#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
৩৯.
~
অন্যদিনের তুলনায় আজকের বিকেল টা একটু বেশিই সুন্দর। বৃষ্টি নেই। তবে আকাশ মেঘলা। রোদের আবছা কিছু আলো দেখা যাচ্ছে। আকাশের গায়ে ভেসে বেড়াচ্ছে দলা পাকানো মেঘগুলো। যেন তারা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে পুঞ্জ পুঞ্জ ভালোবাসা। ভেজা স্যাঁতসেঁতে রাস্তায় মৃদু বেগে ছুটে চলছে মিথির স্কুটি টা। পেছনে বসেছে নৈরিথ। মিথির মনের ভেতরকার অনুভুতি টা এই মুহুর্তে সে ঠিক প্রকাশ করতে পারছে না। কোনো ভাষা জানা নেই তার। কিভাবে বলবে মন তার কেমন করছে। সে নিজেও তো বুঝতে পারছে না। নৈরিথেরও তার চেয়ে ব্যতিক্রম কিছু ঘটছে না। এইভাবে বউয়ের পেছনে বসে স্কুটিতে করে কয়জন বর ঘুরেছে সেটা ঠিক তার জানা নেই। রাস্তার কিছু মানুষ বারবার বাঁকা চোখে তাকাচ্ছে তাদের দিকে। নৈরিথ অবাক হয় তাতে। যেন এটা কোনো অন্যায়। সত্যিই এই সমাজের মানুষগুলো বড্ড অদ্ভুত।
.
শহরের ব্যস্ত রাস্তা পেরিয়ে তারা যায় একটা নিরব জায়গায়। যেখানে কোনো কোলাহল নেই, কোনো হৈ চৈ নেই। যেখানে নিশ্বাস নিলেই কার্বন-ডাই-অক্সাইডের গন্ধ পাওয়া যাবে না, পাওয়া যাবে নির্মল বাতাসে মিষ্টি ফুলের সুবাস।
.
স্কুটি টা একপাশে রেখে মিথি নৈরিথের পাশে এসে দাঁড়ায়। নৈরিথ তার সামনে থাকা দীঘি টার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দীঘি টা সুন্দর। তার পানিটাও পরিষ্কার। চারদিকের নারকেল গাছে আরো বেশি সুন্দর লাগছে তাকে। মিথি চোখ বুলিয়ে আশে পাশের সবকিছু দেখল। তারপর আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে নেমে পানির কাছে গেল। পা ভিজিয়ে একটা সিঁড়িতে বসে পড়ল। ভালো লাগছে। পেছন ফেরে নৈরিথকেও হাতের ইশারা দিয়ে ডাকে। নৈরিথ তার সামনে এসে দাঁড়ায়। মিথির পায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘শাড়ি টা ভিজছে।’
মিথি গুরুত্ব দিল না। বললো,
‘ভিজুক।’
নৈরিথ প্রতিত্যুর করলো না। খানিক চুপ থেকে বললো,
‘শাড়ি পরে স্কুটি চালাতে অসুবিধা হয়নি? আজকে শাড়ি পরার কি দরকার ছিল?’
মিথি মাথা উপরে করে নৈরিথের দিকে তাকাল। থমথমে গলায় বললো,
‘আপনার জন্য পরেছিলাম। কিন্তু আপনার যেহেতু পছন্দ না তাহলে আর পরবো না।’
নৈরিথ কপাল কুঁচকে ফেলল। ঝটপট জবাবে বললো,
‘কে বললো পছন্দ না? আমি তো শুধু তোমার অসুবিধার কথা ভেবে বলছিলাম। সেটাতেও তুমি মন খারাপ করে ফেললে? এত মন খারাপ করলে কি করে হবে বলতো?’
মিথি মুখ ঘুরিয়ে নিল। দীঘির পানিতে গভীর দৃষ্টি রাখল। অতঃপর ফিচেল গলায় বললো,
‘আমি মন খারাপ করলেই বা কি? আপনার তো আর তাতে কিছু যায় আসে না।’
নৈরিথ নিশ্বাস নিল। নরম সুরে বললো,
‘তোমাকে আমি সবকিছু মুখে বলে বোঝাতে পারবো না মিথি। সবাই সবটা প্রকাশ করতে পারে না। আমি জানি তোমার হয়তো আমার প্রতি অনেক অভিমান আছে। আমি তো এমনই। তুমিও তো জানো। একসময় তো আমি ভালোবাসাতেই ভয় পেতাম। কিন্তু, এখন ভালোবাসতে শিখেছি। তুমি সেটা শিখেয়েছ আমায়। তুমি আমার জীবনটা কে বদলে দিয়েছ মিথি। এই অনুভূতিহীন মানুষটাকে আবার অনুভূতি কে আকড়ে ধরে বাঁচতে শিখিয়েছ। তবে এখনও আমার মাঝে অনেক বদলের বাকি। আমাকে কিছু সময় দাও, একদিন তোমার সমস্ত অভিযোগ আমি মিটিয়ে দিব। শুধু কিছুটা সময় দাও আমায়..!’
নৈরিথ কথাটা শেষ করে চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মিথি বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। নৈরিথকে জড়িয়ে ধরলো শক্তভাবে। নৈরিথের বুকে নিজের মাথাটা চেপে ধরল। নৈরিথ দুহাতের বাহুডোরে আগলে নিল তাকে। মিথি প্রাণ ভরে নৈরিথের শরীরের ঘ্রাণ নিল। তারপর ক্ষীণ সুরে বললো,
‘আপনি আমাকে যতটুকু দিয়েছেন যা দিয়েছেন আমি তাতেই খুশি। আপনাকে বদলাতে হবে না। আমার মন খারাপের কারণ কখনোই আপনি না। আমি জানি আপনি আমায় ভালোবাসেন। হয়তো অন্য সবার মতো হাজার বার মুখে বলে সেটা প্রকাশ করতে পারেন না। ঠিক আছে, লাগবে না। আপনি তো মনে মনে আমায় ভালোবাসেন, তাতেই হবে। মুখে বলতে হবে না। আমি এমনিতেই বুঝে নিব।’
নৈরিথ আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল মিথিকে। নিরবে দাঁড়িয়ে থাকল অনেকক্ষণ। মিথি এবার একটু নড়ে উঠতেই নৈরিথ তার হাতের বাঁধন আরো শক্ত করলো। মিথি স্মিত সুরে বললো,
‘কি হলো?’
‘নড়ছো কেন?’
‘আর কতক্ষণ এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকব। ছাড়ুন।’
নৈরিথ ছাড়ল না। বিরক্ত কন্ঠে বললো,
‘আমি যতক্ষণ না চাইব ততক্ষণ এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।’
মিথি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো,
‘কি বলছেন? মানুষ দেখবে, ছাড়ুন তো।’
‘আজব! তুমি এখানে মানুষ কোথায় দেখছ? এখানের আশে পাশে কোথাও কোনো মানুষ নেই। আর থাকলেই বা কি? আমি আমার বউকে যত খুশি জড়িয়ে ধরব, মানুষের কি তাতে?’
নৈরিথের মৃদু প্রতিবাদের সুরে খানিকটা থমকে যায় মিথি। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবারও তার মোচড়া-মোচড়ি শুরু হয়ে যায়।
‘আরে, নৈরিথ ছাড়ুন না। মাঝে মধ্যে আপনার কি হয় বলুন তো? এমনিতে তো সবসময় খুব ভদ্র থাকেন কিন্তু হঠাৎই এমন অভদ্র হয়ে উঠেন কেন?’
নৈরিথ মেকি রাগ দেখিয়ে বললো,
‘অভদ্রতার কি দেখলে? আমি কি সবার সামনে তোমাকে জড়িয়ে ধরেছি? এখানে কেউ নেই, তাই। আর সবচেয়ে বড়ো কথা হলো আজ ওয়েদার টাও ভীষণ রোমান্টিক। খেয়াল করেছো সেটা?’
মিথি এবার মাথা উঁচু করে তাকাল। চোখ জোড়া ছোট ছোট করে সন্দিহান কন্ঠে বললো,
‘আপনি আবার কবে থেকে এসব জিনিস খেয়াল করতে শুরু করেছেন, হু?’
নৈরিথ বাঁকা হাসে। বলে,
‘যবে থেকে তোমার প্রেমে পড়েছি।’
মিথি মাথা নিচু করে হাসল। হঠাৎ তার মনে পড়ল নেহার কথা। নৈরিথের মন টা এখন ভালো আছে। এখনই তাকে সাদের ব্যাপারে কথা বলা উচিত। কিন্তু আবার একটু একটু ভয়ও হচ্ছে। উনার তো আবার মুড চেঞ্জ হতে বেশি সময় লাগে না। যদি আবার রেগে টেগে যায়? কিন্তু, না বলেও উপায় নেই। ঐদিকে নেহা টা খুব কষ্ট পাচ্ছে। না তাকে বলতে হবেই। আর এখনি বলতে হবে। এছাড়া হয়তো পরে আর সময় নাও পেতে পারে। মিথি জোরে শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করলো। তারপর সে নৈরিথের শার্টের বোতামটা আঙ্গুল দিয়ে খোঁচাতে খোঁচাতে আহ্লাদীর সুরে বললো,
‘আপনার কাছে একটা জিনিস চাইব?’
নৈরিথ মিথির কপালের চুলগুলো কানের পিছে গুঁজে দিয়ে বললো,
‘হ্যাঁ, বলো কি লাগবে?’
মিথি মিটমিট করে নৈরিথের দিকে তাকাল। ক্ষীণ সুরে বললো,
‘আপনি আবার রেগে যাবেন না তো?’
নৈরিথ গভীর দৃষ্টিতে মিথির মুখের দিকে তাকাল। বললো,
‘না, বলো?’
মিথি প্রথমে ঢোক গিলল। তারপর জিভ দিয়ে ঠোঁট জোড়া ভেজাল। আস্তে করে বললো,
‘নেহার সাথে সাদ ভাইয়ার বিয়েতে আপনি মত দিয়ে দিন প্লীজ।’
নৈরিথ তাকিয়ে রইল। কোনো জবাব দিল না। হঠাৎই মিথি কিছু অনুভব করলো। তার উদরে উষ্ণ কিছুর স্পর্শ। কেঁপে উঠল মিথি। নৈরিথের শার্ট টা খামছে ধরলো। নৈরিথ গম্ভীর সুরে বললো,
‘সাদ কে আমার পছন্দ না মিথি। ওকে আমি চিনি। ও একসময় খুব বাজে ছেলে ছিল। এর আগেও অনেক প্রেম করেছে। তবে মাঝখানে আর ওকে দেখেনি। তারপর সেদিন আবার ওকে দেখে আমি অবাক হই খুব। চেঞ্জ হয়েছে অনেক। কিন্তু তাও আগের ঘটনাগুলো এখনও আমার মাথায় আছে। আমি আমার বোনকে ঐ ছেলের সাথে বিয়ে দিব না।’
এই বলে সে মিথিকে ছেড়ে দাঁড়াল। মিথি জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলল। শাড়িটা ভালোভাবে টেনে পেটের অংশ টা ঢেকে নিল। তারপর নৈরিথের দিকে তাকিয়ে বিনয়ের সুরে বললো,
‘মানুষ তো সবসময় এক রকম থাকে না। অতীতে তো অনেকেই অনেক কিছু করে। অতীত ধরে বসে থেকে বর্তমান কেন নষ্ট করবেন। সাদ ভাইয়া এখন আর আগের মতো নেই। উনি কিন্তু নেহার কাছ থেকে কোনোকিছু লুকাননি। নেহাকে সব বলেছে। উনি আগে কেমন ছিলেন, কি করতেন, সব। উনি যদি উনার ভালোবাসায় সৎ না হতেন তাহলে কি এসব বলতেন, বলুন? আর সবচেয়ে বড়ো কথা হলো নেহা উনাকে খুব ভালোবাসে। খুব কষ্ট পাচ্ছে মেয়ে টা। প্লীজ নৈরিথ, মেনে নিন না।’
নৈরিথ পাত্তা দিল না মিথির কথায়। হাতের ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,
‘এবার বাড়ি ফেরা দরকার। চলো।’
মিথি মুখ ঘুরিয়ে নিল। রাগ দেখিয়ে বললো,
‘যাবো না আমি।’
নৈরিথ বললো,
‘আচ্ছা চলো তবে অন্য কোথাও যাই।’
‘না।’
নৈরিথ এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো,
‘এদিকে তেমন মানুষ নেই। আর সন্ধ্যাও নামছে। আমার মনে হচ্ছে না জায়াগাটা আমাদের জন্য খুব একটা সেইফ হবে। তাড়াতাড়ি চলে যাওয়াই বেটার।’
মিথি এখনও আগের মতোই গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নৈরিথ তার হাত ধরে বললো,
‘কি হলো, চলো?
মিথি ঠোঁট উল্টে অভিমান করে বললো,
‘প্লীজ নৈরিথ, আমার কথাটা শুনুন। সাদ ভাইয়া কে মেনে নিন প্লীজ।’
নৈরিথ চোখ বুজে নিশ্বাস ফেলল। বললো,
‘ঠিক আছে, এসব নিয়ে পরে ভাবা যাবে। এখন আপাতত চলো এখান থেকে।’
মিথি তাও না নড়াতে নৈরিথ তার হাত ধরে টেনে টেনে স্কুটি পর্যন্ত নিয়ে গেল। তারপর বললো,
‘নাও স্টার্ট দাও।’
মিথি মুখ কালো করে বলে,
‘পারবো না।’
বলেই মেয়েটা আবারও গাল ফুলালো। নৈরিথ বুকের উপর হাত দুটো ভাজ করে অনেকক্ষণ নিষ্প্রভ চোখে চেয়ে রইল তার দিকে। হালকা গোলাপী রঙের শাড়ি পরেছে মেয়েটা। এই স্নিগ্ধ পরিবেশে তাকেও খুব স্নিগ্ধ লাগছে। খোলা চুলগুলো বাতাসে এলোমেলো হচ্ছে। সুন্দর লাগছে মেয়েটা কে। সেই সৌন্দর্য কে আরো বাড়িয়ে দিল তার ফুলিয়ে রাখা গালগুলো। নৈরিথ তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। হয়তো এবার আর নিজেকে আটকে রাখতে পারবে না। মেয়েটার নেশা যেন তাকে আষ্টে-পৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। আর না পেরে নৈরিথ আচমকাই মিথিকে টেনে তার খুব কাছ নিয়ে এল। হঠাৎই ঠোঁট জোড়া দিয়ে চেপে ধরলো মিথির কোমল ওষ্ঠাধর। প্রথমেই যেন কিছু বুঝে উঠতে পারলো না মিথি। তার মস্তিষ্ক তাকে সঠিক তথ্য জানান দিতে দিতে অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছে। ততক্ষণে তার অধরজোড়া নৈরিথ পুরোপুরি তার আয়ত্তে নিয়ে নিল। স্তব্ধ হয়ে গেল মিথি। কিছু সময়ের জন্য থমকে গেল সে। চোখ বুজে কেবল একটাই কথা ভাবল,
‘আদৌ এটা বাস্তব তো? নাকি কেবল স্বপ্ন?’
#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
৪০.(অন্তিম পর্ব)
~
ঠোঁটে হাত দিয়ে আয়নার দিকে অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে আছে মিথি। এখনও তার কাছে সবকিছু স্বপ্ন মনে হচ্ছে। সেই মুহুর্তের কথা মনে পড়তেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে যেন। নৈরিথের প্রথম ছোঁয়া, স্মৃতিতে আটকে থাকবে সারাজীবন। লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছিল তখন। মুহুর্ত টা অবর্ণনীয়। এখনও মিথি লজ্জা পাচ্ছে। বাসায় আসার পর বারবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের অধর জোড়া দেখছে। শুধু দেখছে বললে ভুল হবে, যতবার দেখছে ততবারই লজ্জায় লাল হচ্ছে। দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে সে লজ্জা নিবারণের চেষ্টা করছে। কিন্তু, পারছে কই? লজ্জা তো তার আর পিছু ছাড়ছে না।
.
.
বর্ষার শেষ সময়। বৃষ্টির বেগ কমেছে কিছুটা। আকাশে শুভ্র সাদা মেঘ। দূরের মাঠগুলোতে কাশফুলগুলো মাথা চেরে উঠছে। শরৎ আসবে বলে..।
.
বাড়িতে আজ হৈ চৈ। নৈরিথ ব্যস্ত হয়ে এদিক ওদিক ছুটছে। তবে মাঝে মাঝে আবার একটু বিরতি নিয়ে তার প্রেয়সী কে দেখতে ভুলছে না যেন। মিথিও ভীষণ ব্যস্ত, নেহা কে সাজাতে। বাড়িতে মেহমান আসছে। নতুন আত্মীয়, সম্বন্ধ পাকা করবে। নেহার মুখের মিষ্টি হাসিটা যেন আজ তার পিছুই ছাড়ছে না। ভালোবাসার পূর্ণতায় যে সুখ রয়েছে সেই সুখ আর অন্য কিছুতে নেই। মিথিও আজ ভীষণ খুশি। অবশেষে সবকিছু ভালো ভাবে হচ্ছে। নেহা আর নৈরিথ যেখানে খুশি সেখানে মিথির খুশিও অনিবার্য। নেহাকে সাজিয়ে মাত্রই নৈরিথের রুমে এসেছে মিথি। এই বাড়িতে এর আগে অনেকবার এলেও এই রুমটাতে কখনো আসা হয়নি তার। যেন একটা সুখের খনি এই রুমটা। আর কিছুদিন পরই সেও এই রুমটার ভাগীদার হয়ে যাবে। উত্তরের দেয়ালটায় নৈরিথের বেশ বড়ো একটা ছবি টানানো। মিথি বেশ মনোযোগ দিয়ে সেটা দেখছে। হয়তো তার কলেজ লাইফের ছবি এটা। ইশ, সেসময়ও মারাত্মক ছিল। না জানি তখন কত মেয়ে তাকে প্রপোস করেছিল। মিথির হিংসে হচ্ছে। আবার ভালোও লাগছে। তার বর টা ডেশিং। একেবারে তাকিয়ে থাকার মতো। মনে মনে খুব খুশি হলো সে। তাকিয়ে রইল গভীর ভাবে। ঠিক সেই সময়ই সে কারোর উপস্থিতি টের পেল। অনুভব করলো সেই মানুষটা তার খুব কাছে। এতটাই কাছে যে তার উষ্ণ শ্বাস প্রশ্বাসগুলো ইতিমধ্যেই তার মধ্যকার ধুকধুকানি বাড়িয়ে দিয়েছে। মিথি পেছন ফিরে তাকাতেই নৈরিথ তার কোমর ছড়িয়ে ধরল। মিথি চমকে গেল। অপ্রস্তুত হেসে বললো,
‘আপনি?’
নৈরিথে বাঁকা হেসে বললো,
‘রুম টা যেহেতু আবার সেহেতু আমিই থাকব, তাই না?’
মিথি বোকার মতো মাথা নাড়াল। নৈরিথ তখন তার কোমর টা আরো শক্ত করে জড়িয়ে তার কিছুটা কাছে নিয়ে এল। ঘোর লাগা কন্ঠে বলে উঠল,
‘সুন্দর লাগছে।’
মিথি যেন নিশ্বাস নিতে ভুলে যাচ্ছে। সামন্য সুন্দর বলাতেই দম আটকে আসছে তার। এর থেকে বেশি কিছু বললে হয়তো সে মরেই যাবে। মিথি কাঁপা কাঁপা দৃষ্টিতে তাকাল। মৃদু সুরে বললো,
‘আপনাকেও।’
নৈরিথ হাসল। বললো,
‘ফর্মালিটি দেখাচ্ছো?’
মিথি অনুনয়ের সুরে বললো,
‘না না সত্যিই সুন্দর লাগছে। আর সত্যি বলতে আপনাকে বরাবরই সুন্দর লাগে।’
মিথি কথাটা শেষ করে মাথা নিচু করে ফেলল। ছোট চুলগুলো তখন তার কপালে এসে পড়ল। নৈরিথ সেই চুলগুলো যত্ন করে কানের পিছে গুঁজে দিয়ে বললো,
‘যে যাকে ভালোবাসে, তার চোখে সে বরাবরই সুন্দর থাকে। যেমন আমার চোখে তুমি আর তোমার চোখে আমি।’
মিথি তখন তাকাল। বললো,
‘এই ছবিটাতে আপনাকে আরো বেশি সুন্দর লাগছে। এটা কি আপনার কলেজ লাইফের ছবি?’
নৈরিথ মিথির পেছনের ছবিটার দিকে তাকাল। বললো,
‘হ্যাঁ, কলেজে থাকা অবস্থায় একবার পিকনিকে গিয়েছিলাম সেখানে গিয়েই ছবিটা তোলা। তবে ছবিটা আমার এক ফ্রেন্ড তুলেছিল। তার কাছেই ছবিটা ছিল। তার পরের বছর আবার আমার জন্মদিনে সে আমাকে এটা ফ্রেম করে গিফ্ট করে। বেশ পছন্দ হয়েছিল, তাই এখনও যত্ন করে রেখে দিয়েছি। তবে ওকে রাখতে পারেনি। তার দুবছর পরেই একটা কার এক্সিডেন্টে ও মারা যায়। আর জানতো তারপর থেকে আজ অবধি আমার আর কোনো ফ্রেন্ড হয়নি। আমি বানায়নি। ওর জায়গাটা যে আমি আর কাউকে দিতে পারতাম না।’
নৈরিথ থমকে যায়। নিশ্বাস নেয় ঘন ঘন। মিথি নিষ্পলক চোখে চেয়ে থাকে তার মুখপানে। নৈরিথের চোখের কোণটা যেন টলমল করছে। সে কি কেঁদে ফেলবে? কিন্তু, ছেলেদের তো কাঁদতে নেই। নৈরিথও তাই কাঁদল না। বরং হাসল। বললো,
‘নিচে চলো, মেহমানরা এখনই চলে আসবেন।’
এইবলে নৈরিথ মিথিকে ছেড়ে নিচে চলে যায়। মিথি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবে, ‘ইশ, নৈরিথও যদি তার মতো একটু কাঁদতে পারতো। তাহলে হয়তো তার মনটাও হালকা হতো। কিন্তু আফসোস! ছেলেদের চোখে মেঘ জমলেও সেই মেঘ থেকে বৃষ্টি ঝড়ে না।’
.
.
সাদ তার পুরো পরিবার নিয়ে নেহাদের বাসায় এসেছে। সাদরে নৈরিথ তাদের বরণ করে নিল। নেহার মা বাবা নতুন কুটুমদের আপ্যায়নে ব্যতি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মিথি ব্যস্ত হয়ে পড়ল নাস্তার আয়োজনে। কিছুটা সময় যাওয়ার পর সাদের মা বাবা এবার পাত্রী দেখতে চাইলেন। মিথি তখন সেখান থেকে উঠে নেহার রুমে এল তাকে নিতে। মিথিকে দেখা মাত্রই নেহা মাথায় কাপড় টা ভালো করে টেনে দিয়ে বললো,
‘আমাকে ডেকেছে? চল চল।’
মিথি ব্রু কুঁচকে বললো,
‘এই মেয়ে তোর তো দেখছি খুব তাড়া। আজব তো! নিচে তোর হবু শ্বশুর বাড়ির লোকজন আছে। তোকে দেখতে এসেছেন উনারা। কই একটু লজ্জা পাবি, লাজুক লাজুক হাসি দিবি তা না করে তুই চল চল করছিস কেন? এত কিসের তাড়া তোর?’
নেহা দাঁত কেলিয়ে হেসে বললো,
‘আরে দোস্ত, বুঝোনা কেন? নিচে আমার কুটুস টা আমার জন্য অপেক্ষা করছে না। ওকে দেখার জন্যই তো আমার আর তর সইছে না।’
মিথি বিরক্ত হয়ে বললো,
‘এই কুটুস টা আবার কে?’
‘উফ, বুঝিস না। আমি সাদের কথা বলছি।’
‘সিরিয়াসলি! টুকুস?’
‘হ্যাঁ, টুকুস। এখন এত কথা না বলে চলতো।’
মিথি জোরে নিশ্বাস ফেলল। নেহাকে আলতো করে ধরে বললো,
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, চল চল তোর টুকুসের কাছে যাই।’
নেহা কে নিয়ে গিয়ে একটা সোফায় বসালো মিথি। সাদের পাশে। নেহা কে এক পলক দেখেই সাদের হৃদ কম্পন বেড়ে গিয়েছে। কালো রঙের ভারি পাথরের শাড়িতে মারাত্মক লাগছে তাকে। সাদ পারছে না, যেন যেন বারবার তার বেশরম চোখগুলো নেহার দিকেই যাচ্ছে। নেহারও সেইম অবস্থা। না পারছে দেখতে, না পারছে চোখ সরিয়ে রাখতে।
.
অনেক কথাবার্তা হলো। দুই পক্ষেরই সবকিছু পছন্দ হলো। বিয়ের কথাও পাকাপাকি হয়ে গেল। সামনের মাসেই বিয়ে। তার আগে মিথি কে এই বাড়িতে আনতে হবে। আর তারপরই তাদের বিয়ের আয়োজন শুরু হবে।
.
বাতাসে আজ খুশির ঘ্রাণ বইছে। চারদিকে আনন্দের মেলা বসেছে। মিষ্টি নিয়ে হুড়াহুড়ি লেগেছে। নেহা আর সাদ খুশি হয়েছে। খুশি হয়েছে মিথি আর নৈরিথও। তাদের মতো পূর্ণতা পেয়েছে সাদ আর নেহার ভালোবাসাও। নৈরিথের চোখের অনুরাগে মিথি যেভাবে ডুবেছিল নেহার গভীরতায় সাদও সেইভাবে ডুবেছে। পূর্ণতা পেয়েছে দুই জোড়া ভালোবাসা। পূর্ণতা পেয়েছে ‘তুমি’ নামক সত্তাটাও। সত্যিই এই ভালোবাসা টা ‘#তোমাতেই_পরিপূর্ণ’।
___________________সমাপ্ত___________________
(