সায়াহ্নের প্রণয় পর্ব -২১+২২

#সায়াহ্নের_প্রণয় 🦋🦋
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#একবিংশ_পর্ব

৬০.
– “এ,এটা আবার কেমন প্রশ্ন প্রাচী? হ্যাঁ, আমি তোমাকে ভালোবাসি; কিন্তু কখন থেকে এটা আবার কেমন কথা?”
আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করে সমুদ্র। যেন কিছু লুকিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে। সমুদ্রের কথা শুনে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় প্রাচী। সমুদ্রের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে সরু দৃষ্টিতে তাকায় সে।
– “এড়িয়ে যাচ্ছেন কেন সমুদ্র? আমি তো শুধু একটা সিম্পল‌ প্রশ্ন ই করেছি। আপনি তো দেখি বেশ সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছেন।”
কয়েক সেকেন্ডের জন্য থেমে যায় প্রাচী। সমুদ্র তাও নিশ্চুপ যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে সে।

– “এটা বললেই তো হয় যে আপনি আমাকে এখন থেকে না বরং সেই পাঁচ বছর আগে থেকেই ভালোবাসেন। শুধু মাত্র সেই ভালোবাসা, অনুভূতি গুলোকে প্রকাশ করতে চান নি বলে এড়িয়ে গিয়েছেন আমাকে। চলে গিয়েছিলেন আমাকে ছেড়ে সেই সুদূর ইউকে তে। অ্যাম আই রাইট, মিস্টার জুনায়েদ আরহাম‌ সমুদ্র?”
পিলে চমকে ওঠে সমুদ্র। অবাক হয়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রাচীর দিকে। অন্যদিকে প্রাচীর দৃষ্টি স্থির। দেখে মনে হচ্ছে কোনো প্রতিক্রিয়াই নেই তার মাঝে।
– “কি হলো? এভাবে চমকে উঠলেন কেন? ভাবছেন আমি জানলাম কি করে, এটাই তো? আফটার অল, একজন গ্যাংস্টারের প্রেয়সিনী ছিলাম তার মাথার বুদ্ধি ও তো একটু ইউনিক হতে হবে তাই না? তাহলে শুনুন, আপনার এতদিনের এই অজানা আগন্তুক সেজে থাকার কথা আমি জানতাম। সেদিন রাতে যখন আপনি ব্যালকনি টপকে লুকিয়ে লুকিয়ে রুমে এসেছিলেন হলুদ লাগিয়ে দেয়ার জন্য সেদিন রাতেও আমি সজাগ ছিলাম। এমনকি এতদিনের লিখা চিঠিগুলোও যে আপনার ই; কেননা আপনি একইসাথে অনেক রকম লিখা লিখতে পারেন। সবটা জেনে শুনেও চুপচাপ ছিলাম এই আশায় কখন এসে আমাকে সবটা বলবেন। কিন্তু আফসোস; লাস্টে আমারই সত্যিটা বের করতে হলো। কি করব বলুন? এত টুইস্ট আমার আবার একসঙ্গে হজম হয় না।
রাত হয়েছে অনেক। আপনি গিয়ে শুয়ে পড়ুন। আমারো প্রচুর ঘুম পাচ্ছে এমনিতেই। গুড নাইট ডিয়ার হাজবেন্ড!”
প্রাচীর এমন পরিবর্তিত রূপ ঠিক বোধগম্য হয় না সমুদ্রের। অতি পরিমাণ অবাক হওয়ার কারণে ঠিক কি রিয়্যাক্ট করবে তা বুঝে উঠতে পারছে না ঠিক। প্রাচী তো দেখছি তার চেয়েও একধাপ বেশি ইন্টেলিজেন্ট!
– “এ মেয়ে তো দেখছি আমার চেয়েও বেশি এডভান্স‌। বাহ্ সমুদ্র বাহ্। শেষ মেষ তোর বউ ডিটেকটিভ অফিসারদের ও হার মানাবে এসব ব্যাপারে। আসলেই তারিফ করতে হয়‌। এতদিন ভেবেছিলাম শুধু আমার মাঝেই রহস্য; এখন তো দেখছি আমার চেয়ে আরো বেশি রহস্য এই মেয়ের ভেতরে। ইন্টারেস্টিং!”
মনে মনে বিড়বিড় করে সমুদ্র। ঘড়িতে রাত বারোটা ছুঁই ছুঁই। আসলেই শরীর আজ বেশ ক্লান্ত। তাই আর কথা না বাড়িয়ে গিয়ে বিছানায় একপাশে শুয়ে পড়ে। প্রাচীও এগিয়ে গিয়ে পিহুর পাশে লাইট অফ করে শুয়ে পড়ে। মিনিট দশেকের মাঝেই দুজনেই তলিয়ে যায় অতল ঘুমের ঘোরে।

৬১.
– “আচ্ছা তুমি কি আমাল‌ নতুন মা?”
পিহুকে‌ রেডি করতে ব্যস্ত ছিল প্রাচী। হঠাৎ পিহুর‌ প্রশ্নে থমকে যায় সে। দেখতে অবিকল নিকিতার মতো হয়েছে পিহু‌। বিদেশিনী বিদেশিনী ভাব রয়েছে। সরু নাক, গাঢ় ব্রাউন‌ রঙের চোখ জোড়া। পিহুর আহ্লাদী সুরে বলা কথা শুনে মুচকি হাসে প্রাচী।
– “নতুন মা হবো কেন? নতুন পুরনো বলে মা হয় না। আমি তো তোমারই মা। আমাকে মা বলেই ডাকবে,‌ কেমন?”
– “সত্যি বলছো? ইয়েএএ কি মজা! তার মানে এখন থেকে আমাল ও মা হবে। সবার মতো আমাল মা ও আমাল সাথে স্কুলে যাবে।”
বলেই খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে পিহু। পিহুর‌ এমন উৎফুল্ল তা দেখে মুচকি হেসে পিহুকে জড়িয়ে ধরে প্রাচী।
মাঝ থেকেই আরো এক সপ্তাহ ‌কেটে গিয়েছে চোখের নিমিষেই। আজ হোসেন বাড়িতে যেতে হবে। নতুন মেহমানের আগমনের খবর শুনে প্রত্যেকেই বেশ খুশি। সেই কথা শুনেই আজ কোহিনুর চৌধুরী আর সাদাত চৌধুরীর অনুমতি নিয়ে সে বাড়িতে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল প্রাচী। পিহুকেও সাথে নিয়ে যাবে সে। অবশ্য এই কয়েক দিনে কোহিনুর চৌধুরী পিহুকে নিয়ে বিন্দুমাত্র টু শব্দ ও করেন নি; হয়তো পিহুর‌ ব্যাপারে সবটা জানেন। কোহিনুর চৌধুরীকে যতই দেখে ততই অবাক হয় প্রাচী।

ফোনের মেসেজের রিংটোনের টুং শব্দে ভাবনার সুতো কাটে প্রাচীর। ফোনের স্ক্রিনে সমুদ্র নাম থেকে মেসেজ এসেছে। মেসেজ পড়ে ফোনের দিকে একপলক তাকিয়ে পিহুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে রুম থেকে।
গাঢ় সবুজ রঙের সিল্কের শাড়ি, হালকা অর্নামেন্টস্, চুলগুলো ছেড়ে দেয়া। পিহুকে কোলে গাড়ির কাছে এগোতেই সমুদ্রকে চোখে পড়ে প্রাচীর।
এদিকে সমুদ্র এতক্ষণ গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে ছিল। অপেক্ষা করছিল প্রাচী আর পিহুর‌ জন্য। শাড়ি পরিহিতা নারীর অবয়ব চোখে পড়তেই কিছু সময়ের জন্য থমকে যায় সে। সমুদ্রকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে গিয়ে গলা খাঁকারি দিতেই নড়েচড়ে দাঁড়ায় সমুদ্র।

– “উহুম,উহুম! এখানেই কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সারাদিন পার করার প্ল্যান আছে নাকি ডিয়ার হাজবেন্ড? দেরি হয়ে যাচ্ছে, চলুন।”
সরু দৃষ্টে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে প্রাচী।
– “তুমি চাইলে তা করতে পারি। ডু ইয়ু ওয়ান্ট টু স্টে হেয়ার মাই ডিয়ার ওয়াইফি‌? বাই দা ওয়ে ইয়ু লুক সো হট!”
সমুদ্রের কথা শুনে চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম প্রাচীর। এদিকে পিহু খিলখিল করে হেসে যাচ্ছে।
– “ধ্যাত আপনার সাথে কথায় পেরে ওঠা অসম্ভব! কথাই বলব না আমি।”
বলেই সমুদ্রকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে গাড়িতে বসে পড়ে প্রাচী। প্রাচীর এহেন রিয়্যাকশনে‌ হেসে সমুদ্রও গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়তেই গাড়ি চলা শুরু করে তার নিজ গতিতে।

হোসেন বাড়িতে মেহমান গিয়ে পরিপূর্ণ। হলরুমে মেহমান গিজগিজ করছে। ফিহাকে ঘিরে সবাই নানা আয়োজনে, সেবায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রাচীর দাদীও উপস্থিত রয়েছে। হলরুমে সবার সাথে দেখা করে পিহুকে নিয়ে উপরে নিজের রুমে চলে যায় প্রাচী। নিচে থাকলে মানুষের নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে যেটা এখন চায় না সে।
রুমে আসতেই হাফ ছেড়ে বাঁচে সে। ধীরে ধীরে মেহমান কমলে নিচে যেয়ে কথা বলা যাবে। পিহুকে বিছানার উপর বসিয়ে দিয়ে কাবার্ড থেকে কয়েকটা টেডিবিয়ার বের করে দিতেই সেগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে পিহু। প্রাচীও চলে যায় ফ্রেশ হতে। এদিকে নিচে সমুদ্র বড়দের সবার সাথেই আলাপ আলোচনায় সময় পার করে দিচ্ছে।

৬৩.
সন্ধ্যার পরে,,
বাড়ির সব সদস্য খোশগল্প করতে ব্যস্ত। বাড়ির বড়রা তো ফিহার‌ প্রশংসায় পঞ্চমুখ। প্রাচী কিচেন থেকে সবার জন্য নাস্তা বানিয়ে হলরুমে উপস্থিত হতেই প্রাচীর চাচী মিসেস হেলেনা হাসতে হাসতে কটাক্ষের সুরে বলে উঠেন,
– “কি ব্যাপার গো মেহরিশ; এ বাড়ির বউ তো সুখবর দিয়ে দিল! তা এ বাড়ির মেয়ে আমাদের কবে সুখবর দিবে? আমাদের ও তো বয়স হয়েছে। আর কদিন ই বা বাঁচব বলো?”

চাচীর কথা শুনে প্রথমে খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় প্রাচী। কিন্তু পরমুহূর্তেই বিষয়টি বোধগম্য হতেই লজ্জায় মাথা আপনাআপনি নতজানু হয়ে আসে তার। এর চেয়ে লজ্জাজনক ঘটনায় সম্মুখীন হতে হয়েছে বলে তার মনে হয়না। ভাগ্যিস এখানে সমুদ্র নেই। তাহলে তো লজ্জায় চোখ তুলেই তাকাতে পারত না সে। দ্রুত নাস্তার ট্রে টেবিলের উপর রেখে সবাইকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াবে তখনই সমুদ্রের গম্ভীর কন্ঠস্বর শুনে থমকে দাঁড়ায় সে।

– “আরে চাচি সাহেবা‌, একদম ঠিক বলেছেন আপনি। বয়স তো দেখি আপনার আসলেই অনেক হয়েছে। তা রাইসা যেন কোথায়? শুনেছিলাম তো লাস্ট মান্থ লন্ডনে মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে। বয়স তো রাইসার ও হয়েছে। এতদিনে তো বিয়ে করে আপনাকে নাতি-নাতনি দেয়ার কথা। ঠিক বলেছি না, চাচি সাহেবা?”
সমুদ্রের কথা শুনে মুহূর্তেই মিসেস হেলেনার‌ মুখ চুপসে যায়। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি সমুদ্রের কথা শুনে বেশ বিরক্ত বোধ করছেন। মুখ বাঁকিয়ে কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই সমুদ্র পুনরায় বলে উঠে,
– “আপনারা সবাই জানেন প্রাচীর আর আমার বিয়েটা হুট করেই হয়েছে। সবটাই পরিস্থিতির স্বীকার ছিল। তাছাড়া প্রাচীর এখনো ইয়ারলি এক্সাম বাকি। আমি চাই প্রাচী ওর স্টাডি কন্টিনিউ করুক। আর তেমন কিছু হলে সবার আগের মিষ্টিমুখ আপনাকেই করানো হবে চাচি সাহেবা‌।”
এদিকে সমুদ্রের উদ্ভট সব কথাবার্তা শুনে এককোণে মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে প্রাচী। সব যেন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। সমুদ্র ও আর কোনো কথা না বাড়িয়ে পেছনে ঘুরে প্রাচীর হাত ধরে সবার সামনে থেকেই উপরের দিকে হাঁটা শুরু করে। মিসেস হেলেনা সহ উপস্থিত সবার মুখেই যেন তালা পড়ে গিয়েছে।

– “আরে করছেন টা কি! ছাড়ুন আমাকে। আমি তো চলেই আসছিলাম উপরে। কিন্তু ওখানে সবার সামনে কথাগুলো বলা কি জরুরী ছিল? চাচি সহ সবাই কি মনে করবে এখন? আমিই বা সবার সামনে মুখ দেখাব কি করে? আসলেই আপনার মুখে কোনো কথা আটকায় না!”
মুখ ফুলিয়ে বিরক্তির সুরে সমুদ্রকে বলে ওঠে প্রাচী। সমুদ্র ও হাত ছেড়ে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। সেকেন্ড কয়েক সরু দৃষ্টে তাকিয়ে হুট করেই খানিকটা ঝুকে পড়ে প্রাচীর দিকে। ফিসফিস করে ঘোর লাগানো কন্ঠে বলে ওঠে,

– “কেন ভুল কিছু বলেছি নাকি আমি? ওয়ান মিনিট, ওয়ান মিনিট! বাই এনি চান্স তুমি কি কোনোভাবে এটা বলতে চাইছো না যে নিচে হলরুমে চাচির কথার সাথে তুমিও সহমত? বাহ্, বাহ্ আমার ডিটেকটিভ ওয়াইফি দিন দিন একটু বেশিই রোমান্টিক হয়ে যাচ্ছে।”

সমুদ্রের ফিসফিস করে বলা কথা কর্ণপাত হতেই চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম প্রাচীর। সমুদ্রের ভাবমূর্তি বুঝতে পেরে দ্রুত ছিটকে দু কদম পেছনে সরে এসে দুম করে একটা কিল বসিয়ে দেয় সমুদ্রের বুকে।
– “ব্যাটা লুচু কোথাকার! তিলকে তাল বানিয়ে ফেলেছে। যান আপনাকে আজ থেকে বয়কট করলাম আমি! ধারে কাছে দেখলেও অবস্থা খারাপ করে দেব।”
হঠাৎ প্রাচীর এমন উটকো কথা শুনে মিনিট কয়েক থম মেরে যায় সমুদ্র। অতঃপর বুঝতে পেরে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে আর সেটা খেয়াল করে প্রাচীও মুখ বাঁকিয়ে চলে যায় রুমে।…….
#সায়াহ্নের_প্রণয় 🦋🦋
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#দ্বাবিংশ_পর্ব (সারপ্রাইজ স্পেশাল 🥳🥳)

৬৩.
ঘড়ির কাঁটার সময় তার নিজ পরিক্রমায় চলতে থাকে। সাথে বদলে যেতে শুরু করে পরিস্থিতি, মানুষের জীবন। তেমনই সময়ের পরিক্রমায় চলে গিয়েছে চার মাস। নানান ব্যস্ততায়, সেমিস্টার এক্সাম, ভার্সিটি ক্লাস, বিভিন্ন ফ্যামিলি প্রোগ্রামের মাঝে বেশ ভালোই সময় কাটিয়েছে প্রাচী। সমুদ্রের সাথে ব্যয় করা প্রতিটা মুহূর্ত ই তার দিন ভালো করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। তাদের মধ্যকার আন্ডারস্ট্যান্ডিং আগের চেয়ে আরো কয়েক গুণ বেশি ভালো হয়েছে। আর তার নিত্যদিনের সঙ্গী হিসেবে পিহু তো রয়েছেই। এদিকে অন্যান্য সবার মতোই আকাশ আর হৃদিতার জীবনেও পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তন এসেছে মধ্যকার সম্পর্কে।
হৃদিতার জন্য জমে থাকা বহুদিনের ফিলিংস কয়েকদিন আগেই বেশ সাহস করে হৃদিতার সামনে তুলে ধরে আকাশ। প্রথম প্রথম রিজেক্ট হওয়ার ভয় থাকলেও তার ভয়কে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে হৃদিতাও খুব স্বাভাবিক ভাবেই তা সাদরে গ্রহণ করে নেয়। নিজ নিজ অনুভূতি প্রকাশ করার মাধ্যমেই দুজনের নতুন পথচলা এবং খুব শীঘ্রই তা বিবাহ নামক বন্ধনে রূপান্তরিত হতে যাচ্ছে।

বিগত চার মাসে পিহুকে নিয়ে দু পরিবারের মাঝে বেশ কিছু প্রশ্ন উঠলেও প্রতিবারই প্রাচী সেসব প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে পিহুকে নিজের মেয়ে বলে দাবি করেছে সে। প্রাচীর দৃঢ় মনোভাব নিয়ে হোসেন বাড়ির কেউ তেমন আর কথা বাড়ায়নি। কেননা মিসেস জেবা বেগম আর আনোয়ার সাহেব খুব ভালো করেই জানেন যে প্রাচী একবার কোনো কথা ধোঁয়াশা রেখে দিলে তা আর কেউ জানতে পারবে না। মেয়েটার এমন চাপা স্বভাবের জন্য বেশ চিন্তিত হলেও ইশরাক সামলে নিয়েছে।

ভার্সিটির ক্লাস শেষে ক্লান্ত শরীরে বেশ কিছুক্ষণ আগেই বাড়ি ফিরেছে প্রাচী। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো বাসায় পৌঁছে কোহিনুর চৌধুরী, পিহু কাউকেই চোখে পড়ে নি তার। ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে বেশ খানিকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করার পর বাসার টগর খালার কাছে বাড়ির সবার কথা জিজ্ঞেস করতেই বলে ওঠেন,
– “জানি না গো মা, মালকিন তো আইজ সক্কাল থেইকাই বাড়িত নাই‌। পিহু মা রেও লগে কইরা লইয়া গেছে। কিছু লাগব নি তোমার?”
ছোট্ট করে না বলেই ফের উপরের দিকে চলে আসে প্রাচী। আজকে এমনিতেই কোনো এক কারণে মনটা বিষন্ন ছিল। একেতো সমুদ্রও এখন অফিসের কাজে ব্যস্ত তার উপর হুট করেই তাকে না জানিয়ে কোহিনুর চৌধুরী পিহুকে নিয়ে কোথায় চলে গিয়েছে তাও তার অজানা‌। সব মিলিয়ে পুরো বাড়িতে একা থাকায় মন আপনাআপনিই বিষন্ন হয়ে ওঠে।
বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসে ফোন অন করতেই স্ক্রিনের উপর সমুদ্রের হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী ভেসে ওঠে। কিছু একটা ভেবে সমুদ্রের নাম্বারে ডায়াল করতেই অপর পাশে রিং হতে থাকলেও কেউ রিসিভ করে না। এখন তো লাঞ্চ টাইম। এখন তো সমুদ্রের ফ্রি থাকার কথা। তাহলে ফোন রিসিভ করছে না কেন? বেশ চিন্তিত হয়ে দ্বিতীয় বার পুনরায় কল করতেই সেকেন্ড কয়েক পর রিসিভ হতেই অপর পাশ থেকে কর্কশ কন্ঠস্বর কর্ণপাত হয় প্রাচীর‌।
– “কি হয়েছে প্রাচী? বারবার ফোন করছো কেন? দেখছ তো আমি ফোন রিসিভ করছি না আমি। তোমার তো বোঝার কথা আমি ব্যস্ত আছি। আমি এখন ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং এ আছি। ফোন রাখছি আমি।”
প্রাচীকে কোনো কথা বলার অবকাশ না দিয়ে খট করে কল কেটে দেয় সমুদ্র। আর এদিকে প্রাচী হতভম্ব হয়ে নিষ্পলক চাহনিতে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। স্বাভাবিক ভাবে বললেই তো হতো। এভাবে রুডলি আচরণ না করলেও পারত‌ সমুদ্র। হঠাৎ করেই মন খারাপের পাল্লা আরো দ্বিগুন বৃদ্ধি পায় প্রাচীর। চোখ দুটোও ক্রমশ অশ্রুসিক্ত হয়ে আসছে। টলমল চোখ দুটো লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতে হাঁটুতে মুখ গুঁজে দিতেই অবাধ্য অশ্রু গুলো চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে।

৬৪.
নিচ থেকে অনবরত কলিং বেলের আওয়াজ কানে পৌঁছাতেই ঘুমের মাঝে নড়েচড়ে ওঠে প্রাচী। সন্ধ্যার পর পর কখন যে চোখ লেগে এসেছিল টেরই পয় নি সে। চোখ পিটপিট করে ঘড়ির দিকে তাকাতেই হুড়মুড় করে উঠে বসে প্রাচী। বেশ রাত হয়েছে। অন্যদিকে সমুদ্র দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল বাজিয়েই চলেছে। কিন্তু কেউ না আসায় চিন্তার পরিমাণ ভারী হয় তার। ভেতরে প্রাচী ঠিক আছে তো? চিন্তিত তো পুনরায় কলিং বেলে চাপ দিতে যাবে তখনই দরজা খুলে দেয় প্রাচী।
বিধ্বস্ত, উদাসীন মুখশ্রীতে মলিনতার‌ ছাপ স্পষ্ট। চোখ দুটোও বেশ ফোলা। প্রাচীর এমন অবস্থা দেখে ভ্রু কুঁচকে নেয় সমুদ্র। সে তো সন্ধ্যার সময় প্রাচীকে মেসেজ করেছিল। তাহলে প্রাচী এখনো রেডি হয় নি কেন? তবে কি প্রাচী সেই মেসেজ ই দেখে নি? সমুদ্র ভেতরে প্রবেশ করতেই প্রাচী মাথা নতজানু করে গম্ভীর মুখে বলে ওঠে,

– “আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমি খাবার সার্ভ করে দিচ্ছি।”
প্রাচীর এমন গম্ভীর কন্ঠস্বর শুনে সমুদ্র মাথা তুলে তাকায়।
– “মা, পিহু কোথায়?”
– “টগর খালা বলেছে মা পিহুকে নিয়ে সকালেই বেরিয়েছেন। মাকে ফোন করেছিলাম; সে তো বলেছে রাত ১০:০০ টার মধ্যে বাড়ি ফিরে আসবে। কিন্তু এখন তো ১০:৩০ বেজে গিয়েছে। আচ্ছা আমি মাকে ফোন করে দেখছি।”
বলতে বলতে সমুদ্রকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই সমুদ্র পথ রুখে দাঁড়ায় প্রাচীর।
– “এক মিনিট, প্রাচী! তোমার ফোন কোথায়?”
– “ফোন? ফোন তো রুমে। কিন্তু কেন?”
– “বাই এনি চান্স তুমি কি আমার দেয়া মেসেজ পড়ো নি?”
সমুদ্রের কথা প্রাচীর মাথার উপর দিয়ে যায়। কথার ভাবার্থ বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই সমুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কিছু না বলেই আচমকা প্রাচীর হাত ধরে টেনে রুমে নিয়ে যায়।
– “কি করছেন আপনি সমুদ্র? আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন কেন? আর কিসের মেসেজের কথা বলছেন আপনি? ছাড়ুন আমাকে।”
কিন্তু সেদিকে কোনো প্রকার ভ্রূক্ষেপ না করে রুমে এসে কাবার্ডের কাছ থেকে প্রাচীর ‌ফোনটা হাতে তুলে নেয় সমুদ্র। ফোন অন করে মেসেজ অপশনে ক্লিক করে মেসেজটা প্রাচীর সামনে তুলে ধরতেই প্রাচী চোখ দুটো ছোট ছোট করে স্ক্রিনের দিকে তাকায়। পুরো মেসেজটি পড়তেই মুখ চুপসে যায় তার‌।

– “আ,আস,আসলে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমি খেয়াল,,”
পুরো বাক্য শেষ করতে পারে না প্রাচী। তার পূর্বেই সমুদ্র ধমকের সুরে বলে ওঠে,
– “Go and ready right now! ইডিয়ট একটা!”
মুখ ফুলিয়ে কাবার্ড থেকে একটা ডার্ক রেড কালারের গাউন বের করে ওয়াশরুমের‌ দিকে চলে যায় প্রাচী।
ডার্ক রেড গাউন,‌ পার্ল অর্নামেন্টস‌, ঠোঁটে ডার্ক রেড লিপস্টিক, চুল গুলো সুন্দর করে বেঁধে রাখা। রেডি হয়ে বের হতেই প্রাচী খেয়াল করে সমুদ্র ও তার সাথে ম্যাচিং করে স্যুট পড়েছে। কিন্তু এত রাতে হঠাৎ রেডি হওয়ার বিশেষ কোনো কারণ খুঁজে পায় না সে। এদিকে সমুদ্র একদৃষ্টে প্রাচীর দিকে তাকিয়ে আছে। ডার্ক রেড কালারে বেশ মানিয়েছে প্রাচীকে‌।
বাইরে আঁধার ঘেরা আকাশে টিমটিমে আলো জ্বলছে। গাড়ির কাছে এসে দাড়াতেই সমুদ্র বলে উঠে,
– “এক মিনিট, এখনো একটা কাজ বাকি আছে।”
সমুদ্রের কথায় ভ্রু কুঁচকে নেয় প্রাচী। এখন আবার কি বাকি?
– “কিন্তু কি?”
সমুদ্র কথা না বাড়িয়ে পকেট থেকে একটা ব্লাইন্ড ফোল্ডার বের করে প্রাচীকে ব্লাইন্ড ফোল্ডেড করে দেয়।
– “আমার চোখ বন্ধ করছেন কেন সমুদ্র?”
– “হুসস আর একটা কথা না। চুপচাপ গাড়িতে বসো!”
কি আর করার? অগত্যা শাসন মেনে চুপচাপ গিয়ে বসে পড়ে প্রাচী। এখন শুধু অপেক্ষা সময়ের অব্যাহতির।

৬৫.
বেলুন, শুভ্র রঙের ফুল, বিভিন্ন ক্যান্ডেল আর মরিচবাতি দিয়ে পুরো ছাদ খুব সুন্দর করে ডেকোরেশন করা হয়েছে। ছাদের এক পাশে কাপল টেবিল রাখা হয়েছে। সেটাও খুব সুন্দর করে ডেকোরেশন করা। অতি সন্তর্পণে প্রাচীকে নিয়ে ছাদে উপস্থিত হয় সমুদ্র। এদিকে প্রাচী চোখে থাকা পট্টি খোলার জন্য হাঁসফাঁস করে যাচ্ছে কিন্তু সমুদ্রের কারণে তা আর হয়ে উঠছে না। কিন্তু কথায় আছে না; সবুরে মেওয়া ফলে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর সমুদ্র ধীরে ধীরে প্রাচীর চোখ থেকে পট্টি সরাতেই পিটপিট করে তাকায় প্রাচী।
আশপাশের ডেকোরেশন আর কোহিনুর চৌধুরী, পিহুকে একসাথে দেখতে পেয়ে অবাক হয় সে।
পেছনে ঘুরে সমুদ্রের দিকে তাকাতেই বিনিময়ে সমুদ্র স্মিত হেসে ফিসফিসে আওয়াজে বলে ওঠে,
– “হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, মাই ডিয়ার ওয়াইফি‌!”
সমুদ্রের কথা কর্ণপাত হতেই প্রাচীর টনক নড়ে ওঠে প্রাচীর। জন্মদিন? হ্যাঁ ঠিকই তো। আজ তো তার জন্মদিন। তার ভাবনার সুতো কাটে পিহুর আধো আধো কন্ঠে,
– “হ্যাপি বার্থডে মা!”
সাথে তাল মিলিয়ে কোহিনুর চৌধুরী ও শুভেচ্ছা জানায় প্রাচীকে‌। সমুদ্র চোখের ইশারা দিতেই প্রাচী ভ্রু কুঁচকে পেছনের দিকে তাকায় এবং আরো একধাপ অবাক হয়। অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশের মাঝে বেশ কয়েকটা ফানুস উড়ছে। ছোট বড় সাইজের ফানুস গুলোতে আকাশের নক্ষত্র গুলোও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে আরো কয়েক গুণ বেশি।
সমুদ্র মুচকি হেসে একটা ফানুস প্রাচীর সামনে আনতেই প্রাচীও স্মিত হেসে ফানুস হাতে নিয়ে ছেড়ে দিতেই তা ধীরে ধীরে সুদূর আকাশের দিকে উঠে যেতে থাকে‌।
কেক কাটিং করে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটাতেই পিহু কোহিনুর চৌধুরীর কোলে ঘুমিয়ে পড়ে। প্রাচী আগ বাড়িয়ে পিহুকে নিতে চাইলে কোহিনুর চৌধুরী বাঁধা দিয়ে নিজেই পিহুকে নিয়ে নিচে চলে আসেন।
সমুদ্র ও কিছুক্ষণের জন্য কোহিনুর চৌধুরীকে নিচ পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসে। মিনিট পাঁচেক পর ফের ছাদে উপস্থিত হতেই খেয়াল করে প্রাচী টেবিলে পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।
– “প্রাচী?”
পরপর কয়েকবার ডাক দেয়ার পর ও যখন কোনো প্রত্যুত্তর পেল না তখন সামনে এগিয়ে যায় সমুদ্র। প্রাচীর কাঁধে হাত রেখে পেছনে ফেরাতেই প্রাচী সমুদ্রের বুকের উপর ঢলে পড়ে।
– “ও মাই ডিয়ার সমুদ্র, জানেমান তুমি এসেছ? লাভ ইউ সুইটহার্ট!”
প্রাচীর প্রলেপ শুনে চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে আসে সমুদ্রের। প্রাচী এগুলো তাকে নিজ থেকে বলছে? কিন্তু কি করে সম্ভব?
– “প্রাচী লুক এট মি! কি হয়েছে তোমার? কি সব হাবিজাবি বকছো তুমি?”
প্রাচী মাথা তুলে সরু দৃষ্টে তাকিয়ে কিছুক্ষণ ফিক করে হেসে দেয়। প্রাচীর এমন উদ্ভট আচরণের উৎপত্তি খুঁজে বের করার জন্য আশপাশে তাকাতেই টেবিলের ওপর ওয়াইনের অর্ধেকের বেশি খালি বোতল চোখে পড়ে সমুদ্রের। ছোট্ট একটা দম ফেলে বলে ওঠে,
– “শিট! হলো তো এবার সারপ্রাইজের মাটি দেয়া!”……………..

#চলবে 🍂
#

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here