তোমায় পাবো বলে পর্ব -২৯

#তোমায়_পাবো_বলে
#পর্ব_২৯
#নিশাত_জাহান_নিশি

“হিমেশ পায়েলকে ভালোবাসে। বিস্তারিত বিষয়টা আমি গতকাল রাতেই জেনেছিলাম। তাই আমার মনে হয় না, সব জেনে শুনে হিমেশকে পিয়ালীর সাথে জড়ানোটা ঠিক হবে!”

মা-বাবা ক্ষনিকের মধ্যেই তাজ্জব বনে গেলেন। তাদের অবিশ্বাস্য দৃষ্টি এখন পরশ এবং হিমেশ ভাইয়ার মুখ পানে সীমাবদ্ধ। হিমেশ ভাই মন্থরতা, জড়তা, নিষ্ক্রিয়তা সমেত মাথা নুঁইয়ে বসে আছেন। মুখ দ্বারা রা টি কাটার সাহস ও বোধ হয় কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। পরিস্থিতি এতটাই প্রতিকূলে। পরশ কিয়ৎক্ষন পর পর আমার অস্থির দৃষ্টিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করছেন। মানুষটা নিজে ও সমভাবে অস্থিরভাবাপন্ন। মা-বাবার বিরূপ প্রতিক্রিয়াতে উপস্থিত আমরা তিন ব্যক্তিই ভীষণ চিন্তিত! আনুমানিক কয়েক মুহূর্ত পর বাবা গুরুগম্ভীর গলায় হিমেশ ভাইকে শুধিয়ে বললেন,,

“পরশ এইসব কি বলছে হিমেশ? তুমি সত্যিই পায়েলকে পছন্দ কর?”

পরিস্থিতির চাপে পড়ে হিমেশ ভাই এবার মাথা উঁচিয়ে তুলতে বাধ্য হলেন। পারিপার্শ্বিক দিকে কোনো রূপ কালক্ষেপণ না করে গলা খাঁকিয়ে প্রত্যত্তুরে বললেন,,

“আমি জানি আঙ্কেল, পায়েল বয়সে আমার চেয়ে অনেক ছোট। ৭ বছরের পার্থক্য তো হবেই! আমি জানি, এই বয়সের ক্ষেত্রেই আপনাদের যত জোর আপত্তি। বিস্তর একটা পার্থক্য থাকা সত্ত্বে ও এইটা সত্যি… আমি পায়েলকে ভালোবাসি! আর পায়েল ও আমায় ঠিক অতোটাই ভালোবাসে। এবার সিদ্ধান্ত আপনাদের! আপনারা আদৌতে কি চান? মেয়ের সুখী, সুন্দর, গোছানো, ভালোবাসায় মোড়ানো একটা দাম্পত্য জীবন নাকি আপনাদের ঠিক করা জোরের উপর প্রতিষ্ঠিত ভালোবাসার বিপরীতে থাকা মিথ্যে একটা ফেলনার সংসার?”

বাবা তব্দিত। সংকুচিত দৃষ্টি হিমেশ ভাইয়ার দিকে আবদ্ধ। পরশ আমার দিকে চেয়ে ম্লান হাসলেন। বিনিময়ে আমি ও মৃদ্যু হাসলাম। হিমেশ ভাইয়ার অভিব্যক্তিতে আমরা উভয়ই ভীষন খুশি। কারন, উনার কথায় অযৌক্তিক কোনো উপস্থাপন ছিল না। মা এই পর্যায়ে এসে মুখ খুলতে বাধ্য হলেন। হিমেশ ভাইয়ার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“পিয়ালীর কি হবে? আমরা তো পিয়ালীর জন্য তোমাকে বেছে নিয়েছিলাম!”

হিমেশ ভাই ভাবনা চিন্তা উচ্ছন্নে দিয়ে মন্থর গলায় বললেন,,

“আমার একজন পরিচিত ফ্রেন্ড আছে আন্টি। পরশ ও বোধ হয় চিনতে পারে। একবার পরিচয় হয়েছিল দুজনের। ছেলে সরকারী সিভিল ইন্জিনিয়ার। মান্থলি মোটামুটি ভালো অংকের স্যালারী পায়। ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড ও ভীষন ভালো। তারা এক ভাই, এক বোন। বোন বড়। বিয়ে হয়ে গেছে অলরেডি। মাঝে মাঝে বেড়াতে আসে। একচুয়েলি “রায়হানের” পরিবার প্রায় অনেক দিন যাবত রায়হানের জন্য পাত্রী খুঁজছিলেন। আপনাদের যদি মত থাকে আমি রায়হানের পরিবারের সাথে কথা বলে দেখতে পারি। আই থিংক আপনাদের ও রায়হানকে খুব পছন্দ হবে। পিয়ালীর সাথে একদম পার্ফেক্ট ম্যাচ। হাইট, ওয়েটে অল্প বিস্তর পরশের মতো দেখতে। তবে গায়ের রংটা সামান্য শ্যামলা। শ্যামলা হলে ও চেহারায় ভীষন মায়া কাজ করে!”

পরশ অনতিবিলম্বে বিরামহীন গলায় হিমেশ ভাইকে বললেন,,

“আমার কোনো আপত্তি নেই। রায়হানের বিষয়টা আমার মাথা থেকেই বের হয়ে গিয়েছিল। অভার অল ছেলেটা সত্যিই প্রশংসনীয়। যেহেতু ছেলেকে আমার পছন্দ হয়েই গেছে। আই হোপ সো, মা-বাবার ও কোনো আপত্তি নেই সেখানে। তুই রায়হানের পরিবারের সাথে কথা বলে দেখ। পারলে কাল বা পরশুর মধ্যে বল, পিয়ালীকে এসে দেখে যেতে। পিয়ালীকে তাদের পছন্দ হলেই তবে ঐ দিনই বিয়ের পাকা কথা হয়ে যাবে!”

ইতোমধ্যেই পেছন থেকে পিয়ালীর অট্ট হাসি আমাদের কর্নপাত হলো। উৎকন্ঠিত দৃষ্টিতে সবাই পিছু ফিরে তাকাতেই আপু কদাচিৎ হেসে বললেন,,

“তোমরা পার ও বটে! খেলনা পেয়েছ আমাকে তাই না? যে যেভাবে ইচ্ছে খেলবে, খেলা শেষ তো ছুঁড়ে ফেলে দিবে? এতটাই ফেলনার সামগ্রী আমি? আমার নিজস্ব কোনো অনুভূতি নেই না? নিজস্ব কোনো মতামত ও নেই? নিজেকে সামলানোর সামান্য সময়টুকু কি তোমরা আমায় দিবে না? এতোই তাঁড়া তোমাদের? আমাকে এই বাড়ি থেকে বের করার এতই তাঁড়া? সবেমাত্র বিয়েটা ভাঙ্গল আমার। একটু সময় তো লাগবে নাকি নিজেকে সামলানোর? আর তোমরা এইখানে কি করছ হুম? উঠে পড়ে লেগেছ আমাকে এই বাড়ি থেকে তাঁড়াতে? আমি হয়তো প্রথম অবস্থায় ছেলেটার সাথে মানিয়ে নিব। আস্তে ধীরে তাকে পুনরায় ভালো ও বেসে ফেলব! এরপর কি হবে? ছেলে ভালো না হলে আবার ও আমার মন ভাঙ্গবে! একটু সময় তো প্রয়োজন ছেলেটাকে ভালোভাবে চিনার। তার পরিবার সম্পর্কে সঠিক ধারনা নেওয়ার। হুটহাট করেই তো সবকিছু হয়ে যায় না। আল্লাহ্ র ওয়াস্তে আমায় তোমরা অল্প কিছু দিন সময় দাও প্লিজ। অন্তত এক, দুটো মাস। যেনো আমি নিজেকে কিঞ্চিৎ সামলে উঠতে পারি। এই খারাপ পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে পারি। প্লিজ তোমরা জোর করে আমার উপর কোনো সিদ্ধান্ত চাঁপিয়ে দিও না!”

কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন আপু। আমি দ্রুত পায়ে হেঁটে আপুকে দুহাতে আগলে দাঁড়ালাম। মা বাবার দিকে করুন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম,,

“আপু কিছু ভুল বললেন নি মা-বাবা। আসলেই আমাদের উচিত আপুকে কিছু দিন সময় দেওয়া। এইভাবে জোরপূর্বক কারো উপর আমাদের এক তরফা সিদ্ধান্ত চাঁপিয়ে দেওয়া ঠিক না। অন্তত এক মাস সময় তো আপুকে নির্দ্বিধায় দেওয়া উচিত। এই খারাপ পরিস্থিতি থেকে নিজেকে উত্তরনের জন্য!”

ঘাঁড় ঘুড়িয়ে পরশ আহত গলায় হিমেশ ভাইকে বললেন,,

“পারবি এক মাস ম্যানেজ করতে? মানে রায়হানের পরিবারকে বলতে পারবি অন্তত এক, দুই মাসের জন্য মেয়ে খোঁজা বন্ধ রাখতে?”

হিমেশ ভাই পরশের কাঁধে হাত রেখে বললেন,,

“এইটা কোনো ব্যাপারই না। শুধু পারব না, মানিয়েই ছাড়ব। রায়হানের পরিবারের সাথে আমার খুব ভালো সম্পর্ক। বুঝা পড়া এ খুব ভালো। আমি যা বলব ঠিক তাই হবে!”

মা এবং বাবা উভয়ই স্বস্তির শ্বাস নির্গত করলেন। পরশ বসা থেকে উঠে আপুকে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে আপুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,,

“নিয়ে নে সময়। এই এক, দুই মাসে নিজেকে যতটা পারিস সামলে নে, মানিয়ে নে। বিয়ের জন্য তোকে আর জোর করা হবে না। তোর মতামতের উপরই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”

বিমূর্ষ পিয়ালী আপু কান্নাসিক্ত মুখে ও হাসির রেখা ফুটিয়ে বললেন,,

“থ্যাংকস ভাইয়া। অন্তত একটু হলে ও আমাকে বুঝার জন্য!”

এর মধ্যেই বাবা গলা খাঁকারি দিয়ে তৎপর গলায় হিমেশ ভাইকে বললেন,,

“হিমেশ? তুমি ও বিয়ের প্রস্তুতি নিয়ে নাও! ভালোয় ভালোয় যদি কয়েক মাসের মধ্যে পিয়ালীর বিয়েটা হয়ে যায়। তাহলে এর কিছু মাসের মাথাই পায়েলের সাথে তোমার বিয়ের ডেইট ফিক্সড করা হবে। অবশ্যই যদি তোমার পরিবার রাজি হয় তো!”

হিমেশ ভাই মাথা নুঁইয়ে লজ্জা মিশ্রিত হাসি টেনে বললেন,,

“পরিবারে এই সম্বন্ধ নিয়ে কোনো আপত্তি নেই আঙ্কেল। বাবা-মা জানেন পায়েলকে আমার পছন্দ! গতকাল রাতেই পরিবারকে আমি এই বিষয়ে অবগত করেছি।”

উপস্থিত সবার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠল৷ বিশেষ করে মা ভীষন খুশি। পালাক্রমে বাবা, পরশ, আপু এবং আমি!
,

,

বেগহীন সময়ের গতি ছুটে চলল নিমিষেই। এক মাস পূর্ণ হলো আমার সংসার জীবনের! মা এখন ও পূর্বের ন্যায় খ্যাঁচ খ্যাঁচ করেন আমার কর্মকান্ডে। এর নির্দিষ্ট বহু কারন ও আছে বটে। সব বিষয়েই আমার খামখেয়ালীপনা! একটা কাজ আমার দ্বারা সঠিক ভাবে সম্পাদন হয় না! কখন ও তরকারিতে লবন অতি মাত্রায় পড়ে যায়, তো কখন ও হলুদ দিতেই ভুলে যাই! আবার কখন ও মরিচের মাত্রা এতই বেশি হয় যে, মুখে খাবার তোলাই যায় না! চোখে জল এবং মুখে কাশির উদ্ভব ঘটে! আশ্চর্যের বিষয় হলো আমি যেভাবেই রান্না করি না কেনো, পরশ কখন ও ত্রুটি খুঁজতে আসেন নি। ঠিক মুখ বুজে সব অখাদ্য গিলে নেন! প্রতিদিন রাতে ঘুমুনোর সময় সব অখাদ্য নিয়ে নানান প্রশংসায় মেতে উঠেন। বিপরীত দিকে মা খুব রাগারাগি করেন! মাঝে মাঝে দুঃখ নিবারন করতে না পেরে ফ্যাস ফ্যাস করে কান্না জুড়ে দেই। পরক্ষনে মা স্বয়ং আমার মন ভালো করার জন্য বাজার থেকে নানান পদের আঁচার, তেঁতুল নিয়ে আসেন। তেঁতুলের লোভে আমার সব রাগ যেন গলে ঘি হয়ে যায়। মা তখন আমার কার্যকলাপ দেখে অগোচরে মিটিমিটি হাসেন। যদি ও প্রকাশ্যে কখন ও হাসেন নি!

অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষা ঘনিয়ে আসতেই মা পায়েলকে নিয়ে ভার্সিটিতে গেলেন ফর্মফিলাপ করাতে। পায়েল দুদিন ধরেই ভীষন অসুস্থ। শোয়া থেকে উঠতে পারছে না পর্যন্ত৷ অফিসের কাজের চাপে পরশের সময় হয়ে উঠে নি পায়েলকে নিয়ে ভার্সিটিতে যাওয়ার। ঐদিকে পিয়ালী আপুর ও ফোর্থ ইয়ার টেস্ট পরীক্ষা ঘনিয়ে এসেছে। তাই আপু পড়ালেখার চাপে ভীষন ব্যস্ত৷ সবদিক বিবেচনা করে মা ই পরে বাধ্য হলেন পায়েলকে নিয়ে ভার্সিটিতে যেতে। হিমেশ ভাই যদি ও যেতে চেয়েছিলেন পায়েলের সাথে। তবে মা বারন করে দিয়েছেন! বলেছেন, বিয়ের আগে দেখা, সাক্ষাৎ বা মেলামেশা থেকে নিজেদের দূরে রাখতে।

সারা বাড়িতে আমি আজ একা। পিয়ালী আপু ১০ টা বাজতেই প্রাইভেটের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলেন। গ্যাসে ভাত বসিয়ে আমি পুরো ড্রইং রুম জুড়ে পায়চারী করছি। কপালের ভাঁজে বিরক্তির রেখা ফুটে উঠতেই মনে হলো আম্মুর সাথে একটু কথা বলি! প্রায় ১৫ দিন হলো আম্মুর সাথে প্রতিদিন আমার নিয়ম করে প্রায় একবার হলে ও ফোনে কথা হয়! বাবা অবশ্যি এই বিষয়ে কিছু জানেন না! বাড়ির বাকিরা কিছুটা জানলে ও মিলি আপু এখন ও এই বিষয়ে কিছু জানেন না! জানতে পারলে হয়তো আব্বুর কানে কথাটা পৌঁছে দিতে আপুর দু সেকেন্ড ও ভাবান্তর হবে না। আপু এখন ও ভীষন রেগে আছেন আমার উপর। সুযোগ পেলেই নাকি আমার বিরুদ্ধে আব্বুর কান ভাঙ্গান। আর এই বিষয়টা যদি আব্বু কোনো ভাবে জানতে পারেন তাহলে আম্মুর সাথে খুব রাগারাগি করবেন হয়তো মারধর ও কররেন। বিশ্বাস নেই কিন্তু! ঠোঁটের কোনে মৃদ্যু হাসির রেখা ফুটিয়ে আমি বাড়ির টেলিফোন থেকে আম্মুর নাম্বারে ডায়াল করতেই আম্মু হাসিমুখে কলটা রিসিভ করে বললেন,,

“পিয়াস গেছে তোদের বাড়িতে?”

বিস্মিত গলায় আমি বললাম,,

“কই? না তো!”

“এখন ও পৌঁছায় নি?”

“কেনো আম্মু? ভাইয়ার বুঝি আসার কথা ছিল?”

“হুম। পিয়াস একটা কাজে ঢাকা যাচ্ছিল। তাই আমি ভাবলাম তোর শ্বশুড় বাড়ির জন্য কিছু শপিং করে দেই! সবার জন্য কিছু না কিছু পাঠিয়েছি। জানি না, তোর শ্বাশুড়ীর এসব পছন্দ হবে কিনা! আর শুন? তোর পছন্দের পুলি পিঠা, নারকেলের সন্দেশ, আঁচার, তেঁতুল ও পাঠিয়েছি। সময়, সুযোগের অভাবে এতদিন পাঠাতে পারছিলাম না। পিয়াসকে পেয়ে ভরসা পেলাম। ভালো করে দেখে, শুনে নিস সব। বুঝেছিস?”

ফট করেই আম্মু কলটা কেটে দিলেন। প্রত্যত্তুর করার সুযোগটা দিলেন না পর্যন্ত! ভ্রু যুগল খড়তড়ভাবে কুঁচকে আমি দ্বিতীয় বার আম্মুর নাম্বার ডায়াল করতেই অন্তরআত্তা কেঁপে উঠল আমার। ফোনের ওপার থেকে আব্বু বাজখাই গলায় বললেন,,

“তুমি? কল করেছ কেন? কি দরকার তোমার আমাদের সাথে? তোমার সাথে তো আমাদের সব সম্পর্ক চুঁকে গেছে! তোমার হাজবেন্ড তো ঐদিন জোর গলায় বলেছিল, আমার মতো নিষ্ঠুর,জালিয়াত বাবার কোনো প্রয়োজন নেই। এখন কেন আমাদের প্রয়োজন পড়ছে তোমার? হাজবেন্ড তোমাকে আগলে রাখতে পারছে না? তোমার শ্বশুড়, শ্বাশুড়ী তোমার মা-বাবার অভাব পূরণ করতে পারছে না?”

ফুঁফিয়ে কেঁদে আমি করুন গলায় আব্বুকে বললাম,,

“যা হয়েছে ভুলে যাও না আব্বু। আমার হাজবেন্ডের ব্যবহারে আমি খুব সত্যিই খুব অনুতপ্ত এবং লজ্জিত। বাবা হয়ে মেয়ের একটা ভুল ক্ষমা করতে পারছ না তুমি? খুব মিস করি তোমাকে আব্বু। পুরো পরিবারকে খুব মিস করি। আর একটা বার সুযোগ দাও না আমায়। প্লিজ আর একটা বার সুযোগ দাও!”

“শাট আপ। ফোন রাখ তুমি৷ দ্বিতীয় বার যেন এই নাম্বারে কোনো ফোন, কলস না আসে। আমি তোমাকে মেয়ে হিসেবে স্বীকার করি না। স্বামী, সংসার নিয়েই বাকি জীবন পাড় করতে হবে তোমার।”

কলটা কেটে দিলেন আব্বু। কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম আমি। এই মুহূর্তে আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। জানি না, বাবা আদৌ কখন ও আমাদের মেনে নিবেন কিনা, আমাদের সম্পর্কটাকে মেনে নিবেন কিনা! এত নিষ্ঠুর কেন বাবা? মেয়ের একটা ভুল মাফ করতে পারছেন না? বাবার কাছে কি তবে আমার সুখের চেয়ে মান সম্মান বেশি বড়?

ইতোমধ্যেই দরজায় কলিং বেল বেজে উঠল। বুঝতে আর বেগ হলো না পিয়াস ভাই এসেছেন। তড়িঘড়ি করে আমি দ্রুত পা ফেলে সদর দরজাটা খুলে দিতেই আমার ভেজাক্ত দৃষ্টিতে পরশের অস্তিত্ব মিলল! মলিন মুখমন্ডলে আচম্বিতে উদ্বিগ্নতার ছাপ ফুটিয়ে পরশ আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“কি হলো? কাঁদছ কেন তুমি?”

প্রত্যত্তুর না করেই আমি মুহূর্তের মধ্যে পরশকে ঝাপটে ধরে হেচকি তুলে কেঁদে বললাম,

“আমি বাড়ি যাব পরশ!”

পরশ আমার মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে চিন্তিত গলায় বললেন,,

“হয়েছেটা কি? হঠাৎ বাড়ি যাওয়ার কথা বলছ কেন?”

“আপনার জন্যই তো সব হয়েছে! বাড়ি ছাড়তে হয়েছে আমার! শুধুমাত্র আপনার জন্য!”

আপনার অবান্ত কথায় পরশ কোনো রকম কালক্ষেপণ না করে উল্টে উদ্বিগ্ন গলায় বললেন,,

“ঐ বাড়িতে সবাই ঠিক আছে তো টয়া? মানে মা-বাবা সুস্থ আছেন?”

“সবাই সুস্থ আছে। শুধু আমিই অসুস্থ!”

পরশ স্বস্তির শ্বাস নির্গত করে নমনীয় গলায় বললেন,,

“আচ্ছা চল! আজ আমরা একটু বাহির থেকে ঘুড়ে আসি। তোমার অসুস্থতা কেটে যাবে!”

“কোথাও যাব না আমি। আমি শুধু বাড়ি যেতে চাই!”

“একবার বাড়ি গেলে তো, ফিরে আসার সব পথ বন্ধ হয়ে যাবে টয়া! তোমার বাবা তোমাকে আটকে রাখবেন! পারবে তখন আমায় ছাড়া থাকতে?”

লোকটাকে ছেড়ে কাঁদতে কাঁদতে আমি ড্রইং রুমে প্রবেশ করলাম। সোফার উপর মাথা নুঁইয়ে বসতেই লোকটা দ্রুত পায়ে হেঁটে আমার পাশে বসে আমার দিকে খানিক ঝুঁকে এসে বললেন,,

“ওকে ফাইন। তবে আজ আমরা কুমিল্লায়ই যাচ্ছি? যাবে তুমি?”

বিস্মিত হলাম আমি। মাথা তুলে পরশের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই পরশ ম্লান হেসে বললেন,,

“তোমার থার্ড ইয়ারের ফর্ম ফিলাপ ঘনিয়ে এসেছে। ফাইনাল এক্সামটা তো দিতে হবে নাকি? তাই আজ আমরা তোমার ভার্সিটিতে যাব। ফর্ম ফিলাপ সম্পর্কিত বিস্তারিত সব তথ্য জেনে আসব। পরীক্ষার প্রিপারেশনের ও একটা ব্যাপার আছে। নোটস, বুকস কালেক্ট করতে হবে না?”

আমি বিস্মিত গলায় বললাম,,

“মা? মা রাজি হবেন তো?”

“মা ই তো পারমিশান দিয়েছেন, ভার্সিটি যেতে! মা ভীষন আগ্রহী তোমার পড়া লেখার বিষয়ে। পিয়াস ও বলল, তোমার যাবতীয় সব ফাইল পত্র নিয়ে তোমার ভার্সিটিতে ওয়েট করবে।”

“কিন্তু পিয়াস ভাই তো ঢাকায় আসছেন!”

“ঢাকার কাজটা নাকি ওর কোনো কারনে ক্যান্সেল হয়ে গেছে। মা শখ করে আমাদের জন্য নাকি অনেক কিছুই পাঠাতে চেয়েছিলেন পিয়াসের হাত দিয়ে। তো আমি ভাবলাম আমরা নিজেরাই যেহেতু কুমিল্লায় যাচ্ছি, তো আসার সময় না হয় আমরাই অসব নিয়ে আসব!”

“যাবেন তো ঐ বাড়িতে? আপনি চাইলেই কিন্তু আব্বুকে মানাতে পারেন! কারন আব্বু আপনার উপরই বেশি ক্ষেপে আছেন!”

“আমি ও কিন্তু তোমার আব্বুর উপর কম ক্ষেপে নেই! উনি অনেকবার আমাকে এবং আমার পরিবারকে নানান ভাবে অপমান করেছেন। এবার ও যে অপমানিত হয়ে ফিরে আসতে হবে না, তার ও কিন্তু কোনো গ্যারান্টি নেই!”

“তার মানে আপনি যাবেন না তাই তো?”

পরশ নিশ্চুপ। গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে বসলেন। পুনরায় ফুঁফিয়ে কেঁদে আমি এক আকাশ অভিমান নিয়ে লোকটার পাশ থেকে উঠে দাঁড়াতেই লোকটা আমার ডান হাতটা টেনে ধরে আমাকে উনার বুকের পাজরে স্থান দিলেন। শান্ত গলায় শক্ত হাতে আমায় ঝাপটে ধরে বললেন,,

“যাব! তবে এবার ও কিন্তু অপমানিত হয়ে ফিরে আসতে পারব না। সম্মানবোধ আমার ও আছে। আমার পরিবারের ও যথেষ্ট সম্মান আছে। তোমার আব্বুর সেটা বুঝা উচিত! এক তরফা শুধু নিজের দিকটাই ভাবলে তো হবে না তাই না?”

খুশিতে আপ্লুত হয়ে আমি লোকটার মুখমন্ডলে অজস্র চুমু খেয়ে বললাম,,

“এবার আপনাকে আর অপমানিত হতে হবে না পরশ৷ আমি কিছুতেই আপনার অপমান সহ্য করব না। বাবাকে এবার আমাদের সম্পর্কটা মেনে নিতেই হবে। বাবা যেমন এক রোঁখা, বাবার মেয়ে হিসেবে আমি ও কিন্তু তেমন এক রোঁখা।”

পরশ আহ্লাদী হয়ে আমার গাল দু খানা টেনে ধরে বললেন,,

“তবে আর একটা উপায় আছে! তোমার বাবার রাগ ভাঙ্গানোর!”

আমি নির্লিপ্ত গলায় প্রশ্ন ছুড়ে বললাম,,

“কি উপায়?”

পরশ ঠোঁটের কোণে ক্রুর হাসি ফুটিয়ে বললেন,,

“তোমার বাবা খুব শীঘ্রই নানা হতে পারলেই বোধ হয় রাগটা কিঞ্চিৎ হ্রাসমান হবে!”

“তাহলে তো আমি অতি শীঘ্রই মা হতে চাই!”

স্ব-ইচ্ছায় পরশের ঠোঁট জোড়া আঁকড়ে ধরলাম আমি। পরশ উত্তেজিত হয়ে আমায় আষ্টেপৃষ্টে আঁকড়ে ধরতেই সদর দরজায় কলিং বেল বেজে উঠল। অনতিবিলম্বে পরশ আমায় ছেড়ে বিরক্তি ভরা গলায় বললেন,,

“ধ্যাত! এই সময়ে আবার কে এসে বেগড়া দিল?”

আমি মিটিমিটি হেসে নিজেকে লোকটার থেকে ছাড়িয়ে সদর দরজার দিকে অগ্রসর হয়ে বললাম,,

“বোধ হয় মা এসেছেন!”

#চলবে….?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here