তোলপাড় পর্ব ৪৪

তোলপাড়
ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-৪৪.
কিরণের ফোন নম্বরটা থাকলেও হয়ত রুদ্রর খোঁজ নিতে পারতো। রুদ্র কানাডা যাওয়ার পর কিরণের সাথে মাত্র একবার দেখা হয়েছিলো। নানান অভিমানে সেদিন রুদ্র কিংবা কিরণ কারো ফোন নম্বর-ই নেয় নি অরূণী। পরক্ষণে আবার অভিমানে অরূণীর মন ছেয়ে যায়। কি দরকার এত উতলা হওয়ার? সকল সিদ্ধান্ত ভেঙেচুরে ভালোবাসার টানে যে মানুষটা একবার ফোন দেয় নি,সে মানুষটার জন্য কেন উতলা হবে?চোখের কোণে জমে থাকা জলটুকু সন্তপর্ণে মুছে অরূণী।
আচ্ছা এমন যদি হয় রুদ্র জড়িয়ে গেছে অন্য কারো মায়ায়?অরূণী আর কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছে না। রুদ্রর খোঁজ নেওয়ার কোনো রকম চেষ্টা করবে না‌। এবার খোঁজ রুদ্র নিক। যদি না নেয় খোঁজ তাহলে হয়ত ভালোবাসা, অপেক্ষা সবই মিছে ছিলো। যেদিন অরূণীর সামনে বসে কিরণ রুদ্রর সাথে কথা বলেছিলো সেদিন রুদ্র বলেছিলো অরূণী কেন টিউশনি করে?তার মানে রুদ্র অরূণীর খোঁজ রাখছে। অরূণী একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সব ভাবনা চিন্তা বাদ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। ঝুম বৃষ্টি। অরূণী শামীমা কে ডেকে বলল, “শামীমা আপা খিচুড়ি রান্না করো।”
অরূণী বারান্দায় যায়।হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির ফোঁটা ধরার চেষ্টা করে। ঘণ্টা খানেক অকারণেই দাঁড়িয়ে ছিলো বারান্দায়। বৃষ্টি এখনো থামে নি। মিলা অরূণীর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ডাকলো অরূণীকে। অরূণীর এখন কথা বলতে ভালো লাগছে না। দায়সারা ভাবে প্রত্যুত্তর করলো, “হ্যাঁ, ভাবী বলো।”
– “খিচুড়ি খাবে না তুমি? ডাকছে তোমায় সূর্য।”
– “আসছি।তুমি যাও।”
অরূণীর কিছুক্ষণ পর যায়। বাসার সবাই একসাথে বেশ উৎফুল্ল ভঙ্গিতে খাচ্ছে। ঝুম বৃষ্টিতে খিচুড়ি! কেমন আমেজ আমেজ ভাব। এত মানুষের ভিতরও অরূণীর একা লাগছে। কিছু একটার অভাব, শূণ্যতা, হাহাকার।

ভার্সিটিতে যায় অরূণী। চোখে-মুখে উদাসীনতা। কোনো কিছুতে মন বসছে না। তাইতি কে ফোন দিয়ে বলল, “ভালো লাগছে না। চল,ঘুরতে যাই কোথায়ও।”
সারাদিন তাইতি আর রাকার সাথে ঘোরাঘুরি করে কাটে।তাইতি হঠাৎ মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “রুদ্র ভাই কানাডা গেছে দুই বছর তো পেরিয়ে গেলো তাই না?”
অরূণী চকিত হয়ে তাকায়, “হ্যাঁ দুই বছর হয়েছে।”
– “তো? ফিরে নি? তোর সাথে এখনো যোগাযোগ হয় নি?”
অরূণীর চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে যায়।হাসার চেষ্টা করে, “না ফিরে নি। হয় না যোগাযোগ।”
অরূণী ব্যস্ত গলায় বলল, “বাদ দে ওসব টিউশনিতে যাবো।আমার যেতে হবে।”

সন্ধ্যায় পর অরূণী বাসায় ফিরে।ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হতে না হতেই সাহেদ আহমেদ ডাকলো ভারী গলায়। আবার কী হলো? অরূণীর ক্লান্ত লাগছে। একবার ভাবলো যাবে না,না যাওয়া পর্যন্ত ডাকতেই থাকবে। অরূণী যায় সাহেদ আহমেদের কাছে।
– “বসো এখানে।”
হঠাৎ এমন আচরণের কারণ কী? অরূণী ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে তাকালো। রুদ্রর সাথে সম্পর্কের কথা জানার পর এমন আচরণ করেছিলো। আজ আবার কী হলো? এসব ভাবতে ভাবতে বসে অরূণী। সাহেদ আহমেদ চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলো, “রুদ্রর সাথে তোমার এখনো সম্পর্ক আছে? যা জিজ্ঞেস করছি সোজাসাপ্টা উত্তর দিবে। মিথ্যা বলার চেষ্টা করো না।”
অরূণী হতবিহ্বল হয়ে তাকালো। হঠাৎ এসব কেন জিজ্ঞেস করছে সাহেদ আহমেদ? কী হয়েছে? অরূণীর নির্বাক হয়ে রইল মিনিট দুয়েক। সাহেদ আহমেদ আবার বলল, “কী হলো অরূণী?”
অরূণী বিস্ময় আর শঙ্কিত ভাব কাটিয়ে কোনো মতে বলল, “আব্বা কী হয়েছে? হঠাৎ এসব কেন..।”
– “হঠাৎ এসব কেন,বুঝতে পারছো না তুমি?”
সেলিনা আহমেদ এসে সাহেদ আহমেদের পাশে বসে। অরূণী এক বার সেদিকে তাকালো। অরূণী থেমে থেমে বলল, “না-না। কি বুঝবো?”
অরূণী নির্বোধের মত তাকিয়ে রইল।ভিতরটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মুখাবয়ব স্বাভাবিক রাখার যথাসম্ভব চেষ্টা করছে। হঠাৎ রুদ্রর কথা কেন জিজ্ঞেস করছে? এই প্রশ্নটা অরূণীর মাথায় আন্দোলিত হতে লাগলো। সেলিনা আহমেদ এ পর্যায়ে বলল, “ এতদিন মিথ্যে বলেছিস তুই? তোর সাথে রুদ্রর সম্পর্ক না থাকলে রুদ্র কেন বিয়ের প্রস্তাব দিবে? এত সাহস!”
সেলিনা আহমেদের কথা অরূণীর কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই অরূণীর হাত-পা যেন হিম শীতল হয়ে গেল। রুদ্র বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে? রুদ্র দেশে এসেছে? অরূণীর মন ততক্ষণে উত্তেজনায় পাগল হয়ে গেল। তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে অরূণীর মনে। অরূণীর মনে হচ্ছে এসব স্বপ্ন। অরূণী মনেপ্রাণে চাচ্ছে এটা যেন স্বপ্ন না হয়। সাহেদ আহমেদ আর সেলিনা আহমেদ যে সামনে বসা অরূণীর সেদিকে খেয়াল নেই। মুহূর্তেই সব ভুলে গেল। অরূণী এই অনুভূতির ব্যাখ্যা কাউকে দিতে পারবে না, কাউকে বুঝানো সম্ভব না। অরূণীর শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে। মাথার ভিতর ভনভন করছে। রুদ্র ফিরে এসেছে? অরূণী আর কিছু ভাবতে পারছে না। চিন্তাশক্তি লোপ পাচ্ছে বোধ হয়। আনন্দে অবচেতন হয়ে যাচ্ছে। সাহেদ আহমেদ হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে। ভাবনায় ডুবে থাকা অরূণী হঠাৎ এমন চেঁচানোর শব্দে হকচকিয়ে ওঠে তাকায়। সম্বিত ফিরে অরূণীর। সাহেদ আহমেদ আবার জিজ্ঞেস করলো, “ রুদ্রর সাথে তোমার সম্পর্ক আছে? তুমি রুদ্রকে বিয়ে করতে চাও?”
অরূণী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল শুধু। অনেকক্ষণ পর সাহেদ আহমেদের প্রশ্নের উত্তরে বলল, “রুদ্র ভাইয়ার সাথে তোমার কোথায় দেখা হয়েছে? উনি ফিরে এসেছে?”
অরূণীর প্রশ্ন সাহেদ আহমেদ তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে তাকালো সেলিনা আহমেদের দিকে। মুখ বিকৃত করে বলল, “তোমার মেয়ে এখন কিছু জানে না।”
দীর্ঘ সময় পার হওয়ার পর সাহেদ আহমেদ ক্ষীণ শ্বাস ফেলে ঠাণ্ডা গলায় কেবল বলল, “তুমি যদি ভেবে থাকো তুমি বড় হয়েছো, যথেষ্ট বয়স হয়েছে। তোমার সিদ্ধান্ত-ই সব। তাহলে তুমি ভুল। আমি বেঁচে থাকতে অন্তত চাইবো না ওরকম একটা ফ্যামিলিতে আমার মেয়ের বিয়ে হোক। যদি বিয়ে করতেই হয় আমি মারা যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করো।”
সাহেদ আহমেদের কথা শুনে অরূণীর অন্তর আত্মা কেঁপে ওঠে। এলোমেলো ভাবে পা ফেলে রুমে যায়। মিলা অরূণীর সাথে সাথে অরূণীর রুমে আছে। মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে?”
কথা বলার মতো মানসিকতা অরূণীর নেই। শুধু বলল, “কিছু না ভাবী। যাও এখন।”
অরূণী আর রুদ্রর বিষয়ে মিলা একটু-আধটু জানে। সূর্য কখনো এই ব্যাপারে মিলাকে কিছু বলে নি। মিলা আন্দাজ করতে পারলো হয়ত রুদ্রর বিষয় নিয়ে কিছু হয়েছে।

মাথায় উপর ভনভন করে ফ্যান ঘুরছে। অরূণীর মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো। রুদ্র ফিরলো অথচ দেখা করলো না এখনো! বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে রুদ্র! তাহলে রুদ্র বদলায় নি? রুদ্রর উপর জমে থাকা অভিমান কর্পূরের মত উবে যেতে লাগলো। অন্য দিকে সাহেদ আহমেদের বলা কথা গুলো মাথায় পীড়া দিচ্ছে। অরূণী ফ্রীজ থেকে ঠাণ্ডা পানি বের করে ঢকঢক করে খেলো। শরীর ঘামিয়ে গেছে। কিছু সময় স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো অরূণী। রুদ্রর প্রতি সাহেদ আহমেদের রাগ আগের মতই আছে? দুই বছরে একটু রাগও কমে নি? রুদ্রকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে অরূণীর। রুদ্রকে দেখার পিপাসায় অন্তর আত্মা শুকিয়ে যাচ্ছে অরূণী। এই দেখার পিপাসায় প্রাণটা যেন বেড়িয়ে যাবে। খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হচ্ছে রুদ্রকে। এছাড়া আর কিছু অরূণীর এখন ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছে না।

অরূণীর ফোনটা বেজেই চলেছে। সেদিকে খেয়াল নেই। হঠাৎ মনে হলো, রুদ্র ফোন দিয়েছে? এমন শঙ্কায় নিবিষ্ট হয়ে অরূণী তড়িঘড়ি করে ফোনের কাছে যায়। ফোনের স্ক্রিনে তাইতির ফোন নম্বরটা ভাসছে। অরূণী তীব্র ভাবে আশাহত হলো। ধরতে ইচ্ছে করছে না ফোন। হাত থেকে রেখে দিলো। অনাবরত বেজেই চলল ফোনটা। অরূণী বিরক্ত হয়ে হাতে নিলো ফোনটা, একবার ভাবলো বন্ধ করে রাখবে। আবার কী ভেবে যেন রিসিভ করলো। তাইতি ব্যগ্র গলায় বলল, “দোস্ত কই তুই?”
অরূণী ক্ষীণ স্বরে অনিচ্ছুক ভাবে বলল, “বাসায় আমি। কি হয়েছে?”
– “আমাদের বাসায় আসতে পারবি? ভীষণ বিপদে পড়েছি রে। একটু তাড়াতাড়ি আয় দোস্ত প্লীজ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আয়।”
অরূণীর ভাবলেশহীন গলা, “আমি ঝামেলায় আছি খুব। আসতে পারবো না।”
তাইতি করুন স্বরে অনুরোধ করেই যাচ্ছে। অরূণী বেশ বিরক্ত গলায় বলল, “আমি খুব সমস্যায় আছি। তুই বুঝতে পারছিস না। মন-মেজাজ ভালো নেই।”
অরুণী ফোনটা রেখে দিয়ে আপন ভাবনায় নিবিষ্ট হলো। ফোন কেটে দেওয়ার পর তাইতি ক্রমাগত অনুরোধমাখা টেক্সট করে যাচ্ছে অরূণীর ফোনে। অরূণীর টনক নড়ে। কী হলো হঠাৎ তাইতির? অরূণী ছোট করে একটা ম্যাসেজ পাঠায়, “আচ্ছা আসছি।”
বাসা থেকে বের হওয়ার সময় সেলিনা আহমেদ আর সাহেদ আহমেদের সামনে পড়ে অরূণী। থমথমে মুখে তাকিয়ে ছিলো অরূণীর দিকে। কোনো প্রশ্ন করে নি। তাঁদের দৃষ্টিতে বুঝা গেল, তাঁরা ভাবছে অরূণী রুদ্রর সাথে দেখা করতে যাচ্ছে। অথচ অরূণী কিছুই জানে না।

অরূণী তাইতির বাসায় গিয়ে দেখে সব ঠিকঠাক। কোনো প্রবলেম হয় নি। তাইতি ওর রুমে বসে আছে। তাইতির পাশে ওর ভাবী বসা। ননদ আর ভাবী খোশগল্প করছে। অরূণী ব্যগ্র হয়ে বলল, “সমস্যা কি তোর? মানে এমন ভাবে খবর দিয়ে এনেছিস মনে হচ্ছে তোকে শূলে চড়ানো হয়েছে।আর সেখান থেকে একমাত্র আমিই উদ্ধার করতে পারবো।”
অরূণীর কথায় তাইতির ভাবী হেসে ফেলল। অরূণীর মনের বেহাল অবস্থা। তা তো কেউই বুঝবে না। তাইতির ভাবী খাট ছেড়ে ওঠে বলল, “তোমার সাথে কথা আছে আমার এদিকে আসো।”
দ্বিতীয় আর কোনো প্রশ্ন না করে অরূণী তাইতির ভাবীর পিছনে, পিছনে যেতে লাগলো। ভালো লাগছে না কথা বলতে। তাইতিদের বাসায় দক্ষিণ পাশের একদম কোণার রুমটার কাছে এসে তাইতির ভাবী থামলো। বললো, “তুমি এই রুমে বসো একটু আমি আসছি। যাবো আর আসবো।”
অরূণী উন্মনা ভাবে রুমে ঢুকলো। হাতের ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে অস্থির ভঙ্গিতে সোফায় বসলো। তাইতি কি ফাজলামি টা শুরু করেছে! অরূণীর হঠাৎ চোখ গেল রুমের উত্তর দিকের জানালাটার দিকে। জানালার সাথে হেলান দিয়ে এক দৃষ্টিতে অরূণীর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল রুদ্র। অরূণী ভয়ে, আতঙ্কে,ভুত দেখার মত চমকে ওঠে চিৎকার দিলো গলা ফাটিয়ে। তোতলাতে তোতলাতে কোনো মতে বলল, “রু-দ্র-ওও।”
অরূণী সোফা তড়াক করে উঠে দাঁড়ায়। বার বার চোখের পলক ফেলতে লাগলো। অস্বাভাবিক ভাবে ঘামছে। গলা শুকিয়ে আসছে। রুদ্রর ঠোঁটে এক ঝলক হাসি। অরূণীর দিকে এগিয়ে আসলো। আবেগঘন কণ্ঠে শুধু বলল, “অরূণী।”
অরূণী নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। কিছু বলতে পারছে না। রুদ্র অস্থির গলায় বলল, “আরে কাঁপছো কেন? আমি তো ভেবেছি আমায় দেখার সাথে সাথে বুকের ভিতর ঝাঁপিয়ে পড়বে। নাকে-চোখের পানি দিয়ে শার্ট নষ্ট করে ফেলবে। এজন্য আমি পুরানো শার্ট পড়ে এসেছি।”
অরূণীর শরীর টলমল করছে।এক্ষুণি যেন ঢলে পড়বে। রুদ্র অরূণীকে জড়িয়ে ধরলো। প্রায় এক ঘণ্টার মত কেউই কোনো কথা বললো না। দীর্ঘ সময় পর রুদ্র বললো, “কিরণ বলেছিলো তুমি না-কি বদলে গেছো। আগের মত আবেগ, পাগলামি কিছুই নাই। কই বদলে গেছে আমার আবেগী রাণী? সে তো আবেগে আমার বুকের ভিতর গলে যাচ্ছে। শুধু একটু বড় হয়েছে।”
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here