তোমারই আছি আমি
পর্ব-১৯
Sara Mehjabin
ফ্লাশব্যাক
ভার্সিটির ওয়াশরুমের দিকের জায়গাটা বেশ নির্জন। সাধারণ দরকার ছাড়া কেউ তেমন আসে না। সারা ওয়াশরুমের কাছাকাছি আসতেই কেউ একজন ওকে জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে নেয় এবং তার আগে সাদা রঙের কাপড়ে ওর মুখ চেপে ধরে। কাপড়টায় অদ্ভুত গন্ধ ছিল; নাকের কাছে ধরতেই কেমন নেশা নেশা লাগছিল। সারা টের পায় তার অচেতন শরীরটা কোলে নিয়ে লোকটা হেঁটে চলে যাচ্ছে। এর বেশি কিছু বোঝার আগেই তার চোখদুটো বন্ধ হয়ে আসে।
এরপর যখন আমার জ্ঞান ফিরল নিজেকে সম্পূর্ণ অচেনা একটা রুমে আবিষ্কার করি। শরীরটা ভীষণ খারাপ লাগছিল। এতোটাই কষ্ট হচ্ছিল কিছু নিয়ে ভাবা বা চিন্তা করার মতো অবস্থায় ছিলাম না। শুধু টের পাচ্ছিলাম একজন পরম যত্নে তার বুকে জড়িয়ে রেখেছে। আস্তে আস্তে চুলে কারো হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম। ভীষণ চেনা সেই স্পর্শে সারাটা শরীর আমার শিউরে ওঠছিল। আমি অর্ধেক অচেতন অবস্থায় বারবার কি বলছিলাম মনে নেই কিন্তু প্রচুর পানি পিপাসা পাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল পানি না পেলে আমি মরেই যাব। তারপরেই সে আমার মাথাটা বুকে ঠেস দিয়ে পানির গ্লাসটা মুখের সামনে ধরে। আমার পানিটুকু খাওয়ারও শক্তি কুলাচ্ছিল না তখন। সে আমাকে পানি খাইয়ে দেয়। তারপর হামলে পড়ে ভালবাসার পরশ আঁকতে থাকে চুলে কপালজুড়ে। হাতদুটো টেনে নিয়ে চুমু খাওয়ার সময় তার চোখের পানির পরশ পাই। বুঝতে পারি সে কাঁদছে। কিন্তু কেন?
আবছা আবছা কয়েকটা কথা কানে আসছিল, আমায় মাফ করে দিস,,মাফ করে দিস পুতুল। তোকে আমি আগলে রাখতে পারি নি। আমি থাকতেও ওই শয়তানটা বারবার তোর জীবনে ঢুকে পড়ছে,,আমি কিচ্ছু করতে পারছি না। কিচ্ছু না।
বলেই খুব জোরে শব্দ করল। অনেকটা দেয়ালে জোরে জোরে ঘুষি দেওয়ার মতো।
” শেষ করে ফেলব। ঐ শয়তান আজ যা করতে চেয়েছে তার পরিনাম ওকে ভোগ করতেই হবে। আই প্রমিস পুতুল যে চোখ তোর দিকে তাকিয়েছে ঐ চোখকে আর বেশিদিন দুনিয়া দেখতে হবে না। ও তোর ক্ষতি করতে আসে! আকাশের কলিজা ধরে টান দেয় এতোটা সাহস!! খুন করে ফেলব পুতুল ওকে,,,তোকে কষ্ট দেওয়ার স্পর্ধা করার শাস্তি ওকে পেতেই হবে।”
পায়ের কাছে বসে কথাগুলো বলে ঠিক আগের মতোই পায়ে চুমু খেতে হামলে পড়ল।
এরপর আমার আর কিছু মনে নেই। যখন তাকালাম দেখি একটা চেয়ারে বসা। আমার পায়ের কাছে একজন মাথা নিচু করে বসে গভীর মনোযোগে কিছু করছে। ভালো করে তাকাতেই বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠল। আকাশভাইয়া! আজ না ওনার বিয়ে! তারমানে আকাশভাইয়া আমাকে উঠিয়ে নিয়ে এসেছে!!
: একি, আপনি এখানে কেন? আপনার না বিয়ে আজকে?
আকাশভাইয়া আমার কথার কোন জবাব না দিয়ে ডানপায়ের মল পড়ানো শেষ করে বামপা’টা হাঁটুর ওপর তুলে মল পড়াতে লাগল। নিজের সাজসজ্জা দেখে আমি অবাকের অতিশয্যে পৌঁছে গেছি। ভীষণ সুন্দরভাবে গাঢ় লাল বেনারসি পড়ানো। নতুন বৌদের মতো আমার গায়েভর্তি গহনা। ঠিক ঐদিন বাসায় যেমন হয়েছিল। তাহলে কি এইসব আকাশভাই…। আমার সঙ্গে কি হচ্ছে কেন হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না আর। জীবনটা কেন আমার একটুও স্বাভাবিক নয়?? যতবার অতীতটাকে ভোলার চেষ্টা করি ততবার এই লোকটা আমার জীবনে জড়িয়ে যায়। সে কি চায় আমি কিছুই বুঝতে পারি না। আর এখন যা হচ্ছে তার কোন মানেই আমি খুঁজে পাচ্ছি না। শুধু মন থেকে একটাই ইঙ্গিত আসছে যা হচ্ছে ভালো হচ্ছে না। আমি একটি বিশাল ঝড়ের মুখোমুখি হতে চলেছি এবং তা অতি দ্রুত।
আকাশভাইয়া একবার আমার ভীত চাহনির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। হাটু থেকে পা’টা নামিয়ে শাড়ির নিচের দিকটা ঠিকঠাক করতে থাকে। আমি শুধু অবাক হয়ে তার কার্যক্রম দেখছি। সে কি করতে চাইছে
আমি কিছুই বুঝছি না।
আকাশভাইয়া আমার পিছনে গিয়ে চিরুনি দিয়ে চুল আচড়ে দিল। বেলীফুলের মালা পেঁচিয়ে দিল। তারপর কানের পাশে গোলাপ কুজে দিয়ে বলে, লক্ষী বৌ আমার। তারপর সেখানটায় একটা ছোট্ট করে ভালবাসার পরশ এঁকে দেয়। আমার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। মানুষটার ছোঁয়া পেলে আমি স্থির থাকতে পারি না। আবেগকে বাঁধ মানাতে চাইলেও তা আর পারি না। মানুষটার সমস্ত দোষ-ত্রুটি অপরাধ ভুলে ইচ্ছা করে তার বুকটা জুড়ে বিচরন করতে। কিন্তু না শক্ত হতে হবে আমায়। সে আমার নয়; সে আজ অন্য কারো। তার জন্য বধূ সাজে অপেক্ষা করছে কেউ। তার ওপর আমার অধিকার নেই।
: ছাড়ুন আকাশভাই প্লিজ। কেন তুলে এনেছেন আমাকে? আর এইসব সাজগোজ কে আমাকে করিয়েছে? আমি এখানে থাকব না। যেতে দিন আমাকে।
আকাশভাইয়া আবারো কিছু না বলে আমার মুখের সামনে একটা আয়না ধরে,
: দ্যাখ তো পুতুল,, আমার বৌটাকে কেমন সাজিয়েছি? মিষ্টি না আমার বৌ?
মুখের সামনে থেকে আয়নাটা সরিয়ে পেছনে ফিরে উঠে দাঁড়ালাম। চোখমুখ কঠিনভাবে বললাম, আপনি এইসব কি বলছেন? আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন কেন?
: আমার বৌ করতে নিয়ে এসেছি তোকে।
যদিও বৌ করার কিচ্ছু নেই। তুই আসলেও আমার বৌ। আমার সত্যিকারের বৌ। মনে আছে পুতুল আজকের দিনটার কথা। আমাদের বিয়ে হয়েছিল আজ। সাত বছরের বিয়ে আমাদের। অথচ স্বামী-স্ত্রী হয়ে একটা দিন-ও কাটাতে পারি নি। আমরা আবার আজকে বিয়ে করব পুতুল। আমাদের জীবনের সবচেয়ে বিশেষ দিনটা আমাদের সারাজীবনের নামে একত্রিত হওয়ার সাক্ষী হবে। তোকে আবার বিয়ে করব আমার পুতুল।
আকাশভাইয়ার কথাগুলো শোনার পর আমি এমন একটা কাজ করলাম যা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। আকাশভাইয়াকে ঠাস করে একটা চড় মারলাম। আর সহ্য হচ্ছিল না আমার! একটা মানুষ কত নিচু হতে পারে! কত অভিনয় জানতে পারে! সে আসলে চায় কি? সবাইকে নিয়ে খেলবে,,,আর যখন খেলা শেষ হবে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। পরে আবার যখন মন চাইবে কাছে টেনে নেবে। আর সে যখন যা চাইবে আমাকে তাই করতে হবে! হায় খোদা! এই মানুষটাকেই আমি এতো ভালবাসি কেন যার মধ্যে কোনো মনুষ্যত্বই নেই! কেন হাজার চেষ্টা করেও তার প্রতি ঘৃনা আনতে পারি না।
: পুতুল আমি পারব না। তোর জায়গায় আমার কাউকে সহ্য হবে না। তোর অধিকারে আমি কারো ভাগ মেনে নিতে পারব না। এই যে আমি, আমার দেহ আমার মন সবটাই তোর। এতে আর কারো অধিকার নেই; আমার নিজেরো না। আমি তোর সব অধিকার তোর হাতে তুলে দিয়ে শুধু আমার বৌকে ফেরত চাই। আমি কোনদিন তোর জিনিস কাউকে কেড়ে নিতে দেই নি আজকেও দিব না। আমি শুধু তোর হবো। প্লিজ সুযোগ দে আমায় একবার,, একবার শুধু তোর করে নে। বিশ্বাস কর্ আজ-ও #তোরই_আছি_আমি।
আকাশভাইয়া মাটিতে হাটু মুড়ে বসে আমার পেটে মুখ গুজে কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিল। আমি তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিজেও সরে গেলাম। অথচ ভেতরে ভেতরে কষ্টে বুক ভেঙে যাচ্ছে। ভাইয়ার চোখে কখনো একফোঁটা পানি দেখি নি। আজকে কিরকমভাবে কাঁদল। তার এরকম অসহায়ভাবে চাওয়া দেখলে আমার কতটা কষ্ট হয় তা কি সে বোঝে?
: পুতুল এককা সুযোগ দে বৌ। আমি যা যা করেছি এতদিন সব বাধ্য হয়ে। তোকে সব বলব। তোকে বলার সময় হয়েছে পুতুল। প্লিজ বিয়ে কর্ আমায়। ফিরে আয় আমার জীবনে।
আমি কোন কথাই বললাম না। অনেক কষ্টে চলে আসা কান্নাটাকে আটকালাম।
আকাশভাইয়া আমার সামনে এসে আমার হাতটা ধরে, পুতুল আমি জানি অনেক অন্যায় করেছি তোর সাথে। খুব কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু তোকে কষ্ট দিয়ে আমি তোরচেয়ে বেশি কষ্ট পাই বিশ্বাস কর্। আমাকে এসব করতে হয়েছে পুতুল। আমি তোকে এখনো কিছু বুঝিয়ে বলতে পারব না কিন্তু যা করেছি তোর জন্য-ই করেছি। আমার কাছে আমার ভালবাসার চেয়ে তোর মূল্য অনেক বেশি রে। তোকে পাওয়ার চেয়ে তোর ভালো থাকাতেই আমার সুখ। কিন্তু আর নয় আমি বুঝতে পেরেছি আমার ভালবাসার জোর থাকলে আমার বুক থেকে আমার প্রেয়সীকে আঘাত করার সাধ্য কারো নেই। কাছের জনকে দূরে ঠেলে নয় বরং কাছে রেখেই রক্ষা করতে হয়। আমি জানি তোর মনে আমার জন্য অনেক ঘৃনা অনেক রাগ তাও বলব আমায় ভুল বুঝিস না। একটাবার শুধু একটাবার বল্ আমায় বিয়ে করবি। বল্ না,,,
: যদি না করি তাহলে কি করবেন? জোর করবেন? যেভাবে জোর করে তুলে এনেছেন? সেইভাবে বিয়ে করবেন জোর করে? তাই তো?
: না রে,,আমি তোকে জোর করবো না। তুই চলে যেতে চাইলে এক্ষুনি যেতে পারিস। দরজা খোলা আছে।
আমার গালে হাত রেখে কথাগুলো বলে দরজা দিকে নির্দেশ করল। দেখলাম ঘরের দরজা সত্যিই খোলা।
আমি কয়েক পা করে দরজার কাছে গিয়ে একবার ইচ্ছা হলো শেষবারের মতো ওকে দেখি। আজের পর ও অন্য কারো। পেছন ঘুরতে যা দেখলাম তা আমি সত্যিই চিন্তা করি নি।
আকাশভাইয়া নিজের প্যান্টের পকেট থেকে একটা রিভলবার বের করে টেনে নিয়ে নিজের মাথা বরাবর তাক করল।
দৃশ্যটা দেখার পরবর্তী কয়েকটা মুহুর্ত আমি কি করেছিলাম জানি না সোজা আকাশভাইয়াকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। ঐ সময় মাথার ঠিক ছিল না আমার।
: ছাড়্,,তুই না চলে যাবি? যা চলে।
: হ্যা চলে তো যাব কিন্তু এইটা কি? এক্ষুনি সরান ওটা। ফেলে দিন বলছি নাহলে খুব খারাপ করব।
: যা খুশি করতে পারিস। কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিয়েই এসেছিলাম হয় তোকে নিজের করে নেব নাহয় নিজেকেই সরিয়ে দেব। প্রথমটা তোর হাতে ছিল কিন্তু দ্বিতীয়টা সম্পূর্ণ আমার হাতে। এইখানে তুই আমাকে বাধা দিতে পারবি না।
: একশোবার পারব্। দেখি আপনি আমার সামনে মরেন কিভাবে? আমি চিৎকার করে বলব এখানে একজন সুইসাইডের চেষ্টা করছে।
: লাভ নেই। আশেপাশে কেউ নেই।
আকাশভাইয়া হেসে রিভলবারটা আবার মাথা বরাবর রাখল। ভয়ে আমার হাত-পা কাঁপছে। আকাশভাইয়া গুলি চালাবে এমন মুহূর্তে আমি আকাশভাইয়ার পা জড়িয়ে ধরলাম।
: আকাশভাইয়া তোমার ওপর আমার কোন ঘৃনা নেই বিশ্বাস করো। আমাকে তুমি যত শাস্তি দিয়েছ সব মেনে নিয়েছি কিন্তু এতবড় শাস্তি দিও না। আমি মানতে পারব না।
আকাশভাইয়া আমার পাশে বসে আমার অশ্রুভেজা গালটা হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে, আমাকে বিয়ে করবি পুতুল? বৌ হয়ে থাকবি আমার বুকে? আমার সব ভুলগুলো এভাবেই শুধরে দিবি সারাজীবন?
আবেগের বশে কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দিলাম, তুমি যা বলবে তাই। তাই করব আমি।
: তাহলে আয় আমার সঙ্গে।
আকালভাইয়ার সঙ্গে ঐ রুমেই আমি রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করে দিলাম। আইনিভাবে আকাশের স্ত্রী হয়ে গেলাম।
তারপর আকাশ আমাকে গাড়ি দিয়ে একটা পার্লারের সামনে নিয়ে এলো। সেখান থেকে ঘোমটা দিয়ে আমাকে আরেকটা গাড়িতে তুলে দিল। তারপর সরাসরি মেধাদের বাড়িতে এলাম।
তারপর কি হলো তা সবারই জানা। এখন বুঝতে পারছি সবটাই নাটক করেছে আকাশ। কত বড় একটা ভুল করেছি তা এই মুহূর্তে বুঝতে পারছি। আকাশের জালে আবার আমি ফেঁসে গেলাম।
“পুতুল”
আকাশ দৌড়ে গিয়ে সারাকে ধরে। টলে পড়ে যাচ্ছিল সে। দীর্ঘসময়ের মানসিক চাপ, ভয় আতঙ্ক সব মিলিয়ে সারা আর চাপ নিতে পারছিল না। হঠাৎ করে সেখানেই অজ্ঞান হয়ে যায়।
“পুতুল,, এই পুতুল,, কথা বল্। তাকা দ্যাখ আমি তোর সামনে,,, ভয় পাচ্ছিস কেন পুতুল? আমি তো আছি। ওরা সবাই তোকে অপমান করার জবাব পাবে। ওদের জন্য অনেক বড় শাস্তি অপেক্ষা করছে। তুই ভেঙে যাচছিস কেন?
সারাকে কোলে তুলে আর কারো দিকে না তাকিয়ে আকাশ সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। সারাকে পেছনের সিটে শুইয়ে দ্রুত গাড়ি চালানো শুরু করে।
—————————————————————————-
হসপিটালের অন্ধকার একটা কেবিন। বিছানায় শয্যাশায়ী একজন যুবক। তার হাত ধরে বসা একটি তরুণী। আরেকটু দূরে দাঁড়ানো আরেকজন যুবক। অন্ধকারে কারো মুখ-ই দেখা যাচ্ছে না।
যুবকটি ঘর জুড়ে পায়চারি করছে। অন্ধকারেও তার চেহারায় স্পষ্ট ক্রোধ ফুটে উঠছে। হাঁটতে হাঁটতে যুবকটি হঠাৎ বেডসাইডের টেবিলের পাশে থাকা ফুলদানিটা তুলে ছুঁড়ে মারতে নেয়। মেয়েটি তার হাত ধরে আটকায়।
মেয়ে: তোমার সাহস তো কম না। জানো কত কষ্ট করে ঘুম পাড়িয়েছি ওকে।
ছেলে: তোমার ভালবাসার মানুষটার সামান্য ঘুম নিয়ে এতো চিন্তা আর আমি!! যাকে পাওয়ার জন্য এতো কিছু করলাম,, পয়েন্ট টু পয়েন্ট প্ল্যান সাজালাম যাতে কোন ভুল না হয়। আর শেষ পর্যন্ত ঐ আকাশটা ঠিকই এন্ট্রি নিয়ে নিল। ইচ্ছা করছে আকাশকে খুন করে ফেলি।
মেয়ে: হুম খুন। কিন্তু এখন না। অনেক হিসাব বাকি ওর সাথে। ও যেভাবে আমার ভালবাসার মানুষের জীবন শেষ করে দিয়েছে তেমনভাবে ওর ভালবাসার মানুষকে আমি শেষ করে দেব। ওর কারণে শুধুমাত্র ওর কারণে আমার —- এর এই অবস্থা। আমি ওকে ছাড়ব না।
ছেলে: আমিও ওকে ছাড়ব না। ওর কারণে সারাকে বারবার পেয়েও আমি পাই না। সারা এখনো ঐ আকাশকে ভালবাসে। আমি ওকে এমন ভালোবাসব ওর মন থেকে আকাশ নামটা চিরতরে মুছে যাবে। শেষমুহূর্তে ঐ আকাশটা এসে সব ভেস্তে দিল। শিট। আপুর প্ল্যানমতো সারাকে উঠিয়ে এনেছিলাম। কারন আপু আকাশের ভেতরের প্ল্যান বুঝতে পেরেছিল। তাই আপু সারাকে তুলে এনে আকাশকে ব্ল্যাকমেইল করতে। যেন আকাশ আপুকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। আর সারার চোখে আকাশ হয়ে যাক ভিলেন। স্বাভাবিকভাবেই আকাশকে সারা যেমন ভালবাসে আপুর সঙ্গে বিয়ে হলে ও খুব ভেঙে পড়ত। সেই সময় ওর প্রয়োজন হতো খুব ভালো একজন বন্ধু, যে ওকে সাপোর্ট দিবে সবসময় ওর টেক-কেয়ার করবে। ও বলার আগেই ওর ইচ্ছা-অনিচ্ছা পূরণ করবে। আকাশ আমাদের সব প্ল্যান ভেস্তে দিয়েছে। এখন আপু কোথায় তাও জানি না।
মেয়ে: আমার আর তোমার উদ্দেশ্য এক। আকাশের ক্ষতি করা। তুমি চাও সারা আর আমি চাই প্রতিশোধ। শেষ করে দেব ঐ আকাশকে। একদম শেষ করে দেব।
ছেলে: হায় রে কপাল। এই আকাশ যদি তোমার মুখে এই কথাগুলো শুনত! তাহলে ওকে শেষ করার জন্য এত প্ল্যানের দরকার ছিল না বেচারা এমনিতেই হার্ট ফেইল করত। আচ্ছা আমার সাথে নাহয় আকাশের অনেক শত্রুতা। আকাশ আমার থেকে আমার সারাকে কেড়ে নিয়েছে কিন্তু তুমি– যার ক্ষতি করার জন্য আমার সাথে হাত মিলিয়েছ সে তোমাকে কতটা ভালবাসে চিন্তা করতে পারো!
মেয়ে: না ও ভালবাসে না আমাকে। আমার জন্য একটুকুও চিন্তা করলে পারত না আমার ভালবাসার মানুষটার ক্ষতি করতে। ও তো জানত আমি কতটা ভালবাসি নিবিড়কে। তাও ও শুধু সারার জন্য নিবিড়ের এতো বড় ক্ষতি করেছে। ওর কাছে সারাই সবচেয়ে বড় ; সারাই সবার আগে। আমার কষ্টের কথা একবারো ভাবে নি। স্বার্থপর একটা।। আমি ওকে কখনো ক্ষমা করব না।
মেয়েটি কাঁদতে থাকে। বিছানায় শোয়া অসুস্থ ছেলেটির বুকে পড়ে। আর পাশের ছেলেটি মেয়েটির মাথায় শান্তনা দেয়ার ভঙ্গিতে হাত রাখে। বিড়বিড় করে বলে, বোকা মেয়ে। যে কথাটা মেয়েটির কানে পৌঁছালো না।
—————————————————————————–
: ডক্টর,,পুতুল আমার পুতুল ঠিক আছে তো?
: হুম,,, সবকিছু ঠিকই আছে। আমার ধারনা অতিরিক্ত স্ট্রেস থেকে এরকম সেন্সলেস হয়ে গেছে। চেষ্টা করবে তোমার ওয়াইফ যেন স্ট্রেস ফ্রি থাকে। আপাতত কোনরকম মানসিক চাপ ওর পক্ষে ভয়ানক ক্ষতিকর। ওর টেক কেয়ার করবে। একটা ইনজেকশন দেয়া আছে। দু’ঘন্টা ঘুমাবে,,,চেষ্টা করো কিছু খাওয়ানোর। আমি আসছি।
: এছাড়া ভয়ের কিছু নেই তো? ভীতকন্ঠে প্রশ্ন করে আকাশ।
: না তেমন ভয় নেই। আসছি আমি।
আকাশের বেডরুমে বিছানায় অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে সারা। মনিরা খান ওর মাথার কাছে বসে মাথায় হাত বুলাচ্ছেন। কি হচ্ছে তিনি কিছুই বুঝতে পারলেন না। সবাই আকাশের বিয়েতে গেলেও মনিরা রাগ করে যান নি। ঘরেই চুপচাপ বসে ছিলেন। অদ্বিতীও বড়মার মতো বিয়েতে যায় নি। কিন্তু ওর একটা দরকারি কাজে কিছুক্ষণ আগে বেরিয়ে গেছে। বাসায় শুধু মনিরা ও কাজের লোকজন। এমন সময় আকাশের গাড়ির সাউন্ড শুনেই রাগ করে দোতলায় উঠে যাচ্ছিলেন। তখনই আকাশ পাগলের মতো দৌড়ে বাড়িতে ঢুকে মা মা চিৎকার শুরু করল। মনিরা পেছনে ফিরে দেখেন আকাশের কোলে বৌবেশে সারা।
মনিরা: একি সারা তোর কোলে কেন? ওর এই অবস্থা কিভাবে? তুইবা ওকি কোথায় পেলি?
আকাশ: আম্মু আমি তোমাকে সব বলব। কিন্তু তুমি তো পুতুলের অবস্থা দেখছ ডক্টরকে কল করো আম্মু। প্লিজ।
মনিরা: হ্যা হ্যা করছি।
বর্তমান
মনিরা: আকাশ মেয়েটাকে তো ঘুম ভাঙলে কিছু খাওয়াতে বলল। আমি কিচেনে গেলাম। তুই একটু ওর কাছে থাক।
আকাশ: আচ্ছা আম্মু।
মনীরা চলে গেলে আকাশ বিছানার ধার ঘেষে বসে সারার হাতটা ধরল। মুখের কাছে নিয়ে আলতো চুমু খায়। চোখ থেকে অঝোরে পানি পড়ছে ওর। এই যন্ত্রণা আর সহ্য হচ্ছে না আকাশের। খুব ইচ্ছা করে সারাকে ভালবাসতে,,, খুব করে ভালবাসতে। ভালোবাসায় ভালবাসায় এতদিনের সব অনাদর-অবহেলা পুষিয়ে দিতে। কিন্তু বুকের ভেতর দলা পাকানো পাথরের মতো শক্ত অভিমানটা তাতে সায় দেয় না। সবসময় সারাকে তার থেকে দূর করে রাখছে সেই অভিমান। সারার প্রতি আকাশের প্রচণ্ড ভালোবাসা থাকলেও এক ভয়াবহ অভিমানে সেটা ঢাকা পড়ে গেছে।
অভিমানের ইতিহাস শুরু সাত বছর আগে,,,,,যে ঘটনাটা আকাশ-সারার সম্পর্কের মোড়টাই ঘুরিয়ে দিয়েছে।
চলবে
(লিখেছি)