তোমার প্রণয় নগরে পর্ব -৩৫+৩৬ ও শেষ

তোমার প্রণয় নগরে

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব- ৩৫

(কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )

গতরাতের ভারী বর্ষনের পর, আজ চকচকে আকাশ। প্রভাতের আলো ভুবনের কোণা কোণা ছুঁয়েছে। আড়মোড়া ভেঙে চোখ খুলল আরসাল। নিজেকে ফ্লোরে আবিষ্কার করল। কিছুটা চমকাল সে। তবে কি গতরাতে এখানেই চোখ লেগে গেছে! ফ্লোর থেকে উঠে বিছানায় বসল। চারিদিকে একবার সন্ধানী চোখ বুলাল। সায়রা নেই! সায়রা কোথায়? নিচে, কিচেনে! ভাবল আরসাল। কাবার্ড খুলতেই দেখল সবকিছু আগের মতই সুন্দর গোছানো। এই দেড়বছরে কিছুই পাল্টায়নি।সবটা যত্ন করে রেখেছে সায়রা। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, আরসাল ফিরবে। ঠোঁটের কোণে আলতো হাসি ফুটল আরসালের। ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট টেবিলে পৌঁছাল আরসাল। আহনাফ সাহেব, মুনতাহা বেগম আগে থেকেই সেখানে ছিলেন। ছেলের সাথে সময় কাটাবে বলে আজ অফিসে যাননি। আরসাল চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সায়রার তল্লাসী করছে। আশেপাশে কোথাও দেখছে না তাকে, মাকে কি একবার জিজ্ঞাস করবে? বেশ কিছুক্ষণ ভাবনাচিন্তায় কাটিয়ে মুনতাহা বেগমকে প্রশ্ন করল আরসাল,

–” মা সায়রা কোথায়?”

মুনতাহার স্বাভাবিক উত্তর,

–” বোনের বিয়ে, বাবার বাড়িতে গেছে!”

আরসাল তেতে উঠল। রাগী আওয়াজ করে বলল,

–” এতদিন পর আমি বাড়ি ফিরেছি আর ও আমাকে ফেলে বোনের বিয়ে খেতে বাবার চলে গেল? ওর বাবার বাড়ি কি শ’ মাইল দূরে! সাতদিন আগে যেতে হবে তাকে!”

আহনাফ সাহেব খাবার ছেড়ে চোখ উঠিয়ে ছেলের দিকে তাকালেন। ছেলেটা শুধরাল না আর, সেই আগের মত লাগামহীনই রয়ে গেল। মুনতাহা বেগমের আগের মত স্বাভাবিক উত্তর,

–” বোনের বিয়েতে বাবার বাড়িতে যাচ্ছে সায়রা, আমি বাঁধা দেব! লোকে বলবে আমি পুত্রবধূর উপর অত্যাচার করি। বাবার বাড়ি যেতে দেই না!”

মায়ের বক্তব্যে আরসালের রাগ বাড়ল। প্রচণ্ড রাগ হলো। শেষমেশ মাও তার সাথে পাল্টি নিচ্ছে, নিশ্চয় আরসালকে জ্বালাতে দুজনের প্লান এসব। রাগী আওয়াজে বলল আরসাল,

–” এখন পুত্রবধূ বলা হচ্ছে! এতদিন তো ঠিক মেয়ে মেয়ে বলে জান দিতে, এখন সবাই মিলে আমার সাথে প্রতিশোধ নিচ্ছ! বদলা নিচ্ছ তাই না?”

মুনতাহা বেগম কিছু বলল না মিটমিট হাসল শুধু। সকালের নাস্তা আর করা হলো না আরসালের। ক্ষিপ্ত মেজাজে খালি পেটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।

দুপুর দেড়টা। দরজা খুলে আরসালকে দেখে বিন্দুমাত্র চমকাল না সিন্থিয়া বেগম ।আরসাল আসবে তা যেন আগে থেকেই জানতেন তিনি। বেশ সৌজন্য ভাবে স্বাগতম জানালেন আরসালকে। বিয়ের পর প্রথমবার শ্বশুরবাড়ি এসেছে, খালি হাতে তো আসা যায় না! কাঁচা শাকসবজি থেকে শুরু করে, ভাজাভুজি, ফলমূল, রকমারি মিষ্টান্ন কোন কিছু আনতে বাদ রাখেনি আরসাল।
এতকিছু ঘটে গেছে, দেড়বছর কেটে গেছে। আরসাল কিঞ্চিত লজ্জাবোধ করল। সোফায় বসে আশেপাশে চোখ বুলাল। চোখ শুধু সায়রাকেই খুঁজছে। সকাল থেকে একবারের জন্য দেখেনি। কোথায় মেয়েটা? এত জ্বালাচ্ছে কেন তাকে!

বাহিরের হৈ চৈ আওয়াজে ঘুমঘুম চোখে টলতে টলতে দরজার কাছে এসে দাঁড়াল সায়রা। এখান থেকে বসার ঘর স্পষ্ট একদম। সোফার রুমে আরসাল সিন্থিয়াকে বসে থাকতে দেখে, ভ্রু কুঁচকে নিলো সায়রা। হকচকিয়ে উঠল। চোখের ঘুম কোথাও উড়ে গেল। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে গম্ভীর কোন আলোচনা চলছে। এখান থেকে স্পষ্ট কিছু শুনা যাচ্ছেনা। রুমে চলে গেল সায়রা। খট করে দরজা বন্ধ করে দিলো। রাগে বড়বড় শ্বাস ফেলছে আর নখ কামড়াচ্ছে। খানিক বাদে দরজার কড়া নড়ল, বাহির থেকে সিন্থিয়া বেগমের উঁচানো আওয়াজ ভেসে এলো,

–” সায়রা ! আরসাল এসেছে। তোর জন্য অপেক্ষা করছে, খাওয়া দাওয়া করবি!”

ঘুমের অভিনয় করে, ভাঙ্গা আওয়াজে বলল সায়রা,

–” পরে করবো মা, এখন ঘুম পাচ্ছে আমার! ”

–” সেই সকাল থেকে ঘুমাচ্ছিস আর কত ঘুমাবি তুই? কতক্ষণ হলো ছেলেটা অপেক্ষা করছে!”

সায়রার মুখ থেকে বিরক্তিতে ‘চ’ শব্দ বেরিয়ে এলো। গলা উঁচিয়ে ফোঁস করে উত্তর দিলো,

–” উনাকে খেয়ে চলে যেতে বলো, আমার ঘুম হয়নি আমি আরো ঘুমাব!”

বাহির থেকে সিন্থিয়া বেগমের ঝাঁজাল বিরবির আওয়াজ এলো। তোয়াক্কা করল না সায়রা। ফিসফিস করে বলল,

–” এই দেড় বছর অনেক জ্বালিয়েছেন, অনেক কষ্ট পেয়েছি আমি। এবার কষ্ট পাওয়ার পালা আপনার আরসাল। একচুলও ছাড় দেবনা আপনাকে, হুহ!”

বেশ কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে রইল সায়রা। বিকেল সাড়ে চারটা। সূর্যের তাপ তখন নরম হয়ে এসেছে। আকাশে রক্তিম আলোর খেলা। বিছানা ছেড়ে উঠে বসল সায়রা। প্রিয় বান্ধবী তাইবাকে ফোন করল। আজ বাহিরে খাবে সারা সন্ধ্যা শপিং করে কাটাবে। বেশ সুন্দর করে সেজে তৈরি হয়ে নিলো সায়রা। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে নিজেকে একবার আয়নায় দেখে নিলো। খারাপ না, বেশ ভালোই লাগছে। জুতা জোড়া হাতে তুলে ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার বাহিরে তাকাল। কেউ নেই। ড্রইং ফাঁকা। আরসাল চলে গেছে? আলতো পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায় সে। পিয়াসের রুম থেকে শব্দ আসছে। তবে কি উনি পিয়াসের ঘরে? ভাবল সায়রা। কয়েক কদম সামনে যেতেই আরসালকে দেখল সায়রা। পিঠ দেখা যাচ্ছে উনার। বেশ সচেতন পায়ে বাড়ি থেকে নেমে গেল সায়রা। রিক্সায় চড়ে মাকে ফোন করে জানাল, তাইবার সাথে শপিং- এ যাচ্ছে, ফিরতে রাত হবে। রাতের খাবার বাহির থেকেই খেয়ে আসবে! সিন্থিয়া বেগমকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কাটল। সুইচ অফ করে ফোনটা ব্যাগে রেখে দিলো।
স্বপ্নের শহর ঢাকা। দিনের আলো থেকে রাতে কৃত্রিম মিটমিট আলোর ঢাকা বুঝি বেশ সুন্দর। এই কৃত্রিম, অপ্রাকৃত জিনিস গুলোতেও যেন মানুষের মত মোহমায়ায় মাখানো। থানা রোডের চারতালা বিল্ডিং- এ এক নামীদামী রেস্টুরেন্টে বসে আছে সায়রা তাইবা। সায়রার দৃষ্টি সচ্ছ কাচের বাহিরে ব্যস্ত রাস্তায়। ভীষণ সাধারণ দৃশ্যকে এমন গভীর দৃষ্টিতে দেখছে, যেন বিশেষ কিছু! তাইবা বেশ ঠাহর চোখে সায়রার দিকে তাকিয়ে আছে। ছোট থেকে দুজন একসাথে। স্কুল কলেজ একত্রেই ছিল, ভার্সিটিতে একত্রেই আছে। সেই সাপেক্ষে সায়রার রগরগ সম্পর্কে অবগত তাইবা। সায়রাকে এমন আনমনা দেখে প্রশ্ন করল তাইবা,

–” শুনলাম আরসাল ভাই ফিরে এসেছে।”

সায়রার আনমনা উত্তর,

–” হুম”

–” এতদিন যার জন্য এত অপেক্ষা, এত তপস্যা। এখন যখন সেই মানুষটা তোর কাছে ফিরে এসেছে, তাকে এভাবে এড়িয়ে চলছিস কেন? ”

–” কে বলল, এড়িয়ে চলছি? আমি তো পালাচ্ছি!”

–” পালাচ্ছিস! কেন পালাচ্ছিস তুই?”

–” আমার ভয় হয়, প্রচণ্ড ভয় নিজেকে। উনার মুখোমুখি হলে আমার ভিতরের চেপে থাকা রাগ জেদ বড় কোন ঝড়ের রূপ নিয়ে সব তছনছ করে না দেয়!”

তাইবা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল,

–” তুই আরসাল ভাইকে ঘৃণা করিস?”

–” আমার দ্বারা তা অসম্ভব!”

–” এখনো ভালোবাসিস?”

–” প্রচণ্ড, প্রচণ্ড ভালোবাসি! ”

–” তাহলে মেনে নিচ্ছিস না কেন উনাকে?”

–” কি করবো, পারছি না যে ক্ষমা করতে। দেড় বছর অনেক ভুগেছি, অনেক সহ্য করেছি। এখন না পারছি উনার কাছে থাকতে, না পারছি দূরে থাকতে! তাই তো পালাচ্ছি শুধু!”

সায়রার কথায় তাইবা হাসল। মেয়েটা প্রচন্ড জেদি। ভাঙবে তবুও মচকাবে না!

রাত নয়টা। বাস স্ট্যান্ডে রিকশা থেকে নেমে গেল তাইবা। স্ট্যান্ডের পাশেই তার বাড়ি। তাইবাকে বিদায় দিয়ে সেই রিকশায় চলে গেল সায়রা। জ্যামে পড়ে বেশ দেরী হয়ে গেছে। নিশ্চয় মা চেঁচাবে! ভাবল সায়রা। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঝড়ো হাওয়া বইছে। রাতে ঝুম বৃষ্টি নামবে নিশ্চয়! দোকানীরা হুড়মুড় করে দোকান গুছাচ্ছে, বাচ্চারা ছুটোছুটি করছে। রাস্তার ধুলাবালির সাথে নোংরা পলিথিন ব্যাগও বাতাসে উড়ছে। ওড়না দিয়ে মুখ চেপে নিলো সায়রা। বাড়ির সামনে রিকশা থামতেই ভাড়া মিটিয়ে দ্রুত নেমে পড়ল সে। আচমকা লোডশেডিং হয়। চারিদিক অন্ধকারে তলিয়ে গেছে। বিরক্তির নিশ্বাস ফেলল সায়রা। বিরবির করে বলল,

— ” অসহ্য! এখনি কি লোডশেডিং হওয়ার ছিল!”

ফোনের টচ জ্বালিয়ে। যেই গেটে পা রাখবে অমনি কেউ পেছন থেকে হাত চেপে ধরে। ভয়ে শরীরের রক্ত হিম সায়রার। টচ নিয়ে পিছন ফিরে আরসালকে দেখে ছোট নিশ্বাস ফেলল। খেয়াল করে দেখল- চোখমুখ ভয়ংকর রকম লাল আরসালের। বেশ শান্ত আওয়াজ তার,

–” বাড়ি চল সায়রা”

ধীর আওয়াজে বলল সায়রা,

–” আমি যাবো না, হাত ছাড়ুন !”

বোঝানোর আওয়াজে বলল আরসাল,

–” তুই বাড়ি চল, তোর সব শাস্তি মাথা পেতে মেনে নিবো আমি।”

–” কাউকে কোন শাস্তি দেওয়ার ইচ্ছে নেই আমার। হাত ছাড়ুন!”

বলেই হাত ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নিলো সায়রা। সামনের দিকে পা বাড়াতেই পেছন থেকে হেচকা টান পড়ল। আরসালের বুকে যেয়ে পড়ল সায়রা। সায়রাকে নিজের সাথে শক্তভাবে জড়িয়ে নিলো আরসাল। ফিসফিস করে বলল,

–” আমি তোকে ছাড়া ভালো নেই। একদম ভালো নেই। সারাটা দিন আমার কেমন কেটেছে তোর কোন আইডিয়া আছে? পাগল হচ্ছি আমি সায়রা। জাস্ট পাগল হচ্ছি। আমি তোর অপরাধি! শাস্তি দিবি তো? তোর সব শাস্তি মাথা পেতে নিবো আমি। শুধু তুই বাড়ি ফিরে চল!”

–” মাত্র অর্ধেক দিনে আপনার এই হাল আরসাল? আমি যে দেড়বছর ছটফট করেছি ! … যাকগে, এই রাতে আপনার সাথে কথা বাড়াতে চাইনা। ছাড়ুন আমাকে। অসহ্য লাগছে আমার!”

আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে নিজেকে আরসালের বাহুডোর থেকে ছাড়িয়ে নিলো। বড়বড় পা ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে গেল সায়রা। আরসাল পেছনে থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল। সায়রাকে চলে যেতে দেখে পেছন থেকে চিৎকার করে বলল,

–” চলে যাচ্ছিস তো! বেশ! যেই অবধি তুই বাড়ি না ফিরবি আমিও বাড়ি ফিরবো না। আমি এখানেই রাস্তায় তোর অপেক্ষা করব!”

সায়রা পিছন ফিরে ছোট ছোট চোখ করে আরসালের দিকে তাকাল একবার। তারপর পায়ের গতি বাড়িয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল।
তোমার প্রণয় নগরে

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

অন্তিম পর্ব

(কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )

রাত দুইটা। বাহিরের ঝুম বৃষ্টি। এলোমেলো হাওয়ায় খোলা জানালার পাল্লা গুলো ঠকঠক আওয়াজ করছে। বৃষ্টির ছিটাফোঁটায় ঘুম ভাঙ্গল সায়রার। বিরক্তির মুখ করে ঘুমঘুম চোখে জানালার দিকে এগিয়ে গেল। যেই জানালা লাগাতে যাবে অমনি অন্ধকার রাস্তায় কারো প্রতিবিম্ব দেখল। এই ঘন বর্ষণে ঠাই দাড়িয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে। বিদ্যুৎ চমকাতেই মুখ স্পষ্ট হলো মানুষটার। আরসালকে দেখে আঁতকে উঠল সায়রা। বিছানা থেকে ওড়না নিয়ে দ্রুত ছুটে গেল।
বর্ষণের গভীর রাত। রাস্তাঘাট চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢেকে। দূরে গলির মোরে ল্যাম্পপোস্টের টিমটিম আলো। যার আবছা আলোয় আরসালের মুখ দৃশ্যমান। গেট থেকে বেরিয়ে রাস্তা অবধি আসতে আসতে ভিজে একাকার সায়রা। চুলের পানি নাক গলা ছুঁয়ে নিচের দিকে নামছে। আরসাল মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অভিযোগের কন্ঠে বলল সায়রা,

–” সত্যি সত্যি এই ঘন বর্ষণের রাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন! আপনি কি পাগল হয়েছেন আরসাল? এখনি বাড়ি ফিরে যান।”

আরসাল থরথর কাঁপছে। দাঁতের সাথে দাঁত লেগে শব্দ হচ্ছে বারবার। চোখমুখ ভীষণরকম কঠোর।

— ” আমার সাথে কি তুই বাড়ি ফিরবি? ”

সায়রার আমতা আমতা উত্তর,

–” নাহ ফিরবো না।”

— “তুই হয়তো আমার কথা ভালোভাবে শুনিসনি সায়রা! আমি বলেছিলাম, যেই অবধি তুই বাড়ি না ফিরবি আমি এখানে এই রাস্তায় অপেক্ষা করব।”

সায়রা আরসালের দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে। আরসালের রাগ সম্পর্কে বেশ ভালোভাবে অবগত সে। আরসাল যা বলে তা করেই ছাড়ে। বুক ফুলিয়ে বিরক্তির নিশ্বাস ছাড়ে সায়রা। ধীর আওয়াজে বলে,

–” ঠিক আছে, আমিও আপনার সাথে বাড়ি ফিরছি!”

আরসালের ঠোঁটের কোণে প্রশস্ত হাসি ফুটল।

.
মাত্রই ভেজা কাপড় পাল্টে বিছানায় বসেছে আরসাল। একের পর এক অনবরত হাঁচি দিয়ে চলেছে সে। সর্দি জ্বরে চোখ মুখ রক্তিম হয়ে আছে। ভেজা চুল থেকে টপটপ পানি ঝোরছে। ভেজা কাপড় অনেক আগেই পাল্টে নিয়েছে সায়রা। আরসালকে ঠাণ্ডায় থরথর কাঁপতে দেখে তোয়ালে হাতে তার দিকে পা বাড়াল। সামনা সামনি দাঁড়িয়ে নিশ্চুপ হয়ে, মাথা মুছে দিতে লাগল। গোল গোল চোখে দৃষ্টি উঁচিয়ে সায়রাকে দেখতে লাগল আরসাল। আচমকা দুহাতে শক্ত ভাবে সায়রারকোমর চেপে, পেটে মুখ ডুবাল। আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়িয়ে নাক ঘষতে লাগল। কেঁপে উঠল সায়রা। স্থির শক্ত হয়ে সেভাবেই ঠাই দাঁড়িয়ে রইল। বেশ কিছুক্ষণ পেটে মুখ ডুবিয়ে রাখল আরসাল। যেই জামা বেদ করে আরসালের তপ্ত কপাল সায়রার পেট ছুঁইল। ছিটকে উঠল সায়রা। হাতের পল্লব আরসালের কপালে ছুঁয়িয়ে আঁতকে উঠল,

–” একি! আপনার তো প্রচন্ড জ্বর আরসাল। ঔষধ খেতে হবে! রাতে কিছু খেয়েছেন?”

পেটে চিবুক ঠেকিয়ে ছোট ছোট চোখ মেলে সায়রার দিকে তাকাল আরসাল। না সূচক মাথা নাড়ল। সায়রা আবারো জিজ্ঞেস করল, ” সারাদিন কিছু মুখে তুলেছেন?” এবারো পূর্বরূপ উত্তর এলো। কিছু খায়নি। তপ্ত হতাশ নিশ্বাস ফেলল সায়রা। আরসালের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে। বলল,

–” আপনি বসুন, আমি এখনি আসছি!”

দ্রুত পায়ে নিচে নেমে গেল সায়রা। মিনিট পাঁচেকের ব্যবধানে এক প্লেট খাবার হাতে ফিরে এলো। প্লেটে ধোঁয়া উঠা গরম ভাত আর চিকেন কারি। ওভেনে গরম করে এনেছে। আরসালের সামনে বসে জিজ্ঞেস করল,

–” নিজ হাতে খেতে পারবেন?”

এবারো না সূচক মাথা নাড়ল আরসাল। সায়রা দেরী করল না, দ্রুত প্লেটে হাত ডুবাল। কারি দিয়ে ভাত মাখিয়ে আরসালের মুখের সামনে ধরল। সারাদিন জেদ করে অনাহা্রে কাটিয়ে মুখের সামনে ভাত দেখে গপগপ গিলতে লাগল আরসালএমন ভাবে তৃপ্তির সাথে খাচ্ছে যেন অমৃত একদম!
এত রাতে কোথাও ডক্টর পাবে না। তার উপর ঘন বর্ষণ। তুর্জয়কে ফোন করে ঔষধের নাম জেনে আরসালকে খায়িয়ে , বিছানায় শুয়িয়ে দিলো। গা কাঁপিয়ে জ্বর আসছে তার। আরসালের চোখ মুখ লাল হয়ে আছে, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। ওয়াশরুম থেকে পানি এনে বারবার গা মুছে দিচ্ছে সায়রা। শীতে কম্বলে একদম মুড়িয়ে গেল আরসাল। মাত্রই ঔষধ খেয়েছে, তুর্জয় আশ্বস্ত স্বরে বলেছে, জ্বর ছাড়তে একটু সময় লাগবে। গা মুছে দেওয়ায় থরথর কাঁপছে আরসাল। কোন দিকদিগন্ত না পেয়ে দিশেহারা হয়ে কম্বলে ডুকে শক্ত ভাবে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরল। অচেতন আরসালও বাচ্চাদের মত শক্তভাবে জড়িয়ে ধরল। আরসালের তপ্ত শরীরে তাপ সায়রার গায়ে লাগছে। এত অসুস্থ আরসালকে এর আগে কোন দিন দেখিনি সায়রা। আজ তার জেদের বসে আরসালের এই হাল। কেন এভাবে জিদ করতে গেল সে! নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তার। অচেতন আরসালকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল।

ঘন বর্ষণের পর আরো একটা সোনালি সকাল। চারিদিক সোনালি রোদে চিকচিক করছে, দূর অদূর থেকে ভোরের পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ ভেসে আসছে। পিটপিট করে চোখ মেলল আরসাল। শরীর এখন অনেকটাই সুস্থ! শেষ রাতের দিকে জ্বর ছেড়েছে। মাথাটা চিনচিনে ব্যথা শুধু। বুকে কারো ভারী নিশ্বাসের আবাস পেয়ে ঘাড় ফিরে তাকাল আরসাল। ঘুমন্ত সায়রা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে তাকে, পড়ন্ত চুল কপাল চোখ জুড়ে। নিচের ঠোঁট অনেকটা বাচ্চাদের মত মুখের ভেতরের দিকে। স্মিত হাসল আরসাল। আলতো আদুরে হাতে পড়ন্ত চুল গুলো সরিয়ে দিলো। ভোরের আলো চোখমুখে পড়তেই ভ্রু কুঁচকে নিলো সায়রা। ঘুমের ঘোরেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল আরসালকে, বুকে মুখ লুকানোর চেষ্টায় নাক মুখ ঘষতে লাগল। বাঁধা দিলো না আরসাল। সায়রার মসৃণ তেলতেলে ওষ্ঠদ্বয় নিজের খড়খড়ে ফাটা ওষ্ঠদ্বয়ের ভাজে নিয়ে নিলো। বেশ আলতো আলতো করে ছুঁয়ে দিলো। আস্তে আস্তে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো, বেশ কিছুক্ষণ এভাবেই রইল দুজন। ঘুমের ঘোরে আরসালের অতি নিকটে চলে গেল সায়রা। হুশ ফিরতেই আঁতকে উঠল। আরসালের বুকে হাত ঠেকিয়ে সরে গেল। শরীর প্রচন্ডরকম কাঁপছে তার। ভারী ভারী তপ্ত নিশ্বাস। চোখ বুজে বড়বড় নিশ্বাস ছেড়ে নিজেকে শান্ত করতে চাইল সায়রা। কিন্তু ব্যর্থ! কাঁপাকাঁপা হাতে আরসালের কপাল ছুঁয়ে দেখল- জ্বর নেই এখন! অস্থির আওয়াজে প্রশ্ন করল সায়রা,

–” এখন কেমন লাগছে? মাথাব্যথা এখনো আছে কি! খুব খারাপ লাগছে ?”

মৃদু হেসে ‘না’ সূচক মাথা নাড়াল আরসাল। সায়রার চিবুকে হাত রেখে কাছে টানল, গালে আলতো করে বৃদ্ধাঙ্গুলি বুলিয়ে দিতে দিতে মৃদু কন্ঠে বলল আরসাল,

–” অসুস্থ হয়ে যদি তোকে এমন কাছে পাওয়া যায়, তবে এই অসুস্থতাকে আমি হাজারবার চাই!”

সায়রা চমকাল, ভড়কাল, লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো। থেমে থেমে বলল,

–” একদম উল্টাপাল্টা বকবেন না! জানেন গতরাতে কতটা ভয় পেয়েছি আমি?”

–” জানি তো! গতরাতের ভয়ের চিহ্ন আজ ভোর অবধি ছিল! (সায়রাকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে) এইযে এখনো আছে!”

দুষ্টু হাসল আরসাল। সায়রা আবারো লজ্জায় মুড়িয়ে গেল। আরসাল থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে তাড়া দিয়ে বলল,

–” আমি যাই, মা ডাকছে!”

ফিচেল হেসে কোমর জড়িয়ে ধরল আরসাল। নিজের কাছে টেনে কোলে বসিয়ে নিলো সায়রাকে। সায়রার পিঠ আরসালের উন্মুক্ত বিস্তৃত বুকে যেয়ে ঠেকেছে। ফিসফিস আওয়াজে বলল আরসাল,

— ” আবারো পালাচ্ছিস! ”

ঘাড় বাঁকাল সায়রা। আরসালের চোখেচোখে রেখে মৃদু হেসে বলল,

–” আমি আছি, শেষ নিশ্বাস অবধি আপনার কাছেই আছি আরসাল!”

.
দুএক দিনে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠল আরসাল। বাড়িতে বিয়ের আমেজ। হুল্লোড় চারিদিক। আজ আরমিনের হলুদ সকাল থেকে ভীষণরকম ব্যস্ত সবাই। মেকআপ আর্টিস্ট এসেছে সেই সকালে, মূলত সেদিকেই যত ভিড়। সায়রা টুকটাক কাজ সেরে কোনরকম বাড়ি ফিরেছে, ঘন্টা খানিকের ভেতর সেন্টারে ফিরতে হবে। সবাই আগেই চলে গেছে শুধু সায়রা আরসালই রয়ে গেছে। তড়িঘড়ি করে তৈরি হচ্ছে সায়রা, হলুদ ভারী লেহেঙ্গা গায়ে, সামনের থেকে চিকন স্টাইলিশ বিনুনি করে চুল গুলোকে কার্ল করে ছেড়ে রেখেছে। মাথায় কানে কাঁচা ফুলের সিম্পল জুয়েলারি। ভীষণ ব্যস্ত হয়ে হাতে চুড়ি পড়তে গিয়ে একটা চুড়ি ভেঙে হাতে লাগল সায়রার। চাপা আর্তনাদে আঁতকে উঠল সায়রা। পাশেই তৈরি হচ্ছিল আরসাল। আর্তনাদ শুনে, পাঞ্জাবীর কলার ঠিক করতে করতে ভ্রু কুঁচকে সায়রার দিকে তাকাল। হাত চেপে চোখ কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে সায়রা। কয়েক কদম এগিয়ে এসে সায়রার মুখোমুখি এসে বসল। চিন্তিত মুখে কাটা জায়গায় আঙ্গুল বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

–” খুব লেগেছে? ”

–” উহু, সামান্য আঁচড়, খানিক বাদেই সেরে যাবে!”

চোখ রাঙাল আরসাল,

–” ট্রেন ছুটে যাচ্ছেনা! এত তড়িঘড়ি করার কি দরকার?”

উত্তর দিলো না সায়রা। ভয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। একটা একটা করে সায়রার হাতে চুড়ি পড়িয়ে দিচ্ছে আরসাল। সায়রা চোখ উঁচিয়ে চোরা দৃষ্টিতে তা দেখছে আর মিটমিট হাসছে। টকটকে কমলা পাঞ্জাবি, সাদা কটিতে আরসালকে ভীষণ মানিয়েছে। শেষ বিকালের মৃদু হাওয়ায় চুল গুলো তিরতির কাঁপছে। ঝাঁঝাল চোখ জোড়া সায়রার হাত পানে। বেশ যত্ন করে চুড়ি পড়াচ্ছে। সায়রার গভীর দৃষ্টি মিটিমিটি হাসি লক্ষ করল আরসাল। হাতের দিকে চোখ রেখেই জিজ্ঞেস করল,

–” হাসছিস কেন? ”

বেশ স্বাভাবিক আওয়াজে উত্তর দিলো সায়রা,

–” ভাবা যায়! যেই মানুষটা একদিন এই ঘর থেকে আমাকে টেনে হিঁচড়ে বের করেছিল, আজ সেই মানুষটাই পরম আদরে চুড়ি পড়িয়ে দিচ্ছে! ”

চোখ উঠিয়ে একবার সায়রার মুখখানা দেখে নিলো আরসাল। তারপর হাতের দিকে মনোযোগ দিয়ে গম্ভীর আওয়াজে বলল,

–” পিঞ্চ করছিস?”

হেসে ফেলল সায়রা। বলল,

–” উহু, ভাবছি সময় কি অদ্ভুত! ঘৃণাকে কিকরে ভালোবাসায় রূপান্তরিত করে দেয়। তাই না?”

মুচকি হাসল আরসাল। সায়রার দু গালে হাত রেখে কাছে টেনে আনল। কপালে আলতো স্পর্শ করে। গভীর আওয়াজে বলল,

–” আমি কোনদিন ঘৃণা করিনি তোকে, একটু রেগে ছিলাম শুধু! সেই ছোট থেকে তোকে ভালোবেসেছি, এখনো ভালোবাসি, চিরকাল তোকেই ভালোবাসবো!”

চত্তড়া হাসল সায়রা। কিছু একটা ভেবে হাসিটা ছোট হয়ে এলো। চেহারায় ভাবুক ভাব এঁটে এলো। চিন্তিত স্বরে বলল সায়রা,

— ” একটা প্রশ্ন সবসময় আমার মনে খচখচ করে। আচ্ছা দেশে ফিরে ঐ সাতদিন আপনি কোথায় ছিলেন?”

আরসাল ভ্রু নাচিয়ে দুষ্টু হেসে বলল,

–” কেন তোর চিন্তা হচ্ছে! আমি অন্যকারো সাথে ছিলাম কিনা! ইনডায়রেক্টলি তা জানতে চাইছিস?”

–” উফ! আমি কি তা বলেছি? আপনি শুধু শুধু কথা প্যাঁচাচ্ছেন। বললে বলুন নয়তো আমি যাই!”

সায়রা উঠতে নিলে হাত টেনে বসিয়ে দিলো আরসাল। বোঝানোর স্বরে বলল,

–” আচ্ছা আচ্ছা বলছি! রেগে যাচ্ছিস কেন? সেই সাতদিন ট্যুরে ছিলাম! রাঙ্গামাটি, সাজেক সব জায়গা ঘুরে বেরিয়েছি।”

সায়রা হতভম্ব আওয়াজ করে বলল,

–” বাড়ি সব লোকেদের টেনশনে ফেলে, আপনি রাঙ্গামাটি , সাজেক ঘুরছিলেন! আপনি পারেনও বটে!”

— ” আমি টেনশন করতে বলেছি?”

অভিযোগ করে বলল সায়রা,
–” আপনি এমন বেপরোয়া কেন আরসাল?”

–” কে বলল আমি বেপরোয়া? আমি পরোয়া করি তো, আমার সব পরোয়া , ভয় তোকে ঘিরে সায়রা!”

স্মিত হাসল সায়রা। আলতো করে সায়রার গাল টেনে আরসাল বলল,

–” দেরী হচ্ছে! তোর দুলাভাই এই নিয়ে পাঁচবার ফোন করেছে! আরেকটু দেরী করলে বাড়ি চলে আসবে।”

–” কে সায়ন ভাই?”

আরসাল হতাশ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। সায়রা হেসে ফেলল আবার। সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে মেজর তাহির আহমেদকে দেখে চমকাল সায়রা। আরসালের দিকে তাকাল। আরসালের মুখভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছে তিনিও হতভম্ব, জানেন না। আরসাল সায়রাকে দেখে সোফা ছেড়ে এগিয়ে আসলো মেজর। কৌশল বিনিময় করল আরসাল। বেশ সৌজন্য স্বরে আরসাল বলল,

–” কেমন আছেন আঙ্কল? ”

মেজর কিঞ্চিত হেসে উত্তর দিলো,

–” এইতো বাবা আছি, তোমরা কেমন আছ? ”

–” জি আঙ্কল ভালো!”

কিছুক্ষণ চুপ থেকে মেজর সাহেব বললেন,

–” আজ তোমার সাথে না সায়রা মায়ের সাথে দেখা করতে এসেছি!”

সায়রা চমকাল।মাথা উঠিয়ে মেজরের দিকে তাকাল একবার । মেজর সাহেব সায়রার কাছে এগিয়ে হাত জোর করে বলল,

–” আমার কারণে তুমি তোমার স্বামি থেকে গত দেড় বছর দূরে ছিলে। স্বামী বেঁচে থাকার স্বর্থেও বিধবার জীবন কাটিয়েছ। আমি চাইলে পারতাম তোমাদের সাথে যোগাযোগ করতে কিন্তু নিজ স্বার্থে তা করিনি। সেদিন সিলেটেও আমারই কারণে আরসাল তোমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। নিজের প্রিয় মানুষ হারানো যে কত কষ্টের আমি এখন বুঝছি। আমি তোমার অপরাধি মা। পারলে ক্ষমা করে দিও আমায়!”

–” না না আঙ্কল এসব কি বলছেন। আপনি আমার বড়। তাছাড়া এসব চলে গেছে অনেকদিন হয়ে গেছে, আরসাল আমার কাছে ফিরে এসেছে। আমার আর কিছু চাইনা।”

–” এখানে আর কেউ নেই আমার। ছেলে স্ত্রী সবাই ছেড়ে চলে গেছে। জীবনে আর কিছু নেই। তাই শেষ সময়টা ভাইয়ের কাছে কাটাবো বলে আমেরিকা যাচ্ছি। তাই শেষবারের মত দেখা করতে এলাম। দোয়া করি মা তুমি অনেক সুখী হও!”

চোখ ভিজে এলো মেজরের। গাড়ি বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেলেন তিনি। চোখ ভরে এলো সায়রার। অস্পষ্ট দৃষ্টিতে আরসালের দিকে তাকাল। ভাঙ্গা আওয়াজে বলল,

–“সেদিন অপারেশন সাকসেস হয়নি? আন্টি কি মারা গেছে! ”
আরসাল হতাশ শ্বাস ফেলল। হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। কেঁদে ফেলল সায়রা। খানিকের পরিচয়েই হোক , হোক তা মন্দ বা ভালো। মানুষটার জন্য কেন জানো খুব খারাপ লাগছে সায়রার। ডুকরে কেঁদে দিলো। আরসাল সায়রাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করল। মাথা তুলে জিজ্ঞেস করল সায়রা,

–” আমাকে আগে জাননি কেন?”

–” তুই কষ্ট পাবি তাই। আর তাছাড়া এই খবর শুনে ইমোশনাল হয়ে তুই হয়তো আমাকে খানিকের জন্য ক্ষমা করে দিতি, কিন্তু ভিতরের ক্ষোভটা তোর চিরকালই থেকে যেত। যা আমাদের পরবর্তী জীবনের জন্য সুখকর নয়। আমি তোর অপরাধি, আমা্র উপর রেগে থাকার শাস্তি দেওয়ার পূর্ণ অধিকার আছে তোর। আর আমার আছে সেই রাগ ভাঙ্গানোর অধিকার! আমি চেয়েছি তুই যখন আমার কাছে ধরা দিবি, সব মান অভিমান ভেঙ্গে শুদ্ধ ভাবে ধরা দে!”

আচমকা আরসালকে জড়িয়ে ধরল সায়রা, ভীষণ শক্ত ভাবে! মিনমিন করে বলল,

–“ভালোবাসি আরসাল! প্রচণ্ড ভালোবাসি।”

হেসে ফেলল আরসাল। সায়রার মাথায় গভীর চুমু এঁকে দিলো।

.
আজ আরমিনের বিয়ে। আরমিনকে বিদায় দিয়ে সেন্টার থেকে সোজা বাড়ি ফিরেছে সায়রা। আরসাল বলেছে বাড়ি স্পেশাল কিছু তার অপেক্ষা করছে। সেই থেকে ভিতরে প্রচন্ড কৌতূহল কাজ করছে সায়রার। বাড়ি ফিরে রুমে ডুকে হতভম্ব সায়রা। পুরো ঘর মোমবাতি, ফুলে ফুলে সাজানো। যেন বাসর ঘর। বিছানায় ছোট চিরকুট,

” তবে কি আমার প্রেম তৃষ্ণা, সকল অপেক্ষার অবসান ঘটবে আজ!”

সায়রা মুচকি হাসল। মানুষটা এমন পাগল কেন! নিজের ভালোবাসা প্রকাশের কোন সুযোগ হাত ছাড়া করেনা, একদম! নিজেকে একবার আয়নায় দেখে নিলো সায়রা। আজ টকটকে লাল লেহেঙ্গা পড়েছে। বউদের মতই সেজেছে। শুধু মাথায় ওড়নাটার কমতি!
আরসালের অপেক্ষায় বিছানায় বসল সায়রা। হঠাৎ বিদায় সময় আরমিনের দেওয়া সেই চিঠির কথা মনে পড়ল সায়রার। সেখানে অনেক ভিড় তাই সেন্টারে খুলেনি। এখানে কেউ নেই। পড়া যায় এখন। পার্স থেকে চিঠিটা বের করল সায়রা। পড়তে শুরু করল-

সায়রু,

তুই হয়তো ভাবছিস কথা গুলো সরাসরি না বলে ঢং করে চিঠি লিখেছি কেন! কথা গুলো সরাসরি বলার মত আমার সাহস নেই। অনেকবার চেষ্টা করেছি, পারিনি আমি। তুই আমার ঠিক কতটা কাছের তা শব্দে প্রকাশ করতে পারবো না। কিন্তু একটা আফসোস আমার চিরকাল ছিল। সেই ছোট থেকে। যার জন্য আমি আজও অনুতপ্ত। তোর মনে আছে ছয় বছরের সময় তোর সাথে একটা এক্সিডেন্ট ঘটেছিল। যারপর থেকে তোর অন্ধকারে ফোবিয়ার সমস্যা দেখা দেয়। সেদিন যা ঘটেছিল সেটা কোন এক্সিডেন্ট ছিলনা, আমি জেনে শুনে ইচ্ছে করে তোকে সেই অন্ধকার ঘরে আটকেছিলাম। আমি তোর সাথে তখন ভীষণ রকম জেলাস ছিলাম। যখন দেখতাম তোর বাবা আছে, মা আছে সব কিছুতে তুই ফাস্ট। সবার ভীষণ আদরের আমার খুব হিংসা হতো তোর সাথে। তাই সেদিন জেনে শুনে ইচ্ছে করে তোকে সেই অন্ধকার ঘরটায় আটকেছিলাম, ভয় দেখাতে। কিন্তু এত বড় কিছু হবে আমার ছোট মস্তিষ্কে তা ঢুকেনি। আমি না বুঝে নিজের জেলাসিতে এসব করে ফেলেছিলাম। অনেকবার তোর কাছে ক্ষমা চাওয়ার চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। তারপর যখন জানতে পারলাম আরসাল ভাই তোকে ভালোবাসে আমার ভিতরের সেই ছোট বেলার তীব্র হিংসাটা জেগে উঠে আবার।বারবার মনে হচ্ছিল কেন সবাই তোকেই ভালোবাসে। না চাইতেও ডিপ্রশনে ভুগে অনেক আঘাত করে ফেলি তোকে। সত্যি বলতে আরসাল ভাই কখনো আমার ভালোবাসা ছিল না, মোহ ছিল মাত্র যাতে আমি জড়িয়েছি। আমার মোহ কেটে গেছে। আমি আমার ভালোবাসার মানুষ পেয়ে গেছি। তুর্জয় আমার সেই ভালোবাসার মানুষ। আমার পিছনে করা ভুল গুলো আমাকে প্রচন্ড পোড়ায়। অনেকবার তোর কাছে ক্ষমা চাওয়ার চেষ্টা করেছি, পারিনি। যার অনুতাপ আমি আজ অবধি বয়ে বেড়াচ্ছি। আমি পারছিনা এই অনুতাপের বোজ বইতে আর। তাই আজ নতুন জীবন শুরু করার পূর্বে নিজের সব অনুতাপ গুছিয়ে নিতে চাই। ক্ষমা করে দিস আমায়। তুই সবসময়ই শ্রেষ্ঠ বোন ছিলি, আছিস! শুধু আমিই কখনো তোর যোগ্য বোন হতে পারিনি! যার আফসোস আমার চিরকাল থাকবে!

ইতি

তোর অপরাধি বোন

পড়ে কেঁদে ফেলল সায়রা। চিঠি হাতে করে জানালার কাছে দাঁড়াল। বিশাল আকাশে লক্ষ লক্ষ তারকারাজি। থালার মত চাঁদ যার উজ্জ্বল আলোয় ভুবন আলোকিত। মনটা ভীষণ রকম খারাপ হয়ে গেল সায়রার। বুকে চিনচিনে কষ্ট। আরমিন কেন চিঠিটা দিলো! এসব না জেনেই তো সে বেশ ভালো ছিল। এখন এই অস্থিরতা, চাপা কষ্ট কি করে গুছবে সে!
দরজা খুলে রুমে ঢুকল আরসাল। খেয়াল হলো না সায়রার। অন্ধকার রুম ফুলের ঘ্রাণে মো মো করছে। পুরো ঘরে চোখ বুলাল, বিছানা খালি। চোখ যেয়ে ঠেকল জানালার পাশে আবছা ছায়ায়। কাবার্ড খুলে বিয়ের ওড়নাটা নিয়ে এগিয়ে গেল জানালার দিকে। পেছন থেকে ওড়নাটা মাথায় জড়িয়ে দিয়ে, পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল সায়রাকে। ফিসফিস করে বলল,

–” শুধু এই ওড়নার কমতি ছিল, এখন লাগছে পুরোপুরি নতুন বউ! আমার বউ! ”

প্রতিক্রিয়া করল না সায়রা। সন্দেহ হলো আরসালের। চট নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলো। কাঁদতে দেখে অস্থির হয়ে উঠল। উৎকণ্ঠা আওয়াজে বলল,

–” কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে সায়রা?”

উত্তর দিলো না সায়রা। ডুকরে কেঁদে উঠল। সায়রার হাতের চিঠিতে আরসালের দৃষ্টি আটকাল। আবছা আলোয় লিখা দেখতে অসুবিধে হলো না আরসালের। চিঠি পড়ে মেজাজ খারাপ হলো আরসালের। প্রচন্ড ভাবে! কঠোর স্বরে বলল,

–” যে জিনিস তোর কষ্টের কারণ হবে, সেটা মিটিয়ে ফেলাটাই উত্তম।”

চিঠিটা জানালার পাশে জ্বলতে থাকা মোমবাতিতে পোড়াল আরসাল। সাথে সাথে ছাই হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। আরসালের দিকে দু কদন এগিয়ে এলো। সায়রাকে সাথে সাথে বুকের সাথে মিলিয়ে নিলো আরসাল। চোখ বুঝে নিলো সায়রা। হ্যাঁ, এটাই তার একমাত্র ভরসার নিরাপদ স্থান! এই বুকটাই তার ভীষণ ভরসার। এখানে না আছে কোন ছল, না আছে কোন ধোকা। এই বুক, এই মন, এই হৃদয় এখানে সবটাই শুধু তার। ফিসফিস করে বলল সায়রা,

–” আমি ভীষণ ক্লান্ত আরসাল। আর পারছিনা! আমাকে এই জগত থেকে দূর, বহু দূর! ভালোবাসার নীড়ে, প্রেম সমুদ্রের তীরে, আপনার প্রণয় নগরে নিয়ে চলুন।”

ফিচেল হাসল আরসাল। চট করে কোলে তুলে নিলো সায়রাকে। সায়রার নাকে নাক ঘষতে ঘষতে বলল,

–” সেই কতকাল ধরে, আমার প্রণয় নগর তোমারি পথ চেয়ে! আমার হৃদরানি, আমার সবটা জুড়ে শুধুই তুমি!”

লজ্জায় মেঘেদের আড়ালে মুখ লুকাল চাঁদ। বারান্দার লজ্জাবতী পাতা গুলোও যেন মুড়িয়ে গেল। তবে কি অন্তহীন প্রেমের শুরু….!

সমাপ্ত❣️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here