তুমি শুধু আমারই হও পর্ব – ২৮

#তুমি_শুধু_আমারই_হও
লেখনীতে- অরনিশা সাথী

|২৮|

অফিস থেকে মাত্রই বের হলো অর্নব। আজ একটু তাড়াতাড়ি-ই বাড়ি ফিরছে। হাতে কাজ নেই তেমন, তাই ভাবলো অফিসে বসে থেকে লাভ নেই তার থেকে ভালো বাড়ি চলে যাক। যেই ভাবা সেই কাজ। পার্কিং থেকে গাড়ি বের করে সবেমাত্র অফিস এরিয়া ছাড়িয়েছে এমন সময় দেখতে পেলো একটা ফুচকা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাচ্ছে টায়রা। সাথে একটা ছেলেও আছে। টায়রা ফুচকা খাচ্ছে আর হাত নাড়িয়ে কথা বলছে ছেলেটার সাথে। মাঝে মধ্যে আবার হাসছে। ছেলেটাও ক্ষণে ক্ষণে হাসছে টায়রার কথা শুনে। গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে জোরেশোরে হাত বাড়ি মারলো অর্নব। ঘন্টা দুই আগেও টায়রার সাথে কথা হয়েছে ওর। কই টায়রা তো একবারের জন্যও বললো না বের হবে ও আজ। অর্নব এক সাইডে গাড়ি পার্ক করে এগিয়ে এলো টায়রার দিকে। টায়রা পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে তাকিয়ে অর্নবকে দেখে প্রথমে ক্ষানিকটা অবাক হলো। তারপর হেসে বললো,
–“তুমি এখানে?”

টায়রার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে অর্নব একই প্রশ্ন করলো টায়রাকে,
–“ভুলে যেও না এটা আমার অফিস এরিয়ার মধ্যেই পড়ে। তুমি কি করছো এখানে? সাথে ছেলেটা কে?”

প্রশ্নটা করে চোয়াল শক্ত করে নিলো অর্নব। টায়রা হাসিমুখে বললো,
–“ও হচ্ছে আমার কাজিন আয়ান ভাইয়া, সিঙ্গাপুরে ওদের বাসাতেই___”

আর কিছু শোনার প্রয়োজন মনে করলো না অর্নব। রাগ হচ্ছে প্রচুর ওর। টায়রা ওর খালামণির বাসায় যাওয়ার পর এই আয়ানকে নিয়েই ঝামেলা হয়েছিলো ওদের। টায়রাকে বারবার বলেছিলো ওর থেকে দূরে থাকতে। প্রয়োজনের বাইরে কথা না বলতে। কিন্তু সেই ওকে নিয়েই আজ বেরিয়েছে টায়রা। অর্নবকে জানায়নি অব্দি। অর্নব টায়রার হাত শক্ত করে চেপে ধরে পা বাড়াতেই আয়ান বললো,
–“কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন ওকে? আর ওর হাত___”

–“শি ইজ মাই উডবি ওয়াইফ।”

কথাটা বলে টায়রাকে টানতে টানতে গাড়ির কাছে নিয়ে গিয়ে হাত ছাড়লো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“গাড়িতে উঠো।”

টায়রা অর্নবের হাত ধরে বললো,
–“তুমি এরকম করছো কেন অর্নব? আয়ান ভাইয়া কি ভাবছে বলো?”

অর্নব উচুঁস্বরে কথা বলতে গিয়েও আশেপাশে তাকিয়ে থেমে গেলো। কিছু মানুষ উৎসুক দৃষ্টিতে দেখছে ওদের। অর্নব গলার স্বর নিচু করে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“বলিনি আয়ানের থেকে দূরে থাকতে? বলেছি কিনা?”

–“ব্ বলেছিলে।”

–“তাহলে ওর সাথে এখানে কি করছো?”

–“আয়ান__”

–“সিনক্রিয়েট করতে চাইচি না এখানে। সুতরাং তুমিও বাধ্য করো না আমায় এই পাবলিক প্লেসে উলটাপালটা কিছু করতে। চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসো।”

টায়রা বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নিচু করে গাড়িতে উঠে বসলো। অর্নব শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিয়ে নিজেও গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো।

বাসায় এসেও টায়রাকে টানতে টানতে নিজের ঘরে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো অর্নব। মিসেস অদিতি বেশ কয়েকবার ডাকলো কিন্তু অর্নব জবাব দেয়নি। বাধ্য হয়েই দরজায় কড়া নেড়ে জিজ্ঞেস করলেন,
–“অর্নব কি হয়েছে? টায়রাকে এভাবে___”

আর কিছু বলার আগেই দরজা খুললো অর্নব। মাকে বললো,
–“তোমার ভাইজির সাথে কথা আছে আমার। তুমি ঘরে যাও।”

–“এভাবে টানতে টানতে নিয়ে আসলি কেন? আর ও কাঁদছে কেন?”

–“কিছু না তো আম্মু, ঘরে যাও তুমি। চিন্তা করো না, তোমার ভাইজিকে মেরে টেরে ফেলবো না।”

কথাটা বলেই আবারো ধরাম করে দরজা লাগিয়ে দিলো অর্নব। টায়রা কেঁপে উঠলো ক্ষানিকটা। একদম দেয়ালের সাথে মিশে আছে ও। ওর সামনেই রাগী চক্ষু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অর্নব। মৃদু চিৎকার করে বললো,
–“কেন বেরিয়েছিলে আয়ানের সাথে? বলিনি ওর থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে?”

টায়রা মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলছে। অর্নব খুব শক্ত করে ওর হাত চেপে ধরে রেখেছে। যার দরুন বেশ ব্যথা পাচ্ছে হাতে। অর্নব আবারো বললো,
–“এর আগেও আয়ানকে নিয়ে ঝামেলা হইছে আমাদের, তারপরও ওর সাথেই কেন মিশছো বারবার? ফুচকা খাওয়ার এত ইচ্ছে হলে আমায় বলতে আমি নিয়ে যেতাম। জানো না আয়ান কোন চোখে দেখে তোমায়?”

–“আয়ান ভাইয়া জানে আমাদের এনগেজমেন্ট__”

–“তো? জেনেশুনেও তো প্রপোজালটা দিয়েছে তোমায়। দেয়নি? আমি যেহেতু বলেছি ওর থেকে দূরে থাকতে তোমার উচিত ছিলো না আমার কথাটা শোনার?”

–“ভাইয়া বাসায় নেই, আয়ান ভাই আশেপাশে ঘ্ ঘুরে দেখতে চেয়েছিলো অনেকদিন পর দেশে এসেছে তাই আম্ আম্মু বললো আমায়___”

–“ওমনি নাচতে নাচতে বেরিয়ে গেলে?”

–“ভুল বুঝছো তুমি।”

এবার অর্নব টায়রার গাল চেপে ধরলো, দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“আয়ান যতদিন তোমাদের বাসায় আছে তুমি ও বাসায় থাকবে না।”

–“মানে কি অর্নব? তাহলে কোথায় থাকবো?”

–“আমাদের বাড়ি।”

–“আমাদের এখনো বিয়ে হয়নি, ভুলে যাচ্ছো কেন সেই কথাটা?”

–“এটা তোমার হবু শ্বশুর বাড়ির আগে তোমার ফুপ্পির বাড়ি। সেটাই তুমি ভুলছো কি করে?”

–“আমি__”

–“কোনো কথা হবে না। তুমি এখানে থাকছো মানে এখানেই থাকছো। আমি আম্মুকে বলে দিচ্ছি মামীর সাথে কথা বলতে।”

কথাটা বলেই হনহনিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো অর্নব। এদিকে অর্নবের যাওয়ার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে টায়রা। এই ছেলের মাথায় কখন কি খেলে আল্লাহ জানেন। বড্ড হিংসুটে একটা ছেলে।

–“তুই না অর্নিকে ভালোবাসতি?”

অভ্রের কথায় ওর দিকে তাকালো নিহাল। মৃদু হেসে বললো,
–“বাসতাম না, এখনো ভালোবাসি।”

–“তাহলে ছেড়ে দিলি কেন? ওর সাথে তো তোর এনগেজমেন্ট হয়েই গেছিলো।”

মুচকি হাসলো নিহাল। বেশ কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললো,
–“হ্যাঁ তা হয়েছিলো বটে, তবে আমাদের দুজনের মধ্যে ভালোবাসার সূচনা হয়নি কখনো। যা হয়েছিলো আমার দিক থেকে, একতরফা। আর উৎসব অর্নি দুজন দুজনকে ভালোবাসে। উৎসবের চোখে আমি অর্নির জন্য এক আকাশ সম ভালোবাসা দেখতে পেয়েছিলাম। অর্নিকে হারানোর ভয় ছিলো উৎসবের চোখে। অর্নির প্রতি উৎসবের ভালোবাসাটা ছিলো সমুদ্রের থেকেও গভীর।”

–“তাহলে কি বলতে চাচ্ছিস, তোর ভালোবাসাটা গভীর ছিলো না?”

হাসলো নিহাল। টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে দৃষ্টি রেখে বললো,
–“আমার ভালোবাসা গভীর ছিলো না তা বলবো না। ওই যে অর্নিও উৎসবকে ভালোবাসে। অর্নি যদি উৎসবকে ভালো না বাসতো তাহলে এনগেজমেন্ট কিছুতেই ভাঙতাম না আমি। অর্নি আমারই হতো।”

অভ্র গিয়ে নিহালের কাঁধে হাত রাখলো। নিহাল চোখের কোনে জমা পানি মুছে অভ্রের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো৷ অভ্র বললো,
–“কি করে পারলি নিজের ভালোবাসাকে অন্যকারো হাতে তুলে দিতে? আমি হলে কক্ষনো পারতাম না।”

–“আমি অলওয়েজ চাই আমার ভালোবাসা ভালো থাকুক। আর অর্নি উৎসবের কাছেই ভালো আছে, ভালো থাকবে। অর্নি আর উৎসব যেখানে একে-অপরকে ভালোবাসে সেখানে আমি আমার একতরফা ভালোবাসা নিয়ে অর্নির সামনে দাঁড়াতে পারি না ওকে আটকানোর জন্য।”

অভ্র কিছু না বলে জড়িয়ে ধরলো নিহালকে। নিহালও আলতো হেসে হাত রাখলো অভ্রের পিঠে৷ নিহাল ওকে জাপ্টে ধরেই বললো,
–“সত্যিই তোর মতো মানুষ হয় না রে। আই এম প্রাউড দ্যাট ইউ আর মাই বেস্ট ফ্রেন্ড।”

রাতের খাবার খেতে বসেছে উৎসবের বাড়ির সকলে। খাওয়ার সময় উৎসবের বাবা নিলয় আবরার উৎসবকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–“বিয়ের তো কয়েকমাস হলো, আর এখন তো অফিসে কাজেরও তেমন একটা চাপ নেই, তাই ভাবছিলাম অর্নিকে নিয়ে কোথাও থেকে ঘুরে আসো কয়েকদিনের জন্য।”

নূর খুশিতে আপ্লূত হয়ে বললো,
–“ভাইয়া আর অর্নি হানিমুনে যাবে? বাহ বেশ___”

নূরের কথা শুনে বিষম খেলো অর্নি। উৎসব পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো অর্নিকে। অর্নি এক পলক উৎসবের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। নিলয় আবরার ধমকে উঠলেন মেয়েকে। কঠোর স্বরে বললেন,
–“অর্নি এখন তোমার বড় ভাইয়ের বউ সুতরাং ভাবী হয় তোমার। এখানে আমি তোমার ভাই উপস্থিত আছি, সবার সামনে ওর নাম ধরে ডাকছো কেন?”

ধমক খেয়ে নূর ঠোঁট উল্টালো। অর্নি আমতা আমতা করে বললো,
–“সমস্যা নেই বাবা, আমরা তো একসাথেই পড়াশোনা করি আর ও আমার বেস্ট___”

–“পাশাপাশি তুমি ওর বড় ভাইয়ের বউ অর্নি। এভাবে উৎসবের সামনে ওর নাম ধরে ডাকাটা শোভা পায় না।”

উৎসব নিলয় আবরারকে বললেন,
–“সমস্যা নেই আব্বু, নূর অর্নির নাম ধরেই ডাকুক। অর্নি আমার বউ হওয়ার কয়েক বছর আগে থেকেই নূরের বেস্ট ফ্রেন্ড।”

প্রত্যুত্তরে নিলয় আবরার এ বিষয়ে আর কোনো কথা বললো না। উনি আবারো হানিমুনের প্রসঙ্গে বললেন,
–“তাহলে কবে যাচ্ছো আর কোথায় যাচ্ছো জানিয়ে দিও আমাকে, আমি সব ব্যবস্থা করে রাখবো।”

উৎসব খেতে খেতেই বললো,
–“আপাতত কোথাও যাচ্ছি না। আগে বিয়ের অনুষ্ঠান হোক, তারপর এ বিষয়ে ভাবা যাবে।”

শায়লা বেগম এতক্ষণে মুখ খুললেন,
–“সে কিরে কেন?”

–“এমনি।”

তরী অর্নিকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো,
–“আপু মন খারাপ হলো ভাইয়া না করাতে?”

অর্নি ভ্রু কুঁচকে তাকালো তরীর দিকে। অর্নি কিছু বলার আগেই নিলয় আবরার বললেন,
–“তোমার একা মতামতে কিছু হবে না। এখানে অর্নিরও একটা ইচ্ছে আছে। অর্নি যেতে___”

অর্নি নিচু স্বরে বললো,
–“আমার কোনো ইচ্ছে নেই বাবা। আপনার ছেলের যে রকম ইচ্ছে সেরকমই হবে।”

–“ঠিক আছে, সবকিছুই তোমাদের ইচ্ছে।”

কথাটা বলে নিলয় আবরার খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। খাবার টেবিলে আর কোনো কথা হলো না। খাবার শেষ করে নিলয় আবরার ঘরে চলে গেলেন। নূর সোফায় বসে টিভি অন করলো৷ অর্নি শায়লা বেগমের হাতে হাতে সবকিছু গোছগাছ করছিলো। তরী চেয়েছিলো সাহায্য করতে অর্নি আর শায়লা বেগম বারণ করে ওকে। তাই তরী গিয়ে নূরের পাশে বসে পড়লো। শায়লা বেগম অবশ্য তরীর পাশাপাশি অর্নিকেও বারণ করেছিলো। অর্নি শোনেনি। উৎসব ঘরে যাওয়ার আগে অর্নিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–“অর্নি, হাতের কাজ সেরে ঘরে আসো দ্রুত।”

তারপর আর এক মিনিটও না দাঁড়িয়ে দোতালায় নিজের ঘরে চলে গেলো উৎসব৷ শায়লা বেগম বললো,
–“ঘরে যা তুই, এদিকে তো কোনো কাজ নেই এইটুকু আমিই করে নিতে পারবো।”

শায়লা বেগম কথা শেষ করার পরই নূর বললো,
–“ভাবী যাও ঘরে যাও। ভাইয়া অপেক্ষা করছে তো৷ ডাকলো যে ঘরে যাওয়ার জন্য?”

নূরের কথায় তরী শব্দ করে হেসে দিলো। শায়লা বেগমও মুচকি হাসলেন। অর্নি চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে বললো,
–“একদম ভাবী বলবি না। কোনো ভাবী-টাবী না, আমরা বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলাম আর সেরকমই আছি।”

কথাটা বলে অর্নি আবারো গোছগাছে হাত লাগালো। অতঃপর সবকিছু গুছিয়ে নূরের পাশে গিয়ে বসলো অর্নি। গল্প করার ধান্দায় উৎসবের কথা একদমই ভুলে গেছে অর্নি৷ উৎসব যে ওকে ঘরে যেতে বলেছে হাতের কাজ সেরে সেটা একদমই মাথায় নেই৷ উৎসব চেঁচিয়ে বললো,
–“অর্নি? ঘরে আসতে বললাম না? আসছো না কেন এখনো?”

উৎসবের ডাকে টনক নড়ে অর্নির। দাঁত দিয়ে জিহ্বা কেটে বললো,
–“এইরে, একদম ভুলে গেছি। এখন না জানি আবার রাগে দুই/চারটা ধমক লাগিয়ে দেয়।”

বলেই দৌড় লাগালো অর্নি। ওদিকে তাকিয়ে নূর আর তরী শব্দ করেই হেসে দিলো। শায়লা বেগমও মুচকি হেসে বললো,
–“পাগল ছেলে আমার।”

চলবে~

[নাইছ নেক্সট লিখবেন না। প্রতিদিন গল্প দিলে যেমন আপনারা খুশি হোন তেমনি আপনাদের ভালো ভালো মন্তব্যে আমিও খুশি হই। নাইছ নেক্সট দেখলে বিরক্ত লাগে।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here