তোমাকে চাইবো বলে পর্ব ৩

“তোমাকে চাইবো বলে”
পর্ব-৩

সকাল থেকেই নাদিবের মন ফুরফুরে। মনের ভেতর কোথাও যেনো একটা ভালো লাগা,ভালো থাকার রেশ ছড়াচ্ছে।এক আধটু মুনা কে দেখলেই বুকের ভেতর খচ করে উঠেছে। এটা কখন থেকে শুরু হয়েছে নাদিব জানেনা,কিন্তু মন্দ লাগছেনা।

এই ঘটনার পর থেকেই মুনা নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখে,এভাবে নিজের দুর্বলতা দেখানো ঠিক না।নাদিব হয়তো ভাববে মুনা নাদিবকে কাছে পেতেই এসব করছে।সব আগের মতই স্বাভাবিক চলছে,বউ শ্বাশুড়ির খুনসুটি, নাদিবের সাথে আগের মতই প্রয়োজন মাপিক কথাবার্তা,হুটহাট ঝগ্রা।সেদিন রাতের ঘটনায় মুনা সংকোচে থাকলেও নাদিব দিব্যি আগের মতই রইলো।

..
এর মাঝেই মেহেরনূর ফোন করে বেয়ান কে জ্বালাচ্ছেন, মেয়েকে নিয়ে যেতে। কিন্তু রেবা বেগম মুনাকে ছাড়বেনা এখনি,সবে বিয়ে হলো, ছেলে আর বউয়ের সম্পর্ক টা কিছুটা নরমাল হোক এটাই তার খেয়াল।এক পর্যায়ে বললেন ঠিক আছে,নাদিব নিয়ে যাবে।

মুনা তো শুনে বেশ খুশি,পাঁচদিন হলো ভাইটাকে দেখেনা,আজ নাদিব বাইরে থেকে আসলেই বলবে বিকেলে নিয়ে যেতে।কিন্তু মুহুর্তে মুখ ভার হয়ে গেলো। সে যাবেনা ওই বাড়িতে,গ্রামের মানুষ রা কানাকানি করছে বিয়ের আগে থেকেই,মুনার নাকি দেবরের সাথে বিয়ে হচ্ছে।কি অসহ্যকর! আদিব যাওয়ার পর থেকে চারদিকে জানাজানি হয়ে গেলো মুনার কপাল মন্দ,এত ভালো পরিবারে বিয়ে হচ্ছিলো, তাও ভেস্তে গেলো। এমন মেয়েকে বিয়ে দিতে অনেক ঝামেলা হবে নাকি।এরপর যখন ঠিক হলো আদিব এর ছোট ভাই ই বিয়ে করবে তখন আরেক শোরগোল, বিয়েটা নাকি মানইজ্জত বাচাতে করাচ্ছে দুপক্ষ।এসব শুনে শুনে মুনা অভ্যস্থ,সে চাচ্ছেনা নাদিব গ্রামে গিয়ে এসব শুনুক।

৭.
দুপুরের পর নাদিব তার বন্ধুর সাথে কি একটা প্রজেক্ট এর কাজে চলে গেলো।রেবা বেগম দুপুরের পর একটু নিজের মতন থাকেন। মুনা নিজের রুমে মন খারাপ করে পায়চারি করছে।নাদিব থাকলে এসময় অযথা পিছে লেগে থাকতো।মন ভার করার সুযোগ ই থাকেনা তখন। মুনা শ্বাশুড়ির ঘরে পা বাড়ালো।

রেবা বেগম কাছে পেয়েই সামনে বসিয়ে মুনার মাথায় তেল লাগাতে শুরু করলেন।
মুনার চুপ করে থাকা দেখে বুঝলেন কিছু হয়েছে।
_ কিরে,বাড়ির জন্য মন ছুটেছে?
উহু
_ পাগলি,আমি বুঝি।নাদিব আসুক আমি বলবো কাল সকালে নিয়ে যেতে।কিন্তু দুইদিন থাকবি শুধু,হুম?
“ আমি যাবোনা মা।
_ এমা,সে কি কথা,রাগ করেছিস এতদিন যেতে দিনাই বলে?
“ না,তা নয়,বরং না যেয়েই ভালো করেছি।
_ কি হয়েছে বল তো,বাবু কিছু বলেছে আবার?
“ না মা,আমার আর ইচ্ছে করছেনা ওই বাড়িতে যেতে।মুনার গলা ধরে এলো। ঘুরে বসে শ্বাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বললো, আচ্ছা মা,আমি সত্যিই খুব অভাগী তাইনা?
_ ছিঃ,এসব কি কথা।
“ বলো না,আমি অল্প বয়সে বাবা হারালাম,তোমার ছেলেটাকেও হারিয়ে ফেললাম।জানো গ্রামের সবাই বলে আমার কপাল দোষেই নাকি এসব হয়েছে।
_ আর তুই ওসবে কান দেস? এজন্য এতদূর পড়লি? বোকা
“ না মা,সত্যিই তো।সবাই বলে এই বিয়েটা করায় আমার গতি হয়েছে,কিন্তু কেনো?আমার কি অন্য জায়গায় বিয়ে হতোনা?এখানেই কেন?আমি তো চাইনি,তুমি কেন আরেকজনের ঘাড়ে আমাকে চাপিয়ে দিলে?
_ মুনা! এসব কি হচ্ছে।আমি নিজের কাছে এনেছি তোকে,বরং নিজ স্বার্থে।
“ তাই বলে তুমি একবার ভাবলেনা, ওই মানুষ টার পছন্দ কেমন,সে কেনো তার ভাইয়ের ভার নিবে?
_ আমি এত টাও বোকা না মুনা।আমি বাবুকে একবার বলাতেই ও রাজি হয়েছে।এমন না যে ও তোকে দেখেনি আগে,এমন না যে ওর অন্য সম্পর্ক আছে।থাকলে ও একবার হলেও বলতো,সেই বন্ধুত্ব আমাদের মা ছেলের আছে।তাছাড়া আদিব এর সাথে তোর মাত্র কমাস পরিচয়,যদি ও দেশে থাকতো তবে কি ওই জানাশোনার সুযোগ পেতি? কথা তো একি হলো তাহলে।
“ এসব তোমার অনুমান মা। তুমি একবার ও ভাবলেনা এরকম অবস্থায় ওই মানুষ টার সাথে আমি সহজ হতে পারবো কিনা? ওই মানুষ টা যে আমাকে নিয়ে এমন ভাবে ভাবেই নি,হুট করে আমার সাথে মানিয়ে নিতে পারবে কিনা? আমাদের সম্পর্ক টা এভাবেই অপরিচিতের মতই শুরু করতে পারবো কিনা?
_ সব পারবি,একটুখানি সময় দে।আমার বাবুকে যখন পুরাপুরি বুঝতে পারবি তখন আর কিছুই ভাবতে ইচ্ছে হবেনা।
“ জানো মা,আমার ভয় হয়,আমি ওনার চোখের দিকে তাকাতে পারিনা।তাকালেই বুকের ভেতর মোচড় দেয়,সব ফিরে ফিরে আসে।আমার খালি কষ্ট হয় তখন মা।আমি হয়তো একদিন মরেই যাবো সহ্য করতে না পেরে। মুনা কাঁদছে অঝোরে ,
রেবা বেগম অসহায়ের মত তাকিয়ে রইলেন।তিনি নিজেও জানেন সময় লাগবে দুজনের।কিন্তু দুটো ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ যখন একসাথে হয় তখন অনেককিছুই পাল্টে যায়।

বাইরে থেকে এসে মায়ের রুম পাস করে যেতেই নাদিব সব শুনলো।অবাক হলো মুনার ভাবনা দেখে। আদিব ঠিক ই বলতো,মেয়েটা ডিফরেন্ট। তার উচিত মুনার ভাবনাগুলো দূর করা,তাকেই সব ঠিক করতে হবে।বিয়েটা সে শুধু দায়িত্ব নিতে করেনি,মন থেকেই সায় পেয়েছিলো বলেই করেছে। নাদিব আজো জানেনা মায়ের একবার বলাতেই সে রাজি হয়ে গেলো কেনো?

..
সন্ধ্যে নামতেই মুনা নিজের ঘরে এসে অবাক।ইনি কখন এলো। বারান্দায় বসে সিগারেট টানছে নাদিব।সচারাচর স্মোকিং করতে দেখেনি মুনা, আজ কি হলো। চা বানাতে চলে গেলো মুনা।রান্নাঘরে সুফিয়াকে দেখে খুশিই হলো মুনা।মেয়েটার কথা শুনতে মজা লাগে তার।
_কি হলো বাড়ি যাস্নি আজ?
“ না গো ভাবি।চাচীর লগে থাকুম আইজ,বাইত আজ ঝগা করি আইছি।
_ সে কি,কি জন্য?
“মা আমার বিয়া দিতে চায় বুঝলেন।আচ্ছা আমি এহনো বিয়ার কি বুঝি?
_ হাহা,মায়েদের এমন ই স্বভাব।
“ ধ্যাত,আমি কি সংসার এর কিছু বুঝুম? মায় কয় বিয়ার পর নাকি সব ঠিক অয়া যায়।
আইচ্ছা ভাবি বিয়ার পর কি মাইন্সের আলগা পাকনা গজে?

মুনা হেসে ফেললো,
_ দেখতো আমার পিঠে কি পাখনা গজাইছে কিনা?
“ আরে ভাবি, আমি চিরিয়াস আপনে মজা লন খালি।
_ আচ্ছা যা,এখন মা কে চা টা দিয়ে আয়।আমি তোর ভাইয়াকে দিয়ে আসি।
সুফিয়া চলে গেলে মুনার মনে হলো,ঠিক ই তো,বিয়ের পর কত কি অভ্যেস হয়ে যায়।এই যে গত কয়েকদিনে নাদিবের চা বানানো, এটা ওটা গুছিয়ে রাখা,সব না চাইতেও করা হয়ে যাচ্ছে।

চা টা সামনে ধরতেই নাদিব তাকালো মুনার দিকে।মুনা চোঁখ সরিয়ে নিলো।নাদিব হেসে ফেললো।
_ হাসছেন কেন?
এমনিই
_ বলুন কেন হাসছেন,মুনা সংকুচিত হয়ে শাড়ি দেখলো।
আরে শাড়ি ঠিক ই আছে,মাথায় তেল আরেকটু দিলে হতো না?
এবার মুনাও হেসে দিলো, মা লাগিয়ে দিলে এমন ই করে।
“ প্যাকিং করেছো? সেদিন রাতের পর থেকে মুনাকে তুমি করে বলে নাদিব,মুনা খেয়াল করলেও কিছু বলেনি।
_ কিসের?
“ সকালে তোমাদের বাড়ি যাচ্ছি।মিরান জ্বালাচ্ছে খুব কল দিয়ে।
_ আমি যাবো না এখন।কিছুদিন পর আমার ক্লাস শুরু হবে,তখন গিয়ে থাকবো।
“ মানে? এখান থেকে ক্লাস করতে কি সমস্যা?
_ এমনিই,এখানে পড়া হবেনা তাই।
“ ওহ আমি জ্বালাই বলে? হাহা
মুনা কিছু বললো না,
“ আচ্ছা আমি আর জ্বালাবো না,রাগাবো না,ফ্রেন্ড হয়ে থাকতে পারি?
মুনা আগ্রহ নিয়ে তাকালো,ফ্রেন্ড আর আপনি?
“ কেন,আমি কি ফ্রেন্ড ম্যাটারিয়াল না?
_ তা না,আচ্ছা বেশ দেখা যাবে কেমন ফ্রেন্ড হতে পারেন।
“ ওকে ম্যাম।বাট আমার সাথে এসব সংকোচ রেখে কথা বলা চলবেনা।মায়ের সাথে যেমন অকপটে সব বলা হয় আমার সাথেও তেমন।
মুনা হতবম্ভ,এই লোক কি সব শুনে ফেলছে নাকি,অদ্ভুত তো।

দিন গড়াচ্ছে,মুনার সাথে নাদিবের সম্পর্ক টাও আগের থেকে ফ্রি।দুজনে মিলে নানা টপিকে আড্ডা,একসাথে খাওয়া,হাসি মজা,মুনার পছন্দ মত ঘুরতে যাওয়া,ঝগ্রা সব ই চলছে।রেবা বেগম সব টের পান,খুশি হন এভাবে দেখে। শুধু দুজনের মাঝের ভারি পর্দা সরেনি এখনো। নাদিব চায় মুনা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ভাবেই তার কাছে আসুক,তাকে জানুক,বুঝুক। মুনা নিজেকে ব্যস্ত রাখছে সংসারে।সংসার টা তার এখন। স্বামী শ্বাশুড়ি কে ঘিরে তার ব্যস্ততা।অবশ্য স্বামী শব্দ টা এখনো বলতে তার সংকোচ হয়।নাদিব তার কাছে স্বামীর অধিকার চায়নি।মুনার ভালো লেগেছে ব্যাপার টা,কোনো রকম তাড়াহুড়ো বা জোর নেই মানুষ টার।যেনো ধরেই নিয়েছে সবকিছু একসময় ঠিক হয়ে যাবে।মুনাও নিজেকে প্রস্তুত করছে নতুন করে।মুনা আস্তে আস্তে জানতে শুরু করেছে মাত্র,এখনো জানা বাকি লোকটা তাকে বিয়ে করেছে কেন? মুনা এ ও দেখতে চায় লোকটা তার প্রতি দুর্বল কিনা।

৮.
রাত আটটা বাজতেই ফোনে নাদিবের কল।মুনা ব্যস্ত হয়ে ফোন ধরলো, আজকাল ভালোই লাগে এরকম হুটহাট কল।
_কই তুমি,তাড়াতাড়ি রেডি হও তো।আমি আসছি।
মানে,কেনো।
_ উফফ কত কথা বলেরে,যা বললাম করো,আম্মুকে বলো শাড়ি পড়িয়ে দিতে গুছিয়ে।
মা কে বলবো কেন,আমি কি পারিনা?
_ তোমার পরা? দেখা গেলো মাঝ রাস্তায় শাড়ির অর্ধেক খুলে পড়ে রইলো, রিস্কি হয়ে যাবে।
হুহ,মেজাজ বিগড়ে গেলো মুনার।খট করে ফোন রেখে দিলো।

কি ভাবে লোকটা, মুখের উপর এভাবে যা তা বলে দেয়,যাবোই না আজ কোথাও।টিভি দেখতে বসে গেলো মুনা।খানিক বাদে নাদিব এসে দেখে অবাক,
_ আরে,তোমাকে কল দিয়ে কি বললাম?
মুনা নির্বিকার ভঙিতে তাকিয়ে বললো, কি বলেছিলেন?
_ ও গড,কই যামু তোমারে নিয়া।উঠো কুইক,সবাই ওয়েট করছে।
তো? আমি যাচ্ছিনা কোথাও।
_ মা কই তুমি? এরে কিছু বলোনা কেন তুমি।
মা নামাজ পড়ছে,চিল্লায়া লাভ নাই।
_ মুনা প্লিজ রেডি হও,ফ্রেন্ডরা আসছে তাদের গার্লফেন্ড নিয়া,একসাথে ডিনারের প্লান করেছে।
মজা পাচ্ছে মুনা,ক্ষেপাতে চায় এবার,
“ ওহ,গার্লফেন্ড?তো আপনিও যান উইথ গার্লফেন্ড।
_ গার্লফেন্ড! আমার কি সেই ব্যাচেলর ভাগ্য আছে যে গার্লফ্রেন্ড নিয়া যামু।
“ কিহ! তার মানে বিয়ে করে খুব ঝামেলায় পড়ে গেছেন? মুনার নাক মুখ লাল হই গেছে,
_ ওই ওই এবার কিন্তু প্যাচাবা না এটা,আমি এত সব বুঝিনা। তাছাড়া আমি এখন ওদের সিনিয়র ভাব নিয়ে চলতে পারি,সুবিধাই এটা।প্লিজ উঠো।
রিমোট টা নাদিবের গায়ে মেরে উঠে চলে এলো মুনা,যাবোনা বলছি যাবো না।হুহ
নাদিব জানে মুনা রেডি হবে,মুচকি হেসে মায়ের কাছে চলে গেলো সে।

..
মুনা রুমে এসে দ্বিধায় পড়লো কোনটা পড়বে,রাগ হচ্ছে,লোকটা রুমে এসে বলে যেতে পারছেনা কি পরবে।ঠিক আছে যা পারছে তাই পরবে।
মুনা সিম্পল ভাবে সেজে নিলো,চুল গুলো বেধে নিলো রাত বলে।শাড়ি পরা তার আসেনা ঠিকমতো তাও হয়েছে একরকম।চুড়ি পরতেই নাদিব এসে দাঁড়ালো। মিটিমিটি হাসছে,মেয়েটা সত্যিই পারে বটে ওকে ক্ষেপাতে।
_কি হলো, নিজে কি এভাবেই যাবেন?
_হু,না মানে এভাবে গেলে কি চলবেনা?
_ যেভাবেই যান,আমার কি,হুহ।
_ না ঠিক আছে একটু সেজে নিই,নয় বন্ধুর গার্লফেন্ড রা ক্রাশ খাবে নাকি? বলেই আড়চোখে মুনাকে দেখলো।
_ পাশে বউ দেখেও বিবাহিত পুরুষ এর উপর ওরা ক্রাশ খাবে,এতই বেক্কল নাকি তারা। নিন এটা পরুন,আর চুল এভাবে আঁচড়াবেন না, এভাবে করে রাখবেন।

হাত দিয়ে নাদিবের চুলের ভাজ ঠিক করে দিচ্ছে মুনা।লম্বায় প্রায় বুক সমান নাদিবের,মাথা উঁচু করে তাও নাগাল পাচ্ছে। নাদিব সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো,মুনা টা সচারাচর কেয়ার দেখায় না।এমন ভাবে সব করে যেনো করার জন্যই করে।
বাড়তি কোনো আচরণ দেখায় না।কিন্তু হুটহাট এরকম কিছু কেয়ারিং দেখায় যে নাদিব জ্ঞানশূন্য হয়ে যায়।শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেছে নাদিবের,মুনা কি টের পাচ্ছে সেটা?

মেয়েটার এমন এক আধটু ছোয়া, কলার ঠিক করে দেয়া,চুল বা হাতা গুছিয়ে দেয়া,ঘড়ি পরিয়ে দেয়া,রাতের বেলা ঘুমের ঘোরে হাত পা লেগে যাওয়া নাদিব কে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়।না পারে আঁকড়ে ধরে নিজেকে শান্ত করতে না পারে সরে গিয়ে শান্ত হতে।কি এক মায়া যেনো আটকে রাখে।হাত উঁচু করে থাকায় মুনার কোমরের একাংশ উন্মুক্ত হয়ে আছে,নাদিবের চোঁখ পড়তেই মুচকি হেসে দিলো সে।দেখতে পাকা গিন্নির মতন দেখাচ্ছে ওকে।হ্যাংলা পাতলা কোমর টা ছুয়ে দিতে ইচ্ছে হয় ইদানীং খুব। একটা পুরুষ ই জানে তার দুর্বলতা, এই মেয়েটা কি বুঝেনা সেটা,কেন এমন অগোছালো শাড়ি পড়ে নাদিব কে বেসামাল করে তুলে সে।

নিন এবার হয়েছে,
মুনার কথায় নাদিবের হুশ হলো, আয়নায় নিজেকে দেখার বদলে পাশে দাঁড়িয়ে কুচি সামলানো মুনাকে দেখছে সে।এই যে ঘড়ি রেখে যাচ্ছি,ভুলবেন না।মুনা পাশ কাটিয়ে মায়ের রুমে চলে গেলো। নাদিব হাসছে চোরের মতন,মুনা কি বুঝবে কখনো, নাদিব ইচ্ছে করেই নিজ থেকে ঘড়ি পরেনা।

..
-মা,আমি টেবিলে খাবার রেখেই যাচ্ছি।তুমি খেয়ে নিও কিন্তু।
ওই মেয়ে,চুল খুলে দে
– চুল কে সামলাবে ওখানে? তুমি?
তোর বর সামলাবে,এই দেখ এখন মানিয়েছে বেশ।
_ বর না কচু।তোমার বাবুর চুল আমিই সাইজ করে দিয়ে এলাম এখন।
তুই ছাড়া কে দিবে শুনি, চল বাবু বসে আছে,নাদিব শুন,তাড়াতাড়ি ফিরিস।
_ ট্রাই করবো, সবাই একসাথ হচ্ছে তো মা,তাই বুঝোই তো।
আচ্ছা বুঝছি,চাবি নিয়ে যা তাহলে।
দুজন চলে গেলে রেবা বেগম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন,দুজনের মধ্যে কিছুদিনে অনেক মিল হয়েছে ভেবে শান্তি পাচ্ছেন তিনি।

৯.

_আচ্ছা আপনার ফ্রেন্ড রা আমাকে দেখে কি ভাববে?
_কি ভাববে? ড্রাইব করতে করতে জবাব দিলো নাদিব।
_এই যে বলবে, এত সুন্দর,হ্যান্ডসাম,মেয়েদের জাতীয় ক্রাশ, এই ছেলের বউ এটা?
_কেনো বলবে এমন?
_বলবেনা? আমি ত চিপকলি টাইপের।তার উপর ফর্সাও না অতো,আবার মর্ডান ও না।
_তো,এসব বাদে আর সব ঠিকঠাক আছে তো?
মুনা লজ্জা পেয়ে চুপ করে বাইরে তাকিয়ে গেলো।

_মুনা,সুন্দরী, মর্ডান,এসব দেখতেই সুন্দর, এদের সাথে জীবন কাটিয়ে দেয়ার উপযুক্ত রিজন একসময় আর থাকেনা,কারণ তারা সব রুপেই প্রকাশ করে ফেলে।যারা এর বাইরে,তাদের সারাজীবন ধরে জানা যায় আস্তে ধীরে,কারণ তাদের প্রকাশ পরিধি কম।

কথাগুলো মুনার শুনা, অনেকবার শুনেছে সে।আদিব কে যদি জিজ্ঞেস করতো কেন পছন্দ করে তাকে,আদিব এভাবেই বলতো।কিন্তু নাদিব কিভাবে বললো

_আর হ্যাঁ,চিপকলিদের দেখতে ভালোই লাগে,বিশেষ করে যখন তারা শাড়ির ফাকে চিকনা কোমর দেখায়।মুনা হুট করেই নিজের কোমরের দিকে তাকালো, না ঠিক ই আছে,তবে কি এই লোক চুরি করে ওর কোমর দেখে?
_তা কজনের দেখা হয়েছে?
_মানে কি,ঘরে বউ থাকতে বাইরে কেন দেখতে যাবো,মাথা খারাপ নাকি।
মুনা অবাক হওয়ার চূড়ান্ত সীমায় পৌছে গেলো নির্বিকার ভাবে নাদিবের কথা শুনে।আজকাল বেশিই ফাপর নিচ্ছে লোকটা, অথচ সামনাসামনি কিছুই করেনা।

বিশাল রেস্টুরেন্টের প্রায় অর্ধেক দখল করে আছে নাদিবের ফ্রেন্ডসার্কেল।মুনার থেকে কমবয়সী কিছু আধুনিকা মেয়ে ও আছে,ওরা ফ্রেন্ড দের গার্লফ্রেন্ড সম্ভবত। নাদিব মুনার হাত ধরে ভেতরে এলো,সবাই ওদের দিকে তাকিয়ে।এই একটা জিনিস মুনার বেশ পছন্দের,হাত ধরে রাখা।বিয়ের পর থেকে যতবার ই বাইরে গেছে নাদিব সবার সামনেই এভাবে হাত আঁকড়ে রাখে।প্রথম প্রথম মুনার বাড়াবাড়ি লাগতো, এখন ব্যাপারটা অভ্যেস হয়ে গেছে। নাদিব কে যত জানছে ততই রহস্য লাগে,মুনার ব্যক্তিগত পছন্দের কথাগুলো আদিব কে বলতো সে,অথচ নাদিব প্রায় সব ই করছে,ইচ্ছাকৃত বা অজান্তে তা জানেনা মুনা।

সবাই খুব মজার মানুষ, মুনার একবার ও মনে হয়নি এদের সাথে তার প্রথম আড্ডা এটা।সবাই মুনার কাছে নাদিবের প্রসংশায় পঞ্চমুখ।মুনা শুনছে আর দূরে আড্ডা দেয়া আড়চোখে নাদিব কে দেখছে।কি প্রাণখোলা হাসি তার,ভালো লাগে দেখলে।নাদিবের ফ্রেন্ড কিশোর এসে বসলো মুনার সামনে।
_ভাবি,কেমন যাচ্ছে সব দিনকাল?
_এইতো ভাইয়া,চলে যাচ্ছে। আপনার কি খবর,বাসায় যান না কেনো?
_আর বলিয়েন না,জব নিয়ে প্যারায় থাকা লাগে,তার উপর আরেক বাড়তি প্যারা তো আছেই,বলে পেছনে ইশারা করলো কিশোর।মুনা উঁকি দিয়ে দেখলো নাদিব এর সাথে ওর এক মেয়ে ফ্রেন্ড হেসে হেসে আড্ডা দিচ্ছে।
মুনা হেসে বললো, ওনাকে দেখালেন যে?
_ চিনলেন না? আমার ফিউচার ইরা। গত কয়েকবছরে আমারে চেঞ্জ করে এই আধা পারফেক্ট বানাইছে নাকি সে,হাহা
_ওহ আচ্ছা,এভাবে বলবেন না তাহলে।বেশ সুন্দরী কিন্তু আপু।
_তা বেশ,পটাতে খবর হয়ে গেছিলো। সেদিক থেকে নাদিব লাকি।ব্যাটা সোজা কাজ সেরে ফেলে এখন নির্বিগ্নে প্রেম করছে।
মুনা লজ্জা পেলো,
_আপু কি আপনাদের কমন ফ্রেন্ড নাকি,আড্ডা দেখে তাই মনে হচ্ছে।
_হ্যাঁ,এক ব্যাচ জুনিয়র আমাদের,একই ভার্সিটির। প্রথমে তো উনি নাদিবের জন্যই দেওয়ানা হয়ে ঘুরছিলেন, ব্যাটা হুট করে মালেয়শিয়া উড়াল দেয়ায় সুযোগ পায়নি ইরা।পরে আমিই বন্ধুত্ব করি,তারপর এতদূর
মুহূর্তেই মুনার বুক কেপে উঠলো। অজানা আশংকা যেনো সত্যি হয়ে গেলো। অথচ মুনা চায়নি এই সত্যি টা শুনতে।মাথা টা ঘুরতে লাগলো, বুকের ভেতরে কিছু অতীত বর্তমান একসাথে ঘূর্ণিঝড় পাকাচ্ছে।

চোখের সামনে তখনও নাদিব আর ইরা হাসছে।মুনা মাথা ধরে রেখেছে,কিশোর খেয়াল করে বললো,
ভাবি এনি প্রব্লেম?
_মাথা ধরে আছে আসলে।
_ওয়েট আমি ঠান্ডা কিছু এনে দিচ্ছি বলে কিশোর চলে গেলো।
নাদিব খেয়াল করলো, এক্সকিউজ দিয়ে ইরাকে রেখে মুনার পাশে বসলো।
_মুনা,কি হয়েছে তোমার?
মুনা সহ্য করতে পারছেনা এই লোকটাকে। কেন সে এসব ফালতু কেয়ারিং দেখাচ্ছে।
_কাধে হাত দিয়ে আবার বললো, মুনা মাথা ঘুরছে?বলো আমাকে।
আরে ভাবির মাথা ধরেছে এখানকার শব্দে,তাই ঠান্ডা আনলাম।নিন ভাবি আইস্ক্রিম আর কোল্ড ড্রিংস টা এগিয়ে দিলো কিশোর।
_তোকে কে আনতে বলেছে এসব,ওর এলার্জি আছে ঠান্ডায়।
কি বলিস, সত্যি?
_হ্যাঁ নিয়ে যা তুই,আমি দেখি কি করা যায়।
মাথা তুলে মুনা কোল্ডড্রিংকস আর আইস্ক্রিম টা নিয়ে খেতে লাগলো। এখন সমস্যা হবেনা ভাইয়া।
_আরে,তুমি এখন এসব খাচ্ছো কেনো।সারারাত পরে ঘুমাতে পারবানা।গরম কিছু খাবা চলো।
_বললাম তো সমস্যা হবেনা,এত চিন্তা করতে হবেনা।
_বেশি বুঝবানা,উঠো এসব রেখে।একটু পর ই কাশি শুরু হবে,নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হবে।

বাব্বা,এর মধ্যে এতকিছুও জানা হয়ে গেছে জনাবের?
গত তিন বছরে তো কিশোর আমার ফেভারিট কালার টাও ঠিকমতো বলতে পারবেনা।
পেছন থেকে ইরার আওয়াজ শুনে হাসলো মুনা।এই মেয়েকে কি নাদিব ও পছন্দ করতো?আর ঠিক ই তো,নাদিব কি করে জানলো মুনার সমস্যার কথা? এত ডিটেইলসে তো ওর শ্বাশুড়ি ও জানেনা।মাথা খারাপ লাগছে মুনার।

_আমি বাসায় যাবো।
_হ্যাঁ অনেক রাত হলো, আমরা উঠি রে এবার।মা বাসায় একা।
সবার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠলো দুজন।মুনার এমন হুট করে নিস্তব্ধতা নাদিবের বিষন্ন লাগছে।যেদিন থেকে ওরা ফ্রেন্ড হলো সেদিন থেকে মুনাকে এমন আর দেখেনি,তবে আজ আবার আদিবের কথা মনে পড়ছে ওর? পড়াটাই স্বাভাবিক,যখন মনের ভেতর কাউকে ঘিরে ইমারত তৈরি হয়ে যায়, তখন সেটা ভাঙতে ও সময় লাগে।নাদিব চায়না জোর করে সেটা ভাঙতে,আদিবের জায়গা টা সে জোর চালিয়ে নিবে না।

বাসায় ফিরে মায়ের রুমে যেয়ে দেখলো মা ঘুমিয়ে গেছে।মুনা ফিরে এসে চেঞ্জ করে নিলো।নাদিব এর মাঝেই মুনার জন্য কফি বানিয়ে এনে টেবিলে রেখে শুয়ে পড়লো ।এই যে ম্যাম,খেয়ে নিন,নয় একটু পর আর ঘুমাতে হবেনা।
মুনা কিছু না বলে লাইট অফ করে শুয়ে গেলো। আজ এসব কিছুই তার বাড়তি মনে হচ্ছে।মনের ভেতর শুধু নিজেকে অনাহুত লাগছে।নাদিব কি ওকে বাধ্য হয়েই তবে মেনে নিচ্ছে।ঘুম এসে গেলো একটু পরেই।

নাদিবের সবে মাত্র ঘুম ভার হচ্ছিলো তখনি মুনার কাশি শুরু হলো। কিছুক্ষণ কাশির পর হাফাতে লাগলো মুনা। জেদ করে ঠান্ডা খেয়ে এমন ভোগান্তি হচ্ছে এখন।হাপানির সাথে দুচোখ দিয়ে পানি যাচ্ছে,মুনার বুক ভার হয়ে আসছে।নিঃশ্বাস নিতে ভারী লাগছে।উঠে বসে অন্ধকারে দম নেয়ার চেষ্টা করলো।একটু নিজেকে শান্ত রাখলেই ভালো লাগবে।কিন্তু পারছেনা।নাদিব এতক্ষণ চুপচাপ দেখলো সব। রাগ করে জিজ্ঞেস ও করছেনা কিছু। মুনা বারবার হা করে শ্বাস নেয়ার ট্রাই করছে,নাদিব এবার উঠে লাইট অন করে রাগী চোখে তাকিয়ে রইলো। মুনা অপরাধীর মত চুপ করে আছে।কফির মগ টা হাতে নিয়ে কিচেনে চলে গেলো নাদিব।আদা দিয়ে কড়া এক কাপ চা বানিয়ে এনে মুনার হাতে ধরিয়ে দিলো। চুপচাপ গরম গরম খাও।কফি এনে যে রাখলাম,মানুষ মনে হয়নি আমাকে?
– মুনা আস্তে করে বললো, এত উদ্ভিগ্ন হতে হবেনা,মরে যাচ্ছিনা আমি এখনি।
_ওই একদম চুপ।একটা কথাও বলবা না।কে বলেছিলো বাইরে ওসব খেতে,বারবার নিষেধ করেছি, গায়ে লাগেনি?
_খেয়েছি বেশ করেছি,আপনি কে আমাকে চিল্লাচিল্লি করার? কে বলেছে আপনাকে এসব ফর্মালিটি দেখাতে?
_আমি কে? আমি কে মানে কি? বলো কি মিন করছো।
_যা সত্যি তাই,আমি চাইনা আপনি দায়িত্বের খাতিরে এসব করেন।আপনার যা ইচ্ছা তা করুন,চাইলে পুরোনো পছন্দের কাউকে নিয়েও থাকতে পারেন,আমার আপত্তি নেই।
_শাট আপ মুনা।সবাইকে কি নিজের মতই মাপো? তুমিই এসব কিছু দায়িত্বের খাতিরে করছো,মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে।বাস্তবে তো তুমি কখনোই আদিবের জায়গায় আর কাউকে ভাবতেই পারো না।আমি সব জেনে বুঝেও মানিয়ে নিচ্ছি, কারণ আমি আদিব হতে চাইনা।আমি আমিই।

নাদিব সিগারেট এর প্যাকেট নিয়ে বারান্দায় চলে গেলো। মুনা কঠিন কথা গুলো যেগুলো কিছুদিন আগেও তার জীবনের সত্য ছিলো, সেগুলো নাদিবের মুখে শুনে নিথর হয়ে গেলো। সে তো এখন নিজেকে ওসব থেকে সরিয়ে রেখেছিলো,তবে কেন নাদিব মনে করিয়ে দিলো।সে তো জীবন টা কে গুছিয়ে নিচ্ছিলো নাদিব কে বুঝতে চাচ্ছিলো,কই নাদিব তো একবার ও বললো না তার পছন্দের কেউ নেই।

সারারাত নাদিব বারান্দায় ই ছিলো। এরপরের দুদিন বাসায় সব শান্ত। রেবা বেগম হয়তো আন্দাজ করেছেন কিছু কিন্তু তিনি সব ব্যাপারে আসতে চান না।নাদিব দুদিন ধরে খুব বেশি স্মোক করছে।রাত করে বাড়ি ফিরছে,মুনার সাথে খুব প্রয়োজন ছাড়া কথা বলছেনা।সেদিন ওভাবে মুনাকে না বললেও পারতো।কিন্তু মেয়েটা কেন বারবার দায়িত্বের কথা বলে,সে কি দায়িত্ব আর ভালো লাগার ফারাক বুঝেনা?

মুনা ও জেদ ধরে আছে,সে আর নাদিব কে বুঝতে যাবেনা।নিজেকেও কারো জন্য চেঞ্জ করবেনা।এর মাঝেই মুনার ক্লাস শুরু হয়ে গেলো।
নাদিব ঘুমে থাকতেই মুনা রেডি হয়ে বের হয়ে গেলো।

১০.
এই কদিন সুফিয়া বা মায়ের হাতেই নাস্তা পাঠায় মুনা।সে সামনে থাকেনা।নাদিবের বলা কথাগুলো সে আঁকড়ে ধরে আছে।আজ যাওয়ার আগে শ্বাশুড়ি কে নাস্তা বানিয়ে দিয়ে চলে গেলো।
রেবা বেগম চায়ের কাপ নিয়ে টেবিলে রাখলেন।ছেলের পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।
বাবু,আর কত ঘুমাবি? উঠ না এবার।
কত বেলা হলো, দেখ আমি আজ চা বানিয়ে এনেছি।
নাদিব নড়েচড়ে উঠে মায়ের কোলে মাথা দিয়ে বললো, তুমি কেন? তোমার বউ কি করছে?
সব কাজ কি বউ ই করবে? মেয়েটার কি নিজের কাজ নেই? তাছাড়া ওর সামনে পরিক্ষা,আজ জরুরী ক্লাস আছে,ক্যাম্পাসে গেছে সেই সকালেই।
নাদিব উঠে বসলো। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল সকাল সকাল।যতই ঝগ্রা হোক বাসা থেকে বের হতে নাদিব ই সাথে যায়,আর আজ ক্লাসে যাবে ওকেই বলেনি একবার।কি পেয়েছে কি মেয়েটা।এত জেদ কিজন্য তার উপর।সেদিন রাত থেকেই কিরকম অদ্ভুত আচরণ করছে।
_হ্যাঁ রে বাবু,তোদের মাঝে কি ঝগ্রা চলছে? আমাকে বল তো
_আরে না মা।আমাদের তো এসব চলতেই থাকে। বলে ওয়াশরুমে চলে গেল নাদিব।রেবা বেগম কিছুই বলেননি আর।

নাস্তা শেষ করে সিগারেট হাতে বারান্দায় বসলো নাদিব।আকাশ টা ক্রমশ সাদা থেকে কালো মেঘে ঢেকে যাচ্ছে।মুনা ও ঠিক এভাবেই সব ঢেকে দিচ্ছে, তাদের বন্ধুত্ব টাও নেই আর,কথা নেই,হাসি নেই,খুনসুটি নেই ঘর জুড়ে। নাদিবের ভালো লাগেনা কিছুই। মুষলধারে বৃষ্টি নামলো।

সুফিয়া এক বাটি খিচুড়ি হাতে নাদিবের রুমে এলো।
ভাইজান নেন গরম গরম খান।
_এ সময় খিচুড়ি!
_আরে দেখেন কেমন বৃষ্টি, চাচী তাই রান্না করলো।ইশ ভাবী টা নাই,এই বৃষ্টি তে ছাতাও নিলোনা,কেম্নে যে আসবে।
সুফিয়া যাওয়ার পর নাদিব ভাবলো সত্যিই তো খুব বৃষ্টি, মুনার এখনি ক্লাশ শেষ হবার কথা।

তাড়াহুড়ো করে মাকে না বলেই নাদিব গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলো। মুনার ক্যাম্পাসের সামনে এসে গাড়ি পার্ক করে বসে রইলো যাতে মুনা বের হতেই দেখতে পায়।বৃষ্টির জন্য ছাতা নিয়ে বের হলেও ভিজে যাবে। নাদিব ভাবছে,মেয়েটা ইদানীং যা আচারণ করছে,না জানি আজ কেমন রিয়েক্ট করে।সে কি খুশি হবে আমাকে দেখে?

বেশ কিছুক্ষণ পর মুনাকে দেখা গেলো ফ্রেন্ডদের সাথে হেসে হেসে প্রায় আধভেজা হয়ে আসছে।জামার উপর এপ্রোন টা ভিজে সারা। কি প্রাণোচ্ছল দেখাচ্ছে যা এই কদিন দেখেনি নাদিব।মেয়েটা হাসলে সব ভার নেমে যায় বুকের।

নাদিব ছাতা হাতে বেরিয়ে সামনে দাড়ালো। গেটের কাছে আসতেই মুনার ফ্রেন্ড রা নাদিব কে দেখে হাসছে।
_বাহ মুনা,তুই যে বেশ চেপে গেলি তোর হিরো আসবে যে।
_হিরো মানে?
_ওইযে,সে যে দাঁড়িয়ে আছে আপনার জন্য। হ্যান্ডসাম লাগছে খুব।
_চুপ,নজর দিবিনা।
_ওরে কি দরদ ওনার,চল হাতে তুলে দিয়ে আসি তোকে।

কাছাকাছি আসতেই নাদিব এগিয়ে এসে ছাতা মাথায় ধরলো,
_কি ব্যাপার ছাতা রাখোনা কেন ব্যাগে?
মুনা এক পলক তাকালো অবাক হয়ে,না বলে না কয়ে লোকটা হুট করে চলে আসলো কেন। অবশ্য রোমাঞ্চকর লাগছে বেশ,মন্দ না।
_আচ্ছা এবার দুজনে বৃষ্টি বিলাস করুন,আমরা আসি।
_হাহা,আমার সমস্যা নেই,কিন্তু আপনাদের ফ্রেন্ডের বৃষ্টি তে ঠান্ডা লেগে যায়।পরে এই বান্দাকেই ভুগতে হয়।
মুনার ফ্রেন্ড রা হাসি ঠাট্টা করে বিদায় নিলে মুনা গাড়িতে বসলো। নাদিব গাড়ি স্টার্ট দিতেই মুনা পাশ থেকে বললো, আপনি এই বৃষ্টিতে কেন এলেন?
_আসতে পারিনা?
_কেনো,দায়িত্ববোধ? মানুষ কে দেখাতে আপনি কত রেস্পনসিবল?
নাদিব মুচকি হেসে ড্রাইব করতে লাগলো। এসব নিয়ে মুনাকে সে আর বুঝাবে না।মেয়েটা বেশি বুঝে।

_এপ্রোন খুলে পেছনে রাখো,ঠান্ডা লাগবে।
_লাগুক,আপনার কি।
_পেছনে একটা প্যাকেট এ ফুচকা রাখা আছে,পথে নিয়েছিলাম।বাইরে দাঁড়িয়ে তো এ বৃষ্টিতে খাওয়া সম্ভব না।
মুনা খানিক অবাক হলো, লোকটা অদ্ভুত ভাবে তার সব পছন্দ জানে।সব বুঝে,শুধু মুনাকে বুঝতে চায়না।

মুনা প্যাকেট টা নিয়ে আয়েশ করে খাচ্ছিলো আর নাদিব কে দেখছিলো। ভাবলো সাধবে কিনা,কিন্তু সংকোচ লাগছে।হুট করেই মুনা একটা ফুচকা নাদিবের মুখের সামনে ধরলো। নাদিব এক নজর তাকিয়ে দেখলো,মুনার আগ্রহী দৃষ্টি উপেক্ষা করতে না পেরে হা করতেই মুনা নাদিবের মুখে পুরে দিলো।
একটু পরেই মুনা দেখলো নাদিব ঝাল খেতে পারেনা,নাক মুখ লাল হয়ে আছে। মুনা হাসি চেপে বসে রইলো।

খাবার টেবিলে বসতেই রেবা বেগম জিজ্ঞেস করলেন কিরে বাবু, মুনাকে আনতে যাবি কই বলেও তো গেলিনা।
নাদিব লজ্জা পেয়ে গেলো, আরে মা,তুমি রান্না করছিলে তো।
_হুম,তাই? তুই তো ওকে দিয়েও আসতে পারিস।
_না।মা আমি একাই তো যেতে পারি,অসুবিধা হয়না।তুমি ভেবো না।
নাদিব নিরাশ হয়ে মুনার দিকে তাকালো।
_মা,আমি কিছুদিন আমাদের বাড়ি যাবো? ওখান থেকে পরীক্ষা টা দিবো ভাবছি।
_যাবি? বেশ তো যাস।নাদিব নাহয় আসা যাওয়া করে থাকবে।

১১.
মুনা রুমে এসে মাকে কল করলো। ভাইয়ের সাথে কথা বলতেই মিরান বেকে বসলো ভাইয়ার সাথে কথা বলবে।নাদিব মাত্র রুমে আসতেই দেখে মুনা বললো, ভাইয়া নেই এখন।আসলে কথা বলিস।নাদিব হুট করেই মুনার হাত থেকে ফোন নিয়ে কথা বলতে লাগলো।কথা শেষে মুনাকে জিজ্ঞেস করলো,
_তুমি কি চাওনা আমি তোমার সাথে যাই?
_আমার চাওয়া না চাওয়াতে কি?
_চাওনা ক্লিয়ার বললেই পারতে।
_চাইনা বললে বেশ সুবিধে হয় তাইনা,জানি।

নাদিব কিছু না বলে সিগারেট এর প্যাকেট নিতেই মুনা হাত ধরে ফেললো।
_আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি।
_কেনো? তুমি তো সব ই জানো,নিজের মতোই ভেবে নাও না এবার ও।হাত ছাড়িয়ে বারান্দায় এসে সিগারেট ধরালো সে।

মুনার কান্না পাচ্ছে,নাদিবের উপর সে অধিকার কেনো দেখাতে যায় বারবার,লোকটা কিছুই সহজ ভাবে বলেনা।রাগে গজগজ করতে বারান্দায় গিয়েই নাদিবের মুখ থেকে সিগারেট টা ফেলে দিলো।প্যাকেট টা হাতে নিয়ে চলে আসতেই নাদিব হাত ধরে আচমকা টান দিতেই মুনা টাল সামলাতে না পেরে নাদিবের বুকের কাছে এসে পড়লো।
নাদিব নিজেও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো।এম্নিই সে মেয়েটাকে ইগ্নোর করে নিজেকে কন্ট্রোল এর জন্য,আর এখন মেয়েটার ভয়ার্ত চোখ আর নিঃশ্বাসের গরমে গা কাপছে নাদিবের।মুনার কোমর ধরে আছে নাদিবের সে কথা খেয়াল ই নেই।মুনা নাদিবের টিশার্ট খামচে ধরে রাখলো।এক অদ্ভুত মায়ায় বাধছে মেয়েটা,হুটহাট এমন চমকে দেয় যে ভালোবাসা টা ধরা পড়ে যেতে বাধ্য।সেটা হাত পা ছড়িয়ে বিস্তৃত হতে চায় তখন।ডুবে যেতে ইচ্ছে করে নিমেষে। নাদিব চোখ নামিয়ে নরম স্বরে বললো, প্যাকেট টা দাও।
_একদম না,এটা আপনার একার রুম না,আমারো অধিকার আছে সবকিছুতে।এখানে এসব চলবেনা।
_নাদিব মুচকি হেসে বললো _অধিকার খাটাচ্ছোনা কেন তাহলে?
-অধিকার দিচ্ছেন আপনি?
-মুনা,কথা বাড়িও না।
মুনা আরো জোরে খামছে ধরলো নাদিব কে,কি পেয়েছেন আপনি? যা ইচ্ছা করবেন? কদিন ধরেই তো দেখছি এসব।আর কি কি করার বাকি রেখেছেন বলুন তো? নাকি আমার জন্য করতে পারছেন না।
-মুনা..
_চুপ।আপনার সাথে কথা বলতেই চাচ্ছিনা।মুনা রুমে এসে ঘুমিয়ে গেলো।

নাদিব বুঝতেই পারছেনা মুনা বারবার এমন কেন করছে।কি মিন করছে সে বারবার। এভাবে তো চলা যায়না।হুট করেই নাদিবের ফোন বেজে উঠলো, রিসিভ করতেই মনটা আরো খারাপ হয়ে গেলো। তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে গেলো সে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here