তুমি_নামক_ব্যাধি পর্ব ২০

#তুমি_নামক_ব্যাধি
#মুন্নি_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_২০

গহন রাতে শ্রাবণধারা পড়িছে ঝরে,
কেন গো মিছে তারে জাগাবে ওরে।।
এখনো দুটি আঁখির কোণে যায় যে দেখা
জলের রেখা,
না বলা বাণী রয়েছে যেন অধর ভরে।।
কেন গো মিছে জাগাবে ওরে!!
___প্রেম ও প্রকৃতি(গীতবিতান)

কিন্তু মন আজ রবী ঠাকুরের বারণ শোনেনি।বরষার নবশ্যামের আগমনের কালে শ্রাবণধারার নিরবিচ্ছিন্ন ডাকে সাড়া না দিয়ে পারলাম না।তাকে বাধ্য হয়ে জাগালাম।আজ আকাশের মনের কথা ঝরে পড়ছে যে!তার রিক্ত, ব্যথাতুর, প্রাণহীন, উদাসীন, শ্রাবনের বুকের ভেতর যে আগুন ছিল সব আজ অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ছে। মেঘমল্লার সাহেব আজ পরিপূর্ণ হবে।

চুপচাপ হাত দুদিকে ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছি।ঝুম বৃষ্টি অথচ কি স্তব্ধ হাওয়া। চারিদিকে ঝুম বৃষ্টির মৃদু টালমাটাল গান ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।সামনে যতদূর চোখ যায় সজল মেঘের কোমল কালোয় অরুণ আলো মেশানো।রাস্তার সোডিয়াম আলোর অনেক অংশ ছাদে এসে পড়েছে। সবকিছু স্পষ্ট। বৃষ্টির ফোঁটার ভিতর দিয়ে হলুদ আলোকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে।

পেছন থেকে কারো স্পর্শে শিউরে উঠলাম। তিহাম ভাইয়া দুহাত লম্বা করে আমার হাতের ভেতর দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। হালকা হেসে কিছু বলতে নিতেই আমাকে থামিয়ে দিল।বলল,

—‘এখন শুধু মুহূর্তটাকে ফিল করো।কোনো কথা না।’

বলেই একটানে মাথার ক্লিপ খুলে দিল।সঙ্গে সঙ্গে একরাশ সদ্য ভেজা চুল পেছনে আছড়ে পড়ল।তিহাম ভাইয়া চুলগুলো নিজের নাকের ডগায় এনে বলল,

—‘এই পিচ্চি, তুমি কি শ্যাম্পু ইউজ করো?হ্যাঁ?এমন মাতাল করা সুগন্ধ কেন?’

পেছন দিক মুখ রেখেই বললাম,

—‘দেখেছেন,আপনি নিজেই আমাকে কথা বলতে বারণ করলেন।কিন্তু আপনি নিজেই কেমন সবকিছু ফানি বানিয়ে দিচ্ছেন?’

উনি আমাকে একটানে নিজের দিকে ঘুরিয়ে সামনের চুল ঠিক করে দিতে দিতে বলল,

—‘আমি তোমার খুঁটিনাটি সব ব্যাপারে সিরিয়াস।সত্যি তোমার চুলের গন্ধ গাঞ্জার চেয়েও বেশি মারাত্মক নেশাকর!’

ভ্রু কুঁচকে ওনার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,

—‘কি বললেন আপনি?’

—‘আব.. কিছু না।ভুলে বলে ফেলেছি।আসলে এই মুহূর্তে আর কোনো উপমা মনে পড়ছিল না।ওয়েট, ভেবে বলছি।…….তোমার নেতিয়ে পড়া মাধবী লতার মতো চুল থেকে চাপা ফুলের গন্ধ আসছে।আজ নিশি না পোহাতে তোমার ওই চুল দিয়ে জীবন প্রদীপ জ্বালিয়ে যাও প্রিয়া।তোমার ঘনকৃষ্ণ কালো মেঘপুঞ্জের মতো কেশরাশি থেকে বকুল ফুলের গন্ধ পবনে তরঙ্গ তুলেছে।মেঘরাগিনী কুঞ্জছায়াবিথীকায় হাস্যকল্লোল………ইয়ে মানে,আর মেলাতে পারছি না।’

আমি শব্দ করে হেসে উঠলাম।হাসতে হাসতে প্রায় দম বন্ধের মতো অবস্থা। ওনাকে সর্বপ্রথম নিজ থেকে জড়িয়ে ধরলাম।উনি আমায় দুহাতে আগলে বলল,

—‘পিচ্চি, তোমার এই জলতরঙ্গের মতো হাসিটা আমি আজ প্রথম শুনলাম।আমি ছাড়া আর যেনো কেউ কোনোদিন না শোনে।এই হাসিটা শুধু আমার জন্য বরাদ্দ। মনে থাকবে?’

ওনার বুকে মাথা রেখেই হ্যাঁ বললাম।উনি আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। বৃষ্টির বেগ আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। এখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। তিহাম ভাইয়া আমাকে দাঁড় করিয়ে বলল,চোখ বন্ধ করো।আমি আসছি।একদম খুলবে না।

কিছুক্ষণ পর ওনার ডাকে চোখ খুলে দেখি উনি একহাতে কদম গুচ্ছ আর অন্য হাতে রিং নিয়ে এক হাঁটু গেড়ে বসে আছে।আমি অবাকের সপ্তম আসমানে!আমাদের মধ্যে তো মন দেয়া নেয়া হয়ে গেছে। তাহলে এসবের কি দরকার?আর উনি এই সময়ে তাও আবার বিদেশের মাটিতে কদম ফুল কোথায় পেল?জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই আবেগময় কন্ঠে বলল,

—-‘জানো,পিচ্চি! একদিন রাতের বেলা হুট করে মনে হলো বৃষ্টির দিন রাতে তোমায় কদমগুচ্ছ দিয়ে প্রোপোজ করবো।জানি,খুবই উদ্ভট চিন্তা। তবুও নিজের ইচ্ছেটাকেই প্রাধান্য দিলাম।বন্ধুকে বলে দেশ থেকে কুরিয়ারে করে কদম ফুল আনলাম।

কদম ফুল আমার হাতে পৌঁছেছে পরশু দিন।কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছে না।আমার অনেক মন খারাপ হয়ে গেল। ফুলগুলো অনেক যত্নে পানিতে রাখতেও দেখো প্রায় শুকিয়ে গেছে। কিন্তু আজ যখন হঠাৎ করে বৃষ্টি নামলো অনেক খুশি হয়েছিলাম।তাই আর এক মুহূর্ত দেরি না করে তোমায় এখানে নিয়ে আসলাম।(একটু থেমে)

তোমার মন খারাপের শহরে আমি তুষার হয়ে ঝরতে চাই,
যেনো নিমেষে তোমার বিষণ্ন মন ভালো হয়ে যায়।।

তোমার মন খারাপের শহরে আমি ভোরের পাখি হতে চাই,
যেন গুনগুনিয়ে গান শুনিয়ে তোমার ক্ষত মন পূরণ করতে পারি।।

তোমার মন খারাপের শহরে আমি গ্রীষ্মকালের এক পশলা বৃষ্টি হতে চাই,
যেন তোমার ঘর্মাক্ত ক্লান্ত শরীর আর মন খুশিতে ভরে উঠে।।

তোমার মন খারাপের শহরে আমি হালকা দৃশ্য রামধনু হতে চাই,
যেনো তোমার অবসন্ন বিকেল ঝলমল করে অপার সৌন্দর্যে।।

তোমার মন খারাপের শহরে আমি বর্ষার প্রথম কদম ফুল হতে চাই,
প্রিয়জন থেকে পাওয়া যে ফুল তোমায় উদাসীন হতে বাধ্য করবে।।

তোমার মন খারাপের শহরে আমি ডাকপিয়ন হতে চাই,
যেনো তোমার প্রতিটা সুখ দুঃখের ভাগিদার হতে পারি।।

তোমার মন খারাপের শহরে আমি বৃষ্টির দিনের এক কাপ গরম চা হতে চাই,
যেটা তোমার একাকিত্বের সঙ্গী হবে।।

তোমার মন খারাপের শহরে আমি রাতের জোনাকি হয়ে আলো ছড়াতে চাই,
যেনো তোমার মন অন্ধকার স্মৃতির সাগরে ডুবে যেতে না পারে।।

সর্বোপরি,তোমার মন খারাপের শহরে আমি প্রতিটা জিনিসের সাথে মিশে যেতে চাই,
যেনো দুঃখ, কষ্ট, হাহাকার, একাকিত্ব তোমার নরম মনকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে না পারে।
যেনো তোমার ব্যথায় ছাপা মুখে সবার আগে এক চিলতে হাসি ফুটাতে পারি।।

তোমার কাছে আমার একটাই চাওয়া। জানি অনধিকার চর্চা, তবুও তোমার মন খারাপের শহরে আমায় স্থান দিবে??

আমি আমার পিচ্চিটাকে সারাজীবন নিজের বুকে আগলে রাখবো।আমি তোমাকে ভালোবাসি।ভালোবাসি।ভালোবাসি।উইল ইউ ম্যারি মি দিয়ামণি?’

দুফোঁটা আনন্দাশ্রু গড়িয়ে বৃষ্টির সাথে মিশে গেল।মাথা নেড়ে আসতে বললাম,

—‘হ্যাঁ।’

এক হাত দিয়ে ফুলগুলো নিলাম।আরেক হাতটা এগিয়ে দিতেই উনি রিংটা পড়িয়ে হাতে একটা চুমু দিল।দাঁড় করিয়ে জড়িয়ে ধরে অনেক কষ্টে বললাম,

—‘আমিও আপনাকে ভালোবাসি।’

তিহাম ভাইয়া কেমন কেঁপে উঠলো।আমি মাথা তুলে ওনার মুখ দেখতেই উনি দুহাতে আমার গাল ধরে বলল,

—‘আ’ম সো মাচ হ্যাপি।ইউ নো,আজ নিজেকে পরিপূর্ণ লাগছে।জীবনের সেরা অমূল্য রত্নটা আজ তুমি আমায় দিলে।ধন্যবাদ। অসংখ্য ধন্যবাদ। ‘

বলেই আমার কপালে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ালো।এরপর নাকে,ঠোঁটের কাছে আনতেই বাধা দিলাম।ভ্রু কুঁচকে বললাম,

—‘সেদিনের ঘুষির কথা মনে নেই? ‘

মুচকি হেসে বলল,

—‘উহু।আগে এটার টেস্ট নেই। দেন একটার জায়গা দুইটা ঘুষি দিলেও ক্ষতি নেই। ‘

বলেই দুহাত দিয়ে আমাকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলেন।আর বাঁধা দিলাম না।

_____________

প্রায় ছয় মাস হতে চলল এদেশের মাটিতে।পরিবারকে মিস করলেও দিনগুলো আগের থেকে রঙিন যাচ্ছে। তিহাম ভাইয়ার দুষ্ট মিষ্টি পাগলামি গুলোকে নিজের করে নিয়েছি।

ওনার সবগুলো কাজ কেমন অগোছালো। বলা নেই, হুট করে মাঝরাতে নিয়ে বের হয়ে লং ড্রাইভে যাবে,হুট করে জোসনা দেখবে,মাঝরাতে নির্জন রাস্তা দিয়ে হেঁটে বেড়াবে,হিমশীতল তুষারের রাতে হাঁটা আমাদের নিত্য অভ্যাস হয়ে গেছে। বৃষ্টি আসলে তো কোনো কথাই নেই।

প্রথম দিকে অবাক হলেও এখন আর হই না।অভ্যস্ত হয়ে গেছি।এখন মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যদি নিজেকে খোলা আকাশের নিচে বিস্তীর্ণ মাঠে আবিষ্কার করি তবুও মুখের কোণে এক চিলতে প্রশান্তির হাসি ছড়িয়ে পড়ে।হুটহাট রাতে এসে আমায় গান শুনিয়ে ঘুম পাড়ানো ওনার রুটিন হয়ে গেছে এখন।

অনির্বান ভাইয়ার ডাকে সামনে তাকালাম।গতকাল ভোরে তিহাম ভাইয়া আমায় হিথ্রো শহরে অনির্বান ভাইয়ের ওখানে রেখে এসেছিল। আজ ভাবী,ভাইয়া,আর দুটো বাচ্চা রিসারাত আর রিনি সবাইকে নিয়ে Bologna আসছি। অনির্বান ভাই বলল,

—‘দিয়ানা,খারাপ লাগবে বলবে।তিহাম কিন্তু বার বার বলেছে তোমার কারসিকনেস আছে।’

মুচকি হেসে বললাম,

—-‘ভাইয়া আমি একদম ঠিক আছি।এখানে এসে ঘুরতে ঘুরতে আমার সব সিকনেস ঘোল খেয়েছে।’

পাশ থেকে ভাবি ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় বলল,

—-‘টিহাম টো ডিয়ানাকে ট্রাভেল করাটে করাটে সব সিকনেস ডূর করে ডিয়েছে।’

ভাবীর বাংলা শুনলে আমি এখনো হাসি থামাতে পারি না।ফিক করে হেসে দিলাম।

বাসার সামনে গাড়ি থামতেই অবাক হয়ে গেলাম।

(চলবে)

আর মাত্র এক পর্ব!

95/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here