#তুমি_গহীন_অনুভব
#অন্তিম_পর্ব
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি
সামনে আইজান কে দেখে ও চোখ বন্ধ করে নিল। আর চোখ খুলে ও আর আইজানকে দেখতে পেল না
এটা ভেবে ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মানুষ টা এত দূরে তবুও মায়ায় জরিয়ে রেখেছে সাংঘাতিক ভাবে। আয়েশা চৌধুরী ইরজাকে সামনে ওর দু হাত ধরে বলল,,,
“ইরজা আমাকে মাফ করে দাও। আমি কিছু বুঝতে পারি নি আমি তো তখন জানতাম না। সবকিছুর পেছনে ইসহাক এর হাত আছে। আমি তো তোমাকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসতাম সেদিন আমারও কষ্ট লাগছিল তোমাকে বের করে দিতে কিন্তু আমি নিরুপায় ছিলাম। তুমি প্লিজ সব ভুলে আমাকে মাফ করে দাও। আমি যে আর পারছি না। তুমি চলে আসার পরই আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমি কি ভুল করেছি। আমি চাইনি তোমার সাথে খারাপটা করতে।
তখন ইরজা চোখ মুখ শক্ত করে বলল,,
“কিন্তু করেছিলেন তো আপনি। আর কি বললেন ভুলে যাবো। কি করে ভুলে যাব আপনি বলুন যার চোখের সামনে তার স্বামীকে আঘাত করা হয়েছিল এমনকি সে নিজেও অসুস্থ ছিল সেই মেয়েটাকে আপনি কি করে বলতে পেরেছিলেন যে তার জন্যই তার স্বামী দুনিয়ায় নেই। সব দোষ আপনি তার ঘাড়ে চাপিয়েছেন। এমনকি অসুস্থ অবস্থায় তাকে বের করে দিয়েছিলেন। আপনি জানেন তখন আমার মনের অবস্থা কি রকম ছিল আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। আপনার বোঝার উচিৎ ছিল যেভাবে আপনার সন্তান হাড়িয়ে গেছে তেমন তো আমার জীবনসঙ্গী ও হাড়িয়ে গেছে আপনি বুঝতে চান নি। ভালোবাসার মানুষ টা আপনার সামনে হাড়িয়ে গেলে কেমন লাগবে আপনার।”
কথাগুলো বলতে বলতে ইরজার চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পারছিল আয়েশা চৌধুরী তো কাঁদছেন-ই। ইরজা নিজেকে সামলিয়ে বলল,,,
“আমি আমার অতীতে ফিরতে চাই না এখন আমি বর্তমান আর আমার ইয়াদ কে ভালো থাকতে চাই। আর আল্লাহ যদি চান ভবিষ্যতে উত্তম কিছু হবে। আমি সুখী হবো। আপনি প্লিজ এখন যান আমি জানি না হয়তো আপনাকে খারাপ কিছুও বলে দিতে পারি। ”
“আমার কথাটা তো শুনো!”
“আমি কিছু শুনতে চাইনা আপনি প্লিজ চলে যান।
আয়েশা চৌধুরী কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল। ইরজা ফ্লোরে বসে পড়লো। ওর মনে পরলো। পাঁচ বছর আগে আয়েশা চৌধুরী ওর সাথে কি কি করছিল। আইজানকে সে রাতের পর আর পাওয়া যায় নি। ওরা যে গাড়িতে ছিল সেই গাড়িটা এক্সিডেন্ট হয়েছে সেটা সকলে জানতে পারে। মূলত ইসহাক চৌধুরী গল্পটা সাজিয়েছিলেন তেমন ভাবে। ওদের গাড়িটা নাকি একটা বড় গাছের সাথে ধাক্কা লেগেছিল তার পাশেই একটা খাদ ছিল সেই খাদে নাকি আইজান পড়ে গেছে।বলে সকলের ধারনা। কেউ আইজানের বডি দেখতে পায়নি তবে আইজানের ঘড়ি ওয়ালেট আর কিছু জিনিস দেখে সবাই বলে আইজান মারা গেছে। কেউ ইরজাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় । ইরজা হাতে আর মাথায় ব্যথা পেয়েছিল। ইশতিয়াক চৌধুরী ইরজার ট্রিটমেন্ট করিয়ে বাড়ি নিয়ে যায় ইরজা ঢুকে ড্রয়িংরুমে আসতেই আয়েশা চৌধুরী হুট করেই ইরজার গালে সজোরে থাপ্পড় মারে আর বলে,,,
“তুমি এই বাড়িতে পা রেখেছো কোন সাহসে? আজ তোমার জন্য আমার ছেলেটা আমাদের মাঝে নেই।
তখন ইসহাক চৌধুরী বললো,,,
“ঠিক বলেছো ভাবী এই মেয়েটার জন্যই আমাদের আইজান আমাদের কাছে নেই। এই মেয়েটার আবদার পূরণ করতে গিয়েই তো আমাদের ছেলেটা এইভাবে প্রান দিল। কে বলেছিল রাত করে বাইরে যাওয়ার জন্য।
ইরজা কিছু বলছে না ওর চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পরছে।তখন ইশতিয়াক চৌধুরী বললেন,,
“তোমরা পাগল হয়ে গেছো কি বলছো এসব। এখানে ইরজার কি দোষ এক্সিডেন্ট কি বলে কয়ে আসে। এটা যাস্ট একটা দূর্ঘটনা।”
“বাহ বাহ তুমি দেখছি এই মেয়েটার হয়ে কথা বলছো। তোমার ছেলের জন্য কি তোমার একটুও খারাপ লাগছে না। অবশ্য আইজান কে তুমি কখনো ভালোই বাসোনি। আইজানের সাথে মিশতেই পারো নি। তাই তো আইজান সবাইকে তুমি করে বললেও তোমাকে আপনি করে বলতো। কিন্তু এই মেয়েটা কয়েকদিনেই তোমাকে আপন করে নিল যে তুমি করেই বলে কতো আবদার তুমি পূরন করেছো। তুমি কখনো আইজান কে তোমার ছেলে বলে ভাবোই নি।
ইশতিয়াক চৌধুরী আর সহ্য করতে না পেরে আয়েশা চৌধুরীর গালে একটা থাপ্পড় মেরে দিলেন।আর বললেন,,,
“পাগল হয়ে গিয়েছো তুমি। তুমি সুস্থ মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা হাঁড়িয়ে ফেলেছো? এই মেয়েটার কথা তোমরা কেউ ভাবছো না। নিজের টাই দেখে যাচ্ছো এই মেয়েটা কি কি সহ্য করেছে তোমরা তা দেখছো না।”
“তুমি আমায় মারলে যা কিনা আমাদের এত বছরে সংসারে হয় নি। এই মেয়েটার জন্য তুমি আমাকে মারলে যার জন্য কিনা তোমার ছেলে হাড়িয়ে গেল। এই মেয়ে তুমি এক্ষনি আমার বাড়ি থেকে বের হও। কয়েকদিন আগেই বাবাকে খেয়েছো আর এখন স্বামীকেও তোমার জন্য আমার সংসারে আগুন লেগেছে তুমি কোন সংসারের জন্য ভালো কিছু নও।”
ইরজার হাত ধরে টানতে লাগলো আয়েশা চৌধুরী।ইরজাও বিনা বাক্যে তার সাথে চলে এলো। কারন ইরজা ইসহাক চৌধুরী কে সহ্য করতে পারছিল না। ইশতিয়াক চৌধুরী দিলেও কোন লাভ হয় নি আজ যেনো ওনার ওপর কেউ ভর করেছে। উনি দরজার সামনে এসে ইরজাকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল ইরজা মাটিতে পড়ে গেল। ইশতিয়াক চৌধুরী ইরজা বলে এগিয়ে যেতে চাইলে আয়েশা চৌধুরী বললেন,,,
“যে এখন এ বাড়ির বাইরে পা রাখবে তাকেও আমার জীবন থেকে একেবারেই জন্য বিদায় নিতে হবে। ওকে বের করে দেওয়ার আরেকটা কারন আমার ছেলেটা ওকে এই বাড়িতে এনেছিল এখন যখন ও নেই তাই এই মেয়েটার থাকারও কোন অধিকার নেই। এই মেয়েটাকে যতবার দেখবো ততবার মনে হবে এই মেয়েটার জন্য আমার ছেলেটা আজ নেই। আজ থেকে এই মেয়েটার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। চলে যাও তুমি আমি তোমার চেহারা দেখতে চাই না। আল্লাহ যেন তোমার চেহারা আর আমাকে না দেখায়।”
ইরজা কিছুই বললো না। ও শুধু একদৃষ্টিতে আয়েশা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে ছিল। এই মানুষটাই এতদিনে ওর মা হয়ে উঠেছিল। ইশতিয়াক চৌধুরী কাউকে পরোয়া না করে ইরজা কে উঠিয়ে বলল,,
“এটা তোমার প্রাপ্য নয় ইরজা। আমি তোমায় তোমার বাড়িতে পৌছে দেব। আর হ্যা তুমি নতুন করে তোমার জীবন শুরু করবে। এই দুটো মাস মনে করো একটা দুঃস্বপ্ন ছিল। তুমি তোমার বাবার স্বপ্ন পূরণ করো।”
বলেই ইশতিয়াক চৌধুরী ইরজার হাত ধরে গাড়িতে বসিয়ে দেন। ইরজার ভেতর কোন অনুভূতি কাজ করছে না। যে যা বলছে তাই করছে। ইরজাদের ঢাকায় একটা বাড়ি ছিল রাস্তায় থেকেই ইশতিয়াক চৌধুরী ওদের জানিয়ে দিয়েছিল। ইশতিয়াক চৌধুরী ইরজা কে ওদের হাতে তুলে দিয়ে বাড়িতে আসে। এই জন্যই ও শুধু ইশতিয়াক চৌধুরী সাথে কথা বলতো আর সবাই কে এড়িয়ে চলতো কারন একমাত্র ঐ মানুষটাই ওর সঙ্গে ছিল। ইরজা সেদিন ওর রুমে গিয়ে সব কিছু ভেঙে ফেলে চিৎকার করে কাঁদছিল। এত কষ্টের ভার ও বইবে কেমন করে। তার কয়েকদিন পরেই জানতে পারে ইরজা প্রেগন্যান্ট ও যেন বাঁচার নতুন দিশা পায়। একবছর ওখানে থাকে তারপর ইয়াদ জন্ম নিলে ওরা গ্ৰামে চলে আসে!
________________
আয়াজ দৌড়ে আম্মু আম্মু করে আসছে ইয়াদ আসছে দেখে ইরজা তাড়াতাড়ি করে চোখটা মুছে ফেললো। আর মিথ্যা হাসি ফুটিয়ে বলল,,
“কি হয়েছে এভাবে দৌড়াচ্ছো কেন?”
“ঐ দাদুগুলো এখন বাড়ি যাবে তুমি তাদের বিদায় জানাবে না।তুমি জানো ঐ দাদি টা কি ভালো আমাকে কতো আদর করেছে।”
“তাই বুঝি।”
“হুম। এখন চলো নিচে যাবে তো!
“হুম যাবো!”
ইরজা নিচে চলে এলো ও আসতেই ওর ফোনে একটা কল ওপাশ থেকে তা শুনলো । তা শুনে ওর চোখ দিয়ে পানি পরছে শুরু করেছে সাথে ঠোঁটের কোনে হাসি। বাকি কেউ ওর প্রতিক্রিয়া বুঝতে পারছে না। ও শুধু বলল,,
“আমি এখনি আসছি!”
ও দৌড়ে ওপরে যেতে নিল তখন ইরফান বলল,,
“বোনু কি হয়েছে?”
ও চিৎকার করে বলল,,
“ভাইয়া আমার অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়েছে। আমি হারিনি ভাইয়া আমি জিতে গেছি। ও রেসপন্স করছে ও ফিরে আসবে আমার কাছে ও ফিরছে ভাইয়া ও ফিরছে। আজ আমি অনেক খুশি।”
ইরজা দৌড়ে ওপরে চলে গেল। ইরফান আর ইমদাদ খুশিতে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরলো। আইরিনের মুখেও হাসি ফুটে উঠল। এ যেন ওদের ঈদ। বাকিরা কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। ইশতিয়াক চৌধুরী বললেন,,
“কি হয়েছে ? আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“বড়বাবা আজকে তোমারও খুশির দিন। এখন তুমি শুধু আমাদের সাথে চলো।”
তখন ইয়াদ এগিয়ে গিয়ে বললো,,
“মামু কি হয়েছে বলোতো?”
ইরফান ইয়াদ কে কোলে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,,
“তোমার বাবা ফিরে আসছে।”
কথাটা শুনেই ইয়াদ খুশিতে “ইয়েইইইই” বলে উঠলো কারন ও ওর বাবাকে চেনে ও নিজেও অপেক্ষা করছিল ওর বাবার ফেরার জন্য।
ইরজা খুশি মনে রেডি হচ্ছে।তখনি পাশ থেকে শুনতে পেল,,
“আজ থেকে আমাকে কি হাড়িয়ে ফেলবে শুভ্রপরী!”
“আপনার বিচরন তো আমার মাঝেই তাহলে হাড়িয়ে ফেলবো কেন? আপনি আমার মন আমি যখন তখন আপনার সাথে কথা বলতে পারি।”
“আজ যে তোমার এই প্রেমিক পুরুষের বিদায়ের পালা।”
ইরজা হাসলো তা দেখে তার প্রেমিক পুরুষ অভিমানে বলল,,
“আমার বিদায়ে এতো খুশি হচ্ছো কেন?”
তখন ইরজা মুচকি হেসে বলল,,
“কারন আপনার বিদায় আমায় আরো সুখে ভরিয়ে দেবে। আজ থেকে আপনি মুক্ত আমার থেকে। ধন্যবাদ আমার দুসঃময়ে আমার সঙ্গ দেওয়ার জন্য।”
“তুমি চেয়েছো তাই আমি দিয়েছি মুলত তুমি নিজেই তোমার সঙ্গী। তবে আজ এটা ভেবে আমি খুশি আমায় আর দরকার নেই তোমার । আজ থেকে তোমার আসল প্রেমিক পুরুষ তোমার সাথে থাকবে। আমাকে না ছুঁতে পারার দুঃখ ঘুঁচবে তোমার। আমাকে রাখতে না পারার বেদনা থেকে মুক্তি পাবে। আমাকে আলবিদা বলবে না।
ইরজার চোখে পানি চিকচিক করছে ইরজা মুচকি হেসে বলল,,,
“আলবিদা মাই ডিয়ার প্রেমিক পুরুষ!”
“আলবিদা শুভ্রপরী।”
ইরজা চোখ বন্ধ করলো ওর চোখ দিয়ে একফোঁটা পানি গড়িয়ে পরল। আর চোখ খুলে সামনে কাউকে দেখতে পেল না।তখন ইরজা মুচকি হেসে বলল,,
‘প্রতিটা মানুষ-ই সুখী তার নিজ নিজ কল্পনার জগতে! যেমনটা আমি ছিলাম এতদিন।”
__________________
ওদের হাসপাতালে একটা কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইরজা। অজানা আনন্দের অনুভূতি হচ্ছে। সাথে ভয় ও হচ্ছে যদি খারাপ কিছু ঘটে। বাকি সবাই ইরজাকে পর্যবেক্ষণ করছে। ইরফান ইরজার কাঁধে হাত রেখে বলল,,
“যা ভেতরে যা দেখবি ইনশাআল্লাহ ভালো কিছু হবে।”
“ভাইয়া ভয় হচ্ছে যদি ওর কিছু মনে না থাকে!”
“একটা মানুষ সারাজীবন কষ্ট পেতে পারে না। রবের পরিকল্পনা উত্তম। কষ্টের পরেই আছে সুখ। ইনশাআল্লাহ ভালো কিছু হবে।”
ইরজা বড় একটা শ্বাস নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। বাকিরা কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। সামনের ব্যক্তিটা আধশোয়া হয়ে বসে আছে। দৃষ্টিটা জানালার দিকে। ইরজা বলল,,
“আসসালামু আলাইকুম!”
কারো সালাম শোনে লোকটা ইরজার দিকে তাকালো।
লোকটি মুচকি হেসে বলল,,
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। আচ্ছা আপনি নিশ্চয়ই ডাক্তার তাই না।
ইরজার এখন ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাঁদতে।ইরজার চোখ থেকে একফোঁটা পানি গড়িয়ে পরল। ও নিজেকে সামলিয়ে বলল,,
“হুম আমি ডাক্তার!”
“আচ্ছা আমি কতোদিন যাবৎ এখানে আছি? না মানে কোমায় ছিলাম।”
“কেন?”
“আরে বলুন না?”
“পাঁচ বছর, দুই মাস ,সাত দিন, চার ঘন্টা বিশ মিনিট?”
“বাহ আপনি তো দেখছি অনেক ভালো মনে রাখতে পারেন?”
ইরজা কিছু বললো না। তখন লোকটা বলল,,
“এতদিন আমাকে ছেড়ে থাকতে তোমার কষ্ট হয় নি শুভ্রপরী।”
শুভ্রপরী কানে যেতেই ইরজা যেন থমকে গেল। তারমানে আইজানের সবকিছু মনে আছে। ইরজা দৌড়ে গিয়ে আইজানকে জড়িয়ে ধরলো আর কাঁদতে লাগলো। আর বলল,,
“আপনি আপনার কথা রাখেন নি। আপনি তো বলেছিলেন আপনি আমায় ছেড়ে কোথাও যাবেন না।আপনি আপনার কথা রাখেন নি। আপনি জানেন এতদিন আপনার শুভ্রপরী কতোটা কষ্টে ছিল। শুধু ইয়াদ ছিল বলে না হলে আমি কবেই মরে যেতাম।”
আইজান ইরজাকে কাঁদতে দিল। কিছুক্ষণ পর ইরজার কান্না থামলে আইজান বলল,,
“এই ইয়াদ টা কে? তুমি কাদছিলে বলে তোমায় আর ডিসটার্ভ করলাম না। এই তুমি আমাকে ছেড়ে অন্য কাউকে আবার,,
“আরে থামুন থামুন ইয়াদ হচ্ছে আমাদের ছেলে !”
“ওহ আচ্ছা……. কি!!!! আমাদের ছেলে আছে। “”
কথা বলতে বলতে আইজান এর চোখ ছলছল করে উঠলো একজন বাবা এতবছর পর যখন জানতে পারে তার একজন ছেলে আছে। তখন তার অনুভূতি কি রকম হতে পারে। আইজান বলল,,
“কোথায় আমাদের ছেলে নিশ্চয়ই অনেক বড় হয়ে গেছে তাইনা।”
“হুম বড় হয়ে গেছে!”
ইরজা বাইরে গিয়ে ইয়াদ কে নিয়ে এলো। আর সবাইকে পাঁচ মিনিট পর আসতে বললো। ইয়াদকে পেয়েই আইজান ওকে জড়িয়ে ধরলো। কতো গুলো চুমু দিল। তখন ইয়াদ বলল,,
“বাবা আমি তোমাকে কতো কথা বলতাম তুমি কি শুনতে পেতে। কিন্তু তুমি তো কিছু বলতেই না শুধু শুনতে।”
তখন আইজান হেসে বলল,,,
“সরি সোনা তোমার সাথে কথা বলতে পারি নি। তবে এখন থেকে তোমার সব কথা শুনবো আর তোমার সাথে খেলবোও।”
“সত্যি!”
“তিন সত্যি!”
“ইয়েইইইইইই!”
ইরজা মুগ্ধ চোখে বাবা ছেলের ভালোবাসা দেখছে। তখনি ইরফান সবাইকে নিয়ে ঢুকলো। চৌধুরী পরিবারের সবাই তো অবাক। এ কাকে দেখছে তারমানে আইজান মারা যায় নি। আয়েশা চৌধুরী ছেলেকে দেখেই দৌড়ে ছেলেকে ধরে কেঁদে উঠলো। আইজান ও মাকে জরিয়ে ধরলো। ফায়জা ও তাই ! ইয়াদ তখন ইরজার কোলে। তখন ইশতিয়াক চৌধুরী বললেন,,
“তারমানে আইজান বেঁচে ছিল। আর আমরা ভেবেছিলাম আইজান মারা গেছে। কিন্তু এটা কি করে হলো।”
তখন ইরজা বলল,,
“আমি বলছি আপনারা জানেন তো কারা আমাদের ওপর হামলা করেছিল আর পরে এক্সিডেন্টের নাটক করিয়েছিল।”
ওখানে তিশার মাও ছিল তিনি বললেন,,,
“হ্যা জানি মিস্টার ইসহাক চৌধুরী।”
ইরজা ওনার দিকে তাকালো। তিশার মা সব জানার পরে ইসহাকের থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। আয়েশা চৌধুরী তাকে কোথাও যেতে দেয় নি। ইরজা প্রথম থেকে সব বলতে লাগলো। সেদিন,,
আইজানের মাথায় বাড়ি দেওয়ার পর আইজান একটু সরে যায়। আরেকটা বাড়ি মারতে যাবে তখনি আইজান লাঠিটা ধরে ফেলে। আর লাঠিটা দিয়ে সকলকে মারতে থাকে।ইরজার কষ্ট হলেও ও উঠে পড়ে। তখনি ইসহাক চৌধুরী ইরজার মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে বলে,,
“আইজান ওখানেই থেমে যা নাহলে তোর বউকে এখানেই মেরে ফেলবো।”
আইজান ইরজাকে এ অবস্থায় দেখেই ও থেমে যায় তখনি পরশ ওর মাথার পেছনে আরেকটা বাড়ি মারে রড দিয়ে। ইরজা ইসহাক কে ধাক্কা মেরে আইজান এর কাছে যায় তখন পরশ ইরজার হাতে বাড়ি মারে। ইরজা ঠিক আইজানের সামনে পড়ে যায়। আইজান এক দৃষ্টিতে ইরজার দিকে তাকিয়ে আছে। আইজান চাইছে ইরজার দিকে এগোতে ইরজাও তাই। তখন পরশ বলল,,
“আরে আংকেল দেখুন তাদের ভালোবাসা। ইস এরকম একটা ভালোবাসাকে আলাদা করতে মজাই লাগছে। কিন্তু নিজেকে পাষান ও লাগছে।এখন কি করি বলুন তো।”
“বেশি কিছু করতে হবে না। তুমি আইজানের বুকে একটা গুলি করে দাও। বাকিটা আমি দেখে নেব।”
“আর ওর বউ কে?”
“ওর বউকে কিছু করতে হবে না। কারন এখন এটা হবে এক্সিডেন্ট আর ও যদি বেঁচে ফিরে তাহলে আয়েশা চৌধুরী কে বুঝিয়ে সুজিয়ে ওকে বাড়ি থেকে বের করে দেব। ”
ইসহাক চৌধুরী ইরজার সামনে গিয়ে বলল ,,
‘আজ এখানে যা হলো তা যদি ভুলেও কাউকে বলার চেষ্টা করো নাহলে তোমার বাবা আর আইজানের যা হলো ইশতিয়াক চৌধুরী, আয়েশা চৌধুরী আর ফায়জার সাথে এটাই হবে।। তুমি জানো তোমার বাবা আমার্ সম্পর্কে সবকিছু জানে তবুও কিছু বলেনি। তো বুঝতেই পারছো।”
ইরজা কষ্ট করে উঠে ইসহাক চৌধুরীর কলার ধরলো কিছু করতে যাবে তখনি পরশ আইজানের বুকে গুলি করে দেয়। ইরজা আইজান বলে চিৎকার দেয়। পরশ আরেকটা গুলি করবে তখনি ইরজা গিয়ে ওর হাত থেকে বন্দুক ফেলে দেয়। তখন পরশ আরেকটা লাঠি দিয়ে ইরজার মাথায় মারে ইরজা নিচে পড়ে যায়।ও শরীরে কোন শক্তিই অবশিষ্ট নেই।তখন ইসহাক চৌধুরী হেসে বলল,,
“অনেক হয়েছে আর মারামারির দরকার নেই। এখন ওদের কে গাড়িতে ওঠাও আর গাড়ি স্টার্ট করে দাও ভাগ্য যদি সহায় থাকে তাহলে ওরা বাঁচতে পারবে তবে আইজান যে শেষ সেটা সিওর।”
আইজান আর ইরজাকে গাড়িতে বসিয়ে দেওয়া হলো তখনো ইরজার জ্ঞান আছে। আইজানকে ড্রাইভিং সিটে আর ইরজাকে তার পাশে।ইরজা বুঝতে পারল আইজান এখনো বেঁচে আছে। গাড়ি স্টার্ট করে দিয়ে ওরা নিজেদের মতো চলে গেল। গাড়ি এদিক ওদিক যাচ্ছিল ইরজা কোন রকম স্টেয়ারিং ঘুরাতে লাগল কারন ও ড্রাইভিং জানতো। ইরজার পাশেই ফোন ছিল ইরজা কোনরকমে ইরফানের ফোন দিল ইরজা ইরফান কে জানালো । তখনি একটা গাড়ি ওদের সামনে এলো আর ইরজা কোন রকম গাড়ি ঘুরিয়ে নেয় তখনি একটা গাছের সাথে ধাক্কা লাগে। ইরজা অজ্ঞান হয়ে যায় তার কিছুক্ষণ পর ইরফান আর ইমদাদ ওখানে পৌঁছায় ওরা ওদের দুজনকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। তখন ডাক্তার জানায় আইজান বেঁচে আছে কিন্তু কোমায় আছে।কবে ফিরবে সেটা বলতে পারছে না আর ফিরলেও ও পুরোনো জিনিস ভুলে যেতে পারে। ইরজার জ্ঞান ফিরে আসলে ও আইজানের জীবনের ঝুঁকির জন্য আইজানকে লুকিয়ে রাখে আর বলতে বলে আইজান খাদে পড়ে গিয়েছে। ইসহাক চৌধুরীর থ্রেটের জন্য ও কাউকে কিছু জানায় নি। কিন্তু পরশকে তার উচিত শিক্ষা দিয়েছে ইসহাক চৌধুরী কে না দিলেও। ইশতিয়াক চৌধুরী খবর পেয়েই হাসপাতালে যায় উনি ইরজা কে নিয়ে আসে । তারপরে তো সবাই জানেন।
___________________
বর্তমানে,,
সব শুনে কারো মুখে কোন কথা নেই। আয়েশা চৌধুরী এক দৃষ্টিতে ইরজার দিকে তাকিয়ে আছে। এই মেয়েটা ওনার ছেলেকে বাঁচানোর জন্য কতো কি করেছে অথচ এই মেয়েটাকেই বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। আয়েশা চৌধুরী ইরজার কাছে এসে অসহায় কন্ঠে বলল,,
“যা হয়েছে তার জন্য আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি এখন কি আমরা সব ভুলে একসাথে থাকতে পারি না।”
তখন আইজান বলল,,
“কি হয়েছে মা তুমি কি করেছো?”
তখন ইরজা বলল,,
“কিছু হয় নি। মা কিছু করেনি। অনেক হয়েছে এখন আপনি চুপ করুন রেস্ট নিন।”
সবাই রুম থেকে চলে গেল । আয়াজ ওর বাবার হাত ধরে আছে। তখন ইরজা বলল,,
“ইয়াদ চলো এখন তোমার বাবা রেস্ট করুক।”
“না আমি বাবার কাছে থাকবো।”
তখন আইজান বলল,,
“থাকুক না আমার কাছে।”
“বারে এখন বাবাকে পেয়ে আম্মু কে ভুলে গেলে।”
তখন ইয়াদ বলল,,
“আমি তো তোমাকে যেতে বলিনি তুমি ও থাকো।”
_____________________
দুই দিন পর আইজান মির্জা বাড়িতে এসেছে। কারন ইরজা ওদের হাসপাতালেই আইজানের একটা কেবিন নিয়েছিল। আইজান অনেকটাই সুস্থ।। সবাই ড্রয়িংরুমে বসে আছে হুট করে আয়েশা চৌধুরী বললেন,,
“আমি আমার ছেলে বউমা আর নাতিকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাই।”
এ কথা শুনে সকলে ইরজার দিকে তাকালো তখন ইরজা বলল,,
“আরো দুদিন থাকি তারপর যাওয়া যাবো। এখানে হাসপাতালের সবকিছুর দায়িত্ব তো কাউকে দিতে হবে।”
এ কথা শুনে ইশতিয়াক চৌধুরী আর আইজান ছাড়া আর সকলে অবাকের চরম পর্যায়ে চলে গেল। তা দেখে ফায়জা বলল,,
“কাহিনী কি আমি কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না!”
তখন আইজান বলল,,
“আমি বলছি আসলে আমি দেখছিলাম মায়ের থেকে ইরজা সবসময় দূরে দূরে থাকে তাই মাকে ডেকে জিজ্ঞেস করি কি হয়েছে মা তো বলবেই না তখন জোর করি আর মা বলে দেয় পাঁচ বছর আগে তিনি ইরজার সাথে কি অন্যায় করেছে। আসলে মা ইচ্ছে করে ওকে বাড়ি থেকে বের করে দেয় নি। কেউ মাকে ফোন করেছিল যে ইরজাকে বের করে না দিলে ইরজাকে মেরে ফেলবে। এমন কি লোকটা এটাও জানায় সে নাকি আমাকে মেরে ফেলেছে আর এক্সিডেন্ট ও সে করেছে। তাই মা ভয় পেয়ে ইরজার ভালোর জন্য ইরজাকে বের করে দিয়েছে। সৌভাগ্য বশত তখন ইরজা আর বাবা বাইরে থেকে শুনতে পায়। এটাই হলো মেন কাহিনী তখন ওনারা সবাই মিলে যায় কিছুক্ষণ মেলোড্রামা হয় এই আর কি!”
“আরে বাপরে সবার অগোচরে এত কিছু হয়েছে আর আমরা কিছুই জানিনা।”
এ কথা শুনে সকলে হেঁসে উঠল। দুই দিন পর ইরজারা চলে যায় ইরজা ভাইদের ধরে সে কি কান্না। ইয়াদ ও তাই ।
সবাই আগেই এসে পড়েছে ইয়াদ আইজান আর ইরজা পেছনের গাড়িতে আসছে। ইরজা গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে এই বাড়ি থেকেই ওকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হয়েছিল। সেসব ভেবেই ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কিছু সময় জীবন কেমন চলে বুঝতেই পারি না। আইজান ইরজার অবস্থা বুঝতে পেরে ওর হাত খুব শক্ত করে ধরে বলল,,
“মিসেস ইরজা আজরিন চৌধুরী এবার যাওয়া যাক।”
ইরজা মুচকি হেসে বলল,,
‘হুম!”
আইজান ইয়াদ কে কোলে নিয়ে আর ইজরার একহাত ধরে বাড়িতে প্রবেশ করলো আয়েশা চৌধুরী মুচকি হেসে ওদের বরন করে নিল।
রাতে ইয়াদ ঘুমিয়ে পড়েছে। তা দেখে আইজান বলল,,
“শুভ্রপরী চলো না একটু চন্দ্রবিলাস করে আসি!”
“চলুন!”
আইজান আর ইরজা ছাদে চলে গেল। ওরা এখন চাঁদের মুখ করে ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। হুট করে আইজান বলল,,
“আজ কয়টা চাঁদ দেখছো শুভ্রপরী!”
“আপনার ব্যক্তিগত চাঁদ ছাড়া আমি তো একটাই চাঁদ দেখছি।”
আইজান হাসলো আর বলল,,
“ভালোবাসি বলবে?”
“কেন ভালোবাসি না বললে কি করবেন?”
“অভিমান করবো!”
“আপনার থেকে আমার কল্পনার প্রেমিক পুরুষ বেশি ভালো ছিল।”
“কল্পনার প্রেমিক পুরুষ মানে?”
“আপনি কোমায় চলে যাওয়ার পর আমি কল্পনায় আপনাকে নিজের করে নিতাম। আপনাকে অনুভব করতাম। আপনি আছেন আমার সাথেই আছেন। এমন কি আজ ও আমি তার সাথে কথা বলিছি। আপনার আসার খবর শুনে সে আমাকে আলবিদা বলেছে।
এ কথা শুনে আইজান মুগ্ধ চোখে ইরজার দিকে তাকালো। কতোটা ভালোবাসে মানুষ এরকম করতে পারে। আইজান বলল,,
“ভালোবেসে আমাকে তুমি বলবে আপনি টা কেমন লাগে দূরে দূরে!”
“আচ্ছা তুমি!”
আইজান হাসলো আইজান ইরজাকে একহাত জরিয়ে ধরলো। আইজান বলল,,
“যেদিন তোমাকে বিয়ের জন্য তোমার বাবাকে বললাম সেদিন যে কিরকম নার্ভাস ছিলাম কি বলবো। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে তোমার বাবা তাড়াতাড়ি রাজি হয়ে গেল। অবাক-ই হয়েছিলাম পরে যখন তোমার বাবা আর আমার বাবার কথা বললো তখন বুঝতে পারলাম কাহিনী কি! সেদিন মনে হচ্ছিল জীবনের বেস্ট কিছু পেয়েছি। তবে সব ঠিক হলে আমাদের বিয়েটা ধুমধাম করে হতো।”
“হুম!”
ইরজার হুট করে মন খারাপ হয়ে গেল। জীবন তো কম খেল দেখায় নি। দুজনেই চুপচাপ আইজান হুঁট করে বলল,,
“ভালোবাসি শুভ্রপরী।”
“আমিও ভালোবাসি প্রেমিক পুরুষ!”
দু’জনে আর কিছু বললো না। দুজনেই দুজনকে অনুভব করতে লাগলো।
~সমাপ্ত~
বিঃদ্রঃ