তোমাকে শুধু তোমাকে চাই
সপ্তদশ পর্ব
মুনিরের খুব ব্যস্ততার মধ্যেই দিন কাটছে। দুটো ইউনিভার্সিটি থেকে জব ইন্টারভিউ এর জন্য কল এসেছে, এবং দুটোই এই সপ্তাহের মধ্যেই। এছাড়াও কেনাকাটা তো আছেই।এত ব্যস্ততার মধ্যেও মুনির ঠিক মনে করে অনিমাকে ফোন করে কিন্তু অনিমা ও দারুণ ব্যস্ত। মুনিরই অবশ্য বলেছে সব কাজ গুছিয়ে রাখতে। রাত সাড়ে দশটার দিকে মুনির ফোন দিলI অনিমার পাসপোর্ট আছে কিনা জানাটা খুব জরুরি। ভিসার জন্য এপ্লাই করে ফেলতে হবে। মুনিরের খুব ইচ্ছা বিয়ের পর দার্জিলিং যাবে। দুজন একসঙ্গে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখবে। পাসপোর্ট না থাকলে অবশ্য একটু সমস্যা হয়ে যাবে। এই মুহূর্তে পাসপোর্ট তৈরি করতে গেলে বেশ খানিকটা সময় নষ্ট হয়ে যাবে। অবশ্য সে ক্ষেত্রে অন্য কোথাও যাওয়া যায়I দেশের মধ্যে কোথাও। বান্দরবান কিংবা সিলেট। কথা বলে দেখতে হবেI অনিমার কোনটা পছন্দ। তিনবার ফোন করার পরও যখন ধরল না তখন মুনিরের মনে পড়ল পরদিন সকাল আটটায় ওর ক্লাস। বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। মুনির আর বিরক্ত করলো না। একটা মেসেজ পাঠিয়ে দিল।
অনিমা ফোনটা হাতে নিয়ে বসে ছিল। ইচ্ছে করে ধরে নি। মুনির নিয়মিতই ফোন দেয়। বেশিরভাগ সময় অনিমা ধরে না। ফোন না ধরলে ও মেসেজ পাঠায়। বেশিরভাগই থাকে কবিতা। খুব কবি হয়েছে আজকাল। এই যেমন এখন পাঠালো। লিখেছে
“মেঘের মতো ভার হয়ে রয় বুক,
মেঘের মতো থমথমে কী ব্যথা!
মেঘতো তবু বৃষ্টি হয়ে ঝরে,
আমার কেবল জমছে ব্যাকুলতা।”
দুদিন ধরে অনেক ভেবেছে অনিমা। অন্য কাউকে বিয়ে করা ওর পক্ষে সম্ভব না। সেই সাত বছর আগে যখন বাড়ি ফিরে গিয়েছিল তখন ধরেই নিয়েছিল মুনির ওর জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। এমন কি ফিরে আসার পরও ও ভেবেছিল হয়তো মুনিরের সঙ্গে নীলার বিয়ে হয়ে গেছে । ওর জীবনের প্রথম ভালোবাসা হারিয়ে গেছে চিরতরে। কিন্তু তারপর আবার দমকা হাওয়ার মতো ফিরে এলো ও। এক সমুদ্র ভালোবাসায় ডুবিয়ে দিলো। জীবনে আর অন্য কারো কথা ভাবা সম্ভব নয়। আজ সকালে মাকে জানিয়ে দিয়েছে যে এই বিয়েটা ও করতে পারবে না। রুবিনা কোনো জবাব দেয়নি। তবে বেশ অসন্তুষ্ট মনে হয়েছে তাকে। একবার কথা দেয়া হয়ে গেছে। ওর মতামত নিয়েই কথা দিয়েছেI এখন আবার মানা করছে।
অনিমা ঠিক করেছে মুনিরের সঙ্গে কথা বলবে। নিজের স্বার্থের জন্য কাউকে কষ্ট দিতে পারবে না ও। মনিরের বাবা-মা যদি এই সম্পর্কে খুশি না এ থাকে তাহলে এই বিয়ে হবে না। অনিমা জানে মুনির খুব কষ্ট পাবেI ও নিজেও কষ্ট পাবে। কোন কিছু একবার পেয়ে হারানোর কি যন্ত্রনা যে হারায় সে বোঝে। ওর সঙ্গে কথা বলাটা খুবই জরুরী। ফোনে এত কথা বলা যাবে না সামনাসামনি বলতে হবে। আমিমার কেমন যেন ভয় করছেI মনির খুব রেগে যাবে। এমনিতে ও হাসিখুশি। সারাক্ষণ হাসতে থাকে কিন্তু একবার রেগে গেলে সামলানো মুশকিল।
***************
– তোমার কি হয়েছে অনিমা?
অনিমা চমকে তাকালো। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল
– কিছু হয়নি তো
– বলবে না আমাকে?
– কিছু হলে বলতাম
– আচ্ছা ঠিক আছে চলো লাঞ্চ করি
এই বাসায় এখনও টেবিল কেনা হয়নি। ড্রইংরুমের মেঝেতে পাতলা ম্যাট্রেস দিয়ে বসার ব্যবস্থা করা আছে। আজ একটা বিশেষ দিন। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে মুনিরের চাকরিটা হয়ে গেছে। ও খুব চাইছিল বিয়ের আগে চাকরিটা হয়ে যায়। ইন্টারভিউয়ের সময় কনফার্ম করেছে ওরা। অ্যাপোয়েন্টমেন্ট লেটার ইমেইল করে দিয়েছে। হঠাৎ করেই সিমেস্টারের মাঝখানে একজন চলে যাওয়াতে ওদের আর্জেন্টলি কাউকে দরকার। ইন্টারভিউ শেষে বেরিয়ে মুনিরের মনে হলো সবার আগে অনিমা কে খবরটা জানাবে। দুবার ফোন করতে গিয়েও কেটে দিল। হিসেব মতো এখনো ওর ক্লাস চলার কথা। আজকে মঙ্গলবার গত দুদিন নানা ঝামেলায় ঠিকমতো কথা বলা হয়নি। ফোন না করে একবারে ওর ইউনিভার্সিটিতে চলে গেল মুনির। প্রায় তিনটা বাজে। মনির নয় তলায় চলে গেল। একবার চাচির সঙ্গে দেখা করে নিল টুক করে। এখানে সব টিচারদের আলাদা কিউবিকেল। তিন দিক দিয়ে ঘেরা ছোট্ট এক টুকরো জায়গা। কম্পিউটার টেবিল সামনে দুটো চেয়ার । একটা বইয়ের সেলফ। ছোট কিন্তু ছিমছাম । মনিরকে ভিতরে ঢুকতে দেখে অনিমা কেমন যেন চমকে গেল। অবাক হয়ে বলল
– তুমি এখানে?
– অবাক হয়েছ?
– হ্যাঁ। ফোন করতে একটা
– তুমি ক্লাসে ছিল, তাই ফোন করিনি
মনির চেয়ার টেনে বসে পরলো। অনিমাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। চোখ দুটো কেমন ফুলে আছে। মনে হচ্ছে ঘুমায়নি সারারাত। মনিরের কেমন মায়া হল।
– একটা নিউজ দেয়ার ছিল
– কি?
অনিমার কেমন যেন ভয় করছে। কি জানি কি হয়েছে আজকাল। সবকিছুতেই কেমন ভয় করে। মনে হয় এই বুঝি খারাপ কিছু হবে।
– ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি থেকে আমাকে জব অফার করেছে
– সত্যি ?
অনিমা টেবিলের উপর রাখা মনিরের হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিল নিজের অজান্তেই। তারপর বলল
– আমি খুব খুশি হয়েছি। চা খাবে?
– না। তোমাকে নিয়ে বের হবো। একবারে লাঞ্চ করব। তুমি কখন বের হতে পারবে?
– আর আধাঘন্টা পর
– ওকেI আমি ওয়েট করছি
– দাড়াও ওয়েট করতে হবে না। আমি ম্যাডাম কে বলে আসি। অনিমা উঠে চলে গেল। ওর যাত্রা পথের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল মুনিরের । আজ একটা কালো টেম্পল পাড় সাদা শাড়ি পরেছে ও। কেমন বিষন্ন দেখাচ্ছে ওকে। শাড়িটার জন্য কি? নাকি আসলেই কোন সমস্যা ? অনিমা ফিরে এসে ব্যাগ তুলে নিয়ে বললো
– চলো
অনিমা ভেবেছিল ওরা কোন রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। কিন্তু মুনির যখন ওদের নতুন ফ্ল্যাটের নিচে গাড়িটা পার্ক করলো, বেশ অবাক হয়ে গেল ওI মুনির পাশে তাকিয়ে একটু হেসে বলল
– একটু রিল্যাক্স করে খেতে ইচ্ছা করছে
অনিমা আর কিছু বলল না। মুনির বোধহয় মাঝে এসে গুছিয়েছে বাসাটা। ড্রইং রুমের মেঝেতে একটা ম্যাট্রেস পাতা উপরে রংবেরঙের কুশন দিয়ে সাজানো । পাশে একটা ছোট সাইড টেবিল। রান্নাঘরে কিছু টিকটক সরঞ্জামাদি।মুনির খাবার গুলো রেখে বলল
– তুমি ফ্রেস হয়ে এসো। ওয়াশরুমে সব দেয়া আছে কিছু
অনিমা সময় নিয়ে চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিল। একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজ। ঠিক করেছে মনিরের সঙ্গে কথা বলবে। আজই। বের হয়ে দেখল মুনির মেঝেতে খাবার সাজিয়ে বসে আছে। কাচ্চি বিরিয়ানি অর্ডার করেছে সঙ্গে বোরহানি, স্যালাড। অনিমার খেতে ইচ্ছা করছে না। অসম্ভব ক্লান্ত লাগছে। ইচ্ছা করছে এখানে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়তে। অনিমা এসে হাঁটু মুরে বসলো। মুনির প্লেটে খাবার বাড়তে বাড়তে বলল
– খেতে ইচ্ছা করছে না ?
– একটুও না
– তুমি হেলান দিয়ে বস। আমি খাইয়ে দিচ্ছি ।
অনিমা আপত্তি করল না কয়েকটা কুশন নিয়ে হেলান দিয়ে বসলো। মনির প্লেটে বিরিয়ানি আলু আর মাংসের টুকরো দিয়ে মুখে তুলে দিল ওর। দুইবার খাওয়ার পর অনিমা বলল
– তুমিও খাও
– এখান থেকে খাব ?
– খাও, সমস্যা কি ?
মনির আর কিছু বললো না, তবে বেশ আয়েশ করে আরো খাবার তুলে নিয়ে আরাম করে খাওয়া শুরু করলো।
খাওয়া শেষে অনিমা সব গুছিয়ে রাখছিল ফ্রিজে। ফ্রিজ আর মাইক্রোওয়েভ কেনা হয়ে গেছে । স্টোভ বসানো হয়নি এখনো। ইলেকট্রিক কেটলি আছে। মনির জানতে চাইল
– চা খাবে?
– না। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। খুব ক্লান্ত লাগছে। আমি একটু শুই। আমাকে ডেকে দিও।
– আমি ও বসছি তোমার সঙ্গে। দেয়ালে হেলান দিয়ে বসলো পা ছড়িয়ে বসল মুনির। তারপর কোলের উপর একটা কুশন রেখে বললো
– এখানে ঘুমাও
অনিমা আপত্তি করল না বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। মুনির আস্তে আস্তে ওর চুলের মধ্যে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল
– ঘুমাও। একটু পরে ডেকে দেব
অনিমা চোখ খুলে দেখল চারিদিকে আবছা অন্ধকার। হঠাৎ করেই কিছু চিনতে পারল না। পাশ ফিরতেই চমকে উঠলো। দেয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে মুনির। একটা হাত এখনো ওর চুলের মধ্যে। বোধহয় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল মাথায়। অনিমার চোখে জল এসে গেল। খুব সন্তর্পনে হাত সরিয়ে উঠে বসলো। ওর কপালের উপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে খুব আলতো করে চুমু খেলো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে তারপর ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ালো। আচমকাই চোখ খুললো মুনির। সহসা কিছু বুঝতে পারল না। তারপর নিজের অজান্তেই দুই হাতে ওকে কাছে টেনে নিয়ে ওর অসম্পূর্ণ কাজটাকে সম্পূর্ণ করল, অধরে অধর ডুবিয়ে ।
এইভাবে কতক্ষন কাটলো ওরা কেউ জানে না। একসময় মুনির টের পেল অনিমার চোখ ভেজা । দুই হাতে ওর মুখটা তুলে ধরে আস্তে আস্তে বলল
– কি হয়েছে আমাকে বলবেনা
অনিমে জবাব দিল না মনিরের বুকের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে লম্বা করে শ্বাস নিয়ে বলল
– আমাকে এভাবে কিছুক্ষণ থাকতে দেবে প্লিজ
– আমি চাই তুমি সারাজীবন এভাবেই থাকো
অনিমা খুব আস্তে আস্তে বলল
– তুমি সিওর এই বিয়েতে তোমার বাসার সবাই খুশি?
মুনির একটু অবাক হয়ে বলল
– হ্যাঁ, তোমার কেন মনে হল সবাই খুশি না
– তুমি ওদেরকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে তার পরেও খুশি?
– কোথায় চলে যাচ্ছি? আমি তো আর ফিরে যাচ্ছি না। দেশে আছি তাতেই সবাই খুশি
– আমাকে নিয়ে কারো কোন সমস্যা নেই?
– সমস্যা থাকবে কেন? আমাদের ব্যাপারটা শুরু থেকেই সবাই জানে
– শুরু থেকে মানে? কবে থেকে?
– যেদিন তোমাকে প্রথম বাসায় নিয়ে গেলাম
অনিমা আশ্চর্য হয়ে মুখ তুলে বললো
– তখন তো আমাদের মধ্যে কিছু ছিল না
– ছিল। আমরা বুঝতে পারিনি।তুমি কি এগুলো নিয়ে আপসেট?
– আমার খুব ভয় করছে
– কিসের ভয়?
– মনে হচ্ছে তোমাকে আবার হারিয়ে ফেলবো
– কোন ভয় নেই। সব ঠিক আছে। আমি আছি তো।
অনিমা আর কিছু বলল না।মুনিরের বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে চোখ বুজলে
– অনি
– উম
– একটা গান শোনাবে?
– শোনাবো। আচ্ছা, তুমি যে গান গাও আমাকে আগে বলনি তো
– প্রেমে পড়লে মানুষ আরো কত কিছু করে
– তুমি কবে প্রেমে পড়লে?
– আজকে বলবো না। যেদিন তোমাকে নিয়ে এই বাসায় একবারে আসবো সেদিন বলবো
– আচ্ছা আজকে তুমি গানটা শোনাও
অনিমা দেয়ালে হেলান দিয়ে বসেতে নিলে মুনির বলল
– এভাবে বসলে গান শোনাবো না। আগে যেমন ছিলে সেই ভাবে এস
অনিমা হেসে ফেললো। তারপর আগের মতই বুকের মধ্যে মাথা রেখে বলল
– এবার হয়েছে?
মুনির অনিমার চুলের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে দিয়ে গান শুরু করল
তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা
তুমি আমার সাধের সাধনা,
মম শূন্য গগনবিহারী।
আমি আপন মনের মাধুরী মিশায়ে,
তোমারে করেছি রচনা
তুমি আমারি, তুমি আমারি, মম অসীমগগণবিহারী
তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা,
মম মোহের স্বপন অঞ্জন
তব নয়নে দিয়েছি পরায়ে, ঐ মুগ্ধনয়নবিহারী
মম মোহের স্বপন অঞ্জন
তব নয়নে দিয়েছি পরায়ে, ঐ মুগ্ধনয়নবিহারী
মম সঙ্গীত তব অঙ্গে অঙ্গে,
দিয়েছি জড়ায়ে জড়ায়ে
মম সঙ্গীত তব অঙ্গে অঙ্গে,
দিয়েছি জড়ায়ে জড়ায়ে
তুমি আমারি, তুমি আমারি, মম জীবনমরণবিহারী
তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা
তুমি আমার সাধের সাধনা…
চলবে……..
আজকের কবিতাটা সাদাত হোসেনের লেখা I আর গানটা রবীন্দ্র সঙ্গীত Iতোমাকে শুধু তোমাকে চাই
অষ্টাদশ পর্ব
অনেক অনেক দিন পর আজ অনিমার খুব ফুরফুরে লাগছে। মনে হচ্ছে সব ঠিক হয়ে গেছে। অনিমা ঠিক করে ফেলেছে, আজ বাবা মায়ের সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারে কথা বলবে। মুনিরকে তো ওরা আগেই দেখেছে। শুক্রবার এর ব্যাপারটা জানাতে হবে। আর মাত্র দুইদিন আছে হাতে। এর মধ্যে সব গুছিয়ে ফেলতে হবে। ওর তো আর কেউ নেই। সবকিছু ওকে আর মা কে করতে হবে। মা মনে হয় একটু রেগে আছে। বুঝিয়ে বলতে হবে।
অনিমার যাও বা আগে একটু দ্বিধা ছিল, এখন আর তা নেই।এখন ও পুরোপুরি নিশ্চিত, মুনির ওকে কখনো কষ্ট দেবে না। আজ ফেরার সময়, যখন দরজা দিয়ে বের হতে যাবে, আচমকা মুনির ওর হাতটা ধরে কাছে টেনে নিয়ে বলল
– আর মাত্র দুটো দিন। এরপর আর তোমাকে মন খারাপ করে থাকতে দেবো না। আমি এমন মন খারাপ করা বউ চাই না।
– তাহলে কেমন বউ চাও?
– ঘাড়ত্যড়া, ঝগড়াটে বউ
অনিমা হেসে ফেলেছিল। বলেছিল
– তুমি মনে হয় পৃথিবীর প্রথম ছেলে যে ঘাড়ত্যড়া ঝগড়াটে বউ চায়
বাড়ি ফিরে অনিমার মনে হল কেমন থমথমে পরিবেশ। মা রান্নাঘরে রান্না করছে। বাবার রুমের লাইট নিভানো। অনিমা বাবার রুমে গেল। হাসান সাহেব খাটে হেলান দিয়ে বসে গান শুনছেন। অনিমাকে দেখে হাত বাড়িয়ে দিলেন। অনিমা কাছে বসে বললো
– কি করো বাবা?
– গান শুনি। তুই তো আজকাল আর গান শুনাস না।
– শোনাব বাবা
– কিছু বলবি?
– না। এমনি তোমার কাছে বসতে এলাম। চা খাবে?
– খেয়েছি একটু আগে। তোর মার কি হয়েছে জানিস?
– কেন ?
– সকাল থেকে খায়নি কিছু। কেমন রেগে আছে।
– আচ্ছা আমি দেখব
– মনে হয় তোর ফোন বাজছে
মুনির ফোন করেছে ভেবে অনিমা দৌড়ে গিয়ে ফোনটা ধরল
অপরপ্রান্ত থেকে একটা ভারি মহিলাকণ্ঠ বলল
– অনিমা বলছো?
– জি। কে বলছন?
– আমি মুনিরের মা রেহানা বলছিলাম
– আসসালামু আলাইকুম আন্টি
– ওয়াআলাইকুমুসসালাম। কেমন আছো মা?
– জি আলহামদুলিল্লাহ্ । আপনি ভালো আছেন?
– আমাদের আর থাকা। তোমরা ভাল থাকলেই আমরা ভাল ।
অনিমার কেমন অস্বস্তি হল
– একথা বলছেন কেন আন্টি?
– কি আর বলব মা? আমার তো খুব ইচ্ছা ছিল বোনের মেয়েটাকে বউ করে আনব। মুনির ও রাজি ছিল। যাওয়ার আগে আংটি ও পরিয়ে গেল। আর এখন বেকে বসেছে। যাক কি আর করা। বেশি কিছু বললে আবার বাইরে চলে যাবে। থাক। ওর সুখে আমার সুখ।
অনিমা হতভম্ব হয়ে গেল। কি বলবে বুঝতে পারল না। উনি আবার বললেন
– পৃথিবীতে সবাই নিজের বাবা মা এর কথা ভাবে। শুধু আমার ছেলেটাই ভাবল না।
অনিমা কনমতে বলল
– আপনারা ওর সাথে কথা বলুন
– আমাদের কথা শুনলে তো? এখন তো শুধু তোমার কথাই শুনে
– আপনারা না চাইলে এই বিয়ে হবে না
– আমাদের চাওয়া না চাওয়ায় কিছু যায় আসে না।
রেহানা কান্নাভেজা কণ্ঠে বললেন
– তোমার কাছে ভিক্ষা চাই। আমার ছেলেটাকে ফিরিয়ে দাও।
অনিমা কেমন স্তব্ধ হয়ে গেল। কোনমতে বলল
– আপনারা না চাইলে এই বিয়ে হবে না
– তুমি কথা দাও মা
অনিমা মোহ গ্রস্থের মত বলল
– কথা দিলাম
ফোন রেখে অনিমা অনেকক্ষন ওইভাবেই বসে রইল। আজ কেন যেন কান্না ও পাচ্ছে না। শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছে, কেন ওর সাথেই সব সময় এই রকম হয়? ওর কি একটু ভালো থাকার কোন অধিকার নেই?
রুবিনা ঘরে ঢুকে দখলেন মেয়ে খাটে মাথা নিচু করে বসে আছে। তার মেজাজ এতটাই খারাপ হয়ে আছে যে মায়ের মলিন মুখ তার চোখে পরল না। ঝাঝের সংগে বলল
– তুই এইসব কি শুরু করেছিস? একবার হ্যাঁ বলে আবার না করলি। আমি ওদের কথা দিয়েছি। এইরকম করলে আমার মুখ থাকবে? কি হল, কথা বলছিস না কেন? নাকি তোর কামাই খাই, তাই আমাদের কথার কন দাম নাই?
এতক্ষন কান্না পায়নি কিন্তু এবার চোখ ফেটে জল আসছে। অনিমা উঠে দাঁড়িয়ে বলল
– তোমরা যা চাইবে সেটাই হবে। আমি আর বাধা দেব না।
মুনির অনিমাকে কিছু জানায়নি, কিন্তু ও ঠিক করে রেখেছে পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়ে শুক্রবার দিন যাবে। ওই দিনই বিয়ে হবে এবং অনিমাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবে। প্রয়োজনে আবার ফিরে আসবে পরেরদিন। যতদিন পর্যন্ত না নতুন ফ্ল্যাটে শিফট করা হচ্ছে অনিমা নিজের বাড়িতেই থাকবে। বাসায়ও আলোচনা করেছে। এটাই সব থেকে ভাল। এরপর এই মাসের মধ্যেই একটা ডেট দেখে রিসেপশন করে ফেলতে হবে। বাবা মা আর নাজমা ছাড়া শুধু হাসিবকে বলেছে সঙ্গে আসতে। আত্মীয়-স্বজন আর কাউকে সঙ্গে আনা যাবে না। যদিও তারা মাইন্ড করবে, কিন্তু কিছু করার নেই। রিসেপশন এর সময় সবাইকে একবারে বলতে হবে। মুনির মোটামুটি সব গুছিয়ে রেখেছে।
হাতে আর মাত্র একটা দিন আছে। আজ ইউনিভার্সিটিতে মুনিরের অরিয়েন্টেশন ছিল। দুই ক্যাম্পাস মিলিয়ে সারাদিনের প্রোগ্রাম। সব কাজ গুছিয়ে বের হতে হতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। বের হয়ে মুনির অনিমাকে ফোন করলো। কাল থেকেই ও ফোন ধরছেনা। খুব ইচ্ছা ছিল ওকে নিয়ে একবার বের হবার। কিছু টুকটাক কেনাকাটা ছিল। এছাড়া দুদিন দেখা ও হয়নি। আরও দুবার চেষ্টা করার পরও যখন ফোন ধরলে না অনিমা, তখন বাধ্য হয়েই বাড়ির পথ ধরল মুনির।
শুক্রবার সকাল থেকেই মুনীরের খুব খুব অস্থির লাগছে। অনিমা গত দুদিন দু’দিন ধরে ফোন ধরছেনা। মুনির জানে যে ও খুব ব্যস্ত। বাড়িতে সাহায্য করার মতন কেউ নেই। সব ওকে করতে হচ্ছে। মুনির বলেছে ওরা সন্ধ্যাবেলা আসবে কোন ঝামেলা করার দরকার নেই, তবু কি জানি কি করছে? বলে ও না কিছু। এত চাপা মেয়েটা।
সকালবেলা জগিং শেষ করে মুনির আর দেরি করলো না। একটা রিক্সা নিয়ে অনিমার বাসায় চলে গেল। একেবারে খালি হাতে যাওয়াটা ভালো দেখায় না, তাই শাহবাগে নেমে অনেকগুলো ফুল কিনে নিল। ওর কোন ফুল পছন্দ জানেনা মুনির । কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি তাই কিছু কিছু করে সব রকম নিল ।
মুনির যখন পৌঁছালো ততক্ষণে প্রায় এগারোটা বেজে গেছে। ভেতরে ঢুকে মুনির একটু অবাক হলো । ড্রইংরুমে পাঁচজন লোক বসে আছে। অনিমার মা ব্যস্তসমস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে। অনিমাকে কোথাও দেখা গেলোনা। মুনির রুবিনার কাছে এগিয়ে গিয়ে সালাম দিল। রুবিনা ওকে দেখে আনন্দিত কন্ঠে বলল
– মুনির তুমি এসেছ? ভালো হয়েছে। আমাদের দিকের তো কেউ নেই। একটু সাহায্য হবে।
মুনির অবাক হয়ে বললো
– এসব কি হচ্ছে আন্টি ?
– কেন ? অনিমা তোমাকে কিছু বলেনি?
– কি বলবে?
– আজকে ওর বিয়ে
মুনিরের মনে হল ও ভুল শুনছে। ও বলল
– কার বিয়ে?
– অনিমার। আমার ভাইয়ের ছেলের সঙ্গে। কিন্তু ওকে দেখ, সেই যে সকাল থেকে দরজা বন্ধ করে বসে আছে , খোলার কোনো নাম নেই। তুমি একটু দেখবে বাবা ?
মুনিরের মাথা কাজ করছে না। ও কোনমতে অনিমার ঘরের সামনে গিয়ে দরজায় টোকা দিল। একবার, দুবার, তিনবার ভেতর থেকে কোন শব্দ এলো না। মুনির আবার দরজা ধাক্কা দিল। এবার ভেতর থেকে অনিমার কন্ঠ ভেসে এলো
– কেন বিরক্ত করছো মা? বললাম তো এখন দরজা খুলব না।
মুনির আরো জোরে দরজা ধাক্কা দিলো। কোন কথা বলল না । এবার ভেতর থেকে দরজা খুলে গেল। অনিমা দরজা খুলেই পেছন ফিরে গজ গজ করতে করতে বলল
– অসহ্য! কেন বিরক্ত করছো?
মুনির ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর থমথমে গলায় বলল
– এসব কি হচ্ছে অনিমা ?
অনিমা পেছন ফিরে চমকে উঠলো । কোনমতে বলল
– তুমি এখানে ?!
চলবে……
সাত দিন ধরে জ্বরে পড়ে আছি। জানি আমার চাইতে সবাই মুনিরকে নিয়ে বেশি চিন্তিত। তবু সবাই আমার জন্য একটু দোয়া করবেন যেন তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাই।