তোমাকে চাই পর্ব ৭

#তোমাকে_চাই
#পর্বঃ০৭
#মারিয়া_আক্তার

সকাল থেকে মাথাটা ভীষণ ধরেছে। আম্মু মলম লাগিয়ে দিয়েছিল তাও কমছে না। তাই আমি বড়ফুফুর বাসায় যাচ্ছি। বড়ফুফু খুব সুন্দর করে মাথা ম্যাসাজ করতে পারে।তাই আমি ভাবলাম বড়ফুফুর কাছে যাই। আমাদের বাসা আর বড়ফুফুদের বাসা একমিনিটের রাস্তা। চলে আসলাম বড়ফুফুর বাসায়। ওনাদের ফ্ল্যাটটা পাঁচতলায়।পাঁচতলার এই বাড়িটা বড়ফুফা আমার জন্মের প্রায় একবছর আগে কিনেছেন। তখন দীপ্ত ভাইয়ার বয়স ছিল তিন বছর। বাকি চারতলা ভাড়া দেওয়া। সিঁড়ি ভেঙ্গেভেঙ্গে এখন পাঁচতলায় উঠতে হবে। দীপ্ত ভাইয়াদের বাসায় লিফট নেই তাই। বাসায় গিয়েই একনাগাড়ে কলিংবেল বাজানো শুরু করলাম। আমার এই এক বদঅভ্যাস কলিংবেল বাজানো শুরু করলে আর থামাথামির নাম নেই না। কলিংবেল বাজানোর মধ্যেই কেউ থরাস করে দরজাটা খুলে ফেলল। দরজার সামনে দীপ্ত ভাইয়ার ছোটভাই রিক্ত বুকে দু’হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটা ভীষণ পাঁকা একদম পুষ্পির জেরক্স কপি।

– ম্যানার্স নেই নাকি তোমার মৌ আপু? এভাবে অভদ্রের মত সেই কখন থেকে কলিংবেল বাজিয়েই চলেছো। বলি ভদ্রতা কি শিখোনি?

এমনিতেই মাথা ধরে আছে তারমধ্যে এই ছেলের কথা শুনে মাথাটা যেন আরো ধরে গেল। আমি বিরক্তি নিয়ে রিক্তকে বললাম,

– আজাইরা ঘ্যানঘ্যান করিস নাতো রিক্ত। ভালো লাগছে না এমনিতেই। ফুফু কোথায়রে?

রিক্ত আমাকে কিছুক্ষণ ভালোকরে পর্যবেক্ষণ করে বললো,

– তুমি কি অসুস্থ আপু?

– হুম। মাথাব্যথা করছে।

– ওহ। আগে বলবেতো। আচ্ছা ভিতরে যাও আম্মু ভাইয়ার রুমে আছে।

– আচ্ছা।

আমি হাটতে হাটতে দীপ্ত ভাইয়ার রুমের সামনে আসলাম। উঁকি দিয়ে দেখলাম দীপ্ত ভাইয়া আর ফুফু কি নিয়ে যেন কথা বলছে। তাই ভিতরে যাবো কি যাবো না তা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছিলাম। একবার ভাবলাম ভিতরে ঢুকবো পরে ভাবলাম না থাক ওনারা কথা বলুক আমি বরং ফুফুর রুমে গিয়ে বসি।

– তোর আর মৌ এর ব্যাপারটা নিয়ে এখন কি ভাবলি?

ফুফুর রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়েছিলাম কিন্তু ফুফুর উক্ত কথাটা শুনে আমার পা থেমে গেল। আমাকে আর দীপ্ত ভাইয়াকে নিয়ে কি কথা থাকতে পারে। তাই কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। জানি লুকিয়ে লুকিয়ে কারো কথা শোনা উচিৎ না কিন্তু এখানে আমার কথা হচ্ছে বলে দাঁড়াতেই হলো।

– আমি আর কি বলবো? তুমি মামা আর মামির সাথে কথা বলো।মামার যা শর্ত ছিল তাতো পূরণ হয়েই গেছে। এখন আমি ভালো জব করছি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছি। এখনতো আর তার আপত্তি থাকার কথা না তাই না।

– আচ্ছা আমি ভাইয়ার সাথে কথা বলবো তোর আর মৌ এর বিয়ের ব্যাপারে।

ফুফুর কথাটা শোনা মাত্র যেন আমার শরীরটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো। আমার আর দীপ্ত ভাইয়ার বিয়ে? মানেটা কি? কি বলতে চাচ্ছে ফুফু। আর ফুফু আব্বুর সাথেই বা কি ব্যাপারে কথা বলবে? আর শুনে যতটুকু মনে হলো দীপ্ত ভাইয়া আর ফুফু এ সম্পর্কে আগে থেকেই অবগত।

– আচ্ছা তুই ঘুমা এখন। সারাদিন অফিস করে এসেছিস এখন একটু রেস্ট নে। আমি লাঞ্চের সময় তোকে ডেকে নেবো। আর আমার বৌ-মার চিন্তা এখন এত বেশি করতে হবে না। সব চিন্তা ছেড়ে আগে একটু ঘুমা।

– আম্মু লাইটটা অফ করে দিয়ে যাও।

– আচ্ছা।

ফুফু আসছে দেখেও আমি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এমন মনে হচ্ছে আমার পা যেন ফ্লোরের সাথে কেউ সুপার গ্লু দিয়ে আটকে রেখেছে।ওনাদের কথোপকথন শুনে আমার মাথাব্যথা যেন উধাও হয়ে গেছে।

– মৌ? তুই?তুই এখানে?

ফুফু হাসতে হাসতে আসছিলেন। দরজার সামনে হঠাৎ আমায় দেখে চমকে যান। আমিও কি বলবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না।

– আআমি মমানে আমি।

আসলে আমি ঠিক কি বলবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমায় আমতাআমতা করতে দেখে ফুফু বললেন,

– কি বলছিস তুই এসব? আর কখন এলি এখানে?

– আমিতো একটু আগে এসেছি ফুফু। মাথাটা ভীষণ ব্যথা করছে। তুমি একটু ম্যাসাজ করে দিওতো।

কোনোরকমে কথাটুকু বললাম। ফুফু মৃদু হেসে একবার দীপ্ত ভাইয়ার দিকে তাকালেন। ফুফুর দৃষ্টি অনুসরণ করে আমিও তাকালাম। দীপ্ত ভাইয়াকে মাত্র দেখলাম শুয়ে পড়েছিলেন কিন্তু এখন তিনি খাটের উপর উঠে বসে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। ফুফু তা দেখে আমাকে বললেন,

– আচ্ছা তুই আয় আমার রুমে। বাথরুমে আমার কাপড় কেচে রেখেছিলাম সেগুলোই একটু ছাদে মেলে দিয়ে আসি। এসেই তোর মাথা ম্যাসাজ করে দিবো।

ফুফি তৎক্ষণাৎ জায়গা ত্যাগ করলেন। আমি একবার ফুফুর যাওয়ার দিকেতো একবার দীপ্ত ভাইয়ার দিকে তাকাচ্ছি।

– ভিতরে আয়।

দীপ্ত ভাইয়া আমায় ভিতরে যেতে বলছেন কেন? কিছু বলবেন নাকি। আমি গুটিগুটি পায়ে রুমের মধ্যে প্রবেশ করি।

– আমি জানি তুই আমার আর আম্মুর কথাগুলো শুনেছিস।

আমি দীপ্ত ভাইয়ার কথার বিপরীতে কিছুই বললাম না। উনি মৃদু হেসে বলেন,

– কিরে তোর কি কিছুই বলার নেই।

– বলার মত তো অনেক কিছুই আছে। কিন্তু সেসবের উত্তর কি আপনি দিবেন?

– কেন দেবো না। বলে দেখ একবার।

এবার আমি সোজাসাপ্টাভাবে বললাম,

– ফুফু আপনার আর আমার বিয়ের ব্যাপারে কি যেন একটা বললো?

– শুনতে চাস সব? চল ছাদে যাই।

– হুম চলুন।

_____________________

– আমার বয়স যখন তিন বছর তখন আব্বুর কুমিল্লা থেকে ঢাকায় পোস্টিং হয়। আর সৌভাগ্যবশত আব্বুর পোস্টিং এরিয়াতেই ছোট মামার বাড়ি ছিল। অর্থাৎ তোদের বাড়িটা। তাই আব্বু ছোটমামার সাথে আলোচনা করে তোদের বাড়ির পাশেই আমাদের বাড়িটা কিনে। সেদিন থেকেই তোদের বাসাতে আমার আসা-যাওয়া চলতো। বলতে গেলে তোদের বাসাতেই আমি বেশি থাকতাম। ছোট মামি আমায় খুব আদর করতো।ছোটমামা আর ছোটমামি ছিলেন সমবয়সী। আম্মুর থেকে ছোটমামি কিছু বছরের বড় হবেন। ছোটমামির বিয়ের ছ’বছরেও বাচ্চা হয়নি বলে উনি সবসময় আফসেট থাকতেন। তাই আমায় পেলে উনি খুব খুশি হতেন। তোর মাঝেমাঝে মনে হতো না ছোটমামি কেন আমায় এতটা ভালোবাসেন? আসলে তার কারণটা হল উনি ছোটবেলা থেকেই আমায় খুব আদর করতেন। আর তোরতো এটাও মনে হত ছোটমামি হয়তো তোর চেয়ে আমায় বেশি ভালোবাসেন না তাইনা? আর এটা নিয়ে তোর মাঝেমাঝে মন খারাপও হতো আমি জানি এটা। যদি এসব ভেবে থাকিস তাহলে আমি বলবো তুই সম্পূর্ণ ভুল। কারণ একজন মা অন্যকারো আগে নিজের সন্তানকেই বেশি ভালোবাসবে। হয়তো ছোটমামি নিজের ভালোবাসা প্রকাশে ব্যর্থ।

দীপ্ত ভাইয়ার কথার মাঝখানে আমি বলে উঠলাম,

– আমি জানি সেটা। আর আমি কখনো এটা ভাবি নি আম্মু আমার চেয়ে আপনায় বেশি ভালোবাসে। কিন্তু আম্মু আমার কথার চেয়ে আপনার কথাকে সবসময় কেন বেশি প্রায়োরিটি দেন।

– কারণ ছোটমামি আমায় অনেক বেশি বিশ্বাস করেন। আর উনি মনে করেন আমি তোর ব্যাপারে তোর চেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত নিতে পারবো। আচ্ছা আসল কথাতে আসা যাক। একদিন বিকেলবেলা আমি প্রতিদিনের ন্যায় সেদিনও ছোটমামির কাছে গেলাম। গিয়ে দেখি ছোটমামি বসে বসে কান্না করছে। আমি অবাক হয়ে গেলাম। ছোটমামিকে কান্না করতে দেখে আমিও নাকি কান্না করে দিয়েছিলাম। আমার বয়স তখন চার হবে। আমি গুটিঁগুঁটি পায়ে মামির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম- ‘তোমার কি হয়েছে মামি? তুমি কান্না কেন করছো?তোমার কোথায় কষ্ট হচ্ছে?’ সেদিন ছোটমামি আমায় জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, – দীপ্ত বাবা আমি না আজকে খুব খুশি। এতটা খুশি হয়েছি যে তাতে কান্না চলে আসলো। ‘ আমি ছোটমামির কথা বুঝতে না পেরে তারদিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। আমার ছোটমাথায় এটা ঢুকলো না কেউ খুশি হলে বুঝি কান্না করে।

– এত আগের কথা আপনার মনে আছে কিভাবে? আর তখনতো আপনি নিজেও ছোট ছিলেন।

উনি মৃদু হেসে বলেন,

– অনেক কথা আম্মুর কাছে শোনা। আবার অনেককিছু নিজেরই মনে আছে। এসব কেউ ভুলে নাকি।

– জানতে চাস না কেন কোন খুশিতে মামি কান্না করেছিল?

– হ্যাঁ। বলুন।

– সেদিন মামি জানতে পেরেছিল বিয়ের সাত বছর পরে তিনি মা হবেন। অর্থাৎ তখন তুই মামির গর্ভে ছিলি।

– তারপর?

– মামি সেদিন আমায় কাছে টেনে বলেন-‘ জানো দীপ্ত বাবা আমার এখানে (পেট দেখিয়ে) একটা বাবু আছে’।মামির কন্ঠে সেদিন উপচে পড়া খুশি ছিল। সেদিন আমিও খুব খুশি ছিলাম। মামির পেটে আমি আমার ছোট্ট হাত বুলিয়েছিলাম। সেদিনের পর থেকে আমি মামির কাছে আরো বেশি থাকতাম। একদিনতো মামির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম-‘মামি তোমার পেটটা এত বড় হচ্ছে কেন’?মামি মুচকি হেসে বলেন-‘ তুমিতো জানো এখানে একটা বাবু আছে। সে যে একটু একটু করে বড় হচ্ছে তাই আমার পেটটা বড় হচ্ছে’। আমি তখন মামির সাথে আরো একটু ঘেঁষে বলি- ‘এই বাবুটা আমায় দেবে মামি’?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here