তোমাকে চাই পর্ব ৩

#তোমাকে_চাই
#পর্বঃ০৩
#মারিয়া_আক্তার

– কিরে কিছু বলছিস না যে? আমি কি অসভ্যতামি করেছিলাম তোর সাথে?

দীপ্ত ভাইয়ার প্রশ্নের বিপরীতে আমি তার দিকে ফিরে একটা ক্যাবলামার্কা হাসি দেই। মনের মধ্যে চলছে উথালপাথাল ঝড়। এতগুলো মানুষের সামনে না আবার আমার গাল ফাঁটিয়ে ফেলেন কে জানে। কিন্তু আমি আর চড় খেতে চাই না। এমনিতেই কালকে ওনার হাতের দু’দুটো চড় খেয়ে আমার গালের অবস্থা শেষ। ভয়টাকে ভিতরে দমিয়ে রেখে হেসে হেসে বলি,

– আমিতো মজা করছিলাম ভাইয়া। তুমি কি না কি ভাবছো। হে হে। তোমার মত ভালোমানুষ আছে বুঝি বাংলাদেশে? তাই না বলো আদিদ ভাইয়া?

সবার দিকে তাকিয়ে দেখি সবাই মুখে হাত দিয়ে হাসতেছে। আর পুষ্পিটা আমায় হাত দিয়ে ইশারা করে দেখায় আজতো তু গায়া।এমনিতেই ভয়ে আমার কলিজা কাঁপছে তার মধ্যে পাঁজি মেয়েটা আমায় আরো ভয় দেখাচ্ছে। আদিদ ভাইয়াকে চোখ দিয়ে ইশারা করলাম আমাকে বাঁচানোর জন্য। তিনি আমার ইশারা বুঝতে পেরে দীপ্ত ভাইয়ার কাছে গিয়ে ওনাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলেন,

– ও তো এটা মজা করে বলেছে ইয়ার। তুই এসব নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছিস কেন? ছোট মানুষ ভুল করে বলে ফেলেছে কিছু মনে করিস না ওর কথায়।

এসব বলতে বলতে ওনাকে যেখানে স্টেজ সাজাচ্ছে সেখানে নিয়ে যাচ্ছেন। আমি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। একবার দীপ্ত ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখি উনি উল্টো দিকে হাটলেও আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। ওনার চোখগুলো বলছে তোকে পরে দেখে নিচ্ছি। আমি বুঝে গেছি এখন না পারলেও উনি পরে এটার শোধ নিবেন।

_________________________

দীপ্ত ভাইয়াদের ড্রয়িংরুমের এককোণে অসহায়ের মত বসে আছি। সবাই কত খুশি কত হাসাহাসি করছে সবাই কিন্তু আমি হাসছি না। হাসবো কি করে দীপ্ত ভাইয়া ওনার জন্মদিন উপলক্ষে সবার জন্য শপিং করে এনেছেন। যে যা চেয়েছে তাই এনেছেন। ছেলেদের সবার জন্য নেভিব্লু কালার পাঞ্জাবি আর সাদা পাজামা। মেয়েদের সবার জন্য সাদা আর নেভিব্লু কম্বিনেশনের গাউন। ওনার পছন্দ জাস্ট ফাটাফাটি। উনি যেটা পছন্দ করবেন। সেটা সবার পছন্দ হতে বাধ্য। আর এখানের জামাকাপড়গুলো অনেক এক্সপেন্সিভ মনে হচ্ছে। সে যাই হোক আসল কথা হলো উনি সবার জন্য কিনলেন এবং তাদেরকে সব দিয়েও দিলেন। কিন্তু আমার জন্য কিনলেন না। এমনকি আমার দিকে ফিরেও তাকালেন না। আমার খুব খারাপ লাগছে ব্যাপারটাতে। এমনটা নয় যে ড্রেস পাইনি বলে আমার খারাপ লাগছে। মূলত আমার খারাপ লাগছে এই কারণে উনি সবাইকে ড্রেস কিনে দিলেন আমাকে দিলেন না। এর মানেতো এই দাঁড়ায় উনি আমায় তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলেন। আজকে কেন যেন চোখ ফেঁটে কান্না আসছে আমার। চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে।নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টায় আছি। মোবাইলটা টিপতে শুরু করলাম। যাতে কেউ না দেখে আমার চোখের পানি। সবাই বুঝতে পারলে ব্যাপারটা খুব বিশ্রী হবে আমার জন্য। হঠাৎ করে আদিদ ভাইয়া বলে উঠলেন,

– কিরে দীপ্ত তুই সবার জন্য শপিং করলি। মৌ-এর টা কই?

আদিদ ভাইয়ার কথায়ও আমি মাথা তুলে তাকাইনি। কারণ তাদের দিকে তাকালেই আমি কান্না করে দিবো।

– ওর জন্য আবার কিসের শপিং? ওর জন্য আমি শপিং করবো ভাবলি কি করে?

দীপ্ত ভাইয়ার কথার বিপরীতে কিছু বলবো ভাবছিলাম। কিন্তু নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে আমি সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। এখন ওনাকে কিছু বলতে যাওয়া মানেই নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা। এখন কথা বলতে গেলেই আমার হিচকি উঠে যাবে। তাই আমি বড়বড় পা ফেলে ওনাদের ড্রয়িংরুম ত্যাগ করলাম। পিছনে না তাকালেও আমি জানি সবাই আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তাতে আমার কি আমি এখন আমার রুমে গিয়ে অনেক্ষণ কাঁদবো। কাঁদলে হালকা হবো। তার আগে আমি হালকা হবো না। মাঝে মাঝে আমি নিজেই এটা ভেবে অবাক হয়ে যাই। আমি এতটা ছিঁচকাঁদুনে কেন। কেউ কিছু বলতে না বলতেই কান্না করে দেই কেন?

_______________________

কান্না করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতেই পারিনি। ওমা ঘুম থেকে উঠে দেখি সকাল ৯টা। কালকে দীপ্ত ভাইয়াদের বাড়ি থেকে রাগ করে চলে এসেছিলাম যখন, তখন সন্ধ্যা ৮:৩০ ছিল। এতটা সময় ধরে আমি ঘুমিয়ে ছিলাম বুঝতেই পারি নি। তারমানে কালকে রাতে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সে যাই হোক আমায় এখন ফ্রেশ হতে হবে। বিছানার বামদিকে তাকিয়ে দেখি আমার মাথার কাছে একটা শপিং ব্যাগ রাখা। কৌতুহলবশত সেটা খুলে দেখি এটার মধ্যে সাদা আর কালোর কম্বিনেশনে একটা গাউন। অনেক সুন্দর গাউনটা। সাদা আর কালো এই দুইটা কালার আমার ভীষণ প্রিয়। তাই গাউনটা উল্টেপাল্টে দেখছিলাম। হঠাৎ মাথায় আসলো এটা এখানে কে রাখলো? বুঝেও গেলাম এটা দীপ্ত ভাইয়ার কাজ। মাথাটা হঠাৎ গরম হয়ে গেল। কালকে এভাবে সবার সামনে অপমান করে আজকে আদিখ্যেতা দেখাতে এসেছে। টাকার গরম দেখাতে এসেছে। আমার বাবার মনে হয় টাকা নেই। ওনার টাকায় কেনা জিনিস পরবো না। রাগে দুঃখে ব্যাগ সমেত গাউনটা ফ্লোরে ছুঁড়ে মারলাম। তারপর বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালাম। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি দীপ্ত ভাইয়া গাউনটা হাতে নিয়ে আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। বুঝতে পারলাম উনি খুব ক্ষেপে আছেন। কিন্তু আমার আজকে ওনাকে ভয় লাগছে না। কেন যেন খুব রাগ লাগছে ওনাকে দেখে। আমি ওনাকে এড়িয়ে ওয়াশরুমে ঢুকতে গেলে উনি এসে একহাতে আমায় টান মেরে ওনার কাছে নিয়ে আসেন। দাঁতে দাঁত চেপে বলেন,

– তোর সাহস কি করে হলো এটা ছুঁড়ে মারার?

– এটা আমার রুমে ছিল। আর আমার রুমে আমি কি করবো আর কি না করবো সেসবের জন্য বুঝি আপনার কাছে আমায় অনুমতি নিতে হবে?

– হ্যাঁ আমার কাছে অনুমতি নিতে হবে তোর। তুই এটা ছুঁড়ে ফেলেছিস কেন?

– আচ্ছা সেসব ছাড়ুন। আগে বলুন আপনি কি জানেন এটা এখানে কে রেখেছে? আসলে আমি বুঝতে পারছি না এটা আসলে কে রাখলো।

জেনেও না জানার ভান করে ওনাকে ভ্রুঁ কুঁচকে প্রশ্ন করলে উনি আমায় ছেড়ে অন্যদিকে ফিরে তাকান। তারপর আবার আমার দিকে তাকিয়ে বলেন,

– আমি এনেছি এটা। তুই এটা আজকের অনুষ্ঠানে পরবি।

ওনার কথা শেষ না হতেই আমি জোরে হেসে দেই। উনি আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।

– আপনি না কালকে বলছিলেন। আমার জন্য আপনি শপিং করবেন, এটা ভাববার মতও না। তাহলে আজ আপনার কি হলো? শরীর খারাপ নাকি। জ্বর এসছে বুঝি?

– থাপড়িয়ে তোর গালের দাঁত ফেলে দিবো আমি। আমার সঙ্গে মশকরা করছিস তুই? তোকে যখন বলেছি এটা তুই পরবি। তারমানে তুই আজকে এটাই পরবি। এই আমার শেষ কথা।

ওনার ধমকে আমার সব হাওয়া ফুঁশ। এতক্ষণ সিংহীর মত কথা বলছিলাম। আর এখন ভিজা বিড়াল হয়ে গেলাম। মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে কিছু বলতে নিলেই উনি আমায় থামিয়ে দিয়ে আমার হাতে ব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে রুম ত্যাগ করলেন। আর আমি গাউনটার দিকে তাকিয়ে আছি। আমি কি এটা পরবো। উঁহু আজ এটা আমি পরবো না। এই প্রথম আমি দীপ্ত ভাইয়ার অবাধ্য হবো। দেখবো উনি কি করেন।

_________________________

সবদিকে লাইটিংয়ের আলোয় চোখ ঝলসে যাওয়ার উপক্রম। বেলুন ফুল দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে দীপ্ত ভাইয়াদের বাড়ির ছাদটা।আমার আগে সবাই চলে এসেছে।দেরি করলাম আমিই। সবাই খুব সুন্দর করে সেজেছে। একমাত্র আমি ছাড়া। চারদিকে খুঁজে দীপ্ত ভাইয়াকে কোথাও ফেলাম না। ছাদের পশ্চিমদিকে তাকিয়ে দেখি আমার কাজিনরা সব সেখানে। তাই আমি ওদের কাছে ছুটলাম।

– এই ফকিন্নি কেগো?

পুষ্পির কথায় আমার মেজাজটা বিগড়ে গেল। ও আমাকে ফকিন্নি বলছে।আমি কিছু বলতে যাওয়ার আগেই পুষ্পি আবার বলে ওঠে,

– বুঝলাম দীপ্ত ভাইয়া তোর জন্য শপিং করেনি। তারমানে এই না যে আমার বাবা তোকে জামাকাপড় কিনে দেয়না। এই ফকিন্নির মত থ্রি-পিছটা পরে কি প্রমাণ করতে চাইছিস,আমার বাবা তোকে কখনো কিছু কিনে দেয়না?

আমি নিজের ড্রেসটার দিকে তাকালাম। খারাপ কি বুঝলাম না। একটা থ্রি-পিছ পরে এসেছি। তবে একদম নতুনও না। আগে দুই একবার পরেছি। তারজন্য পুষ্পি আমাকে ফকিন্নি বলছে। আমি রেগে ওর কানটা টেনে ধরে বললাম,

– খুব পেঁকেছিস না? বড়বোনকে ফকিন্নি বলা হচ্ছে। আজ তোর একদন কি আমার একদিন।

– দীপ্ত ভাইয়া?

পুষ্পির কথায় আমি কানটা ছেড়ে দিয়ে পিছনে ফিরে তাকাই। দেখি দীপ্ত ভাইয়া কেন তার টিকিও এখানে নেই। তারমানে এই মেয়েটা আমায় বোকা বানিয়েছে? বড়ফুফু সবাইকে ডাকাডাকি শুরু করে দিলেন এরমধ্যে। তাই সবাই স্টেজের কাছে চলে গেলাম। সেখানে গিয়েও দীপ্ত ভাইয়াকে দেখলাম না।

– আদিদ! দীপ্ত কোথায়?

– আমি জানি না ফুফু। দাঁড়াও দেখছি।

হঠাৎ কোথা থেকে যেন দীপ্ত ভাইয়া আসলেন। সঙ্গে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। ওদেরকে আমি চিনি ছেলেটা শান ভাইয়া আর মেয়েটা দিশা আপু। ওরা দীপ্ত ভাইয়া আর আদিদ ভাইয়ার ফ্রেন্ড। তারমানে দীপ্ত ভাইয়া ওদের আনতেই গেছিলেন। সেজন্যই এতক্ষণ ওনাকে দেখলাম না। দিশা আপু শান ভাইয়া সবার সাথে কুশল বিনিময় করলেন। শান ভাইয়া সম্পর্কে এটুকুই বলা যায় উনি হলেন প্লেবয়। উনি টিস্যুর মত গার্লফ্রেন্ড বদলান। আর আমার অন্যান্য কাজিনদের দেখলে উনি ফ্লার্ট করা শুরু করে দেন।তবে আমার সাথে কখনো ফ্লার্ট করেন না। আমার সাথে খুব নম্র ভাষায় কথা বলেন উনি। ব্যাপারটা আমায় খুব ভাবায়। আর দিশা আপু উনি দীপ্ত ভাইয়ার মতই খুব মেধাবী। ওনার বাবা নামকরা আইনজীবী। দিশা আপু দীপ্ত ভাইয়ার বেস্টফ্রেন্ড হলেও সবার কাছে দীপ্ত ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড বলে পরিচয় দেন নিজের। ওনার দিকে তাকিয়ে এসব ভাবতেই ভাবতেই দীপ্ত ভাইয়ার দিকে নজর দিলাম। ওনার পরনে একটা কালো পাঞ্জাবি আর সাদা প্যান্ট। ফর্সা শরীরে কালো পাঞ্জাবিটা খুব মানিয়েছে। তবে আমি কিন্তু আমাদের ফ্যামিলির সবার থেকে বেশি ফর্সা। এর জন্য সবাই আমাকে উইফোঁকা বলে ডাকে। উইফোঁকার পাখনাগুলো সাদা বলে আমাকেও ওরা উইফোঁকা বলে ডাকে মাঝেমাঝে। এর মধ্যে বড়ফুফু দীপ্ত ভাইয়াকে ডাকলেন কেক কাঁটার জন্য। উনি এগিয়ে গেলে সবাই সাথে যায়। আমিও ওনাদের পিছুপিছু গিয়ে একটা সাইডে গিয়ে দাঁড়াই।এরমধ্যে একটা জিনিস খেয়াল করলাম দীপ্ত ভাইয়া একবারের জন্যও আমার দিকে তাকালেন না। না তাকালে না তাকাক আমার কি? দীপ্ত ভাইয়া কেক কেঁটে একেএকে সবাইকে খাওয়ালেন। বড় থেকে শুরু ছোট সবাইকে। শুধুমাত্র আমাকে ছাড়া। খুব লজ্জা লাগছিল আমার এখানে থাকতে। সবাই আনন্দ মজায় ব্যস্ত থাকায় এই ব্যাপারটা কেউ খেয়াল করেনি। তাই আমি হাফ ছেড়ে একটু দূরে গিয়ে ছাদের রেলিং ধরে আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়াই।

– আমাকে এভাবে না পোড়ালে তোর চলে না তাই না?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here