি জানি না। মেহেভীন আমাকে একপ্রকার ধোঁকা দিয়েই ঘর থেকে বেড়িয়ে গিয়েছে। ‘
আরহাম আশিককে টেনে আরেকটি সজোড়ে থাপ্পড় বসিয়ে হিংস্র সুরে বলে,
‘ তুই জানিস আমার মেহেভীন কোথায়? নাহলে তোর এমন অবস্হা করবো যে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাও মরে যাবে। ‘
________
আশিকের লোকগুলো চলে যেতেই,মেহেভীন কর্নারের থেকে বেড়িয়ে আসে। সে একদম বাড়িটার শেষের দিকে অবস্হান করছে। মেহেভীন ঠিক করেছে পিছন দিয়েই সে পালিয়ে যাবে। যে ভাবা সেই কাজ। মেহেভীন একপ্রকার দৌড়ে সদর দরজার কাছে যেতে থাকে।
মেহেভীন তার ভারি পেট টা নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। তবুও সে হাল ছাড়েনা। তার সন্তানের জন্যে তাকে এখান থেকে বেড়োতে হবে,নাহলে আশিক নামক পশুটা তার সন্তানকে মেরে ফেলবে।মেহেভীন দৌড়াতে গিয়ে, অসাবধানতায় পা পিছলে মেঝেতে পড়ে যায়। মেঝেতে কাচেত টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো,যা মেহেভীনের পেটে ঢুকে গেছে। মেহেভীন ব্যাথায় শব্দটুকু করার শক্তিও পায় না। মেহেভীন তার পেটে হাত রাখতেই সে দেখতে পায় রক্ত। সে কিছু একটা আশন্কা করে,সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে বলে,
‘ আমার বাচ্ছা! ‘
মেহেভীন কথাটি বলেই ডুকরে কেঁদে উঠে। মেহেভীনের শব্দ আরহামের কানে আসতেই,আরহাম আশিককে ছেড়ে দিয়ে……
#তুমি_আছো_মনের_গহীনে 💖
#পর্ব-৪৪
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
মেহেভীনের আর্তনাদ কানে আসতেই,আরহাম আশিককে ছেড়ে দিয়ে,নীচের দিকে ছুটে যেতে থাকে। মেহেভীনের কান্নার আওয়াজটা নীচ থেকেই আসছে। আরহাম নীচে সদর দরজার কাছে আসতেই,বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। মেহেভীন পেটে হাত দিয়ে ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। তার পেট দিয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে অনবরত। আরহামের পা যেন চলছে না মেহেভীনকে এই অবস্হায় দেখে। আরিয়ানের চিৎকারে আরহামের হুশ আসে। আরিয়ান মেহেভীনের দিকে ছুটে এগিয়ে যায়। মেহেভীন কাপা কাপা হাতে আরহামের দিকে হাত নাড়িয়ে কম্পিত গলায় বলে,
‘ আরহাম সাহেব! আমার বাচ্ছা। ‘
আরহামের এক মুহুর্তেও দেরী করে না,মেহেভীনের কাছে গিয়ে মেহেভীনকে কোলে তুলে নিয়ে বলে,
‘ কিচ্ছু হবে না বাচ্ছার। আমি আছি তো মেহেভীন। ‘
মেহেভীন ঠোট কামড়ে ব্যাথা সহ্য করছে। আরিয়ান চিন্তিত সুরে বলে,
‘ ভাই মেহুকে নিয়ে আমাদের এখুনি হসপিটালে যেতে হবে। আমি যা দেখছি মেহেভীনকে এই মুহুর্তে হসপিটালে শিফট না করলে,বড় ধরণের ক্ষতি হবে। মেহেভীনের ব্লিডিং হচ্ছে যা বাচ্ছা এবং মেহু দুজনের জন্যেই বিপদজনক। ‘
আরহাম মেহেভীনকে কোলে নিয়ে আরিয়ানের সাথে হসপিটালের উদ্দেশ্য গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। মেহেভীন ঠোট কামড়ে ব্যাথা সহ্য করে যাচ্ছে। তার মনে শুধু একটা ভয়েই উঁকি দিয়ে বেড়াচ্ছে তার সন্তানের কিছু হবে না তো? আরহাম মেহেভীনের এমন অবস্হা দেখে একপ্রকার অস্হির হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্হায় আরহামের ড্রাইভ করা ঝুঁকিপূর্ন।তাই আরিয়ানই ড্রাইভ করে নিয়ে যাচ্ছে। আরহাম মেহেভীনকে একপ্রকার নিজের সাথে মিশিয়ে মেহেভীনের হাতজোড়া আকড়ে ধরে রেখেছে। এই সময়ে সে শুধু আরহামকেই ভরসা করে।
গাড়ি হসপিটালের কাছে আসতেই আরহাম মেহেভীনকে কোলে নিয়ে হসপিটালে নিয়ে আসে। ডক্টর জেসমিন যিনি প্রেগ্ন্যাসির সময় মেহেভীনকে চেকাপ করছিলেন তিনি মেহেভীনের এই অবস্হা দেখে ভয় পেয়ে যান। তিনি দ্রুত মেহেভীনকে এডমিট করে নেয়। জেসমিন আরহাম এবং আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত গলায় বললেন,
‘ আপনাদের বলা হয়েছিলো মেহেভীন এবং বাচ্ছাটা যথেষ্ট ঝুঁকির মধ্যে আছে। মেহেভীনের এখন পাঁচ মাস শেষ হয়ে ৬মাস চলছে প্রেগ্ন্যাসির। প্রেগ্ন্যাসির এই ৬মাস টা কতটা ঝুঁকিপূর্ন।তার মধ্যে মেহেভীনের পেটে কাচ ঢুকে গেলো এইটা কতটস রিস্কি আপনারা তো বুঝতে পারছেন তাইনা? এই অঘটন ঘটলো কী করে?’
আরহাম কিছু বলার আগেই, আরিয়ান দ্রুততার সাথে বললো,
‘ আসলে সেইটা অনেক বড় ঘটনা। আপনি আগে মেহুর ট্রটমেন্ট শুরু করুন ডক্টর জেসমিন। মেহু এবং বেবীর যেন কিচ্ছু হয়না। ‘
জেসমিন চশমাটা ঠিক করে বললো,
‘ আপনিও তো একজন ডক্টর আরিয়ান। পেশেন্ট এর যা অবস্হা তাতে কেউ ঠিক থাকবে বলে আমার মনে হয়না। ‘
ডক্টরের কথায় আরিয়ান চুপ করে যায়। আরহাম কথাটি শুনে একপ্রকার উত্তেজিত হয়ে বলে,
‘ এইসব কথা বললে তো হবে না। আপনি যে করেই হোক বেবী এবং মেহুকে বাঁচান। ওদের যেন কিচ্ছু না হয়। কিছুটা নয়। ‘
আরহামকে দেখেই মনে হচ্ছে সে এখন স্বাভাবিক অবস্হাতে নেই। তাই ডক্টর জেসমিন কথা বাড়ালেন না। মেহেভীনের কেবিনের দিকে পা বাড়িয়ে দেয়।আরিয়ানও কেবিনে চলে যায় মেহেভীনের অবস্হা দেখার জন্যে। আরহাম কাঁচের জানালা দিয়েই স্পষ্ট দেখতে পারছে মেহেভীন ব্যাথায় কতটা কাতরাচ্ছে। ডক্টররা মিলেও রক্ত পড়া থামাতে পারছে না। মেহেভীনের এমন করুন অবস্হা নিজের চোখের সামনে দেখে আরহামের বুকটা জ্বলে যাচ্ছে। ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে হৃদয়টা তার প্রেয়সী তার ভালোবাসার মানুষটির করুন পরিনতিতে। যে বা যারা মেহেভীনের এই অবস্হার জন্যে দায়ী তাদের সে কিছুতেই ছাড়বে না। তখনি পুলিশ স্ট্যাশন থেকে জানায় আশিক নাকি পালিয়ে গেছে কেননা এই ঘটনার পিছনে যে মূল রয়েছে তার নাম সে কিছুতেই বলবে না।কথাটি শুনেই আরহামের আখিজোড়া রক্তবরণ ধারণ করছে। শরীরে রাগ রক্ত যেন টগবগ করছে। আরিয়ান মেহেভীনের অবস্হা সম্পর্কে ধারণা নিয়ে, নিজের ভাইকে দেখে ঘাবড়ে যায়। কারন রাগে আরহামের হাতের রগ একবারে ফুলে উঠেছে রাগে। আরহাম সহজে রেগে যায়না। যথেষ্ট ধৈর্যধারণের ক্ষমতা আছে তার,কিন্তু একবার যদি রেগে যায় তাহলে আরহামের থেকে ভয়ংকর আর কেউ হতে পারেনা। একপ্রকার হিংস্র হয়ে উঠে সে। আরহামকে এই রুপে আরিয়ান ছোটবেলায় একবার দেখেছিলো।আরিয়ানকে কয়েকজন বখাটে ছেলে মেরেছিলো যার ফলে সেদিন ছোট্ট আরিয়ানের একপ্রকার জ্বর হয়ে গিয়েছিলো। তখন আরহাম এতোটাই রেগে গিয়েছিলো সে সেদিন মাটির টপ দিয়ে বখাটে ছেলেদের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলো। বখাটে ছেলেগুলোর সেদিন হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার অবস্হা ছিলো। আরহাম তখন বয়সে ছোট হলেও হিংস্র হয়ে উঠেছিলো। সেদিন আরহামের বাবা ব্যাপারটা ধামাচাপা দিয়েছিলো অনেক বকেও ছিলো আরহামকে। সেদিনের পর আরহামের সেই রুপটা আর কেউ দেখতে পায়ন, কিন্তু আজ আবারো আরহামের সেই আগের রুপ দেখে আরিয়ানের বুঝতে বাকি থাকেনা আরহাম আজও বিরাট ভয়ংকর কাজ করবে। আরিয়ান এগিয়ে তার ভাইকে আটকাতে নিলে, আরহাম হাত দিয়ে আরিয়ানকে আটকিয়ে সে শান্ত গলায় বলে,
‘ আমি আপাতত তোর কোন কথা শুনতে চাইনা। আমি আসছি। তুই শুধু মেহেভীনের খেয়াল রাখিস। ‘
আরহাম বেড়িয়ে যায়। আরিয়ান চাইলেও বাঁধা দিতে পারে না।
___________
আশিক একপ্রকার পুলিশের চোখে ধূলো দিয়েই কোনরকম পুলিশের গাড়ি থেকে তার লোকদের সাহায্য পালিয়ে একটা পুরনো কুঠিরে ঠায় নিয়েছে।
কুঠিরে আশিক আপাতত একাই রয়েছে। সে ভেবেছে আজকের রাতটা সে এখানে কাটিয়ে, কাল রুক শাদেহের যোগাযোগ করে দূরে কোথাও চলে যাবে,সে কিছুতেই পুলিশের কাছে ধরা দিবে না।
কিন্তু সে জানতো না একজন এর চোখ সর্বক্ষন তার উপর রয়েছে, সে আর কেউ নয় স্বয়ং আরহাম। কারো পায়ের আওয়াজ পেতেই আশিক ভয়ে ভয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখে আরহাম বাঁকা হাঁসি দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আরহামকে দেখেই ভয়ে কাঁপাকাপি অবস্হা হয়ে যায় আশিকের। আরহাম আশিকের দিকে ঝু্ঁকে বলে,
‘ আরহাম হাসান তালুকদার কখনোই কাঁচা কাজ করেনা। তোর ভাবনা যেখান থেকে শেষ আরহাম হাসান তালুকদার এর ভাবনা সেখান থেকেই শুরু।
আমি ধারণা করেই নিয়েছিলাম তুই ঠিক পালাবি। তাই তোর শার্টে আমি লুকিয়ে একটা ট্রেকার ফিক্সড করে রেখেছিলাম। তাই তুই যেখানেই যাবি আমি সব জানতে পারবো। এখন তুই বলবি এইসব এর পিছনে কে আছে নাকি আমি…’
আরহাম তার সম্পূর্ন কথাগুলো শেষ না করেই, আরেকদফা বাঁকা হাঁসলো। আশিক ভয়ে ঢুগ গিললো।
________
দেয়ালের এক কোণে রক্তাক্ত অবস্হায় আশিক বসে আছে। নড়ার শক্তিটুকুও পাচ্ছে না। তার সামনেই টুলে হাতে রড নিয়ে বসে আছে। আধাঘন্টা ধরে নির্মমভাবে আশিককে মেরেছে আরহাম। আরহাম রডের দিকে তাকিয়ে আলতো সুরে বলে,
‘ তোর জন্যে আজ আমার মেহেভীনের এই অবস্হা।
তোকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে জাস্ট। এখন তুই বলবি তোর পিছনে কে আছে?নাহলে কিন্তু এখুনি মেরে ফেলবো তোকে।’
শেষের কথাটি একপ্রকার গর্জন দিয়ে বললো আরহাম। আশিকের এতোটাই খারাপ অবস্হা, সে মুখটাও খুলতে পারছে না তবুও সে অনেকটা কষ্টে বলে দেয় এর পিছনে মূল মাস্টারমাইন্ডের নাম।
_______________
মায়রার বাবা রুক শাহেদ জেনে গিয়েছেন আশিককে পুলিশ ধরে ফেলেছে। আশিক এইবার নিশ্চই তার নাম বলে দিবে। কথাটি ভেবেই রুক সাহেদ তর তর করে ঘামতে থাকে। এই শীতের মধ্যেও তার প্রচন্ড অস্হিরতা কাজ করছে। তাকে যা করেই হোক প্রথমত অফিস থেকে বেড়োতে হবে। রুক শাহেদ তার কেবিন থেকে বেড়োতে নিলে,কেউ তার বুক বরাবর লাত্থি মারে। সে ধপ করে মাটিতে শুয়ে পড়ে। সে তাকিয়ে দেখে আরহাম। আরহাম রুক শাহেদের কলার চেপে ধরে বলে,
‘ এতো সহজে পালালে হবে? এখনো তো অনেক কিছু বাকি আছে রুক শাহেদ। এতেটা খারাপ আপনি। কতটা নিষ্ঠুর হলে নিজের মেয়ের বয়সী আরেকজন মেয়ের সন্তানকে মেরে ফেলার জন্যে লোক ভাড়া করে নেয়। শুধুমাত্র নিজের মেয়ের সুখের জন্যে ছিহ। অথচ আপনাদের মতোই জঘন্য মানুষেরা সমাজের নামি নামি পদে অবস্হান করছে।’
কথাটি বলেই আরহাম রুক শাহেদকে মারতে থাকে,তখনি পুলিশরা এসে আরহামকে কোনরকম ছাড়িয়ে নেওয়া চেস্টা করে,কিন্তু ব্যর্থ হয়। আরহাম রুক শাহেদের কলার চেপে ধরেইবলে,
‘ এই জঘন্য লোকটাকে আমি কিছুতেই ছাড়বো না। ওর জন্যে আমার মেহেভীন এতোটা কষ্ট সহ্য করছে।
আমার মেহেভীনের এবং বাচ্ছার কিছু হয়ে গেলে তখন আমি করবো? আপ্নারা বলতে পারেন?’
পুলিশ অফিসার আরহামের কাছে গিয়ে বললেন,
‘ আপনি উনাকে ছেড়ে দিন। একটু শান্ত হোন প্লিয।
আইনের উপর একটু ভরসা রাখুন। আইন ঠিক রুক শাহেদকে তার সঠিক শাস্তি দিবে। ‘
আরহাম ঘৃণিত দৃষ্টিতে রুক শাহেদের দিকে তাকিয়ে তাকে ছেড়ে দেয়। রুক শাহেদকে পুলিশ গ্রেফতার করে নেয়। সমস্ত মিডিয়ার লোকেরা জানতে পেরে একপ্রকার ছুটে এসে রুক শাহেদকে গ্রেফতার করার ছবি তুলে, নিউজ বানিয়ে দেয়,
‘ বিশিষ্ট ব্যাবসায়ী রুক শাহেদ সবে মাত্র পুলিশ হাতে
আটক হলেন,নিজের কুকৃর্তির জন্যে।’
রুক শাহেদের লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে সে
এমন একটা জঘন্য কাজটি করে ফেললেন তার ফল তাকে সারাজীবন ভোগ করতে হবে।
টিভিতে নিজের বাবার এইসব কৃর্তির কথা শুনে মায়রা চোখের জল ফেলতে থাকে।
রুক শাহেদকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিয়ে, আরহাম থানার থেকে বেড়োতেই তার ফোনটা বেজে উঠে। সে তাকিয়ে দেখে আরিয়ানের ফোন। ফোন রিসিভ করে সে যা শুনে তাতে সে একপ্রকার স্তব্ধ হয়ে যায়। সে একপ্রকার ছুটে হসপিটালে চলে যায়।
#তুমি_আছো_মনের_গহীনে 💖
#পর্ব- ৪৫
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
আরহাম এক প্রকার ছুটেই হসপিটালে দৌড়ে চলে আসে। আরহাম এসেই দেখতে পায় তার প্রেয়সী ব্যাথায় কতটা কাতরাচ্ছে কতটা মরণ যন্ত্রনা ভোগ করছে। মেহেভীনকে স্ট্রেচারে করে ওটির দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মেহেভীন স্ট্রেচার ধরেই মরনব্যাথায় অনবরত কান্না করে যাচ্ছে।আরহামের চোখ ভিজে যায় দাঁড়িয়ে থাকা দায় হয়ে পড়ে তার পক্ষে। আরিয়ান আরহামকে ফোন করেই জানিয়ে দিয়েছিলো মেহেভীনের অবস্হা একদমই ভালো নয়। মেহেভীনের শরীর থেকে অনবরত রক্ত যাচ্ছে। এই অবস্হা চলতে থাকলে বাচ্ছা তো বাঁচবেই না তার সঙ্গে মেহেভীনও বাঁচবে না। এই মুহুর্তেই মেহেভীনকে সিজার করতে হবে, নাহলে মেহেভীনের অতিরিক্ত রক্তপাতে মৃত্যু ঘটবে। এই কথাটি শুনেই আরহামের একপ্রকার স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। অভ্র ও মেহেভীনের কথা শুনে হসপিটালে দৌড়ে ছুটে। নিজের ভালোবাসার মানুষটির এই করুন দশা দেখে অভ্রের বুকটা জ্বলে যাচ্ছে। সে মেহেভীনের দিকে এগোতে নিলেই, মেহেভীন হাত নাড়িয়ে আরহামকে কাছে ডাকে, আরহাম ধীর পায়ে মেহেভীনের কাছে যায়। মেহেভীন যন্ত্রনা নিয়েই আরহামের হাত জোড়া শক্ত করে আকড়ে ধরে ভেজা কাতরতার সুরে বলে,
‘ আরহাম সাহেব! ওরা আমার এতো তাড়াতাড়ি সিজার করছে কেন? আমার বাচ্চার কিচ্ছু হয়নি তো? ও আরহাম সাহেব বলুন না কিছু? ‘
আরহামের বুক ফেটে কান্না আসলেও, সে তা সংযত করে, মেহেভীনের দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসি দিয়ে বলে,
‘ কিচ্ছু হবে না বেবী। বুঝলে না বেবী একটু তাড়াতাড়িই চলে আসতে চাইছে, তাকে নিয়ে কত প্ল্যান করেছি আমরা। সে চলে আসলেই আমরা সবকিছু করবো। আল্লাহ ভরসা কিচ্ছু হবে। বি পজিটিভ ওকে। ‘
মেহেভীন আরহামের কথা শুনে, আরহামের হাতজোড়া আরো শক্ত করে বলে,
‘ আপনি তো আছেন তাইনা আরহাম সাহেব? আমার আর কোন চিন্তা নেই। ‘
মেহেভীন আরহামের অনেকটা ভরসা নিয়ে ধরে আছে এতোটা যন্ত্রনার মধ্যে। অভ্র মেহেভীনের দিকে এগোয় না,সে থেমে যায় তার স্হানেই। সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে মেহেভীনের এই মুহুর্তে তার সঙ্গের প্রয়োজন নেই। মেহেভীন সবথেক ভরসা আরহামকেই করে,তাইতো এতোটা যন্ত্রনার মধ্যেও সে ঠিক আরহামের হাতজোড়া আকড়ে ধরে রেখেছে।
আরিয়ান আরহাম এবং মেহেভীনের কাছে এসে বলে,
‘ ভাই দেরী হয়ে যাচ্ছে মেহুকে এখুনি ওটিতে নিয়ে যেতে হবে।’
আরহাম আরিয়ানের কথা শুনে মেহেভীনের হাত আলতো করে ছেড়ে দেয় এবং চোখ দিয়ে মেহেভীনকে ভরসা দেয়। মেহেভীন আরহামের ভরসা পেয়ে,নিজের আখিজোড়া বন্ধ করে ফেলে। মেহেভীনকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হয়। ডক্টর জেসমিন মেহেভীনের প্রস্রব বেদনা উঠানোর জন্যে, মেহেভীনকে ইঞ্জেকশন দিয়ে দেয়। মেহেভীনের ব্যাথা দ্বীগুন ভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
ওটির বাইরে আরহাম পাইচারি করে যাচ্ছে। তরতর করে ঘামতে থাকে। আরহাম শুধুমাত্র এখন আল্লাহর কাছেই দোয়া করছে বাচ্চাটা এবং মেহেভীন যেন ঠিক থাকে। অভ্র এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে।
আরহাম আরিয়ানের কাছে এসে বলে,
‘ আচ্ছা ভাই একটা কথা বলতো? বাচ্চা এবং মেহেভীন দুজনেই ঠিক থাকবে তাইনা? এই ভাই বল না? ‘
আরিয়ান কোনরুপ জবাব দেয়না। তার চোখের কোণে জল এসে জমাট বাঁধে। তার ভাই যে সত্যিটা শুনে সহ্য করতে পারবে না,তা সে খুব ভালো করেই জানে। একজন ডাক্তার হয়ে এইটুকু আরিয়ান খুব ভালো করেই জানে ছয় মাসের মাথায় কোন বাচ্চার ডেলিভারি হলে, তার বেঁচে থাকার তেমন একটা চান্স নেই, তার মধ্যে মেহেভীনের শরীর থেকে অঝোড়ে রক্তপাত হয়েছে, তাতে তো বাচ্চার যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। এতো কিছুর মধ্যে বাচ্চাটা বাঁচার আদোও কোন সম্ভবনা রয়েছে? আরিয়ানকে চুপ থাকতে দেখে, আরহামের অস্হিরতার দ্বীগুন ভাবে বেড়েই চলেছে। ভিতর থেকে মেহেভীনের আর্তনাদ কানে আসতেই সেস্হীর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা। আরহাম বেড়িয়ে যায়।অভ্রের চোখ ও ভিজে উঠে। ভালোবাসার মানুষটির কষ্টটা অনুভব করাটা কতটা যে বেদনার, তা আজ অভ্র হারে হারে টের পাচ্ছে। যে মেয়েকে কষ্ট দিয়ে এক সময় সে পৌচাশিক আনন্দ পেতো আজ তারই কষ্টে অভ্রের বুকটা ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছে। কি অদ্ভুর নিয়তির খেলা! অভ্র এখন খুব করে চাইছে, ‘ তার সন্তানের কিংবা মেহেভীনের যেন কিচ্ছু না হয়। ‘
__________________
একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা ছবির ফ্রেমে চোখ বুলাচ্ছেন। ছবিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে একজন যুবতী তার ছোট্ট মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে আছে। ছবিটা দেখে মহিলাটির চোখ থেকে নোনাজল গড়িয়ে পড়ে।কেননা ছবিটাতে রয়েছে তিনি এবং তার মেয়ে।আজ তারই কোন এক পাপের ফলে তার মেয়ে তার থেকে আজ অনেকটাই দূরে। এমনকি তারই পাপের ফলটা আজ তার মেয়েকে সহ্য করতে হচ্ছে। মহিলাটা ছবিটাকে বুকের মাঝে সীমাবদ্ধ করে বলে,
‘ মেহু মা রে। তোর মা এইবার আর নিজেকে লুকিয়ে রাখবে না। এইবার তোর মা তোর কাছে ধরা দিবে।’
_____________
আরিয়ান চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখতে পায় আরহাম নেই। এইরকম সময় আরহাম আবার কোথায় গেলো? আরিয়ান আরহামকে খুঁজার উদ্দেশ্য হসপিটালে চারপাশে যেতে লাগলো। হাটতে হাটতে আরিয়ানের চোখ আটকে যায়,হসপিটালের মসজিদেদ দিকে। মসজিদে বসে আরহাম নামায পড়ছে। মোনাজাত তুলেছে তার রবের কাছে। কেননা আরহাম জানে এই মুহুর্তে মহান আল্লাহ তায়ালাই পারে তার প্রেয়সী এবং বাচ্চাটাকে বাঁচাতে। আরিয়ান স্পষ্ট দেখতে পারছে আরহাম মমোনাজাত কি যেন বিড়বিড় করছে। বিড়বিড় করতে করতে তার চোখ দিয়ে অঝোড় ধারায় অশ্রুপাত হচ্ছে। আরহাম নামাযটা পড়েই, উঠে দাঁড়িয়ে দেখে আরিয়ান দাড়িয়ে আছে। মুখটা কেমন থমথমে। আরিয়ান ধরে আসায় গলায় বলে,
‘ ভাই অপারেশন হয়ে গিয়েছে। ওটির সামনে চল। ‘
আরহাম খুশি হয়ে বলে,
‘ তার মানে ডেলিভারি হয়ে গিয়েছে? আলহামদুলিল্লাহ।
বেবী চলে এসেছে আরিয়ান তাইনা? তাহলে তুই এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি করছিস? চল। সবার আগে বেবীকে কিন্তু আমিই দেখবো। ‘
আরিয়ান আরহামকে কিছু বলতে চাইলেও সে শুনে না। বরং ছুটে যায় ওটির সামনে। ওটির সামনে আসতেই সে দেখতে পায় অভ্র চেয়ারে বসে কাঁদছে। অভ্রকে এইভাবে কাঁদতে দেখে আরহামের কিছুটা অবাক হয়। আরিয়ান ও চলে আসে। আরিয়ানও চোখে পানি। ডক্টর জেসমিন ও কালো মুখে বেড়িয়ে আসে ওটি থেকে। আরহাম ডক্টর জেসমিনের কাছে এসে বললেন,
‘ডক্টর জেসমিন? বেবী কোথায়? ‘
‘ আম সো সরি মিঃ আরহাম সাহান তালুকদার। ‘
জেসমিনের কথা শুনে এইবার আরহামের সত্যি ভয় হচ্ছে প্রচন্ড। আরহাম ঘাবড়ে গিয়ে বলে,
‘ সরি মানে কিসের সরি? ‘
জেসমিন এইবার স্পষ্ট গলায় বললো,
‘ দেখুন মিঃ আরহাম এমনিতেই ডেলিভারি ছয় মাসের মাথায় হয়েছে। ছয় মাসে কোন বাচ্চার স্বাভাবিক গঠন কোনভাবেই হয়না। ছয় মাসে ডেলিভারি মানে বাচ্চাটা নিশ্চিত মৃত্যু। তার মধ্যে মেহেভীনের যথেষ্ট রক্তখনন হয়েছে। মেহেভীনকে বাঁচাতেই আমাদের ছয় মাসে সিজার করতে হয়েছে। তাই বলছি আম সো সরি মিঃ আরহাম। বাচ্চাটাকে আমরা বাঁচাতে পারেনা। ‘
কথাটি শুনেই আরহামের পৃথিবী যেন এক মুহুর্তের জন্যে থমকে যায়। জেসমিন হাতের ইশরায় আরহামকে ছোট্ট কেবিনটির দিকে তাকাতে ইশারা করে। আরহাম তাকাতেই দেখতে পায় ছোট্ট কেবিনের ছোট্ট খাটে সাদা কাপড়ে ছোট্ট বাচ্চাটাকে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। তার চার পাশে কাচ দিয়ে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। বাচ্চাটাকে এইভাবে দেখে
আরহাম থমকে দাঁড়ায়। শরীরটা যেন তার ভারসাম্য হারাতে শুরু করে। আরহাম যেন দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে সে। আরহাম এসে তার ভাইকে সামলায়। আরহাম স্তব্দ হয়ে বসে আছে। মুখের ভাষাটুকুও আজ তার নেই। বেবীটাকে নিয়ে মেহেভীনের এতো লড়াই মুহুর্তেই বিফল হয়ে গেলো। বেবীটাকে নিয়ে আরহাম এবং মেহেভীনের কত স্বপ্ন ছিলো,মুহুর্তেই তা শেষ হয়ে গেলো। অভ্র তার সন্তানের দিকে তাকাতে পারছে না। ঢুকরে মাথা নিচু করে কেঁদে যাচ্ছে। নিয়তি এতোটা নিষ্ঠুর কেন?
#তুমি_আছো_মনের_গহীনে 💖
#পর্ব-৪৬
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
প্রাক্তন স্ত্রীর ঘুমন্ত মুখের দিকে এক ফোটা জল ফেলে অভ্র। ঘুমন্ত অবস্হায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মেহেভীনের শুকনো মুখটা। এখন রাত প্রায় দুটো বাজে। অপরাশনেই ডক্টর জেসমিন মেহেভীনকে ঘুমের গভীর ডোজ দিয়ে দিয়েছিলো,যার ফলে
মেহেভীন এখনো জানেনা যাকে নিয়ে তার এতো লড়াই সে বেঁচে নেই পৃথিবীর বুকে।ছোট্ট নবাজাত শিশুটিকে আরিয়ান আরহাম, অভ্র ও আরহামের বাবাসহ অনেক মিলে দাফন করতে নিয়ে গিয়েছিলো। দাফন শেষে আরহাম কিংবা আরিয়ানকে অভ্র আর দেখিনি। তাই সে দাফন শেষে সোজা মেহেভীনকে চোখের দেখাটুকু দেখতে চলে এসেছে। অভ্রের গলা ধরে আসছে। ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে তার সন্তান পৃথিবীর বুকে আর বেঁচে নেই।
ছোট্ট প্রানটার পৃথিবীতে আগমনের আগেই সে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলো। মেয়ে সন্তান হয়েছিলো তার।অভ্রকে এখন নিজেকে সবথেকে বেশি বড় দুর্ভাগা মনে হচ্ছে, তার একটা ভূলের জন্যে আজ সে তার সন্তানকে হারিয়ে ফেললো। প্রথমত সে জানতোই না মেহেভীনের গর্ভে তার সন্তান বেড়ে উঠছে, তখনি তার সন্তান তাকে ছেড়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে ফেললো। অভ্র তার সদ্য মৃত সন্তানকে স্পর্শ করার সাহসটুকুও পাইনি নিজেকে কেমন একটা অপরাধী মনে হচ্ছিলো তার।
আরহাম নিজের হাতেই কাঁদতে কাঁদতে বুকে পাথর দিয়ে সেই ছোট্ট শিশুটিকে নিজ হাতে মাটিতে শুয়িয়ে দেয়।অভ্র আরেকদফা কেঁদে উঠে। তখনি তার চোখ যায় সামনে থাকা রমনীর দিকে। মায়রা
ছল ছল চোখে তার দিকেই তাকিয়েই আছে। মায়রাকে দেখেই পুনরায় মাথায় রক্তচড়ে বসে তার।
___________
হসপিটালের করিডোরে মাথা নিচু করে বসে আছে আরহাম। আরিয়ানও তার ভাইয়ের দিকে অশ্রুসিক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আরিয়ান জানে তার ভাইয়ের মনের উপর দিয়ে কতটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
একপ্রকার পাথর হয়ে বসে আছে আরহাম। আরিয়ান আরহামকে ঝাকাতে ঝাকাতে বললো,
‘ ভাই তুমি একটু মাথা তুলে বসো। আমি জানি ভাই তুমি কতটা কষ্ট পাচ্ছো। তাই বলে এইভাবে পাথর হয়ে বসো থেকো না। কাঁদো ভাই একটু কাঁদো তুমি। হাল্কা করো নিজেকে। ‘
আরহাম আরিয়ানের দিকে মাথা তুলে তাকাতেই আরিয়ানের বুকটা ধক করে উঠলো। আরহামের সমস্ত কষ্ট যেন তার চোখ এসে ধরা দিচ্ছে এখন শুধু অজোড়ে অশ্রুপাত করলেই, সেই কষ্টগুলো একটু হলেও বুকটাকে হাল্কা করবে,কিন্তু আরহাম কাঁদলো না বরং তার হাতের দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বললো,
‘ যেই হাতে বেবীকে বড় করবো ভেবেছিলাম আজ সেই হাতেই তাকে দাফন করে দিয়ে আসলাম।ভাবতে পারছিস আরিয়ান কতটা বেদনাদায়ক অনুভুতি। আমার এবং মেহেভীনের কত স্বপ্ন, তা নিমিষেই শেষ হয়ে গেলো। জানিস আমি ওকে আমার নিজের মেয়ের মতো মানুষ করতাম। ওকে সবকিছু কিনে দিতাম। আমার কাছে যা যা চাইতো সব দিতাম। তাহলে কেন চলে গেলো রে বলতে পারিস আমাকে?আরিয়ান? নিয়তি এতোটা নিষ্ঠুর কেন হলো?’
আরহাম কথাটি শান্ত সুরে বললেও সেই কথাতে ছিলো বেদনাদায়ক তার আর্তনাদ। তার ভিতরের কষ্টগুলো যে জমাট বেধে রয়েছে, সেইটাই বহিঃপ্রকাশ ঘটতে শুরু হয়েছে। আরিয়ান তা ভালো করেই বুঝতে পারছে। আরিয়ান কিছু বলতে নিলে,তখনি সে শুনতে পায় অভ্রের চিৎকার চেচামেচি। আরহামকে রেখে আরিয়ান উঠে দাঁড়িয়ে দেখতে পায় অভ্র মায়রার সাথে চেচিয়ে কথা বলছে।
‘ এইখানে কেন এসেছো তুমি?এইটাই দেখতে এসেছো তাইনা যে তুমি আজ জিতে গিয়েছো। এতোটাই প্রতিহিংসার আগুন তোমার মধ্যে যে আমার এবং মেহেভীনের বাচ্চাটাকেই তুমি মেরে ফেললে। ‘
অভ্রের কথার প্রেক্ষিতে মায়রা নিচু গলায় বললো,
‘ তুমি আমাকে ভূল ভাবছো অভ্র। দেখো আমি যতই মেহেভীনকে সহ্য না করতে পারি,কিন্তু বাচ্চাটাকে আমি মারিনি। দেখো বাচ্চাটার তো কোন দোষ নেই সে তো নিষ্পাপ তাকে আমি কেন মারতে যাবো? ‘
সঙ্গে সঙ্গে অভ্র দ্বিগুন চিৎকার করে বলে,
‘ তোমার নাটক বন্ধ করো মায়রা। তুমি যে কতটা খারাপ হতে পারো তা আমি ভালো করেই জেনে গিয়েছি। তোমার বাবাকে তো তুমি এই কাজটা করতে বলেছিলে তাইনা? ছিহ মায়রা। ‘
মায়রা কাঁদতে কাঁদতে বললো,
‘ দেখো অভ্র। আমি জানি আমার বাবা যা করেছি তা কতটা ভূল কতটা ঘৃণিত কাজ। বিশ্বাস করো আমি এইসব কিচ্ছু জানতাম না। জানলে আমি কখনোই বাবাকে এমন কাজ করতে দিতাম না। আমিও তো মা হতে চলেছি আমি বুঝি একটা মায়ের কতটা কষ্ট। আমি নিজের বাবার কাজের জন্যেও অনেকটা অনুতপ্ত তাই আমি ছুটে চলে এসেছি যখন খরবটা শুনলাম যে মেহেভীনের বাচ্চাটা মারা গিয়েছে। ‘
মেহেভীনের চিৎকার চেচামেচিতে ঘুম টা হাল্কা হয়ে গিয়েছিলো। মায়রার কথা কানে আসতেই সে ধরফরিয়ে উঠে বসে। সে একপ্রকার জন্যে স্থগিত হয়ে বসে থাকে কিছুক্ষন। বুকে ব্যাথা করছে। মেহেভীন কিছুক্ষন এর জন্যে ভাবলো সে ভূল শুনেছে। এইসব কিছুতেই সত্যি হতে পারেনা। তার সন্তান তার কাছেই আছে। মেহেভীনের পুরো কেবিনে জুড়ে চোখ বুলিয়ে নিলো। তার সন্তানের তো তার পাশেই থাকার কথা। সাধারণত সন্তান জন্মগ্রহণ করলে তার মায়ের পাশেই তাকে শুয়িয়ে রাখা হয়।
তার কলিজার টুকরো কোথায়? সে তো পৃথিবীতে চলে এসেছে তাহলে সে মেহেভীনের পাশে নেই কেন?
মেহেভীন পেটের ব্যাথ নিয়েই কেবিন থেকে বেড়িয়ে গেলো। মেহেভীনকে এই অবস্হায় বেড়িয়ে আসতে দেখে সবাই চমকালো বটে।
অভ্র বললো,
‘ মেহু তুই এই অবস্হায় বেড়িয়েছিস কেন? ‘
অভ্রের কথায় পাত্তা না দিয়ে মেহেভীন আরিয়ানের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,
‘ আচ্ছা আরিয়ান আমার বেবী কোথায় বল তো? নিশ্চয় আরহাম সাহেব তাকে নিজের কাছে এখনো রেখে দিয়েছে। কোথায় নিয়ে আসতে বল। আমার বেবীকে সবার আগে ভেবেছিলাম আমি কোলে নিবো। দূর কিছুই হলো না। আরহাম সাহেব ঠিক আমার বেবীকে আগে কোলে নিয়ে নিয়েছেন।’
মেহেভীনের কথায় আরিয়ান ঠোট কামড়ে কেঁদে উঠে। আরিয়ানকে কাঁদতে দেখে মেহেভীন অবাক হয়ে বলে,
‘ কিরে এইভাবে কাঁদছিস কেন তুই? আমার বেবী কোথায় আরে বল না? ‘
আরিয়ান বলতে পারলো না তার আগেই অভ্র কান্নামিশ্রিত গলায় বললো,
‘ আমার সন্তান বেঁচে নেই রে মেহু। সে আমাদের ছেড়ে অনেক দূরে চলে গিয়েছে। ‘
সঙ্গে সঙ্গে মেহেভীন অভ্রের মুখ চেপে ধরে বলে ক্ষিপ্ত গলায় বলে,
‘ কি বলছো অভ্র? তুমি এতোটা নিকৃষ্ট যে আমার সন্তানকে মৃত্যু বলছো? একদম মিথ্যে বলবে না তুমি। আমার কলিজা টুকরোর কিচ্ছু হয়নি।’
মেহেভীন এইবার ডক্টরদের কাছেও জানতে চাইলো তার সন্তানের কথা,কিন্তু বরাবরের মতো তারাও নিরবতা পালন করলেন। মেহেভীন এইবার আরহামের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে বলে,
‘ কেউ আমার বেবীর কথা বলছো না কেন? তার মানে সবাই ওই প্রতারক অভ্রের মিথ্যে কথার সাথে সায় দিচ্ছো তাইনা? কিন্তু আরহাম সাহেব ঠিক সত্যি কথা বলবে। আরহাম সাহেব? কোথায় আপনি? ‘
আরহাম মাথা নিচু করে বসে ছিলো, মেহেভীনের ডাকে সে মাথা তুলে তাকিয়ে বুঝতে পেরে যায় মেহেভীন জেগে গিয়েছি এবং এইটাও জানতে পেরে গিয়েছে তার সন্তান আর বেঁচে নেই। আরহাম উঠে দাঁড়িয়ে মেহেভীনের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। আরহামের চোখ-মুখ ফুলো দেখেই মেহেভীন বুঝতে পারছে আরহাম কেঁদেছে। মেহেভীন আরহামের কাছে অনেকটা আশা নিয়ে জিজ্ঞাসা করে,
‘ আমার বেবী কোথায় আরহাম সাহেব? দেখুন না ওরা কি বলছি আমার বেবী নাকি পৃথিবীতে বেঁচে নেই। এইটা কী করে হতে পারে বলুন? আমার বেবীকে নিয়ে আমার এতো লড়াই এতো ফাইট সবকিছু কি নিমিষেই শেষ হয়ে যেতে পারে বলুন? আচ্ছা আমরা না কত স্বপ্ন দেখেছিলাম বেবীকে নিয়ে। সেগুলো পূরণ করবো না? ও আরহাম সাহেব বলুন না আমার বেবী কোথায়।’
আরহাম অপরদিকে ঘুড়ে যায়। মেহেভীনের কথার জবাব দেওয়ার সাধ্যি তাই নেই। সে পারবে না তা করতে।
কথাটি বলতে বলতে মেহেভীন মাটিতে ধপ করে চিৎকার করে কেঁদে দিয়ে বলে,
‘ আমার বাচ্ছা! আমার কলিজা মাকে ছেড়ে কোথায় গেলি তুই? ‘
মেহেভীনের কান্নার আর্তনাদ পুরো হসপিটালের দেয়াল জুড়ে বিরাজমান হয়ে রয়েছে। মেহেভীনের কান্নাতে আরহামের বুকটাও ফেটে আসছে। মেহেভীনের এই করুন আর্তনাদ দেখে ডক্টরদের চোখেও জল চলে আসে। অভ্র মেহেভীনকে সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে আসতে নিলে,মেহেভীন দ্রুত পায়ে অভ্রের কাছে এসে, অভ্রের কলার চেপে চিৎকার করে বলে,
‘ কেন করেছিলে প্রতারণা তুমি? কেন করেছিলে? তোমার টাইম পাসের মূল্য শুধুমাত্র আমি নই আমার সন্তানকেও দিতে হলো। আজ যদি তুমি আমার সাথে প্রতারণা না করতে তাহলে এইরকম পরিনতি কখনোই হতো না। আমার বাচ্চা আমার কলিজা আজকে আমার সাথে থাকতো অভ্র। তুমি আমার বাচ্চার খুনি। তুমি আমার বাচ্চার খুনি। ‘
মেহেভীন কথাটি বিড়বিড় করে বলতে লাগলো।
মেহেভীনের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো অভ্র। চোখ দিয়ে অজান্তেই তার নোনাজল গড়িয়ে পড়লো। সে তার সন্তানের খুনি? তার জন্যে আজ তার সন্তান তাদের সকলকে ছেড়ে চলে গেলো। মেহেভীন অভ্রকে ছেড়ে কিছু একটা ভেবে দৌড় দিয়ে বেড়িয়ে গেলো। মেহেভীনকে এইভাবে দৌড়ে বেড়িয়ে যেতে দেখে সবাই হতবাক! মেহেভীন যেন এখন নিজের মধ্যে নেই।
ডক্টর বললেন,
‘ উনাকে আটকান আপনারা। সবে মাত্র উনার সিজারি হয়েছে। এই অবস্হায় দৌড়া দৌড়ি করা উনার জন্যে বিপদজনক। ‘
আরহাম ও অপেক্ষা না করে মেহেভীনের পিছনে দৌড়াচ্ছে। মেহেভীন কাঁদতে কাঁদতে হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে যায়।
#তুমি_আছো_মনের_গহীনে 💖
#পর্ব- ৪৭
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
আরহাম মেহেভীনের দিকে দৌড়াতে নিলে,মেহেভীন থেমে যায়। মেহেভীনকে থেমে যেতে দেখে আরহাম ও থেমে যায়। মেহেভীন হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যেতে নিলে, আরহাম এসে মেহেভীনকে আকড়ে ধরে। আরহাম মেহেভীনের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় মেহেভীনের সিজার করা জায়গা থেকে রক্ত বের হচ্ছে। আরহাম ঘাবড়ে গিয়ে মেহেভীনকে পাজকোলে তুলে দ্রুত হাসপাতালের দিকে নিয়ে যায়। ডক্টর জেসমিন মেহেভীনের সিজার করা জায়গাটাকে পুনরায় বেন্ডিজ লাগিয়ে দিয়ে, বাইরে বেড়িয়ে আসে। ডক্টরকে দেখেই আরহাম বলে উঠে,
‘ মেহেভীন ঠিক আছে তো ডক্টর? ‘
‘ জ্বী আপাতত ঠিক আছে। আরেকটু হলেই সিলিটা
ছিড়ে যেতো। যেভাবে এই অবস্হায় মেহেভীন দৌড়াচ্ছিলো। আমি বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মেহেভীন এখন নিজের মধ্যে নেই।
মেহেভীন প্রচন্ড রকমের শোকের মধ্যে আছে। তাইতো সবেমাত্র সিজার করা অবস্হায় যেখানে অন্য মেয়েরা নড়তে পারেনা,সেখানে মেহেভীন দৌড় দিয়ে ফেলেছিলো। আসলে আমিও বুঝতে পারি একজন মা যখন শুনে তখন তার সন্তান বেঁচে নেই তখন সেই মা কি আর ঠিক থাকে? তখন সে নিজের মধ্যে একেবারেই থাকে না। ‘
ডক্টরের জেসমিনের কথায় সায় দিয়ে আরিয়ান ও বললো,
‘ তা ঠিক। প্রচন্ড রকমের শোকের মধ্যে থাকলে মানুষ তখন নিজের ব্যাথা -যন্ত্রনা সব ভূল গিয়ে অন্য একটা জগতে চলে যায় । যেমনটা মেহেভীনও করেছিলো। ‘
আরহাম নিজের চোখের কোণে থাকা জলটুকু মুছে
থমথমে গলায় বলে,
‘ মেহেভীনকে আমরা কবে বাড়ি নিয়ে যেতে পারবো?’
‘ তা ঠিক বলতে পারবো না। মেহেভীনের মানষিক অবস্হার উপর দিয়ে যা যাচ্ছে। তাতে কখন মেহেভীন সুস্হ হয়ে উঠবে তা বলা যাচ্ছে না। ‘
অভ্রের এক পলক কাচের জানালা দিয়ে তার মেহুকে দেখে নেয়। আজ তারই করা এক ভুলের জন্যে মেয়েটাকে এতোটা শাস্তি পেতে হচ্ছে। নিজেকে নিজের সন্তানের খুনি মনে হচ্ছে। মেহেভীন তখন নিজের মতো না থাকলেও, সে ঠিকই বলেছে। আজ অভ্রের জন্যেই তাদের সন্তান তাদের ছেড়ে চলে গেলো। তার ভুলের মাশুল গুনতে হলো ছোট্ট শিশুটাকে। অভ্র আর এক মিনিট ও দাঁড়ায় না বেড়িয়ে যায়। অভ্রকে বেড়িয়ে যেতে দেখে মায়রাও বেড়িয়ে যায়।
______________
আরহাম মেহেভীনের পাশে বসে আছে। মেহেভীনের মায়াবী মুখখানা কেমন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। মেহেভীনের মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে আরহাম দীর্ঘশ্বাস ফেলে।আরহামের ভিতরেও দহন হচ্ছে, যা সে তা চাইলেও প্রকাশ করতে পারছে না। আরিয়ান আরহামের অবস্হা দেখে লম্বা নিঃশ্বাস নেয়। তার ভাই এবং তার বন্ধু মেহু দুজনেই যেই কষ্টের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তাতে সে তার ভিতরটাও জ্বলে যাচ্ছে। সব তো ঠিকই ছিলো, তাহলে হঠাৎ সব এলোমেলো হয়ে গেলো কেন? আরহামের মুখের দিকে আরিয়ান চাইলেও তাকাতে পারছে না। অতিরিক্ত কষ্ট বুকে চেপে রাখলে মানুষকে একটা পাথর মনে হয়, আরিয়ানের কাছে আরহামকে বর্তমানে সেই পাথর মনে হচ্ছে। আরিয়ান এগিয়ে গিয়ে, আরহামের কাঁধে হাত রেখে বলে,
‘ মানুষ কষ্ট বুকে পুষে রাখতে রাখতে একসময় সেই কষ্টগুলো পাহাড়ের সমতল্য হয়ে যায়। তখন তা চাইলেও বুক থেকে সরানো যায়না। কষ্ট বুকে পুষে রাখলে যে শুধু কষ্টই বাড়ে ভাই। তার থেকে বরং তুই একটু কেঁদে নিজেকে হাল্কা কর না ভাই। ‘
আরহাম কথা বলেনা চুপ হয়ে থাকে। আরহামের নিরবতা আরিয়ানের ভিতরটাকে আরো পুড়িয়ে তুলছে। আরিয়ানের এই পরিবেশে থাকতে দমবন্ধ লাগছে। এই পরিস্হিতে কেউ কি নেই তাকে একটু শান্তি দিতে পারবে?সে কিছু একটা ভেবে দ্রুত পায়ে
বেড়িয়ে গেলো কেবিন থেকে।
___________
ফারিয়া নিজের রুমে শুয়ে কার্টুন দেখছিলো আর বসে বসে চিপ্স খাচ্ছিলো। যদিও তার মা তাকে পড়তে বলেছে, কিন্তু ফারিয়া কি আদোও পড়ার মেয়ে? পড়া ছাড়া সবকিছুই সে করতে পারবে। তখনি তার ফোনে মেসেজ আসে। ফারিয়া তাকিয়ে দেখে আরিয়ানের মেসেজ তাতে লিখা,
‘ আমি তোমার বাসার নীচেই রয়েছি। একটু আসবে প্লিয নীচে। শুধু একটা মিনিট দেখা করেই চলে যাবো। ‘
এতো রাতে আরিয়ানের এমন মেসেজে যথেষ্ট চম্কিত হয় ফারিয়া। সে সঙ্গে সঙ্গে মেসেজের রিপ্লাই দিয়ে বলে,
‘ আপনি আমার সাথে মজা করছেন তাইনা ডাক্তার সাহেব? দূর এতো রাতে প্র্যাংক করছেন কেন?’
‘ আমি কোন মজা করছি না। চাইলে তুমি বারান্দায় এসে দেখে যেতে পারো। ‘
ফারিয়া মেসেজ টি পেয়েই বারান্দায় গিয়ে চমকে গেলো। সত্যি আরিয়ান এসেছে। আরিয়ান সঙ্গে সঙ্গে আবারোও মেসেজ দিয়ে বলে,
‘ নীচে আসবে প্লিয? কিছুক্ষন এর জন্যে হলেও প্লিয এসো। জানি এতো রাতে হয়তো তোমাকে খুব বিরক্ত করছি,কিন্তু বিশ্বাস করো এই মুহুর্তে তোমাকে আমার বড্ড প্রয়োজন। ‘
ফারিয়া এই আকুতি ভরা মেসেজ পড়ে নিজেকে দমিয়ে রাখতো পারলো না। তার মাকে কিছু একটা বুঝিয়ে সে নীচে চলে আসতেই, সে দেখতে পেলো গাড়িতে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে আরিয়ান। ফারিয়া দেখেই, সে এগিয়ে এলো। আরিয়ানের চেহারা দেখেই ফারিয়ার কপালে দুশ্চিন্তার ভাজ পড়ে গেলো। কেননা আরিয়ানের চোখ ছলছল হয়ে রয়েছে।
‘ কি হয়েছে ডাক্তার সাহেব? সব ঠিক আছো তো? ‘
ফারিয়ার প্রশ্নে আরিয়ান উত্তর দিয়ে বললো,
‘ কিচ্ছু ঠিক নেই ফারিয়। কিচ্ছু ঠিক নেই। ভাই মেহু কেউ ঠিক নেই। সবাই খুব কষ্ট পাচ্ছে। আমি আর পারছি না ফারিয়া। আমারোও যে বড্ড কষ্ট হচ্ছে।’
কথাটি বলেই আরিয়ান ফারিয়াকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে কান্নার সুরে বলে,
‘ সব এতোটা এলোমেলো হয়ে গেলো কেন ফারিয়া?
আমি যে নিজেকেই সামলাতে পারছি না। তাহলে ভাই এবং মেহুকে কীভাবে সামলাবো? ‘
আরিয়ান ফারিয়াকে জড়িয়ে ধরায় ফারিয়া স্হগিত হয়ে গেলো একপ্রকার। প্রথম কোন পুরুষ তাকে এইভাবে জড়িয়ে ধরেছে।
সে জানে আরিয়ান তাকে আবেগপ্রবণ হয়েই তাকে জড়িয়ে ধরেছে। হয়তো বড্ড কষ্টে আছে আরিয়ান। আরিয়ানের কান্নার সুরে বলা প্রতিটি কথা ফারিয়ার বুকে গিয়ে লাগে। সেও আরিয়ানের পিঠে হাত রেখে, আরিয়ানকে শান্ত করার প্রচেস্টা থাকে। সে আরিয়ানের কাছে কারণ জানতে চাইলে আরিয়ান সব খুলে বলে তাকে। সব শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় ফারিয়া।চোখে তার জল এসে জমা হয়ে থাকে।
_________< আরহাম পানি খেতে গিয়েছিলো,কেবিনে এসেই দেখে মেহেভীনের জ্ঞান ফিরেছে। সে তার পাশে থাকা সব জিনিস ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে এবং চিৎকার করে বলছে,'তোমরা সবাই আমাকে মিথ্যে বলছো। আমি জানি তো আমার বেবীর কিচ্ছু হয়নি। তোমরা আমার বেবীকে লুকিয়ে রেখেছো। এনে দাও না আমার বেবীকে। ' তখনি মেহেভীনের চোখ যায় আরহামের কাছে। সে আরহামের দিকে তাকিয়ে বলে, ' আরহাম সাহেব! আপনিও কিন্তু কিচ্ছু বলছেন না। আমার বেবীকে এখুনি এনে দিন। ' আরহাম এগিয়ে মেহেভীনের গালে হাত রেখে ভেজা গলায় বলে, ' মেহেভীন প্লিয তুমি নিজেকে সামলাও। ' মেহেভীন তৎক্ষনাক আরহাম হাত সরিয়ে বলে, ' ছেড়ে দিবো মানে? আপনিও আমার সাথে মিথ্যে কথা বলছেন। আচ্ছা আমি নিজেই আমার বেবীকে খুঁজতো যাবো।' মেহেভীন একপ্রকার পাগল হয়েই নিজের হাতের ক্যানেলা খুলতে চাইলে ডক্টর জেসমিন দ্রুত মেহেভীনকে অজ্ঞান করার ইঞ্জেকশন পুশ করে দেয়,কেননা এখন মেহেভীনকে অজ্ঞান না করলে আটকানো যাবে না। আরহামও যেন এইবার ধীরে ধীরে দূর্বল হয়ে যাচ্ছে। প্রেয়সী এমন করুন দশা দেখাটা সত্যি বড্ড কষ্টকর। আরহাম না পেরেই গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে যায়। আরহামের গাড়ি নদীর পাড়ে গাড়িটি রেখে বেড়িয়ে আসে। নদীর কিনারা বসে চিৎকার করে কেঁদে উঠে। যেই বাচ্চাটাকে নিয়ে তার এতো স্বপ্ন ছিলো সে তো চলে গেলোই তার মধ্যে মেহেভীনের এই করুন দশা। সবমিলিয়ে আরহাম ও নিজেকে সামলাতে পারছে না। চিৎকার করে কেঁদে সে তার কষ্টগুলো একটু কমানোর প্রচেস্টায় থাকে। আজ যদি বেবীটা তাদের সাথে থাকতো তাহলে কি খুব ক্ষতি হতো? এতোদিন নিজের সন্তানের মতো ভালোবেসে ফেলেছিলো বেবীটাকে। ________ সারারাত আরহাম হাসপাতালে ফিরেনি। সকালেই সে ফিরে আসে হাসপাতালে। মেহেভীন জ্ঞান ফিরার পর একদম চুপচাপ হয়ে যায়। কোন কথা বলেনি কারো সাথে। এক দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আরহাম আসতেই সে মুখ খুলে বলে, ' আমাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাবেন আরহাম সাহেব?' মেহেভীন এই অবস্হায়.... #তুমি_আছো_মনের_গহীনে 💖 #পর্ব- ৪৭ #Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা) আরহাম মেহেভীনের দিকে দৌড়াতে নিলে,মেহেভীন থেমে যায়। মেহেভীনকে থেমে যেতে দেখে আরহাম ও থেমে যায়। মেহেভীন হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যেতে নিলে, আরহাম এসে মেহেভীনকে আকড়ে ধরে। আরহাম মেহেভীনের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় মেহেভীনের সিজার করা জায়গা থেকে রক্ত বের হচ্ছে। আরহাম ঘাবড়ে গিয়ে মেহেভীনকে পাজকোলে তুলে দ্রুত হাসপাতালের দিকে নিয়ে যায়। ডক্টর জেসমিন মেহেভীনের সিজার করা জায়গাটাকে পুনরায় বেন্ডিজ লাগিয়ে দিয়ে, বাইরে বেড়িয়ে আসে। ডক্টরকে দেখেই আরহাম বলে উঠে, ' মেহেভীন ঠিক আছে তো ডক্টর? ' ' জ্বী আপাতত ঠিক আছে। আরেকটু হলেই সিলিটা ছিড়ে যেতো। যেভাবে এই অবস্হায় মেহেভীন দৌড়াচ্ছিলো। আমি বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মেহেভীন এখন নিজের মধ্যে নেই। মেহেভীন প্রচন্ড রকমের শোকের মধ্যে আছে। তাইতো সবেমাত্র সিজার করা অবস্হায় যেখানে অন্য মেয়েরা নড়তে পারেনা,সেখানে মেহেভীন দৌড় দিয়ে ফেলেছিলো। আসলে আমিও বুঝতে পারি একজন মা যখন শুনে তখন তার সন্তান বেঁচে নেই তখন সেই মা কি আর ঠিক থাকে? তখন সে নিজের মধ্যে একেবারেই থাকে না। ' ডক্টরের জেসমিনের কথায় সায় দিয়ে আরিয়ান ও বললো, ' তা ঠিক। প্রচন্ড রকমের শোকের মধ্যে থাকলে মানুষ তখন নিজের ব্যাথা -যন্ত্রনা সব ভূল গিয়ে অন্য একটা জগতে চলে যায় । যেমনটা মেহেভীনও করেছিলো। ' আরহাম নিজের চোখের কোণে থাকা জলটুকু মুছে থমথমে গলায় বলে, ' মেহেভীনকে আমরা কবে বাড়ি নিয়ে যেতে পারবো?' ' তা ঠিক বলতে পারবো না। মেহেভীনের মানষিক অবস্হার উপর দিয়ে যা যাচ্ছে। তাতে কখন মেহেভীন সুস্হ হয়ে উঠবে তা বলা যাচ্ছে না। ' অভ্রের এক পলক কাচের জানালা দিয়ে তার মেহুকে দেখে নেয়। আজ তারই করা এক ভুলের জন্যে মেয়েটাকে এতোটা শাস্তি পেতে হচ্ছে। নিজেকে নিজের সন্তানের খুনি মনে হচ্ছে। মেহেভীন তখন নিজের মতো না থাকলেও, সে ঠিকই বলেছে। আজ অভ্রের জন্যেই তাদের সন্তান তাদের ছেড়ে চলে গেলো। তার ভুলের মাশুল গুনতে হলো ছোট্ট শিশুটাকে। অভ্র আর এক মিনিট ও দাঁড়ায় না বেড়িয়ে যায়। অভ্রকে বেড়িয়ে যেতে দেখে মায়রাও বেড়িয়ে যায়। ______________ আরহাম মেহেভীনের পাশে বসে আছে। মেহেভীনের মায়াবী মুখখানা কেমন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। মেহেভীনের মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে আরহাম দীর্ঘশ্বাস ফেলে।আরহামের ভিতরেও দহন হচ্ছে, যা সে তা চাইলেও প্রকাশ করতে পারছে না। আরিয়ান আরহামের অবস্হা দেখে লম্বা নিঃশ্বাস নেয়। তার ভাই এবং তার বন্ধু মেহু দুজনেই যেই কষ্টের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তাতে সে তার ভিতরটাও জ্বলে যাচ্ছে। সব তো ঠিকই ছিলো, তাহলে হঠাৎ সব এলোমেলো হয়ে গেলো কেন? আরহামের মুখের দিকে আরিয়ান চাইলেও তাকাতে পারছে না। অতিরিক্ত কষ্ট বুকে চেপে রাখলে মানুষকে একটা পাথর মনে হয়, আরিয়ানের কাছে আরহামকে বর্তমানে সেই পাথর মনে হচ্ছে। আরিয়ান এগিয়ে গিয়ে, আরহামের কাঁধে হাত রেখে বলে, ' মানুষ কষ্ট বুকে পুষে রাখতে রাখতে একসময় সেই কষ্টগুলো পাহাড়ের সমতল্য হয়ে যায়। তখন তা চাইলেও বুক থেকে সরানো যায়না। কষ্ট বুকে পুষে রাখলে যে শুধু কষ্টই বাড়ে ভাই। তার থেকে বরং তুই একটু কেঁদে নিজেকে হাল্কা কর না ভাই। ' আরহাম কথা বলেনা চুপ হয়ে থাকে। আরহামের নিরবতা আরিয়ানের ভিতরটাকে আরো পুড়িয়ে তুলছে। আরিয়ানের এই পরিবেশে থাকতে দমবন্ধ লাগছে। এই পরিস্হিতে কেউ কি নেই তাকে একটু শান্তি দিতে পারবে?সে কিছু একটা ভেবে দ্রুত পায়ে বেড়িয়ে গেলো কেবিন থেকে। ___________ ফারিয়া নিজের রুমে শুয়ে কার্টুন দেখছিলো আর বসে বসে চিপ্স খাচ্ছিলো। যদিও তার মা তাকে পড়তে বলেছে, কিন্তু ফারিয়া কি আদোও পড়ার মেয়ে? পড়া ছাড়া সবকিছুই সে করতে পারবে। তখনি তার ফোনে মেসেজ আসে। ফারিয়া তাকিয়ে দেখে আরিয়ানের মেসেজ তাতে লিখা, ' আমি তোমার বাসার নীচেই রয়েছি। একটু আসবে প্লিয নীচে। শুধু একটা মিনিট দেখা করেই চলে যাবো। ' এতো রাতে আরিয়ানের এমন মেসেজে যথেষ্ট চম্কিত হয় ফারিয়া। সে সঙ্গে সঙ্গে মেসেজের রিপ্লাই দিয়ে বলে, ' আপনি আমার সাথে মজা করছেন তাইনা ডাক্তার সাহেব? দূর এতো রাতে প্র্যাংক করছেন কেন?' ' আমি কোন মজা করছি না। চাইলে তুমি বারান্দায় এসে দেখে যেতে পারো। ' ফারিয়া মেসেজ টি পেয়েই বারান্দায় গিয়ে চমকে গেলো। সত্যি আরিয়ান এসেছে। আরিয়ান সঙ্গে সঙ্গে আবারোও মেসেজ দিয়ে বলে, ' নীচে আসবে প্লিয? কিছুক্ষন এর জন্যে হলেও প্লিয এসো। জানি এতো রাতে হয়তো তোমাকে খুব বিরক্ত করছি,কিন্তু বিশ্বাস করো এই মুহুর্তে তোমাকে আমার বড্ড প্রয়োজন। ' ফারিয়া এই আকুতি ভরা মেসেজ পড়ে নিজেকে দমিয়ে রাখতো পারলো না। তার মাকে কিছু একটা বুঝিয়ে সে নীচে চলে আসতেই, সে দেখতে পেলো গাড়িতে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে আরিয়ান। ফারিয়া দেখেই, সে এগিয়ে এলো। আরিয়ানের চেহারা দেখেই ফারিয়ার কপালে দুশ্চিন্তার ভাজ পড়ে গেলো। কেননা আরিয়ানের চোখ ছলছল হয়ে রয়েছে। ' কি হয়েছে ডাক্তার সাহেব? সব ঠিক আছো তো? ' ফারিয়ার প্রশ্নে আরিয়ান উত্তর দিয়ে বললো, ' কিচ্ছু ঠিক নেই ফারিয়। কিচ্ছু ঠিক নেই। ভাই মেহু কেউ ঠিক নেই। সবাই খুব কষ্ট পাচ্ছে। আমি আর পারছি না ফারিয়া। আমারোও যে বড্ড কষ্ট হচ্ছে।' কথাটি বলেই আরিয়ান ফারিয়াকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে কান্নার সুরে বলে, ' সব এতোটা এলোমেলো হয়ে গেলো কেন ফারিয়া? আমি যে নিজেকেই সামলাতে পারছি না। তাহলে ভাই এবং মেহুকে কীভাবে সামলাবো? ' আরিয়ান ফারিয়াকে জড়িয়ে ধরায় ফারিয়া স্হগিত হয়ে গেলো একপ্রকার। প্রথম কোন পুরুষ তাকে এইভাবে জড়িয়ে ধরেছে। সে জানে আরিয়ান তাকে আবেগপ্রবণ হয়েই তাকে জড়িয়ে ধরেছে। হয়তো বড্ড কষ্টে আছে আরিয়ান। আরিয়ানের কান্নার সুরে বলা প্রতিটি কথা ফারিয়ার বুকে গিয়ে লাগে। সেও আরিয়ানের পিঠে হাত রেখে, আরিয়ানকে শান্ত করার প্রচেস্টা থাকে। সে আরিয়ানের কাছে কারণ জানতে চাইলে আরিয়ান সব খুলে বলে তাকে। সব শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় ফারিয়া।চোখে তার জল এসে জমা হয়ে থাকে। _________< আরহাম পানি খেতে গিয়েছিলো,কেবিনে এসেই দেখে মেহেভীনের জ্ঞান ফিরেছে। সে তার পাশে থাকা সব জিনিস ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে এবং চিৎকার করে বলছে,'তোমরা সবাই আমাকে মিথ্যে বলছো। আমি জানি তো আমার বেবীর কিচ্ছু হয়নি। তোমরা আমার বেবীকে লুকিয়ে রেখেছো। এনে দাও না আমার বেবীকে। ' তখনি মেহেভীনের চোখ যায় আরহামের কাছে। সে আরহামের দিকে তাকিয়ে বলে, ' আরহাম সাহেব! আপনিও কিন্তু কিচ্ছু বলছেন না। আমার বেবীকে এখুনি এনে দিন। ' আরহাম এগিয়ে মেহেভীনের গালে হাত রেখে ভেজা গলায় বলে, ' মেহেভীন প্লিয তুমি নিজেকে সামলাও। ' মেহেভীন তৎক্ষনাক আরহাম হাত সরিয়ে বলে, ' ছেড়ে দিবো মানে? আপনিও আমার সাথে মিথ্যে কথা বলছেন। আচ্ছা আমি নিজেই আমার বেবীকে খুঁজতো যাবো।' মেহেভীন একপ্রকার পাগল হয়েই নিজের হাতের ক্যানেলা খুলতে চাইলে ডক্টর জেসমিন দ্রুত মেহেভীনকে অজ্ঞান করার ইঞ্জেকশন পুশ করে দেয়,কেননা এখন মেহেভীনকে অজ্ঞান না করলে আটকানো যাবে না। আরহামও যেন এইবার ধীরে ধীরে দূর্বল হয়ে যাচ্ছে। প্রেয়সী এমন করুন দশা দেখাটা সত্যি বড্ড কষ্টকর। আরহাম না পেরেই গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে যায়। আরহামের গাড়ি নদীর পাড়ে গাড়িটি রেখে বেড়িয়ে আসে। নদীর কিনারা বসে চিৎকার করে কেঁদে উঠে। যেই বাচ্চাটাকে নিয়ে তার এতো স্বপ্ন ছিলো সে তো চলে গেলোই তার মধ্যে মেহেভীনের এই করুন দশা। সবমিলিয়ে আরহাম ও নিজেকে সামলাতে পারছে না। চিৎকার করে কেঁদে সে তার কষ্টগুলো একটু কমানোর প্রচেস্টায় থাকে। আজ যদি বেবীটা তাদের সাথে থাকতো তাহলে কি খুব ক্ষতি হতো? এতোদিন নিজের সন্তানের মতো ভালোবেসে ফেলেছিলো বেবীটাকে। ________ সারারাত আরহাম হাসপাতালে ফিরেনি। সকালেই সে ফিরে আসে হাসপাতালে। মেহেভীন জ্ঞান ফিরার পর একদম চুপচাপ হয়ে যায়। কোন কথা বলেনি কারো সাথে। এক দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আরহাম আসতেই সে মুখ খুলে বলে, ' আমাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাবেন আরহাম সাহেব?' মেহেভীন এই অবস্হায়.... #তুমি_আছো_মনের_গহীনে 💖 #পর্ব- ৪৮ #Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা) মেহেভীনের এই অবস্হায় আরহামের কাছে ছোট্ট একটা আবদার নিবেদন করেছে। সেই আবদার নাখোঁচ করার ক্ষমতা কি আরহামের আদোও আছে? আরহামের কিছুক্ষন ভেবে সিদ্ধান্ত নিলো সে মেহেভীনের আবদার পূরণ করবে। আরহাম হাল্কা গলায় বললো, ' কোথায় যেতে চাও তুমি? ' ' আপনার বাসায় নিয়ে যাবেন আমায়? আমাকে দ্রুত হসপিটাল থেকে ডিস্টার্চ করার ব্যবস্হা করুন আরহাম সাহেব। ' মেহেভীন নিজ ইচ্ছেয় আরহামের বাসায় যেতে চাইছে, যার ফলে কিছুটা অবাক হলেও মেহেভীনের কথাকে গুরুত্ব দিয়ে বড় বড় পা ফেলে ডক্টরের সাথে কথা বলতে চলে যায়। ডক্টর জেসমিন মেহেভীন এতো তাড়তাড়ি হসপিটাল থেকে ছাড়তে না চাইলেও,আরহাম তাকে বুঝিয়ে মেহেভীনকে ডিস্টার্চ করিয়ে, বাড়িতে নিয়ে আসে। আরিয়ান ও সারারাত বাড়ির বাইরে ছিলো মধ্যরাতে সে হসপিটালে চলে গিয়েছিলো। এখন তার হসপিটালে ডিউটি রয়েছে,তাই আরহামই মেহেভীনকে বাড়িতে নিয়ে আসে। তারা বাড়িতে আসতেই,মেহেভীনের বাবা-মা মেহেভীনের মুখশ্রীকে দেখে আঁতকে উঠে। মেয়েটার মায়াবী মুখশ্রী একদিনই কেমন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। আরহামের চোখ-মুখের অবস্হাও স্বাভাবিক নয়। আখিজোড়া কেমন করে ফুলে রয়েছে। ছেলের চোখ-মুখের অবস্হা দেখে আরহামের মায়ের বুঝতে বাকি রইলো তার ছেলেটি নিশ্চই খুব কেঁদেছে। আরহামের বাবা-মা মেহেভীনকে শান্তনা দিতে প্রস্তুত হলে আরহাম তাদের চোখের পলক ফেলে ইশারা করে যেন, আপাতত মেহেভীনকে কিছু যেন না বলে। মেহেভীন আস্তে আস্তে সিড়ি বেয়ে উঠতে চাইলেও পারেনা। পেটের সিলিতে টান পড়ে। ব্যাথায় মুখ থেকে আলতো ব্যথার সুর বের করে। সেই ব্যাথার সুরের রেশ ধরে আরহাম দ্রুত মেহেভীনের হাতটাকে নিজের কাঁধে রেখে,মেহেভীনের সমস্ত ভার তার উপর নিয়ে নেয়। অতঃপর আস্তে ধীরে ধীরে আরহাম মেহেভীনের রুমে নিয়ে যায়। উপরেই উঠেই মেহেভীন সর্বপ্রথম আরহামের ঘরের সামনে মৃদ্যু ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ফেলে। আরহামের ঘর-জুড়ে বাচ্চাদের বিভিন্ন ছবি দেয়াল জুড়ে রয়েছে। বাচ্চাদের খেলনাও চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। আরহাম কিনে রেখেছিলো বেবীর জন্যে। মেহেভীন এক পা এগিয়ে ছোট্ট কাবার্ড বের করে বাচ্চাদের সব জামা-কাপড় বের করে নিয়ে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। এইসব কাপড় সে এবং আরহাম একসাথে কিনিছিলো বেবীর জন্যে। মেহেভীন চোখটা বন্ধ করে, সুদীর্ঘ শ্বাস ফেলে ঠোটের কোণে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটিয়ে বলে, ' আরহাম সাহেব! আপনারা সবাই মিথ্যে বলেছেন। আমার বেবী তো বেঁচে আছেই। এই ঘরে প্রতিটি কোণায় কোণায় তার জিনিস-পত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তার মানে সে বেঁচে আছে। এই ঘরেই আছে সে। শুধুমাত্র আমার থেকে লুকিয়ে আছে। বড্ড দুষ্টু তো আমার মেয়েটা। ' মেহেভীন বাচ্চার জন্যে নিয়ে আসা ছোট্ট বেডে মাথা ঠেকিয়ে,বিড়বিড় করে বলে, ' আমার বেবীর কিচ্ছু হয়নি। সে বেঁচে আছে। আমি তো মা। আমি জানবো না তো কে জানবে? আমার বাচ্চা বেঁচে আছে। আমি খুব ভালো করেই অনুভব করতে পারি সে আছে। আমার খুব কাছেই আছে সে।' মেহেভীনের করা এইসব কার্যকলাপগুলো আরহামের কষ্টকে আরো দ্বিগুনভাবে বাড়িয়ে তুলছে। খুব শখ করে তার ঘরটাকে সাঁজিয়েছিলো সে। ভেবেছিলো বাচ্চাটা যখন আসবে, তখন সে এই ঘরে খেলবে হাঁসবে। আরহাম অফিস শেষে বাচ্চাটাকে নিজ হাতে ঘুম পাড়িয়ে দিবে,কিন্তু নিয়তির নিষ্টুর খেলায় আজ সবকিছুই শুধুমাত্র একটা স্বপ্ন। আরহামের দরজা দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে মেহেভীনকে দেখতে থাকে। কাঁধে কারো স্পর্শ পেতেই সে দেখতে পায় তার মা দাঁড়িয়ে আছে। মাকে দেখে সে নিজেকে সংযত করতে পারেনা বরং চোখের কোনে লেগে থাকা জলটুকু মুছে মাকে জড়িয়ে ধরে। _____________ অভ্র ওয়াইনের বোতলটা নিয়ে তাতে চুমুক দিয়ে দেয়। চোখগুলো ঘোলা ঘোলা দেখালেও,সে স্পষ্ট দেখতে পারছে মেহেভীন তার দিকে এগোতে এগোতে বলছে সে খুনি! হ্যা অভ্র তার সন্তানের খুনি। অভ্র আর দেখতে পেলো না। মুহুর্তেই কোথায় যেন হারিয়ে গেলো মেহেভীন। অভ্র মুখ চেপে কাঁদছে। ইশরা বেগম ছেলেকে কাঁদতে দেখে বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞাসা করে,' অভ্র বাবা কি হয়েছে তোমার? এইভাবে কাঁদছো কেন তুমি? ' অভ্র তার মায়ের দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে, মায়ের ডান হাতে নিজের মাথা ঠেকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ' মা গো! মেহেভীন বলেছে আমি নাকি আমার সন্তানের খুনি। আচ্ছা আমি কি সত্যিই বাবা হয়ে নিজের সন্তানের খুনি হতে পারি? আমি কি এতোটাই খারাপ মা? মা গো বলো না। আমি কি এতোটাই খারাপ। ' সন্তানের ব্যাথায় ইশরা বেগম নিজেও ব্যাথিত হলেন। ছেলের বুক চেপে, ঠোট কামড়ে বললেন, ' না বাবা কে বলেছে তুমি খারাপ? আমি খারাপ। হ্যা হ্যা আমি খারাপ। ' অভ্র বোধহয় আর কিছু শুনতে পেলো। আখিজোড়া বন্ধ হয়ে এলো তার। ইশরা বেগম বুঝলেন অতিরিক্ত নেশা করে অভ্র ঘুমিয়ে পড়েছে। ইশরা বেগম ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে রুম ত্যাগ করলেন। _________________ আরিয়ান নিজের চেম্বার বসে রয়েছে, তখনি কেউ তার সামনে একটা বাটি রাখে। আরিয়ান তাকিয়ে দেখে ফারিয়া। ফারিয়ার দিকে এমনভাবে তাকালো যেন ফারিয়াকে সে এখানে আশাই করেনি। আরিয়ান বিস্ময় গলায় বললো, ' তুমি? ' ' হুম আমি। আমি তো জানি আমার সাথে কথা বলে আসার পর আপনি আর বাড়ি যাননি। তাই আপনি কিছু খাননি। তাই আমি আপনার জন্যে হাল্কা নাস্তা নিয়ে আসলাম।' আরিয়ান নিজেকে হাল্কা করার জন্যে ফারিয়ার সাথে কাল অনেকটাসময় ধরে কথা বলেছে। আরিয়ান জানে এই মেয়েটার সাথে কিছুক্ষন কথা বললে সে অনেকটাই হাল্কা হয়ে যাবে। যা সে হয়েছে ও। আরিয়ানের মাঝে মাঝে মনে হয় মেয়েটার মাঝে এমনকি আছে যার ফলে আরিয়ান মেয়েটার দিকে বার বার আর্কষিত হয়। আচ্ছা মেয়েটার নাম তো ফারিয়া কেন? আরিয়ানের ধারণামতে, নামটা ফারিয়া না হয়ে 'চম্বকীয় মেয়ে' হওয়া উচিৎ ছিলো। আরিয়ানের উদ্ভুট ভাবনার মাঝে ফোড়ন কেটে,ফারিয়া বললো, ' কি হলো ডাক্তার সাহেব কি এতো ভাবছেন? নাস্তাটা খেয়ে নিন। ' ' জ্বী আচ্ছা। ' আরিয়ান সঙ্গে সঙ্গে বাটিটা হাতে নিয়ে দেখে তাতে আলু পরোটা। আরিয়ান একটা খেয়ে নেয়। অতঃপর ফারিয়ার কথা শুনার জন্যে মনোযোগী হয়। ফারিয়া নরম গলায় বললো, ' দেখুন আপনি এখন খেয়ে বাড়িতে যান। আপনিও যদি এখন বাইরে বাইরে থাকেন এবং পরিস্হিতি থেকে পালানোর চেস্টা করেন তাহলে সেইটা খুব একটা ভালো হবে না।' আরিয়ান নিম্নসুরে বললো, ' তাহলে আমি করবো? আমি বাড়িতে কীভাবে যাবো? ভাই এবং মেহুর কষ্ট দেখে আমার নিজের ভিতরটাও যে জ্বলে।' ' তাই বলে এইভাবে পালাবেন? পরিস্হিতি ফেস করতে শিখুন ডাক্তার সাহেব। কঠিন পরিস্হিতি আমাদের জীবনে বহুবার আসবে যাবে তাই বলে দমে গেলে কিছুতেই হবেনা,বরং কঠিন পরিস্হিতিতে আমাদের শক্ত থাকতে হবে। আপনি বাসায় যান। এই সময় আরহাম ভাইয়া এবং মেহেভীন আপুকে আপনার বড্ড প্রয়োজন। ' ফারিয়ার কথা শুনে আরিয়ান মুগ্ধ হয়। মেয়েটা কতটা সুন্দরভাবে তাকে বুঝিয়ে দিলো। _______________ দিনের পর দিন যায় মাসের পর মাস ও চলে যায়। থেকে যায় অতীতের কিছু বিশাক্ত ক্ষত। সেই ক্ষতগুলো চাইলেও মুছে ফেলা যায়না জীবন থেকে। ক্ষতগুলো যেন আজীবন রয়ে যায়। দেখতে দেখতে চার মাস হয়ে গেলো মেহেভীনের সন্তান মারা গিয়েছে। সবাই আগের থেকে কিছুটা স্বাভাবিক হলেও মেহেভীন হতে পারেনি। শত হলেও মা তো। মেহেভীন এখন আরহামের ঘরেই সারাদিন বসে থেকে সারাদিন বাচ্ছার খেলনা - জামাকাপড়গুলো আগলে রাখে। আরহামের রুমের সাথেই আরহাম আরেকটা এটাচ করে রুম বানিয়ে ফেলেছে। সেখানেই বাচ্ছার সব খেলনা জামাকাপড় বাচ্ছার ছোট্ট বিছানা সব রয়েছে। মেহেভীন সেই এটাচ করা রুমেই সারাদিন থাকে। কারো সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। কারো পায়ের শব্দে পিছনে ঘুড়ে মেহেভীন দেখে আরহাম দাঁড়িয়ে আছে। আরহাম ধীর পেয়ে এগিয়ে এসে, মেহেভীনের কাছে এসে শান্ত গলায় বললো, ' সকাল থেকে কিচ্ছু খাও নি। এইবার অন্তত টোস্ট টা খেয়ে নাও। তুমি খাওয়ার পরে আমি অফিসে যাবো। ' মেহেভীন নির্লিপ্ত ভাবেই জবাব দিয়ে বললো, ' আমি খাবো না। ' ' খাবো না মানে? দেখো মেহেভীন স্টুপিডের অনেক জেদ দেখিয়েছো এতোদিন। আমি আর সহ্য করবো না। খুব বকবো আমি তোমায়। চুপচাপ খেয়ে নাও। এইভাবে অনিয়ম করতে থাকলে কিন্তু অসুস্হ হয়ে পড়বে। ' মেহেভীন দমে যাওয়া গলায় বললো, ' আমি সত্যি কিচ্ছু খেতে পারবো না আরহাম সাহেব। আমার শুধু নিজেকে ব্যর্থ মনে হচ্ছে। আমি একজন ব্যর্থ মা। যে নিজের সন্তানকে রক্ষা করতে পারেনা। সে কখনোই মা হওয়ার যোগ্যতা রাখেনা। আমি জীবনের প্রতিটা মুহুর্তেই ব্যর্থ হয়েছি আরহাম সাহেব।' আরহাম শীতল গলায় বললো, ' ব্যর্থতা বলে জীবনে কিছুই নি। আমরা যখন জীবনের কিছু কঠিন মুহুর্তে এসে নিজেদের পরাজিত মনে করি তখনি আমরা ব্যর্থতা নামক শব্দটা প্রয়োগ করি। জীবনে অনেক কঠিন মুহুর্ত আসবে,কিন্তু তাই বলে কি জীবন থেমে থাকে? ব্যর্থতা থেকেই নতুন ভালো কিছু সূচনা হয়, যদি আমরা চাই। আমি জানি তুমি আপাতত যে সময়টাতে আছো তাতে ভেঙ্গে পড়াটা স্বাভাবিক। আমরাও প্রথমে অনেকটা ভেঙ্গে পড়েছিলাম,কিন্তু এখন নিজেকে শক্ত করো মেহেভীন। জীবনটা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। ' মেহেভীন আরহামের কথা শুনে প্রতিউত্তরে কিছু বললো না। নিভু নিভু দৃষ্টিতে জানালার দিকে তাকিয়ে রইলো। ____________ সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গেলো। আরহাম অফিসের কাজ সেরে সবেমাত্র অফিস থেকে বেড়িয়ে আসবে তখনি বাড়ি থেকে ফোন আসে। মেহেভীন নাকি কাউকে কিছু না বলেই বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে। কথাটি শুনেই আরহামের মাথায় রক্ত চড়ে বসে। আরহাম তার হাত দুটো টেবিলে রেখে বাড়ি দিয়ে বলে, ' মেহেভীন এইবার দেখবে তুমি আরহাম হাসান তালুকদার কি জিনিস। এইবার আমি সহ্য করবো না। আমার থেকে দূরে যাওয়ার স্পর্ধা কি করে মাথায় আসলো তোমার? ' ________চলবে....কী?