তোমায় পাবো বলে পর্ব -৩৩+৩৪+৩৫+৩৬+৩৭+৩৮+৪৯+শেষ পর্ব

#তোমায়_পাবো_বলে
#পর্ব_৩৩
#নিশাত_জাহান_নিশি

ইতোমধ্যেই পরশ ওয়াশরুমের দরজা থেকে আমায় ইশারা করে বলছেন যেন বাবাই পরশকে কল করেন! আমি যেন কিছুতেই রাজি না হই পরশকে কল করে এই বাড়িতে নিমন্ত্রণ করতে!

সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি আমি! বাবার নেতিয়ে যাওয়া বিবর্ণ মুখমন্ডলে ক্লেশ, গ্লানি, লজ্জা এবং তীব্র অপরাধবোধ প্রগাঢ় ভাবে ফুটে উঠেছে। পৃথিবীর কোনো মেয়েই তার বাবাকে এহেন বিমূর্ষ অবস্থায় দেখে বাবার করা আবদারের বিপরীতে যেতে পারবে না। নিজ নিজ অবস্থান থেকে চেষ্টা করবে বাবার আবদার মেটানোর। আমি ও ঠিক সেভাবেই বাবার নিরান্দন, বিষাদপূণ মুখশ্রীতে চেয়ে পরশের কাছে বাবাকে অতি পর্যায়ে টেনে এনে ছোট করতে পারছি না! বিবোধ বোধে তীব্র আঘাত অনুভব করছি! অন্যদিকে পরশ ক্রমাগত ইশারা করেই চলছেন, বাবার করা আবদারে রাজি না হতে! পরশকে হারিয়ে না দিতে! এই পর্যায়ে এসে আমি মাথা নুয়াতে বাধ্য হলাম। পরশের দিকে আর এক দফা তাকালেই হয়তো বাবার আবদারের বিপরীতে যেতে হবে আমার!

কিয়ৎক্ষন সবার মধ্যেই পিনপনত নীরবতা বিরাজমানের পর মাথা উঁচিয়ে আমি যেই না বাবাকে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে যাব অমনি বাবা দীর্ঘশ্বাস নির্গত করে আমার মুখপানে চেয়ে বললেন,,

“বিষয়টা আসলেই খুব খারাপ দেখায় টয়া! মেয়ের বাবা হওয়ার সুবাদে আমার যথার্থভাবেই উচিত মেয়ের জামাই এবং মেয়ের শ্বশুড়, শ্বাশুড়ীকে নিমন্ত্রণ করা! বিয়ের দুমাস হতে চলল তোদের। অথচ মেয়ের বাবা হওয়া সত্ত্বে ও আমি এখন ও অবধি তোর শ্বশুড়বাড়ির লোকজনদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতে পারি নি। আদর, যত্ন, সেবা, আত্নি কিছুই করতে পারি নি। বলা বাহুল্য, ভবিষ্যতে হয়তো তোর শ্বশুড় বাড়ির লোকজন তোকে খোঁটা দিতে পারেন! বলতেই পারেন, তোর বাবা খুব দাম্ভিক, বদরাগী, কিপটে এবং জাদরেল স্বভাবের! মেয়ের প্রতি, মেয়ের ভালো-মন্দের প্রতি এবং মেয়ের শ্বশুড়বাড়ির প্রতি কোনো খেয়ালই নেই উনার! তার উপর মেয়েকে দিয়ে আমাদের নিমন্ত্রণ জানিয়েছে, নিজ থেকে নিমন্ত্রণ জানান নি। বিষয়টা খুব দৃষ্টিকটু দেখায় না?”

বাবার সুবুদ্ধি উদয় হওয়ার খুশিতে আমি আনন্দঘন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করার পূর্বেই পরশ ওয়াশরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁত কপাটি কেলিয়ে হাসছেন আর চড়কির মতো গোল গোল আকারে ঘুঁড়ছেন। জিতে যাওয়ার পৈশাচিক খুশি লোকটার মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে! ফিক করে হেসে উঠে আমি বাবার হাত দুখানা চেঁপে ধরে বললাম,,

“কিছুটা দেরি হয়ে গেলে ও তুমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছ বাবা। আমি না চাই না জানো তো? শ্বশুড় বাড়ির লোকজনদের কাছে ছোট হয়ে থাকতে! আমার বাবাকে তাদের কাছে বিন্দু পরিমান ছোট করতে! কেউ না জানুক অন্তত আমি তো জানি, আমার বাবা কতটা মহান! হয়তো উপর থেকে প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই রাগী। তবে ভেতরের মনটা শিশুর মতো কোমল এবং নমনীয়।”

ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা ফুটিয়ে বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে মমতাময় গলায় বললেন,,

“আমি জানি, আমার ছোট মেয়ে আমাকে কতটা ভালোবাসে। তাই তো তার উপরই আমার সমস্ত রাগ, জেদ, জোর, অভিমান, সীমাবদ্ধ! নানা হওয়ার খুশিতে আমি ও দারুন খুশি জানিস? এই প্রথম তোর কাছে খুশিটা শেয়ার করলাম! নানা ভাইয়ের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি আমি। তোর প্রথম সন্তান কিন্তু এই বাড়ি থেকেই হবে টয়া। সব মেয়েদের প্রথম সন্তান তার বাপের বাড়ি থেকেই হয়। আশা করি, তোর স্বামী, শ্বশুড়-শ্বাশুড়ী এই নিয়মটার কথা মাথায় রাখবেন!”

“তুমি যা বলবে ঠিক তাই হবে বাবা। পরশ বা আমার শ্বশুড়-শ্বাশুড়ী এতে দ্বিমত পোষন করবেন না।”

বাবা মিষ্টি হেসে স্থান ত্যাগ করে দাঁড়ালেন। পুনরায় আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,,

“ঘুমিয়ে পড়। কাল সকালে কথা হবে। পরশের পরিবারকে ও কাল সকালেই নিমন্ত্রণ করব। ভাবছি পিয়াস এবং মিলির বিয়েটা ও কাল বা পরশুর মধ্যে ফিক্সড করে নিব। বড় আপা খুব তাড়া দিচ্ছেন!”

“তাহলে তো খুবই ভালো বাবা। আমরা মিলি আপুর বিয়েটা খেয়েই না হয় ঢাকায় যাব। তুমি বরং কাল বা পরশুর মধ্যেই বিয়ের ডেইটটা ফিক্সড করে নাও। শ্বশুড় বাড়ি যাওয়ার পর হয়তো আগামী ৪/৫ মাস ও আমি এই বাড়িতে আসতে পারব না বাবা! পিয়ালী আপু এবং পায়েলের বিয়ে ও অনেকটা ঘনিয়ে আসছে!”

“তুই যা বলছিস তাই হবে মা। এখন ঘুমা। বাবা আসছি কেমন?”

প্রস্থান নিলেন বাবা। যাওয়ার সময় রুমের দরজাটা হালকা ভেজিয়ে দিয়ে গেলেন। ইতোমধ্যেই পরশ ঝড়ের বেগে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে আমার হাত দুখানা টেনে ধরে সোজা দাঁড় করিয়ে দিলেন। বাঁ কোমড়টায় হাতে রেখে লোকটা আমার ডান হাতের আঙ্গুলে নিজের হাতের সবক’টা আঙ্গুল মিশিয়ে আমায় নিয়ে গোল গোল হয়ে ঘুড়তে লাগলেন আর দাঁত কেলিয়ে হেসে গুনগুন করে বললেন,,

“ইয়েস! মে জিত গেয়া। জাদরেল শ্বশুড়ের সাথে চ্যালেন্জ্ঞে আমি জিতে গেছি! এবার দেখার পালা এই দজ্জাল শ্বশুড় কিভাবে আমায় নিমন্ত্রণ জানান। ঠিক কতটা কাতর ভঙ্গিতে বলেন এই বাড়িতে আসতে, উনার মেয়েকে নিয়ে যেতে!”

“শুনুন পরশ। আমার বাবা যেহেতু ভুলটা বুঝতেই পেরেছেন। সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় না আপনার উচিত হবে বাবার অনুভূতি নিয়ে কোনো হাসি, তামাশা করার। বাবাকে কোনো রকম ঠাট্টার খোড়াক তৈরী করার। বাবা কল করে নিমন্ত্রণ জানালে এক কথাতেই আপনি রাজি হয়ে যাবেন প্লিজ। বাবাকে বাধ্য করবেন না কাকুতি, মিনতি করতে। হাজার হলে ও বাবা আপনার বয়োজ্যেষ্ঠ, আপনার নিজের বাবার সমতুল্য!

পরশ আকস্মিক নাচ থামিয়ে বেশ তৎপর গলায় প্রত্যত্তুরে বললেন,,

“তুমি এত সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে কেন টয়া? বাবার সাথে আমার সম্পর্কটা সাপে-নেউলের! আমি সবসময় চাইব বাবার সাথে হাসি, ঠাট্টা করতে। ইচ্ছেপূর্বক বাবাকে ক্ষ্যাপাতে! এর মানে এই নয় যে, বাবাকে আমি সম্মান বা শ্রদ্ধাবোধ করি না। বাবার প্রতি আমার আলাদা এক অনুভূতি আছে। যা আমি প্রকাশ করতে চাই না। আমি চাই সবসময় এভাবেই বাবার পিছনে লেগে থাকতে, ঝগড়া-বিবাদ করতে, সম্পর্কটাকে সবসময় এভাবে জমিয়ে রাখতে৷ অতিরিক্ত সম্মানবোধ দেখিয়ে সম্পর্কটাকে এক ঘেঁয়ে করতে চাই না। আমাদের শ্বশুড়, জামাইয়ের সম্পর্কটা হবে একদম আলাদা। আট, পাঁচটা শ্বশুড়-জামাইয়ের সম্পর্কের মতো অতোটা স্বাভাবিক বা সহজ নয়!”

“ওহ্ তাই? তার মানে আপনি সবসময় আমার বাবার পিছনে এভাবেই লেগে থাকবেন?”

“হ্যাঁ থাকব! এভাবেই লেগে থাকব। শ্বশুড়-জামাইয়ের লড়াই আজীবন ঠিক এই ভাবেই বহাল থাকবে!”

ফিক করে হেসে দিলাম আমি। পরশ আমায় ছেড়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে রুমের দরজাটা আটকে দিলেন। অতঃপর আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আচমকা আমায় কোলে তুলে নিলেন। কটমট দৃষ্টিতে লোকটার লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকাতেই লোকটা আমার নাকে নাক ঘঁষে বললেন,,

“আজ যে আমার মেয়ের মাম্মাম আমাকে ঠিক কতটা খুশি করেছে তার কোনো এক্সপ্লেনেশান হয় না। তাই আজ রাতটা আমার মেয়ের মাম্মামকে আমি খুব বেশি ভালোবাসতে চাই। ঠিক প্রথম রাতের মতো!”

লজ্জায় কুঁকড়ে উঠে আমি লোকটার বুকের পাজরে মুখ লুকালাম। মন্থর গলায় বললাম,,

“আপনি কি করে জানলেন? আমাদের মেয়ে হবে?”

“ছেলে বাবু হলে ও কিন্তু আমার কোনো আপত্তি নেই! তবে আমি চাই আমাদের প্রথম সন্তান মেয়ে বাবু হউক!”

“আর যদি দুইটা মেয়ে বাবু হয়? তখন?”

“তখন তো আমি খুশিতে পাগল প্রায় হয়ে যাব। বাঁধ ভাঙ্গা খুশিতে ঠিক আত্নহারা হয়ে উঠব!”

“তখন আমায় কি গিফটস দিবেন হুম?”

“তুমি যা চাইবে!”

“আমাদের কিন্তু এখন ও হানিমুনে যাওয়া হয় নি!”

“মাথায় আছে আমার। জাস্ট কয়েকটা মাস সময় দাও আমায়। আমরা ও হানিমুনে যাব। চার চারটে কাপল মিলে আমরা হানিমুনে যাব!”

“মানে? আপনি মিলি আপু, পিয়ালী আপু এবং পায়েলের কথা বলছেন?”

“ঠিক তাই!”

মিষ্টি হেসে আমি পরশের গলা জড়িয়ে ধরলাম। ক্রুর হেসে পরশ আমায় নিয়ে বিছানায় শায়িত হলেন। তীব্র ভালোবাসায় আমায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন লোকটা এক অজানা শহরে! যে শহরে ভালোবাসার কোনো এক্সপ্লেনেশান হয় না!

,
,

পরের দিন। ঘড়িতে প্রায় ১০ টার কাছাকাছি। সকালের নাশতা শেষে বাড়ির সবাই বসার ঘরে গোল হয়ে বসে আছি। বাড়ির প্রতিটা সদস্য এই গোল বৈঠকে উপস্থিত। বৈঠকের মধ্যমনি হয়ে বসে আছেন বাবা। সবার উৎসুক দৃষ্টি বাবার দিকে। বাবা ফোন হাতে নিয়ে দারুন জড়তায় ভুগে কিয়ৎক্ষন পর পর আমাদের সবার দিকে ক্ষীণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করছেন। মা আমার পাশে বসে কেবলই দাঁতে দাঁত চেঁপে বাবাকে বলছেন, তাড়াতাড়ি পরশকে কলটা করতে। বেলা বয়ে যাচ্ছে। বাবা গলা খাঁকারী দিয়ে বার বার পরশের নাম্বারে ডায়াল করে ও মাঝ পথে হুট করে কলটা কেটে দিচ্ছেন। প্রায় চার বার এই একই কাজ পুনরাবৃত্তি হওয়ার পর মা অবশেষে রাগান্বিত গলায় বাবাকে শুধিয়ে বললেন,,

“কি চাইছটা কি তুমি? মেয়ের জামাইকে কল করবে না? মেয়ের শ্বশুড়-শ্বাশুড়ীকে নিমন্ত্রণ করবে না? এতই অহংকার তোমার?”

বাবা আবদার সূচক গলায় মায়ের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“তুমি একটু আমার বদলে মেয়ের জামাইয়ের সাথে কথা বলে দিবে?”

“কেন কেন? আমি কথা বলব কেন? চ্যালেন্জ্ঞ নেওয়ার সময় কি আমি চ্যালেন্জ্ঞটা নিয়েছিলাম? না আমি মেয়ের জামাইয়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিলাম?”

বাবা মাথা নুঁইয়ে নিলেন। নিরুপায় হয়ে আঁখিদ্বয় বুজে বাবা বুকে এক গাধা সাহস সন্ঞ্চার করে পরশের নাম্বারে এবার ডায়াল করেই নিলেন। কানে ফোন চেঁপে বাবা চোখ, মুখ খিঁচে বন্ধ করে রেখেছেন। বাবার এহেন হটকারী কার্যকলাপ দেখে উপস্থিত সবাই মুখ চেঁপে হাসতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। পর পর দুবার কান থেকে ফোন নামিয়ে বাবা পরশের নাম্বারে অনবরত ডায়াল করেই চলছেন। ঐ পাশ থেকে ফোন তুলছেন না পরশ। বুঝতে আর বাকি রইল না পরশ ইচ্ছাকৃত ভাবে বাবাকে ঘাটাচ্ছেন! চতুর্থ বারের বেলায় বাবা কপালের ভাঁজে বিরক্তির ছাপ ফুটিয়ে বিড়বিড় গলায় বললেন,,

“ইচ্ছে করেই ছেলেটা আমায় রাগাচ্ছে। ভাব দেখাচ্ছে ভাব! আমার হেরে যাওয়ার খুশিতে নিশ্চয়ই সে শয়তানী চাল চালছে। আমাকে আর ও হেনস্তা করার ফন্দি আঁটছে। উফফফ অসহ্যকর এই ছেলে!”

হাসি গলাধঃকরন করে আমি বাবার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললাম,,

“কি হয়েছে বাবা? পরশ ফোন তুলছেন না?”

“নাম্বার ব্যস্ত বলছে। নিশ্চয়ই আমার সাথে বজ্জাতি করছে!”

উপস্থিত সবাই খিলখিলিয়ে হেসে উঠতেই বাবা সবার দিকে অগ্নিঝড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। সঙ্গে সঙ্গেই সবাই হাসি থামিয়ে শুকনো ঢোক গিলতে আরম্ভ করলেন! মা ঠোঁট কামড়ে হাসি চেঁপে বললেন,,

“দেখি, ডায়াল করতে থাক। যতক্ষন অবধি না জামাই ফোন তুলছে। ব্যস্ত মানুষ তো! হয়তো অফিসের কাজে মহাহাহা ব্যস্ত৷ আমার মেয়ে জামাই তো আর তার শ্বশুড়ের মতো নিকাম্মা নয়! যে সারাক্ষন বাড়িতে থেকে থেকে অলস সময় পাড় করবে!”

বাবা ক্ষেপে উঠে ও মায়ের উপর রাগ ঝাড়লেন না। সন্তপর্ণে রাগটাকে আয়ত্তে নিয়ে এলেন। প্রায় ষষ্ঠ বারের বেলায় ঐ প্রান্ত থেকে পরশ কলটা তুলতেই বাবা কলটা লাউড স্পীকারে রেখে দিলেন। গলা খাঁকিয়ে বাবা হ্যালো বলার পূর্বেই পরশ ঐ প্রান্ত থেকে রূঢ় গলায় বললেন,,

“হ্যালো কে? বার বার বিরক্ত করছেন কেন? কলটা কেটে দিচ্ছি মানে আমি ব্যস্ত আছি! এতটুকু বুঝার বুদ্ধি ও মাথায় নেই আপনার? ভারী আশ্চর্যকর লোক তো!”

বাবার পাশাপাশি উপস্থিত সবাই হকচকিয়ে উঠলেন। শার্টের কলারটা ঠিক করে বাবা নমনীয় গলায় বললেন,,

“স্ক্রীনের দিকে তাকাও। নাম্বারটা ভালো দেখে এরপর কথা বল!”

“দেখেছি! তো? কি হয়েছে? আননৌন নাম্বার। আপনাকে নিশ্চয়ই চেনার কথা নয় আমার!”

“ভয়েসটা ও চিনতে পারছ না?”

“উমমমমম..কিছুটা পরিচিত লাগছে! কিন্তু কেন বলুন তো?”

“কেন?”

“কারন আমার জাদরেল শ্বশুড়ের গলার স্বরটা ও কিছুটা এরকম! তবে উনি আপনার মত এতটা মিষ্টি স্বরে কথা বলেন না! খুব অহংকার আমার শ্বশুড়ের বুঝেছেন? গলায় অহংকারী একটা ভাব আছে! আপনি হয়তো আমার শ্বশুড়ের কাছের কেউ হতে পারেন! নিশ্চয়ই আপনাকে উনি হায়ার করেছেন তাই না? আমাকে মানিয়ে এই বাড়িতে আনার জন্য?”

“এই যে এই লোকটার সাথে কথা বলছ তার গলায় অহংকারী ভাব নেই?”

“না নেই। থাকলে এতক্ষন কথা বলতাম নাকি? ঠিক মুখের উপর কলটা কেটে দিতাম। অহংকারী পুরুষ মানুষ আমার পছন্দ না। তাই বোধ হয় আমার শ্বশুড় মশাই স্বয়ং অহংকারী স্বভাবের পড়েছেন!”

দাঁতে দাঁত চেঁপে ও বাবা রাগ সংবরন করতে না পেরে বললেন,,

“তুমি কি সত্যিই আমাকে চিনতে পারছ না? আমার নাম্বারটা সত্যিই কি তোমার ফোনে সেইভ করা নেই? আমাকে কি আমাকে হায়ার করা লোক মনে হচ্ছে?”

“না নেই! অপ্রয়োজনীয় কারো নাম্বার আমার ফোনে সেইভ করা থাকে না। অবশ্য জোর দিয়ে বলতে পারছি না, আপনি আমার শ্বশুড়ের হায়ার করা লোক। তবে সন্দেহ করছি!”

“আচ্ছা? তুমি কি এভাবে জনে জনে বদনাম করে বেড়াও তোমার শ্বশুড় মশাইয়ের নামে?”

“হ্যাঁ করি! প্রয়োজন হলে করি! আপনি নিশ্চয়ই আমার শ্বশুড় মশাইয়ের কাছে এসব বলতে যাবেন না! আচ্ছা যাই হোক, এখন বলুন? আপনি কে? আপনার পরিচয় কি?”

“মশকরা করছ আমার সাথে? ইয়ার, দোস্ত পেয়েছ আমায়?”

“স্যরি স্যার! আমি আপনার সাথে মোটে ও ইয়ার, দোস্ত হিসেবে কথা বলছি না। সম্পূর্ণ একজন অপরিচিত মানুষ হিসেবে কথা বলছি। সত্যি বলতে গেলে আপনার সাথে অহেতুক মশকরা করার পর্যাপ্ত সময়টা ও নেই আমার!”

“আমি তোমার শ্বশুড় বলছি! আফজাল হোসেন বলছি!”

“হ্যাঁ তো? কি করতে পারি? আমি জানি আপনি আমার শ্বশুড় মশাই বলছেন! যার সাথে আমার কোনো সু-সম্পর্ক নেই। না আছে কোনো বুঝা-পড়া। সেক্ষেত্রে তো আপনি আমরা অপরিচিতই হলেন তাই না?”

“তার মানে তুমি ইচ্ছে করে আমার সাথে নাটক করছিলে?”

“হ্যাঁ করছিলাম। আপনি ও কিন্তু আমার সাথে কম নাটক করেন নি! আপনার এক মেয়েকে নিয়ে যা নাটক করেছেন আপনি! বাপরে, বাপ! হেরে যখন ভূত হলেন ঠিক তখনই মেয়ের জামাইকে কল করতে বাধ্য হলেন তাই না? অহংকার ভেঙ্গেছে তো আপনার?”

“শুনো? আমি তোমার সাথে নতুন করে কোনো দ্বন্ধে জড়াতে চাই না। আজ বা আগামী কালের মধ্যে তোমার পুরো পরিবার নিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে আসবে৷ নিমন্ত্রণ রইল তোমাদের!”

“স্যরি স্যার! আমি আসতে পারব না। আপনি এক কাজ করুন। আপনি এসে আপনার মেয়েকে আমাদের বাড়িতে দিয়ে যান!”

“গুরুজনদের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানো না? মুখের উপর মানা করে দিলে?”

“আপনি জানেন না? মেয়ের জামাইদের সাথে কিভাবে আদুরে গলায় কথা বলতে হয়? সব ক্ষেত্রে ঝাঁঝালো গলায় কথা বললে হয় না! মেয়ের জামাইদের সাথে নমনীয় হতে হয়!”

“এখন কি আদর, সোহাগ করে বলতে হবে? বাবা এসো, তোমার পরিবার নিয়ে এসো, এসে আমার মেয়েকে নিয়ে যাও, আমাকে এবং আমার পরিবারকে উদ্ধার কর, তুমি বা তোমরা না এলে আমি ভীষণ কষ্ট পাব বাবা! এভাবে ননাই করে কথা বলতে হবে?”

“আলবাদ বলতে হবে! ঠিক এভাবেই আহ্লাদী স্বরে বলতে হবে! দেখি, বলা শুরু করুন। আমি অপেক্ষা করছি!”
#তোমায়_পাবো_বলে
#পর্ব_৩৪
#নিশাত_জাহান_নিশি

“আলবাদ বলতে হবে! ঠিক এভাবেই আহ্লাদী স্বরে বলতে হবে! দেখি, বলা শুরু করুন। আমি অপেক্ষা করছি!”

প্রবল ঝোঁক চেঁপে বসল বাবার আপাদমস্তকে। ধৈর্য্যশীলতা ক্রমশ হ্রাসমান হয়ে কঠোর সংকল্পে পরিনত হলো! একগুঁয়ে ভাব নিয়ে বাবা সশব্দে চেঁচিয়ে বললেন,,

“দিচ্ছি না আমি আমার মেয়েকে কোথাও। আমার মেয়ে এই বাড়িতেই থাকবে। আমার সাথে থাকবে, আমার পরিবারের সাথে থাকবে। নমনীয়, কোমলীয়, মধুময় ভাষায় কথা বলতে পারব না আমি! রাতারাতি নিজস্ব স্বভাব পাল্টানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”

পরশ খানিক ভড়কে উঠলেন। কিঞ্চিৎ নীরবতায় নিজেকে প্রতিস্থাপন করলেন। অতঃপর শান্ত গলায় বললেন,,

“কুল শ্বশুড় আব্বা। প্লিজ বি কুল! বুঝলাম না এত চটকে যাচ্ছেন কেন? এই যে এইমাত্র হুটহাট রেগে সিদ্ধান্ত নিলেন আপনার মেয়েকে আপনার বাড়িতে আপনার কাছে রেখে দিবেন। আদৌ কি সিদ্ধান্তটা যুক্তিযুক্ত হয়েছে? সমাজ মানেন তো আপনি? মানে, সমাজের কর্ণধার তো আপনি নিজেই। এমনিতেই আপনার মেয়ে আমার সাথে পালিয়ে বিয়ে করে আপনার নাক কেটেছিল। এখন যদি আপনি, আপনার মেয়ে এবং তার গর্ভে বেড়ে উঠা আমার সন্তানকে আপনার কাছে পার্মানেন্টলি রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিন, সমাজে কি তবে এই বিষয় নিয়ে কোনো অনধিকারচর্চা হবে না? অভিজ্ঞ মা, চাচী, খালাম্মা, আন্টিরা এই বিষয়ে কথা তুলবেন না? মুখ ভর্তি পান চিবুতে চিবুতে পাড়ায় পাড়ায় এসব রটিয়ে বেড়াবেন না? তখন আপনার মান- সম্মান ঠিক কোথায় যাবে শ্বশুড় আব্বা? পারবেন তো নিজের মান-সম্মান ঠেকাতে?”

“তো কি করব আমি হ্যাঁ? কি করব? তোমার হাতে-পায়ে ধরে বলব এসো আমার মেয়েকে নিয়ে যাও?”

“বুঝেছি, আপনার হাই প্রেশারের ব্যামো আছে! তাই অল্পতেই রেগে যান। আরে মেরি শ্বশুড় আব্বা! আমি তো বলি নি, আমার হাতে-পায়ে ধরে আমায় আমন্ত্রণ জানাতে! আমি জাস্ট বলতে চাইছি, সামান্য আদুরে গলায় আমার সাথে কথা বলুন। ভালোবাসা এবং আবেগঘন অনুভূতি নিয়ে আমায় আহ্বান জানান! মানে, বাকি শ্বশুড় আব্বারা যেভাবে তাদের জামাইদের সাথে নমনীয়, কোমলীয়, মধুরময় আচার-ব্যবহার করেন ঐ রকম আর কি!”

“শুনো? তোমার সাথে আমার আর কোনো কথা নেই। সব কথা মিটে গেছে। এবার যা কথা হবে তোমার মা-বাবার সাথে হবে। উনাদের নিমন্ত্রন জানিয়েই আমি আমার ভূমিকা শেষ করব!”

“আরে ওয়েট ওয়েট শ্বশুড় আব্বা। আমার সাথেই তো আপনার সমস্ত কথা বার্তা! আমি যদি আসতেই রাজি না হই তবে আমার বাবা-মা কোন কারনে, কোন জোরে, কোন অধিকারে আপনাদের বাড়িতে আসবেন? আমিই তো হলাম রেড পেন দিয়ে আন্ডারলাইন করা মেইন পয়েন্ট! সো যেন তেন প্রকারেই হউক আমাকে আপনার মানাতেই হবে!”

ফট করে বাবা কলটা কেটে দিলেন। রাগ, জেদ, সংকীর্ণমনতায় এক বিমূর্ষ অবস্থা বাবার। উপস্থিত সবার মুখমন্ডলে আতঙ্কের ছাপ প্রগাঢ় ভাবে দৃশ্যমান। হুট করে বাবা বসা থেকে উঠে ঝাঁঝালো গলায় বললেন,

“এমন মেয়ের জামাই আমার চাই না। যে মেয়ের জামাই শ্বশুড়কে ঠাট্টা পাত্র হিসেবে দেখা। আমার চেনা-জানা কোনো শক্রুর ও যেন এমন বাজিগর জামাই না হয়!”

শুকনো মুখে আমি বাবার রক্তিম বর্ণ ধারন করা মুখমন্ডলে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললাম,,

“পরশ তোমার সাথে মজা করছিলেন বাবা। তুমি সিরিয়াসলি নিও না প্লিজ। পরশ মন থেকে সত্যি তোমাকে অনেক ভালোবাসেন, শ্রদ্ধা করেন, এমনকি সম্মান ও করেন। পরশ খামোখা তোমায় রাগাতে চান বাবা। আর তুমি ও উনার কথায় হুটহাট রেগে যাও! এসব প্লিজ ছাড় বাবা! মা-বাবাকে কল করে নিমন্ত্রণ জানিয়ে দাও। এরপর তোমাকে আর কিছু করতে হবে না! যা করার আমরা করব!”

বাবা রাগে গজগজ করে স্থান পরিত্যাগ করে বললেন,,

“রুমে যাচ্ছি আমি। ঐ বাজিগর, ধূর্ত, বজ্জাত ছেলের বাবা-মায়ের সাথে আমি ঠান্ডা মাথায় রুমেই কথা বলছি!”

বাবা উনার কক্ষের চৌকাঠে পদার্পণ করতেই সবাই বুক ফাঁটা হাসিতে মত্ত হয়ে উঠল। মিলি আপু, রুম্পা আপু, নীলা, স্নিগ্ধা দাঁত কেলিয়ে হেসে সমস্বরে বলছে,,

“ইশশশ! এই প্রথম জেঠু জব্দ হয়েছে! তর্কে আমাদের জিজুর সাথে ঠিক পেরে উঠতে পারেন নি! ঠিক দু দু বার বাধ্য হয়ে জেঠুকে হার মানতে হয়েছে!”

মা হাসি চেঁপে রুক্ষ গলায় বোনদের শাসিয়ে বললেন,,

“এই থাম তোরা। এখন যদি উনি রুম থেকে শুনতে পান না, তোরা উনার খিল্লি উড়াচ্ছিস? তো আজ বাড়িতে দক্ষযজ্ঞ বেঁধে যাবে, এই বলে দিলুম!”

হাসি থামিয়ে সবাই নিশ্চুপ, নির্বিক, নিস্তব্ধতার, রূপ নিলো। আমি আড্ডা মহল ছেড়ে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হলাম। পরশের সাথে অনেক বুঝা পড়া বাকি আছে আমার। লোকটা কেন বার বার আমার বাবার পেছনে লাগছেন, কেন বাবাকে কষ্ট দিচ্ছেন, কেন কটু কথা শুনাচ্ছেন এ সবকিছুর জবাবদিহি লোকটাকে দিতে হবে! এসব ইয়ার্কি, দুষ্টুমি আর চলবে না বাবার সাথে। বাবাকে বাবার মতো সম্মান দিতে হবে। প্রচুর ক্ষিপ্র হয়ে আমি রুমে প্রবেশ করে পরশের নাম্বারে ডায়াল করলাম। ঐ প্রান্ত থেকে পরশ কলটা তুলতেই আমি তটস্থ গলায় লোকটাকে শুধিয়ে বললাম,,

“কি চাইছেনটা কি আপনি? কেন আপনি বাবার সাথে রীতিমতো অসভ্যতামো করছেন?”

পরশের অট্ট হাসির আওয়াজে আমার কান শুদ্ধ ঝালাফালা হয়ে যাচ্ছিল! নাক, মুখ খিঁচে বন্ধ করে আমি কপালে কয়েক দফা বিরক্তির ভাজ ফুটিয়ে বললাম,

“কি হয়েছেটা কি? এভাবে বিচিত্র প্রাণিদের মতো হাসছেন কেন?”

“উফফফ, আর পারছি না আমি। সিরিয়াসলি টয়া। জীবনে এই প্রথমবার এত হেসেছি আমি! ইউ নো হোয়াট? আমার আশে পাশের কলিগরা আমাকে কম/বেশি পাগল ভাবতে শুরু করেছে! রীতিমতো আমার চোখে জল এসে গেছে বিলিভ মি! পেটে জাস্ট খিল ধরে গেছে। জাদরেল শ্বশুড় মশাই আজ আমাকে অনেক বেশি মজা দিয়েছে!”

“খু্ব মজা হচ্ছে না? খুব মজা হচ্ছে? আমার বাবাকে যা তা বলে ক্ষেপিয়ে খুব মজা পাচ্ছেন আপনি?”

“হ্যাঁ পাচ্ছি। সাংঘাতিক মজা পাচ্ছি। এইটা তো জাস্ট ডেমো ছিল আমার বউ। পিকচার তো এখন ও বাকি আছে!”

“মানে? আর ও কি কি করার বাকি রেখেছেন আপনি?”

“আগে তো স্ব-সম্মানে শ্বশুড় বাড়িতে আসতে দাও। এরপর না হয় দেখে নিবে, আর কি কি করার বাকি আছে!”

“আসছেন কবে আপনি?”

“আমি এবং বাবা আগামী কাল বা পরশুর মধ্যে আসছি। মা, পিয়ালী এবং পায়েল বিকেলের মধ্যে কুমিল্লা পৌঁছে যাবে আশা করছি।”

বিষন্ন গলায় আমি লোকটাকে শুধিয়ে বললাম,,

“আপনি আসবেন না আজ?”

“না বউ! অফিসে অনেক গুলো কাজ।”

কিঞ্চিৎ মুহূর্ত থেমে লোকটা ম্লান হেসে পুনরায় বললেন,,

“পরশু চলে আসব পাক্কা!”

“আজ মিলি আপুর বিয়ের পাকা কথা হবে! আর আপনি থাকবেন না? খুব মিস করব আপনাকে!”

“আমি ও খুব মিস করব বউ! কিন্তু কি করব বলো? আমার পেশা আমাকে আটকে দিচ্ছে! মন খারাপ করবে না একদম। পরশু ঠিক চলে আসব আমি!”

বিমূর্ষ গলায় আমি বললাম,,

“ঠিক আছে, রাখছি।”

কলটা কোনো মতে কেটে আমি মন খারাপের মেঘ নিয়ে রুম থেকে প্রস্থান নিলাম। প্রায় এক মাস হতে চলল, লোকটাকে আমি ঠিক মতো কাছে পাচ্ছি না! এই বাড়িতে আসার পর মাত্র দুবার এসেছেন উনি আমার কাছে। মন চাইলে ও দেখতে পারছি না, ছুঁতে পারছি না, লোকটার সেবা-যত্ন করতে পারছি না! বুকটা খাঁ খাঁ করছে৷ লোকটার শূণ্যতায় বুকটা খাঁ খাঁ করছে। চাঁপা শ্বাস নির্গত করে আমি রান্নাঘরে মা এবং চাচীমনিদের কাজে সাহায্য করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আজ সন্ধ্যায় মিলি আপুকে দেখতে আসছেন পিয়াস ভাইয়ার পরিবার। দেখতে আসা বলতে, পাকা কথা বলতে আসছেন। হয়তো আগামী দু/তিন দিনের মধ্যেই তাদের বিয়ের ডেইট ফিক্সড করা হয়ে যাবে!

,
,

সন্ধ্যা ৭ টা বাজছে ঘড়িতে। আমরা সব বোনরা মিলে মিলি আপুকে নিয়ে মাত্র বসার ঘরে এলাম। আমাদের সঙ্গে পিয়ালী আপু এবং পায়েল ও আছেন। পিয়াস ভাইয়ার পরিবাররের পাশাপাশি আমার শ্বাশুড়ী মা এবং বাড়ির বাকি সদস্যরা ও উপস্থিত আছেন। বিকেলের দিকেই আমার শ্বাশুড়ী মা এবং ননদরা এই বাড়িতে এসে পৌঁছেছেন। সবার সামনে ট্রে ভর্তি শরবত, চা, নাশতা এবং হরেক রকম মিষ্টান্ন পরিবেশন করা হয়েছে। আমরা প্রথমে চাই নি, মিলি আপুকে সামনে আনতে। কারন, কনে তো খালামনির অতি পূর্ব থেকেই পরিচিত। তবে খালামনি হুট করেই প্রস্তাব রাখলেন মিলি আপুকে শাড়ি, চুড়ি পড়িয়ে সাজিয়ে, গুজিয়ে সামনে আনতে। দেখতে চান, শাড়ি পরিহিত অবস্থায় মিলি আপুকে কতটা সুশ্রী এবং মাধূর্যমন্ডিত দেখায়! আদৌ বাড়ির বউ বউ দেখায় কিনা! তাই খালামনির প্রস্তাব রাখতে আমরা বোনরা মিলি আপুকে শাড়ি পড়িয়ে সাজিয়ে, গুজিয়ে সবার সামনে নিয়ে এলাম। খালামনির পাশে মিলি আপুকে বসিয়ে দিতেই পিয়াস ভাই অন্য পাশের সোফা থেকে আড়চোখে কেবল মিলি আপুকে বিরামহীন ভাবে প্রেমময়ী দৃষ্টিতে হারাচ্ছেন! খালামনি ব্যস্ত আপুকে নানা ধরনের প্রশ্ন করতে। অপরিচিত কোথাও মেয়ে দেখতে গেলে মুরুব্বিরা যেভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মেয়ে দেখেন? জিজ্ঞাসাবাদ করেন? খালামনি ও ঠিক তাই করছেন। আপুর হাত দেখছেন, পা দেখছেন, চুল দেখছেন, বডি ফিটনেস দেখছেন, লম্বা-চড়া দেখছেন! পরিশেষে আপুকে জায়গা থেকে উঠিয়ে হাঁটতে পর্যন্ত বাধ্য করলেন! খালামনির কার্যকলাপে নিজেরই খুব বিরক্তি লাগছে। না জানি মিলি আপুর কতটা বিরক্তিকর লাগছে! বাড়ির বাকিদের মুখভঙ্গি দেখে তো মনে হচ্ছে না, তারা অন্তত বিষয়টাকে বিরক্তির দৃষ্টিতে দেখছেন। কোথাও যেন মনে হচ্ছে বিষয়টা তারা ভীষণ এন্জ্ঞয় করছেন! শাড়ি পড়া অবস্থায় আপুর হাঁটা চলা দেখার পর খালামনি পুনরায় মুখের উপর আপুকে বললেন,,

“মিলি মা? এক কাজ কর! এবার একটা থ্রি-পিস পড়ে এসো। এবার দেখি থ্রি-পিস পরিহিত অবস্থায় তোমায় ঠিক কতটা ভয়ঙ্কর সুন্দুরী দেখায়!”

মিলি আপু দাঁতে দাঁত চেঁপে প্রত্যত্তুর করার পূর্বেই মা তটস্থ গলায় আপুকে শাসিয়ে বললেন,,

“আপা যা বলছেন তাই কর মিলি। শাড়িটা পাল্টে জলদি থ্রি-পিসটা পড়ে আয়।”

প্রত্যত্তুরে আপু খড়তড় গলায় বললেন,,

“কিন্তু জেঠিমনি….

“যা বলছি তাই কর। অযথা কথা বাড়াস না!”

মিলি আপু রাগে গজগজ করে প্রস্থান নিলেন। পরিবারের সবার ঠোঁটের কোনে এক রহস্যময়ী হাসি! সবাই কি প্ল্যান মাফিক আপুকে হেনস্তা করতে চাইছেন? মানে, আপুকে কোনো বিশেষ কারনে শিক্ষা দিতে চাইছেন?

প্রায় ২০ মিনিটের মাথায় মিলি আপু লাল টুকটুকে একটা থ্রি-পিস পড়ে মাথা নুঁইয়ে খালামনির পাশ ঘেঁষে বসলেন। গলা খাঁকিয়ে খালামনি পুনরায় আপুর দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“তো মিলি বলো? রান্না বান্না কতটুকু পারো? মানে আমি বলতে চাইছি ভাত, ডাল, ডিম এর বাইরে আর কি কি পারো?”

মিলি আপু অতি রাগে আঙ্গুল কচলে বললেন,,

“ভাত, ডিম, ডাল এর বাইরে আর অন্য কিছু রাঁধতে পারি না!’

“এ্যাঁ! মানে কি? তো বিয়ের পর আমাদের রান্না করে খাওয়াবেটা কে? মাসের ত্রিশ দিনই কি আমাদের ডাল, ভাত, ডিম খেতে হবে?”

চাচীমনি মুখ চেঁপে হেসে বললেন,,

“এই নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না আপা। মিলিকে ঠিক আমরা সব শিখিয়ে পড়িয়ে দিব! আমার মেয়ে আস্তে ধীরে সব মানিয়ে নিবে। সংসারের কাজ শেখা এ আবার বড় ব্যাপার কি?”

“হ্যাঁ আপা। শিখাতে তো হবেই। আমি আবার বাড়ির কাজের বুয়াদের হাতের রান্না তেমন খেতে পারি না। তাছাড়া বাড়ির বউ থাকতে কাজের বুয়ার হাতের রান্না কেন খেতে হবে?”

আমার শ্বাশুড়ী মা বোধ হয় এই সুযোগটার অপেক্ষাতেই ছিলেন। মুখমন্ডলে বিদ্রুপাত্নক ছাপ ফুটিয়ে মা আড়চোখে আমার এবং বাবার দিকে চেয়ে খানিক ঢ্যাশ দিয়ে বললেন,,

“হ্যাঁ! ঠিকই তো আপা। বাড়ির বউরা থাকতে আমাদের শ্বাশুড়ীদের কেন কাজের বুয়াদের হাতের রান্না খেতে হবে? আপনি একদম ঠিক বলেছেন আপা। বাড়ির বউদেরই উচিত আমাদের রান্না বান্না করে খাওয়ানোর! পরিবার থেকে সব শিখে যাওয়া!”

বাবা গলা ঝেঁড়ে প্রসঙ্গ পাল্টে খালামনির দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“আচ্ছা? এবার বিয়ের পাকা কথাতে আসি? তো বলুন আপা? বিয়ের ডেইট কবে ফিক্সড করতে চাইছেন আপনারা?”

খালামনি স্বল্প সময় মৌন থেকে অতঃপর মলিন হেসে প্রত্যত্তুরে বাবাকে বললেন,,

“আগামী সপ্তাহে। আগামী সপ্তাহে হলে খুব ভালো হয় ভাই। এরেন্জ্ঞমেন্টের একটা ব্যাপার আছে। তাছাড়া আমার একমাত্র ছেলের বিয়ে। মহা ধুমধাম করেই দিতে চাই। তাই অনেকটা সময়ের প্রয়োজন।”

বাবা ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা ফুটিয়ে বললেন,,

“তাহলে বিয়ের আর ও প্রায় ১০ দিন বাকি আছে। ঠিক আছে ব্যাপার না। এতে আমাদের ও গুছিয়ে আনতে অনেকটা সুবিধে হবে।”

উপস্থিত সবার মুখে খুশির হাসির রেখা ফুটে উঠল। মা, চাচীমনিরা আনন্দে হতবিহ্বল হয়ে সবাইকে মিষ্টি মুখ করাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লন। কাজিনরা তো খুশিতে হাই ফাইভ করছে। মিলি আপু ফোঁস করে শ্বাস নিয়ে কেবল অনবরত শুকনো ঢোক গিলতে থাকা পিয়াস ভাইয়ার দিকে তেজী দৃষ্টি নিক্ষেপ করছেন। পিয়াস ভাই পাঞ্জাবির কলার ঠিক করে কিয়ৎক্ষনের মধ্যে মাথা নুঁইয়ে নিলেন। বাবা এবং চাচারা মিষ্টি মুখ করে আসর ছেড়ে উঠতেই খালামনি মিলি আপুর দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“চা বানিয়েছে কে মা? তুমি? নাকি বাড়ির অন্য কেউ?”

“রুম্পা আপু করেছেন!”

“কেন কেন? রুম্পা করল কেন? করার কথা তো তোমার ছিল!”

“আমি তখন রেডি হচ্ছিলাম আন্টি। তাই আপুই এসব করেছেন!”

“উঠো তুমি! এক্ষনি উঠো। আমার জন্য এক কাপ গরম গরম মালাই চা করে নিয়ে এসো! অবশ্যই তোমার নিজের হাতের তৈরী। বিয়ের পর কিন্তু দৈনিক চার বার করে আমাকে চা বানিয়ে খাওয়াতে হবে। কোনো অলসতা করলে চলবে না!”

মিলি আপু নাক কেঁদে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। ধপাধপ পা ফেলে রান্না ঘরের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন আর বলছেন,,

“শিক্ষে হয়ে গেছে আমার! বিয়েতে রাজি হওয়ার শিক্ষে হয়ে গেছে আমার। টয়ার মতো আমার ভবিষ্যত ও অন্ধকার। পরের জন্য খাঁদ করলে এই খাঁদে নিজেকে ও পড়তে হয়!”

আপু প্রস্থান নিতেই বসার ঘরে উপস্থিত সব সদস্যরা দাঁত কপাটি কেলিয়ে হাসতে আরম্ভ করলেন। খালামনি ও খুব হাসছেন। সবাই এক জোট হয়ে মিলি আপুকে রাগাতে উঠে পড়ে লেগেছেন! মাঝখান থেকে বেচারা পিয়াস ভাই ভয়ে দুর্বল হয়ে আছে! সবার উপর জমতে থাকা রাগ, জেদ, ক্ষোভের পুরো অংশ বিশেষ যে পিয়াস ভাইয়ার ঘাড়ের উপর বর্তাবে বেশ আঁচ করতে পারছেন আমার অবলা পিয়াস ভাইটা!

,

,

মাঝখানে কেটে গেল এক সপ্তাহ। শ্বাশুড়ী মাকে এক প্রকার জোর পূর্বক রেখে দিয়েছেন মা, বাবা এবং বাড়ির অন্যান্য সদস্যরা মিলে। বাবার কড়া নির্দেশ মিলি আপুর বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর পরই আমি সহ আমার শ্বশুড় বাড়ির সকলকে ঢাকা ফিরতে হবে। অনেকটা অপারগ হয়েই শ্বাশুড়ী মা পিয়ালী আপু এবং পায়েলকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে রয়ে গেছেন। এক সপ্তাহ পর আজ পরশ এবং শ্বশুড় আব্বু আমাদের বাড়িতে আসছেন। অফিস থেকে ৪ দিনের ছুটি নিয়েছেন উনারা। হিমেশ ভাই ও উনাদের সাথে আসছেন! মিলি আপুর বিয়ে উপলক্ষ্যে আমি নিজ থেকেই হিমেশ ভাইকে আমন্ত্রণ করেছি। পায়েল ও ভীষণ আনচান আনচান করছিল হিমেশ ভাইকে দেখতে। তাই আর ও বিশেষ করে হিমেশ ভাইকে আমন্ত্রণ করা।

রাত প্রায় ৯ টা বাজতে চলল ঘড়িতে। তবে এখন ও অবধি শ্বশুড় আব্বু এবং পরশের আসার সাথে কোনো নাম নিশানা নেই। ফোন হাতে নিয়ে আমি রুমের ডিভানে দাঁড়িয়ে প্রায় অনেকক্ষন যাবত পায়চারী করছি। মেইন গেইটের দিকে সূক্ষ্ম নজর আমার। বাড়িতে আসা মাত্রই যেন আমি উনাকে দেখতে পাই। মেইন গেইট থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আমি যেই না রুমের দিকে অগ্রসর হতে যাব অমনি আমার ফোন বেজে উঠল। স্ক্রীনের দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ করতেই দেখলাম পরশের নাম্বার থেকে কল! অতি আগ্রহের সহিত আমি কলটা তুলতেই পরশ ঐ প্রান্ত থেকে ব্যস্ত হলায় বললেন,,

“শ্বশুড় আব্বা কোথায়?”

“বাড়িতেই আছেন। কেন?”

“তো উনি আমার কল তুলছেন না কেন? সেই কখন থেকে কল করেই চলছি তো করেই চলছি। মেয়ের জামাইকে এভাবে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার মানে কি?”

“কল করছিলেন কেন কারনটা বলুন? অযথা প্রসঙ্গ টেনে বাড়াতে হবে না!”

“বাবাকে বলো, আমি বাস স্ট্যান্ড চলে এসেছি। এসে আমাকে পিক করে নিয়ে যেতে!’

“মানে কি? রাস্তা-ঘাট চিনেন না আপনি? সি.এন.জি করে বাড়ি অবধি চলে আসুন। তাছাড়া আপনি গাড়ি থাকতে বাসে করে কেন এসেছেন?”

“ইট’স মাই চয়েজ! আমার বাসে করে আসতে ইচ্ছে করেছে তাই আমি এসেছি। এখন আমার শ্বশুড় আব্বার দায়িত্ব হলো কোনো কথা না বাড়িয়ে উৎসাহের সহিত মেয়ের জামাইকে বাস স্ট্যান্ড থেকে পিক করে আনা!’

“ইশশ। সবসময় আপনার মাথায় বাদড়ামী বুদ্ধি ঘুড়ে তাই না? কিভাবে আমার বাবাকে হেনস্তা করতে পারবেন সেই সুযোগটাই আপনি খুঁজেন তাই না?”

“বাবার হয়ে উকালতী করা বন্ধ করো। যত দ্রুত সম্ভব বাবাকে বলো গাড়ি নিয়ে বাস স্টপ চলে আসতে!”

“আমি বলতে পারব না। পারলে আপনি বলুন।”

“আচ্ছা আমিই বলছি। ফোনটা বাবার কাছে দাও!”

“একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছেন আপনি!”

“বারে! নতুন জামাই আমি৷ বিয়ের পর এই প্রথম বার শ্বশুড় বাড়িতে নিমন্ত্রণে আসছি। শ্বশুড় আব্বা হিসেবে উনার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না আমাকে এই বাড়িতে রিসিভ করে আনাটা?”

“উফফ৷ আপনার দেখছি লজিকের শেষ নেই! দাঁড়ান একটু, বাবাকে পাঠাচ্ছি গাড়ি করে।”

লোকটা কদাচিৎ হেসে বললেন,,

“এই তো আমার লক্ষী বউটা৷ আসতে দাও শুধু। অফুরন্ত আদর, ভালোবাসা জমে গাঁ বেয়ে একদম গলে গলে পড়ছে আমার।”

অসভ্য লোকটার মুখের উপর কলটা কেটে দআমি বাবার রুমের দিকে অগ্রসর হলাম। রুমের কাছাকাছি আসতেই দেখলাম বাবা পাঞ্জাবি, পায়জামা পড়ে পাঞ্জাবির হাতা ফোল্ড করতে করতে রুম থেকে বের হচ্ছেন। দৃষ্টির সম্মুখে আমাকে দেখা মাত্রই বাবা ব্যস্ত গলায় বললেন,,

“তোর শ্বশুড় আব্বু বাস স্টপে অপেক্ষা করছেন। ভাবছি পিয়াসকে নিয়ে উনাদের পিক করতে যাব!”

“মানে কি? পরশ তোমাকে কল করেছিলেন?”

বাবা অধৈর্য্য গলায় অনর্গল বলতে আরম্ভ করলেন,,

“হাজারটা ম্যাসেজ করে রেখেছে! শ্বশুড় আব্বা আপনি কোথায়, শ্বশুড় আব্বা আপনার মেয়ের জামাই আসছে, শ্বশুড় আব্বা আপনার মেয়ের জামাইকে সাদরে আমন্ত্রণ জানাতে আসবেন না? তাকে পিক করতে আসবেন না? একই ম্যাসেজ বার বার ফরওয়ার্ড করে করে আমার মাথা খেয়ে নিচ্ছে। সন্ধ্যা সাতটা থেকে চালু করে এই অবধি ম্যাসেজ আসছে তো আসছেই! ম্যাসেজ আর থামছে না! ফোনের ৫০% চার্জ অলরেডি ম্যাসেজ আসতে আসতে খেয়ে নিয়েছে। এখন আমি বাধ্য হচ্ছি তোর জামাইকে পিক করে আনতে! বিশেষ করে আর ও বাধ্য হচ্ছি কারন, তোর শ্বশুড় আব্বু ও সাথে আছেন!”

ফোঁস করে এক দফা দম নিয়ে বাবা পুনরায় আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“হ্যাঁ রে? পৃথিবীতে কি ছেলে মানুষের অভাব পড়েছিল প্রেম করার, ভালোবাসার? বেছে বেছে তোকে ঐ হাড় বজ্জাত, ধড়িবাজ ছেলেটাকেই ভালোবেসে পালিয়ে বিয়ে করতে হলো?”

এর মধ্যেই বাবার ফোন বেজে উঠল। পায়জামার পকেট থেকে ফোনটা বের করে বাবা স্ক্রীনের দিকে একবার তাকিয়ে অতঃপর আমার দিকে অবলা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,,

“এই যে দেখ! আবার কল করেছে! দাঁড়া লাউডে দিচ্ছি। শুন, তোর গুনধর জামাই আমায় কি কি বলে!”

ফোনটা পিক করে বাবা লাউড স্পীকার অন করতেই পরশ ঐ প্রান্ত থেকে উচ্চ শব্দে চেঁচিয়ে বললেন,,

“শ্বশুড় আব্ববাবাবাবাবাবাবা! আপনি কোথায়য়য়য়? মেয়ের জামাইকে পিক করতে আসবেন না?”
#তোমায়_পাবো_বলে
#পর্ব_৩৫
#নিশাত_জাহান_নিশি

“শ্বশুড় আব্ববাবাবাবাবাবাবা! আপনি কোথায়য়য়য়? মেয়ের জামাইকে পিক করতে আসবেন না?”

সঙ্গে সঙ্গেই বাবা শক্ত হাতে বাঁ কানটা চেঁপে ধরলেন! অন্য হাতে বাবার ফোনটা ঢকঢক করে কাঁপছে। অনতিবিলম্বে আমি ও কান দু খানা চেঁপে ধরতে বাধ্য হলাম। কানের পোকা জাস্ট নড়ে গেল আমার! পুরুষ মানুষদের গলা তো এমনিতেই অনেক বড়। তার উপর হাঁক ছাড়লে অতিরিক্ত শব্দ দূষণে মানবজীবন ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে! যার প্রমাণ আমি এবং বাবা স্বয়ং নিজেরাই। কপালের ভাজে অঢেল জেদ এবং বিরক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে বাবা ফোনের স্পীকারে ওষ্ঠদ্বয় ঠেঁকিয়ে বললেন,,

“এই চুপ করো! একদম চুপ করো। গলার আওয়াজ নামিয়ে কথা বলো! এভাবে চিৎকার চেঁচামেচি করছ কেন? কানে কালা নাকি আমি? যে নিম্ন আওয়াজে কথা বললে শুনব না?”

কিয়ৎক্ষনের মধ্যেই পরশ কদাচিৎ হেসে বললেন,,

“আরেহ্ মেরি শ্বশুড় আব্বা! বিষয়টা বুঝতে হবে আপনার। সন্ধ্যা সাতটা থেকে আপনার পেছনে পড়ে আছি আমি। ম্যাসেজ, কলস ক্রমাগত করেই চলছি। কোনো ভাবেই আপনার সাথে যুক্ত হতে পারছিলাম না। ধৈর্য্যের বাঁধ প্রায় ভেঙ্গে দিচ্ছিলেন আমার! দীর্ঘ অনেকক্ষন চেষ্টার পর অবশেষে আমি পেরেছি আপনার সাথে যুক্ত হতে শ্বশুড় আব্বার কান অবধি আমার কথা পৌঁছাতে! নাও হ্যাভ এ্যা রিলাক্স।”

“এই? তুমি কি মানুষ হবে না? গুরুজনদের সাথে কিভাবে আচরন করতে হয় তা ও জানা নেই তোমার?”

“না আব্বা। সত্যিই আমার জানা নেই! থ্যাংকস টু ইউ! আপনি না বললে হয়তো জানতেই পারতাম না গুরুজনদের সাথে এরচেয়ে ও অতি নম্র ভাষায় আচরণ করতে হয়!”

“মানে কি? তুমি কবে, কখন আমার সাথে নম্র ভাষায় আচরন করেছিলে? সবসময় তো এই একই অসভ্যের মতো আচরণ করো!”

“এখন এত কথা বাড়িয়ে লাভ নেই শ্বশুড় আব্বা। খুব আরামে আছেন না? মেয়ের জামাইকে মশার কামড় খাইয়ে খুব চিল মোডে আছেন?”

বাবাকে অভিব্যক্তি প্রকাশ করার সুযোগ না দিয়েই পরশ পুনরায় বিদ্রুপাত্নক গলায় বললেন,,

“ওহ্ হ্যাঁ শ্বশুড় আব্বা! আপনার তো আবার মশাকে থ্যাংকস জানানো উচিত! আপনি না পারলে ও আপনার সহচর কিন্তু ঠিকই পারছে আমার রক্ত চুষে খেয়ে নিতে! কেউ না কেউ তো আমায় জব্দ করতে পারছে তাই না?”

মুহূর্তের মধ্যেই বাবা পৈশাচিক হাসিতে মত্ত হয়ে বললেন,,

“তাহলে আর ও এক ঘন্টা অপেক্ষা করো বাছা! হাতের কাজটা সেরে আসছি আমি। অনেক ইস্পর্টেন্ট কাজ কিন্তু। মিলির বিয়ে সম্পর্কিত কাজ!”

পরশ অট্ট হেসে বেগহীন গলায় বললেন,,

“আপনি কিন্তু আমায় এখন ও চিনেন নি শ্বশুড় আব্বা! যে বাস দিয়ে আমি কুমিল্লায় এসেছি না? ঠিক সেই বাস দিয়েই এখন আমি ঢাকায় ব্যাক করব! তখন কিন্তু ঢাকা গিয়ে তোষামোদ করে আমায় সঙ্গে করে নিয়ে আসতে হবে আপনার! নাও ডিসিশান ইজ ইউর’স! বিনা ঝামেলায় আপনি ১৫ মিনিটের মধ্যে আমায় পিক করতে আসবেন নাকি আমিই ঢাকায় ব্যাক করব?”

বাবা থমকালেন। শুকনো মুখে আমার দিকে মলিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। আমি রাগে লুচির মতো ফুলছি। অসভ্য লোকটাকে আজ হাতের কাছে পেয়ে নেই। বাদড়ামো করার শখ মিটিয়ে দিব। নিরুপায় হয়ে আমি বাবার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে তটস্থ গলায় লোকটিকে শুধিয়ে বললাম,,

“কি হয়েছে টা কি আপনার? কি শুরু করেছেন আপনি? বাবা যাচ্ছেন তো আপনাকে তুলে আনতে। অযথা কথা বাড়াচ্ছেন কেন বাবার সাথে!”

“ওহ্হো! শ্বশুড়, জামাইয়ের কথা বার্তার মধ্যে তুমি কেন বউ মানুষ হয়ে ঢুকতে গেলে? দেখি বাবাকে ফোনটা দাও। যা বলার আমি বাবাকে বলব!”

“নিকুচি করেছি আপনার যতসব অপ্রাসঙ্গিক কথা বার্তা! বাবার সাথে আমি আসছি। আপনার এই রং ঢং আমি এসে বের করছি!”

দুষ্টুমি ভুলে পরশ ক্ষনিকের মধ্যেই বেশ তৎপর গলায় বললেন,,

“এই না না টয়া। এই অবস্থায় তোমার আসতে হবে না। তার উপর অনেকটা রাত হয়ে গেছে। আচ্ছা, বাবাকে আমি আর ঘাঁটাব না। যত দ্রুত সম্ভব তুমি বাবাকে পাঠিয়ে দাও।”

টুং টাং শব্দে কলটা কেটে গেল! কত সিরিয়াস মানুষটা আমায় নিয়ে! বিষয়টা যখন আমায় নিয়ে তখনই তিনি হেয়ালী পূর্ণ আচরন পাল্টে তৎপর হয়ে উঠলেন! পিছু ঘুড়ে আমি বাবার দিকে ফোনটা এগিয়ে দিয়ে নতজানু হয়ে বললাম,,

“স্যরি বাবা! পরশের হয়ে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি! মানুষটা একটু পাগলাটে স্বভাবের হলে ও ভেতর থেকে কিন্তু অনেক ভালো। তোমাকে ও পরশ অনেক ভালোবাসেন বাবা! যথেষ্ট সম্মান ও করেন!’

ঐ পাশ থেকে বাবার কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে আমি মাথা উঁচিয়ে উৎসুক দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দেখলাম বাবা হনহনিয়ে হেঁটে সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। রওনা হয়ে গেছেন বাস স্টপের উদ্দেশ্যে! না জানি বাবা কতটা খারাপ ভাবছেন পরশকে! লোকটা শুধু শুধু বাবার পিছনে লাগছেন। বাবা যদি হঠাৎ রেগে যান তখন কি হবে? সম্পর্কটা তখন খারাপ বৈ তো ভালো হবে না! কেন যে পরশটা এই সহজ বিষয়টাকে বুঝতে পারছেন না তাই আমার বোধগম্য হচ্ছে না।

,
,

রাত প্রায় ১১ টা বাজছে ঘড়িতে। পরশ হাত-পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসার ঘরের সোফায় মাথা এলিয়ে রেখেছেন। শ্বশুড় আব্বু এবং হিমেশ ভাই ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। পাশে অবশ্য শ্বাশুড়ী মা ও আছেন। পিয়াস ভাই একটু আগে বাড়ি ফিরে গেছেন। বিয়ের কিছু বন্দোবস্ত এখন ও বাকি আছে তাই। বাবার বিক্ষুব্ধ দৃষ্টি পরশের ক্লান্ত মুখমন্ডলে সীমাবদ্ধ। বাবা পারছেন না ধোঁয়া উঠা গরম চা টা পরশের মুখমন্ডলে ফেকতে! শুকনো ঢোক গিলে আমি পরশের ঠিক পেছনের দিকটায় দাঁড়িয়ে আছি। মা এবং চাচীমনিরা ডাইনিং টেবিলে রাতের খাবার সাজাতে ব্যস্ত। চাচাতো বোনরা সব এক জোট হয়ে হল ঘরে সিনেমা দেখছে। তাদের সাথে অবশ্য পিয়ালী আপু এবং পায়েল ও আছে। লজ্জায় পায়েল হিমেশ ভাইয়ার মুখোমুখি হতে চাইছে না। অন্যদিক, হিমেশ ভাই অস্থির দৃষ্টিতে কেবল পায়েলকে খুঁজে চলছে! ইতোমধ্যেই আমার বাবা দাঁতে দাঁত চেঁপে আমায় শাসিয়ে বললেন,,

“তোর জামাইকে আর ও বল, ক্লান্ত শরীর নিয়ে আমায় হয়রানি করতে! কি দরকার ছিল শর্টকার্ট রাস্তা ছেড়ে পুরো কুমিল্লা শহর ঘুড়ে রাত ১১ টায় বাড়ি ফিরতে? ১৫ মিনিটের রাস্তা পাকা দেড় ঘন্টায় বাড়িয়েছে। নিজে ও ক্লান্ত হয়েছে পাশাপাশি আমাদের চার চারটে লোককে ও ক্লান্ত করে ছেড়েছে!”

শ্বাশুড়ী মা ফিক করে হেসে দিলেন। উপস্থিত সবাই তাজ্জব দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকাতেই মা অট্ট হেসে বললেন,,

“বুঝলাম না! আমার এই ছেলে কার মতো হয়েছে। মানে শ্বশুড়কে কেউ এভাবে হেনস্তা করে? অবশ্য যেমন শ্বশুড় তেমনি তার জামাই!”

মা আর এক সেকেন্ড ও বসলেন না। আড়চোখে বাবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে তাড়াহুড়ো করে স্থান পরিবর্তন করে রান্নাঘরে মা এবং চাচীমনিদের সাথে যুক্ত হলেন। শ্বশুড় আব্বু এবং হিমেশ ভাই মিটিমিটি হেসে উঠতেই পরশ ক্লান্তি ভুলে ফটাফট চোখ জোড়া খুলে সোজা হয়ে বসলেন। বাবার বিক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তৎপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,,

“আমি ছিলাম বলেই তো আপনি পুলিশ কেইস থেকে বেঁচে ফিরেছেন শ্বশুড় আব্বা! গাড়ির কোনো কাগজপত্র ছিল নাকি আপনার? আমি না থাকলে পারতেন সব দিক সামলে বাড়ি ফিরতে? কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা উচিত আপনার! তা না করে আপনি অযথা আমাকেই দোষারোপ করছেন?”

“তোমার ক্ষেত্রে আমার কৃতজ্ঞতা আসে না বুঝেছ? ধড়িবাজ ছেলে একটা!”

“ধড়িবাজ বলুন আর যাই বলুন। সব শেষে কিন্তু আমি আপনার জামাই। আমার শ্বশুড় আব্বা হয়ে আপনি কিভাবে পারলেন এতটা অমনযোগী হতে? গাড়ির কাগজপত্র বাড়িতে ছেড়ে যেতে? হাও স্ট্রেন্জ্ঞ শ্বশুড় আব্বা!”

বাবা জায়গা থেকে খানিক নড়েচড়ে বসলেন। গলা খাঁকিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টাতে মরিয়া হয়ে বললেন,,

“ক্লান্ত আমি! এখন অপ্রয়োজনীয় কোনো ব্যক্তির সাথে কথা বাড়াতে চাইছি না আমি!”

বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন বাবা। ইতোমধ্যেই পরশ ব্যাঙ্গাত্নক হেসে বাবার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“আপনি কি কোনো ভাবে অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন শ্বশুড় আব্বা? মানে লজ্জা টজ্জা পেয়েছেন নাকি?”

বাবা কটমট দৃষ্টিতে পরশকে উপেক্ষা করে আমার দিকে চেয়ে বললেন,,

“এই? একে খাইয়ে দাইয়ে মুখ বন্ধ কর! কাল সকাল ১০ টার আগে যেন এর ঘুম না ভাঙ্গে! মিলির বিয়ের এরেন্জ্ঞমেন্ট কাল থেকে শুরু হবে। এর পাগলামীর জন্য যেন আমার কাজে কোনো বিঘ্ন না ঘটে!”

বাবা সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতেই পরশ পেছন থেকে বাবাকে ডেকে বললেন,,

“আরেহ্ শ্বশুড় আব্বা। যাচ্ছেন কোথায়? খাবারটা তো খেয়ে যান। আপনার জন্য কি আমি ও উপোস থাকব নাকি?”

“তোমার খাবার তুমি খেয়ে নাও। আমার খাবারের পেছনে তোমার পড়তে হবে না।”

“তা, কি খাব টা শুনি? বিফ বিরিয়ানির ব্যবস্থা আছে তো?”

“বাড়ির গিন্নিদের জিজ্ঞেস কর। আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন?”

ইতোমধ্যেই মা দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে পরশের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শুকনো গলায় বললেন,,

“বিরিয়ানি তো আজ করি নি বাবা! পোলাও, মোরগ, বিফ করেছি। কষ্ট করে আজ একটু ম্যানেজ করে নাও। কাল অবশ্যই বিরিয়ানির ব্যবস্থা করব!”

পরশ ক্রুর হেসে মাকে ইশারায় বললেন শান্ত হতে। অতঃপর চ্যালচ্যালিয়ে হেঁটে পরশ বাবার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন,

“বিরিয়ানি ছাড়া কিন্তু আমি অন্য কিছু মুখে তুলব না শ্বশুড় আব্বা! ফুড ফান্ডা থেকে এক্ষনি বিরিয়ানি অর্ডার করে দিন!”

“আশ্চর্য তো! তোমার শ্বাশুড়ি আম্মা তো বললেন ই আজ ম্যানেজ করে নিতে!”

“ম্যানেজটা ঠিক আমার দ্বারা হয় না শ্বশুড় আব্বা। আমি বিরিয়ানি খেতে চেয়েছি। আপনি বিরিয়ানির ব্যবস্থা করে দিন ব্যাস শেষ!”

বাবা কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বললেন,,

“বড় মেয়ের জামাই ও আমায় এতটা পেইন দেয় নি! এই ছোট মেয়ের জামাই আমায় যতটা পেইন দিচ্ছে!”

অপারগ হয়ে বাবা এই রাতে ফুড পান্ডায় বিরিয়ানি অর্ডার করলেন। আধ ঘন্টার মধ্যে হোম ডেলিভারি আসতেই পরশ ফ্রেশ হয়ে বাড়ির সবাইকে নিয়ে খেতে বসে পড়লেন। বাবা যদি ও খেতে চাইছিলেন না। পরশ জোরপূর্বক বাবার হাত চেঁপে ধরে বাবাকে নিয়ে খেতে বসলেন৷ খুব আনন্দ, হুল্লোড়ের মাঝেই খাবার সময়টা কেটে গেল। পায়েল এবং হিমেশ ভাইয়ার চোখাচোখির বিষয়টা খুব মজা লেগেছে আমার। এর মধ্যে আমি প্রায় অনেক বার এ ও খেয়াল করেছি বাবা আড়চোখে উৎফুল্ল দৃষ্টিতে পরশের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিলেন! এই দৃষ্টিতে যেমন এক ধরনের আনন্দ ছিল তেমনি মায়া, মমতা, ভালোবাসা, এক ধরনের তৃপ্তি ও ছিল!

বাড়ির সবাইকে গুড নাইট জানিয়ে পরশ আমায় নিয়ে শোবার ঘরে প্রবেশ করলেন। দরজার খিলটা কোনো রকমে আটকে তিনি এক মুহূর্ত ব্যয় না করে আমায় জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বললেন,,

“খুব ভালোবাসি বউ! জানো? এই এক সপ্তাহ কতটা মিস করেছি তোমায়? বিয়ের পরে ও কতটা দূরত্ব আমাদের মধ্যে! চাইলে ও তোমায় কাছে পাচ্ছি না, ছুঁতে পারছি না, ভালোবেসে জড়িয়ে ধরতে পারছি না!”

প্রসঙ্গ পাল্টে আমি বিষন্ন গলায় পরশকে শুধিয়ে বললাম,,

“কেন এভাবে ঘাঁটাচ্ছেন আমার বাবাকে? বাবা তো মনে মনে কষ্ট ও পেতে পারেন তাই না? কেন করছেন এমন ছেলে মানুষী?”

“উফফফ! ছাড় তো ঐ প্রসঙ্গ! আমি জানি, বাবা আমার ব্যবহারে মোটে ও কষ্ট পাচ্ছেন না। উল্টে প্রতিটা ঘটনাই বাবা খুব আনন্দের সাথে মেনে নিচ্ছেন। রাগী মুখের আড়ালে যে প্রাণোচ্ছ্বল মুখভঙ্গি লুকিয়ে আছে তা বেশ বুঝতে পারি আমি!”

“জ্যোতিষ বিদ্যা রপ্ত করেছেন বোধ হয়? এত সিউর কিভাবে?”

আহ্লাদি স্বরে পরশ আমার গাল দুটো টেনে বললেন,,

“ওরে আমার মেয়ের মাম্মামটা রে। জিজ্ঞাসাবাদ করা একটু বন্ধ করুন এবার। বরের দিকে একটু নজর দিন। আপনার আদরের অভাবে দেখুন কত রোগা, সোগা হয়ে গেছে আপনার বরটা!”

ক্রুর হেসে আমি এক এক করে পরশের প্রতিটা শার্টের বাটন খুলে উন্মুক্ত বুকের মাঝখানে দীর্ঘ কয়েক জোড়া চুমো এঁকে বললাম,,

“সত্যিই তো আমার বরটা অনেক শুকিয়ে গেছে। একদম যত্ন নেওয়া হয় নি আমার বরটার৷ আচ্ছা? আদরের অভাবে ও কি মানুষের শরীর এতটা শুকিয়ে যায়?”

পরশ অতি উত্তেজিত হয়ে শক্ত হাতে আমায় বুকের পাজরে চেঁপে ধরে বললেন,,

“হুম যায়! যার ক্ষতিপূরণ তোমার এক্ষনি, এই মুহূর্তে পুষিয়ে দিতে হবে!”

পরশ আর এক মুহূর্ত বিলম্ব করলেন না। পাজা কোলে তুলে নিলেন আমায়। রুমের লাইটটা অফ করে আমায় নিয়ে বিছানায় শায়িত হলেন। ভারী শরীরটাকে আমার গাঁয়ের উপর প্রতিস্থাপন করে লোকটা আমার সমস্ত মুখমন্ডলে চুমো খেয়ে ঘোর জড়ানো গলায় বললেন,,

“আমার বউটা ও খুব শুকিয়ে যাচ্ছে! নিয়মিত খাওয়া দাওয়া করছ তো তুমি? এই অবস্থায় কিন্তুু অধিক পরিমানে খেতে হয়। নিজের খুব যত্ন নিতে হবে বউ৷ তবেই আমাদের বেবি ভালো থাকবে।”

প্রেমময়ী দৃষ্টিতে আমি পরশের প্রেমপিপাসু দৃষ্টিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললাম,,

“রাখছি তো নিজের খেয়াল। একটু বেশিই খেয়াল রাখা হচ্ছে। নিজের মা, বাবা, পরিবার এবং শ্বাশুড়ী, ননদের আদর-যত্নে খুব ভালোই খেয়াল রাখা হচ্ছে আমার!”

পরশ মৃদ্যু হাসলেন। কপালে ওষ্ঠদ্বয় ঠেকিয়ে বললেন,,

“ঢাকায় ফেরার পর তোমার বরই সারাক্ষন তোমার খেয়াল, যত্ন রাখবে বউ! আমি একাই যথেষ্ট আমার বউয়ের জন্য!”

নির্ভেজাল হেসে আমি পরশের চুলে হাত বুলিয়ে দিতেই পরশ ক্রুর হেসে আমার ঠোঁট জোড়া আঁকড়ে ধরলেন। তৎপর হয়ে উঠলেন তিনি আমায় আপন করে নিতে। আমি ও আটকালাম না লোকটিকে। তৃপ্তির হাসি হেসে লোকটাকে সঙ্গ দিতে লাগলাম।

,
,

সকাল ৮ টা বাজতেই আমি সদ্য শাওয়ার সেরে রান্নাঘরে চলে এলাম পরশের জন্য কফি বানাতে। প্রায় পাঁচ মিনিট দেরি হতেই পরশ গলায় টাওয়াল ঝুলিয়ে উদ্দেশ্যহীন ভাবে হেঁটে বাবার রুমের দরজায় দাঁড়ালেন। কফির মগ হাতে নিয়ে আমি পরশের পিছু পিছু ছুটতেই পরশ বাবার রুমের দরজায় কড়াঘাত করে হাঁক ডাক ছেড়ে বললেন,,

“শ্বশুড় আব্বব্বাব্বা… আপনার মেয়েকে বলুন, তাড়াতাড়ি আমার জন্য কফি করে আনতে!”
#তোমায়_পাবো_বলে
#পর্ব_৩৬
#নিশাত_জাহান_নিশি

“শ্বশুড় আব্বব্বাব্বা… আপনার মেয়েকে বলুন, তাড়াতাড়ি আমার জন্য কফি করে আনতে!”৷

অগ্নিশর্মা আমি। মাত্র পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে লোকটি এই হুলুস্থুল কান্ড বাঁধিয়ে বসবে কে জানত? সুযোগ পেলেই শুধু চলবে! কিভাবে আমার বাবাকে হেনস্তা করা যাবে সেই ফন্দিতে থাকবে। এই কোন শয়তানী ভূত চেঁপেছে লোকটির মাথায় আল্লাহ্ মালুম! আগুনের ফুলকির ন্যায় জ্বলন্ত আঁখি যুগল নিয়ে আমি পেছন থেকে লোকটিকে ডেকে বললাম,,

“এই? এদিকে তাকান। এদিকে তাকান বলছি!”

লোকটি কিয়ৎক্ষণ পর পর বাবার ভেজানো রুমের দরজায় দূরদর্শী দৃষ্টি নিক্ষেপ করছেন। আমার ডাকাডাকিতে লোকটির কোনো ভাবান্তর নেই! বোধ হয় বেশ বিরক্তিবোধ করছেন। তাই তো কেমন যেন বিরক্তি মিশ্রিত গলায় বললেন,,

“উফফ যাও তো এখন। শ্বশুড় আব্বাকে জ্বালানোর সময় ডিস্টার্ব করতে এসো না!”

লোহিত গলায় আমি লোকটিকে শুধিয়ে বললাম,,

“কি বললেন আপনি? আমি আপনাকে ডিস্টার্ব করছি?”

“হ্যাঁ, করছই তো! আমার লক্ষ্য থেকে আমায় লক্ষ্যচুত্য করছ!”

প্রত্যত্তুরে আমি হাঁক ডাক ছেড়ে বললাম,,

“উউউফফফ… আপনার শ্বশুড় আব্বা এখন রুমে নেই! তিনি বাড়ির আঙ্গিনায় প্যান্ডেলের কাজে ব্যস্ত!”

পরশ তড়িঘড়ি করে পিছু ঘুড়ে তাকালেন। ভেজা টাওয়ালটা আমার গলায় ঝুলিয়ে তিক্ত গলায় বললেন,,

“ধ্যাত! আগে বলবে না? খামোখা হাঁক ডাক ছেড়ে শরীরের এনার্জি নষ্ট করলাম।”

প্রতিত্তুর করার পূর্বেই লোকটি হাত দু খানা ঝেড়ে কদাচিৎ হেসে বললেন,,

“যাই এবার! একটু প্যান্ডেলের দিকটায় যাই। শ্বশুড় আব্বাকে একটু ঘাঁটিয়ে আসি!”

ঠোঁটের কোণে ক্রুর হাসি ফুটিয়ে লোকটি আমায় উপেক্ষা করে বাড়ির আঙ্গিনায় গতিপথ নির্ধারন করলেন। দাঁতে দাঁত চেঁপে আমি পেছন থেকে লোকটিকে শুধিয়ে বললাম,,

“কফিটা কি করব? আমার মাথায় ঢালব?”

পরশ থামলেন। কিছু একটা ভেবে ট্যারা দৃষ্টিতে পিছু ফিরে আমার দিকে তাকালেন। অতঃপর মন্থর গতিতে হেঁটে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মৃদ্যু হেসে বললেন,,

“এক কাজ কর! আর ও এক কাপ কফি করে আনো! ঠিক প্যান্ডেলের দিকটায় চলে আসবে। শ্বশুড় আব্বা ও হয়তো এখন ও কিছু খান নি!”

পরশ প্রস্থান নিলেন। সত্যিই তো বাবা এখন ও কিছু খান নি! ব্যস্ততায় সকালের কফিটা ও মা করে দিতে পারেন নি। পরশ না বললে হয়তো বিষয়টা আমার মাথা থেকেই বেরিয়ে যেত। তড়িঘড়ি করে আমি রান্নাঘরের দিকে মোড় নিলাম। রান্নাঘরে মা এবং চাচীমনিদের ব্যস্ততা ঠেলে দু কাপ কফি করে প্যান্ডেলের দিকটায় চলে এলাম। বাবা এবং পরশ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছেন। বুকে দুহাত গুজে গুরু গম্ভীর রূপে বাবা দন্ডায়মান। বিরক্তিকর দৃষ্টিতে বাবা ক্ষনে ক্ষনে পরশের দিকে দৃষ্টি বুলাচ্ছেন। পরশের উপস্থিতি কিছুতেই যেন বাবার পছন্দ হচ্ছে না। তাই মাঝে মাঝে হাত নাড়িয়ে প্যান্ডেলের লোকদের দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন কিভাবে কি করতে হবে! পরশকে টোটালি ইগনোর করার চেষ্টা করছেন। পরশ ও কম যান না। অবিকল বাবার মতো বুকে দুহাত গুজে দাঁড়িয়ে আছেন! বাবার দেখাদেখি পরশ ও হাত নাড়িয়ে প্যান্ডেলের লোকদের দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন! বিষয়টা বাবার বিব্রতকর ঠেকতেই বাবা তীক্ষ্ণ গলায় পরশকে শুধিয়ে বললেন,,

“কি হয়েছেটা কি? আমাকে এভাবে অনুকরন করছ কেন?”

পরশ বেগহীন গলায় ক্রুর হেসে বললেন,,

“বারে! জামাই শ্বশুড়কে অনুকরন করবে না তো, কাকে করবে?”

দাঁতে দাঁত চেঁপে বাবা অধৈর্য্য গলায় বললেন,,

“তোমাকে না বলেছিলাম? সকাল ১০ টার আগে ঘুম থেকে না উঠতে? আমার মাথা না খেতে?”

“এত গুলো দিন কি কম জ্বালিয়েছিলেন আমায়? মাথা শুদ্ধু খেয়ে নিয়েছিলেন! অসভ্য, বেয়াদব, ধূর্ত, ধপবাজ বলে! পালাক্রমে এবার আপনার ও পালা এসেছে! মাথা তো আপনার ও খেতে হবে তাই না?”

“উফফফ বিরক্তিকর! তোমার মতো জামাই যেন আমার চির শত্রুর ও না হয়!”

পরশ ফিক করে হেসে রঙ্গরসিক গলায় বললেন,

“ইদানিং আপনার অভিশাপ ও আমার দো’আ মনে হচ্ছে! কেন এমন মনে হচ্ছে আপনি জানেন শ্বশুড় আব্বা?”

“না জানি না!”

রাগে গজগজ করে বাবা স্থান পরিত্যাগ করে পেছনের দিকে মোড় নিতেই আমি বাবার সম্মুখস্থ হয়ে দাঁড়ালাম। শুকনো হেসে বাবাকে শুধিয়ে বললাম,,

“কোথায় যাচ্ছ বাবা?’

“জাহান্নামের চৌরাস্তায়! তোর জামাইয়ের প্রতি আমি সত্যিই খুব বিরক্ত!”

পরশ দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে আমার হাত থেকে কফির মগ গুলো তুলে নিলেন। অতঃপর ধোঁয়া উঠা এক কাপ কফি বাবার দিকে এগিয়ে বললেন,,

“কফিটা খেয়ে মাথাটা ঠান্ডা করুন শ্বশুড় আব্বা। সকাল সকাল এত হাইপার হলে চলবে?”

“তোমার মতো ধড়িবাজ জামাই থাকলে আমার মাথা এমনিতে ও ঠান্ডা হবে না! তড়তড় করে মাথা গরম হতেই থাকবে তো হতেই থাকবে!”

“পর পর আর ও দুইদিন আপনাকে এই জ্বালা সহ্য করতে হবে শ্বশুড় আব্বা! তাই অভ্যেস করে নিন!”

জোরপূর্বক পরশ কফির মগটা বাবার হাতে গুজে দিলেন। বাধ্য হয়ে বাবা কফির মগটা হাতে তুলে নিলেন। কফির মগে এক চুমুক দিয়ে পরশ মিষ্টি হেসে বাবার লোহিত দৃষ্টিতে নমনীয় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,,

“কফি এমনিতেই অনেক গরম আছে শ্বশুড় আব্বা। আপনার অগ্নিশর্মা দৃষ্টিতে না আবার কফিতে আগুন ধরে যায়!”

কফির মগ হাতে নিয়ে বাবা এবার সত্যি সত্যিই স্থান পরিত্যাগ করলেন। আমার বারনকে অগ্রাহ্য করে পরশ ও বাবাকে অনুসরন করতে আরম্ভ করলেন! বাবা যেখানে যাচ্ছেন পরশ ও ঠিক সেখানেই যাচ্ছেন। বাবা যা করছেন পরশ ও ঠিক বাবাকে সেই ভাবেই অনুকরন করছেন! বাবার প্রতিটা কাজে পরশ বেগড়া দিচ্ছেন! ওয়াশরুম বাদে সব স্থানেই পরশ বাবার ছায়া সঙ্গী হিসেবে ঘুড়ঘুড় করছেন! বাড়ির সবাই জামাই শ্বশুড়ের এহেন কান্ড দেখে কখন ও হাসছেন তো কখন ও হাসি থামিয়ে দুজনের সাথেই মজা নিচ্ছেন। ফারিহা আপু এবং জিজু ও সকালের দিকে আমাদের বাড়িতে চলে এসেছেন। জিজুর প্রশংসায় বাবা পঞ্চমুখ! পরশকে এক প্রকার দেখিয়ে দেখিয়ে বাবা জিজুর সাথে মিষ্টি হেসে কথা বলছেন এবং যত্ন আত্তির দিকে খুব খেয়াল রাখছেন। বিষয়টায় পরশ অনেক জেলাস! তাই তিনি জিজুর থেকে যত সম্ভব পারছেন দূরে থাকার চেষ্টা করছেন! তবে বাবার পিছু লাগা থেকে যেন কিছুতেই বিরাম নিচ্ছেন না!

কাজিনরা মিলে আমরা এইমাত্র সিদ্ধান্ত নিলাম শপিংয়ে যাব। আজই মিলি আপুর গাঁয়ে হলুদ। কেনা কেটা এখন ও অনেক কিছু বাকি আছে৷ সেগুলো আজ বিকেলের মধ্যেই সেরে ফেলতে হবে। পরশ এবং হিমেশ ভাইকে নিয়ে আমরা দুপুর ১২ টার দিকে রওনা হলাম শপিং মলের উদ্দেশ্যে। গাড়িতে উঠতে যাব অমনি পেছন থেকে বাবা আমায় ডেকে বললেন,,

“টয়া শুন?”

পরশ গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে ছিলেন। তাই বাইরের কিছু খেয়াল করেন নি। মিষ্টি হেসে আমি বাবার মুখোমুখি দাঁড়াতেই বাবা আমার ডান হাতটায় মুঠো ভর্তি টাকা গুজে দিয়ে বললেন,,

“এখানে কিছু টাকা আছে৷ তোর শ্বশুড় বাড়ির সবার জন্য শপিং করে নিস। ব্যস্ততার কারনে বের হওয়া সম্ভব হচ্ছে না আমার। তাই এই দায়িত্বটা তোর হাতে দিলাম।”

“কিন্তু বাবা। তুমি যদি নিজেই সবার জন্য শপিং করে আনতে তাহলেই হয়তো বিষয়টা ভালো দেখাত!”

“ব্যস্ত আছি বললাম তো! ব্যস্ততা শেষ হলে অন্য একদিন আমি নিজ হাতেই তোর শ্বশুড় বাড়ির সবার জন্য শপিং করে আনব। আজ তুই একটু ম্যানেজ করে নে!”

“তাহলে তুমি টাকাটা পরশের হাতে দিতে!”

“তোর জামাইকে আমার পছন্দ না! জামাই হিসেবে কথা বলতে ও আমার রুচিতে বাঁধে!”

দাম্ভিকতা নিয়ে বাবা প্রস্থান নিলেন। মনটা মুহূর্তের মধ্যেই যেন বিষন্ন হয়ে উঠল। পরশের নামে কারো করা কটুক্তি আমার পছন্দ নয়! নেহাত বাবা বলেই কোনো তর্কে জড়াতে চাইলাম না। পিছু ঘুড়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। প্রথম গাড়িতে আমি, রুম্পা আপু, ফারিহা আপু এবং পিয়ালী আপু। দ্বিতীয় গাড়িতে নীলা, স্নিগ্ধা, পায়েল এবং হিমেশ ভাই। গাড়ি দুটো ছুটে চলল শপিং মলের উদ্দেশ্যে। পরশের পাশাপাশি সিটে আমি বসেছি। অনেকক্ষন যাবত দেখছি পরশ খুব চুপচাপ আছেন। কেমন যেন মনমরা হয়ে ড্রাইভ করছেন। পাশ থেকে আমি লোকটির বাঁ হাতটায় আলতো হাত স্পর্শ করে শুধালাম,,

“কি হয়েছে আপনার?”

পরশ আমার দিকে তাকালেন। শুকনো হেসে বললেন,,

“কিছু না!”

“কিছু না”- কথাটির মধ্যেই কিন্তু অনেক না বলা কথা লুকিয়ে আছে! কি লুকিয়ে আছে বলুন?”

“আমার বউটা ও না? একটু বেশিই বুঝে! এত বেশি বুঝলে মন খারাপের অনুভূতি টা অনুভব করব কিভাবে? বউয়ের জোরাজুরিতে তো সবসময় আমায় হাসি-খুশি থাকতে হবে!”

“মন খারাপ হবে কেন আপনার হুম? আমি থাকতে কখন ও আপনার মন খারাপ হতে দিব না!”

পরশ মিষ্টি হেসে বললেন,,

“জানি তো! তাই তো মন খারাপকে বেশিক্ষন আশকারা দিতে পারি না!”

মৃদ্যু হেসে আমি পরশের বাঁ হাতটায় দীর্ঘ এক চুমো এঁকে দিলাম। অমনি রুম্পা আপু পেছন থেকে গলা ঝাঁকিয়ে বললেন,,

“উহুম উহুম! কি হচ্ছে কি বোনদের সামনে হুম? রাতে রোমান্স করার সময় পাস নি তোরা?”

সঙ্গে সঙ্গেই পরশের হাত খানা ছেড়ে আমি লজ্জায় কুঁকড়ে উঠলাম। পরশ ক্রুর হেসে আপুকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,

“এত দিকে নজর দিতে নেই শালী সাহেবা! আমার বউ এমনিতে ও নিজ থেকে আমায় আদর করতে চায় না। আজ যা ও করতে চাইল তখনি আপনি বেগড়া দিলেন?”

উপস্থিত সবাই ফিক করে হেসে দিল। লোকটির মুখে আসলেই লাগাম নেই৷ মুখ দিয়ে যা আসে ঠিক তাই বলে বসে। লোকটির এই হটকারীতার জন্য সবসময় আমাকেই অপ্রস্তুতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি পড়তে হয়!

,
,

সন্ধ্যা ৭ টা চলমান ঘড়িতে। পরশকে বাড়ির কোথাও খুঁজে না পেয়ে আমি খুব ঘাবড়ে গেলাম। মানুষটা গেল কোথায়? প্রায় অনেকক্ষন যাবত লোকটির অস্তিত্ব লুপ্ত প্রায়। বাড়ির সব সদস্যরা বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত বলে লোকটির খবর ও নিতে পারছে না কেউ। আর আমি তো এইদিকে মেহেন্দি পড়তে পড়তেই সন্ধ্যা গড়িয়ে দিলাম। ব্যস্ততার কারনে লোকটির খুঁজ ই নেওয়া হলো না। শ্বাশুড়ী মা, শ্বশুড় আব্বু ও বসার ঘরে মেহমান-অতিথিদের সাথে কথা বার্তায় মশগুল। তাদের ও হয়তো পরশের দিকে খেয়াল নেই। মেহেন্দি রাঙ্গা হাতে শাড়ির কুঁচি সামলে আমি ছাদের দিকে গতিপথ নির্ধারন করলাম। লোকটি বোধ হয় ছাদেই আছেন। এত এত অপরিচিত মেহমান-অতিথিদের সাথে থাকার কথা নয়। তাছাড়া বাবাকে ও দেখলাম চাচাদের সাথে বিভিন্ন কাছে ব্যস্ত সময় পাড় করছেন। পরশের অস্তিত্ব বাবার আশেপাশে দেখা গেল না!

দ্রুত কদমে সিঁড়ি টপকে আমি ছাদের বাউন্ডারিতে অস্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দেখলাম পরশ রাগান্বিত মুখমন্ডলে একের পর এক সিগারেটে ফুঁক দিচ্ছেন। রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে সমস্ত মুখমন্ডল। নাকের ডগা রক্ত জবার মতো রঙ্গিন। উদ্বিগ্ন রূপে আমি দ্রুত কদমে হেঁটে মানুষটির পাশাপাশি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন ছুড়ে বললাম,,

“এই? কি হয়েছে আপনার? ছাদে নিরিবিলি কি করছেন? আর এভাবে রেগে আছেন কেন? কি হয়েছে কি?”

মুহূর্তের মধ্যেই পরশ হাত থেকে অর্ধ জ্বলন্ত সিগারেটটা নিচে ফেকলেন। চোয়াল শক্ত করে আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“কিসের এত দাম্ভিকতা তোমার বাবার হ্যাঁ? কিসের এত ক্ষোভ আমার উপর উনার? কোন ক্ষতিটা করেছিলাম আমি উনার? উনার মেয়েকে পালিয়ে বিয়ে করাটা কি খুব বড় অন্যায় ছিল আমার? যার কারনে তিনি সবার সাথে আমার পরিচয় দিতে কুন্ঠা বোধ করেন? রীতিমতো সবার সামনে আমাকে ছোট করার চেষ্টা করেন!”

নীরব, নিভৃত, মানব মূর্তি আমি। উদ্বিগ্নতায় ঘেরা দুটো আঁখি যুগলে পরশের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললাম,,

“কি হয়েছে বলবেন তো? কোথায় আমার বাবা আপনাকে ছোট করেছেন? কার সাথে পরিচয় করান নি?”

“আমার চোখের সামনে তোমার বাবা বড় জিজুকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। অথচ আমি ও যে উনার সামনে দাঁড়িয়ে আছি উনি সেইদিকে নজর ই দিলেন না। একবার ও পরিচয় করিয়ে দিলেন না আমি উনার ছোট মেয়ের জামাই!”

রাগে, ক্ষোভে, অতি যন্ত্রণায় পরশের রক্তিম আঁখি যুগলে ভাসমান জল স্পষ্টত! লোকটি কান্না করছেন! খুব মনে লেগেছে আঘাতটা! শুকনো ঢোক গলাধঃকরণ করে আমি লোকটিকে শান্তনা দিতে যাব অমনি লোকটি আর ও এক খানা সিগারেট ধরিয়ে মুখে গুজে নিলেন! অন্য দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে ক্ষীন গলায় আমায় উদ্দেশ্য করে বললেন,,

“যাও তুমি এখান থেকে। আমাকে একটু একা থাকতে দাও৷ সিগারেটের বিদঘুটে গন্ধে আমার বাচ্চার সমস্যা হতে পারে!

“বাচ্চার কথা ছাড়ুন! আগে আমার কথা চিন্তা করুন। শুনুন আমি কি বলতে চাইছি!”

পরশ প্রত্যত্তুরে কিছু বলার পূর্বেই ছাদের দরজা থেকে বাবার বাজখাই গলার স্বর কর্নকুহরে প্রতিধ্বনিত হলো! বিস্মিত দৃষ্টিতে পিছু ফিরে তাকাতেই বাবা পরশকে ডেকে বললেন,,

“আমার বাড়িতে ধূমপান নিষিদ্ধ পরশ! হাত থেকে এইসব ছাই পাশ ছুড়ে ফেল!”

রূঢ় দৃষ্টিতে পরশ পিছু ঘুড়ে তাকালেন। কিয়ৎক্ষনের মধ্যেই বাবার দিকে তেড়ে দাঁড়িয়ে বললেন,,

“আপনার বাড়িতে আর কি কি নিষিদ্ধ একটু বলবেন? মুখ খুলে শুধু একবার বলুন আপনার বাড়িতে আমি ও নিষিদ্ধ! কথা দিচ্ছি আমি এক্ষনি, এই মুহূর্তে এই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাব!”

বাবা নিরুত্তর। শুধু বুকে দুহাত গুজে সরল দৃষ্টিতে পরশের দিকে চেয়ে আছেন। রাগী গলায় পরশ পুনরায় বললেন,,

“খুব কুন্ঠা বোধ হয় আপনার তাই না? আমাকে ছোট জামাই হিসেবে পরিচয় দিতে? আমাকে আপনার বড় জামাইয়ের মতো কাছে টেনে নিতে? স্নেহ করতে? এতটাই খারাপ আমি? ছোট জামাই হওয়ার এতটাই অযোগ্য আমি? বুঝতে পারেন না? আমি ও আপনাকে ভালোবাসি? শ্বশুড় হিসেবে যথেষ্ট সম্মান করি এবং শ্রদ্ধাবোধ ও করি? পার্থক্য শুধু এতেই। আমি শো অফ করি না। আপনার বড় জামাইয়ের মতো শো অফ করতে পারি না আমি। সম্পর্কটাকে একটু অন্য রকমভাবে প্রকাশ করার চেষ্টা করি। আর এটাই আমার দোষ তাই না?”

পরশের অনুরক্তিতে বাবার বিন্দু পরিমান ভাবান্তর হলো না। একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। কেবল ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকে বললেন,,

“আর কিছু? আর কোনো অভিযোগ আছে?”

ভাসমান জলরাশি গুলো দু হাত দিয়ে মুছে পরশ খর্ব গলায় বললেন,,

“আপাতত আর কিছু মনে পড়ছে না! মনে পড়লে বলব!”

বাবা হঠাৎ ফিক করে হেসে দিলেন। আমাদের দুজনকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে বাবা পরশের হাত থেকে সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে হুট করে পরশকে ঝাপটে ধরে বললেন,,

“তোমার চোখে আমার প্রতি ঠিক এই ভালোবাসাটাই দেখতে চেয়েছিলাম পরশ! যাক, দেখা হয়ে গেল! নিশ্চিন্ত হতে পেরেছি। শুধু আমিই আমার ছোট জামাইকে ভালোবাসি না! ছোট জামাইটা ও তার শ্বশুড়কে ঠিক অতোটাই ভালোবাসে! তুমি কি ভেবেছ? হেরে যাওয়ার কষ্টে আমি খুব আপসেট হয়ে আছি? না একদমই না! এই হেরে যাওয়ার মাঝেই আমি প্রকৃত সুখ খুঁজে পেয়েছি। একজন ভালো জামাই এবং একজন ভালো বন্ধু খুঁজে পেয়েছি। যার ভালোবাসার কাছে আমার মেয়ে আজীবন সুখে, শান্তিতে নিরাপদে থাকতে পারবে! যার সাথে আমার সম্পর্ক সবসময় দুষ্টু-মিষ্টি পর্যায়ের থাকবে৷ একদম একগুঁয়ে সম্পর্ক হবে না আমাদের। সম্পূর্ণ অন্য রকম একটা সম্পর্ক বজায় থাকবে!”

মৃদ্যু হাসলেন পরশ। বাবাকে ছেড়ে কিয়ৎক্ষন বাবার দিকে সন্তোষজনক দৃষ্টি স্থির করলেন। অতঃপর ফিক করে হেসে বললেন,,

“আসেন আব্বা! আজ আমরা জামাই, শ্বশুড় মিলে একই রঙ্গের পাঞ্জাবি পড়ব!”

বাবা অট্ট হাসি হাসলেন। মুহূর্তের মধ্যেই পরশ বাবার হাত দুখানা চেঁপে ধরে পাশ ফিরে আমার দিকে দুষ্টু দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। আমি তৃপ্তির হাসি হেসে উঠতেই পরশ বাবাকে নিয়ে সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হলেন। তাদের পিছু পিছু আমি ও হাঁটা ধরলাম!

,
,

রাত ৯ টা বাজতেই বাড়িতে হলুদের অনুষ্ঠান জমজমাট। পরশের জোরাজুরিতে বাবাকে ও হলুদ পাঞ্জাবি পড়তে হলো! দুই জামাই, শ্বশুড়ের হাস্যকর কান্ডে বাড়ির সব সদস্যদের পাশাপাশি মেহমান-অতিথিরা ও হাসতে বাধ্য হচ্ছিল। হাসি, খুশি, আনন্দ, অনুষ্ঠানে কেটে গেল হলুদের রাত! কাজিনরা যে যেভাবে পেরেছে নেচেছে। তবে আমি এইবার নাচের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করতে পারি নি। প্রেগনেন্ট তার উপর পরশের কড়া নির্দেশ!
#তোমায়_পাবো_বলে
#পর্ব_৩৭
#নিশাত_জাহান_নিশি

রাত ৯ টা বাজতেই বাড়িতে হলুদের অনুষ্ঠান জমজমাট। পরশের জোরাজুরিতে বাবাকে ও হলুদ পাঞ্জাবি পড়তে হলো! দুই জামাই, শ্বশুড়ের হাস্যকর কান্ডে বাড়ির সব সদস্যদের পাশাপাশি মেহমান-অতিথিরা ও হাসতে বাধ্য হচ্ছিল। হাসি, খুশি, আনন্দ, অনুষ্ঠানে কেটে গেল হলুদের রাত! কাজিনরা যে যেভাবে পেরেছে নেচেছে। তবে আমি এইবার নাচের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করতে পারি নি। প্রেগনেন্ট তার উপর পরশের কড়া নির্দেশ!

আজ মিলি আপুর বিয়ে! সকাল হতেই বাড়িতে কান্নার ঢল পড়ে গেল। চাচীমনি যেন কিছুতেই কান্না থামাতে পারছেন না। কিয়ৎক্ষণ পর পর মিলি আপুকে বুকে চেঁপে ধরে বিরামহীন ভাবে কেঁদে চলছেন। লোকমা তুলে অতি আদরে, যত্নে, ভালোবাসায় আপুকে খাইয়ে দিচ্ছেন। চাচা ও খুব বিষন্ন মনে মিলি আপুর আশেপাশে ছটফটিয়ে ঘুড়ছেন। ভাসমান অশ্রুকণা সমেত মিলি আপুকে অতি সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছেন। মুখ খুলে শুধু বলতে পারছেন না, “যাস না মা। বাবার রাজকন্যা হয়ে থেকে যা!” বাড়িতে কম/বেশি সবার মনই খুব খারাপ। প্রয়োজন বলেই বোধ হয় কাজ করতে হচ্ছে। নয়তো সবাই মিলি আপুকে ঘিরেই বসে থাকত। অশ্রুবিলাসে মেতে থাকত। ঐদিকে পরশ, জিজু, হিমেশ ভাই, বাবা এবং ছোট চাচা মিলে বিয়ের ক্যাটারিং এবং অন্যান্য ভারী কাজ সামলাচ্ছেন। দুপুর বারোটা বাজতেই পার্লারের মেয়েরা আমাদের বাড়ি এসে জড় হলেন। মিলি আপুকে সাজিয়ে দেওয়ার পর পালাক্রমে আমাদের সব বোনদের সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

দুপুর দুটো বাজতেই বরযাত্রী চলে এলো! বাড়ির সবাই বেশ তৎপর হয়ে উঠল বরযাত্রীদের আপ্যায়নে। মিলি আপুর রুমের জানালা দিয়ে বিয়ের প্যান্ডেল এবং স্টেইজ স্পষ্টত! পরশকে অতি সূক্ষ্ম এবং স্বচ্ছ দৃষ্টিতে পর্যালোচন করতে পারছি আমি। নয়নাভিরাম দৃষ্টি আমার। অতি প্রেমে রঞ্জিত! মানুষটি আজ লাল পাঞ্জাবি পড়েছেন। অনিন্দ্য সুন্দর দেখতে লাগছে মানুষটিকে! চোখ বুজে পুনরায় প্রেমে পড়ার মতোন যথেষ্ট। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে প্রফুল্ল হাসিতে মত্ত লোকটি। পিয়াস ভাইয়ার মাথার পাগড়ী নিয়ে তিনি হাসি, ঠাট্টা, দুষ্টুমিতে মশগুল। ছোট কাজিনরা সব সেজেগুজে স্টেইজে চলে গেছে। পিয়াস ভাইয়ার চারপাশে বসে নানা রকম ঠাট্টা, মশকরা করছে। আমি, পিয়ালী আপু এবং রুম্পা আপু মিলি আপুকে ঘিরে বসে আছি। বউ সাজে মিলি আপুকে দেখতে অনিন্দনীয় লাগছে! একদম তাক লেগে থাকার মতো সুন্দর লাগছে। পিয়াস ভাই হয়তো আজ আপুর থেকে দৃষ্টিই সরাতে পারবেন না। একদম ফিদা হয়ে যাবেন! পিয়াস ভাইকে ও কোনো দিক থেকে কম সুন্দর লাগছে না আজ। বিয়ের খুশিতে যেন ভাইটি আমার গ্লো করছেন! প্রিয় মানুষটিকে বউ হিসেবে পাওয়া মানেই হলো মন থেকে উৎপত্তি হওয়া এক বাঞ্ছনীয় সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ। যে সৌন্দর্য পিয়াস ভাইয়ার মুখমন্ডলে ঠিকরে পড়ছে! এর মধ্যেই দরজায় হঠাৎ খটখট শব্দে টোকা পড়ল। চাচার গলার স্বর ভেসে এলো।

“এই রুম্পা? দরজাটা খোল। কাজি সাহেব এসেছেন।”

রুম্পা আপু মৃদ্যু হেসে তড়িঘড়ি করে দরজার খিলটা খুলে দিলেন। অমনি চাচা হাসি মুখে কাজি সাহেব সমেত রুমে প্রবেশ করলেন। মিলি আপুর দিকে আহত দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে চাচা মাথা নুঁইয়ে নিলেন! অমনি মিলি আপু ঢুকড়ে কেঁদে উঠলেন। চাচা এই মায়া কান্না সহ্য করতে না পেরে আঁখি যুগলে বেদনা নিয়ে রুম থেকে প্রস্থান নিলেন! মা, চাচীমনিরা, ছোট চাচা এসে মিলি আপুকে শান্ত করে মুখ থেকে কবুল কথাটি বের করলেন। রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করিয়ে আপুর দিক থেকে বিয়ে সম্পন্ন করলেন। সবার ঠোঁটের কোনে এক দীপ্তিময় তৃপ্তির হাসি লেগে আছে। শুধু মিলি আপু এবং চাচীমনি বাদে!

অপর প্রান্তে পিয়াস ভাই ও তিন কবুল বলে, রেজিষ্ট্রি পেপারে সাইন করে চূড়ান্তভাবে বিয়েটা সম্পন্ন করলেন। এরপর শুরু হলো খাওয়া দাওয়ার পালা। বরযাত্রীকে যথেষ্ট আদর, আপ্যায়ন, সেবাযত্নের মাধ্যমে কব্জি ডুবিয়ে খাওয়ানো হলো। বরযাত্রীদের খাওয়ার পর আমরা বাড়ির সব সদস্যরা এক টেবিলে খেতে বসলাম। বিকেল ঘনিয়ে আসতেই বিদায়ের লগ্ন দরজায় কড়া নাড়ল! এবার মিলি আপুকে এই বাড়ি ছেড়ে সারা জীবনের শ্বশুড় বাড়িতে পা বাড়াতে হবে। কান্নার রোল পড়ে গেল পুরো বাড়িময়। সবার চোখের কোটর কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেল জলে! ঘনিয়ে এলো যে মিলি আপুর বিদায়ের লগ্ন! বুকে এক প্রকার পাথর চাঁপা দিয়ে চাচা এবং চাচীমনি মিলে পিয়াস ভাইয়ার হাতে মিলি আপুকে সমর্পণ করে দিলেন। বাড়ির সবাইকে শান্তনা দিয়ে পিয়াস ভাই ছুটে চললেন মিলি আপুকে নিয়ে আপুর নতুন বাড়িতে! যে বাড়িই হবে মিলি আপুর শেষ আশ্রয়স্থল!

,
,

রাত ৮টা বাজতেই পরশ হঠাৎ মরিয়া হয়ে উঠলেন ঢাকায় ফিরে যেতে! অফিস থেকে জরুরী কল এসেছে মাত্র। আগামীকাল যেভাবেই হোক সকাল ৯ টার মধ্যে অফিসে প্রেজেন্ট থাকবে হবে। উনার তাড়াহুড়োয় আমরা বাধ্য হলাম কাপড়-চোপড় গুছিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হতে। এমনিতেই বাড়িতে সবার মন খারাপ তারপর পরশের নেওয়া এমন হুটহাট সিদ্ধান্তে বাড়ির পরিবেশটা আর ও থমথমে এবং নিরাগ হয়ে উঠেছে। বাবার অমতে গিয়ে পরশ আমাদের সবাইকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলেন। শ্বশুড় আব্বু এবং শ্বাশুড়ী মা মিলে বাড়ির সবাইকে নিমন্ত্রণ দিয়ে গেলেন। আগামী শুক্রবার যেন আমার স্ব-পরিবার ঐ বাড়ি উপস্থিত থাকে। বাবা অধিক রাগে বশবর্তী হয়ে আছেন বলে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন না। তবে মা বাধ্য হয়ে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন! নয়তো আমার শ্বশুড়, শ্বাশুড়ী খুব কষ্ট পেতেন। বাবা-মা করে ভুল বুঝতেন। বাড়ির সবাইকে আর ও একবার কাঁদিয়ে আমি পা বাড়ালাম শ্বশুড় বাড়ির উদ্দেশ্যে! বাবার চোখের কোটর জুড়ে এই প্রথম বার অবাধ্য জলেদের অস্তিত্ব দেখেছি আমি! হুহু শব্দে কেঁদে উঠলাম আমি। বাবা ও দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে আমায় জড়িয়ে ধরে পরশের প্রতি পোষানো রাগ থেকে বিনা শব্দে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়লেন! পরশ চাঁপা শ্বাস নির্গত করে আমাদের সবাইকে নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লেন। বাড়ির গাড়ি দুটো করেই আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছি। ড্রাইভার আমাদের পৌঁছে দিয়েই গাড়ি দুটো করে কুমিল্লায় ফিরে আসবেন!

বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় ১২ টা বাজল! সবাই ক্লান্ত, শ্রান্ত হয়ে যে যার রুমে ফিরে গেল। আমি এবং পরশ ও নিজেদের রুমে ফিরে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গাঁ এলিয়ে দিলাম। পাশাপাশি শায়িত হতেই পরশ যখন আমায় ঝাপটে ধরতে যাবে ঠিক তখনি আমি আস্তে করে লোকটিকে উপেক্ষা করে অন্য পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম! পরশ ভীষন অবাক হলেন! বিস্মিত গলায় আমার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে বললেন,,

“কি হলো? সরে গেলে কেন?”

অভিমানী গলায় আমি প্রত্যত্তুরে বললাম,,

“কিছু হয় নি। একা একাই শুয়ে পড়ুন!”

পরশ খানিক রূঢ় গলায় বললেন,,

“অফিসে ইম্পর্টেন্ট কাজ ছিল টয়া। তোমার বুঝতে হবে। অযথা রাগ দেখালে তো চলবে না!”

“গতকাল মিলি আপুর রিসিপশান। আর আজ আমি এই বাড়িতে! মানে ঢাকায়! কত মাইল দূরে বুঝতে পারছেন তো? এই পরিস্থিতিতে আমি রাগ করব না তো কি করব? আর একটা দিনের জন্য ঐ বাড়িতে আমায় রেখে আসলে কি হত?”

পরশ নিশ্চুপ! অল্প সময় মৌনতা বজায় রেখে আচম্বিতে পেছন থেকে আমায় ঝাপটে ধরে আহ্লাদি গলায় বললেন,,

“জানি। তোমার মন খারাপ হচ্ছে! কিন্তু আমি ও তো অপারগ টয়া! নতুন জব আমার। কিছুদিন হলো পেয়েছি। এখন থেকেই যদি ঢিলেমি করি জবটা হাত থেকে গেল বলে! তবে কথা দিচ্ছি আমি! পিয়ালী এবং পায়েলের বিয়ের পর কয়েকদিনের জন্য তোমাকে কুমিল্লায় রেখে আসব। কিছুদিন থেকে আসবে। কোনো আপত্তি করব না আমি।”

গলায় সেই একই অভিমানিনী ভাব ফুটিয়ে আমি বললাম,,

“অনেক হয়েছে। আর কৃপা দেখাতে হবে না। তাছাড়া আমার সাত মাস পড়তেই আমি কুমিল্লায় চলে যাব। ওখান থেকেই ডেলিভারি হবে!”

“আমার মতামত ছাড়া তোমার কোনো সিদ্ধান্তই কার্যকর হবে না টয়া। সো এই বিষয় নিয়ে আর কোনো বার্কেটিং করবে না!”

“কিসের বার্কেটিং হুম? কিসের বার্কেটিং? নিয়ম এটাই। মেয়েদের প্রথম সন্তান তার বাবার বাড়ি থেকেই হয়। আপনার জন্য কিন্তু এই নিয়মটা পাল্টাবে না!”

“এত হাইপার হচ্ছে কেন? অযথা বিষয়টাকে তুমি টেনে হেছড়ে বড় করছ!”

“বড় আমি নই৷ আপনি করছেন! আপনার সিদ্ধান্তের উপর আমি বসে থাকব না কিন্তু। আমার প্রথম সন্তান ঐ বাড়িতেই হবে। এতে যতই আপনার আপত্তি থাকুক। আই জাস্ট ডোন্ট কেয়ার!”

তৎক্ষনাৎ পরশ হাতের বাঁধনটা ছেড়ে দিলেন। অন্য পাশ ফিরে অনুরক্ত গলায় বললেন,,

“তোমার যা ইচ্ছে তুমি তা করো। আমার কোনো সিদ্ধান্তের উপরই তোমার বসে থাকতে হবে না।”

মুখে হাত চেঁপে কেঁদে উঠলাম আমি। আমি চাই নি লোকটিকে রাগাতে! লোকটির সাথে খারাপ ব্যবহার করতে! তবে কেন জানি না মনটা ভীষণ বিষন্ন হয়ে আছে আমার! মা-বাবা, ভাই বোন, পরিবারের প্রতিটা সদস্যকে দারুন ভাবে মিস করছি। প্রায় এক মাসের মতো থাকা হয়েছে ঐ বাড়িতে! নতুন করে মায়া বোধ জন্ম নিয়েছে সবার প্রতি! বিশেষ করে মিলি আপুর কথা ভীষন ভাবে মনে পড়ছে। আপুর বিয়ের রিসিপশানে থাকতে পারব না আমি! কষ্ট তো আমার হবেই তাই না? ইতোমধ্যেই ক্রিং ক্রিং শব্দে পরশের ফোন বেজে উঠল। রাগ, জেদ থেকে পরশ বোধ হয় ফোনটা তুলছেন না। কেন জানি না মনে হচ্ছে ঐ বাড়ি থেকে কল এসেছে। মা-বাবা হয়তো কল করেছেন। ঠিকঠাক মতো আমরা পৌঁছেছি কিনা জানতে! তাড়াহুড়ো করে আঁখিপল্লবের জলরাশি মুছে আমি পাশ ফিরে পরশের বালিশের তলা থেকে ফোনটা হাতে নিলাম। অমনি স্ক্রীনে আব্বুর ফোন নাম্বারটি ভেসে উঠল৷ অপেক্ষার যেন অবসান ঘটল আমার! ঠোঁটের কোনে এক চিলতে স্বস্তির এবং প্রফুল্লতার হাসি ফুটে উঠল। চট জলদি আমি কলটা তুলতেই বাবা ঐ পাশ থেকে ব্যতিব্যস্ত গলায় বললেন,,

“তোমরা পৌঁছেছ তো পরশ?”

মুহূর্তের মধ্যেই আবার ও আমার কান্না পেয়ে বসল! মুখ চেঁপে কেঁদে আমি প্রত্যত্তুরে বললাম,,

“পৌঁছেছি বাবা!”

বাবা নিরুত্তর! হয়তো বেদনা নিবারন করতে ব্যস্ত। বেশ কিছুক্ষন পর বাবা জোর পূর্বক হাসিতে শান্ত গলায় বললেন,,

“বাবা সকালে কল করব। এখন রেস্ট নাও তুমি। গুড নাইট!”

ফট করে বাবা কলটা কেটে দিলেন। কান থেকে ফোনটা সরিয়ে আমি ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠতেই পরশ পাশ ফিরে শক্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। কড়া গলায় আমায় শাসিয়ে বললেন,,

“কান্না থামাবে তুমি? কি কখন থেকে ফ্যাস ফ্যাস করে কেঁদেই যাচ্ছ? একেবারে চলে এসেছ নাকি ঐ বাড়ি থেকে? আর কখন ও ফিরবে না ঐ বাড়িতে?”

কান্না থামিয়ে আমার ভীতসন্ত্রস্ত দৃষ্টি পড়ল পরশের রাগী দৃষ্টিতে! রেগে গেলে লোকটিকে বড্ড ভয়ঙ্কর দেখায়। নিমিষেই যে কেউ জব্দ হতে বাধ্য। শুকনো ঢোকের সাথে কান্না গলাধঃকরন করে আমি খানিকটা শান্ত হতেই পরশ নমনীয় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন আমার দিকে। অতঃপর আমার দিকে এগিয়ে এসে আলতো হাতে চোখের জল গুলো মুছে দিলেন। কপালে দীর্ঘ চুম্বন বসিয়ে বললেন,,

“আমি জানি। ঐ বাড়ির সবাইকে ছেড়ে এসেছ বলেই তোমার খুব মন খারাপ করছে। তার মানে এই না যে কান্নাকাটি করে নিজের শরীর খারাপ করতে হবে। একটু শান্ত হও তুমি। কয়েকটা দিন সময় দাও। দেখবে দুদিন পরেই তুমি আবার এই বাড়িতে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছ। ঐ বাড়ির কথা খুব একটা মনে পড়ছে না তখন। হুট করে স্থান পরিবর্তন কারনেই এতটা কষ্ট হচ্ছে তোমার!”

নাক টেনে কেঁদে আমি বললাম,,

“আমার প্রথম বাচ্চাটা কিন্তু ঐ বাড়ি থেকেই হবে পরশ। বাবার নির্দেশ দয়া করে অমান্য করবেন না!”

“আচ্ছা! সে এখন অনেক দূরের খবর। এখন ও তো মাস ও ফুরোয় নি। আপাতত বিষয়টিকে ভুলে নিজের শরীর এবং স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দাও। চুপ করে একটু ঘুমাও। কাল সকাল ৮ টা বাজতেই আমার রওনা দিতে হবে। তোমাকে শান্ত করতে করতেই তো রাত পাড় হয়ে যাচ্ছে আমার। ঘুমাব কখন শুনি?”

“আচ্ছা আর কাঁদব না আমি। শান্ত হয়ে গেলাম। এবার আপনি ঘুমান।”

মৃদ্যু হাসলেন পরশ। কপালে পুনরায় দীর্ঘ চুম্বন এঁকে বললেন,,

“আমার লক্ষি বউটা!”

বিপরীতে আমি মৃদ্যু হাসলাম। পরশকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে ঘুমের অতলে পা বাড়ালাম!

,
,

সকাল সাতটায় ঘুম ভাঙ্গল আমার। তড়িঘড়ি করে ঘুম থেকে উঠে আমি প্রথমে আমার রুমটা ঝাড়ু দিলাম। ফ্রেশ হয়ে ফজরের কাযা নামাজ আদায় করে রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে ছুট দিলাম। মা আজ এখন ও ঘুমুচ্ছেন! ভীষন ক্লান্ত বলেই বোধ হয় ঘুম থেকে উঠতে পারছেন না। ঘন্টাখানিকের মধ্যে নাশতার জোগাড় সেরে আমি খাবার টেবিলে নাশতার প্রতিটা পদ সাজিয়ে দিলাম। আটটার মধ্যেই পরশ ঘুম থেকে উঠে পড়লেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই শাওয়ার নিয়ে, অফিসের জন্য একেবারে রেডি হয়ে খাবার টেবিলে চলে এলেন। মা, বাবা, পায়েল, পিয়ালী আপু ও একজোট হয়ে খাবার টেবিলে সমবেত হলেন। পরশ এবং শ্বশুড় আব্বু খুব তাড়ায় আছেন! তাই কোনো রকমে নাশতা করে দুজনই অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলেন।

দুপুর ১২ টা বাজতেই হঠাৎ সদর দরজার কলিং বেল বেজে উঠল৷ এই সময় তো সচরাচর বাড়িতে কেউ আসেন না! তবে আজ কে এলেন? গ্যাসে তরকারী বসিয়েছি মাত্র। মা বাজারে গেছেন সবজি আনতে। পায়েল ভার্সিটিতে। আগামী সপ্তাহেই তার সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল এক্সাম! পিয়ালী আপু বোধ হয় ঘরে বসে পড়ছেন। বাধ্য হয়ে আমাকেই রান্নাঘর থেকে বেরুতে হলো। ব্যতিব্যস্ত ভঙ্গিতে আমি সদর দরজার দিকে অগ্রসর হতেই পিয়ালী আপু বসার ঘর থেকে আমায় থামিয়ে বললেন,,

“আমি যাচ্ছি ভাবী। তুমি বরং রান্নাঘরে যাও। আগের বারের মতো না আবার ভাতের বদলে তরকারী পুড়ে যায়!”

জিভ কেটে হুড়মুড়িয়ে আমি রান্নাঘরে ঢুকে পড়লাম। কিয়ৎক্ষণের মধ্যেই মনে হলো পিয়ালী আপু দরজা খুলেই কারো সাথে তুখাড় ঝগড়া ঝাঁটিতে লিপ্ত হয়ে পড়েছেন! গ্যাসের আগুন কমিয়ে আমি তড়িঘড়ি করে দৌঁড়ে গেলাম সদর দরজার দিকে। চৌকাঠের ঠিক ওপারে দাঁড়িয়ে আছেন খুব লম্বা-চূড়া, সুঠাম দেহের একজন সুদর্শন ছেলে। গাঁয়ের রং হালকা চাঁপা। তবে মুখমন্ডল মায়ার ভরা! চেহারার আর্ট খুব সুন্দর। হাতে ছেলেটির ফুটন্ত গোলাপের বগি, ঠোঁটের কোনে এক নজর কাড়া হাসি! সেই হাসিতেই যেন পিয়ালী আপুর সমস্ত রাগ! অগ্নিশর্মা দৃষ্টিতে পিয়ালী আপু ভদ্র ছেলেটিকে শুধিয়ে বলছেন,,

“কি চাই কি আপনার হুম? কি চাই? সাহস তো কম না আপনার! পিছু করতে করতে বাড়ি অবধি চলে এসেছেন? আর হাতে ওটা কি? কি ভেবেছেন? সস্তা কয়েকটা ফুল অফার করলেই অমনি আমি হ্যাংলাদের মতো আপনার প্রেম প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাব? এতই চিপ নাকি আমার মেন্টালি?”

পিয়ালী আপুর তীক্ষ্ণ কথার বিপরীতে মনে হলো না ছেলেটির খুব বেশি ভাবান্তর হলো! ঠোঁটের কোনে সেই একই হাসির রেখা ফুটিয়ে ছেলেটি অতি কোমলীয় গলায় বললেন,,

“দীর্ঘ এক মাস যাবত ফলো করছি তোমাকে! কি ভেবেছ? এত সহজে আমার হাত থেকে তোমার মুক্তি মিলবে? হাজার গাঁ ঢাকা দিয়ে ও আমার থেকে পরিত্রাণ মিলবে না তোমার! অবশেষে তোমাকে আমি জয় করেই ছাড়ব!”
#তোমায়_পাবো_বলে
#পর্ব_৩৯
#নিশাত_জাহান_নিশি

লোকটি আমার বারণ শুনলেন না। উত্তেজিত হয়ে আমায় আপন করে নিতে তৎপর হয়ে উঠলেন। প্রথম অবস্থায় যদি ও আমি সায় দিতে চাই নি লোকটিকে। তবে পরবর্তীতে সায় দিতে বাধ্য হলাম!

,
,

আজ পিয়ালী আপু এবং পায়েলের হলুদ সন্ধ্যে! বাড়ি ভর্তি আনন্দ-অনুষ্ঠান এবং জমকালো উৎসবের রকমারি আয়োজন! সারা বাড়িময় মুখরিত হাসি, খুশি, হৈ-হুল্লোড় এবং আমোদ-প্রমোদে। রান্না ঘর থেকে অতি লোভনীয় খাবারের ঘ্রাণ ভেসে আসছে নাকে। আত্নীয় স্বজনদের চাপ যেন বিপুল হারে বাড়ছে। তাদের যত্ন আত্তি করতে করতে আমি ক্লান্ত প্রায়। শরীরে দম খুঁজে পাচ্ছি না। এত ক্লান্তি এবং ব্যস্ততার মাঝে ও আমার মন পড়ে আছে অন্য ধ্যানে! সন্ধ্যে ৭ টা বাজতে চলল ঘড়িতে। অথচ আমার বাবার বাড়ির লোকজনের সাথে এখন ও কোনো দেখাই নেই। তাদের আসার কোনো গতগম্য ও নেই। অনেক বার যোগাযোগ করার চেষ্টা করে ও বাড়ির একটি লোকের সাথে ও সংযুক্ত হতে পারছিলাম না প্রায় অনেকক্ষন যাবত। সবার ফোনই ব্যস্ত আসছে নয়তো সংযোগ বিচ্ছিন্ন আসছে! পরশকে ও এক মুহূর্তের জন্য একা খুঁজে পাচ্ছি না কোথাও। চিন্তার বিষয়টি ও লোকটির কাছে ব্যক্ত করতে পারছি না। ঐদিকে পার্লার থেকে কয়েকজন স্পেশালিষ্ট এসে পায়েল এবং পিয়ালী আপুকে সাজাতে আরম্ভ করেছে। কিছুক্ষন পর হয়তো আমার ও ডাক আসবে!

জনাজীর্ণ শরীর নিয়ে আমি দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ দু আঁখি পল্লবে আমার শোবার ঘরে প্রবেশ করলাম। সেই একই উদ্যমে অটল থেকে আমি তড়িঘড়ি করে পুনরায় বাবার নাম্বারে ডায়াল করলাম। এবার ও কলটি অবলীলায় বেজে গেল। ঐ পাশ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়াই পরিলক্ষিত হলো না! এর মধ্যেই রুমের দরজা ঠেলে পরশ রুমে প্রবেশ করলেন। এদিক ওদিক না তাকিয়েই তিনি অতি ব্যস্ত ভঙ্গিতে আলমারির ড্রয়ার খুলে টাকার প্যাকেটটা হাতে নিয়ে রুম থেকে প্রস্থান নেওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে অস্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন আমার দিকে। আহত দৃষ্টিতে আমি লোকটির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম,,

“ঐ বাড়ি থেকে কেউ আমার কল তুলছেন না পরশ। ভীষণ টেনশান হচ্ছে আমার। রাস্তায় কোনো বিপদ-আপদ ঘটল না তো?”

পরশ ঘাবড়ালেন! কপালের ভাঁজে কয়েক দফা বির্দীণতার ছাপ ফুটিয়ে বললেন,,

“বাবা ও কল তুলছেন না?”

“না। তাই তো বেশি দুশ্চিন্তা হচ্ছে!”

“ওয়েট। আমি দেখছি!”

পরশ এবার উনার ফোনটা হাতে নিলেন। প্রখর উদ্বিগ্নতা সমেত ডায়াল করলেন বাবার নাম্বারে। চার দফা রিং বাজার পর পাঁচ বারের বেলায় বাবা কলটা তুললেন! স্বস্তির শ্বাস নির্গত করে পরশ সঙ্গে সঙ্গেই অনুরক্ত গলায় বাবার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“কি হয়েছেটা কি শ্বশুড় আব্বা? আপনারা কোথায়?”

বাবা কেমন যেন শুষ্ক এবং অস্থির গলায় বললেন,,

“চলে এসেছি! আর একটু।”

“এতক্ষন কলটা তুলছিলেন না কেন বাবা? কি হয়েছিল?”

“বাড়ি এসে বলছি!”

“বাড়ি আসতে আসতে আপনার মেয়েকে সামলানো যাবে না। দুশ্চিন্তা এবং আতঙ্কে আপনার মেয়ের যায় যায় অবস্থা।”

“টয়াকে বলো একদম দুঃশ্চিন্তা না করতে। আমরা ভালো আছি, নিরাপদে আছি। ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যেই আমরা ওর সামনে হাজির হচ্ছি!”

টুং টাং শব্দে কলটা কেটে গেল। পরশ কান থেকে ফোনটা সরাতেই আমি কান্নাজড়িত গলায় পরশকে ঝাপটে ধরে বললাম,,

“নিশ্চয়ই রাস্তায় কোনো বিপদ-আপদ ঘটেছিল! তাই তো বাবার গলাটা কেমন যেন শুকনো এবং অধীর লাগছিল।”

বলিষ্ঠ বুকের পাজরে পরশ আমাকে পরম আবেশে ঝাপটে ধরে ধীর গলায় বললেন,,

“এত উৎকন্ঠিত হওয়ার কিছু নেই বউ। সবাই এখন নিরাপদে আছে, সুস্থ আছে এই ভেবেই সন্তুষ্ট থাকো!”

বোবা কান্নায় লিপ্ত আমি। শঙ্কা যেন কিছুতেই কাটছে না। বেগতিক দুর্বল চিন্তা ভাবনা খারাপ দিকেই স্থির হচ্ছে। মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে পরশ নমনীয় গলায় বললেন,,

“কিছুক্ষন রেস্ট নাও তুমি। সারাদিনের ধকলে খুব ক্লান্ত হয়ে আছো। আমার বাচ্চার ও তো বিশ্রামের প্রয়োজন নাকি? তাছাড়া কিছুক্ষন পর তোমার বাপের বাড়ির লোকজন এলে তো তোমায় আর খুঁজেই পাওয়া যাবে না৷ তখন আর ও ব্যস্ত হয়ে উঠবে তাদের নিয়ে। তাই এখন যতটাই পারো বিশ্রাম নিয়ে নাও।’

“কিভাবে বিশ্রাম হবে? বাড়িতে তো অনেক কাজ পড়ে আছে!”

“চিন্তার কিছু নেই। মা সামলে নিবেন!”

পরশের জোরাজুরিতে এক প্রকার আমার বাধ্য হয়ে বিশ্রাম নিতেই হলো। যাওয়ার সময় পরশ রুমের দরজাটা হালকা ভেজিয়ে দিয়ে গেলেন। আমি ও বেশ আরাম পেয়ে কিয়ৎক্ষণের মধ্যেই আঁখি যুগল বুজে নিলাম৷ সঙ্গে সঙ্গেই আমার ক্লান্ত দু আঁখিপল্লবে অবাধ্য ঘুমেরা হানা দিলো!

__________________________________________

ঘড়িতে রাত ৯ টা ছুঁইছুঁই৷ সমুদয় বাড়ির পাশাপাশি আমার শোবার ঘর ও এখন হাসাহাসি এবং অঢেল আনন্দ ফুর্তিতে ভরপুর। সব কাজিনদের মিলন মেলা বসেছে আমার শোবার ঘরে! রুম্পা আপু থেকে শুরু করে মিলি আপু, ফারিহা আপু, নীলা, স্নিগ্ধা, পায়েল এবং পিয়ালী আপুতে এসে থেমেছে এই লিস্ট! তাদের সবাইকে একসাথে পেয়ে যেন আমার সমস্ত ক্লান্তি, ক্লেশ, মনোক্ষুণ্ণতা সব এক নিমিষেই দূর হয়ে গেল। শরীরটা ও এখন খুব প্রফুল্ল এবং ফুঁড়ফুঁড়া লাগছে। দুর্বলতা এবং বিষাদের রেশ ও ক্ষনিকের মধ্যেই কেটে গেছে। জিহাদ ভাই, পিয়াস ভাই এবং রুম্পা আপুর হাজবেন্ড সবাই পরশের সাথে বিভিন্ন কাজে যুক্ত হয়ে গেছে। এই দিকে আমার এখন ও সাজগোজ করা হয় নি। বাড়ির সবাইকে পেয়ে আমি শুধু সাজ নয়, বোধ হয় নিজেকেই ভুলতে বসেছি! খুশি যেন আমার আর ধরছে না। আমার সাথে কিছুক্ষন সময় কাটানোর পর মা-বাবা, চাচা এবং চাচীমনিরা মিলে এবার আমার শ্বশুড় এবং শ্বাশুড়ীর সাথে বসার ঘরে আড্ডায় মশগুল হয়ে উঠলেন। বাড়ির কাজের জন্য পরশ আলাদা করে তিনজন কাজের মহিলা রেখেছেন। তারাই বাড়ির সমস্ত অভ্যন্তরীন কাজ সামলে নিচ্ছেন। তাই আমাদের উপর কাজের ধকল খুব কম যাচ্ছে!

হলুদের সাজে পিয়ালী আপু এবং পায়েলকে আলাদা করাটা বড্ড মুশকিল হয়ে পড়ছে! মনে হচ্ছে যেন দুজনই জমজ বোন! একই শাড়ি, একই অরনামেন্টস, একই সাজ, একই গাঁয়ের রং! তাদের দুজনকে কেন্দ্র করেই আমরা সব কাজিনরা গোল হয়ে বসে আছি। সবার আলোচনার বিষয় হলো পায়েল এবং পিয়ালী আপুর সাজ নিয়ে! তাদের দুজনের মধ্যে লক্ষিত প্রকারভেদ নিয়ে। এর মধ্যেই আমি হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টে উদ্বিগ্ন গলায় ফারিহা আপুকে শুধিয়ে বললাম,,

“আচ্ছা আপু? তোমাদের আসতে এত দেরি হয়েছিল কেন? রাস্তায় কিছু হয়েছিল?”

ফারিহা আপু ভগ্ন গলায় ঘোর আতঙ্ক সমেত বললেন,,

“আর বলিস না! আমাদের ড্রাইভারের একটু ভুলের জন্য মহা ফ্যাসাদে ফেসে গিয়েছিলাম আমরা! ড্রাইভারের সামান্য অসতর্কতার জন্য সামনের গাড়িটায় হালকা ধাক্কা লেগে যায়! ব্যাস হয়ে গেল! ঐ গাড়ির মালিক এসে রাস্তায় হাঙ্গামা বাঁধিয়ে বসলেন। লোকটিকে বুঝিয়ে শুনিয়ে এই মহা ফ্যাসাদ থেকে বেরুতে অনেকটা সময় পাড় হয়ে গেল৷ যার কারনে আমাদের আসতে ও অনেকটা দেরি হয়ে যায়!”

উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে আমি বেগহীন গলায় বললাম,,

“তোমাদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয় নি তো আপু?”

“আরে না! আমরা সবাই ঠিক আছি। অতো চিন্তা করার কিছু নেই। এখন তুই রেডি হ যাহ্। হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হতে চলল বলে!”

হুট করেই আমার দৃষ্টি পড়ল মিলি আপুর দিকে! আপু কেমন যেন উদাসীন এবং মনমরা চিত্তে বসে আছেন! ক্ষীণ গলায় আমি আপুকে শুধিয়ে বললাম,,

“এই আপু? কি হয়েছে তোমার? আপসেট কেন?”

চাঁপা দীর্ঘশ্বাস নির্গত করে আপু দুঃখ ভারাক্রান্ত গলায় বললেন,,

“সংসার জীবনে এসে আমি পুরোপুরি ফেঁসে গেছি রে বোন! শ্বাশুড়ী পড়েছেন একদম জাদরেল স্বভাবের! সারাদিন নানান কাজে আমাকে খাটিয়ে মারেন। কাজে একটু ভুল ভ্রান্তি হলেই হাজারটা কথা শুনিয়ে দেন। পিয়াস ও মায়ের মুখের উপর কিছু বলতে পারে না। প্রতিনিয়ত আমাদের মাঝে টক ঝক লেগেই থাকে! জাস্ট হাঁফিয়ে উঠেছি আমি। বিলিভ মি? আমি এসব অশান্তি আর নিতে পারছি না!’

“আরেহ্ আপু৷ চিন্তা করো না। এইটা কোনো ব্যাপার ই না! আমার ও প্রথম প্রথম এমন হতো। মায়ের সাথে কথা কাটি, ভুল বুঝাবুঝি, কাজে ভুলত্রুটি, ঘুম, খাওয়া, নাওয়া, হাঁটা-চলা এমন হাজারটা অভিযোগ হতো। এসব নিয়ে কত কেঁদেছি, পরশের সাথে মাঝে মধ্যে অশান্তি ও করেছি। কিন্তু এখন দেখো? কত মানিয়ে নিয়েছি আমি৷ সব কিছুর জন্যই একটা নির্দিষ্ট সময়ের প্রয়োজন আপু। হোক সেটা মানিয়ে নেওয়া বা মেনে নেওয়া। তুমি আস্তে ধীরে নিজেকে মানিয়ে নাও। দেখবে খালামনি ও তোমাকে মেনে নিবেন। তাছাড়া সংসার জীবনে প্রথম অবস্থায় এসেই যে কেউ কাজে খুব বেশি পটু বা পারদর্শী হয়ে উঠে এমনটা কিন্তু না। কয়েকটা মাস সময় দেওয়ার পর, কাজে মনঃসংযোগ দেওয়ার পরই সে আস্তে ধীরে সাংসারিক কাজে পটু হয়ে উঠে এবং সমান ভাবে পারদর্শী হয়ে উঠে। এর প্রমান কিন্তু আমি নিজেই!”

মিলি আপু মলিন হাসলেন। আমার মাথায় গাড্ডা মেরে বললেন,,

“বাহ্ আমার বোন তো দেখছি আমার চেয়ে খুব ভালো বুঝে! কি সুন্দর কম শব্দে বুঝিয়ে দিলো আমায়! জানিস? আমি ভেবে নিয়েছি। এবার থেকে সাংসারিক যেকোনো প্রতিকূলতায় আমি তোর থেকে সমাধান নিব। দিবি তো সঠিক সমাধান?”

আমি এক চোখ টিপে ক্রুর হেসে বললাম,

“কেন নয়?”

হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হলো রাত প্রায় ১০ টায়! বিনা সাজেই আমি পিয়ালী আপু এবং পায়েলকে হলুদ, মেহেন্দি পড়িয়ে দিলাম। আসলে আড্ডা চারীতায় মশগুল থাকার কারনে সাজগোজ করাটা ঠিক হয়ে উঠে নি আমার! আর এই কারনেই পরশ ভীষন রেগে আছেন আমার সাথে! মুখ খুলে কথাটি বলছেন না পর্যন্ত! লোকটির এক ছটা দৃষ্টি ও পড়ছে না আমার দিকে। এই রাগ নিয়েই তিনি হলুদের রাত কাটিয়ে দিলেন! রাতে আমার সাথে ঘুমুতে এলেন না পর্যন্ত। ব্যগ্র গলায় বলে দিলেন কাজিনদের সাথে ঘুমিয়ে পড়তে! আমি ও কম যাই না। মুখের উপর আমি ও বলে দিয়েছি, হ্যাঁ আমি কাজিনদের সাথেই ঘুমুব। আপনার সাথে ঘুমুতে বয়ে গেছে আমার। প্রত্যত্তুরে লোকটি কিছু বলবেন না। শুধু ফোঁস করে তেজী শ্বাস নির্গত করলেন! তখন মুখ চেঁপে হাসি নিবারন করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না আমার। প্রকাশ্যে হেসে উঠলেই পড়ত আমার পিঠে দু’ঘা!

,
,

পরের দিন সুষ্ঠু সম্মত ভাবেই পিয়ালী আপু এবং পায়েলের বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলো! তিন কবুল এবং রেজিস্ট্রির মাধ্যমে দু জোড়া বিয়ে কোনো ঝামেলা ছাড়াই সম্পাদন হলো! বাড়ি ভর্তি এলাহি কান্ড, হাসি, খুশি, আমোদ, প্রমোদের রেশ যেন দুজনের বিদায়ের লগ্নে এসে থমকে গেল! আমাদের সমগ্র বাড়িটিকে নির্জীব, প্রাণহীন এবং থমথমে করে দিয়ে পিয়ালী আপু এবং পায়েল বিদায় নিলেন দু রাস্তা ধরে! এই আনন্দ মিশ্রিত শোকের ভয়বহতায় মা, বাবা এবং পরশ ভেতর থেকে দারুনভাবে ভেঙ্গে পড়েছেন। একই দিনে দুই মেয়ের বিদেয় হলো! এই বিষন্ন বেদনায় হৃদয় কলুষিত হওয়ার ই তো কথা! এই দুর্বিষহ বেদনায় তাদের যেন কিছুতেই সামলানো যাচ্ছে না। পরশ নিজে ও যখন রায়হান ভাই এবং হিমেশ ভাইয়ার হাতে পিয়ালী আপু এবং পায়েলকে তুলে দিচ্ছিলেন তখন উনার রাঙ্গা দু’আঁখিতে আমি বিষন্ন কান্নার ছাপ দেখেছিলাম। লোকটির এই কাতর ভাব দেখে আমি ও কাঁদতে বাধ্য হয়েছিলাম। এই ভেবেই বেশি কষ্ট হচ্ছে যে, আজ থেকে পুরো বাড়িতে আমি এবং মা খুব একা হয়ে গেলাম।

পরের দিন পিয়ালী আপুর বৌভাতের অনুষ্ঠান থেকেই আমার মা-বাবা এবং আমার পুরো পরিবার কুমিল্লার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলেন। অনেক কেঁদে কেটে ও তাদের আটকাতে পারি নি। দু রাত মেয়ের শ্বশুড় বাড়িতে কাটিয়েছেন এই নাকি অনেক। এর চেয়ে বেশি কিছু চাওয়া দৃষ্টিকটু! পরের দিন যথারীতি পায়েলের বৌভাতের অনুষ্ঠান ছিল। বৌভাতের অনুষ্ঠান কাটিয়ে পিয়ালী আপু এবং পায়েল তাদের হাজবেন্ড সহ তিন দিনের জন্য আমাদের বাড়িতেই অবস্থান করছেন।

আগামী সপ্তাহটি যেন অতি দ্রুতই ঘনিয়ে এলো! চোখের পলকেই দরজায় কড়া নাড়ল রুটিন মাফিক আমার চূড়ান্ত পরীক্ষার প্রথম দিন! পরীক্ষা শুরু দুপুর একটা নাগাদ। খুব ঢিলেঢালা প্রিপারেশন আমার! তা ও পরশের চাপে জ্ঞানহীন এবং অলস মস্তিষ্ক নিয়ে অল্প স্বল্প পড়তে বসা। একই সাথে দু দুটো বিয়ের ধকল সামলে পড়তে বসাটা আমার জন্য নিঃসন্দেহে অতি কষ্টদায়ক এবং বিরক্তিকর ঠেঁকছিল। তবু ও জোরপূর্বক বিচ্ছিন্ন মন মানসিকতা নিয়েই পাশ করার মতো প্রিপারেশন নেওয়া হয়েছে আমার! সকাল ৯ টা বাজতেই মা-বাবার থেকে দো’আ এবং বিদায় নিয়ে আমি পরশের সঙ্গ ধরে কুমিল্লার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। পরীক্ষার চলাকালীন আগামী এক মাস আমি বাবার বাড়িতেই থাকব। ওখান থেকেই পরীক্ষা শেষ হলে তবে ঢাকা ফিরব। দুদিন পর পর জার্নি করা এই অবস্থায় আমার পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। পরশ রীতিমতো এই বিষয়টাতে খুব যত্নশীল ছিলেন। আমার সুবিধের জন্য লোকটি আমায় ছেড়ে দীর্ঘ এক মাস থাকার সিদ্ধান্ত অতি অনায়াসেই গ্রহন করে নিয়েছিলেন।

_________________________________________

পরীক্ষার বাহানায় দীর্ঘ এক মাস পরশকে ছাড়া থাকতে হয়েছে আমার। এই একটা মাস অতি যন্ত্রণাময় এবং খুব কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে পাড় করেছিলাম আমরা দুজনই। আবার ও সমস্ত দূরত্ব ঘুচিয়ে আমি এবং পরশ এক হতে সমর্থ হয়েছি! আজই পরশের সাথে আমার ঢাকা ফেরা হলো!
#তোমায়_পাবো_বলে
#পর্ব_৪০ (অন্তিম পর্ব)
#নিশাত_জাহান_নিশি

পরীক্ষার বাহানায় দীর্ঘ এক মাস পরশকে ছাড়া থাকতে হয়েছে আমার। এই একটা মাস অতি যন্ত্রণাময় এবং খুব কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে পাড় করেছিলাম আমরা দুজনই। আবার ও সমস্ত দূরত্ব ঘুচিয়ে আমি এবং পরশ এক হতে সমর্থ হয়েছি! আজই পরশের সাথে আমি ঢাকা ফিরেছি!

প্রেগনেন্সির আড়াই মাস চলমান। কাজে, কর্মে, চলতে ফিরতে যদি ও তেমন কোনো সমস্যা পরিলক্ষিত হচ্ছে না, তবে খাওয়া দাওয়ায় বড্ড অনীহা এবং অরুচি আমার! জিহ্বায় স্বাদের কোনো বালাই নেই। যাই মুখে তুলছি তাই যেন পাকস্থলী নিংড়ে অম্লস্বাদ হয়ে বের হচ্ছে। এই বিষয়টিতে পরশের পাশাপাশি মা ও ভীষন চিন্তিত। ডাল-ভাত চটকে খাওয়া ছাড়া জিহ্বা আর কোনো স্বাদ গ্রহনই করতে পারছে না। পুষ্টিকর সঠিক খাবারের অভাবে শরীর ক্রমাগত আমার শুকিয়ে কাঠের লাকড়িতে পরিনত হচ্ছে। অন্যদিকে নিদ্রা ভারী হয়ে উঠছে প্রতিদিন নিয়ম করে! আড়াই মাসে পড়তেই যে আমার শরীরের এতটা অবনতি ঘটবে, তা নিতান্তই অপ্রত্যাশিত ছিল আমাদের প্রত্যেকের কাছে! রাত ১০ টা বাজতেই আঁখি যুগলে আমার অবাধ্য সুপ্তি পরীরা হানা দিচ্ছে। আর তখনই কোনো কাল বিলম্ব না করে সঙ্গে সঙ্গেই আমার ঘুমিয়ে পড়তে হচ্ছে। অলসতা করলেই পরে শরীরে অবসন্নতা দেখা দিচ্ছে। মেজাজ খিটখিটে এবং চড়া হয়ে উঠছে। যার প্রভাব পড়ছে সম্পূর্ণ পরশের উপর। এই তো, আজ একটু আগের ঘটনা। কুমিল্লা থেকে ফিরেছি এক সপ্তাহ হলো। এই এক সপ্তাহে এক রাতে ও আমি পরশের ধারে কাছে ঘেঁষি নি! অফিস থেকে তিনি ফিরতে ফিরতেই প্রতি রাতে আমি দশটা নাগাদ ঘুমিয়ে পড়ছি। লোকটির সাথে নীরবে, নিভৃতে দু’একটা প্রেম মাখানো কথা বলছি নি পর্যন্ত। অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এসে লোকটি ক্লান্ত শরীর নিয়েই নিজ হাতে খাবার বেড়ে খেয়ে নিচ্ছেন! ঘুমিয়ে পড়ছি বলে আমার অসুবিধে করে ঘুম থেকে আমায় জাগিয়ে তুলতে চান নি। আজ ও ঠিক হয়েছে তাই! দশটা বাজতেই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। খুব গভীর ঘুম। যে ঘুমে দরজা ঠেলে দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি রুমে প্রবেশ করলে ও টের পাওয়া যায় না ঠিক সেই ঘুম। ঘুমের মধ্যেই হঠাৎ অনুভব হয়েছিল কেউ আমায় বলিষ্ঠ শরীরে ঝাপটে ধরে আমার সমস্ত মুখমন্ডলে গাঢ় চুম্বন করছিল! সেই লোকটির নাক থেকে নিঃসৃত তপ্ত শ্বাস আমার সমগ্র মুখমন্ডলে কম্পন সৃষ্টি করছিল। লোকূপদ্বয়কে সূচালো ভাবে জাগিয়ে তুলছিল! অতি উত্তেজনা এবং ঘোর আতঙ্কে এই বার আমার গভীর ঘুম ভেঙ্গে উঠতেই হলো। বিস্ময়াত্নক এবং তীক্ষ্ণ দৃষ্টি পড়ল পরশের উপর। ঠোঁটের আলিজে ক্রুর হাসি ফুটিয়ে পরশ আমার ঘাঁড়ে মুখ ডোবানোর চেষ্টায় অটল হয়ে বললেন,,

“আজ কোনো বারণ শুনছি না আমি। কিছুক্ষনের জন্যে হলে ও আমায় আপন করে নিতে হবে! তোমার সঙ্গ এই মুহূর্তে আমার ভীষণভাবে প্রয়োজন।”

কি হলো জানি না! সাংঘাতিক রাগ চেঁপে বসল মাথায়! এক ঝটকায় পরশকে গাঁয়ের উপর থেকে সরিয়ে আমি বিছানার অপর প্রান্তে ছিটকে ফেললাম! নিজে ও হুড়মুড়িয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলাম! তাৎক্ষণিক ব্যগ্র দৃষ্টিতে দাঁতে দাঁত চেঁপে পরশকে শাসিয়ে বললাম,,

“দেখছেন না? শরীর খারাপ আমার? তবু ও কেন জোরাজোরি করছেন?”

পরশ তাজ্জব বনে গেলেন! নির্বাক নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে আমার রাগান্বিত আঁখিদ্বয়ে তাকিয়ে রইলেন। কিয়ৎক্ষণ একই দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রেখে তিনি হঠাৎ বিছানা ছেড়ে উঠে হনহনিয়ে ব্যালকনীর দিকে গতি নির্ধারন করলেন! কিছু মুহূর্ত পর ব্যালকনী থেকে সিগারেটের উগ্র গন্ধ বাতাসের সঙ্গে আমার নাকে ভেসে আসছিল! সঙ্গে সঙ্গেই নাক সিঁটকে এলো আমার। বুঝতে বেশি বেগ পেতে হলো না, লোকটি ধূমপান করছেন। কম রাগে, অভিমানে লোকটি নিশ্চয়ই পুরনো অভ্যেসটি আবার নতুনভাবে শুরু করেন নি! ভুল কিছু আমার ও ছিল। ঘুমন্ত মস্তিষ্ক একটু সচল হয়ে উঠতেই আমি উপলব্ধি করতে পারলাম, যা করেছি আমি সত্যিই ভুল করেছি! স্ত্রী হিসেবে স্বামীর ইচ্ছে, চাহিদা, আকাঙ্ক্ষা, মনমর্জি বুঝার উচিত ছিল আমার। মাঝখানে দীর্ঘ এক মাস তিনি আমায় ছাড়া থেকেছেন। অল্প সময়ের জন্যে ও কাছে পান নি। কুমিল্লা থেকে ফেরার পরে ও প্রায় এক সপ্তাহ লোকটির ধারে কাছে ঘেঁষি নি আমি। স্বাভাবিক ভাবেই আমার করা একটু আগের অস্বাভাবিক আচরনে পরশের কষ্ট পাওয়াটা বাঞ্ছনীয় ছিল!

হুড়মুড়িয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম আমি। নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য নিজেই নিজেকে বকতে আরম্ভ করলাম। ইচ্ছে করছে বাঁ হাত দিয়ে ডান গালে ট্রাস ট্রাস করে সজোরে দুটো চড় বসাতে। তবে যদি একটু শিক্ষে হয় আমার। ভারী অপদার্থ আমি। নিজের হাতে এমন দু’চার ঘাঁ না খেলে এই জীবনে শুধরাবার মেয়ে আমি নই! এসব আকাশ কুসুম ভাবতে ভাবতেই রাগান্বিত পরশের পাশাপাশি দাঁড়ালাম আমি। আমার অস্তিত্ব টের পাওয়া মাত্রই পরশ ব্যালকনীর গ্রীল থেকে হাতটি সরিয়ে সিগারেটটা দু ঠোঁটের মাঝখানে চেঁপে ধরে স্থান পরিত্যাগ করলেন! রাগে বিষধর সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করছেন তিনি। ভয়ে এবার অন্তর আত্তা কেঁপে উঠল আমার। না জানি আজ সত্যি সত্যিই আমার পিঠে দু’চার ঘাঁ পড়ে!

শুকনো ঢোক গলাধঃকরণ করে আমি মন্থর গতিতে হেঁটে চললাম পরশের পিছু পিছু। সিগারেট মুখে নিয়ে লোকটি পুরো রুম জুড়ে পায়চারী করছেন। নাক দ্বারা ফোঁস ফোঁস শব্দে রাগ নির্গত করছেন! আমি ও হন্ন হয়ে লোকটির পিছু পিছু পায়চারী করছি। এইভাবে প্রায় দু, তিন মিনিট কেটে যাওয়ার পর বিষয়টি পরশের চোখে পড়ল! পিছু ফিরে লোকটি অতি তীক্ষ্ণ এবং সূচালো দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন আমার দিকে। সঙ্গে সঙ্গেই আমি আতঙ্কে গলা ঝেঁড়ে কম্পিত দৃষ্টিতে লোকটির দিকে চেয়ে বললাম,,

“স্যরি!”

কপাল কুঁচকানোর পাশাপাশি লোকটি ভ্রু যুগল ও খড়তড় ভাবে কুঁচকে নিলেন! অতঃপর আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“কেন?”

মাথা নুইয়ে আমি কাতর গলায় বললাম,,

“একটু আগের করা নির্বোধ ব্যবহারের জন্য!”

তড়তড় করে যেন পরশের রাগটা আর ও গাঢ় গভীর হয়ে উঠল! হাতে থাকা সিগারেটটি তিনি মেঝেতে ছুড়ে ফেলে আমায় উপেক্ষা করে কাঁথা মুড়ি দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। বিষন্ন মনে আমি কিছুসময় পরশের বিদীর্ণ মুখমন্ডলে তাকিয়ে রইলাম। রুমের লাইট অফ করে বিছানায় নিজের স্থান দখল করে নিলাম। পরশের পাশ ফিরে শায়িত হতেই পরশ উল্টো পাশ ফিরে মাথা অবধি কাঁথা টেনে নিলেন! কিছুতেই যেন আমার মুখ দর্শন করবেন না তিনি! জনাবের ভীষণ গোশশা হয়েছে! এখনই যদি এই গোশশা ভাঙ্গানো না যায় তবে আগামী কয়েকদিনে ও বোধ হয় এই গোশশা ভাঙ্গানো যাবে না। ভালোবাসায় কাতর হয়ে আমি একটু একটু করে পরশের গাঁয়ের সাথে ঘেঁষে শুলাম। পরশ কোনো প্রতিক্রিয়াই করলেন না। মনে হলো যেন আমার অস্তিত্বই উনার আশেপাশে নেই! আর ও কিছুটা সাহস সঞ্চার করে আমি আরেকটু এগিয়ে পরশকে পেছন থেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরতেই পরশ ঝাঁঝালো গলায় বললেন,,

“ছাড়ো বলছি টয়া! সিরিয়াসলি বিরক্ত লাগছে আমার!”

“উঁহু! কোনো ছাড়াছাড়ি নেই। একটু ও বিরক্ত লাগছে না আপনার! আমার প্রতি রেগে আছেন বলেই আপনি ভালো লাগার অনুভূতি গুলোকে অস্বীকার করছেন। কি ভেবেছেন? আমি কিছু বুঝতে পারব না?”

“অনেক বুঝেছ আমায়! দয়া করে আর বুঝতে হবে না। ঘুমুতে দাও প্লিজ। যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রাখো আমার থেকে!”

পরশের এত রাগান্বিত অভিব্যক্তির বিপরীতে ও আমার তেমন ভাবান্তর হলো না! পরশকে আর ও জোরালো ভাবে ঝাপটে ধরে আমি অতি প্রেমমাখানো স্বরে বললাম,,

“কিছুতেই আজ আপনাকে ছাড়ছি না আমি! আমার এই প্রেমময়ী আবেদনে আপনাকে আজ সাড়া দিতেই হবে! পূর্ণ সিক্ত হতে চাই আপনার ভালোবাসায়। যতটা সিক্ত হলে আপনার প্রতি দিন দিন আমার আসক্তি বাড়বে! নেশার মত টানবে!”

এক হেচকা টানে আমি লোকটির মুখমন্ডল থেকে কাঁথাটি সরিয়ে নিলাম! অমনি পরশ টগবগে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন আমার দিকে। কিছুতেই যেন লোকটির মন গলছে না। রাগটা ও বিন্দু পরিমান হ্রাস হচ্ছে না। মুখ ফুলিয়ে আমি আহ্লাদী গলায় লোকটিকে শুধিয়ে বললাম,,

“বাচ্চার মায়ের উপর এত রাগ দেখালে চলবে? আপনার মেয়ে কিন্তু সব দেখছে! বাবাকে খারাপ মনে করছে। খারাপ বাবা হতে চান আপনি?”

দৃষ্টিতে মিশ্রিত তুখাড় রাগান্বিত ভাবটি যেন কিয়ৎক্ষণের মধ্যেই পরশের কোথাও উধাও হয়ে গেল! প্রবল মায়াসিক্ত দৃষ্টিতে লোকটি অবিশ্বাস্যভাবেই আমায় দুহাতে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলেন! ধীর গলায় আমার বাঁ কানে ওষ্ঠদ্বয় ঠেঁকিয়ে বললেন,,

“আমি খারাপ বাবা হতে চাই না বউ! আমি তো আমার মেয়ের খুব ভালো বাবা হতে চাই। আমার মেয়ের জন্য আমি সব রাগ বিসর্জন দিতে পারি। এমনকি তোমার হাজারটা ভুল ও মাফ করে দিতে পারি!”

মৃদ্যু হাসলাম আমি। লোকটির সমস্ত মুখমন্ডলে অসংখ্য চুমো খেয়ে মন্থর গতিতে লোকটির কানে লোমহর্ষক গুঞ্জন তুলে বললাম,,

“ভালোবাসি জনাব! প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই ভালোবাসি। যতটা ভালোবাসলে আল্লাহ্ র কাছে সন্তুষ্ট থাকা যায়, আমি আপনাকে ঠিক ততোটাই ভালোবাসি!”

আচম্বিতেই পরশ আমার বাঁ কানের লতিতে হালকা কামড় বসিয়ে বললেন,,

“তোমাকে তো আমি ভালোই বাসি না! তুমি হলে আমার সহজাত প্রবৃত্তি! আমার স্বভাবে মিশ্রিত এক অপরিমেয় সু-স্বভাব! আমার বুকের বাঁ পাশটায় বরাদ্দ করা অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ, তুমি আমার উষ্ণ রক্তের সঙ্গে মিশ্রিত এক টগবগে উত্তেজনা, তুমি আমার ললাটে উপর ওয়ালার বিধান অনুয়ায়ী অতি পূর্ব থেকেই রচিত এক জীবন্ত চরিত্র, তুমি আমার অদূর ভবিষ্যত! আমার ৬০ এর কোঠা পেরিয়ে যাওয়া বৃদ্ধ বয়সের সর্বশেষ সঙ্গ এবং সম্বল। মৃত্যের দাড়প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা আমার প্রাণবায়ুর শেষ দীর্ঘশ্বাস তুমি!”

নেত্রকোটরে অবাধ্য জলেরা চিকচিক করে উঠল। কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই নেত্র কোটর বেয়ে দু ফোটা অশ্রুকণা গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। জলের ভেজাটে অস্তিত্ব টের পাওয়া মাত্রই পরশ অস্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন আমার অশ্রসিক্ত চোখের পানে! উতলা, উদাসীন, উদগ্রীব চিত্তে লোকটি ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলেন আমার চোখের জল মুছে দিতে, যেনো তেনো প্রকারেই হউক আমার দুঃখ নিবারণ করতে। আনন্দ, আবেগে আমি এতটাই বিভোর হয়ে উঠেছিলাম যে, পরশকে ঝাপটে ধরে হেচকি তুলে কেঁদে উঠলাম। পরশ ও সমভাবে আমায় ঝাপটে ধরে ছোট ছোট চুম্বনে আমায় উত্তেজিত করে তুলছিলেন। লোকটি বুঝতে পেরেছিলেন এছাড়া আর অন্য কোনো উপায় নেই আমাকে শান্ত করার! লোকটির মিলনের আবেদন আমি নিজে ও নাকোচ করতে পারছিলাম না। তাই আমি ও লোকটির উত্তেজনায় সায় দিয়ে লোকটিকে আপন করে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

__________________________________________

প্রেগনেন্সির আট মাস আজ পূর্ণ হলো! ডক্টরের দেওয়া ডেইট অনুযায়ী আগামী পনেরো দিন পর আমার ডেলিভারী ডেইট। বিগত পনেরো দিন পূর্বেই আমি বাপের বাড়ি চলে এসেছি! এই নিয়ে পরশের সাথে নানান প্রকারভেদে আমার মনোমালিন্য! পরশ চায় নি আমাদের প্রথম “সন্তানদ্বয়” কুমিল্লায় হোক। পরশ চেয়েছিলেন তার উপস্থিতিতেই ঢাকায় আমার ডেলিভারি হোক। সম্পূর্ণ নিশ্চিত এবং নিরাপদ ভাবে পরশের পরিচিত প্রাইভেট হসপিটালে আমার সিজার সম্পন্ন হোক। সৌভাগ্য বশত টুইন বেবি আমার গর্ভে! আর এর জন্যই পরশের মাত্রাতিরিক্ত শঙ্কা এবং ভয়। ডক্টরের পরামর্শ অনুযায়ী সিজারিংয়ের মাধ্যমেই আমার সন্তান প্রসবে ঝুঁকি কম থাকবে। এই দিকে বিগত কয়েক মাস যাবত অফিসে পরশের অত্যধিক কাজের চাপ বেড়েই চলছে। যার দরুন পরশের পক্ষে সম্ভব নয় কুমিল্লায় এসে আমার সাথে থাকা বা ডেলিভারির কয়েক দিন পূর্ব থেকে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে আমার পাশে থাকা। ঢাকায় যদি আমার ডেলিভারি হতো তবে পরশের পক্ষে খুব সহজাধ্য ছিল। যেকোনো মুহূর্তে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে হসপিটালে ছুটে আসা বা ঐ সংকটাপন্ন মুহূর্তে আমার আশেপাশে থাকা। কিন্তু কুমিল্লা থাকার দরুন তো আমার লেবার পেইনের খবর পেয়ে আমার কাছে ছুটে আসতেই পরশের কমপক্ষে ৩ ঘন্টা সময় ব্যয় হয়ে যাবে!

রাতের খাবার খেয়ে বিছানায় গাঁ এলিয়েছি মাত্র। কুমিল্লা আসার পর থেকে নীলা এবং স্নিগ্ধা রাতে আমার পাশে ঘুমায়। রাত বিরাতে আমার ভালো, মন্দের খেয়াল রাখে। সাত মাসের পর থেকে এই উঁচু এবং ভারী পেট নিয়ে আমার চলাফেরা করতে ভীষণ অসুবিধে হয়ে দাঁড়াচ্ছে। দু কদম বাড়াতেই যেন হাঁফিয়ে উঠছি। পেটে ও সাংঘাতিক ভাবে চাপ লাগে তখন। ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না! রাতে এপাশ ওপাশ ফিরে ঘুমানো যায় না। সোজা হয়ে ঘুমানো ছাড়া সুপ্তি বিলাসের আর কোনো উপায় নেই। রাত প্রায় এগারোটা বেজে যাওয়ার পরে ও নীলা এবং স্নিগ্ধা আমার রুমে আসে নি। দুজনেরই ফাইনাল পরীক্ষা সামনে। হয়তো রাত জেগে পড়ছে। পরশের সাথে আজ দুই দিন যাবত কথা হয় না আমার! তবে আমার প্রতিদিনের সমস্ত আপডেট তিনি মায়ের কাছ থেকে অতি গুরুত্বের সাথে জেনে নেন। রাগের পাহাড় ভেঙ্গে কিছুতেই যেন আমার কাছে নতজানু হবেন না। আমি ও উনার চেয়ে কম যাই না। আসার পর থেকে গুনে গুনে মাত্র দুবার উনার সাথে টেলিফোনে কথা বলেছি। এর অধিক দু অক্ষর কথা বলার প্রয়োজনটি মনে করি নি! রাগ কি শুধু উনার ই আছে? আমার বুঝি রাগ করতে মানা আছে?

এসবের মাঝেই চার মাস পূর্বের কথা মনে পড়ে গেল! শৈবাল দ্বীপে যখন আমরা হানিমুনে গিয়েছিলাম। পাঁচ পাঁচ জোড়া নব দম্পতি আমরা হানিমুনে শৈবালদ্বীপ গিয়েছিলাম। খুব মজা হয়েছিল তখন! ট্রিপটি এতটাই আনন্দঘন এবং তৃপ্তিদায়ক ছিল যে আজীবন আমার এই ট্রিপটির কথা স্মৃতির পাতায় স্মরনীয় হয়ে থাকবে। কালচক্রে প্রতিটা মুহূর্তে মনে পড়বে। কত শত স্মৃতি, মুহূর্ত, হাস্যকর নানান ঘটনা জড়িয়ে আছে এই ট্রিপটিতে! পাঁচটে পুরুষ এবং পাঁচটে নারীর নব সংসারের হাসি খুশির কয়েক গুচ্ছ মুহূর্তে পরিপূর্ণ ভাবে রচিত হয়েছিল এই ট্রিপটি! সাংসারিক জীবনে সবাই এখন বেশ খুশি। পায়েল, পিয়ালী আপু, রুম্পা আপু, মিলি আপু সবাই তাদের সাংসারিক জীবনে নিজেদের ঠিকঠাক ভাবে মানিয়ে নিয়েছেন। এদের মধ্যে মিলি আপু দু মাসের অর্ন্তসত্তা। রুম্পা আপুর চলমান মাস সহ পাঁচ মাস চলছে। পিয়ালী আপু মাত্র কিছুদিন হলো কনসিভ করেছেন। পায়েলের এখন ও কনসিভ করা হয় নি! হিমেশ ভাই চাইছেন না পায়েল এত দ্রুত কনসিভ করুক। আর ও ৫/৬ মাস পর তিনি ভেবে দেখবেন। ঐ দিকে ফারিহা আপুর শ্বশুড় বাড়ি থেকে দুদিন হলো খবর এসেছে ফারিহা আপু কনসিভ করেছেন! অনেক ডাক্তারি টেকনিক এবং বিভিন্ন টোটকার মাধ্যমে ফারিহা আপু শেষ পর্যন্ত পেরেছেন বাচ্চা ধারন করতে!

মুহূর্তের মধ্যেই আমার ভাবনা চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটল! বালিশের তলা থেকে আমার ফোনটি বিকট শব্দে বেজে উঠল। কলিজাটা তাৎক্ষণিক মোচড় দিয়ে উঠল! মন যেন জাগান দিয়ে বলছিল পরশ কল করেছে! এর বাইরে তো এত রাতে কেউ আমায় কল করেন না। চট জলদি ফোনটা হাতে নিতেই স্ক্রীনে পরশের নাম্বারটি দেখতে পেলাম। খুশিতে মনটা কানায় কানায় ভরে উঠল। প্রফুল্লিত গলায় আমি তড়িঘড়ি করে কলটি তুলে বললাম,,

“পরশ?”

অপর প্রান্ত থেকে পরশ গুরুগম্ভীর গলায় বললেন,,

“কেন? এত রাতে কি অন্য কারো কলের অপেক্ষায় ছিলে?”

“এখন ও রেগে আছেন আমার উপর?”

“আমার মেয়েদের খবর নিতে আমি কল করেছি। নিজের রাগের কারন ব্যক্ত করতে কাউকে কল করি নি!”

“এভাবে কথা বলছেন কেন? এখন বুঝি আমার চেয়ে আপনারা মেয়েরা বেশি আপন হয়ে গেল?”

পরশ বোধ হয় ধূমপান করছেন। তাই তো কেমন যেন নাক দিয়ে শ্বাস নির্গত করছেন। পুনরায় তিনি সিগারেটে ফুঁক দিয়ে বললেন,,

“মেয়েদের মা বড্ড স্বার্থপর হয়ে গেছে! মেয়েদের বাবার কথা কিঞ্চিৎ পরিমান ও চিন্তা করে না। শুধু নিজের দিকটাই ভাবে। নিজের ইচ্ছে এবং চাওয়াটাকেই বেশি প্রাধান্য দেয়!”

“আমার মেয়েদের বাবাটা না? বড্ড অবুঝ! সোজা বিষয়টা সোজা ভাবে বুঝতেই চায় না। মেয়েদের প্রথম সন্তান সচরাচর তার বাবার বাড়ি থেকেই হয়। আর এটাই নিয়ম। আমার শ্বাশুড়ী মা ও কিন্তু এই কথাটিই আপনাকে বলেছিলেন। তাছাড়া আপনি ও কিন্তু আপনার নানা বাড়ি থেকেই হয়েছিলেন। আমার বড় আপু ও নানা বাড়িতে হয়েছিলেন। যুগ যুগ ধরে এই নিয়ম চলে আসছে৷ তাই আমাদের দুই পরিবারের সদস্যরা ও এই নিয়মটিকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। মাঝখান থেকে আপনি শুধু শুধু বিষয়টিকে অন্যভাবে দেখছেন!”

“আমি অতো শত বুঝি না! তোমাদের এই ফালতু নিয়মের জন্য যদি তোমার বা আমার বাচ্চাদের কোনো ক্ষতি হয় না? তাহলে কিন্তু আমি তোমাদের কাউকেই ছাড়ব না। তোমাদের তিনজনকেই আমি সুস্থ, সবল এবং নিরাপদে দেখতে চাই। আর হ্যাঁ? তোমার বদরাগী বাবাকে এক্ষনি, এই মুহূর্তে জানিয়ে দাও, ডেলিভারী ডেইটের ঠিক দুদিন পূর্বে যেন তোমাকে প্রাইভেট কোনো হসপিটালে ভর্তি করিয়ে দেন। আগে থেকেই প্রিপারেশন নিয়ে রাখা ভালো। কোনো শঙ্কা বা বিপদ যেন না ঘটে। যদি এর অন্যথায় হয় না? আমি কিন্তু দুনিয়া উল্টে ফেলব। তোমার বাবাকে ও তখন ছাড়ব না!”

মিটিমিটি হাসলাম আমি। তবে লোকটিকে প্রকাশ করলাম না। কতটা চিন্তিত তিনি আমাদের নিয়ে। তাই তো সেই কখন থেকে যা তা বকেই চলেছেন। শঙ্কা কাটাতে পূর্ব প্রস্তুতি নেওয়ার কথা ও বলছেন। চাঁপা হাসি থামিয়ে আমি লোকটির দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললাম,,

“খেয়েছেন আপনি?”

“তিনবেলা সিগারেট সেবন করেই পেট ভর্তি হয়ে যাচ্ছে! আলাদা করে খাবারের কি প্রয়োজন?”

“এইবার কিন্তু আমার ভীষণ রাগ হচ্ছে পরশ! আপনি মাত্রাতিরিক্ত করছেন। ধূমপান কি পেট ভরানোর জিনিস? এসব করে করে আপনি স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছেন। আপনার মেয়েদের খারাপ বাবা হয়ে উঠছেন!”

“মেয়েদের মা ই আমায় বাধ্য করছে খারাপ হতে! কিছুতেই যেন বুঝতে চাইবে না আমার মনের ব্যাথাটা! তাকে ছাড়া থাকতে আমার ঠিক কতটা কষ্ট হয়! কতটা অসহ্য যন্ত্রণা হয়! সে কখনই বুঝবে না! তাকে ছাড়া শূন্য লাগে আমার আশপাশটা। মনে হয় যেন ঘোর অমবস্যা লেগেছে আমার মনে! দম বন্ধ হয়ে আসে এই একা বদ্ধ ঘরে থাকতে। সে যে আমার অভ্যেস হয়ে গেছে! চোখ বুজার আগে ও পরে তাকে এক পলক না দেখলে আমার চোখে প্রশান্তি মিলে না। শান্তির ঘুম হয় না! সে কি আদৌতে বুঝবে না আমার মনের নিগূঢ় যন্ত্রণাটা?”

মনটা কেঁদে উঠল অজান্তেই। ফট করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে আমি অশ্রুবিলাসে মগ্ন হয়ে উঠলাম! এসব আবেগপ্রবণ কথা বলে লোকটি প্রতিবারই আমায় দুর্বল করে দেন! মৃত্যুর মুখে পড়ে ও মৃত্যুকে ভয় পেতে ইচ্ছে করে তখন! উপর ওয়ালা না করুক, যদি ডেলিভারির সময় আমার খারাপ কিছু একটা হয়ে যায় তখন পরশের কি হবে? লোকটি কি আদৌতে এই শোক সামলে উঠতে পারবেন? নাকি তিনি ও সেচ্ছায় জীবন দান করবেন?

লোচন জোড়ায় এক সাগর অশ্রু নিয়ে আমি ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। এর মধ্যেই নীলা এবং স্নিগ্ধা রুমে প্রবেশ করল। রুমের লাইট অফ করে দুজনই আমার পাশে শুয়ে পড়ল। তাদের দেখে মলিন হেসে আমি ও ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমের মধ্যেই হঠাৎ অনুভব করলাম আমার তল পেটটায় ভীষন পেইন হচ্ছে। নিচের অংশ ভিজে একাকার। অসহ্য ব্যাথায় গুঙ্গিয়ে উঠলাম আমি। ক্ষনিক বাদে বিছানার চাঁদর খামছে ধরে আত্নচিৎকার করে উঠলাম। সঙ্গে সঙ্গেই নীলা এবং স্নিগ্ধা ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠল। দুজনই সমস্বরে উদ্বিগ্ন গলায় আমায় ঝাঁকিয়ে বলল,,

“কি হয়েছে আপু? চিৎকার করছ কেন?”

আঁখি যুগল খিঁচে বন্ধ করে আমি তুখাড় আর্তনাদে সিক্ত হয়ে বললাম,

“লেবার পেইন উঠেছে আমার। প্লিজ তোরা মা আর চাচীমনিদের ডেকে দে।”

মরণ যন্ত্রণা হচ্ছিল আমার! নিচের অংশ ভিজতে ভিজতে পুরো বিছানা ছড়িয়ে পড়ছিল। জবজবে ঘামে অবসন্ন আমি। আশপাশটা চড়কির মতো ঘুড়ছিল। বিষন্ন ব্যাথায় নেত্র যুগল খোলার সামান্য সাহসটুকু যোগাতে পারছিলাম না। প্রাণ বায়ু যায় যায় করছিল! বুঝতে পারছিলাম মা হওয়া অতো সহজ নয়! পৃথিবীর সমস্ত দুঃসাধ্য কাজের মধ্যে এটি একটি! মৃত্যুর দাড়প্রান্ত থেকে ফিরে আসা পৃথিবীর সমস্ত মায়েদের সৌভাগ্য রচনা করছি। আদৌ নিজের ভাগ্যে সেই সৌভাগ্য জুটবে কিনা জানি না! তবে আমি নিজে ও এখন সেই সৌভাগ্য রচনা করতে আল্লাহ্ র কাছে দু’হাত তুলে দো’আ করছি!

পরশ বোধ হয় ঠিক এই আশঙ্কার কথাটিই আন্দাজ করেছিলেন! তাই তো তিনি বার বার সতর্ক থাকতে বলেছিলেন। আসন্ন বিপদে ঘাবড়ে উঠেছিলেন। কিন্তু হঠাৎয়ের মধ্যে যে এই দুর্বিষহ বিপদ ঘনিয়ে আসবে কে জানত? জানলে তো পূর্ব প্রস্তুতিই নেওয়াই থাকত! আন্দাজ করতে পারলাম মা এবং চাচীমনিরা রুমে প্রবেশ করেছেন। আশেপাশে তাদের হাঁক ডাক শুনতে পারছি। দরজার বাইরে থেকে বাবার উত্তেজিত গলার স্বর কর্নপাত হচ্ছে। বাবা বোধ হয় ফোনের মাধ্যমে হসপিটালে যোগাযোগ করছেন। এর মধ্যেই মেঝো চাচীর কন্ঠস্বর কানে এলো। তিনি শুকনো গলায় বলছেন,,

“রাত প্রায় ৩ টে বাজতে চলল। এই মাঝরাতে আশেপাশের কোনো হসপিটাল খোলা থাকবে তো ভাবী?”

মা আমার মাথায় অনবরত হাত বুলিয়ে কান্নারত গলায় বললেন,,

“কিছু জানি না আমি। কিছু না। যেকোনো মূল্যেই হোক আমি আমার মেয়ে এবং নাতনিদের সুস্থ অবস্থায় দেখতে চাই। ফারিহার বাবা যেভাবেই পারুক আমার মেয়েকে হসপিটালে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করুক! আদর্শ বাবা হওয়ার পরিচয় দিক।”

শরীর নিংড়ে উঠছিল আমার! সারা শরীর অবশ হয়ে আসছিল। হাত-পা ছেড়ে আমি দিশাহীন হয়ে চেতনা শক্তি হারানোর ঠিক এক মুহূর্ত পূর্বে মা কে ডেকে আকুতি ভরা গলায় বলে গেলাম,,

“পরশকে খবরটা জানিয়ে দাও মা৷ নতুবা পরশ দুনিয়া উল্টে ফেলবেন!”

দিন-দুনিয়ার আর কোনো খবর নেই আমার। চেতনা শক্তি হারিয়ে আলাদা এক জগতে বিনা দ্বিধায় আরোহণ করলাম। নিকষ কালো অন্ধকারে ঢাকা সেই জগত! ঘুটঘুটে অন্ধকার। মাত্রাতিরিক্ত অন্ধকার। আমি একাই অবস্থান করছি সেই অন্ধকার জগতে! পরশকে হাতড়াচ্ছি! কিন্তু কোথাও তিনি নেই, কোথাও তিনি নেই!

,
,

চেতনা শক্তি ফিরতেই মনে হলো খুব সাংঘাতিক এক শ্রুতি সুন্দর স্বপ্নে নিমজ্জিত আমি! চোখ খোলা অবস্থায় কেউ স্বপ্ন দেখে নাকি? কিন্তু আমার তো সবকিছু স্বপ্নের মতোই মনে হচ্ছে! দু পরিবারের প্রতিটি সদস্য আমায় ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন! সবার ঠোঁটের কোণে এক প্রশান্তির হাসি। সব’চে আশ্চর্যের বিষয় হলো পরশ আমার ঠিক বাঁ পাশটায় বসে আমার সদ্য জন্ম নেওয়া বাচ্চা দুটোকে ভেজা চোখে আদরে আদরে ভরিয়ে দিচ্ছেন। আমার দিকে যেন কোনো ধ্যানই নেই এই লোকটির। মেয়েদের পেয়ে একদম ভুলে গেছেন আমায়। সৃষ্টিকর্তার কাছে আর ও এক দফা শুকরিয়া! তিনি আমাকে ও সৌভাগ্য রচনা করার সুযোগ করে দিয়েছেন।

তীব্র ব্যাথার রেশ মাখা অশ্রুসিক্ত আঁখিযুগলে আমি মেয়ে দুটোর দিকে তাকালাম। দুজনই কেমন তীক্ষ্ণ ভাবে নাক, মুখ কুঁচকে রেখেছে। কাঁদবে কাঁদবে এমন ভাব। বাবার অতি আদরে তারা অতিষ্ঠ প্রায়! মেয়ে দুটি কি আমার মত হলো? খাড়া নাক, ভাসা ভাসা চোখ! এর মধ্যেই শ্বাশুড়ী মা হাসি মাখা মুখে আমার দিকে চেয়ে বললেন,,

“নাতনীদের খাইয়ে দাও এবার। দেখছ না? পেটের ক্ষুধায় কেমন নাক, মুখ কুঁচকে রেখেছে আমার দাদুমনিরা!”

পরশের অস্থির দৃষ্টি এবার আমার দিকে পড়ল। লোক লজ্জা ভুলে সঙ্গে সঙ্গেই লোকটি আমায় ঝাপটে ধরলেন। তাৎক্ষণিক মাথা নুইয়ে নিলাম আমি! পরিবারের সবাই এই আকস্মিক লজ্জা এড়াতে এক এক করে রুম থেকে প্রস্থান নিলেন। যাওয়ার পূর্বে বাবা ক্রুর হেসে পেছন থেকে পরশকে ব্যগ্র গলায় বললেন,,

“মেয়েদের বাবা হয়েছ তো এবার? আমি ও দেখে নিব, মেয়েদের কিভাবে মানুষ করো তুমি! মেয়েরা উচ্ছন্নে গেলে বাবাদের মনে ঠিক কতটা আঘাত হয় এবার বুঝবে তুমি! আমার মেয়েকে তুমি পালিয়ে নিয়ে বিয়ে করেছিলে না? এবার আমি ও দেখব, তোমার মেয়েরা ঠিক কাকে, কিভাবে বিয়ে করে!”

এক ঝটকায় আমায় ছেড়ে পরশ অট্ট হেসে বাবার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“আপনি কি আমায় বদ’দোআ দিচ্ছেন শ্বশুড় আব্বা?”

“তাই ধরে নাও। মেয়েদের সঠিক ভাবে গড়ে তোলা যে কত কঠিন এবার বুঝবে!”

পরশ থামকালেন। ভাবুক গলায় বললেন,,

“আপনার মনোবাঞ্ছা বুঝে তো মনে হচ্ছে…! আপনিই উসকে দিবেন আমার মেয়েদের পালিয়ে যেতে! যেন আপনি আমায় এবার অন্তত একটু ভালো ভাবে জব্দ করতে পারেন!”

“প্রয়োজন হলে ঠিক তাই করব! যে কোনো মূল্যেই হোক, তোমায় জব্দ করা চাই ই চাই!”

রাগে গজগজ করে বাবা প্রস্থান নিলেন। পরশ নির্বোধ ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলেন বাবার যাওয়ার পথে। ফিক করে হেসে আমি লোকটির কাঁধে মাথা রেখে বললাম,,

“ছাড়ুন তো বাবার কথা! বাবা আপনার সাথে রসিকতা করেছেন!”

পরশ বেশ চিন্তিত গলায় বললেন,,

“তোমার বাবার সাথে এক ফোঁটা ও বিশ্বাস নেই। এখন থেকেই আমার সতর্ক থাকতে হবে! আর শুনো? আমার মেয়েদের নিয়ে বেশি বাপের বাড়ি বেড়ানো যাবে না। সুযোগ পেলেই তোমার বাবা আমার মেয়েদের মাথা নষ্ট করে দিবেন, ছলা কলা করে উসকে দিবেন আমার মেয়েদেরকে! বলা যায় না, হয়তো আমার মেয়েদের বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে তোমার বাবাই সাহায্য করবেন! যদি তিনি ফন্দি করে আমার মতই কোনো ধড়িবাজ জামাইয়ের হাতে আমার মেয়েদের তুলে দেন? তখন? তখন কি হবে? ধড়িবাজ জামাই থেকে তখন আমি জাদরেল শ্বশুড় হয়ে উঠব? এমা না না! কিছুতেই এটা হতে দেওয়া যাবে না!”

খিলখিলিয়ে হেসে উঠলাম আমি। পরশ ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লেন। তেজী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন আমার দিকে। অতি যত্নে মেয়েদের মুখে স্তন জোড়া তুলে দিয়ে আমি ক্রুর হেসে পরশকে শুধিয়ে বললাম,,

“নিজের বেলায় ষোল আনা, আর পরের বেলায় এক আনা? না?”

পরশ উচ্চ শব্দে হেসে উঠলেন। সুঠাম বাহুডোরে একই সঙ্গে আমায় এবং মেয়েদের ঝাপটে ধরে সুদৃঢ় গলায় বললেন,,

“তোমাদের বেলায় আমি আজীবনই ষোল আনা! তোমাদের ঘিরেই আমার জীবন সংসার ষোল আনায় পরিপূর্ণ হলো!”

#সমাপ্ত

(হাহ্! অবশেষে সমাপ্তি ঘটল এই গল্পটির। জানি না গল্পটি পাঠক/পাঠিকাদের মন ছুঁতে কতটা সক্ষম হয়েছ! তবে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি গল্পটিকে আমার কুঁড়ে অনুভূতি দ্বারা সাজিয়ে গুছিয়ে তুলতে! যদি ও অনেক আঘাত পেতে হয়েছে গল্পটি চলাকালীন সময়। আমার অপারদর্শীতার জন্যই হয়তো অনেক কটুক্তির মুখোমুখি হতে হয়েছিল আমার! যাই হোক, যা আমার প্রাপ্য তা আমি ভোগ করেছি। এতকিছুর পরে ও যদি গল্পটি পাঠকদের স্বল্প পরিমানে হলে ও মন ছুঁয়ে থাকে তবে অনুরোধ রইল গল্পটি সম্পর্কে আপনার দু, লাইন অভিব্যক্তি প্রকাশ করবেন। ভালো থাকবেন সবাই, সুস্থ থাকবেন। ভালোবাসা রইল।)
#চলবে…?
#চলবে…?
#চলবে…?

(

2 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here