তোমার স্মৃতি পর্ব -০২

#তোমার_স্মৃতি
#পর্বঃ০২
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা

সানজিদা খুব কষ্টে অল্প কিছু খেয়ে নিলো। ভালো লাগছে না ওর কিন্তু জান্নাতি বেগমের জোরাজোরিতে খেতে হয় তার। কোনোমতে হাত ধুয়ে নিজের বাসায় চলে এলো। শশী ও ওর বাসায় চলে গেল।

রুমের লাইট টা অফ করে বেডে শুয়ে পরলো। শরীরটা খুব ক্লান্ত। ঘুমের খুব প্রয়োজন। কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য বাধা এসে ঘুমাতে দিচ্ছে না ওকে। দুইঘন্টা যাবত বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করলো ও। কিন্তু ঘুম আসছে না তার। আর থাকতে না পেরে ফট করে উঠে বসলো সানজিদা। বিছানা থেকে ওড়না নিয়ে গায়ে জরিয়ে বারান্দায় চলে গেল। দোলনায় বসে বারান্দায় থাকা লাইট অন করে সেই খয়েরী ডায়রিটি হাতে তুলে নেয়। ডায়রি থেকে শুকনো একটা গোলাপ বের করে চুমু খায়। চোখ বেয়ে দুফোটা জল গরিয়ে পড়ে। গোলাপটা আবার ডায়রিতে রেখে ডায়রিটা বুকের মাঝে আকরে ধরে চোখ বন্ধ করে আর বলতে থাকে

“জীবনটা তো অন্যরকমও হতে পারতো। আচ্ছা একটু ভালোবাসায় চেয়েছিলো। একটু ভালোবাসা দিলে কি খুব খারাপ হয়ে যেত রোহান। ছোটখাটো একটা সুখের সংসার বাধতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি তো হতে দিলে না প্রিয়। আচ্ছা তুমি না হয় তোমার মতো সুখে আছো। কিন্তু আমি আমি যে পারছিনা এই দুঃখ সহ‍্য করতে। আমার কথা কি তোমার কোনো সময় মনে পরে না। আমি তো তোমাকে সত্যিই ভালোবেসেছিলাম। প্রচণ্ড আকারে ভালোবেসেছিলাম। পাগলের মতো ভালোবাসার পর কেন অবহেলা উপহার দিলে প্রিয়। তোমার সঙ্গে কি শেষ দেখা হবে নাকি তার আগেই তোমাকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে যেতে হবে। জানো তো তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় সব আপন মানুষকেও নিয়ে গিয়েছ। তবে একটা জিনিস দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছ কখনো কখনো রক্তের সম্পর্ক ছাড়াও মানুষ আপন হয়।”

এসব ভাবতে ভাবতে সানজিদা যে কখন ঘুমিয়ে গেছে টেরও পায়নি। সকালের মিষ্টি রোদ ওর মুখে পরতেই ওর ঘুমটা ভেঙে গেল। সানজিদা ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে রেডি হয়ে নিলো। আজকে আবার একবার হাসপাতালে যেতে হবে ভার্সিটি থেকে। ও একটা সাদা রঙের সালোয়ার কামিজ পরে নিলো। হাতে একটা কালো ঘড়ি কালো হিজাব পেচিয়ে নিলো। এখন আর তার সাজগোজ করতে ভালো লাগে না। বিশেষ একজন তার সাজগোজ করা মুখটা দেখতে খুব পছন্দ করতো। সেই যখন নেই তাহলে সেজে কি করবে। মুখে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠে ওর। অল্প কিছু খেয়ে নিলো সে। বাসা থেকে বেরিয়ে পরলো সে ভার্সিটিতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। ও এবার অর্নাস লাস্ট ইয়ারে পরছে। তার ফ্রেন্ড বলতে শুধু একজন রয়েছে শশী। মেয়েটা অনেক চঞ্চল। মেয়েটা সবসময় সানজিদার হাসির কারণ। যতো কষ্টের মাঝেই থাকুক না কেন মেয়েটা সবসময় তার মন ভালো করার জন‍্য প্রস্তুত থাকে।

রিক্সা থেকে নেমে পরলো সানজিদা। তখনই শশী দৌড়ে এসে জরিয়ে ধরে সানজিদাকে। সানজিদা খেয়াল করলো শশী ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না করছে। সানজিদা অবাক হয়ে শশীর মুখটা নিজের মুখের সামনে এনে বলল

“কিরে কান্না করছিস কেন! কি হয়েছে?”

শশী নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে বলল “তোকে ছাড়া আমি কিভাবে থাকবো বল না।”

সানজিদা কষ্টমাখা একটা মুচকি হাসি বলল “পাগলি একটা এই ব‍্যাপার নিয়ে কেউ এমন ফেচফেচ করে কান্না করে। মানুষকে তো একদিন এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিতেই হবে। আমিও না চলে যাবো। সে যাইহোক চল আজ না হয় ক্লাস করবো না। একটু ঘোরাঘুরি করে আসি।”

শশী মাথা নাড়িয়ে হ‍্যাঁবোধক সম্মতি দিলো। সানজিদা মুচকি হাসি শশীর সঙ্গে ঘুরতে বের হয়। সারাদিন অনেক মজা করে কাটায় তারা। সকাল পেরিয়ে বিকেল হতেই শশীকে ওর বাসায় পাঠিয়ে দিলো সানজিদা। শশী হাসপাতালে সানজিদার সঙ্গে যেতে চেয়েছিল কিন্তু সানজিদা জোর করে ওকে বাসায় পাঠিয়ে দিলো।

হাসপাতালে গিয়ে বসে রইলো সানজিদা। চারপাশে মানুষের তাড়াহুড়ো। কেউ নতুন অতিথি পেয়ে আনন্দে চোখের পানি ফেলছে। কেউবা আপনজন হারিয়ে কান্না করছে। চারপাশে চোখ বোলাচ্ছিল সানজিদা তখন তার ডাক পরলো। ডাক পরতেই ও ধীর পায়ে ডাক্তারের কেবিনে চলে গেল। আধ বয়সী একজন ডাক্তার। ডাক্তারটির নাম আজিজ আহমেদ। তিনি তার চোখের চশমাটা ঠিক করে ওর রিপোর্ট গুলো নেড়েচেড়ে দেখলো। তারপর তার পিএ কে ডেকে সানজিদাকে ডাক্তার নিবিড়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলল। তার সানজিদাকে উদ্দেশ্য করে মুচকি হাসি দিয়ে বলল

“মিস সানজিদা আপনার ট্রিটমেন্ট এখন থেকে আমার স্টুডেন্ট ডাক্তার নিবিড় করবে। আমার পার্সোনাল কিছু সমস্যার কারণে আমি করতে পারছিনা। কিন্তু ও খুব ভালো একজন ডাক্তার। আশা করছি সমস্যা হবে না।”

সানজিদাও কিছু বলল না চুপচাপ ডাক্তার নিবিড়ের কেবিনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। আজিজ সাহেবের পিএ নক করতেই ভিতর থেকে হ‍্যাঁবোধক জবাব ভেসে এলো। ওরা দুইজন কেবিনে প্রবেশ করলো। লোকটা ফাইলে মুখ গুজে রেখেছে। সানজিদা এক নজর তাকিয়ে মাথা নিচু করে রইলো। আজিজ সাহেবের পিএ নিবিড়কে কিছু কথা বলে বেড়িয়ে গেল।

নিবিড় মুচকি হেসে সানজিদার দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে বলল “একি আপনি আপনিই সেই না যে কাল মরতে ধরেছিলেন।”

ডা.নিবিড়ের কথায় সানজিদা মাথা উঠিয়ে দেখলো কালকে যে ওকে বাঁচিয়েছিল সেই ছেলেটা। সানজিদা মুচকি হাসি দিয়ে বলল

“আসলেই পৃথিবী গোল কাল আপনি আমাকে বাঁচালেন আবার আজ আপনিই আমার ট্রিটমেন্ট করবেন। সে যাইহোক এখন বলুন তো আমাকে আর কতো কষ্ট লাগবে এই দুনিয়া ত‍্যাগ করতে।”

নিবিড় সানজিদাকে তার সামনে থাকা চেয়ারে বসতে বলল। সানজিদাও মুচকি হেসে বসে পরলো।

নিবিড় কলম হাতে নিয়ে কপাল কুচকে খুব মনোযোগ দিয়ে সানজিদার সব রিপোর্টগুলো খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগলো। প্রায় পনেরো মিনিট পর নিবিড় রিপোর্ট থেকে চোখ তুলে সানজিদার দিকে তাকালো। সানজিদা একহাত দিয়ে ওর মাথা চেপে ধরে বসে আছে। মুখে বিরক্তিকরভাব স্পষ্ট। নিবিড় তার গলা পরিষ্কার করে গম্ভীর কন্ঠে বলল

“আপনার একটা অপারেশন করতে হবে। অপারেশনটি অনেক ক্রিটিকাল। এই অপারেশনের পর হাজারে খুব অল্প মানুষই বেঁচে থাকে। আমি আপনাকে কিছু ঔষধ লিখে দিচ্ছি। সেগুলো নিয়মিত খাবেন কিন্তু।”

সানজিদা একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল “কি হবে অপারেশন করে। মরে গেলে তো মরে গেলাম। কিন্তু যদি বেঁচে যাই তাও বা আর কতোদিন বাঁচবো। এতো খাটাখাটি করে কি হবে। তার থেকে অপারেশন না করেই না হয় দুনিয়া ত‍্যাগ করি।”

নিবিড় এবার তার দুইহাত টেবিলে রেখে একসঙ্গে করে সানজিদার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো

“আপনি কি আবেগে ভাসছেন। আপনাকে দেখে তো শিক্ষিত মনে হচ্ছে। তারপরও এমন ডিসিশন নেওয়ার মানে কি। অপারেশন করবেন না কেন। আপনি বুঝতে পারছেন তো বিষয়টি। আপনি যদি এখন অপারেশন না করান তাহলে আপনি সইচ্ছায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পরবেন। বেঁচে থাকার একটা সুযোগ আছে। তাও আবার আপনি এমন খামখেয়ালি পানা করছেন কেন। যদিও সব আল্লাহর ইচ্ছে। আপনি খুব অদ্ভুত!”

সানজিদা চুপ করে রইলো। ভালো লাগছে না তার।

নিবিড় এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে টেবিলে থাকা পানির গ্লাস থেকে পানি খেয়ে সানজিদার দিকে তাকিয়ে বলল “আপনার হয় তো আমার কথায় খুব বিরক্ত লাগছে। সরি আমি হয় তো একটু বেশিই কথা বলে ফেলেছি। সে যাইহোক জানেন তো আমাদের বেঁচে থাকা না মরে যাওয়াতে কারো কিছু আসে যায় না। কি আর হবে দুই একদিন কান্নাকাটি করবে তারপর ভুলে যাবে। আমাদের তো বাঁচতে হয় নিজের জন‍্য। নিজে নিজেকে ভালোবাসতে শিখতে হয় জীবনটাকে উপভোগ করতে হয়।”

সানজিদা এবার মাথা তুলে নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে বলল “আমি কি এখন যেতে পারি।”

নিবিড় একটা মুচকি হাসি দিয়ে সানজিদাকে সাতদিন পর আবার মিট করার কথা বলল। সানজিদা নিবিড়ের কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। সানজিদার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো নিবিড়। সে গালে হাত দিয়ে ভাবতে লাগল। আর বিরবির করে বলতে লাগল

“আচ্ছা মেয়েটা এমন অদ্ভুত কেন! মানুষ তো নিজের জীবন বাঁচাতে উঠে পড়ে লাগে আর…

#চলবে

(আসসালামু আলাইকুম; ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here