তোমাকে চাইবো বলে পর্ব ৮

#তোমাকে_চাইবো_বলে
#পর্ব_৮

মুনা নিঃশব্দে নাদিবের কাছে এগিয়ে মাথা নিচু করে রইলো। কি বলবে সে এখন।এই মানুষ টা কষ্ট পাচ্ছে,এই মানুষ টা তাকে ভালোবাসে,এই মানুষ টাকেই ভালোবাসার জন্যই তো মুনা চেয়েছিলো নিজেকে বদলাতে।অতীত ছেড়ে আসতে পুরোপুরি। যাতে আদিবের ছায়া না আসে নাদিবের উপর।

চারদিক নিস্তব্ধতায় ঘেরা,নাদিবের বুকের উপর মুনার মাথা।হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি ছাড়া এই শহরে এই মুহূর্তে কিছুই নেই। দুহাতে খুব শক্ত করে মুনা নাদিবকে জড়িয়ে আছে।মুনার খোলা চুল বাতাসে এক আধটু নাদিবের মুখে এসে লাগছে।নাদিব শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে,নড়ার শক্তিটুকুন তার নেই।মেয়েটা তাকে এত শক্ত করে ধরেছে,বুকের ভেতরকার কষ্ট গুলো উগ্রে আসতে চাইছে।মুনা টের পেলো নাদিবের চোখের পানি এসে মুনার কপালে পড়ছে।খুব কষ্টে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা চালাচ্ছে নাদিব।নাদিবের প্রতিটি হার্টবিট এসে মুনার বুকে লাগছে । মুনা খুব আস্তে করেই বললো..

“সেদিন আপনার বন্ধুদের সাথে যখন মিট করাতে নিয়ে গেলেন,কিশোর সেদিন বললো আপনাকে ইরার খুব পছন্দ ছিলো। আমি ও দেখলাম আপনারা দুজনে বেশ আড্ডায় মেতে আছেন।আমি কিচ্ছুই ভাবতে পারছিলাম না তারপর আর।মাথায় শুধু এটাই ঘুরেছে আপনি ইরাকে চেয়েছিলেন, আমাকে হয়তো পরিস্থিতির কারণে মানিয়ে নিতে চেয়েছেন। বিয়ের পর থেকে কতহাজার বার চেষ্টা করেছি সমস্ত পিছুটান ভুলে নতুন করে শুরু করতে।কতবার নিজেকে বুঝিয়েছি আদিব নেই,ছিলো না।কিন্তু মন তো মানেনা,কারো মায়া কাটিয়ে ওঠা কি এতই সহজ।তাও আমি চেষ্টা করেছি,আমি চাইনি আদিব এর মিসিং নিয়ে আপনাকে গ্রহণ করতে।তাহলে সেটা নিজেকে ধোকা দেয়া হতো। কিন্তু ইরার কথা আসার পর আমি আর সহ্য করতে পারিনি।মনে হয়েছিলো আমি ততদিনে দুর্বল হয়ে পড়েছি।নিজের মনগড়া চিন্তাটাকেই সত্যি ভেবে সরে থেকেছি।বুঝতেও চাইনি আপনাকে।নিজেও আর এগিয়ে যাইনি।

নাদিব শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে শুনলো।মুনা থামতেই নাদিব মুনাকে ঠেলে সরে আসলো।মুনা অবাক হয়ে গেলো। চোঁখ মুছে জবাব দিলো..

” চিন্তা নেই মুনা।আমি তোমার আদিবের জায়গা টা দখল করতে আসবোনা আর।জোর করে প্লিজ আমাকে ভালো বাসতে এসোনা অন্তত। এটা তোমাকে স্পর্শ করার চাইতেও আরো বেশি অপমানজনক।

মুনা এবার সত্যিই ভয় পেয়ে গেলো। মেয়েদের অভিমান ভাঙানো যতটা কঠিন তার থেকেও কঠিন একটা ছেলের জেদ ভাঙানো। সেখানে ব্যাপার টা অনেক জটিল ই হয়ে গেছে।এই মুহূর্তে নাদিবকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে মুনা যেনো পাথর হয়ে গেলো। এই মানুষ টা যদি সত্যিই এই জেদ টা ধরেই বসে থাকে।তবে?
“মুনা কেঁদে ফেললো জোরেই।
” প্লিজ মুনা কেঁদোনা আর।আমি আর এসব নিয়ে তোমাকে বিরক্ত করবোনা।আমাদের মাঝের এই ব্যাপার গুলা এখানেই শেষ। বাকিটা তোমার ইচ্ছা।আশা করি আর সমস্যা হবেনা এসব নিয়ে।আমি চলে গেলে তুমি তোমার মর্জিমাফিক থেকো।আমাদের বাড়িতে সমস্যা হলে এখানে থেকো।আমি মা কে ম্যানেজ করবো।কিচ্ছু টের পাবেনা এসব।আমি ও সহজে ফিরবোনা সো তোমার জন্য সুবিধাই হবে রিজন দেখানো। সরে আসতে পারবে।

মুনার কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে।কি শুনছে সে এসব।একটা সম্পর্ক এতই সস্তা? চাইলেই সরে আসবে,মানে কি।একটা আঘাত এর ভার বইতে বইতে আরেকটা আঘাত পেতে চলেছে।এই নতুন আঘাত নিয়ে কিভাবে বাঁচবে সে।পাগল হয়েই যাবে। ছেলেদের কাছে সম্পর্ক টা কি এতই সস্তা? মনের মিল হচ্ছেনা ব্যাস ছেড়ে দাও।সময় দিতে চায়না একটু।আমার কথা তো পুরো শুনলোই না নাদিব।তার আগেই এতকিছু ভেবে ফেললো।

মুনা নাদিবের বুকের কাছে গিয়ে টিশার্ট খামচে ধরলো দু হাতে।নাদিবের চোঁখের দিকে তাকিয়ে রইলো। দুজনের চোঁখেই পানি।
“কি পেয়েছেন আপনি? সম্পর্ক টা আপনার একার নয়।আমার ও হক আছে এতে।সব সিদ্ধান্ত আপনি কেনো নিবেন।ভীতু কোথাকার,পালিয়ে বেড়ানোর প্লান তো ভালোই কষেছেন।
“মুনা ছাড়ো।ঘুমাতে হবে।আমি সকালে যাচ্ছি বাসায়,আমাকে সব রেডি করতে হবে গিয়ে।তুমি যদি যাও তৈরি থেকো।
“আমি কোত্থাও যাচ্ছিনা।আমার কথা শুনার ফুরসত ই হলোনা আপনার।বেশ আমিও বলবোনা।ফিরতে চান না তাইনা,ফিরতে হবেনা।যেদিন মনে হবে আমার কথা শুনতে চান, সেদিন ই ফিরবেন,সেদিন ই কথা হবে আপনার সাথে।তার আগে নাহ।

নাদিব হালকা হাসি দিয়ে রুমে এসে শুয়ে পড়লো। পুরো দুনিয়াটাই যেনো উল্টো ঘুরছে তার।কি করছে কি বলছে সব যুক্তিহীন লাগছে বারবার।তবু সহ্য করছে।এত সহজে সে আর মুনার কাছে নিজেকে ছোট করবেনা।

মুনা বারান্দায় বসে বসে কাঁদছে।কি করতো সে আর? লোকটা তো কিছুই বুঝতে চাইলো না,সব কথা শুনলোই না। শুনতেই তো চাইলো না যে,এতদিনে আদিবকে ভুলার সাথে সাথেই নাদিব কে সে ভালো বেসে ফেলেছে। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাঁদতে।সারারাত সেখানেই বসে বসে কেঁদেছে মুনা।মেহেরনূর কয়েকবার খাওয়ার জন্য ডেকেও কোনো সাড়া না পেয়ে চলে গেলেন।মেয়ের চোঁখে তিনি জামাইয়ের জন্য ভয় দেখেছে।মা হলেই এসব টের পাওয়া যায় হয়তো।

সকালে নাদিবের ঘুম ভাঙার আগেই মুনা রুমে এসে বইপত্র গুছিয়ে নিলো।সারারাত মনের সাথে জেদের অনেক লড়াই চলেছে।রাগের বশে যাবেনা বলে দিলেও তার মন সায় দিচ্ছেনা এখানে থাকতে।ওখানে থাকলে অন্তত একটা ভরসা পাবে। সেও দেখতে চায় নাদিব ফিরে কিনা।
যতদিন না ফিরবে সেও কথা বলবেনা।আরো একবার ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিতে চায় সে।এই মুহুর্তে নাদিবকে হাজার বুঝালেও সে বিলিভ করবেনা মুনার কথা। নাদিবের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে কান্না পেয়ে বসলো আবার।রাতে যা করেছে সব এখন বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে।মাঝেমধ্যে এমন হয় কেন,যা করি তা মস্তিষ্ক একসময় নাকোচ করে বসে।যতই যুক্তি যুক্ত মনে হয় করার সময়,পরে মনে হয় সব ই অহেতুক।না পারছে নাদিব কে জাগিয়ে তুলে বলতে,”আমি তোমাকেই ভালোবাসি,আমায় রেখে যেওনা প্লিজ” না পারছে নাদিব কে হারানোর ভয় থেকে সরতে।এ এক অদ্ভুত পীড়াপীড়ি মনের উপর। কান্না চেপে মুনা ফ্রেশ হতে চলে গেলো।

মেহেরনূর মেয়ের চোখ মুখ দেখেই বুঝলেন রাতে কিছু একটা ঘটেছে। তিনি কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না।মুনা মাকে বললো রুমে নাস্তা পাঠাতে মিরান কে দিয়ে।ওরা চলে যাবে এখনি।মেহেরনূর নিজে নাস্তা নিয়ে গিয়ে জামাইকে ডেকে তুললেন।
“এখনি চলে যাবে বাবা?
” হ্যাঁ মা।আমাকে আবার বাসায় গিয়ে সব গোছানো লাগবে।
“হু,মুনাও রেডি হয়ে আছে দেখলাম।মেয়েটা কেমন মনমরা হয়ে আছে কাল বিকেল থেকেই।তুমি একটু তাড়াতাড়ি ফিরিও বাবা।আমার মেয়েটা হয়তো বলেনা অনেক কিছুই,কিন্তু আমি বুঝি সে তোমাকে যেতে দিতে ভয় পাচ্ছে।
নাদিব অবাক হলো মুনা যাবে শুনে।রাতেই তো বললো যাবেনা।তাহলে..
” আসলে মা,আমি ট্রাই করবো ফেরার।কাজের উপর ডিপেন্ড করছে সব।
কোনো মতে শ্বাশুড়ি কে বুঝ দিলো সে।

গাড়িতে একটাও কথা বলেনি দুজনে।বাসায় এসে মায়ের সাথে দেখা করতেই মুনার মনে পড়ে গেলো তার শ্বশুরের কথা।তার উপর আরো একটা দায়িত্ব আছে সে ভুলেই গেছিলো। নিজেদের সমস্যার কারণে নাদিব কেও বলা হয়নি।এই মুহুর্তে বললে নাদিব মোটেই ঠিক থাকবেনা।এক জায়গায় যাচ্ছে এখন আর বলবে না মুনা।রুমে এসে দেখলো নাদিব ব্যাগে সব গুছাচ্ছে।অনেক জামাকাপড় নিচ্ছে।মুনার কলিজা মুছড়ে উঠলো।সত্যি সত্যিই কি নাদিব সহজে ফিরবেনা? মুনার কথাটা মনে হলেই গা কাপিয়ে কান্না আসে, লোকটা কেনো বুঝেনা তাকে।কিভাবে থাকবে দিনের পর দিন এই বদ্ধ ঘরে? খুব তো বলে দিলো কথা বলবেনা,অপেক্ষায় থাকবে।কিন্তু এই অপেক্ষা কি তার এজন্মে ফুরাবে? মুনার মাথাটা ঘুরছে,দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে।নাদিব আড়চোখে দেখেও গুরুত্ব দিলোনা। সে নিজেও জানেনা তাকে কতদিন থাকতে হবে।জেদের বশে তো বললো আর ফিরবেনা।আসলেই কি পারবে এই মেয়েটাকে ছাড়া একলা থাকতে,ভয় টা নাদিবের ও হচ্ছে। চেষ্টা তো করতেই হবে তাকে। কিছু জিনিসের জন্য সাধনা করতে হয়,হাতের কাছে থাকলেও সেটাকে নিজের বলে দাবি করতে অধিকারিত্ব অর্জন করতে হয়।সেই সাধনাই নাহয় চলুক এবার।মুনা যদি এই অনুপস্থিতে ভালোবেসে কখনো একবার ডাকে এই অপেক্ষায় থাকবে সেও।

রেবা বেগম খেয়াল করলো মুনার চুপচাপ থাকা।তিনিও বুঝলেন কিছু হয়েছে।খাবার টেবিলে ছেলেকে ইনিয়ে বিনিয়ে ইঙিত দিলেন যাতে না যায়।লাভ হলোনা।নাদিব কে যেতেই হবে।
একটা বিছানা,ডীম লাইটের নীলাভ আলো,নিরবতা। মুনা একা শুয়ে আছে অনেক্ষণ। নাদিব আসছেনা রুমে।বেলকনিতে বসে বসে সিগারেট টানছে।বেশ কিছুক্ষণ পর এসে সোফায় শুয়ে পড়লো। মুনা জেগেই আছে।আর থাকতে পারলোনা সে,উঠে লাইট জ্বালিয়ে নাদিবের সামনে দাড়ালো।
“কি সমস্যা আপনার,এসব নাটকের মানে কি?
” কি?সব তো ঠিক ই আছে।
“খাটে না শুয়ে এখানে কেন?
” কিছুইনা।পুরুষ জাত তো,নিজের উপর ভরসা করিনা আর।ঘুমাও তুমি।
“কাল তো পালিয়েই যাচ্ছেন,সেটুক কি এনাফ ছিলোনা আমাকে শাস্তি দেয়ার জন্য? ষোলো কলা পূর্ণ করছেন এখানে শুয়ে।
” ঘুমাও মুনা,আমাকে আর্লি রওনা দিতে হবে।
মুনা কিছুই না বলে নাদিবের হাত ধরে টানলো বিছানায় আনতে।নাদিব ছাড়িয়ে নিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো।

মুনা বিছানায় বসে রইলো অনেক্ষণ। একসময় জোরেই কেঁদে উঠলো। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে মুনা,নাদিব এর দু চোখ ভরে আসছে। মুনার কান্না নাদিব কে অশান্ত করে তুলছে।এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে সব নিয়ম ভুল।সব ছেড়ে ছুড়ে মুনাকে আগলে নিতে বুকে। অথচ কেউই জেদের কাছে হার মানছেনা। একসময় মুনা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেলো। নাদিব উঠে মুনার গায়ে কাথা টেনে দিলো। অনিচ্ছাসত্ত্বে ও মুনার কপালে বিদায়ী চুমু দিলো। সে জানেনা মুনা কে আর কখনো এভাবে পাবে কিনা,বা মুনা তার জন্য ভালোবাসা নিয়ে অপেক্ষা করবে কিনা।সব ই অনিশ্চিত।

..
খুব ভোরেই উঠে রেবা বেগম ছেলের জন্য নাস্তা বানাচ্ছেন।মন তার ভীষণ ভার আজ।ছেলেটাকে তিনি আর কাছছাড়া করতে চাননি।স্বামী কে হারিয়েছে, বড় ছেলেকেও একিভাবে হারালেন।নাদিব এখন তার একমাত্র সম্বল।এখনো ছেলের সংসার টা গুছিয়ে উঠা হলোনা।এখনি চলে যাচ্ছে।
মুনা আসতেই হেসে উঠলেন তিনি।কিরে উঠে গেলি যে,মন খারাপ?
“তুমি কেনো এসব করছো,আমাকে দাও।
” থাক না,আজ আমিই করি।তুই বরং নিয়ে যা রুমে।
মুনা কথা না বাড়িয়ে ট্রে হাতে চলে গেলো। নাদিব ও জেগে গেছে।ফ্রেশ হয়ে আসতেই মুনা ট্রে এগিয়ে দিলো।চুপচাপ খেয়ে নিলো নাদিব।কারো মুখে কথা নেই।দম বন্ধ হয়ে আসছে নাদিবের।মুনা যদি একবার ওকে আটকাতো জোর খাটিয়ে,ও সব জরুরী কাজ একবার না ভেবেই ছেড়ে দিয়ে আসতো।কথায় কথায় শুধু কাঁদতেই পারে।কাজের কাজ করেনা।
মুনা ট্রে নিয়ে কিচেনে এসে নিরবে চোখের পানি ফেলল কিছুক্ষণ। মুনার বিশ্বাস ই হচ্ছেনা নাদিব সত্যিই চলে যাচ্ছে।আর কিভাবে সে আটকাতো তাকে? পায়ে পড়ে?
নাদিব বের হওয়ার সময় মুনা সামনে আসেনি। নাদিব চোখ বুলিয়েও দেখতে পেলোনা তাকে।মায়ের সাথে দেখা করেই বেরিয়ে গেলো। নাদিব যাওয়ার পর মুনা দরজা বন্ধ করে ছিলো সারাদিন।একবার ও বের হয়নি।রেবা বেগম কয়েকবার ডাকবে ভেবেও একা ছেড়ে দিলেন।এরকম পরিস্থিতিতে তিনিও ছিলেন একসময়, তাই বুঝেন কষ্টটা কেমন।
সারাদিন মুনা শুয়ে শুয়ে কেঁদেছে, ভীষণ একা লাগছে,বারবার মনে হচ্ছিলো সে ডিপ্রেশনে ভুগছে এখনি।অথচ এই অবস্থা টা আগে কখনোই হয়নি। একসময় কি মনে করে ফোন হাতে নিলো, দেখলো নাদিবের মেসেজ।মুনা যেন শান্তি পেলো, ভাবলো এই বুঝি ও সিদ্ধান্ত বদলেছে।
“আসার সময় একবার ও দেখলাম না তোমায়।ভালো থেকো।”
মুনার গা জ্বলে উঠলো। রাগের মাথায় ফোনটাই আছাড় মারলো। সে চায়না এসব সহানুভূতি। কক্ষনো আর কথা বলবেনা সে।দেখি কেমন থাকে এবার।

সন্ধ্যে নামছে তখন মুনা ফ্রেশ হয়ে বের হলো।লজ্জা লাগছে এখন বের হতে।শ্বাশুড়ি কি না কি ভাবছে।মুনা বের হতেই রেবা বেগম ডাকলেন।
“কিছু খাসনি কেন? মাথা ধরেছে?
” একটু।
“বোস,আমি চা বসিয়েছি।সাথে কিছু খেয়ে নে।তারপর আমি মাথা টিপে দিবো।
” তুমি বসো,আমি আনছি।

মুনা চা এনে শ্বাশুড়ির কোল ঘেষে বসলো। চায়ে চুমুক দিতেই রেবা বেগম বললেন
“কিছু জিনিসের প্রতি আমরা বরাবরই স্বার্থপরতা দেখাই।নিজের কাছে রেখে পচিয়ে ফেলবো কিন্তু কাউকে শেয়ার করবো না।এটাই আমাদের স্বভাব।
মুনা চুপ করে শুনছে।শ্বাশুড়ির অভিজ্ঞতা থেকেই বলছেন তিনি,অমত করার সুযোগ নেই।
” জিনিসটা যখন আমাদের কাছে আছে আমরা তার গুরুত্ব বুঝিনা।ভাবি আরো সময় যাক,আমার ই তো।এই করতে করতেই যে কখন সময় ফুরিয়ে যায় সেটাই বড় মুশকিল।যখন সময়ের টানে জিনিসটা হাতছাড়া হয়ে যায় তখনি বুঝি কি ভীষণ জরুরী ছিলো সেটা। শ্বাশুড়ির গলা ভারি হয়ে আসতেই মুনা খেয়াল করলো কথা গুলো তার সাথে মিলে যাচ্ছে।তবে কি সে খুব বড় ভুল করে ফেললো? এই ভুল কি শুধরানোর নয়?ভয়ে বুক কেঁপে উঠলো মুনার।

“আয় মাথাটা টিপে দিই।
মুনা কাছে এসে বসতেই রেবা বেগম তার মাথা টিপে দিচ্ছে।মুনার চোখ বুজে আসছে।
হঠাৎ মনে হলো এই সুযোগ এ কি একবার তার শ্বশুরের কথা তুলবে? সেটা কি বেশি স্পর্ধা দেখানো হয়ে যাবে? কিন্তু বলতে তো হবেই।
” একটা কথা কথা বললে তুমি খুব রেগে যাবে মা?
“তোর উপর আমি রেগেছিলাম নাকি?
” তুমি শান্ত এটাই আমার ভয় লাগে বেশি।এরা রাগলে সেটা ভয়ানক হয়।
“হু বলেছে তোকে।কি বলবি নির্ভয়ে বল।
” সত্যিটা আমাকে বলবে তো? তবেই বলবো।
“আমার এমন কি সত্যি আছে যা তুই জানিস্না?
” আমার শ্বশুর বেঁচে আছেন তাইনা?
স্তব্ধ হয়ে গেলেন রেবা বেগম।হাত থেমে গেলো। মুনা কিঞ্চিৎ ভয় পেয়ে উঠে যেতে চাইলো।তখনি রেবা মুখ খুললেন।
“হয়তো বেঁচে আছে এখনো। আমি ঠিক জানিনা। কোনো খোজ রাখিনি আমি।প্রয়োজন পড়েনি আমাদের ছেলেদের জন্য বা আমার জন্য তাকে।
” তোমার সাথে শেষ কবে কথা হয়েছিলো?
“সে অনেক বছর হবে।আমার ছেলেদের হয়তো এখন আর সেই সব দুর্দিনের কথা মনেও পড়েনা।মনে পড়ুক তাও আমি চাইনা।
” কিন্তু মা,তোমার ছেলের তো অধিকার আছে তার বাবার সাথে দেখা করার।
“না নেই।কিসের অধিকার? যে মানুষ টার আদর স্নেহ থেকেই বঞ্চিত হয়েছে তার প্রতি আমার ছেলের কোনো টান থাকার কথা নয়।
” টান তো ছিলোই মা।তুমি হয়তো দেখোনি।আর সেই টান থেকেই আদিব তার বাবাকে খুঁজেও পেয়েছিলো একদিন।
রেবা বেগম চমকে উঠলো শুনেই। এ কোন সত্যির মুখোমুখি হতে চলেছে সে আজ।
“আদিব! আদিব খুঁজে পেয়েছে?তুই এসব কি করে জানলি মুনা?আদিব বলেছিলো কই আমাকে তো বলিস নি।
” না মা,আদিব বলার সুযোগ পায়নি।সে তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলো বাবাকে সাথে নিয়ে এসে।তার আগেই তো…
“তবে? বল মুনা।আর কি জানিস তুই,কিভাবে জানিস?
বেশ উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে রেবা বেগমকে।সারা গা ঘামাচ্ছে।
” যতটা তুমি লুকিয়েছিলে সবার কাছে,তার থেকে বেশিই জেনেছি আমি।সেই লোকটা এখন দেশে মা। আমাকে খুঁজে বের করেছে সব বলতে।
“মুনা!
রেবা বেগম কথা বলতে পারছেন্না।শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার।হাপাচ্ছে শুধু।মুনা ভয় পেয়ে গেলো, দৌড়ে গিয়ে ইনহেলার এনে দিলো।
” সরি মা।এসব নিয়ে আমি আর কথাই বলবো না।চলো তুমি শুবে।
“না, বোস এখানে।একটু দম নিতে দে আমাকে।

অনেক্ষণ পর রেবা বেগম শান্ত হলেন।
“কোথায় সে?
” জানিনা। আমার সাথে ক্যাম্পাসের সামনে দেখা হয়।একটা কার্ড দিয়েছে আমাকে।
আদিবের সাথে তার দেখা হয়েছিলো। তার কাছেও তিনি অপরাধ স্বীকার করেছিলেন।

“কার্ড! কেনো?
” উনি একবার তোমার সাথে দেখা করতে চায় শুধু।মাফ চাইতে এসেছে।
“অসম্ভব। যে সত্যিগুলোকে আমি এত বছর আড়ালে রেখেছি সেগুলোর মুখোমুখি আর হতে চাইনা।সে সাহস আমার নেই।
” কিন্তু মা তিনি যা করেছেন তা তোমাদের কথা ভেবেই।এখনো অনুতপ্ত তিনি সেজন্য।একবার দেখা করবে?

“আমি এমন সুখ যাইনি। আমি কখনো ভাবতেও পারিনা যাকে নিয়ে সংসারের ঘুড়ি উড়িয়েছি,সে আমার সুতো কেটে অন্য কোথাও গিয়ে পড়েছে। তুই বুঝবিনা মুনা, এ জ্বালা তুই বুঝবিনা।

মুনা চুপ করে গেলো। সে নিজেও কম জ্বালায় পুড়ছেনা।

কিন্তু একবার যে করেই হোক মায়ের সাথে ভদ্রলোকের দেখা টা করাতেই হবে।সামনাসামনি মনের কথা প্রকাশ না করতে পারার কষ্ট মুনা টের পাচ্ছে কদিনেই।সেক্ষেত্রে ওই দুটো মানুষ তো কতো বছর ধরেই ভুগছে সে কষ্ট।
“মা তুমি প্লিজ একবার ভেবে দেখো।তোমার কথা ভেবেই আমি নাদিব কে জানাই নি কিছু।এরপর তো এমন ও হতে পারে তিনি নাদিবের সাথেই দেখা করলেন,তখন কি নাদিব শকড হবেনা?
” না,আমার ছেলেকে আমি এসব সত্যি এতবছর পর জানাতে চাইনা।তার এত সাহস হয় কিভাবে সে তোর কাছে গেছে। আমাকে কথা বলতে হবে তার সাথে।নাদিব ফেরার আগেই।
“হ্যাঁ মা।আমিও চাই যা ক্ষোভ তা সামনাসামনি বলেই শেষ হোক।আমি চাই তুমি এই কষ্টের ভার নামাও এবার। তুমি বললেই আমি ওনাকে কল করবো,তার আগে না।


প্রায় মাঝরাত।মুনার দুচোখের পাতা এক হচ্ছেনা।জেদের বশে ফোনটাও ভেঙে ফেললো। বারবার মনে হচ্ছে নাদিব যদি একবার কল করতো।মাকে জিজ্ঞেস করতেও সংকোচ হচ্ছে।
মুনা বারান্দায় গিয়ে বসলো। চারদিকে যেনো নাদিবের হাসিটা ভাসছে।কত শত খুনসুটি ভরা মুহূর্ত কেটেছে এখানে একসাথে।মুনার কান্না পাচ্ছে,চিৎকার করে নাদিব কে ডাকতে ইচ্ছে করছে।অন্ধকার রুম টাতে নাদিব নেই,নাদিবের হাসি ঠাট্টা নেই,গম্ভীরতা নেই,যেটুক আছে শুধু হাহাকার। সেটাই যেনো মুনাকে গিলে খেতে চাইছে বড্ড।মুনা ভাবতেই পারেনি এতটা নিঃসঙ্গতা পেয়ে বসবে নাদিব ছাড়া।লোকটা পৌছেছে তো? কবে ফিরবে?আমাকে মিস করছে কি?

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here