তোমায় পাবো বলে পর্ব -১২

#তোমায়_পাবো_বলে
#পর্ব_১২
#নিশাত_জাহান_নিশি

ক্ষনিকের মধ্যে আমি চোখ জোড়া বুজে অনর্গল কন্ঠে বললাম,,

“ভাং! পিয়াস ভাই ভাং আনার কথা বলছিলেন!

পরশ ভাইয়ার ডিম্বাকৃতির আঁখি জোড়ায় গাঢ় গম্ভীর রক্তিম আভা ফুটে উঠল যেনো মুহূর্তের মধ্যেই। লোকটার তেজভরা চাহনিতে আমার কম্পিত আঁখি পল্লবে অত্যধিক ভয়ের নেশা জেগে উঠল কিঞ্চিৎ প্রহর অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্বেই। তড়িৎ বেগে আমি ভয়ার্ত নেএ যুগল নামিয়ে নেওয়ার ফুসরতটা ও কুলাতে পারলাম না পর্যন্ত। এর অতি পূর্বেই পরশ ভাই ক্রোধান্বিত গলায় বললেন,,

“ভাং? ভাং খাবে তুমি?”

প্রত্যত্তুরে আমি মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানালাম। আশ্চর্যিতভাবেই পরশ ভাই ক্রোধ আয়ত্তে এনে কেমন যেনো সরল, স্বাভাবিক গলায় আমায় শুধিয়ে বললেন,,

“নাউজুবিল্লাহ। তুমি ও ভাং খাবে?”

প্রশ্রয় পেয়ে আমি কয়েক দফা স্বস্তির শ্বাস নির্গত করে পরশ ভাইকে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বললাম,,

“অসুবিধে কি? আপনারা খেলেই বুঝি মারহাবা? আর আমরা খেলেই নাউজুবিল্লাহ?”

“তাহলে সিগারেট ও ফুঁকো! কে বারণ করল?”

“শুনুন? ভাং মোটে ও আমাদের জন্য নেশাজাত দ্রব্য নয়। যে প্রতিবেলাই ভাং সেবন করতে হবে! বিয়ে শাদির আগমন ঘটলেই তবে আমরা খুশিতে অতি সামান্য পরিমানে ভাং খেতে পছন্দ করি। তাও আবার প্রতিবার নয়। পিয়াস ভাই কায়দা করে এ্যারেন্জ্ঞ করতে পারলেই তবে খাওয়া হয়।”

অতি আগ্রহ নিয়ে পরশ ভাই পুনরায় আমার দিকে অযাচিত প্রশ্ন ছুঁড়ে বললেন,,

“হ্যাংওভার কাটে কিভাবে? আসলে এই বিষয়টাতে খুব কাঁচা তো তাই জিগ্যাসা করলাম!”

“আপনার যেভাবে কাটে, আমাদের ও ঠিক সেইভাবেই কাটে!”

“বললাম তো, এই বিষয়ে আমি এক্কেবারে আনাড়ি।”

“আনাড়ি নয় ওটা খিলাড়ি হবে!”

গলা খাঁকিয়ে পরশ ভাই প্রসঙ্গ পাল্টাতে উদগ্রীব গলায় বললেন,,

“বাড়ির লোকজনদের হ্যান্ডেল করো কিভাবে? মানে দু’তিন ঘাঁ পিঠে পড়ে তো?”

“এটা আপনার বধ্যমূল ধারনা। বাড়ির লোকজনরা আন্দাজই করতে পারেন না।”

দীর্ঘশ্বাস নির্গত করে পরশ ভাই বেশ তৎপর গলায় বললেন,,

“খিলাড়ি! এরপর আসে আমার চে বড় খিলাড়ি!”

অট্ট হেসে আমি পরশ ভাইকে শুধিয়ে বললাম,

“ঐ সময় পিয়াস ভাইয়ার উপর হঠাৎ এতো রেগে উঠলেন কেনো? অযথা মিথ্যেই বা বলছিলেন কেনো? আবার স্যরি চাইতে ও রীতিমতো জোর করছিলেন। বিরাট ভুল তো আপনি ও মাঝে মধ্যে করে থাকেন। আপনার বেলায় তো ভুলের বদলে হাজারটা ভুলই পরিলক্ষিত হয়। কই কখনো তো নিজের ভুলটা প্রকাশ্যে এনে স্যরি চাওয়ার মনোভাবটা ও পর্যন্ত পোষণ করেন না!”

পরশ ভাই স্বাভাবিক গলাই বললেন,,

“পিয়াসের সাথে আমার কোনো কম্পেয়ারিজন নেই। দুজনই আলাদা দুটো মানুষ। তাদের অধিকার, বোধ-বুদ্ধি, জোর খাটানোর মনোভাবটা ও সম্পূর্ণ আলাদা। আমি তোমার সাথে যা করতে পারব, অভেয়সলি পিয়াস তা করতে পারবে না! আর করতে এলে ও আমি বাঁধা দিবো। প্রয়োজনে গলা থেকে মন্ডু আলাদা করে নিবো! তবু ও আমার জায়গা আমি একরত্তি ও ছাড়ছি না। এই জায়গাটা একান্তই আমার। ভাগাভাগির বিষয়টা আমার কোনো কালেই পছন্দের তালিকায় পড়ে নি আর এখন ও পড়বে না। ব্যাস ভবিষ্যৎ আমার নিশ্চিত, সুরক্ষিত!”

হতবাক চাহনিতে আমি পরশ ভাইয়ার দীপ্তিময় মুখমন্ডলে যেনো এক জাদুকরী চুম্বকের আকর্ষন অনুভব করছি। দিন, দুনিয়া বোধ হয় আমার উদাসীনতায় ব্যাস থমকে গেছে। বুকের ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে মন-মাতানো কিছু মিশ্র রঙ্গের সহস্রাধিক অনুভূতির সংমিশ্রনে। কিছু মুহূর্ত এমন হয়, -“যা সারা জীবনের জন্য আঁকড়ে ধরে রাখতে বেহায়া মনটা বেশ উদগ্রীব, উতলা, তৎপর হয়ে উঠে। মুহূর্তটা শেষ হওয়া মানেই যেনো হলো বিরাট এক দুঃস্বপ্ন থেকে টুপ করে বের হয়ে আসা! এই বুঝি স্বপ্ন ভাঙ্গার অপরাধে ক্ষিপ্র হয়ে উঠা মন নিঃস্ব হতে দু সেকেন্ড ও সময় নিবে না! চূর্ণ-বিচূর্ণ হতে ও খুব বেশি একটা বিলম্ব করবে না।

কিঞ্চিৎ মুহূর্ত পর আমি আন্দাজ করতে পারলাম আমার পাশের লোকটা আর পাশে নেই। চঞ্চলা দৃষ্টিতে আমি অন্য পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলাম লোকটা আমার বাঁ পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। তবে আমার ডান কাঁধে উনার প্রশ্বস্ত হাত ছুঁয়ে আছে। অগ্রে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই একজন মাএাতিরিক্ত অসভ্য লোককে আমার দৃষ্টিলোকন হলো। বিদঘুটে চেহারা দেখলেই বুঝা যায় কতোটা নোংরায় মেশানো এই লোকের চাহনি। ইতোমধ্যেই পরশ ভাই লোকটাকে শাসিয়ে রূঢ় কন্ঠে বললেন,,

“কি ব্যাপার ভাই? দেখে-শুনে চলতে পারেন না? মেয়েদের গাঁয়ের সাথে ঢলাঢলি করার অভ্যেসটা কি আপনার পরিবার থেকেই পেয়েছিলেন? মা-বাবার কাছ থেকে শিক্ষা পান নি? মেয়েরা কখনো মায়ের জাত, তো কখনো বোনের জাত?”

লোকটা ব্যাপক ভয় পেয়ে ইতস্তত গলায় প্রত্যত্তুরে পরশ ভাইকে বললেন,,

“স্যরি ভাই। আমি খেয়াল করি নাই।”

“খেয়াল ঠিকই ছিলো। তবে খেয়ালটা নেগেটিভ দিকেই বেশি ছিলো। পরের বার সতর্ক থাকবেন। আই জাস্ট ওয়ার্ন ইউ! থোবড়া মোটামুটি চিনে রাখলাম। পরের বার এসব দেখলেই এ্যাকশন টু রিয়েকশান হবে!”

লোকটা হুড়মুড়িয়ে পরশ ভাইয়ার সম্মুখ থেকে প্রস্থান নিচ্ছেন আর বলছেন,,

“ঠিক আছে ভাই। খেয়াল রাখব!”

অসভ্য লোকটার যাওয়ার পথে পরশ ভাই এখন ও রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছেন। আমার কাঁধে যে উনার হাতটা এখন ও জড়িয়ে আছে সেই দিকে বোধ হয় কিঞ্চিৎ পরিমান ভ্রুক্ষেপ ও নেই লোকটার! গলা খাঁকিয়ে আমি মিটিমিটি হেসে বললাম,,

“বিপদ তো কেটেই গেছে, এবার হাতটা সরান!”

তড়িঘড়ি করে পরশ ভাই আমার কাঁধ থেকে হাতটা সরিয়ে নিলেন। জড়তা সমেত পরশ ভাই আমার দৃষ্টিতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই আমি কড়া কন্ঠে লোকটাকে শুধিয়ে বললাম,,

“আমার প্রতি খুব খেয়াল দেখছি আপনার? ব্যাপার কি হুম?”

“সহাভূতি! ইট’স কল্ড সহানুভূতি!”

ইতিমধ্যেই বিকট হর্ণে বাস এসে থামল স্টপে। যাএীরা সব ক্লান্ত ভঙ্গিতে এক এক করে বাস থেকে নামছেন। পরশ ভাই তড়িঘড়ি করে চায়ের ভাঁড়টা দোকানির হাতে সমর্পণ করে, আমার হাত ধরে ছুটে চললেন বাসের উদ্দেশ্যে। ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকে আমি পরশ ভাইকে প্রশ্ন ছুড়ে বললাম,,

“পিয়ালী আপু তো বাস থেকে নামল বলে। তেঁতুলের আঁচারটা কিনবেন না?”

“ওহ্ সিট। বলতে তো ভুলতে গিয়েছিলাম! এটা একটা ট্রেপ ছিলো।”

মনটা বিষন্ন হয়ে উঠতেই কপালের ভাঁজে চরম বিরক্তরা ভর করল। অনতিবিলম্বে আমি এক ঝটকায় পরশ ভাইয়ার হাতটা ছাড়িয়ে আহত কন্ঠে বললাম,,

“কোথাও যাবো না আমি!”

পরশ ভাইয়া হাঁটার গতি থামিয়ে কোঁমড়ে দু হাত গুজে আমার সম্মুখস্থ হলেন। অতঃপর দাঁতে দাঁত চেঁপে বললেন,,

“কোথাও যেতে হবে না তোমার। এখানেই দাঁড়িয়ে থাকো। মেয়েরা কি এতোটা ও ছোঁচামুখো হয়? তোমাকে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না।”

“হ্যাঁ আমি ছোঁচাই। তেঁতুল, আঁচার, টক জাতীয় সব জিনিসই আমার দুর্বলতা। তাছাড়া আমি জেঁচে পড়ে হাত পাতি নি আপনার কাছে। আপনিই অফার করেছিলেন!”

“মিথ্যেবাদী, চরম মিথ্যেবাদী। তুমি শুধু ছোঁচামুখো নও, চরম মিথ্যেবাদী ও বটে।”

“যা ইচ্ছে ভাবুন। আমি তেঁতুল ছাড়া কোথাও নড়ছি না!”

“উফফফ কিনে দিবো বলছি তো। চলো এবার?”

ঠোঁটের আলিজে মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে আমি পরশ ভাইয়ার ডান হাতটা আঁকড়ে ধরলাম। ম্লান হেসে পরশ ভাই আমার হাতের বাঁধনটায় সরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,,

“মাঝে মধ্যেই প্রবল ইচ্ছে জাগে জানো? কাঙ্ক্ষিত মানুষটা ঠিক এভাবেই স্ব-ইচ্ছায় আমার আঙ্গুলে আঙ্গুলে ছুঁয়ে থাকুক। আগে প্রেম মানেই বুঝতাম- “নিজেকে সস্পূর্ণ দেউলিয়া করে ফেলে ভালো থাকার কোনো এক বৃথা চেষ্টা।” কিন্তু এখন প্রেম মানে বুঝছি-“কিছু পাওয়ার বিনিময়ে সবকিছু উজাড় করে দেওয়াটাই হলো প্রকৃত প্রেমানুভূতি।”

মাথা নুঁইয়ে রাখা ছাড়া আপাতত কোনো সরল পথ মগজে কুলাচ্ছে না। উনার প্রেম আসক্তিময় লাগামহীন কথাবার্তায় শরীরের প্রতিটা লোমকূপে হিমেল হাওয়ার তান্ডব বইতে আরম্ভ করল। সত্যিই তো! আজ উনার ছোঁয়া বড্ড বেসামাল লাগছে! শরীরটা কেমন যেনো শিরশিরিয়ে উঠছে। বুকে কম্পন অনুভব হচ্ছে তীব্রগতিতে। উত্তেজনাময় কয়েকটা স্নিগ্ধ, সুন্দর মুহূর্তের যুগলবন্দীতে হাঁফিয়ে উঠছি ক্রমাগত। তবে কি প্রেম জিনিসটাই এতোটা স্নিগ্ধ, সুন্দর, অমায়িক? প্রেমিকের ছোঁয়া বুঝি ভালো লাগা, ভালোবাসার উপলব্ধি এতোটা নিঁখুতভাবে বুঝিয়ে দিতে পারে? কারো প্রতি তৈরী হওয়া অনুভূতিগুলো ও খুব সহজেই ধরিয়ে দিতে পারে? আজ কি তবে বিশেষ কিছু আছে উনার ছোঁয়ায়? কেনো আজ এতোটা নিমগ্ন হয়ে উঠছি উনাতে? তবে কি এই বুঝি শুরু হলো এক দুষ্টু মিষ্টি প্রেমের শুভারম্ভ?

আমার অপ্রত্যুল ভাবচিন্তায় ছেদ ঘটিয়ে পায়েলের উত্তেজিত কন্ঠস্বর ভেসে এলো কর্ণকুহরে। আনন্দে অত্যধিক আত্নহারা হয়ে পিয়ালী আপু এবং পায়েল আমায় সমভাবে ঝাপটে ধরে বললেন,,

“ইশশ। কতোটা মিস করছিলাম তোমায় জানো? মনে হলো যেনো হাজার বছর পর তোমার সাথে দেখা হলো!”

মৃদ্যু হেসে আমি ও তাদের সাথে তাল মিলিয়ে বললাম,,

“আমি ও তোমাদের খুব মিস করছিলাম জানো? এবার বুঝি আমাদের অপেক্ষার পরিসমাপ্তি ঘটল।”

পাশ থেকে পরশ ভাই ব্যগ্র কন্ঠে বললেন,,

“কি আশ্চর্য। মায়ের চেয়ে মাসির দরদ দেখছি একটু বেশিই উতলে উঠছে। আমি ও তো এখানে আছি নাকি? চোখে পড়ছে না আমায়? এখন তো মনে হচ্ছে আমার চেয়ে এই টয়ার গুরুত্ব তোদের লাইফে বেশি!”

পিয়ালী আপু এবং পায়েল সমস্বরে হেসে পরশ ভাইয়ার মুখোমুখি দাঁড়ালেন। সঙ্গে সঙ্গেই দুজন পরশ ভাইকে ঝাপটে ধরে বললেন,,

“দিন দিন তুমি বড্ড হিংসুটে হয়ে উঠছ ভাইয়া। ইট’স নট ফেয়ার ওকে?”

“আমি বললেই নট ফেয়ার। আর টয়া বললেই সব ফেয়ার? সমাজটা কি আদৌ পুরুষ শাসিত আছে নাকি নারী শাসিত?”

তিন ভাই-বোন মিলে বিভিন্ন ধরনের দুষ্টুমিতে লিপ্ত হয়ে পড়লেন। আন্টি কিছুটা দূর থেকে এক কোনায় দাঁড়িয়ে সবটা পর্যবেক্ষন করছেন অথচ আমাদের ধাঁরে কাছে ঘেঁষছেন না পর্যন্ত। বিষয়টা আমার দৃষ্টিতে সন্দেহের ঠেঁকতেই আমি দ্রুত পায়ে হেঁটে কৌতুহলীপ্রবণ হয়ে আন্টির সম্মুখস্থ হয়ে দাঁড়ালাম। আমাকে প্রদর্শন করা মাএই আন্টি দৃষ্টি ঘুড়িয়ে নিলেন অন্যপাশে। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি তাজ্জব ভঙ্গিতে আন্টিকে শুধিয়ে বললাম,,

“কি হয়েছে আন্টি? আপনাকে এতো উদাস দেখাচ্ছে কেনো?”

বুকের উপর দুহাত বেঁধে আন্টি গুরুগম্ভীর কন্ঠে আমায় বললেন,,

“বাধ্য হয়ে তোমাদের বাড়ি আসতে হলো। নয়তো আমার ইচ্ছে ছিলো না জীবনে কখনো তোমাকে ফেইস করা বা তোমাদের বাড়িতে আসা!”

আহত দৃষ্টিতে আমি আন্টির রাগী মুখের আদলে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই আন্টি চোখ ঘুড়িয়ে আমার দিকে তেজী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,,

“আমার সব’চে দুর্বল জায়গা কি জানো? আমার ছেলে! আমার পরশ। তুমি আমার ছেলে সম্পর্কে কটুক্তি করার দুঃসাহস দেখিয়েছিলে। শুধু তাই নয়, আমার মুখের উপরেই আমার ছেলের স্বভাব সম্পর্কে দু’এক কটু কথা শুনিয়ে দিয়েছিলে। কতোটা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিলাম তুমি জানো?”

পরমুহূর্তে আন্টি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন,,

“তোমার জন্য আমার ছেলের বিয়ে আটকে থাকবে না। বুঝতে পেরেছ তুমি? তোমার চেয়ে হাজার গুন সুন্দুরী, রূপবতী, গুনবতী, মিশুক, অত্যন্ত নম্র-ভদ্র, বুঝদার মেয়েকেই আমি আমার ছেলের বউ হিসেবে খুব শীঘ্রই খুঁজে বের করব। যে আমার ছেলেকে ভীষণ ভালোবাসবে, আমার ছেলেকে আমার চেয়ে দ্বিগুন ভালো বুঝবে, আমার ছেলের স্বভাব-চরিএ নিয়ে তার এতটুকু পরিমান দ্বিধা-দ্বন্ধ থাকবে না! ভালো, খারাপ মিলিয়েই আমার ছেলেকে ভালোবাসবে!”

আমার হতবিহ্বল নেএ যুগলে শ্রাবণের মেঘ জমতেই দৃষ্টি জোড়া নুঁইয়ে নিলাম আমি। ঐদিনের বলা কথাগুলো যে আন্টি এখনো ধরে বসে আছেন পূর্ব থেকে জানতে পারলে হয়তো পরশ ভাইয়ার প্রতি জন্ম নেওয়া কিঞ্চিৎ পরিমান ভালো লাগা টুকুকে ও প্রশ্রয় দিতাম না আমি। সন্তপর্ণে বেহায়া অনুভূতিদ্বয়কে সামলে নিতাম। ইতিমধ্যেই আন্টি হনহনিয়ে আমার সম্মুখ থেকে প্রস্থান নিলেন। চোখের উদয়স্ত জলরাশি চোখের কোটরে নিবদ্ধ করেই হেঁটে চললাম আন্টির পিছু পিছু। কিন্তু পরশ ভাইকে কোথাও দেখতে পেলাম না। মাথা নুঁইয়ে আমি আন্টি, পিয়ালী আপু এবং পায়েলের মুখোমুখি দাঁড়ানোর প্রায় দশ মিনিটের মাথায় পরশ ভাই হম্বিতম্বি হয়ে যেনো কোথা থেকে ছুটে এলেন। পিয়ালী আপু এবং পায়েলের হাত থেকে কাপড়ের ব্যাগটা হাতে নিয়ে পরশ ভাই ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে আমাদের উদ্দেশ্য করে বললেন,,

“চলো চলো। গাড়ি ওয়েট করছে আমাদের জন্য!”

একে একে আমরা সবাই পরশ ভাইকে অনুসরন করে রাস্তার সাইডে দাঁড় করানো বিশাল অটো গাড়িটায় উঠে বসলাম। গাড়িটায় মোট তিনটে ধাপ। প্রথম ধাপের দুটো সিটে ড্রাইভার এবং পরশ ভাই। দ্বিতীয় ধাপের দুটো সিটে আমি এবং পায়েল। তৃতীয় ধাপের দুটো সিটে পিয়ালী আপু এবং আন্টি। যতো রাজ্যের গম্ভীরতা মুখের আদলে পরিপূর্ণভাবে ফুটিয়ে আমি মাথা নুঁইয়ে রাখতে বাধ্য হচ্ছি। আসলেই আমি চাই না, কেউ আমার মন খারাপের রেশটা কিঞ্চিৎ পরিমান আঁচ করতে পারুক। কেউ আমার দিকে অযাচিত প্রশ্ন ছুড়াছুঁড়ি করুক। এর মধ্যেই পেছন থেকে পিয়ালী আপু হঠাৎ পরশ ভাইকে উদ্দেশ্য করে তিরিক্ষি পূর্ণ কন্ঠে বললেন,,

“কি দরকার ছিলো ভাইয়া? অযথা আমাদের বাসে আসতে বলা? পার্সোনাল গাড়িটা নিয়ে এলেই তো পারতাম আমরা। কিছুক্ষন পর পর গাড়ি চেইঞ্জ করতে হচ্ছে। রীতিমতো অসহ্যকর ঠেঁকছে বিষয়টা!”

“ছোট, বড় সব গাড়িতেই ট্রাভেল করার এক্সপেরিয়েন্স থাকা উচিত তোদর। তাই আমি বিশেষভাবেই চেয়েছিলাম মিনিমাম এই ত্যাগটুকু স্বীকার করে বাসে ট্রাভেল করার এক্সপেরিয়েন্সটা তোরা অর্জন কর।”

পিয়ালী আপু নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। পায়েল কিছুক্ষন পর পর আমাকে খুঁচিয়ে মিহি কন্ঠে বলছে,,

“কি হয়েছে আপু? তুমি এতো চুপচাপ কেনো?”

বিনিময়ে আমি জোরপূর্বক হাসি টেনে বিষয়টাকে রীতিমতো এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টায় অটল ছিলাম। পায়েল ও বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবে নেওয়ার চেষ্টাতেই অবিচল ছিলো। গাড়িতে আর একটা কথা ও বলি নি আমরা। গন্তব্যের অপেক্ষাতেই কেটে যাচ্ছে সময়।

,
,

রাত ১২ টা বেজে ১৫ মিনিট বাজছে। আমার রুমের পূর্ব পাশের দেয়ালে টাঙ্গানো বিশাল একক্রলিক ঘড়িটায়। রাতের খাবার না খেয়েই আমি অভুক্ত অবস্থায় বিছানার উপর হাঁটু ভাজ করে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে আছি। আন্টির বলা প্রতিটা ধাঁরালো কথা আমার কর্নকুহরে খুব অসহনীয় ভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। আন্টি কি তবে সত্যিই আমার উপর ভীষন রেগে আছেন? আমাকে খুব মন্দ মেয়ে ভাবতে শুরু করছেন? আমার সম্পর্কে নেতিবাচক ধারনা মনে পোষণ করছেন? খাবার টেবিলে ও তো আন্টি আমার সাথে এক ফোঁটা কথা ও বললেন না। বাকি সবার সাথে কতো হাসি, ঠাট্ট, হৈ, হুল্লোড়ের সাথে কথা বলছিলেন। বিশেষ করে মিলি আপুর সাথে! আন্টি তো রীতিমতো মিলি আপুকে চোখে চোখে হারাচ্ছিলেন! কি এমন ক্ষতি হতো যদি আমার সাথে ও একটু মিষ্টি মধুর সুরে কথা বলতেন? আমার মনের অবস্থাটা একটু খানি বুঝার চেষ্টা করতেন? আন্টির বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্যই তো রাতের খাবারটা খাওয়া হয় নি আমার! আন্টি কি ঘুনাক্ষরে ও টের পান নি তা?

নাকের ডগায় চোখের অবাধ্য জলেরা ছুঁই ছুঁই করতেই আমি নাক টেনে বিছানায় বাঁ কাত হয়ে শুয়ে পড়লাম। বালিশের তলায় হাত রাখতেই পলিব্যাগ জাতীয় কিছু একটার অস্তিত্ব আমি টের পেলাম। তাড়াহুড়ো করে আমি গচ্ছিত সবক’টা পলিব্যাগ হাতে নিয়ে চোখের সামনে ধরতেই তেঁতুলের পাঁচ পাঁচটে আঁচারের প্যাকেট আমার দৃষ্টিলোকন হলো। হুড়মুড়িয়ে শোয়া থেকে উঠে আমি প্রকান্ড চোখে আঁচার গুলোর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই মনে হলো রুমের দরজা ঠেলে কেউ রুমে প্রবেশ করলেন। দরজার দিকে অস্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই ঠোঁটের আলিজে লেগে থাকা পরশ ভাইয়ার ক্রুর হাসি আমার দৃষ্টি সীমানায় পড়ল। দরজায় হেলান দিয়ে বুকে দু হাত গুঁজে পরশ ভাই ঠোঁটের কোণে একই হাসি বজায় রেখে আমার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে বললেন,,

“এই সামান্য কয়েকটা আঁচারের জন্যই রাতের খাবারটা স্কিপ করে গেছো তাই না?”

#চলবে…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here