তোলপাড়
ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-৮
_______________
কিরণের ভিতর কোনো সিরিয়াস ভাব নেই।কিরণ ভাবলেশহীন ভাবে কৌতুক করে যাচ্ছে। রুদ্র উগ্র মেজাজে এক হাত দিয়ে অন্য হাতের তালু চাপড়াতে চাপড়াতে বলল, “আরে ভাই বোঝার চেষ্টা কর।এই মেয়ে যথারীতি মেন্টাল টর্চার করছে আমায়। আমার মায়ের দিব্যি দিয়েছে।বিষয়’টা কত ভয়ানক ভাবতে পারিস? আমার মা’কে আমি কত ভালোবাসি!”
কিরণ তাঁর স্বভাব অনুসারে নিরুদ্বেগ ভাবে বলল, “কাটিস না দাঁড়ি।টাকা সাশ্রয় হবে।”
রুদ্র কোনো উত্তর না দিয়ে কিরণের হাত থেকে ফোন’টা নিয়ে হাঁটা শুরু করলো।কিরণের সাথে কথা বললে ক্রমশ মেজাজ’ই খারাপ হবে শুধু,কোন ফয়দা হবে না। কিরণ পিছন থেকে রুদ্র’কে ডেকে বলল, “আরে মেয়েটা তোর প্রেমে পড়ে গেছে।নয়ত কি এমন করে?যা গিয়ে প্রেম কর।”
রুদ্র আর কোনো প্রত্যুত্তর করলো না।কিরণের সাথে এই ব্যাপার নিয়ে কোনো কথা বললো না। কয়েকদিন কেটে গেলেও অরূণী’কে খুঁজে পেলো না। অরূণীর ফোন নম্বর’টাও বন্ধ। মাঝে মাঝে ম্যাসেজ করে বন্ধ করে রাখে। আজও একটা ম্যাসেজ দিয়েছে, “খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে আপনাকে লুক অ্যালাইক আল্লু আর্জুন লাগে।যদিও আমি আপনার হাসি দেখে প্রেমে পড়েছি।ভালোবাসি আপনায় রুদ্র আকন।”
ম্যাসেজ’টা যখন দেখে তখন রুদ্র বাসে ছিলো।ভার্সিটি থেকে ফিরছিলো। রুদ্র’কে এভাবে ফোনের দিকে গভীর মনোযোগে তাকিয়ে থাকতে দেখে রুদ্রের পাশের সিটে বসা আদিল রুদ্রের ফোনের দিকে উঁকি মারে। রুদ্র অপ্রস্তুত ভাবে ফোন’টা প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে ফেলে।এমন অপদস্থ হওয়ার কথা বন্ধু মহলে জানিয়ে হাসি-ঠাট্টার স্বীকার না হওয়াই ভালো। আদিল অবাক গলায় বলল, “কিরে ভাই! নতুন প্রেম শুরু করছিস?এত গভীর মনোযোগে কার ম্যাসেজ পড়িস?”
রুদ্র তাচ্ছিল্য করে বলল, “প্রেম-ট্রেম ওসব আর আমায় দিয়ে হবে না।”
– “অমন লাবন্য কত আসবে!এত বৈরাগী সাজার কি দরকার?নতুন করে শুরু কর আবার। তোর মত চেহেরা থাকলে প্রেমে সেঞ্চুরি করতাম।”
রুদ্র উত্তর না দিয়ে বাসের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে উঁকি দিলো। রুদ্রের চিন্তা-ভাবনায় তখন অরূণীর দেওয়া ম্যাসেজ’টা স্প্রিংয়ের বলের মত লাফাচ্ছে।রুদ্রের রাগ,ক্ষোভ কিছুই হলো না। শুধু ভাবছে, “মেয়েটা কেন এমন করছে?কি চায়?” রুদ্রের মুখের অভিব্যক্তি দেখে মনে হচ্ছে মহা দুশ্চিন্তায় ভুগছে। যথারীতি হতোদ্যম হয়ে গেল। অরূণী ম্যাসেজ দিয়েই ফোন’টা অফ করে রাখে। রুদ্র ফোনেও পায় না অরূণী’কে। লুকোচুরি খেলছে অরূণী। কিছু সময় বাদে বাস থামালো। অরূণী জানে এই সময়ে রুদ্র ভার্সিটি থেকে ফিরে। মাঝে মাঝে সুযোগ হলে অরূণী বাস স্ট্যান্ডে আসে।আজও এসেছে। রুদ্র বাস থেকে নামলো।এই বাস স্ট্যান্ডে প্রথম রুদ্র’কে দেখেছিলো অরূণী। অরূণী আড়াল থেকে তাকিয়ে রইল। রুদ্রের ফোনে কল করলো। অরূণী দূর থেকে দেখতে পেলো রুদ্র ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে ফোনের দিকে। চোখে বিস্ময় আর রাগ। রুদ্র ফোন রিসিভ করার সাথে সাথে অরূণী বলল, “যাক আবার সেই খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি।দারুন লাগছে।এভাবেই রাখবেন সব সময়।আপনার মায়ের দিব্যি কিন্তু।”
কিছু কিছু সময় মানুষ অতি রাগে,বিরক্তিতে কিংবা বিস্ময়ে কারো কথার জবাব তৎক্ষণাৎ দিতে পারে না। রুদ্রেরও হয়েছে তাই। ফোন হাতে নিয়ে এদিকে-ওদিক অস্থির ভাবে তাকাতে তাকাতে বলল, “এই মেয়ে তুমি সামনে আসো আমার।কোথায় তুমি?” রুদ্র কথা’টা বলে ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখে ফোন কেটে দিয়েছে। রুদ্র ফের ডায়েল করে দেখে ফোন বন্ধ। অত্যাশ্চর্য হয়ে গেল রুদ্র। কেমন প্রতিক্রিয়া করা উচিত রুদ্র বুঝতে পারছে না। রুদ্র চারদিক খুঁজতে খুঁজতে অরূণী যেদিকে সেদিকে যেতে লাগলো। অরূণী টুপ করে একটা শপিং মলে ঢুকে মানুষের ভিড়ে হারিয়ে গেল। আড়াল থেকে রুদ্রের হন্য হয়ে খোঁজ করা দেখছে। অরূণীর মনে বসন্ত পবনের স্নিগ্ধতা অনুভূত হচ্ছে। রুদ্রের রাত কিংবা দিবস অরূণীর ভাবনায় বিভোল হয়ে কাটুক। অরূণী’কে হন্য হয়ে খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে যাক। সময় কিংবা অসময়ে রুদ্রের উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠুক অরূণী।
রুদ্র অনেকক্ষণ অরূণী’কে খুঁজে না পেয়ে বিফল হয়ে বাসায় চলে গেল।ক্ষুধায় রুদ্রের পেট চোঁ চোঁ করছে।নয়ত আরো কিছুক্ষণ খুঁজতো। রুদ্র টাকার কথা ভুলে গিয়েছে। রুদ্রের এখন শুধু মনে হচ্ছে টাকার দরকার নেই। শুধু মেয়ে’টা কে একবারের জন্য সামনে পাক। রুদ্রের খুব আশ্চর্য লাগছে। একটা মেয়ে এভাবে ও’কে সব সময় ফলো করে। রুদ্র প্রথম প্রথম তত গুরুত্ব দেয় নি। কিন্তু ক্রমে ক্রমে যেন মেয়ে’টা রুদ্রের অস্থি মজ্জার চিন্তা-ভাবনায় গেঁথে যাচ্ছে।
রুদ্র বাসায় গিয়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে কিরণ’কে উদ্দেশ্য করে বলল, “কিরণ তাকা তো আমার দিকে।”
কিরণের গভীর মনোযোগ মোবাইলের দিকে। গার্লফ্রেন্ডের সাথে চ্যাটিং করছে বোধ হয়। রুদ্র আবার গলার আওয়াজ বৃদ্ধি করে ডাকল, “কিরণ।”
কিরণ ফোনের স্ক্রিনের দিক থেকে অনিচ্ছাকৃত ভাবে মুখ তুলে মহা বিরক্তি নিয়ে বলল, “কি হইছে?”
– “দেখ তো আমায় আল্লু আর্জুনের মত দেখায় কি-না?”
কিরণ হাসতে হাসতে বলল, “গোল আলুর মত দেখায়।”
রুদ্রের মুখ থমথমে।চাপা একটা ক্ষোভ নিয়ে বলল, “তুই কি কোনো কথার সহজ ভাবে উত্তর দিতে পারিস না?”
– “তুই তো দেখতে সুন্দর এটা সবাই জানে। সুন্দর না হলে কি মেয়েরা তোর জন্য এত পাগল থাকে?আমার গার্লফ্রেন্ডও তোর চেহেরার প্রশংসা করে।এটা নতুন করে আর কি বলব?”
এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে কিরণ ফোনের দিকে মনোযোগ দিলো আবার। রুদ্র কিরণের দিকে তাকিয়ে হতাশ গলায় বলল, “তোকে কী আমি জিজ্ঞেস করেছি যে আমার চেহারা কেমন? আমি জিজ্ঞেস করেছি আমায় কি আল্লু আর্জুনের মত দেখায়?”
কিরণ পুনরায় বলল, “গোল আলুর মত দেখায়।”
রুদ্র এবার রেগে গিয়ে বলল, “তুই যে এ্যাঞ্জেল ঊর্মি নামে ফেইক আইডি চালাস এটা যদি আমি তোর গার্লফ্রেন্ড’কে না বলছি।”
কিরণের যেন এবার টনক নড়ল।ফোন দ্রুত হাত থেকে রেখে রুদ্রের দিকে তাকিয়ে অবাক হওয়ার ভান করে বলল, “সত্যি বলতে দোস্ত তোকে যেদিন আমি প্রথম দেখেছি আমি তো আশ্চর্য হয়ে গেছি।” এইটুকু বলে থেমে কিরণ অবাক হওয়া ভাব’টা আরো গাঢ় করে বলল, “আমার মনে হচ্ছিলো আমি স্বপ্নে দেখছি। তামিল থেকে আল্লু আর্জুন বাংলাদেশে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তো হতভম্ব হয়ে..!”
কিরণের পিঠে বিকট শব্দে থাপ্পড় পড়তেই কিরণ ব্যথিত গলায় উহ্ বলে ওঠলো। রুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলল, “দোস্ত মারলি কেন?”
রুদ্র রাগে বিড়বিড় করতে করতে বলল, “শালা ইতর।আমি কত মানসিক দুশ্চিন্তায় আছি আর তুই সবকিছু উড়িয়ে দিচ্ছিস।”
রুদ্র আর একটা থাপ্পড় দিতে উদ্যত হলে কিরণ হাসতে হাসতে বলল, “দোস্ত, দোস্ত মারিস না। ওই মেয়ে আবার তোকে ম্যাসেজ করেছে?”
– “ওই মেয়ে আমার নাম জানলো কীভাবে? বাস স্ট্যান্ডে, সেলুনে, ভার্সিটি’তে সব জায়গায় আমায় ফলো করে। কি সাংঘাতিক মেয়ে। আমার আশেপাশে থেকেই ম্যাসেজ করত এতদিন আজ একদম কল দিলো। আমি কিছু বলার আগেই লাইন কেটে ফোন বন্ধ করে রাখলো। কেমন একটা অদ্ভুত ব্যাপার।”
কিরণ আফসোস করে বলল, “ইস দোস্ত এমন পাগলামি যদি কোনো মেয়ে আমার জন্য করত সোজা কাজী অফিসে নিয়ে যেতাম।”
কিরণের সাথে কথা বলাই বৃথা। রুদ্র চেপে গেল। আর কোনো কথা বললো না। নোট রেডি করতে হবে। রুদ্র বই নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগলো।
_________________
বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে।অরূণী বৃষ্টির ফোঁটা ধরার চেষ্টা করছে। বৃষ্টির জন্য আজ কলেজে যাওয়া হয়নি। বারান্দায় বসে বসে ভাবছে আরো কয়েক ধাপ সামনে এগুতে হবে। বিকালের দিকে বৃষ্টি কমে গেলে অরূণী ব্যাগে একটা চিঠির খাম নিয়ে কার্তিক কর্মকারের বাসার দিকে রওয়ানা হলো। আজকে আর বাসার ভিতরে ঢুকবে না। খানিক’টা দূর থেকে দেখলো বাসার আশেপাশে রুদ্র আছে কি-না। ভালো করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অবলকোন করে বাসার গেটের কাছে গেল। দারোয়ান’কে দেখছে না। আজ দারোয়ান’কে প্রয়োজন অরূণীর। যেকোন মুহুর্তে কার্তিক কর্মকার কিংবা রুদ্র চলে আসতে পারে।তাই কার্তিক কর্মকারের বাসার পাশের দোকানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দারোয়ানের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। কয়েক মিনিট পর দারোয়ান আসলে অরূণী দ্রুত গেটের দিকে যায়। দারোয়ান অরূণী’কে দেখেই এই চিলতে হাসি ছুঁড়ে দেয়।কার্তিক কর্মকার ভাইয়ের মেয়ে বলে কথা। পরিতোষপূর্ণ ভাব তো দেখানো দারোয়ানের কর্তব্য। অরূণী বেশ মিষ্টি গলায় বলল, “কেমন আছেন আপনি?”
দারোয়ান হাসি হাসি মুখে বলল, “ভালাই আছি। আপনে অনেকদিন পর?”
অরূণী চারপাশে তাকিয়ে খুব সতর্ক গলায় বলল, “চাচা একটু এদিকে আসেন।ভালো কথা আছে আপনার সাথে।”
দারোয়ান কপাল কুঁচকে তাকালো। ভারি চমকালো অরূণীর আচরণে। অরূণী তাড়া দিয়ে বলল, “আহা চাচা! কি ভাবছেন এত?আসেন তো।”
দারোয়ান ঠিক বুঝতে পারছে না অরূণীর হাবভাব। বিভ্রান্ত হয়ে বলল, “কই যামু? কি কইতাছেন?”
অরূণী এবার কঠোর ভাবে বলল, “আসতে বলছি না আপনায়। একদম চাকরি খেয়ে দিবো।”
চাকরি খাওয়ার কথা শুনলেই দারোয়ান বিহ্বল হয়ে যায়।অরূণী পুনরায় বলল, “আরে আসেন আপনি।দশ মিনিট লাগবে। কার্তিক মশাই কিছু বললে আমি বুঝবো।”
অরূণীর ছলচাতুরি কিংবা তোপের মুখে পড়ে দারোয়ানের যেতেই হলো। অরূণী দারোয়ান’কে নিয়ে কাছেই একটা রেস্টুরেন্টে গেল। দারোয়ান বার বার তাকাচ্ছে অরূণীর দিকে।কিছুই বুঝতে পারছে না। অরূণীর উদ্দেশ্য কি?অরূণী দারোয়ান’কে বসতে বলে। দারোয়ান অরূণীর কথা মত বসে। অরূণী জিজ্ঞেস করল, “চাচা আপনি কি কি খাবেন?কি কি খেতে পছন্দ করেন?নাম বলেন শুধু।বিল পাঁচ হাজার হলেও সমস্যা নেই।”
অরূণীর কথা একদম বিশ্বাস করছে না দারোয়ান। অরূণী ভয়াবহ রকমের মেয়ে সেটা দারোয়ান ভালো করেই জানে। দারোয়ান চিন্তা-ভাবনা মতে অরূণী খাওয়া-দাওয়া শেষে দারোয়ান’কে বিলের জন্য ধরিয়ে দিবে। অরূণী এই ফন্দি ফিকির এঁটে তাঁকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে এসেছে। দারোয়ান নিজেকে সাবধান করছে, অরূণীর কথা কিছুতেই বিশ্বাস করা যাবে না। লোভে পড়ে নিজের বিপদ ডেকে আনা যাবে না। এই ভাবনা থেকে দারোয়ান শুধু সিঙ্গারা আর কফি খেলো। অরূণী হাজার বার জোর করা সত্ত্বেও আর কিছু খেতে রাজি হলো না। দারোয়ানের এই নারাজ ভাব দেখে অরূণী অবাক। অরূণী বার্গার খেলো দুইটা। খাওয়া শেষে দারোয়ান’কে অবাক করে দিয়ে অরূণী বিল দিলো। দারোয়ান বিস্ময় ভরা চোখে তাকিয়ে আছে। দারোয়ানের আফসোস হচ্ছে! কেন বেশি করে খেলো না?পরক্ষণে মনে হলো অরূণী হঠাৎ কেনো রেস্টুরেন্টে ডেকে আনলো?অরূণী ঢকঢক করে জুস খেতে লাগলো। খালি জুসের বোতল’টা নড়াচড়া করতে করতে বলল, “চাচা একটা কাজ করে দিতে হবে?”
দারোয়ানের চোখে-মুখে আতঙ্ক। বিপদে পড়ার আতঙ্ক। অরূণী দারোয়ানের মুখের অভিব্যক্তি বুঝতে পেরে অভয় দিয়ে বলল, “আরে চাচা ঘাবড়াবেন না! খুব সহজ একটা কাজ। আপনি বিপদে পড়বেন না।”
দারোয়ান ভয় ভয় গলায় বলল, “কি কাজ?”
– “কাজ যা ই হোক আপনি কারো কাছে বলতে পারবেন না।”
অরূণী ব্যাগ থেকে এক হাজার টাকার চকচকে নোট বের করে দারোয়ান’কে দেখিয়ে বলল, “এই এক হাজার আপনার।যদি আপনি একটা খাম আমার পরিচয় না দিয়ে রুদ্র আকন’কে দিয়ে আসতে পারেন।”
দারোয়ান লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকালো হাজার টাকার চকচকে নোক’টার দিকে। মনে মনে ভাবছে এতো খুব সহজ কাজ। দারোয়ান হৃষ্টচিত্তে বলল, “এতো খুব সহজ কাজ।”
অরূণী আবারো তীব্র সাবধানী গলায় বলল, “কাজ সহজ। কিন্তু কেউ যেন না জানে। রুদ্র আকন আপনার কাছে জিজ্ঞেস করলে বলবেন এক মেয়ে এসে দিয়ে গেছে। তাঁকে আপনি একদমই চিনেন না।”
দারোয়ান বলল, “আচ্ছা বুঝতে পারছি।আপনের পরিচয় কওয়া যাইবে না।”
অরূণী খাম আর টাকার নোট ধরিয়ে দিলো দারোয়ানের হাতে।বলল, “রুদ্র আকন যত যা বলে আপনি আমার নাম কিংবা আমি কার্তিক মশাইয়ের আত্মীয়, তাঁর বাসায় যাই এসব কিছুই বলবেন না।”
দারোয়ান’কে বার বার সতর্ক করে অরূণী রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে গেল। অরূণী শুধু রুদ্র’কে চমকে দিতে চায়। রুদ্রের মনে উদ্বেগ সৃষ্টি করতে চায়। দারোয়ান বাসায় গিয়ে রুদ্র’কে পেলো না। একবার ভাবলো কিরণের কাছে দিবে পরবর্তীতে অরূণীর কঠিন সর্তকার কথা মনে পড়তেই আর কিরণ’কে দিলো না। রাতে রুদ্র ফিরে আসতেই রুদ্রের হাতে ধরিয়ে দিলো খাম’টা। এই যুগে চিঠির খাম? রুদ্র অবাক হলো। কে দিলো?কি লিখে দিয়েছে? এসব প্রশ্ন রুদ্রের মনে দারুন উত্তেজনার সৃষ্টি করলো। বাসায় ঢুকে চিঠির খাম’টা খুলতেই দেখে লেখা-
“তোমার দর্শনে তোলপাড় হৃদয়ে।”
কাগজের ওপাশ উল্টিয়ে দেখে লেখা-
“টাকা দিয়ে দিলেই তো হিসেব চুকে যাবে। আমি এই হিসেব সারা জীবনেও চুকাতে চাচ্ছি না।”
রুদ্রের চোখে মুখে বিস্ময় বিস্ফোরন হয়েছে যেন।ছুটে যায় দারোয়ানের কাছে। হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কে দিয়ে গেছে এটা?” রুদ্রের গলায় অস্থির ভাব।
দারোয়ান সহজ গলায় বলল, “নাম-টাম কিছু কয় নাই। শুধু কইলো রুদ্র আকন’কে দিয়েন এটা।”
– “কখন এসেছিলো?”
– “বিকালের দিকে।”
রুদ্র দারোয়ানের কাছ থেকে কিছু জানতে না পেরে ব্যর্থ হয়ে রুমে চলে গেল। চিঠি’টা কয়েকবার পড়ল। মেয়েটা বাসার ঠিকানা পেলো কোথায়? তাহলে রুদ্র রাজশাহী থাকাকালীন এই মেয়েই বাসায় এসে কিরণের থেকে ফোন নম্বর নিয়েছে? রুদ্র ফোন দিলো অরূণীর নম্বরে। ভেবেছিলো বন্ধ থাকবে ফোন নম্বর’টা। কিন্তু না, রিং হতে লাগলো। ওপাশ থেকে অরূণী অতিশয় আকুল হয়ে ফোন তুলল। সেকেন্ডের ভিতর হাজার বার অরূণীর মনে প্রশ্ন জাগলো, “কি বলবে রুদ্র?” রুদ্র হ্যালো বলতেই অরূণী ঢোক গিলল। প্রচুর ভয় করছে অরূণীর। রুদ্র খুব ঠাণ্ডা গলায় বলল, “কি হলো কথা বলছো না কেন?”
অরূণী ঈষৎ কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “বলছি তো।”
– “কে তুমি?কি চাও?”
– “আপনাকে চাই।”
কথা’টা বলে উথাল পাতাল হয়ে উত্তরের অপেক্ষা করতে লাগলো। অরূণীর বার বার মনে হচ্ছে রুদ্র ও’কে ফোনের ভিতরই চড় মেরে বসবে। রুদ্র হেসে বলল, “আচ্ছা তাহলে দেখা করো আমার সাথে।”
রুদ্রের এমন অতি স্বাভাবিক আচরণ অস্বাভাবিক লাগছে অরূণীর কাছে। অরূণী নিচু স্বরে বলল, “উঁহু না।মারবেন আপনি আমায়।”
পাঁচ-সাত বছরের বাচ্চাদের বলা কথার মত লাগলো অরূণীর কথা’টা। সারাদিন দুরন্তপনা করে দিন শেষে মায়ের মারের ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে থাকা বাচ্চাদের মত। রুদ্র বলল, “না কিছু বলবো না তোমায়।”
রুদ্রের এমন সহজ আচরণে অরূণী কথা বলার জোঁ পেলো।খুশিতে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। রুদ্র এত ভালো করে কথা বলবে এ যেন ধারণাতীত।অরূণী’কে নিরুত্তর দেখে রুদ্র আবার বলল, “কি হলো? দেখা না করলে প্রেম করবে কীভাবে?”
– “আপনি আমায় মারবেন আমি বুঝতে পারছি।দেখা,প্রেম ওসব মিথ্যে বলছেন।”
অরূণীর কথা গুলো কেমন বাচ্চাসুলভ লাগলো। রুদ্রের তেমন রাগ হলো না। বলল, “আচ্ছা তাহলে বলো তুমি আমার পিছু কেনো নিয়েছো?”
– “আপনার প্রেমে পড়ে গেছি তাই। আপনার গেঁজ দাঁতের হাসি দেখে দুই রাত আমার ঘুম হয় নি।”
রুদ্র অরূণীর কথা শুনছে আর বিস্ময়ে ডুবছে। কিভাবে রুদ্রের নাম, ঠিকানা জেনেছে কিছুই বলছে না। দেখা করতেও চাচ্ছে না। রুদ্র শেষে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা তোমার নাম’টা বলো?”
– “মিসেস আকন।”
রুদ্র এই পর্যায়ে কিছু’টা শক্ত গলায় বলল “এই মেয়ে পাগলামি করো না।নাম বলো।”
অরূণী এসবের জবাব না দিয়ে বলল, “আপনায় বলেছিলাম না যে আমি বাসায় প্রেম করে ধরা খেয়েছি।ওসব মিথ্যে কথা। ওসব নিয়ে ভুল বুঝে আপনি আমার থেকে দূরে চলে যেয়েন না।”
রুদ্র বিস্ময়ে স্তম্তিত হয়ে গেল।পাগল নাকি? কয়েক মুহূর্ত পর বলল, “মাথায় সমস্যা আছে তোমার?”
– “না মাথা ভরা প্রেম আমার আপনার জন্য। আপনি আর আমি মিলে একটা মুভি বানাবো এক মাথা প্রেম।”
রুদ্রের হাসি পাচ্ছে। কিন্তু হাসা সমীচীন নয় ভেবে হাসলো না।অরূণী কিছু না বলেই ফোন রেখে দিলো। সূর্য এসেছে বাসায়। এভাবে হুট করে ফোন কেটে দেওয়ায় রুদ্র অবাক হলো। রুদ্র ভেবেছে খুব সুন্দর করে কথা বলে একবার অরূণীর সাথে দেখা করবে।অরূণীর এমন সহজ সহজ কথায় রুদ্র যেমন বিস্মিত হচ্ছে ঠিক তেমনি আমজাদ হোসেনের বাসায় গিয়ে তাড়া খাওয়ার কথা মনে পড়তে মেজাজ উত্তপ্ত হয়ে যাচ্ছে।উত্তপ্ত মেজাজ আর বিস্ময় মিলে অদ্ভুত এক অনুভূতি সৃষ্টি করেছে।
(চলবে)