#তুমি_নামক_প্রশান্তি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_আটাশ
অন্ধকার রুমের এক কোনায় তানিশার গ*লা চে*পে ধরে আছে শাকিল। নিজেকে ছাড়ানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তানিশা। ‘ওর’ দ’ম ব’ন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। চোখ গুলো মার্বেল আকৃতির হয়ে আছে। মুখটা লাল বর্ণ ধারণ করেছে। ঠোঁট গুলো তীব্র গতিতে কাঁপছে। শাকিল রক্তিম চোখে তাকিয়ে তানিশার দিকে। এই মুহূর্তে তাকে বড্ড হিং’স্র দেখাচ্ছে। তানিশার মনে হচ্ছে ‘ও’ মা**রা যাচ্ছে। এই বুঝি দেহ থেকে প্রাণ পাখিটা উড়াল দিলো। নিজের পরকিয়া আড়াল করার জন্য কতশত কাহিনী। হায়! কত কী দেখতে হবে? কে জানে? তানিশার শরীরের শক্তি ক্রমশ কমে আসছে। তা বুঝতে পেরে শাকিল বিশ্রি প্রয়োগ করল। গর্জন করে বলে উঠল,
“তোরে পছন্দ হইছিলো তাই বিয়া করছিলাম। তোরে আমি তোর বাপের থেইকা কিন্না আনছি। তোর মতো দুই টাকার মাইয়ার মুখে এত বড় বড় কথা মানায় না। কোন সাহসে তুই আমার উপর খবরদারি করতে আহোস? আরেকবার এমন ভুল করলে তোরে সোজা মা*ই*রা* ফে*লুম। মনে রাহিস।”
বলে তানিশাকে ছিটকে ফেলে দিলো। হনহন করে রুমের থেকে বেরিয়ে গেলো। নিচে পড়ে তানিশা গ*লা কা*টা মু*রগীর মতো কিছুক্ষণ ছ*টফ*ট করলো যন্ত্রনায়। কান্না গুলো সব গ*লার মধ্যে আটকে আছে। মনে হলো, ব্যাথায় জীবন বেরিয়ে যাবে এক্ষুনি। চিৎকার করে কান্না করে উঠল তানিশা। কিছুসময় পর দুই হাতে মুখে আঁচল গুঁজে কান্না নিবারণের চেষ্টা করতে লাগল। মস্তিকের মধ্যে কিছু শব্দ জানান দিলো। এই শহরে মেয়েদের শব্দ করে কান্না বারণ। অভিযোগ করা বারণ। ম*রে যাও। তবুও টুঁশব্দ করো না। তুমি মেয়ে তোমার জন্ম হয়েছে শুধু স্যাক্রিফাইস করার জন্য। তোমার মুখে এত কথা মানায় না। তুমি কেন প্রতিবাদ করতে যাবে? তুমি তো মুখে আঙ্গুল দিয়ে থাকবে। কথাগুলো ভেবেই তানিশার দ’ম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। বুক ফে*টে কান্না আসছে। কী ভয়ংকর পরিস্থিতি! এই যন্ত্রণা যে সহ্য করা যায় না। তানিশার বোবা কান্নায় দেয়াল গুলোর বুক ভারী হয়ে আসতে লাগল। চারপাশের বাতাসে বিদঘুটে কান্নার আওয়াজ ভাসতে লাগল। কিছুসময় পর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে করতে তানিশা বলে উঠল,
“তোমরা ভালো আছো তো মা? আমি কিন্তু অনেক ভালো আছি। আমার ভালো থাকার লেইগাই তো এতসব কিছু। তোমরাও ভালো থাইকো। আমি সবসময় দোয়া করুম। তোমরা অনেক ভালো থাইকো।”
—
মাগরিবের নামাজ পড়ে সবে মাত্র বিছানায় বসেছে বেলী। নামাজের পর মনের মধ্যে যেই প্রশান্তি অনুভব হয় তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। কখনো খুব বেশি মন খারাপ হলে, অশান্তি লাগলে। জায়নামাজে দাঁড়িয়ে পড়লে সব অশান্তি, মন খারাপ নিমিশেই কে*টে যায়। সকালে আমিনের কথাগুলো আজ সারাদিন বেলীর মাথায় গেঁথে ছিলো। নামাজ পড়ার পর এখন কিছুটা শান্তি লাগছে। মনে হচ্ছে, বুকের উপর থেকে ভারী বোঝাটা নেমে গেছে। হুট করে ফোনটা বেজে উঠতেই বেলী হকচকালো। ফোন স্ক্রিনে তানিশার নামটা দেখেই মুখে হাসির রেখা টেনে সাথে সাথে রিসিভ করল। হাস্যজ্বল কন্ঠস্বরে জিজ্ঞেস করল,
“কেমন আছিস পে*ত্নী?”
তানিশা কিছুক্ষণ চুপ থাকল। তারপর নিচু স্বরে বলল,
“আমি ভালো আছি। তুই কেমন আছোস?”
তানিশার কন্ঠস্বর আজ আবারো বেলীকে ভাবতে বাধ্য করছে। সত্যিই, কী তানিশা ভালো আছে? মনের প্রশ্নটাকে আজ আর প্রশ্রয় দিলো না। হয়তো বেলী একটু বেশি ভাবছে? একটু হেসে উত্তর দিলো,
“আলহামদুলিল্লাহ! আমি ভালো আছি। তোকে আজ একটা কথা বলতে ফোন দিয়েছিলাম সকালে। কিন্তু, তুই রিসিভ করলি না। কেন রে?”
তানিশা পূর্বের ন্যায় শান্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিলো,
“কাজে ব্যস্ত ছিলাম রে। এখন বল কী বলবি?”
বেলী বোধহয় একটু লজ্জা পেলো? নিজের বিয়ের কথা নিজের মুখে বলতে লজ্জা পাওয়াটাই স্বাভাবিক। বেলীকে চুপ থাকতে দেখে, ওপাশ থেকে তানিশা একটু জোরেই বলে উঠল,
“কিরে চুপ কইরা আছোস কেন? ভূ*তে ধরছে না-কি?”
বেলী একটু মুচকি হেসে জবাব দিলো,
“এক মাস পর আমার বিয়ে…।”
কথাটা বলে থেমে গেলো বেলী। চোখ দুটো অনায়াসে বন্ধ করে নিলো। হয়তো প্রশান্তির সুখ অনুভব করছে? বুকের মধ্যে বইছে শান্তির ঢেউ। ফোনের ওপাশ থেকে তানিশা চিৎকার করে বলে উঠল,
“কিহ! সত্যি? আমার বিশ্বাস হইতাছে না! কী খুশির খবর দিলি রে বেলু? আমার তো এহন নাচতে মন চাইতাছে।”
তানিশার চিৎকারে বেলীর কান ফে*টে যাওয়ার উপক্রম। মেয়েটা মাঝে মাঝে এত জোরে চ্যাঁচিয়ে উঠে যে, কবে যেন কার হার্ট অ্যাটাক হয়ে যায়? ধমকে বলে উঠল,
“এত জোরে কেউ চিৎকার করে? আর একটু হলে আমার…।”
তানিশা বেলীর মুখের কথা কেড়ে নিলো। সাথে সাথে খোস আমেজে উত্তর দিলো,
“অন্য কেউ না দিলেও, আমি দেই। বুঝলি? এহন কবে বিয়ে হেইডা কও, সোনা। আই ওয়েটিং!”
এহেন কথায় বেলী হাসলো। প্রফুল্ল মনে সবটা বলতে লাগল। দুজন মিলে বকবক শুরু করে দিলো, মুহুর্তেই। তানিশাও নিজের কষ্টটা কিছু সময়ের জন্য ভুলে গেলো। বুকের ভেতর হাজারটা কষ্ট চে*পে রেখে কী করে হাসা যায়? তা তানিশাকে দেখে শিখা উচিত। সবাই নিজের কষ্টটা প্রকাশ করে না। কেউ কেউ ছেড়ে দেয় উপর ওয়ালার হাতে। হয়তো তিনি এই কষ্টের বিনিময়ে উত্তম কিছু দিবেন। অপেক্ষা শুধু সময়ের। উপর ওয়ালা কী কাউকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেয়? নাহ! অবশ্যই, হাত ভর্তি করে দেন। হয়তো ইহকালে, নয়তো পরকালে।
“তুই কিন্তু আমার বিয়ের সাতদিন আগে আসবি।”
কথার মাঝে হঠাৎ বেলীর এই কথায় তানিশা থমকে যেতে বাধ্য হলো। চিন্তায় পড়ে গেলো মুহূর্তেই। এই ইচ্ছেটা যে পূরণ হবে না তা, তানিশা খুব ভালো করে জানে। বেলীকে বলতে গিয়েও থেমে গেলো। হাস্যজ্বল স্বরে বলে উঠল,
“আরে তোর বিয়া আর আমি যামু না। এইডা জীবনে হইব না। তোর বিয়াতে গিয়ে আমি কব্জি ডুবাইয়া খামু।”
বেলী শব্দ করে হেসে উঠল। তারপর মিছিমিছি রাগী স্বরে বলল,
“আমি তোরে খেতে দিব না। তোকে আমার বিয়েতে আনব থালা বাসন ধোয়ার জন্য। কাজের বেটি জরিনা হয়ে সব কাজ করবি।”
তানিশা এবার হুংকার ছেড়ে উঠল। চ্যাঁচিয়ে বলল,
“ঝা*ড়ু খুইলা মা**রু**ম বেলুরুটি। কত্ত বড় সাহস আমারে কয় কাজের বেটি জরিনা? আমি হইলাম নায়িকা জ্যাটরিনা।”
‘জ্যাটরিনা’ শব্দটা বোধহয় বেলী আজ ফাস্ট শুনল? ‘জ্যাটরিনা’ বলে কী আদৌও কোনো নায়িকা আছে? জানা নেই তো? অবাক স্বরেই জিজ্ঞেস করল,
“এই জ্যাটরিনা আবার কোন দেশের নায়িকা?”
তানিশা বেশ ভাব নিয়ে উত্তর দিলো,
“আরে ক্যাটরিনা কইলে আবার মাইনসে কইতো অশ্লীল। তাই আমি ক্যাটরিনার বিপরীত শব্দ কইলাম। বুঝোস না গা*ধী?”
কথাটা শুনে বেলী নিজেই নিজের কপাল চা*পড়ানো শুরু করল। কী দিয়ে কী শব্দ বানায় মেয়েটা? এইসব উদ্ভট শব্দ কই পায়? মানুষ শুনলে নির্ঘাত পা**গল বলব। তানিশাকে কিছু বলতে যাবে। তখনি তানিশা হা হা করে হেসে দিলো। বেলীও নিজের হাসিটা দমিয়ে রাখতে পারলো না। তানিশার সাথে তাল মিলিয়ে উচ্চস্বরে হেসে দিলো। বেলীর ডাক পড়তেই ফোন রাখার জন্য প্রস্তুত হলো। ব্যস্ত গলায় বলল,
“এখন রাখছি, তানু। পরে মেসেঞ্জারে নক করব। মা ডাকছে।”
তানিশা প্রতিউত্তরে কিছু বলল না। বেলী ফোনটাকে কান থেকে নামিয়েও কা*টল না৷ আবার কানে দিয়ে বলে উঠল,
“কিরে? কিছু বললি না যে?”
তানিশা সময় নিলো বোধহয়? অল্প একটু খানি সময়ের ব্যবধানে হুট করে একটা অবিশ্বাস বাক্য বলে উঠল। এই বাক্যটা এই মুহূর্তে বেলী আশা করেনি। বুকটা কেঁপে উঠল খানিকটা। ভয়েরা এসে গ্রাস করল সর্বাঙ্গ। তানিশা বলল,
“আচ্ছা দোস্ত? মৃ**ত্যু অনেক কঠিন তাইনা?”
বেলী প্রতি উত্তর করতে পারল না। জোরে চ্যাঁচিয়ে বলতে লাগল,
“থা*ব*ড়া*ইয়া তোর দাঁ*ত ফে*লে দিব। এইসব কী বলিস? বেশি পাকনামি শিখে গেছিস? একবার তোর সামনে আইসা নেই। তোর পাকনামি আমি বের করতাছি। তুই আমারে আর কোনোদিন ফোন দিবি না। তোর সাথে আমার কোনো কথা নাই। কত দিন তোরে বারণ করছি, এইসব বলবি না। তবুও বলে যাস। আমার কথার কোনো দাম নেই তাইনা? ঠিকি তো দাম থাকবেই কেন? আমি কে?”
বেলী এক নিশ্বাসে কথা গুলো বলে থামল। রাগে ওর মাথা ফে*টে যাচ্ছে। সেই সাথে ভয়ে হাত-পা অটোমেটিক কাঁপা-কাঁপি শুরু করে দিয়েছে। এই কথাটা হঠাৎ কেন বলল, মেয়েটা? বেলীকে ভয়ংকর রাগতে দেখে তানিশা চুপসে গেলো। চুপসানো কন্ঠস্বরে বলল,
“স্যরি! স্যরি! রাইগা যাইতাছোস কেন? আমি কী কইছি, আমি ম**ই**রা যামু? আমি শুধু জিগাইছি?”
বেলী আবার চ্যাঁচালো। বলল,
“কেন? তুই জানস না? মৃ**ত্যু কঠিন না-কি সহজ? মৃ**ত্যু কঠিন এইটা দুনিয়ার সবাই জানে। তুইও জানস। তবুও কেন জিগাইলি? ফাজলামি করস?”
তানিশা কিছু শান্ত থাকল। নিজেও জানেনা হঠাৎ কেন এমন একটা প্রশ্ন করল? এখন নিজের উপর নিজের রাগ হচ্ছে। শুধু শুধু মেয়েটার মন খারাপ করে দিলো। মেয়েটা কত খুশি ছিলো? ধুর! বেলীকে শান্ত করার জন্য বলল,
“আচ্ছা আর কমু না। স্যরি! আর সবাইরে একদিন তো ম**র**তেই হইব। রাগিস না, প্লিজ। ”
বেলী দাঁতে দাঁত চে*পে কটমট করে উত্তর দিলো,
“যা। তুই ম**ই**রা যা। আমারে চল্লিশার দাওয়াত দিস। বিরিয়ানি রান্না করতে বলিস। কব্জি ডুবাইয়া খাইয়া আসব। রাখি।”
বলে ফোন কে*টে দিলো। সুইচ অফ করে দিলো। রাগে পুরো শরীর জ্ব*ল*ছে। শীতল রক্ত গুলো বোধহয় গরম হয়ে গেছে? জোরে একটা নিশ্বাস ছাড়ল। মনে মনে বলে উঠল,
“ইয়া আল্লাহ! তুমি আমার সব প্রিয়জনদের ভালো রেখো।”
তারপর বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। কিন্তু মাথার মধ্যে তানিশার কথাটা চক্রাকারে ঘুরতে লাগল।
—-
ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে মাত্র দরজা খুলতেই, নীলাভ্রকে হঠাৎ দেখে বেলী ভয় পেয়ে গেলো। বেলীকে ভয় পেতে দেখে নীলাভ্র হাসল। হাসতে হাসতে বলল,
“কী ব্যাপার? আজকাল মেয়েরা নিজের স্বামীকে দেখেও কী ভয় পায়?”
বেলী রাগান্বিত চেহারায় তাকালো নীলাভ্রর দিকে। বলে উঠল,
“খাম্বার মতো এমন করে দাঁড়িয়ে থাকলে। সবাই ভয় পাবে।”
হুট করে চোখ গেলো নীলাভ্রর হাতে থাকা কাগজটার দিকে। দেখে মনে হচ্ছে কোনো একটা টেস্টের রিপোর্ট? কিন্তু কার কী হলো আবার? সাথে সাথে প্রশ্ন করল,
“এটা কিসের রিপোর্ট? দেখি? আর আপনার কী হয়েছে?”
বলে সেদিকে হাত বাড়াতেই নীলাভ্র সরিয়ে নিলো। নীলাভ্রর মুখ দেখে মনে হলো, একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেছে বোধহয়? কিন্তু কেন? বেলী কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করল,
“কী হলো? দেখতে দিলেন না কেন? কী হয়েছে আপনার?”
নীলাভ্র আমতা আমতা করল। উত্তর দিলো,
“আরে এটা আমার নয়। এটা আমার বন্ধু, রিয়াদের।”
বেলী হাঁফ ছাড়ল। এক মিনিটের জন্য মনে হয়েছিলো এটা নীলাভ্রর। শান্ত স্বরেই বলল,
“রিয়াদ ভাইয়ার কী হয়েছে?”
নীলাভ্রর চুপ করে গেলো৷ উত্তর দিলো না। প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বলল,
“তোকে একটা কথা বলার জন্য এসেছিলাম।”
“কী কথা?”
বেলী সাথে সাথে পাল্টা প্রশ্ন করল। নীলাভ্র বলল,
আমি পনেরো দিনের জন্য একটু চট্রগ্রাম যাব। আমার একটা কাজ পড়ে গেছে। আজকেই যেতে হবে। তাই তোকে বলার জন্য এসেছিলাম।”
বেলী একটু ভড়কালো। হঠাৎ, চট্রগ্রাম! কিন্তু কেন? কী এমন কাজ? নীলাভ্রর মুখ দেখে কেন মনে হচ্ছে, যে মিথ্যা বলছে? এটা কী বেলীর মনের ভুল? না-কি সত্যিই নীলাভ্র কিছু লুকাচ্ছে?
#তুমি_নামক_প্রশান্তি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_উনত্রিশ (শেষাংশ)
চোখের সামনে অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটাকে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে কেঁপে উঠল বেলী। নীলাভ্রর চোখ জোড়া কোটরে ঢুকে গেছে। শুকিয়ে কেমন হয়ে গেছে! মুখটা ফ্যাকাসে। ঠোঁটে কোনে আজ হাসি নেই। কী হয়েছে ছেলেটার? ক্ষুধার্ত ব্যক্তি অনেকদিন পর খাবার পেলে যেমন করে হা/মলে পড়ে। তেমনি, প্রায় একসপ্তাহ পর প্রিয় মানুষটাকে দেখে বেলী তার বক্ষস্থলে হা/মলে প/ড়ল। নীলাভ্র ঠাঁই দাঁড়িয়ে। কোনো কথা বলার ভাষা বা শব্দ খুঁজে পেলো না। কোন ভাষা বা শব্দ ব্যবহার করে বেলীকে নিজের অবস্থা বুঝাবে? বেলী শব্দ করে কাঁদছে। নীলাভ্র এখনও দাঁড়িয়ে। নাহ! বেলীকে আকঁড়ে ধরতে গিয়েও পারল না। হাত বড্ড কাঁপছে! ভয় না-কি সাহসের অভাবে? ইশারায় রিকশাওয়ালাকে নীলাভ্র চলে যেতে বলল। শুনসান রাস্তায় হাতে গোনা কয়েকটা রিকশা চলছে। সকালের মিষ্টি আবহাওয়ায় দুটি মানুষ প্রণয়ের দহনে জ্ব/লছে। বেলী ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ আরো বেড়ে গেলো। এবার নীলাভ্রর টনক নড়ল। শক্ত করে বেলীকে আঁকড়ে ধরল। স্বান্তনার ভঙ্গিতে বলে উঠল,
“এত জোরে কেউ কান্না করে না-কি ব/লদ? সবাই কী ভাববে বল তো?”
বেলী এবার গর্জে উঠল। নীলাভ্রর শার্ট জোরে খা/মচে ধরল। বক্ষস্থল থেকে মাথা তুলে নীলাভ্রর চোখে চোখ রাখল। বেলীর চোখের দিকে তাকিয়ে নীলাভ্র তৎক্ষনাৎ চোখ নামিয়ে নিলো। এই চোখে তাকিয়ে থাকার সাহস নেই। বেলী সেদিকে তাকিয়ে চ্যাঁচিয়ে বলে উঠল,
“চুপ! একদম চুপ! আমাকে যে যা খুশি ভাবুক। খারাপ ভাবলে আমি খারাপ। ভালো ভাবলে আমি ভালো। আমার খারাপ, ভালো নিয়ে আপনার চিন্তা করা লাগবেনা। কে আমি? কেন ভাববেন আমাকে নিয়ে? যদি ভাবতেন তাহলে আমার থেকে দূরে যেতে পারতেন না। আপনার যখন ইচ্ছে হবে, আপনি আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন। যখন ইচ্ছে হবে, ফিরে আসবেন। কী পেয়েছেন আমাকে? আমি কি মানুষ না? না-কি আমাকে মানুষ বলে আপনি গণ্য করেন না?”
কথাগুলো বলতে বলতে বেলী কেঁদে দিলো। এই মুহূর্তে নীলাভ্রর নিজেকে খুব অসহায় লাগল। কতটা অসহায় হলে একটা মানুষ কিছু বলার থাকলেও চুপ থাকে? বেলীর চোখে পানি গুলো নীলাভ্রকে বড্ড যন্ত্রণা দিচ্ছে! নীলাভ্র কোনো উত্তর না দিয়ে বেলীকে বুকে জড়িয়ে ধরল। শক্ত করে। মনে হচ্ছে, ছেড়ে দিলে এক্ষুনি পালিয়ে যাবে। বেলী ছোটাছুটি করতে লাগল। তবুও নীলাভ্র ছাড়ল না। বরং, আরো শক্ত করে জড়িয়ে রাখল নিজের সাথে। এবার বেলী না পেরে, নীলাভ্রর বুকে কি/ল ঘু/ষি যা পারছে বসিয়ে দিচ্ছে। বেলীর কান্ড দেখে নীলাভ্র খানিকটা মুচকি হাসল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শান্ত কণ্ঠ বলা শুরু করল,
“তুই তো জানিস, যারা রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকে। তাদের কত কী সহ্য করতে হয়? সামনে নির্বাচন। তাই বিপক্ষ দলের মানুষেরা আমাকে ক্ষিপ্ত হয়ে খুঁজছে। হাতের কাছে পেলে আমাকে মে/রে ফেলতেও একবার ভাববে না। যখন আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তখন আমার ফ্যামিলির উপর আক্রমণ করবে। আমার বড় দূর্বলতা তুই। তাই ওদের ফাস্ট টার্গেট তুই। আমি যদি তোর থেকে দূরে না থাকতাম। তাহলে এতদিনে তুই বা আমি দুজনের একজন মা/র্ডার হয়ে যেতাম। তাই বাধ্য হয়ে তোর থেকে দূরে থাকতে হয়েছে। আমি তোদের কাছে থাকলে তোকে বা আমার পরিবার কাউকে রক্ষা করতে পারতাম না। এই এক সপ্তাহ দিনরাত এক করে সমস্যার সমাধান করেছি। সব কয়েকটাকে হাজতে পাঠিয়েছি। এখন আমি আমার পরিবার সবাই বিপদমুক্ত। আর হ্যাঁ, আমি কিন্তু ঢাকাতেই ছিলাম। চট্রগ্রাম যাইনি।”
শেষ কথাটা শুনতেই বেলী বিস্ফোরিত চোখে তাকাল নীলাভ্রর দিকে। ওমনি নীলাভ্র চোখ মা/রল। তা দেখে বেলীর রাগ যেন দ্বিগুণ হয়ে গেলো। ঢাকা থেকেও মিথ্যা বলেছে। কী সাংঘাতিক! কোমড়ে হাত দিয়ে রাগান্বিত চোখে তাকাল নীলাভ্রর দিকে। দাঁ/তে দাঁ/ত চে/পে বলল,
“মিথ্যা কথা খুব ভালো শিখেছেন, তাইনা?”
নীলাভ্র মুচকি হাসল। শার্টের কলারটা ঠিক করতে করতে ভাব নিয়ে বলল,
“ইট’স মাই পাওয়ার! এই গুণটা সবার থাকেনা।”
ভ্রু যুগল কুঁচকে ফেলল কথাটা বলে। কথাটা বেলীর কর্ণদ্বয়ে পৌঁছাতেই বেলীর কপাল কুঁচকে এলো। দাঁ/ত কটমট করতে করতে শুধাল,
“আপনি একটা জ/ঘন্যতম ব্যক্তি! মিথ্যা কথা বলে আবার জোর গলায় বলছেন? লজ্জা করছে না আপনার? নি/র্লজ্জ লোক একটা! ”
বলে বাড়ির দিকে পা বাড়াল। বেলীর রাগ দেখে নীলাভ্র শব্দ করে হেসে উঠল। নীলাভ্রর হাসির শব্দ বেলীর কানে আসতেই রাগে কান গরম হয় গেলো। আঁখি জোড়া রাগে লাল বর্ণ ধারণ করল। পেছন ফিরে দেখল নীলাভ্র কোমড়ে হাত দিয়ে হেসেই যাচ্ছে। হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাওয়ার উপক্রম। হঠাৎ ঝিনঝিনিয়ে উঠল সর্বাঙ্গ। ছেলেটার মুখে হাসি কী সুন্দর মানায়! হাসলে পৃথিবীর কুৎসিত ব্যক্তিটাকেও মা/রাত্নক সুন্দর লাগে! ভালো লাগার ছোঁয়ায় সারা অঙ্গ পুলকিত হলো। চেয়ে রইল এক ধ্যানে। হাস্যজ্বল মুখপানে তাকিয়ে নিজের সব কষ্ট, অভিযোগ, অভিমান ভুলে গেলো। মুছে গেলো হৃদয় থেকে। ভালোবাসার মানুষটা অন্যায় করলেও ঘৃণা করা যায় না। বড়োজোর ‘ঘৃণা করি’ কথাটা মুখে বলা যায়। কিন্তু, মন থেকে সত্যি সত্যি ঘৃণা করা যায় না। মানুষটার আড়ালে বুকের ভেতর হাজারটা অভিযোগ জমিয়ে রাখা যায়। কিন্তু দিনশেষে মানুষটার সামনে দাঁড়িয়ে অভিযোগ গুলো প্রকাশ করা যায়না। কী এক অদ্ভুত অনুভূতি! বেলীকে নিরলস চেয়ে থাকতে দেখে নীলাভ্র থমকালো। মা/দকতার মতো চাহনী মেয়েটার! দেখলেই নে/শা ধরে যাওয়ার মতো। রাগলে মেয়েটাকে আরো সুন্দর লাগে। আর হাসলে তো বক্ষস্থল চিনচিন করে উঠে। হৃদযন্ত্রটা লাফানো শুরু করে। চারদিকে সব বিষাদ ভুলে দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে তৃপ্তি সহকারে। হুট করে কোথা থেকে গাড়ির হর্ণের শব্দ কানে আসতেই দুজনের চৈতন্য ফিরে এলো। ধড়ফড়িয়ে উঠল দুজনেই৷ বেলী একটু লজ্জা পেলো বটে। বেলীর লজ্জানত মুখখানে দেখে নীলাভ্রর মাথায় দুষ্টু বুদ্ধিরা এসে হা/না দিলো। উচ্চস্বরে অপকটচিত্তে বলে উঠল,
“তোমাকে দেখে আমার বুকের ভেতর ধুপধাপ করে, বেলীপ্রিয়া। তোমার প্রণয়ের দহনে আমি জ্ব/লে, পু/ড়ে ক’য়লা হয়ে যাচ্ছি। আমার বক্ষস্থলের এই জ্বা/লানি একমাত্র তুমি ছাড়া আর কারোর পক্ষা নিভানো সম্ভব না। তুমি আমার জ্বালাময়ী রানী।”
নীলাভ্র এহেন সব অদ্ভুত কথা শুনে বেলীর হাসি পেলেও দমিয়ে নিলো। কপট রাগ দেখিয়ে হাতের মোবাইলটা ছুঁ/ড়ে মা/রল নীলাভ্রর দিকে। নীলাভ্র কেস ধরে নিলো সাথে সাথে। বেলী সেদিকপানে তাকিয়ে মেকি হাসল। জোরেই বলল,
“আপনি এক কাজ করুন। সিনেমায় যোগদান করুন। ভালো উন্নতি করতে পারবেন। অভিনয়ে একদম সেরা! আর ডায়লগ তো মা/রহাবা!”
কথা টুকু শেষ করে। বিড়বিড় করে বলল,
“শা/লা এক নাম্বার পট্টিবা/জ!”
বলে বাসার দিকে পা বাড়াল। আর নীলাভ্র সেখানে দাঁড়িয়ে হাসিতে মত্ত হয়ে পড়ল। বেলী বাসার ভেতরে ঢুকে যেতেই নীলাভ্রর মুখের হাসিটা গায়েব হয়ে গেলো। বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। হাহাকার শুরু হলো মুহূর্তেই। এতক্ষণ হাসি মুখে থাকলেও এবার নয়ন জোড়ায় অশ্রু এসে হা/মলে পড়ল। কী এক যন্ত্রণা! এই যন্ত্রণার শেষ কোথায়? কে জানে? বেলীকে হারানোর ভয়টা মস্তিষ্কের মা/রাত্মক ভাবে ঘা/পটি মে/রে বসেছে। কিছুতেই দূর হচ্ছে না। এতদিন বেলীকে ছেড়ে থাকতে পারছিলো না। কিন্তু, ফিরে আসার কোনো রাস্তাও ছিলো না। সব সময় মন চাইলেই সব পাওয়া যায়না। যদি মানুষ চাইলেই সব পেয়ে যেতো তাহলে কী আর পৃথিবীতে না পাওয়ার হাহাকার থাকত? আকাশের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে নয়ন জোড়া বন্ধ করে নিলো। সাথে সাথে দুই ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল, চোখের কোন বেয়ে। তড়িঘড়ি করে মুছে নিলো। বুকের মধ্যে সূক্ষ্ম ব্যাথা টের পেলো। নিজে নিজেই বলে উঠল,
“তোকে ছেড়ে আর যাব না, বেলীপ্রিয়া। আমি তোকে ছাড়া বাঁচতে পারিনা রে! আমার খুব কষ্ট হয়। আমি এতদিন ভালো ছিলাম না। কিন্তু ফিরতেও পারছিলাম না। এখন যখন একবার ফিরে এসেছি। তখন আর যাব না। প্রমিস। ভালোবাসি, বেলীপ্রিয়া। বড্ড বেশি ভালোবাসি তোকে!”
বলে বেলীর ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে বাসার দিকে হাঁটা শুরু করল।
—
বেলী মুখ গুমরা করে সোফায় বসে আছে। রিতা অনেকক্ষণ যাবৎ একটার পর একটা প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। কিন্তু বেলী উত্তর দিচ্ছে না। এবার সে রেগে এক প্রকার ধমক দিয়েই জিজ্ঞেস করল,
“আমি কী বলছি? শুনতে পাচ্ছিস না তুই? ফিরে আসলি কেন? কী হয়েছে?”
বেলী বিরক্ত হয়ে কিছু কথা বলার জন্য মুখ খুলল। তখনি দরজার সামনে থেকে পরিচিত কণ্ঠ ভেসে এলো।
“কারণ আমি ফিরে এসেছি তাই।”
নীলাভ্রর কণ্ঠ পেয়ে বেলীর কোনো ভাবাবেগ প্রকাশ পেলো না। কিন্তু রিতা অবাক চোখে সেদিকে তাকাল। দরজার সামনে নীলাভ্রকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আকাশ থেকে পড়ল যেন? তড়িৎ গতিতে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। নীলাভ্র শান্ত ভঙ্গিতে এসে দাঁড়াল রিতার সামনে। হাসি মুখে রিতাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরল। প্রশ্ন করল,
“কেমন আছো, ফুপ্পি? শরীর ঠিক আছে তোমার?”
নীলাভ্রর প্রশ্নটা শেষ হতে দেরি। কিন্তু গা/লে থা/প্প/ড় পড়তে দেরি হলো না। আচমকা এমন একটা কান্ড ঘটে যাওয়ায় বেলী বজ্রাহত চোখে তাকাল মায়ের দিকে। হকচকিয়ে উঠে, দাঁড়িয়ে পড়ল।
নীলাভ্র বো/কার মতো তাকিয়ে রইল শুধু…
#তুমি_নামক_প্রশান্তি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_ত্রিশ
সজোরে দুইটা থা°°/প্প/°°ড় খেয়ে নীলাভ্র গালে হাত দিয়ে চেয়ে আছে। চোখে লেগে আছে অসহায়ত্ব। যে মানুষটা ছোট বেলা থেকে মায়ের মতো আদর, স্নেহ দিয়ে বড় করে তুলেছে। আজ সেই মানুষটা গা°য়ে হাত তুলল! তাও বিনা দোষে! ভাবতেই অবাক লাগছে নীলাভ্রর। কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। রিতা রা°গান্বিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। তার সর্বাঙ্গে কাঁ°পুনি হচ্ছে। রাগে বশিভূত হয়ে তৃতীয় থা°°/প্প/°°ড়টা মা°°/রা/র জন্য হাত উঠাতেই, বেলী সাহস করে মায়ের হাতটা ধরে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে অনুরোধ বাক্যে বলে উঠল,
“মা! আর মা°°/র/°°বে না প্লিজ।”
বেলীর চোখ অশ্রুসিক্ত। নীলাভ্রর দৃষ্টিতে মেঝের সাদা ঝকঝকে টাইলসের উপর। চোখ দুটো যে, অশ্রুসিক্ত তা বুঝতে দেরি হলো না বেলীর। রিতা কিছু একটা ভাবল হয়তো? কিছু সময়ের ব্যবধানে গম্ভীর স্বরে বলল,
“এই ছেলেটা আমার বাসায় কী করছে? এক্ষুনি আমার চোখের সামনে থেকে চলে যেতে বল। নয়তো আমি ধা°°/ক্কা মে/°°রে বের করে দিব।”
রিতার এহেন কথা শুনে নীলাভ্রর চোখ জোড়া থেকে দুই ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। শোকে নীলাভ্র স্তম্ভিত, কিংকর্তব্যবিমূঢ় কণ্ঠে বলে উঠল,
“ফুপ্পি! তুমি আমাকে এইভাবে বললে! ”
রিতা পুনরায় তাকাল। স্নেহ, মায়াহীন চোখে। যেই চোখে আগে নীলাভ্র ভালোবাসা, মায়া খুঁজে পেতো। আজ সেই চোখে কোনো স্নেহ, মায়া দেখতে পাচ্ছে না। কী অদ্ভুত! এই সাতদিনে কী সব পাল্টে গেলো? সবাই কী দূরে সরে গেলো? কে জানে? বুকের মধ্যে তীব্র হাহাকার যুক্ত কান্নারা দলবেঁধে আছে। যেকোনো মুহূর্তে সমুদ্রের পানির উপর তীরে উপচে পড়বে। রিতা কাঠকাঠ গলায় জবাব দিলো,
“তুই আমাকে আর ফুপ্পি বলে ডাকবি না। তুই কী করে পারলি আমাদের সবাইকে এভাবে কষ্ট দিতে? এবারও তোর বেলীর কথা মনে হলো না? মনে হলো না তোর মায়ের কথা, পরিবারের সবার কথা? সবাই কতটা দুশ্চিন্তায় দিন কা/°°টিয়েছে সেই ধারণা তোর আছে? কী এমন কাজে ছিলি তুই? বল কী কাজ ছিলো তোর?”
বলতে বলতে রিতা কান্নায় ভে°°/ঙে পড়ল। নিজের শক্ত আবরণটা ধরে রাখতে পারল না। মায়েরা যতই শক্ত হোক। সন্তানের কাছে বরাবরেই তারা খুব দূ°র্বল, নরম। নীলাভ্র কিছু বলল না। শুধু নিঃশব্দে রিতাকে জড়িয়ে ধরল। মেয়েদের মতো ফুঁপিয়ে কান্না করে উঠল। রিতা দুই হাতে নীলাভ্রর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। শান্ত, শীতল স্বরে বলল,
“তুই আমাকে সত্যি করে বল, তুই কোথায় ছিলি?”
নীলাভ্র কিছু সময় চুপ থাকল। খানিক সময় পর সবটা খুলে বলল। রিতার মন থেকে একটা ভারী পাথর নেমে গেলো। বেলীর থেকে সেদিন ওইসব রি°পোর্টের কথা শুনে দুশ্চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছিল। নীলাভ্র রিতার হাত দুটো শ°ক্ত করে আকঁড়ে ধরল। নরম স্বরে বলল,
“আমাকে ক্ষমা করে দাও ফুপ্পি, প্লিজ। আমি আর কখনো তোমাদের সবাইকে ছেড়ে যাব না।”
রিতা কিছু বলল না। পরম আবেশে হাত বুলিয়ে দিলো নীলাভ্রর গালে। মাঝখান থেকে বেলী চ্যাঁচিয়ে বলে উঠল,
“কোনো ক্ষমা করা হবেনা আপনাকে। এক্ষুনি আমার বাসা থেকে বের হয়ে যান। আপনাকে দেখলেই আমার গা-পিত্তি জ্ব°°/লে যাচ্ছে।”
বেলীর কণ্ঠে তীব্র রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটল। রিতা হেসে উঠল হাহা করে। আর নীলাভ্রর মুখটা চু°পসে গেলো। রিতা ওদের দুজনকে কথা বলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য, রুম থেকে বেরিয়ে গেলো৷ চা বানানোর বাহানায়। রিতা চলে যেতেই বেলীর রাগটা দ্বিগুণ হয়ে উঠল। কোমরে হাত রাখল। আঁখি জোড়ায় আ/°°গুন জ্ব°°/লে উঠল। বেলীর রাগান্বিত মুখটা দেখে নীলাভ্রর এবার হাসি পেলো। বেশ প্রফুল্ল মনে বলে উঠল,
“তোকে রাগলে কিন্তু বেশি সুন্দর লাগে, বেলীপ্রিয়া।”
বলে বেলীকে দ্বিতীয় বার কোনো শব্দ উচ্চারণ করার সুযোগ দিলো না। দুই হাতে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিলো। নরম, শান্ত, শীতল কণ্ঠে বলে উঠল,
“ভালোবাসি, বেলীপ্রিয়া।”
ব্যস! লাগে কী আর? বেলীর রাগ নিমিশেই উধাও। ছেলেটা জাদু জানে হয়ত? কী সুন্দর মুহূর্তেই রাগটাকে গ্রাস করে নিলো? শান্ত হয়ে গেলো বেলী। নড়াচড়ার মতো শ°ক্তি পেলো না। অশান্ত মনটা ছটফট করতে লাগল। কী এক অদ্ভুত শান্তি! আচ্ছা প্রিয় মানুষের বুকে কী এত শান্তি থাকে? না-কি প্রিয় মানুষ বলে এত শান্তি অনুভব হয়? কে জানে? উত্তর খুজে পেলো না। একদম লেপ্টে রইল নীলাভ্রর বুকে। দুজনের মাঝে পিনপতন নীরবতা। নীরবতা ভেঙে নীলাভ্র বলে উঠল,
“বেলীপ্রিয়া?”
বেলী নিচু স্বরে জবাব দিলো,
“হুম।”
নীলাভ্র সাথে সাথে বলল,
“আর মাত্র এক মাস। তারপর তুই আমার। সারাজীবনের জন্য। তোকে আগলে রাখব আমার বক্ষস্থলে। একদম ছেড়ে দিব না। শক্ত করে আকঁড়ে রাখব। প্রমিস।”
বেলী কিছুক্ষণ চুপ থাকল। তারপর আচমকা হুঁহুঁ করে কেঁদে উঠল। কান্নারত স্বরে বলল,
“আমাকে আপনার পায়ে হলেও একটু ঠাঁই দিয়েন। আমি সারাজীবন মাটি আঁকড়ে থাকব। তবুও ছেড়ে যাবেন না, প্লিজ।”
বেলীর কথায় নীলাভ্র থমকাল। ধমকের স্বরে বলল,
“আজেবাজে কথা বললে একটা সজোরে থা/প্প/ড় মা/র/ব।”
বলে থামল কিছুসময়। তারপর বেলীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছাড়ল। শান্ত কণ্ঠে বলতে লাগল,
“তোর জায়গা আমার পায়ে নয় রে, বেলীপ্রিয়া। তোর জায়গা আমার বক্ষস্থলে। তুই আমার এক প্রিয় অসুখ। মারাত্নক নে/শাধর অসুখ। যা দুনিয়ার কোনো ওষুধে কমবে না। বুঝলি, গা/ধি?”
এমন সরল স্বীকারোক্তিতে বেলীর মনটা গলে গেল। অশান্তটা মনটা শান্ত হয়ে গেলো। হাসল বোধহয়? কে/টে গেলো এভাবেই। মুহূর্তটা সুন্দর! ভীষণ সুন্দর! ভালোবাসাও সুন্দর!
—
তানিশার শরীরটা ইদানীং ভালো যাচ্ছে না। কেমন যেন সারাক্ষণ ঝিমাতে থাকে মেয়েটা! মুখটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। মো°টাসো°টা মেয়েটা শুকিয়ে গেছে। একদম লা/°°ঠির মতো! দূর্বলতা গ্রা°স করে নিয়েছে শরীর। বিছানায় শ°রীর রাখলে আর উঠাতে মন চায়না। এই শরীর নিয়েও সুয়ে থাকার সময় নেই। সারাদিন গা/°°ধার মতো খা°°টুনি খে°°টে যায় মেয়েটা। চু°লায় ভাত বসিয়ে দিয়ে নিচে বসে পড়ল ধপ করে। চলছে না শরীর টা। দুই হা°টুর ভাঁজ করে মুখ লুকাল সেখানটায়। গা গু°লিয়ে আসছে বার বার। ব°মির বেগ আসতেই দৌড়ে গেলো ওয়াশরুমে। ওয়াশরুমের সাদা টাইলসটা মুহূর্তেই র°°ক্তে ভেসে গেলো। গলগল করে মুখ দিয়ে র°°ক্ত বেরিয়ে আসতে লাগল। ভ°য়ে বুকটা কেঁ°পে উঠল তানিশার। শরীর যেন অ°বশ হয়ে আসতে লাগল। হাত-পা সারা শরীর কাঁ°পা-কাঁ°পি শুরু হয়ে গেলো। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসল মুহূর্তেই। ফ্লোরে পড়ে গেলো চোখের পলকেই। ধ°পাস করে কিছু প°ড়ার শব্দ তানিশার শাশুড়ী দৌড়ে এলো রুম থেকে। রান্নাঘরে তানিশাকে খুঁজে না পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে আবার অন্যদিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। রান্না ঘরের সোজাসুজি ওয়াশরুমে চোখ যেতেই আঁত°কে উঠল। তানিশার পড়নের শাড়িটা র°°ক্তে মাখা। চিৎকার করে ডাকতে লাগল সবাইকে। দৌড়ে গিয়ে তানিশার মা°থাটা নিজের কোলে নিয়ে বসল। তানিশার ঠোঁ°টের কোণে এখনো র°°ক্তের ছড়াছড়ি। এইসব দেখে ভয়ে তার কলিজা শুকিয়ে আসতে লাগল। বাসায় তখন শাকিল ছিলো না। পাশের রুম থেকে বেরিয়ে এলো শাকিলের বাবা। ছেলের বউয়ের এই অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেলো। দুজনের পা°-গলের মতো অবস্থা হয়ে পড়ল। তাড়াতাড়ি এ°ম্বুল্যান্স খবর দিলো। প্রায় আধা ঘন্টা পর এ°ম্বুল্যান্স আসল। তোলা হলো তানিশাকে এ°ম্বুল্যান্সে। এই আধাঘন্টা অনেক চেষ্টা করেও তানিশার জ্ঞা°ন ফেরানো যায়নি। এ°ম্বুল্যান্সে যেতে যেতে তারা দুজন সবাইকে ফোন করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। দ্রুত একটা ভালো হসপিটালে ভর্তি করানো হলো। শাকিল প্রথমবার ফোনটা রিসিভ করেছিল, ঠিকি। কিন্তু তারপর থেকে ফোনটা বন্ধ করে রেখেছে। তানিশার বাবা-মা প্রায় ঘন্টাখানেকের মা°থায় হসপিটালে এসে উপস্থিত হলেন। মেয়ের অবস্থা দেখে কান্নায় ভে°ঙে পড়ল। হসপিটাল জুড়ে সাহেলা বেগমের কান্নার শব্দ। রতন চুপচাপ বসে আছে। চোখের কোনে অশ্রুরা জমাট বেঁধে আছে। বুকটা কষ্টে ফে°-টে যাচ্ছে। কিছু সময় পর ডাক্তার বেরিয়ে আসতেই সবাই মিলে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। একের পর এক প্রশ্ন ছু°ড়ে মা°র°ল সবাই। ডাক্তার বেশ শান্ত স্বরেই জবাব দিলো,
“এইটুকু একটা মেয়ের এত চা°প কিসের বলুন তো? যে সে অতিরিক্ত চা°পে ব্রে°ন স্ট্রো°ক করে ফেলল?”
কথাটা সবার কানে যেতেই যেন, সবাই পা°থরে পরিনত হলো। ঠিকি তো? তানিশার এত কিসের চা°প? প্রশ্নটা হা°না দিলো সবার মনে। এত উত্তর খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
#তুমি_নামক_প্রশান্তি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_একত্রিশ (প্রথম খন্ডের সমাপ্তি)
বিয়ের আসরে কোনো মেয়ের ভালোবাসার মানুষটা পালিয়ে গেলে ঠিক কতটা কষ্ট হয়? কতটা সম্মানহানি হয়? ভাবতে পারছেন একবার? যেই মানুষটাকে বেলী নিজের সবটুকু দিয়ে ভালোবাসল। সেই মানুষটা আজ ঠকাল! বিশ্বাস হচ্ছেনা। আচ্ছা মানুষটার কী কোনো বিপদ হলো? মনটা এমন ছট°ফট করছে কেন? সব কিছু এত ঘোলাটে লাগছে কেন? দ°ম আটকে আসছে কেমন যেন? এই বুঝি বেলীর নিশ্বাস ফুরিয়ে গেলো? বিভ°ৎস এক যন্ত্র°ণা সহ্য করতে না পেরে চিৎকার করে ‘মা’ বলে ডেকে উঠল বেলী। ধড়°ফড়িয়ে লাফিয়ে উঠে বসে পড়ল বিছানায়। হাত-পা সমানে কেঁ°পে একাকার অবস্থা। শরীর থেকে পানির ন্যায় ঘাম ঝড়ছে। কী একটা অবস্থা! বু°কের ভেতরটা ধুকপুক করছে। বেলীর চিৎকারে রিতা অন্য রুম থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলো। বেলীর রুমে প্রবেশ করে বেলীকে এই অবস্থায় দেখে ঘাবড়ে গেলো। বেলী কাঁপছে এখনো। থামার নাম নেই। চোখ দুটো থেকে ভয়ের রাশ যেন কমার নাম নেই? রিতা বেলীর পাশে বসতেই বেলীর যেন হুশ এলো। বিশ্বস্ত, ভরসাযোগ্য ব্যক্তিকে পেয়ে হামলে পড়ল তার বুকে। জোরে কান্নায় মত্ত হয়ে পড়ল৷ রিতা যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে? কথা বলতে পারছেনা। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে উঠল,
“কী হয়েছে মা? স্বপ্ন দেখেছিস কোনো?”
বেলী উত্তর দিলো না। ওইভাবেই কাঁদতে লাগল। রিতার ভয়টা দ্বিগুণ হলো। পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
“বল কী হয়েছে? এমন লাগছে কেনো তোকে?”
বেলী এবার একটু সময় নিলো। ফুঁপিয়ে কান্না করতে করতে সবটা অগোছালো ভাবে বলল। রিতা এবার সব বুঝতে পারল। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চি°রে। রাতের নিরবতার মাঝে বেলীর ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ ভয়ং°কর শুনাচ্ছে। কিছু সময়ের ব্যবধানে রিতা স্বান্তনা দিয়ে বলে উঠল,
“দেখ মা, স্বপ্ন কোনোদিন সত্যি হয় না। এইতো আর মাত্র কয়েকদিন তারপর তোদের বিয়ে। দেখবি, এইসব কিছু হবেনা। নীলাভ্র তোকে কত ভালোবাসে, বল তো? কোনোদিন তোকে ছেড়ে যাবে না।”
এবার বেলী একটু শান্ত হলো। বাচ্চাদের মতো কান্নামিশ্রিত স্বরে বলল,
“সত্যি বলছো, মা? নীলাভ্র ভাই, আমাকে ছেড়ে যাবে না তো?”
রিতা বোধহয় খানিকটা হাসল। মেয়ের এহেন কান্ডে। হাসিটা ঠোঁটের কোনে চে°পে বলল,
“ছেড়ে যাবে না। আমার এই রাজকন্যাকে ছেড়ে যাওয়ার সাধ্য আছে না-কি?”
মায়ের এমন কথায় বেলী একটু লজ্জা পেলো। হাসি ফুটল ঠোঁটদ্বয়ে। বুকের ভেতরের ভা°রী পা°থরটা নেমে গেলো। কিছুক্ষণ মায়ের বুকে এভাবেই রইল।
রিতা বেশ শান্ত ভাবে বলতে লাগল,
“এখন ঝটপট উঠে নফল নামাজ আদায় করে নে। আমার কাছে কেঁদে যেইটুকু সময় নষ্ট করলি, সেটুকু সময় উপরওয়ালার কাছে কাঁদলে শান্তি পাওয়া যেত। মনে রাখিস, জীবনে কেউ তোর পাশে না থাকলেও আল্লাহ তোর পাশে আছেন। আমি মানে একটা মা তার সন্তানকে যতটা ভালোবাসি। তিনি তার চেয়েও দ্বিগুণ ভালোবাসে তার বান্দাকে। তাই মনের মধ্যে ভয়, হতাশা পুষে না রেখে সেজদায় গিয়ে সব ঝেড়ে ফেল। নিমিশেই সব হাওয়া হয়ে যাবে।
বলে মেয়ের মাথায় পরম যত্নে হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেল। রিতা চলে যেতেই বেলী জোরে নিশ্বাস ফেলল। মায়ের কথাগুলো অদ্ভুত শান্তি দিচ্ছে। কিছুসময়ের জন্য ধড়াম করে বিছানায় সুয়ে পড়ল। ফোনটা তুলে নিতেই সময় চোখে পড়ল। সাড়ে চারটা বাজে। ভোর হতে বেশিক্ষণ নেই! কথাটা মনে উঠতেই আবার ভয়ে আঁতকে উঠল। ভোরের স্বপ্ন না-কি সত্যি হয়? তারপর নিজে নিজেই দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠল,
“এইসব কিছু হবেনা। আর যদিও হয় তাহলে আমি মেনে নিব। কারণ আমার আল্লাহ আমার জন্য যা করবেন, তা নিশ্চয়ই ভালো হবে।”
বলে উঠে পড়ল নামাজ আদায়ের তাগিদে।
—
২৪ঘন্টা হয়ে গেছে। তানিশার জ্ঞান ফিরেনি এখনো। চিন্তায় সবার অবস্থা এই মুহূর্তে পা°গল পা°গল। হসপিটালের করিডোরে তানিশার বাবা-মা পা°গলের মতো কেঁদে চলেছে সারাক্ষণ। এখন সকাল সাতটা বেজে দশ মিনিট। এর মধ্যেই একজন নার্স এসে বলতে লাগল,
“তানিশার বাড়ির লোক কে আছেন? তার জ্ঞান ফিরেছে। আপনারা চাইলে দেখা করতে পারেন।”
বলে সে চলে গেলো। মনে হলো উপস্থিত সবার বুকের উপর থেকে ভা°রী বোঝা নেমে গেলো। তানিশার মা সময় না নিয়ে দৌড়ে কেবিনের ভেতর ঢুকে গেলো। তানিশা চোখ বন্ধ করে ছিল, রুমের মধ্যে কারোর প্রবেশ করার শব্দ পেয়ে চোখ খুলে তাকাল। চোখের সামনে ‘মা’ নামক ব্যক্তিটাকে দেখে অভিমান গুলো উপচে পড়ল। মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো মুহূর্তেই। সাহেলা বেগম চোখের জলটুকু মুছতে মুছতে তানিশার মাথার সামনে বসল। মাথায় হাত রেখে বলে উঠলেন,
“আমার লগে কথা কবি না, মা?”
তানিশা নিশ্চুপ। কথা বলার জন্য বেশি শক্তিটুকু ওর শরীরে নেই। তবুও আজ অনেক অভিযোগ দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পারছেনা। সাহেলা বেগম পুনরায় বলে উঠলেন,
“একবার আমার দিকে চাইয়া দেখ। আমি তোর মা হইয়া তোর কাছে মাফ চাইতাছি। আমারে মাফ কইরা দে। টাকার লেইগা আমরা অন্ধ হইয়া গেছিলাম। বুঝিনাই তোর দুঃখ। আমাগোরে এমনে শাস্তি দিস না, মা।”
বলে কান্না করে উঠলেন তিনি। তানিশার চোখ বেয়েও পানি গড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু কিছু বলতে পারছে না। বার বার মস্তিস্ক প্রশ্ন করছে,
” সত্যিই এবার তাহলে এই জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে?”
—
নীলাভ্র আর বেলী পাশাপাশি বসে আছে। বেলীর মুখে রাজ্যের বিষন্নতা। বার বার তানিশাকে ফোন করে যাচ্ছে কিন্তু ওপাশ থেকে কেউ রিসিভ করছে না। মেয়েটার কী হলো কে জানে? এই চিন্তায় কাল থেকে শেষ বেলী। এবার বেশ অধৈর্য হয়ে বেলী বলে উঠল,
“আমার এবার খুব বেশি চিন্তা হচ্ছে, নীলাভ্র। তানিশা তো কখনো এমন করে না। তাহলে কী ওর কোনো বিপদ হলো?”
মনের মধ্যে ভয়টা যেন ঝেঁকে বসছে ওর। নীলাভ্র কী বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। তানিশার জন্য ওর নিজেরও চিন্তা হচ্ছে। তিনদিন ধরে মেয়েটার কোনো খোঁজ নেই৷ তবুও বেলীকে শান্ত রাখার জন্য বলল,
“আরে হয়ত ও ব্যস্ত। আবার এমনও হতে পারে ওর ফোন নষ্ট হয়ে গেছে। তুই এক কাজ তানিশার মায়ের কাছে ফোন দে।”
বেলী তানিশার মায়ের কাছে ফোন দেওয়ার জন্য ডায়াল করবে, এমন সময় রাকিব ফোন দিল। তড়িঘড়ি করে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরতেই, ওপাশ থেকে রাকিব শান্ত স্বরে বলে উঠল,
“তানিশা ঠিক আছে। তুই চিন্তা করিস না। সামান্য জ্বর ছিল তাই শাকিল ফোন রিসিভ করতে দেয়নি। ভাবতে পারছিস, কী ভালোবাসা?”
বলে একটু হাসল। বেলী স্পষ্ট বুঝতে পারছে এই হাসির মানে? তাচ্ছিল্যের হাসি। ভালোবাসার মানুষটাকে অন্য একজন এতটা যত্নে রেখেছে তা সহ্য হচ্ছে না রাকিবের। রাকিব ফোনটা কে°টে দিল। বেলীকে কিছু বলার সুযোগ দিল না। বেলীর মুখটা চুপসে আছে। রাকিবের কষ্টের কথা মনে উঠতে মনটা আগের তুলনায় দ্বিগুণ বি°শিয়ে গেল। নীলাভ্রর দিকে করুণ চোখে তাকাল। বলল,
“ভালোবাসা অসহায় তাইনা?”
নীলাভ্র একটু হাসল। বেলীর গালে সযত্নে হাত রাখল। আদুরে স্বরে বলল,
“ভালোবাসা সুন্দর। আবার ভালোবাসা অসহায়। ভিন্নতা শুধু পরিস্থিতির। বুঝলি, পা°গলি?”
বেলী অশ্রুসিক্ত চোখে খানিক হাসল। নীলাভ্রর বুকে লেপ্টে যেতে যেতে বলে উঠল,
“আপনি আমাকে কোনোদিন ছেড়ে যাবেন না তো নীলাভ্র?”
নীলাভ্র পরম যত্নে চু°মু খেলো বেলীর কপালে। দুইদিকে মাথা নাড়িয়ে কেমন শীতল স্বরে উত্তর দিলো,
“কখনো ছেড়ে যাব না। ভালোবাসি বেলীপ্রিয়া।”
বেলীও খুব সযত্নে উত্তর দিলো,
“আমিও আপনাকে ভালোবাসি, নীলাভ্র।”
—
সময় চলে যায় সময়ের গতিতে। যত সময় যাচ্ছে তত যেন বেলী আর নীলাভ্রর বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসছে। এই তো কে°টে গেলো সাতদিন। আর বাকি কিছুদিন। কত স্বপ্ন, কত আশা? কাল প্রায় ঘন্টা খানেক বেলী আর তানিশা মিলে কত শত প্লানিং করল। ভরদুপুর। ঘড়ির কা°টায় বারোটা। ভার্সিটি থেকে এসে বেলী সবেমাত্র ব্যাগটা খাটের উপর রাখল। পানির গ্লাসটা হাতে নিতেই ফোনটা বেজে উঠল। ফোন স্ক্রিনে রাকিবের নামটা দেখে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল। ছেলেটা রাগ হয়ে এই কয়েকদিন কথা বলেনি। আজ তবে অভিমান ভাঙল। ফোন রিসিভ করেই বেলী বলে উঠল,
“কিরে, তোর রাগ ভাঙল অবশেষে।”
কথাটা বলেই বেলী থেমে গেলো। ওপাশ থেকে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ আসছে। রাকিব কাঁদছে? কিন্ত কেনো? আতঙ্কিত স্বরে বেলী প্রশ্ন করল,
“কাঁদছিস কেনো? কী হয়েছে? রাকিব ভাই আমার কাঁদছিস কেনো? কী হয়েছে?”
রাকিব তবুও কেঁদে চলেছে। বেলী এবার অধৈর্য হয়ে ধমকে জিজ্ঞেস করল,
“বলবি, কী হয়েছে তোর? মাথাটা খারাপ হচ্ছে আমার। আন্টি, আংকেল ঠিক আছে?”
ওপাশ থেকে রাকিব জোরে চিৎকার করে বলে উঠল,
“তানিশা আর নেই দোস্ত। তানিশা আমাদের উপর অভিমান করে চলে গেছে। না ফেরার দেশে চলে গেছে। আমার তানিশা ম°রে। আমার তানিশা আমাকে একা করে দিয়ে গেছে।”
কথাগুলো বেলীর কান অব্দি পৌছাল না। তার আগেই বেলী দ্বিগুণ জোরে চিৎকার করে বলে উঠল,
“রাকিব। একদম মজা করবি না। থা°প্পড় দিয়ে সব দাঁ°ত ফে°লে দিব।”
বলে কে°টে দিলো ফোন টা৷ তড়িঘড়ি করে ফোন দিলো তানিশার ফোনে। কিন্তু রিসিচ হলো না। এতে যেন ভয়টা পুরো শরীরে ঝেঁকে বসল। এবার আর উপায়ন্তর না পেয়ে তানিশার মায়ের ফোনে ফোন দিলো৷ দুইবার রিং হতেই ওপাশ থেকে কেউ একজন ফোনটা রিসিভ করল। বেলী ঠিক চিনল না গলার স্বরটা। তবুও অন্য কিছু না জিজ্ঞেস করে সোজা জিজ্ঞেস করল,
“তানিশা। তানিশা কই? তানিশাকে একটু দিবেন প্লিজ।”
কিন্তু পাল্টা উত্তরে ভেসে আসল। এক দুঃসংবাদ। যা সহ্য করার ক্ষমতা বেলীর নেই। দুই মিনিট নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারল না। ঘুরে পড়ে গেলো নিচে। শুরু হলো এক নতুন লড়াই। মেয়েটা কী পারবে সব সামলে নিতে?
#সমাপ্ত
(