তোলপাড়
ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-৩
___________
কার্তিক কর্মকারের বাসা থেকে খুব সতর্কতার সাথে বের হতে লাগলো অরূণী।একদিকে ভয়ে বুক ধড়ফড় করছে,অন্যদিকে রুদ্রর ফোন নম্বর পেয়ে অরূণীর নিস্তব্ধ হৃদয় উপকূলে চুপিসারে আনন্দের বেজায় ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এখন যদি সঞ্জিতা কর্মকারের সামনে পড়ে?সঞ্জিতা কর্মকারের সে ভয়ংকর ক্রোধাদ্দীপ্ত চেহেরা অরূণীর কল্পনায় তীব্র ত্রাসের সৃষ্টি করে। হৃৎস্পন্দন অতিমাত্রায় বেড়ে যায়। অবশেষে গেট পেরিয়ে বের হলো অরূণী। এতক্ষণ ভয়ে রুদ্ধ হয়ে থাকা নিঃশ্বাস’কে জোরে জোরে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার মাধ্যমে মুক্তি দেয়। দারোয়ান দাঁত কেলিয়ে অরূণীর দিকে তাকিয়ে বলল, “সঞ্জিতা বৌদি তাড়া করছে নাকি? হাঁপান ক্যা?”
অরূণী চোখ-মুখ কুঁচকে তাকায় দারোয়ানের দিকে।মেকি রাগ দেখিয়ে বলে, “সঞ্জিতা কর্মকার আমায় তাড়িয়ে দিবে?কার্তিক কর্মকার ইন্ডিয়ায় থাকাকালীন আমার পাশের বাসায় জেঠা ছিলো।”
অরূণী রুদ্রের ফোন নম্বর পাওয়ার উত্তেজনায় দারোয়ানের সাথে তর্ক করার আগ্রহ পেলো না। কিছুদূর গিয়ে ব্যাগ থেকে ফোন’টা বের করে রুদ্রের নম্বরে ডায়েল করল। অরূণীর হাত যেন ঈষৎ কাঁপছে। রুদ্র ফোন ধরলে কি বলবে? অরূণীর অস্থিরতা কাজ করতে লাগলো। প্রবল অধীরতা নিয়ে ওপাশ থেকে ফোন রিসিভড হওয়ার অপেক্ষায় প্রহর গুনতে লাগলো। কয়েক সেকেন্ড পর মেয়েলি এক গলা ভেসে ওঠে, “দুঃখিত! কাঙ্ক্ষিত নম্বর’টি এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।”
রাগে অরূণীর চোখ বুঁজে আসছে। ইচ্ছে করছে ফোন’টা ছুঁড়ে ফেলে দিতে। রাগ সংবরণ করে। হয়ত রুদ্রর ফোনে চার্জ নেই।আবার কিছুক্ষণ পর ফোন দেয় তাও সুইচ অফ। ক্ষোভে অরূণীর মাথা ধরে যাচ্ছে, নিজের উপর ক্ষোভ হচ্ছে। এই ঘটনায় কারো ওপর ক্ষোভ দেখানো যায় না। যখন কারো ওপর ক্ষোভ দেখানো না যায় তখন মানুষ আত্মক্ষোভে ফেটে পড়ে।
চার-পাঁচ দিনে টানা কয়েক’শ বার ফোন দিয়েছে। শেষমেষ বুঝতে পারলো রুদ্রর রুমমেট কিরণ বন্ধ ফোন নম্বর দিয়েছে। কিরণের প্রতি অরূণীর ক্ষিপ্ততা বাড়তে থাকে। অরূণীর শরীরের প্রতিটি শিরা উপশিরা রাগে দপদপ করছে। ঠিক করে আবার যাবে কার্তিক কর্মকারের বাসায়।
________
শুক্রবার! সাহেদ আহমেদ জুম্মার নামাজ পড়ে এসে অরূণী’কে ডাকে। শামীমা তখন টেবিলে খাবার বাড়ছিলো। সাহেদ আহমেদের বাসার কাজের মেয়ে শামীমা। সাহেদ আহমেদ আরো কয়েক বার ডাকলো অরূণীর নাম ধরে। শামীমা সাহেদ আহমেদের দিকে তাকিয়ে বলল, “কাকা অরূণী ঘুমায়।”
– “এই অবেলায় ঘুমায়? সেলিনা কোথায়?”
– “অবেলায় ঘুমায় না। সকালের ঘুম এহনো ভাঙে নাই। কাকি গোসল করে মনে হয়।”
সাহেদ আহমেদ ভ্রু কুঁচকে শামীমার দিকে তাকিয়ে অবাক গলায় বলল, “অরূণী এখনো ঘুমায়?”
সাহেদ আহমেদ সোফা ছেড়ে ওঠে অরূণীর রুমের দিকে যায় দ্রুত পায়ে। রুমের দিকে যেতে যেতে রাগে গিড়গিড় করে বলতে লাগল, “কলেজের দুই বছর চোখের পলকেই শেষ হয়ে যায়। ফার্স্ট ইয়ার তো চলেই গেছে। সেকেন্ড ইয়ার যেতে দুই মাসও লাগবে না। সাইন্স নিতে বলেছে কে ও’কে? অল সাবজেক্টে ফেল করবে। আমি বুয়েট থেকে ট্রিপল ই নিয়ে পাস করেছি। আর আমার মেয়ে এইচএসসি’তে অল সাবজেক্টে ফেল করবে!”
এসব ভাবতে ভাবতে সাহেদ আহমেদের রাগ আরো গাঢ় হয়। অরূণীর রুমের দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা দিয়ে ডাকতে লাগল, “অরূণী,অরূণী।”
সাহেদ আহমেদের চেঁচামেচি শুনে সেলিনা আহমেদ দ্রুত গোসল সেরে বের হয়। ভেজা চুলে তোয়ালে পেঁচাতে পেঁচাতে ছুটে আসে অরূণীর দরজার দিকে। আতঙ্কিত স্বরে সাহেদ আহমেদের দিকে তাকিয়ে বলল, “কি হয়েছে?এমন ভাবে চিৎকার করছেন মনে হয় খুন-খারাবি হয়ে গেছে।”
সাহেদ আহমেদ ধমকে ওঠে, “মেয়ে এত বেলা পর্যন্ত ঘুমায় সেদিকে খেয়াল আছে তোমার? এমনিতেই হচ্ছে মাথা ভরা গোবর তার উপর লেখাপড়ায় ভুজুর গুজুর। ছাদে সবজি চাষ না করে তোমার মেয়ের মাথায় চাষ করো।মাথায় খাঁটি গোবর সার,কোন ভেজাল নাই। ফসলাদি ভালো হবে।”
– “আপনার মাথায় গোবর কি কম? বাপ কা বেটি।”
সাহেদ আহমেদ যেন বিস্ময়ের চূড়ায় পৌঁছে গেল।রাগের চোটে মুখ থেকে ইংরেজি বেরিয়ে এলো, “শ্যাট আপ সেলিনা! হ্যাভ ইউ এ্যানি আইডিয়া এবাউট মি? আই ওয়াজ এ্যা বুয়েটিয়ান।”
রেগে গেলে সাহেদ আহমেদের মুখ থেকে অনার্গল ইংলিশ বের হবে। ন্যাশনাল থেকে ইতিহাসে অনার্স করা সেলিনা আহমেদের পক্ষে সেগুলো বোঝা অসম্ভব বটে। সাহেদ আহমেদের রাগ কমে আসলে ফের বলে, “যাও,যাও অরূণী’কে ঘুম থেকে তুলে পড়তে বসাও।”
সাহেদ আহমেদ হাতের কব্জি’তে দেওয়া ঘড়ির দিকে তাকিয়ে পুনরায় বলল, “আমার বেরুতে হবে।”
সেলিনা আহমেদের কাছ থেকে উত্তর আসে “খেয়ে যাবেন না?”
সাহেদ আহমেদ না বোধক ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে চলে যায়।
সাহেদ আহমেদের সাথে বিয়ে হওয়ার পর মহা বিপাকে পড়েছিল সেলিনা আহমেদ। বাসর রাতে ইংরেজি’তে কি একটা জিজ্ঞেস করল সেলিনা আহমেদ হাঁ করে তাকিয়ে রইল। বড়লোক বাবার একমাত্র সুন্দরী মেয়ে হওয়ার সুবাদে বিয়ে’টা হয়ে গিয়েছিল সাহেদ আহমেদের সাথে। নিত্য উঠতে বসতে ইংরেজি আর ফিজিক্স, রসায়নের যুক্তি দিয়ে সেলিনা আহমেদ’কে বোকা বনে পাঠাতো। একদিন সেলিনা আহমেদ লজ্জা-সরমের মাথা খেয়ে বলল, “আমি ইংরেজি বুঝিনা। সব সময় ইংরেজি টেনেটুনে পাশ করতাম।তাও অন্যের খাতা দেখে লিখে।আর আমি আর্টসের স্টুডেন্ট। ফিজিক্স,রসায়ন ওসব কিভাবে বুঝবো?”
সেলিনা আহমেদের কথা’টা শোনার সাথে সাথে সাহেদ আহমেদ যেন বজ্রাহত হলো। তীব্র হতাশা তাকে ঘিরে ধরলো। সাহেদ আহমেদের বউ ইংরেজি বুঝে না? সাহেদ আহমেদের যেন লজ্জা রাখার জায়গা নেই।
ঘুম থেকে ওঠে গোসল সেরে পড়তে বসলো অরূণী। রুদ্রর বন্ধ ফোন নম্বরে অকারণে ডায়েল করল। ক্ষীণ আশা অরূণীর মনের পর্ণকুটিরে, এবার বোধ হয় ফোন’টা রিসিভ হবে। বরাবরের মত হতাশ হলো। কিছুক্ষণ বইয়ের দিকে উন্মনা হয়ে তাকিয়ে থাকার পরই অরূণীর ফোনে রিং বাজে। অরূণী স্ক্রিনের দিকে ফোন রিসিভ করে হাই তুলতে তুলতে বলে, “হ্যালো রাকা! কি খবর বল?”
ওপাশ থেকে খুব জরুরি গলায় বলল, “অরূণী রেস্টুরেন্টে। যাবি? তাইতি, নীড়াও যাবে।নীড়া খাওয়াবে।”
অরূণী বিস্মিত হয়ে বলল, “যাবো না মানে?এখুনি আসছি।”
অরূণী হুমুড়িয়ে রুম থেকে বের হয়। সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলেই সেলিনা আহমেদের কঠিন দৃষ্টি পড়ে অরূণীর দিকে। অরূণী অপ্রস্তুত ভাবে হেসে খুব ব্যস্ত গলায় বলল, “আম্মা আমি একটা কাজে বের হচ্ছি। তুমি যদি সূর্য দাদার কাছে বলো খারাপ হবে।”
সেলিনা আহমেদ কর্কশ গলায় বলল, “বলবো না মানে? আমি এখুনি ফোন দিচ্ছি। তুই গেট পর্যন্ত যেতেই দেখবি সূর্য দাঁড়ানো। তুই লেখবি না, পড়বি না আর তোর শিক্ষিত বাপ আমায় কথা শুনাবে প্রতিদিন।”
অরূণীর খুব গুরুতর গলায় বলল, “আম্মা আমার ফ্রেন্ড সৃষ্টির আম্মু অসুস্থ ভীষণ।রক্ত লাগবে। আমি সেখানে যাচ্ছি।”
অরূণীর এত তাড়াহুড়ো ভাব দেখে সেলিনা আহমেদ কিছু বলার জোঁ পেলো না। শুধু বলল, “তোর সৃষ্টি নামে নতুন ফ্রেন্ড জন্মালো কবে?”
সেলিনা আহমেদের কথা বোধ হয় অরূণীর কান পর্যন্ত গেল না। আরূণী ততক্ষণে বাসার গেট পেরিয়েছে।তাইতি,রাকা, নীড়া দাঁড়িয়ে আছে অরূণীর অপেক্ষায়। ওঁদের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অরূণী গিয়ে হাজির হলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, “হঠাৎ রেস্টুরেন্টে যাওয়ার জন্য জরুরি তলব?”
রাকা হেসে নীড়ার দিকে তাকিয়ে অরূণীর প্রশ্নের উত্তরে বলল, “রাকিব্বার ব্রেক আপ হয়েছে।”
অরূণী ভাবুক গলায় বলল, “রাকিব! রাকিব! রাকিব যেন কে?নীড়ার সেই এক্স বয়ফ্রেন্ড?”
হাসির উচ্চ ধ্বনি আকাশ-বাতাস মাতায়। নীড়া হাসি থামিয়ে তীব্র ক্ষোভ নিয়ে বলে, “আমি এমন অভিশাপ দিয়েছি। একদম জায়গা মত লেগেছে।প্রেম পনেরো দিনও টিকে নি।”
তাইতি বলল, “এখন থেকে আমরাও অভিশাপ দিবো। তোর এক্সের প্রেম প্রতি সপ্তাহে সাত বার ভাঙুক। আর আমরা রেস্টুরেন্টে খাবো।”
কথা বলতে বলতে রেস্টুরেন্টের দিকে যায়। বাইরের রোদ’টা ছিলো একটু তীব্রই ছিলো। রেস্টুরেন্টের ভেতরের ছায়া’টা আরামের স্পর্শ বুলিয়ে দিলো যেন। অরূণী চেয়ার টেনে বসে ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেল। বলল, “এই ওয়াইফাই নাই? এইচডি মুভি ডাউনলোড দেওয়া শুরু কর সবাই।”
তাইতি অরূণীর দিকে তাকিয়ে আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলল, “তোর বাসায় ওয়াইফাই নাই রে অরূ? সারাক্ষণ মাথায় কুবুদ্ধি নিয়ে থাকিস।”
– “আজব!আমার বাসায় আছে বলে সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবো?”
ওয়েটার মেন্যু কার্ড দিয়ে যায়। রেস্টুরেন্টে মৃদু তালে হিন্দি গান বাজছে। খাবার আসতে একটু দেরি হবে ওয়েটার কোল্ড ড্রিংকস দিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর খাবার দিয়ে গেল। অরূণী বার্গারে কামড় দেয়। হঠাৎ চোখ যায় সামনের টেবিলে। মিনিট দুয়েক আগে রেস্টুরেন্টে ঢুকে এক ছেলে মেন্যু কার্ড দেখে খাবারের অর্ডার দিচ্ছে। বার্গারের মাংস অরূণীর গলায় বিঁধে। রাকা পানি এগিয়ে দেয়। কাশতে কাশতে অরূণীর চোখে পানি এসে পড়ে। উত্তেজনায় বুঁজে আসা গলায় তাইতির হাত খামচে ধরে বলে, “রুদ্র..রুদ্র।”
ওঁরা সবাই আশেপাশে ব্যগ্র চোখে তাকিয়ে বলল, “কোথায় রুদ্র?তোর সেই আল্লু আর্জুন?”
অরূণী কারো কথার জবাব না বিস্ময়ে হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকে। শুধু তাইতি চিনে রুদ্র’কে। তাইতি দেখে ওঁদের সামনের টেবিলে বসে আছে রুদ্র। তাইতির দৃষ্টি কিছুক্ষণের জন্য আটকে যায়। রুদ্রর চেহেরায় সুষমা আছে বটে! রাকা, নীড়া’কে ইশারায় দেখিয়ে বলে, “ওই যে রুদ্র। যার জন্য অরূণী বৈরাগী সেজেছে।”
রাকা সাবধানী হয়ে বলে, “আস্তে বল। শুনবে তো উনি। উনায় নিয়ে আলোচনা করি বুঝতে পারলে ভাব বেড়ে যাবে।”
আকস্মাৎ ভাবে অরূণী চেয়ার ছেড়ে উঠে রুদ্রর পাশে গিয়ে বসে। ওঁরা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকে।অরূণী ইশারায় ওঁদের চুপ থাকতে বলে। হঠাৎ পাশের চেয়ারে কাউকে এভাবে বসতে দেখে রুদ্র তাকায়। অরূণী যেন খুন হয়ে গেল রুদ্রর চাহনি’তে। এতদিন খোঁজ করে হঠাৎ এভাবে দেখা! অরূণীর বিশ্বাস হচ্ছে না, স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। বুকের ভিতর হৃৎযন্ত্র’টা স্প্রিংয়ের বলের ন্যায় লাফাচ্ছে। মুহূর্তেই নিজেকে সংযত করে অরূণী। কিছুই বুঝতে দেওয়া যাবে না রুদ্র’কে। অরূণী রুদ্রর দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলল, “আমি চারু।”
এভাবে আগ বাড়িয়ে মেয়েরা সাধারণত পরিচয় দেয় না। স্বাভাবিক নিয়মের ব্যতিক্রম হওয়ার রুদ্র অবাক হলো। জিজ্ঞেস করল, “আপনি চারু। তো আমি কি করতে পারি?”
এমন কাঠখোট্টা জবাবের বিপরীতে কি বলে কথা এগুবে অরূণী বুঝতে পারলো না। ক্ষণকালেই গলার স্বর পরিবর্তন করে খুব অসহায় ভাবে বলল, “আপনায় দেখে খুব ভালো মনে হয়েছে। তাই আপনার কাছে একটা হেল্প চাইতে এসেছি।”
রুদ্রর থেকে খুব গুরুগম্ভীর গলায় উত্তর আসলো, “কি হেল্প?”
অরূণী বুঝতে পারলো চাটুকতায় রুদ্র’কে প্রভাবিত করা যাবে না। অরূণী হাল ছাড়ল না।বলল, “রেস্টুরেন্টে আসছি এখন টাকা দেখছি না ব্যাগে।”
এইটুকু বলে থেমে অরূণী খুব সংশয় ভরা গলায় বলল, “আপনি যদি টাকা ধার দিতেন উপকার হতো।”
রুদ্র ভ্রু কুঁচকে তাকায়।অরূণী ফের বলে, “আমার ফোন নম্বর, বাসার ঠিকানা, বাবা-মায়ের নাম সব লিখে দিয়ে যাবো। আপনার টাকা মেরে খাবো না।”
রুদ্রর মুখের অভিব্যক্তি দেখে বুঝা যাচ্ছে না ঠিক টাকা দিবে কি না? রুদ্র খুব সংক্ষেপে জবাব দিলো, “এই হেল্প আমি করতে পারবো না।আসতে পারেন।”
অরূণীর গলায় অনুনয়-বিনয়, “ভাইয়া প্লীজ না করবেন না। আমি তো বলেছি আপনায় ঠিকানা, ফোন নম্বর সব দিবো। রেস্টুরেন্টেওয়ালারা আমায় বেঁধে রাখবে ,অপমান করবে।”
কথা’টা বলে অরূণী গভীর মনোযোগে তাকায় রুদ্রের দিকে। চোখে রুদ্র’কে দেখার পিপাসা। অরূণীর কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না ও রুদ্রর সাথে কথা বলছে। নিজের শরীরে নিজে গোপনে চিমটি কেটে দেখল স্বপ্ন নাকি বাস্তব? রুদ্রর কাছ থেকে কিছুক্ষণ উত্তরের অপেক্ষায় থেকে বলল, “কি ভাইয়া করবেন না হেল্প?”
রুদ্র সোজাসাপ্টা জবাব দেয়, “না।”
রুদ্রের আচরণ দেখে অরূণী মনে মনে নিরাশ হচ্ছে। এই হৃদয়াবেগহীন মানুষের প্রেমে পড়ে বসে আছে। কথায় ভিতর সামান্য আন্তরিকতা নেই। অরূণী আবার বলল, “ভাইয়া প্লীজ উপকার’টা করেন না।”
– “আরে কি আজব মেয়ে! বলেছি তো করতে পারবো না উপকার।”
রুদ্রর সামান্য ধমকে দমে যাবার পাত্রী নয় অরূণী। প্রায় আধা ঘন্টা পর রুদ্র টাকা দিতে রাজি হয়। বলল, “বাসার ঠিকানা দিন। ফোন নম্বর, বাবা-মায়ের নাম, স্কুল কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে পড়েন প্রতিষ্ঠানের নাম লিখে দিন।”
– “আমার নাম চারু। মায়ের নাম পারু। বোনের নাম কারু। বাবা নেই। বাসায় সবাই আমায় সাথি ডাকে। বাসায় গেলে সাথি নামে খোঁজ করবেন।”
এইটুকু বলে বাসার এড্রেস, যে স্কুল দিয়ে এসএসসি পাস করেছে সে স্কুলের নাম আর ফোন নম্বর লিখে দিলো অরূণী। রুদ্র অবাক আর বিরক্তি মিশ্রিত গলায় বলল, “আপনার বাসায় গিয়ে খোঁজ করব মানে?”
এই বলে অরূণীর দেওয়া কাগজের দিকে তাকিয়ে ফের কপাল কুঁচকে বলল, “স্কুলে পড়ো তুমি সবে মাত্র?”
স্কুলের নাম লেখা দেখে আপনি থেকে তুমি বলে ফেলল রুদ্র। অরূণী বলল, “হ্যাঁ স্কুলে পড়ি। বয়স হয়নি তেমন লম্বা হয়ে গেছি শুধু। আর বাসার ঠিকানা যেহেতু নিয়েছেন তাই ডাক নাম’টা বলে দিলাম প্রসঙ্গক্রমে।”
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে অরূণীর হাসতে হাসতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার অবস্থা হলো। ওঁরা সবাই তাকিয়ে রয়েছে অরূণীর দিকে। তাইতি আগ্রহী গলায় জিজ্ঞেস করল, “কিরে হাসছিস কেন?কি করেছিস উনার সাথে?”
– “এতদিন আমি উনায় খুঁজেছি এখন উনি আমায় খুঁজবে।”
সব শোনার পর ওঁরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল অরূণীর দিকে। রাকা বিস্ময় ভরা গলায় বলল, “কার ঠিকানা দিয়েছিস?”
– “কার আবার? আমজাদ স্যারের ঠিকানা দিয়েছে। আমজাদ স্যারের প্রাক্তনের নাম সাথি। আমার খোঁজ না পেয়ে একবার আমজাদ স্যারের বাসায় গিয়ে সাথি’কে খোঁজ করুক এমন দৌড়ানি দিবে।”
হাসির বেগে কথা বলতে পারছে না অরূণী। তাইতি বলল, “তুই প্রথম দেখাতেই এমন কাণ্ড করলি! এই ছেলে তোর সাথে প্রেম করবে?”
– “ বীজ গনিতে দেখিস নি মাইনাসে মাইনাসে প্লাস হয়?তেমনি বিদ্বেষে-বিদ্বেষে প্রেম হয়।”
অরূণী একটু থেমে আবার বলল, “আমি স্কুলের নাম লিখে দিয়েছি, স্কুলে গিয়ে খোঁজ করে আমায় পাবে না। বাসায় গিয়ে দৌড়ানি খাবে। কিন্তু ফোন নম্বর সঠিকই দিয়েছি। সাথে সাথে যদি উনি ফোন দিয়ে ট্রাই করত? এক বার শুধু ফোন দিক, উনার ফোন নম্বর’টা রেখে আমার এই সিম’টা অফ করে রাখবো। উনার রুমমেট যে ফোন নম্বর’টা দিয়েছে সেটা অফ। এখন এই পদ্ধতিতে ফোন নম্বরও পেয়ে যাবো।”
অরূণীর কণ্ঠে উচ্ছ্বাস। চোখে-মুখে আমোদ। তাইতি উৎকণ্ঠিত হয়ে বলল, “তাই বলে তুই আমজাদ স্যারের ঠিকানা দিবি? স্যারের বাসায় গিয়ে সাথি’কে খোঁজ করলে উনার হাত-পা ভেঙে দিবে।”
– “দিক ভেঙে।আমি হসপিটালে গিয়ে সেবা করব।”
– “তুই কি উনার টাকা সত্যি ফেরত দিবি না?”
– “দিবো দিবো।তবে এত তাড়াতাড়ি নয়।”
(চলবে)