তোমার প্রণয় নগরে
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব- ৩৩
(কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )
থমথমে বসে আছে সায়রা। চুল থেকে টপটপ পানি ঝরছে। চোখ মুখ অসম্ভব লাল। সায়রার মাথায় তোয়ালে মুড়িয়ে চুলের পানি ঝরাচ্ছে রিদ্ধি। রুম জুরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে সবাই। সবার দৃষ্টি সায়রার উপর। রিদ্ধি আলতো আওয়াজে বলল,
–” তুই চিন্তা করিস না সায়রা। ঐ লোকটার চৌদ্দ গুষ্টির খোঁজখবর বের করে ফেলবে সায়ন। ঐ লোকটা আমাদের আরসাল নাকি উনাদের ইফতি ঠিক বেরিয়ে আসবে।”
রিদ্ধির কথা কানে তুলল না সায়রা। বেশ শান্ত আওয়াজে বলল সে,
–” আমি বিয়ের জন্য তৈরি দি। কাল সকালে ব্রেকফাস্টে আবির সাহেবকে আসতে বলো। আর শুনো, তুমি কি সাথে করে এক্সট্রা শাড়ি এনেছ? হাজার হোক পাকা দেখা শাড়ি না পড়লে বড্ড বেমানান দেখায় তাইনা!”
বিস্ময়ে সারা ঘর জুড়ে থমথমে নীরবতা বিরাজ করছে। রিদ্ধি হতভম্ব আওয়াজে প্রশ্ন ছুঁড়ল সায়রার দিকে,
–” পানির বদলে ওয়াশরুমের কল দিয়ে কি ওয়াইন বের হচ্ছিল সায়রা? এসব উল্টাপাল্টা কি বকছিস তুই। এতদিন কোন আশার ছাড়া যেই মানুষটার জন্য অপেক্ষা করেছিস, আজ যখন একটা আশার প্রদীপ জ্বলেছে এখন তুই হার মানছিস! বোন আমার ধাক্কাটা কি খুব বেশি লেগেছে। ডক্টরের কাছে নিয়ে যাবো তোকে !”
বিরক্ত হলো সায়রা। কন্ঠে বিরক্তি জড়িয়ে রুক্ষ আওয়াজে উত্তর দিলো,
–” আমি জানি, আমি কি করছি। যা করছি সজ্ঞানে করছি। এতদিন তোমরাই বিয়ের জন্য জোরাজোরি করেছ। আজ যখন আমি বিয়ের জন্য তৈরি, তোমরা পিছুপা হচ্ছ! তোমরা কল করবে? নাকি আমি আবির সাহেবকে কল করব! ছাড়ো আমিই কল করছি!”
রিদ্ধির হাত থেকে ফোন নিয়ে বারান্দায় চলে গেল সায়রা। সায়রার এমন স্বাভাবিক আচরণে হতভম্ব সবাই। এসব হচ্ছে কি!
.
সকাল সকাল শাড়ি পরে বেশ পরিপাটি ভাবে তৈরি হয়ে নিচতলায় রেস্টুরেন্টে অপেক্ষা করছে সায়রা। বারবার আশেপাশে চোখ বুলাচ্ছে। আচমকা সামনের চেয়ারটায় আবির এসে বসল। ঘোর কাটল সায়রার। চওড়া হেসে আবির বলল,
–” সরি, সরি লেট হয়ে গেল! খুব বেশি অপেক্ষা করাইনি তো!”
সায়রা কৃত্রিম হেসে না সূচক মাথা নাড়াল। বিস্তৃত হাসল। গাঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে ধীর আওয়াজে প্রশ্ন করল,
–” কেমন আছেন আপনি?”
–” হু, ভালো!”
সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে সায়রা আবারো আশেপাশে কাউকে খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আবির বিষয়টা লক্ষ করল। কিন্তু তেমন গুরুত্ব দিলো না।
–” আপনি কি নার্ভাস সায়রা! আমার সম্পর্কে কিছু জানার হলে আপনি সংকোচহীন জিজ্ঞেস করতে পারেন।”
সায়রা এবারো কৃত্রিম হাসল। আচমকা চোখ আটকাল রেস্টুরেন্টের দরজায়। ইফতি নামক লোকটাকে ঢুকতে দেখে বাঁকা হাসল সায়রা। আবিরের সাথে বেশ ফ্রেন্ডলি হেসে হেসে কথা বলতে লাগল যেন তার কতদিনের চেনা! ইফতি দূর থেকে লক্ষ করে চোখ কুঁচকে নিলো। আবিরের পেছনের টেবিলটায় সায়রার মুখোমুখি হয়ে বসল ইফতি। ইফতি লক্ষ করল সায়রার চেহারায় আজ অন্যরকম এক চমক। হাসি উজ্জ্বল মুখশ্রী। অন্যরকম এক সৌন্দর্য। শুধু সৌন্দর্য- ই না সাথে চাপা জেদও বটে। হঠাৎ এভাবে বদলে কেন মেয়েটা? কিছু কি আন্দাজ করতে পারল! কি চলছে সায়রার মনে! ইফতি ভাবল।
আবির সায়রার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
–” সায়নের বিয়েতে আপনাকে প্রথম দেখেছি সায়রা । সত্যি বলতে প্রথম দেখায় আমি আপনার মুগ্ধতায় আটকে গেছি। আপনার হাসি কথা ফেস এক্সপ্রেশন সব কিছু আমাকে এলোমেলো করে দিয়েছে। সেই বিয়েতেই আপনার বাড়িতে বিয়ের প্রপোজাল পাঠাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পরে সায়ন থেকে জানতে পারি আপনার বাগদান হয়ে গেছে।”
সায়রা মাথা নুয়ে চুপ করে আছে। আবির কিছুক্ষণ চুপ থাকে। আচমকা সায়রার এক হাত চেপে ধরে, করুন কন্ঠে আবার বলল,
–” বিশ্বাস করুন সায়রা, আমার আপনার অতীত নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ব্যথা নেই। আপনি আমাকে ভালো না বাসলেও কোন আক্ষেপ নেই। আপনি শুধু আমার হন। আমার চোখের সামনে থাকেন এতেই আমার শান্তি। আর কিছু চাইনা আমার।”
সায়রা আবিরের কথায় ইতস্ততবোধ করল। সে আবিরকে নিজের কার্য হাসিলের উদ্দেশ্যে ডেকেছে । কিন্তু আবিরের এই গভীর অনুভূতি সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই সায়রার। বেশ অবাক হয়েছে সেই সাথে নিজের উপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে তার। আবিরের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে যাবে সায়রা অমনি ইফতি এসে সায়রার হাত আবিরের হাত থেকে ছাড়িয়ে টেনে নিজের সাথে দাঁড় করাল। বিনাবাক্যে রেস্টুরেন্ট থেকে টেনে হিচড়ে সায়রাকে নিয়ে যাচ্ছে ইফতি। হতভম্ব আবির। বিস্ময়ের সপ্তম আকাশে! আটকানোর সাধ্যি কই তার! যতক্ষণে হুশ ফিরল আবিরের ততক্ষণে চোখের আড়ালে চলে গেছে তারা।
লোকটা সায়রাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। পেছন থেকে তেজি আওয়াজে প্রশ্ন ছুঁড়ল সায়রা,
–” এসব কি ধরনের অসভ্যতা! আপনি আমার হাত টেনে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন ইফতি! ছাড়ুন আমার হাত! ছাড়ুন বলছি!”
পেছন ফিরে সায়রার দিকে থমথমে ক্রোধিত দৃষ্টিতে তাকাল লোকটা। চুপ হয়ে গেল সায়রা, কিন্তু ক্ষান্ত হলো না। হাত ছাড়ানো আপ্রাণ চেষ্টা তার। সায়রার জোরাজোরিতে অতিষ্ঠ হয়ে লোকটা কাঁধে তুলে নিলো সায়রাকে, লিফটে চড়ল।
.
চুপচাপ বিছানার এক কোণে গুটিসুটি মেরে বসে আছে সায়রা। হাত মুখ বাঁধা। অশ্রুভারাক্রান্ত চোখে ক্রোধের রক্তিম আভা! সামনের মানুষটার আঁখি জোড়া ভীষণরকম শান্ত। গালে হাত ছোঁয়াতে গেলেই মুখ ফিরিয়ে নেয় সায়রা। ছোট নিশ্বাস ছাড়ল আরসাল। চুল গুলো কানের পেছনে গুজে দিতে দিতে বলল,
–” হ্যাঁ আমি- ই তোর আরসাল! আমাকে জেলাস ফিল করানোর জন্য এসব করেছিস, এই দেখ আমি সত্যি- ই জেলাস! ভীষণ জেলাস। এবার এই নাটকের ইতি টান! ঐ আবির দ্বিতীয়বার যেন তোর ত্রিসীমানায় না আসে।”
ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সায়রা। জোর গলায় কিছু বলতে চাইল, কিন্তু মুখ বাঁধা হওয়ায় আওয়াজ করতে পারল না। চোখ থেকে টপটপ পানি ঝরছে সায়রার। আরসাল এবার জোর করে কলে তুলে নিলো । সায়রার কপালের সাথে কপালে ঠেকিয়ে চোখ বুজে নিলো। আবেশিত আওয়াজে বলল,
–” তোর সাথে ঢাকা থেকে অদূর সিলেটে দেখা হওয়াটা টোটালি আনএক্সপেক্টেড। দেড়বছর পর তোকে এভাবে এতটা কাছে পাবো কল্পনাতীত ছিল। এক্সিডেন্টের পর লাস্ট একবছর চার মাস কোমাতে ছিলাম। আর দু’মাস আগে যখন কোমা থেকে ফিরলাম তখন আমার চারপাশের সবটাই বদলে গেছে। এলোমেলো হয়ে গেছে সব। না চাইতেও কৃতজ্ঞতাবশত একটা সম্পর্কে জড়িয়ে গেছি। তাই বলে এই না যে আমি তোদের ভুলে গেছি। এই দু মাসে এমন কোন দিন নেই যেদিন আমি তোর আর বাবা মায়ের খোঁজ নেইনি। প্রত্যেকটা দিন গলা কাটা মুরগীর মত ছটফট করছি আমি। আমাকে একটু সময় দে আমি এদিকটা গুছিয়ে তোদের কাছে ফিরে আসবো। কথা দিচ্ছি!”
সায়রা কাঁদছে তো কাঁদছেই। কান্নার বেগে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে সায়রার। হাত মুখের বাঁধন খুলে দিলো আরসাল। তড়াক করে আরসালের কোল থেকে উঠে দাঁড়াল সায়রা। আরসাল সায়রার দিকে এগিয়ে আসতেই চিৎকার করে বলল সায়রা,
–” রক্তের সম্পর্ক থেকে এই কৃতজ্ঞতাবশত সম্পর্ক দামী হয়ে গেল আপনার? এই দেড় বছর আমাদের কেমন কেটেছে ধারণা আছে আপনার? বাড়িতে বাবা মা কেমন করে বাঁচছে সেই সম্পর্কে বিন্দুমাত্র আইডিয়া আছে!”
–” উনাদের কাছে তুই আছিস! তাছাড়া অনেক কিছু আছে যা এখনি আমি তোকে ব্যাখ্যা করতে পারছিনা। আমি কেন এসব করছি প্লিজ এর কারণ জিজ্ঞেস করিস না। আমাকে একটু সময় দে, আর দুটো মাস! আমি সবটা এক্সপ্লেইন করব!”
কয়েক পলক স্থব্দ চেয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল সায়রা। আরসাল পা বাড়াতেই রাগে জিদে ইচ্ছেমত বুকে আঘাত করল সায়রা। শার্টের বোতাম ছিঁড়ে ফেলল আরসালের। সজোরে চিৎকার করে বলল,
–” আমার জীবনে কেন এসেছিলেন আপনি? কেন এভাবে এলোমেলো করে দিলেন আমাকে? আপনিহীন বেশ ভালো ছিলাম আমি। কেন খনিকের ভালোবাসার লোভ দেখিয়ে এক সমুদ্র কষ্ট দিলেন!”
আরসাল বেশ শান্ত দৃষ্টিতে সায়রার দিকে চেয়ে আছে। নিখুঁত ভাবে দেখছে এলোমেলো কাজল ল্যাপটানো সায়রাকে। সায়রা সেই কখন থেকে কেঁদে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। এসি রুমে ঘামে গা ভিজে আছে তার। অস্থির হয়ে গেছে। আরসাল আবারো কোলে তুলে নিলো। বুকে সজোরে আঘাত করছে সায়রা। এতে আরসালের পা থামল না। সায়রাকে বিছানায় বসিয়ে তার পায়ের কাছে বসল। একের পর এক অনবরত সায়রার হাতের পিঠে চুমু খেতে লাগল আরসাল। ঝাড়ি দিয়ে হাত সরিয়ে নিতে চাইল সায়রা। পারল না। শক্ত ভাবে চেপে ধরল আরসাল!
পিটপিট দৃষ্টিতে আরসালকে দেখছে সায়রা। অনেকটা বদলে গেছে আরসাল। ফর্মাল ড্রেসাপ, আর্মিদের মত খাটো খাটো চুল। কপালে বড় এক দাগ। বেশ গভীর ভাবে দেবে গেছে দাগটা। আচ্ছা এই দাগ কিসের? আগে তো ছিল না। এক্সিডেন্টের কি? আনমনে আরসালের কপালের দিকে হাত বাড়াল সায়রা। আলতো স্পর্শে দাগটা আঙ্গুল ছুঁয়ে দেখতে লাগল। চোখ উঁচিয়ে সায়রাকে দেখছে আরসাল। অকস্মাৎ সায়রার কোমর জড়িয়ে কোলে শাড়ির ভাজে মাথা রেখে চোখ বুজে নিলো আরসাল। ফিসফিস করে বলল সায়রা,
–” যত যাই করেন, আমি আপনাকে কোনদিন ক্ষমা করব না আরসাল! কোনদিন না”
শুনে মুচকি হাসল আরসাল। টু শব্দ করল না সায়রা। মূর্তির মত শক্ত হয়ে বসে রইল শুধু। ঘন্টা খানেক এভাবেই কাটল। হঠাৎ আরসালের ফোনটা বেজে উঠল। রিসিভ করে কানে ধরল আরসাল। অপর পাশ থেকে কি বলল শুনল না সায়রা। আরসাল সায়রার দিকে একবার তাকাল। ভ্রু কুঁচকে নিলো সায়রা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ফোনের অপর পাশের মানুষটাকে জবাব দিলো আরসাল,
— ” আসছি আমি”
ফোন কাটল। সায়রার দিকে এগিয়ে এসে আচমকা শক্ত করে জড়িয়ে ধরল আরসাল। দৃঢ় আওয়াজে বলল,
–” আমাকে এখন ফিরতে হবে। খুব তাড়াতাড়ি তোর কাছে ফিরে আসবো!”
সায়রা আবারো কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। আরসালের বুকে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে করুন কন্ঠে বলল,
–” এত কষ্ট! এত কষ্টই কি আমার পাওনা ছিল আরসাল? আমি আপনাকে কোনদিন ক্ষমা করব না। কোনদিন না!”
আরসাল হাতের মুঠো শক্ত করে নিলো। সায়রার কপালে গাঢ় করে চুমু এঁকে ভাঙ্গা আওয়াজে বলল, “সরি পুতুল বউ!”
চট করে সায়রা থেকে দূরে সরিয়ে হাতের পিঠে চোখ মুছতে মুছতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল আরসাল। ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়ল সায়রা। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
–” আরসাল!!!! আমি আপনাকে কোনদিন ক্ষমা করব না! ক্ষমা করব না!”
তোমার প্রণয় নগরে
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব- ৩৪
(কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )
আরসাল চলে গেছে। সায়রা ঢাকায় ফিরে এসেছে। সিলেট থেকে ফিরে নিজেকে একদম গুটিয়ে নিয়েছে। আগের চেয়ে আরো বেশি গম্ভীর নিশ্চুপ হয়ে গেছে। নিজের সবচেয়ে কাছের, প্রিয় মানুষটা থেকে এত বড় ধাক্কাটা মেনে নিতে পারেনি সায়রা। নির্বাক কষ্ট গুলো তার ভিতর কুরে কুরে খাচ্ছে। দহনে পুড়ছে সারাক্ষণ।
দুমাস কেটেছে। এই দুমাসে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে,
এই তো সাপ্তা দু এক বাদে তুর্জয় আরমিনের বিয়ে। শেষবার সিলেট থেকে ফিরে যখন তুর্জয় নিজের ভালোবাসা অনুভূতির স্বীকারোক্তি করেছিল, ফিরিয়ে দিতে পারেনি আরমিন। সে বেশ বুঝেছে যেই মানুষটা তার দুর্দিনে হাত বাড়িয়ে ছিল সেই মানুষটা আর যাই হোক কখনো তাকে ছেড়ে যাবেননা। দুই পরিবারের সম্মতিতে বেশ ধুমধাম আয়োজন করে বিয়ে হবে তাদের।
প্রতিদিনের মত আজও ঠিকঠিক বারটায় ফোনটা বেজে উঠল সায়রার। সে জেগেই ছিল। আজকাল দুচোখে ঘুম খুব কম বললেই হয়। দিন দিন সে কি নিশাচর হচ্ছে! কি জানি! ফোনের দিকে চোখ বুলাল, ‘ আননোন নাম্বার ‘! বুক চিড়ে চাপা নিশ্বাস বেরিয়ে এলো । সে জানে ‘আরসাল’ ফোন করেছে। কিন্তু কথা বলার মত বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই তার। সিলেট থেকে ফিরার পর আরসালের সাথে কথা বলেনি আর। এই দুমাসে বেশ কয়েকবার মুনতাহা বেগম আহনাফ সাহেবকে ফোন করেছে আরসাল। কিন্তু সায়রার সাথে কথা হয়নি একবারও। ফোন করলেও তুলেনি সায়রা। বুকে শক্ত এক অভিমান জমেছে। এই অভিমানের বরফ এত তাড়াতাড়ি গলবে না। আরসাল তার সাথে যা করেছে, তা ভীষণ জঘন্য। কারণ যাইহোক না কেন, সে এত তাড়াতাড়ি সব ভুলে ক্ষমা করতে পারবেনা আরসালকে। ভাবল সায়রা।
ফোন বাজছে তো বাজছেই! বেশ কয়েকবার বাজার পর বিরক্ত হয়ে ফোন তুলল সায়রা। অপর পাশ থেকে শান্ত আওয়াজ ভেসে এলো,
–” কি চাস মরে যাই? এমনিতেই তোর থেকে দূর ছটফট করছি সারাক্ষণ, তার উপর ফোনটাও তুলছিস না! আমার উপর তোর এত অভিমান, এত রাগ!”
উত্তর দিলো না সায়রা। বেশ কিছুক্ষণ উত্তরের আশা করল আরসাল। উত্তর মিলল না। পিনপতন নীরবতা, নীরবতা ভেঙে বলল আরসাল,
–” আগামীকাল অনেক বড় একটা দিন। সবটা ঠিকঠাক হলে খুব দ্রুত তোর কাছে ফিরব! ”
এবারো সায়রা চুপ রইল। আরসালের নিমিষ আওয়াজ,
–” শুনে খুশি হোসনি? কিছু বলবি না!”
এবার মুখ খুলল সায়রা। প্রত্যুত্তরে বলল,
–” আপনার জীবন আপনি কি করবেন, কি করবেন না আপনার সিদ্ধান্ত। এখানে আমি খুশি কি না তার প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে!”
অপর পাশ থেকে কোন উত্তর এলো না। সায়রা কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্ত স্বরে বলল,
— ” আমার ঘুম পাচ্ছে, রাখছি! ”
বলেই ফোন কাটল। নিশ্বাসের প্রচণ্ড উঠানামা। থরথর কাঁপছে সারা শরীর। পাশ ফিরে অস্থির দৃষ্টিতে দেয়ালে টানানো আরসালের বড় ছবিটার দিকে তাকাল। আঁখি জোড়া জলে ভরে এলো। ঠোঁটের কোণঘেঁষা তৃপ্ত হাসি সায়রার।
.
রাত এগারোটা। ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। চারিদিক বৃষ্টির ঝুমঝুম আওয়াজে নাচছে। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। চায়ের কাপ হাতে শুধু সায়রা জেগে। ঝুম বৃষ্টি ভেজা রাত আর সাথে চায়ের কাপ, বেশ দারুণ কম্বিনেশন! এই বৃষ্টি ভেজা রাতে পুরানো অতীত কুরাচ্ছে সায়রা। বছর দু এক আগে এমনি এক ঝুম বৃষ্টির রাতে বাড়ি ফিরেছিল আরসাল। মন বলছে আজ এমনি কিছুর পুনরাবৃত্তি হবে আবার! বৃষ্টির আঁচ জানালা গড়িয়ে গা ছুঁইছে, হুশ ফিরল সায়রার। ওড়না প্রায় ভিজে একাকার। ওড়নার থেকে পানি ছাড়াতে ছাড়াতে বিছানা অবধি আসলো। এমন সময়ই নিচের ডোর বেল বেজে উঠল। ভ্রু কুঁচকে এলো সায়রার। এই সময়, এত রাতে কে এলো! দ্রুত পায়ে সিড়ির দিকে পা বাড়াল। সায়রার আগেই মুনতাহা বেগম আহনাফ সাহেব বেরিয়ে এসেছে। কয়েক সিড়ি নিচে নামতেই পা থেমে গেল সায়রার। সায়রার বাবা মা বাকি সবাই ও এখানেই আছে। সাথে অচেনা মাঝবয়েসী একজন। ঘটনা কি জানতে সিড়ির দিকে বাড়াল কয়েক কদম বাড়াতেই আবারো থামল। চক্ষু তখন চড়কগাছ! ড্রাইং রুমে মাঝামাঝি সোফায় আরসাল বসে। বিদ্যুৎ চমকানোর মত চমকাল সে। হতভম্ব, কিংকত্র্তব্যবিমূঢ় সায়রা! শরীর কাঁপছে, মাথা ঘুরছে! নিজেকে সামাল দিতে শক্ত করে সিড়ির রেলিং চেপে দাঁড়াল। মাঝবয়েসী লোকটা কিছু বলছে, মূলত সবার দৃষ্টি উনার দিকেই। আরসাল মাথা নুয়ে চুপচাপ বসে। দূর থেকে স্পষ্ট কিছু শুনা যাচ্ছেনা। আরসালকে দেখে নিচের দিকে আর পা বাড়াল না সায়রা। দ্রুত পায়ে রুমে চলে গেল।
.
রাত তিনটা! থমথমে পায়ে ঘরের দিকে পা বাড়াল আরসাল। বৃষ্টি নেই। আকাশ এখন পরিষ্কার। মেঘেদের আড়ালে লুকিয়ে থাকা চাঁদটাও বেরিয়ে এসেছে। যার জ্যোৎস্নায় আলোকিত চারিদিক। বৃষ্টি স্নান স্নিগ্ধ পরিবেশ। জানালার পর্দা গুলো মৃদু হাওয়ায় দুলছে। চন্দ্রসুধা জানালা মাড়িয়ে বিছানায় পড়ছে। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে সায়রা। ফর্সা পিঠ স্পষ্ট ভেসে, এলোমেলো চুল গুলো বিছানায় ছড়িয়ে। রুমে কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে চোখ বুজে নিলো সায়রা। চোখের কোণ বেয়ে দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল বালিশে। হাঁটু গেড়ে সায়রার মুখোমুখি বসল আরসাল। গাঢ় দৃষ্টিতে দেখতে লাগল সায়রাকে। চাঁদের চাঁদনি চুয়ে চুয়ে পড়ছে তার মুখশ্রীতে। ভেজা চোখ, রক্তিম নাক। আঁখিপল্লব এখনো জলে ভিজে। আরসালের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো! ছুঁয়ে দিতে হাত বাড়াল আরসাল। অতি নিকটে সেই চিরচেনা ঘ্রাণকে অনুভব করে মুখ ফিরিয়ে নিলো সায়রা। দীর্ঘ দেড়বছর যেই মানুষটা তাকে ছেড়ে থাকতে পেরেছ, এখনো ঠিক পারবে! এক রাশ অভিমানে চোখ বেয়ে অঝোরে জল পড়তে লাগল সায়রা। চাই না এই মানুষটাকে তার, চাইনা আর!
আচমকা সায়রাকে কোলে তুলে নিলো আরসাল। শক্ত ভাবে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো। চোখমুখ কুঁচকে নিলো, বিন্দুমাত্র নড়চড় করল না সায়রা। নিজেকে শক্তভাবে চেপে রাখল। নিমিষ আওয়াজে বলল আরসাল,
–” আমি তোর অপরাধী! শাস্তি দেওয়ার সম্পূর্ণ অধিকার আছে তোর। তাই বলে এভাবে মুখ ফিরিয়ে নিস না! ছটফট করতে করতে মরে যাবো আমি।”
কোন প্রতিক্রিয়া করল না সায়রা। আগের মতই নিজেকে শক্ত ভাবে চেপে রাখল। আরসাল আবার বলল,
–” আমাকে নিজের দিক এক্সপ্লেইন করার একটা সুযোগ দিবি সায়রা?”
উত্তর দিলো না সায়রা। সায়রার মৌনতাকে সম্মতির লক্ষণ মেনে নিলো আরসাল। নিজে থেকে বলতে শুরু করল,
–” দেড়বছর আগে সেই দিন বাড়ি ফেরার পথে গাড়ীর ব্রেক ফেইল হয়ে এক্সিডেন্ট হয় আমার। নিরিবিলি রাস্তা হওয়ায় এক্সিডেন্টের পর ঘন্টা খানেক সেখানে সেভাবেই পরে ছিলাম। সাহায্যের জন্য কাউকে পাইনি। সেই এক্সিডেন্টের রাস্তায় রিটায়ার মেজর তাহির সাহেব উনার অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে হসপিটালে যাচ্ছিলেন। এক্সিডেন্ট দেখে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন তিনি। হসপিটালে নিয়ে যায়। ততক্ষণে কোমায় চলে গেছি আমি। এক বছর চার মাস পর যখন কোমার থেকে ফিরলাম, তখন আমার চারিদিক পুরোপুরি পাল্টে গেছে। মেজর তাহির আহমেদের স্ত্রী মানসিক ভারসাম্যহীন, আমাকে উনার মৃত ছেলে ইফতি মানতে শুরু করেছে। আমি সবটা ক্লিয়ার করতে চাইলে তাহির সাহেব বাঁধা দেয় আমাকে, তিনি জানান, আমার এক্সিডেন্টের ঠিক ছয় মাস আগে তার বিয়ের কিছুদিন আগে এক এক্সিডেন্টে ইফতি মারা যায়। একমাত্র সন্তানকে হারানোর শোকে মেজরের স্ত্রী মানসিক ভারসাম্য হারায়। এক্সিডেন্টের দিন আমাকে দেখে মেজরের স্ত্রী নিজের মৃত ছেলে ইফতি ভাবতে শুরু করে। কারণ ইফতিরও ঠিক একই ভাবে এক্সিডেন্ট হয়েছিল। উনার হার্ট ডিজিজ ছিল, অবস্থা ছিল ক্রিটিকাল! খুব শীঘ্রই অপারেশন করার কথা ছিল। মানসিক ভারসাম্যহীন হওয়ায় ডক্টর তা করতে সাহস জোটাতে পারেনি। আমাকে পেয়ে অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তাই মেজর আর আমার ঠিকানা খুঁজে বের করেনি। স্ত্রীর প্রাণ বাঁচাতে বিষয়টা গোপন রেখেছিল। কোমা থেকে ফিরে যখন বাড়ি ফিরতে চেয়েছিলাম। তখন আমার কাছে খুব করে অনুরোধ করেন মেজর সাহেব। আমি যেন অপারেশন অবধি ইফতি হয়ে উনাদের কাছে থাকি। অপারেশনের বাঁচার চান্স ছিল অল্প, তাই যতটুকু সময় উনার হাতে আছে উনি যেন হাসি খুশি থাকে, আমি উনার কাছে উনার ছেলে হয়ে থাকি। মেজর সাহেবের অনুরোধ ফেলতে পারিনি আমি। ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে। বাবা মা তুই নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছিলি অনেকটাই। যোগাযোগ করে ব্যাপারটা ঘাটতে চাইনি। তাই আমিও আর সামনে আসিনি। চারটা মাসের ব্যাপারই তো! এই চারটা মাস নিজেকে আড়াল করে রাখতে চেয়েছিলাম, অপারেশন শেষে আমি নিজেই তোদের কাছে ফিরে আসতাম।
কিন্তু ঢাকা থেকে অদূর সিলেটে যে হুট করে তোর সাথে দেখা হয়ে যাবে। তা আমার কল্পনাতীত ছিল। হ্যাঁ সেই রাতে আমিই তোর পাশে ছিলাম! সেদিন উনার সামনে অচেনাদের মত আচরণ করতে বাধ্য হয়েছি।
সেদিন যদি সিলেটে এভাবে হুট করে দেখা না হতো হয়তো তোর এতটা রাগ অভিমান হতো না! আমি তোকে ঠকাইনি সায়রা! কৃতজ্ঞতা বশত বাধ্য ছিলাম শুধু!”
কোন উত্তর এলো না। ডুকরে কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো শুধু। আরসাল সায়রার দিকে হাত বাড়াতেই সরে গেল সায়রা। চিৎকার আওয়াজে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
–” সব বুঝলাম! কিন্তু এসব কিছুতে আমার কি দোষ ছিল আরসাল? দিনের পর দিন আপনার অপেক্ষা করেছি। নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি। পাইপাই মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করেছি! আপনি জানেন এই দেড় বছর আমাকে কি কি সহ্য করতে হয়েছে? অলক্ষ্মী, অর্থলোভীর মত আরো কত ট্যাগ লেগেছে আমার উপর। অনেকে তো এটাও বলেছে আমি আমার স্বামীকে খেয়েছি। রাক্ষসী আমি! পারবেন আমার সব অপমান কষ্ট গুলো মুছে দিতে!”
চলবে…….