সায়াহ্নের প্রণয় পর্ব -০১

১.
বড় ভাইয়ের হলুদ সন্ধ্যা উপলক্ষে এক হাতে হলুদের বাটি নিয়ে ছাদের দিকে এগোতে কারো বিশালাকার দেহের সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ার মতো অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়তেই দু কদম পিছিয়ে যায় প্রাচী। সাথে নিকোটিনের তীব্র গন্ধ নাকে এসে পৌঁছাতেই নাকমুখ কুঁচকে নেয় সে। একপ্রকার রাগ আর বিরক্তি নিয়ে মাথা তুলে তাকাতেই মুখশ্রী থেকে সব বিরক্তি আর রাগ উধাও হয়ে যায় প্রাচীর। বরং রাগের পরিবর্তে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট ফুটে ওঠে তার চেহারায়। সামনে থাকা ব্যক্তিটির গম্ভীর চেহারা দেখে আপনাআপনি তার কপালে ভয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘামের বিন্দু জমা হয়েছে। গভীর নীল চোখ জোড়ার চাহনিই ভয় পাইয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। ব্যক্তিটি আর কেউ নয় বরং বড় ভাইয়ের বেস্ট ফ্রেন্ড ওরফে জুনায়েদ আরহাম‌ সমুদ্র। বেস্ট ফ্রেন্ডের বিয়ে উপলক্ষে কিছুদিন আগেই ইউকে থেকে বিডিতে ব্যাক করেছে সমুদ্র। আর সেটাই যেন প্রাচীর জীবনের সবচেয়ে বড় রিস্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সমুদ্রের দিকে চোখ যেতেই আতকে উঠে প্রাচী। চোখ দুটো টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। চেহারায় ফুটে উঠেছে স্পষ্ট রাগের আভা। সেটা দেখে অস্ফুট স্বরে প্রাচী কোনোমতে বলে উঠে,
– “অ,আ,আরে সমুদ্র ভাইয়া আপনি এখানে? আপনি এখানে কি করছেন? আপনার তো এখন ভাইয়ার সাথে থাকার কথা। আর আপ,আপনার হাতে সিগারেট কেন?”

প্রাচীর বলা কথা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই হাতে থাকা সিগারেটের দিকে একপলক তাকিয়ে সেটা পাশে ছুঁড়ে ফেলে দেয় সমুদ্র। অতঃপর প্রাচীর দিকে ধীর পায়ে এগোতে নিলেই হালকা নড়েচড়ে দাঁড়ায় প্রাচী। সমুদ্রের ভাবমূর্তি বুঝতে পেরে পেছনে পা বাড়াবে তার পূর্বেই সমুদ্রের পুরুষালী হাত তার বাহুদ্বয়‌ চেপে ধরে দেয়ালের সাথে। এতে করে প্রাচীর যেন চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। হাতে থাকা হলুদের বাটি টাও একটুর জন্য নিচে পড়ে যায় নি। তাছাড়া পুরুষালী হাত তার বাহু আঁকড়ে ধরায় ব্যাথায় চোখ মুখ খিচে‌ নেয় সে।
– “ক,কি করছেন কী আপনি সমুদ্র ভাইয়া! এভাবে আমাকে আটকে রেখেছেন কেন? আমাকে যেতে দিন; ভাইয়ার হলুদ সন্ধ্যায় দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
ভয়ার্ত কন্ঠে বলে উঠে প্রাচী। কিন্তু তাতে যেন কোনো প্রতিক্রিয়া নেই সমুদ্রের মাঝে।
– “খুব সাহস বেড়ে গিয়েছে তাই না? আকাশ নামের ছেলেটার সাথে কিসের এত হাসাহাসি? খুব ভালো লাগে তাইনা ছেলেদের সাথে হেসে হেসে কথা বলতে?
ফারদার তোমার আশেপাশে আকাশকে দেখতে পেলে কি অবস্থা হবে সেটার জন্য মোটেও প্রস্তুত থাকবে না। সো বি কেয়ারফুল!”
চাপা কন্ঠস্বরে বলে উঠে সমুদ্র। রাগ মিশ্রিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রাচীর বাহু ছেড়ে দেয় সে। অতঃপর হাঁটা শুরু করে উপরের দিকে। এদিকে প্রাচী ড্যাবড্যাব করে এতক্ষণ ধরে সমুদ্রের কথা শুনে যাচ্ছিল। সবটাই যেন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। আকাশ তো তার বেস্ট ফ্রেন্ড। আর বেস্ট ফ্রেন্ডের সাথে একটু হেসে কথা বললে কি বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে তার কোনো আগাগোড়া খুঁজে পায় না সে।

– “ইয়া আল্লাহ, এই লোকটার সমস্যা কি কে জানে! যেদিন থেকে এ বাড়িতে এসেছে সেদিন থেকেই আমার জীবন তামা তামা হয়ে গিয়েছে। ভাইয়ুর বেস্ট ফ্রেন্ড বলে কিছু বলতেও পারি না। আর কিই বা বলব? ওরকম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালে শুধু আমি কেন যে কেউ ই ভয় পেয়ে যাবে। আর অন্য ছেলেদের সম্পর্কে এত কথা বলে নিজেই হুটহাট এমন উদ্ভট আচরণ করে কেন? এই লোকটাকে বোঝা আর দিনের আকাশে তারা দেখা একই কথা।
ধ্যাত, ভালো লাগে না!”
বিরক্তিকর গলায় বলে ওঠে প্রাচী। সমুদ্র নামের লোকটা বরাবরের মতই তার অপছন্দের তালিকায়। চার বছর পর আবারও এই লোকটার সম্মুখীন হতে হবে ভাবে নি সে।
প্রাচী। পুরো নাম মেহরিশ‌ আয়াত প্রাচী। আনোয়ার হোসেন ও জেবা বেগমের আদরের রাজকন্যা এবং বড় ভাই ইশরাকের আদরের ছোট বোন। দেখতে প্রায় একটা মাঝারি গড়নের পুতুলের ন্যায়। চোখ গুলো বেশ বড় বড় এবং ঘন পাপড়ি যুক্ত। নাকটাও বেশ সরু ও লম্বা। অনার্সের অধ্যয়নরত দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী প্রাচী।
অন্যদিকে সমুদ্র। পুরো নাম জুনায়েদ আরহাম সমুদ্র। ৫ ফুট ১০ ইঞ্চির অধিকারী একজন সুদর্শন যুবক। মুখে হালকা চাপদাড়ি। নীল চোখজোড়া তার নামের মতোই এক সমুদ্র পরিমাণ গভীর। মুখের মধ্যে হাসির রেখা নেই বললেই চলে। বাবা সাদাত চৌধুরী এবং মা কোহিনূর চৌধুরীর একমাত্র সন্তান। মাস্টার্স কমপ্লিট শেষে আপাতত কিছুদিনের বিরতিতে আছে সে।

২.
হলুদ সন্ধ্যার অনুষ্ঠানের জন্য বাড়ির মেহমান সহ সবাই আগে থেকেই ছাদে উপস্থিত রয়েছে। পুরো ছাদ ছোট ছোট রঙ বেরঙের মরিচ বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে যা রাতের অন্ধকারে আরো বেশি ফুটে উঠেছে। হলুদের বাটি নিয়ে ছাদে উপস্থিত হতেই জেবা বেগম দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন প্রাচীর দিকে।
– “কি ব্যাপার, এত সময় লাগে এই হলুদের বাটি আনতে? সেই কখন থেকে সবাই অপেক্ষা করছে। তুই পারিস ও বটে!”
বলেই প্রাচীর হাত থেকে হলুদের বাটিটা নিয়ে নিলেন জেবা বেগম।
– “হুহ, আমি কি ইচ্ছে করে দেরি করেছি নাকি? সব দোষ তো ঐ বজ্জাত‌ লোকটার। কেউ তো তার দোষ দেখবে না সব দোষ আমার ঘাড়েই চাপাবে। আমারো সময় আসবে একদিন। সেদিন আমিও গুনে গুনে প্রতিশোধ নিব। ব্যাটা বদ লোক!”
ঠোঁট দুটো কিঞ্চিৎ প্রসারিত করে মনে মনে বিড়বিড় করে বলতে থাকে প্রাচী।
হলুদ আর জলপাই রঙের মিশ্রণের লেহেঙ্গা, গলায়, কানে কাঁচা রজনীগন্ধা আর গোলাপ ফুলের অর্নামেন্টস, মুখে হালকা মেকআপের আবরণ। সব মিলিয়ে যেন জলজ্যান্ত পুতুলের মত লাগছে প্রাচীকে‌। ছাদের স্টেজের এক কর্ণারে দাঁড়িয়ে চুপচাপ মায়ের সাথে টুকটাক কাজ করছে সে।
– “এই মেহরিশ‌, এখানে আয় তো! ওখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস? যা নিচ শরবতের ট্রে টা নিয়ে আয়। ইশরাক, সমুদ্র, আকাশ ওপাশেই আছে। ছেলেগুলো আর কতক্ষণ এভাবে বসে থাকবে? কি বলিস জেবা?”
ফাতেমা ইয়াসমিন ওরফে প্রাচীর দাদির কথা শুনে থমকে দাঁড়ায় প্রাচী। সমুদ্রের কথা শুনে মুহুর্তেই মুখটা চুপসে গিয়েছে।
– “হ্যাঁ, ঠিকই বলেছে তোর দাদি। যা শরবতের ট্রে নিয়ে দ্রুত ওখানে দিয়ে আয়। বাকি কাজ গুলো আমিই গুছিয়ে নিতে পারব।”
– “কিন্তু মা আমি কেন?”
আর কিছু বলার পূর্বেই প্রাচীকে থামিয়ে দিলেন জেবা বেগম।
– “কিন্তু আবার কি? যা বলছি তাই কর! এমনিতেই দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
মায়ের কথায় অগত্যা মুখ ফুলিয়ে নিল প্রাচী। কি আর করার? বাধ্যতামূলক নিচে পা বাড়ালো সে। কিচেনে গিয়ে ট্রে এর উপর শরবতের গ্লাস গুলো সাজিয়ে হাতে নিতেই কর্ণারে থাকা একটা বাক্সের উপর নজর পরে প্রাচীর। সাথে সাথেই মনে দুষ্টু বুদ্ধি আঁটে সে।
– “সবসময় আমাকে ধমকানো, আমাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করা তাইনা মিস্টার সমুদ্র? এবার বুঝবে এই প্রাচী কি জিনিস!”

ছাদের পশ্চিম পাশে বাড়ির সব ছেলেরা একসাথে জড়ো হয়ে বসে আছে। তাদের খোশগল্পের মাঝেই ট্রে হাতে নিয়ে হাজির হয় প্রাচী।
– “আরে প্রাচী, তুই? তুই এখানে কি করছিস?”
ভ্রু কুঁচকে বলে উঠে ইশরাক।
– “তেমন কিছু না ভাইয়ু। এই যে শরবত গুলো মা পাঠিয়েছে। সেগুলোই দিতে আসলাম।”
বলেই একে একে সবার দিকে গ্লাস এগিয়ে দিতে থাকে। সর্বশেষ দুটো গ্লাস বাকি। একটা আকাশ আর অন্য আরেকটা সমুদ্রের। সমুদ্রের দিকে গ্লাস এগিয়ে দিবে এমন সময় পেছন থেকে হুট করে আকাশ এগিয়ে এসে ট্রে থেকে গ্লাস উঠিয়ে নেয়।
– “আরে আকাশ কি করছিস তুই? ওটা তো,,”
– “গলাটা প্রচুর শুকিয়ে গিয়েছে রে প্রাচী। থ্যাঙ্ক ইউ দোস্ত।”
বলেই গ্লাস নিয়ে বসে পড়ে আকাশ। অন্যদিকে প্রাচী অসহায় দৃষ্টিতে ট্রে টার দিকে তাকিয়ে বাকি থাকা গ্লাস টা সমুদ্রের দিকে এগিয়ে দেয়। সমুদ্র আড়চোখে একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে শরবতের গ্লাস নিয়ে নেয়।
এদিকে প্রাচী মনে মনে দোয়া দুরূদ পড়ে যাচ্ছে এই বুঝি আকাশের কারণে তার সব প্ল্যান ভেস্তে যাবে। তার ভাবনার মাঝেই আকাশ গ্লাসে চুমুক দেয়ার পরক্ষণেই বিষম খেয়ে বসে। ঝালে চোখ নাক লাল বর্ণ ধারণ করেছে ইতোমধ্যে। আকাশের এমন করুণ অবস্থা দেখে আশপাশের সবাই আকাশকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আর সেই ফাঁকেই প্রাচী আস্তে করে কেটে পড়ে সে জায়গা থেকে।

৩.
বাড়ির আত্মীয় স্বজন সহ বাকি সকল মেহমান ইশরাকের হলুদ সন্ধ্যা নিয়ে ব্যস্ত। একে একে সবাই ইশরাকের গালে, হাতে হলুদ লাগানো শেষ করে। একপর্যায়ে প্রাচী হলুদ হাতে নিয়ে ইশরাকের দিকে এগোতে নিলে তার পাশ কাটিয়ে সমুদ্র গিয়ে ইশরাকের গালে হলুদ ছুঁইয়ে দেয়। সমুদ্রের এহেন কান্ডে প্রাচীর রাগে শরীর রি রি করছে।
– “সব জায়গায় কাবাবে হাড্ডির মতো আমার কাজে বাধা না দিলে হয় না, কবে যে মুক্তি পাব এই লোকটার কাছ থেকে কে জানে!”
রাগে কটমট করে বিড়বিড় করে প্রাচী। সমুদ্র চলে যেতেই প্রাচী গিয়ে সযত্নে ভাইয়ের গালে হলুদ ছুঁইয়ে দেয়। তবে পরমুহূর্তেই ইশরাক ও পাশের বাটি থেকে অনেকখানি হলুদ নিয়ে এবড়োখেবড়ো ভাবে প্রাচীর গালে লাগিয়ে দেয়। এতেই শুরু হয়ে যায় ভাই বোনের খুনসুটি। ইশরাকের হঠাৎ আক্রমণে কাঁদো কাঁদো চেহারায় মা জেবা বেগমের দিকে তাকায় প্রাচী। এতে জেবা বেগম সহ উপস্থিত সবাই ফিক করে হেসে উঠে।
বেশ খানিকক্ষণ ঘষামাজা করে মুখে লেগে থাকা হলুদের প্রলেপ সরিয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসে প্রাচী। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল গুলো ভালোভাবে আঁচড়ে নেয় সে। ঘড়ির দিকে চোখ যেতেই খেয়াল করে অনেকটাই রাত হয়ে এসেছে। চোখে ঘুম ঘুম ভাব এসে জড়ো হয়েছে। রুমের দরজা লাগিয়ে দিয়ে ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিতেই মিনিট পাঁচেকের ভেতরেই অতল ঘুমের ঘোরে হারিয়ে যায় প্রাচী।

রাতের নিস্তব্ধ প্রহর‌। গভীর ঘুমের মাঝেই গালে, গলায় শীতল কোনো কিছুর স্পর্শ পেতেই শিউরে উঠে প্রাচী। প্রচন্ড ঘুমকাতুরে হওয়া স্বত্বেও যেন মস্তিষ্ক সেই স্পর্শ সম্পর্কে তাকে জানান দিচ্ছে। স্পর্শ ধীরে ধীরে গভীর হতেই আপনাআপনি চোখ খুলে যায় তার। ধড়ফড় করে উঠে বসে সে। পাশে থাকা ল্যাম্প বাতির আলোয় চোখ বুলিয়ে নেয় চারপাশে। না কোথাও কেউ নেই। খাট থেকে ধীর পায়ে নেমে রুমের লাইট অন করে নেয় প্রাচী। অতঃপর আয়নায় নিজের দিকে নজর পড়তেই আতকে উঠে সে। বিস্ময়ে চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে আসে প্রাচীর।…………

#চলবে 🍂

#সূচনা_পর্ব
#সায়াহ্নের_প্রণয় 🦋🦋
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here