#ধূসর_রঙের_প্রজাপতি
#ফাতেমা_তুজ
#part_45
” মির্জা বাড়ির মেয়ে মুখ কালো করতে রেসট্রন এ আসছে। বিয়ের আগেই যে মেয়ে পালায় যায় তাঁর চরিত্র নিয়ে সন্দেহ থাকা স্বাভাবিক। ”
আরফানের কন্ঠ টা চিনতে অসুবিধা হলো না অভিনবর। অভিনব পেছন ঘুরে তাকালো। মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে আরফান বাঁকা হাসছে। অভিনব কে দেখতে পায় নি সে। কারন ঝিলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে আরফান। ঝিল উঠে দাঁড়ালো। উক্ত ব্যক্তিটি কে সে চিনে না। তবু ও ভদ্রতার খাতিরে বলল
_ আপনাকে তো চিনলাম না ! আমার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার কে আপনি ?
_ অহনা মির্জা ঝিল রাইট ?
_ হুমম।
আরফান ব্যঙ্গ হাসলো। অভিনব বিষয় টা বোঝার চেষ্টা করছে। আপাতত সামনে থাকা মানুষটার প্রতি চরম বিরক্ত ঝিল। ততক্ষণে মৌনতা ও চলে এসেছে। মৌনতা কে দেখে আরফান বলল
_ আবার সাথে করে বান্ধবী কে ও নিয়ে এসোছো। বাহহ মির্জা বংশের কি উন্নতি হলো। এইসব নোংরামি শুধু ওরাই পারে।
অভিনবর রাগ উঠে গেল। সমস্ত কিছু তাঁর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। নিজেকে দমিয়ে রাখতে ব্যর্থ হলো। উঠে দাঁড়াতেই আরফান অন্য দিক ফিরে হাঁক ছেড়ে ডাকতে লাগলো।
_ আরে কোথায় তোরা ! মির্জা বংশের সম্মান দেখে যাহহ। কোন ছেলের সাথে ফস্টি নষ্টি করে বেড়াচ্ছে।
ঝিল অবাক হলো। কি বিশ্রী ভাষা ব্যবহার করছে। অভিনবর চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। টেবেলি টাকে খামচে ধরে বলল
_ আরফান ভাই !
কথা টা শোনা মাত্র আরফানের মস্তিষ্ক এলোমেলো হয়ে গেল। পেছন ঘুরে অভিনব কে দেখে অবাকের চরম পর্যায়। এতোটাই অবাক হলো যে চোখের পলক পরছে না। অভিনবর মুখে ভাই ডাক শুনে ঝিলের মুখের অভিব্যক্তি পাল্টে গেছে। সব কেমন উলোট পালোট লাগছে।
মৌনতার অবস্থা শোচনীয় । সে যেন দর্শক মাত্র। কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। অভিনব ভ্রু কুঁচকে বলল
_ এ কেমন ভাষা ? ওর প্রতি এমন বাঝে ইনটেনশন কি করে দিতে পারো ?
_ ইহান তুই ! মির্জা বংশের মেয়ের সাথে তুই কি করছিস?
_ ওহ আমার গার্লফ্রেন্ড।
_ হোয়াট ! এখনি বাসায় ফিরবি তুই। এই মেয়েটার সাথে কোনো কথা নয়। বাজে বংশের বাজে
কথাটা বলার আগেই টগবগে কন্ঠের ধমক ভেসে আসলো। সবাই যে দিকে তাকালো। রোহন এর শরীর কাঁপছে। দিরহাম কে ঝিলের পিছু পাঠিয়েছিলো। একটা ছেলের সাথে দেখা করছে শুনেই এ দিকে রওনা দেয়। এখানে এসেই আরফানের ভাষা গুলো শুনতে পায়।
_ একটা ও কথা নয় আরফান শিকদার। নিজে কে সংযত রাখুন। আমার বোনের দিকে আঙুল উঠানোর সাহস কি করে হয় ?
_ বোনের হয়ে সাফাই গাইছিস ? তোর বোনের মানসিকতার ঠিক আছে ?
_ এখানেই থেমে যান না হলে বিবাদে যেতে বাধ্য হবো আমি।
দুজনের কলহ লেগে যায়। ঝিল জোড়ে চিৎকার করে উঠে। কেউ কোনো কথা শুনে না। মুহুর্তেই শোরগোল পেকে যায়। অভিনব যেন পাথরের মূর্তি। সমস্ত কিছু দেখে যাচ্ছে। বুঝতে পারছে না এঁদের শত্রুতা । চরম বিপাকে পরেছে ছেলেটা। তবে চুপ থাকাই শ্রেয় বলে চুপ রয়েছে। ঝিল কে এক সাইটে টেনে নিয়ে গেল অভিনব।
_ শান্ত হও ঝিল।
_ অনেক বড় সমস্যা হবে অভিনব। আমার মাথা কাজ করছে না।
_ ঠান্ডা হও প্লিজ।
মুহুর্তের মধ্যো পুরো রেসট্রন কলহের সরাই খানা হয়ে উঠে। মির্জা পরিবার আর শিকদার পরিবার মুখোমুখি হয়।
অভিনব বুঝতে পারে জটলা টা গভীর । এর সমাধান কি করে করবে বুঝে উঠে না।
রেসট্রন এর ম্যানেজার সবাই কে বসার ব্যবস্থা করে দেন। ঝিল আর অভিনব পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রইলো।
হঠাৎ করেই ছেলেটা ঝিলের হাত শক্ত করে ধরলো। ঝিলের নয়নে অশ্রুর মেলা। অভিনবর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকালো। অভিনবর দৃষ্টি স্থীর দেখে অবাক হলো।
_ তোমার সাথে মির্জা বাড়ির মেয়ের কি সম্পর্ক ইহান ?
_ বড় মামা ওহ আমার ভালোবাসা।
_ ইহান কিছু নিষিদ্ধ জিনিস থাকে সেখাতে হাত বাড়াতে নেই।
_ ঝিল এদিকে আসো !
_ পাপা আমি
আহনাফ গিয়ে ঝিলের পাশে দাঁড়ালো। এক পলক তাকিয়ে বোনের হাত ধরলো। অভিনব ভ্রু কুটি করে বলল
_ হাত টা ছেড়ে দাও !
_ আমার বোনের হাত ধরার জন্য পারমিশন লাগবে ?
_ উহুহ লাগবে না। তবে এখন ওহ আমার সাথেই থাকবে।
_ ভাইয়া আমার কথা টা শোনো।
_ অনেক হয়েছে ঝিল। এবার আর না , আমরা চাই না শিকদার দের সাথে আত্মীয়তা গড়তে।
_ ভাইয়া !
অভিনব ঝিল কে টেনে নিলো। আহনাফ ফোঁস করে দম ফেলে বলল
_ আমাকে জোড় করতে বাধ্য করবেন না অভিনব । আমরা সম্মান দিতে জানি আবার সম্মান মাটি তে মেশাতে তো পারি।
_ তুমি ওর বড় ভাই আহনাফ। বোন কে কতোটা ভালোবাসো আমি জানি। তোমার বোঝা উচিত।
_ পরিস্থিতি ভালো না হাত টা ছেড়ে দিন।
_ ভাইয়া !
_ ভরসা রাখ আমার উপর।
অভিনব একটু বেঁকে তাকালো। হাত টা আলগা করে দিয়ে ঝিলের দিকে তাকালো। চোখের কোনে পানি জমেছে। একটু হাসলো , আহনাফের দিকে তাকাতেই আহনাফ চোখ সরিয়ে নিলো। ঝিলের হাত ধরে এগিয়ে গেল। বিভক্ত হয়ে গেল দুটো পরিবার।
বিচ্ছেদ এর রেখা দুটো হৃদয়ে। হঠাৎ করেই ঝিল কেঁদে উঠলো।
_ আমি ওর কাছে যাবো, ছাড়ো তোমরা ।
_ ঝিল !
অভিনব আগাতেই ইববান বাঁধা দিলেন। ঝিলের কান্নার মাত্রা বেড়ে গেল। বুকে পাথর চেপে আছেন জাফর। মেয়ে কে কষ্ট দিতে চাইছেন না। তবে সব কিছুর সমাধান যে হয় না।
*
” ডোন্ট টক মি। কেউ আমার কাছে ও আসবে না। আমাকে জীবন্ত লাশ বানিয়ে দিলে তোমরা। মানুষ মনে হয় না আমাকে ? কিসের এতো অহংকার ? শিকদার বংশের সাথে ঝামেলা হয়েছে তো অভিনবর কি দোষ ? আমার থেকে কেন আলাদা করে দিলে তোমরা ? ”
_ ঝিল মামুনি তুমি কেন বুঝতে চাইছো না। ঐ ছেলেটার সাথে তোমাকে জুড়ে দিতে পারি না আমরা।
_ ওয়াও বড় পাপা। এতোদিন তো খুব বলতে চাঁদ কে ও হাজির করে দিবে। পুরো পৃথিবী টাই আমার। আজ কেন উল্টো গান গাইছো ?
_ মামনি !
_ নো মোর ওয়ার্ড। লিভ মি এলোন। অভিনব কে এনে দাও না হলে শেষ করে দিবো আমি। ভালোবাসি আমি , এনি কস্ট অভিনব কে চাই আমার।
_ মামনি
হাতে থাকা ফোন টা আয়নায় ছুঁড়ে মারে ঝিল। আয়নার এক পাশ ভেঙে পরে। তাঁর থেকেই এক টুকুরো আয়না নিয়ে নিজের হাতে লাগিয়ে দেয়।
রক্তে মাখোমাখো হয়ে যায় তাঁর হাত। ইববান এগোতে আসলেই ভয়ঙ্কর গর্জন করে উঠে। জাফরের চোখে পানি। ব্যথা টা বোধহয় বুকে লেগেছে।
পাঁচ ভাই হন্ত দন্ত হয়ে পরেছে। ঝিলের শরীরের রক্ত দেখে পাগল প্রায় অবস্থা। হঠাৎ করেই মেয়েটা জ্ঞান হারায়।
” একটা শত্রুতার জন্য ঝিল কেন সাফার করবে বলো তো ? তাছাড়া ওঁদের মাঝে তো কোনো ঝামেলা নেই তাহলে সমস্যা কোথায় ?
_ রোহন শান্ত হও তুমি।চাইলেই সব ঠিক হয় না।
_ কেন ঠিক হবে না ? ইহরিমা সরকার কে মেনে নিয়েছে শিকদার বংশ।
তাহলে আমাদের সাথে কেন শত্রুতা ?
মনিরুল এতো ক্ষন চুপ করে ছিলেন। ব্যথাতুর জায়গায় আবার ব্যথা অনুভব হলো। ফোঁস করে শ্বাস ফেললেন। এক টা ছবির ফ্রেম বের করলেন।
ছবিটা তাঁর স্ত্রীর। বার কয়েক হাত বুলিয়ে বললেন
_ তোমার মা কে খুব ভালোবাসি রোহন। ইহরিমা তোমার মায়ের বান্ধবী। অহেদ কে ভালোবাসতো খুব ।
কিন্তু শিকদার বংশ তা মেনে নেয় নি। পূর্ব পরিচিত শিকদার বংশ। সকলের সাথে বেশ ভালো বন্ধুত্ব।
তোমার মা কে কথা দেই অহেদের সাথে ইহরিমা কে পালিয়ে যেতে সাহায্য করবো। অন্যায় ই করেছিলাম সেদিন । তবে সেটা ছিল পরিস্থিতি । দুটো ভালোবাসা কে আলাদা করতে চেয়ে ওরা উচিত করে নি।
শিকদার পরিবারে অসম্মান হয়েছিলো খুব। বিশ্বাস করো সেটা আমি চাই নি। তবে উপায় ছিলো না আমার ।
তারপর থেকেই মিত্রতা হয়ে উঠে শত্রুতা। শিকদার পরিবার মির্জা পরিবার কে ঘৃনা করে। আর আমরা ওহ শিকদার পরিবার কে ঘৃনা করি।
_ বাহ আজ কেন উল্টো বলছো ? ঝিল আর অভিনব কে কেন আলাদা করছো ?
_ দোষ টা তোমাদের ছিলো আব্বু। ক্ষমা চেয়ে নাও।
_ রাফাত।
_ কি বলবো আমি। ঝিলের দিকে তাকাও একবার। চোখ মুখ কেমন হয়ে গেছে।
_ ভাইয়া ক্ষমা চাইবে না রাফাত। রোহন বোন কে ভালোবাসা দোষের নয়। তবে সব আবদার পূরন হয় না ।
জাফরের কথায় সবাই অবাক হলো। ইবান বললেন
_ জাফর তুই
_ থামো তুমি। আমরা নত হবো না।
রোহন কিছু বলবে তাঁর আগেই চলে যায় ওনারা । রাফাতের রাগ হলো। রাগে গজগজ করতে লাগলো।
কেউ মাথা নত হবে না। এতো অহংকার ভালো নয়। শেষে ভুগতে না হয়।
*
” মম এমন কেন বলছো ? আমি চাই না তোমার সাথে মামাদের সম্পর্ক নষ্ট হোক। ঝিল আমার আছে আর আমারি থাকবে। তবে পরিস্থিতি সামলাতে হবে অন্য ভাবে। পুরুনো বন্ধুত্ব ফিরিয়ে নিতে হবে। জানো তো ক্ষত তে টান পরলেই পুরনো স্মৃতি মনে পরে। তেমনি কিছু করতে হবে। ”
_ মেয়েটার জন্য খারাপ লাগছে । কতোটা ভালোবাসে তোকে। ভাইয়ারা এখনো রেগে আছেন।
আচ্ছা ভুল তো আমি করেছি। ওদের কেন শাস্তি দিচ্ছে বল তো ।
_ মম প্লিজ। ঝিল কে স্ট্রং থাকতে হবে আর তোমাকে ওহ। আমি বলেছি ওকে ওর মা ফিরিয়ে দিবো। মেয়েটা খুব ভালো জানো তো।
উজার করে ভালোবাসে আমায়।
ইহরিমা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন
_ দেড় বছর দূরে রেখেছিস অভিনব। একটা মেয়ের মন কতো টা ভেঙে যেতে পারে ভেবে দেখেছিস ?
_ স্যরি মম। আমি তো তখন
_ তখন কি হুমম ? তখন ভালোবাসতে না আর এখন ভালোবাসো ? আমি তো জানতাম আমার ছেলে দায়িত্ববান। বিয়ে করা স্ত্রী কে কি করে ফেলে গেলে ?
অহেদ এর কথাতে মাথা চুলকোয় অভিনব। আসলেই চরম ভুল করেছে সে। তবে সব ছিলো পরিস্থিতির খেলা। অভিনব ভেবে রেখেছে মামা বাড়ির সবাই কে বিয়ের বিষয় টা জানাবে।
তবে সমস্যা হচ্ছে আগুনে ঘি ঢাললে আগুন তত তেতে উঠে।
ঘি ঢালা টা কি উচিত হবে ?
_ শোন অভিনব। ঝিলের একটু খোঁজ নে। মেয়েটা কেঁদে অবস্থা খারাপ করে ফেলেছে নিশ্চয়ই।
অভিনব ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে। একটু ভাবে ঝিল নিজেকে সামলাতে পেরেছে তো ?
মেয়েটা মাঝে মাঝে এতোটা বেখায়ালি হয় যে ভাষায় প্রকাশ হবে না।
বেশ কিছুক্ষন ভেবে ঝিল কে কল লাগালো।
কয়েক বার রিং হলো তবে ফোন রিসিপ হলো না। প্রচন্ড চিন্তা হলো। হয়তো আশে পাশে মানুষ আছে ভেবে আর কল দিলো না।
ফোনে ম্যাসেজ এর আওয়াজ ভেসে আসলো। আরফান ম্যাসেজ দিয়েছে। ছেলেটা স্যরি বলতে বলতে পাগল হয়ে গেল। অভিনব এতো বার বলল তবু ও শুনছে না।
যখন থেকে জেনেছে ঝিলের সাথে বিয়ে হয়েছে অভিনবর। তখন থেকে লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে।
অভিনব একটু করে হাসলো।টাইপিং করে বলল
” সাহায্য করবে আরফান ভাই ? তুমি তো জানো আমাদের বিয়ের কথা। একটা পথ খুঁজে দাও না প্লিজ ।”
ম্যাসেজ টা সেন্ড করা মাত্র ই অভিনবর ফোন বেজে উঠলো। ঝিল ফোন করেছে। অভিনব এতোটাই উত্তেজিত ছিলো যে ফোন রিসিপ করা হলো না।
দ্বিতীয় বার রিং হতেই রিসিপ করে ফেললো।
_ হ্যাঁ ঝিল। তুমি ঠিক আছো ?
_ ঠিক নেই। আপনার জন্য নিজে কে রক্তাক্ত করেছে।
_ রোহন ! মজা করছো আমার সাথে ?
_ না। আপাতত ঘুমুচ্ছে। একটু আগে ডাক্তার ইনজেকশন পুস করে দিয়েছে। বুঝে উঠতে পারছি না মেয়েটা কেন আপনাকে এতো ভালোবাসে। কয়েকদিনের পরিচয়ে এতো ভালোবাসা!
অভিনব আর কথা বাড়ালো না। ফোন টা রেখে দ্রুত বেরিয়ে পরলো। ঝিল কে দেখতেই হবে। মেয়েটা এমন বোকামি কি করে করলো ?
#ধূসর_রঙের_প্রজাপতি
#ফাতেমা_তুজ
#part_46
রক্তিম আকাশে মেঘের মেলা। মেঘ নাকি কুয়াশা ঠিক ঠাওর করা যাচ্ছে না। শীতের পরিযায়ী পাখি রা মাথার উপর দিয়ে ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে । কুয়াশা যেন আকাশ কে চাঁদরে মুরিয়ে নিয়েছে। সূর্যের দেখা মেলা ভার।
অভিনবর মন খারাপ। আজ চারদিন হলো ঝিলের সাথে দেখা হয় না। কয়েক মিনিট ফোনে কথা বলে কি মন ভরে ?
এই যে সেদিন ঝিলের জন্য ওদের বাসায় গিয়েছিল। শুধু মুখেই ফিরে আসতে হয়েছে। কড়া গার্ড দেওয়া। মারামারি করে নিজের ইমেজ খারাপ করতে চায় না সে। ফোন দিলেই ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদে মেয়েটা। বাড়ির ছেলে পুলে গুলো ফুল সাপোর্ট এ থাকলে ও বড় রা মানতে পারছেন না।
হাজার হোক ত্রিশ বছরের দ্বন্ধ এতো সহজে কি যায় ?
সূর্যের সেটুকু আলো পৃথিবী কে রাঙিয়ে ছিলো সেটা ও নিভে যাচ্ছে। সারাদিনের কর্ম ব্যস্ততা কাটিয়ে এখন সে বিশ্রাম নিবে। মন খারাপের মাঝে অভিনবর বাজে এক ইচ্ছে হলো।
হাতের কাছে সিগারেট থাকলে এই অনুচিত কাজ টা নির্দ্বিধায় করে নিতো। আফসোস সেটা ও নেই। হঠাৎ ছোট ছোট পায়ের আওয়াজ এলো।
পেছন ফিরতেই ফুল আর রূপা কে দেখতে পেল। অভিনব এগিয়ে ফুল কে কোলে তুলে বলল
_ কি হয়েছে ফুল ঝুঁটি ?
_ দুপুরে খেতে আসলে না কেন ভাইয়া ?
_ খেতে ইচ্ছে করছে না যে আমার।
ফুল রূপার দিকে তাকালো। রূপা একটু এগিয়ে এসে বলল
_ তুমি না খেলে আমরা ও খাবো না।
_ রূপা তোমার এখনো লাঞ্চ করো নি ?
রূপা আর ফুল মাথা কাত করলো। অভিনবর ভেতরে লুকায়িত দীর্ঘশ্বাস টা কেমন করে যেন বেরিয়ে আসলো। এদের মুখের দিকে তাকিয়ে বারন করতে পারছে না। তাছাড়া না খেয়ে থাকা টা বোকামি। এতে কোনো সমাধান তো হবেই না উল্টো অসুস্থ হতে হবে।
পরিশেষে দুজন কে নিয়ে ডাইনিং এ চলে আসলো। ঝিলের কথা ভাবতেই খাবারের ইচ্ছে টা মরে যাচ্ছে। না জানি মেয়েটা খেয়েছে কি না ।
” মাহিন প্লিজ কিছু করো ! ঝিল কি এখনো খাচ্ছে না ? ”
_ শুনছে না কারো কথা। তুমি একটু বোঝাও প্লিজ। মেয়েটা পুরো পাগল। আমাদের ই ধমকাচ্ছে।
_ হাতের জখম টা কতদূর ?
_ মোটামুটি ঠিক ঠাক ই আছে । তবে ঔষধ না খেলে বিপরীত হতে পারে ।
অভিনবর মুখে বিরক্তি। ঝিল কেন বাচ্চামো করছে। এতো বার বলার পর ও শুনছে না। আচ্ছা এভাবে কি সমাধান হয় ?
মাহিন কোনো শব্দ না পেয়ে কান থেকে ফোন নামালো। কল ঠিক দেখে আবার বলল
_ আমার কথা শুনছো অভিনব ?
_ হ্যাঁ শুনছি। আচ্ছা শোনো না কোনো ভাবে দু একদিনের মধ্যে একটু বাইরে নিয়ে আসতে পারবে ওকে ?
মাহিন একটু ভেবে সম্মতি জানালো। অভিনবর অধর কোনে হাসি ফুটলো। মেয়েটাকে কাছে পেলে ভালো করে বোঝানো যাবে। দিন রাত কান্না করে ঠান্ডা বাঁধিয়েছে। এভাবে চললে জ্বর বাঁধাবে অতি শীঘ্রই।
*
দানেশ এর সাথে লডু খেলছে রূপা। টান টান উত্তেজনা নিয়ে খেলছে। ইহরিমা দু চোখ ভরে দেখছে। ছোট সময়ে ভাইদের সাথে ডাবা খেলতেন ওনি। কতো সুন্দর ছিলো সে সময়।
ডিবাইনে বসে নখ কামড়াচ্ছে অভিনব । এই বিচিত্র স্বভাব টা ছিলো না তাঁর । আজকাল সব কেমন উল্টো পাল্টা হচ্ছে। মুখের রঙ পাল্টে গেছে। অতি চিন্তায় চোখ দুটো কোটরে ঢুকে গেছে। ফর্সা মুখে লাল লাল ছোপ তাঁর সাথে চোখের নিচের অংশে কালি জমেছে। ভয়ঙ্কর সুন্দর ছেলেটা কে আজকে ভয়ঙ্কর ই লাগছে। এমন বিদঘুটে রূপ কখনো হয় নি তাঁর। মানুষ কতোটা পরিবর্তন হতে পারে তাঁর ই উদাহরন। অহেদ অনলাইনে মিটিং সেরে লিভিং রুমেই আসছিলেন। প্রচন্ড কাজ হাতে ব্যস্ত ওনি।
আমেরিকায় বেশ কয়েকটি প্রপার্টি কেনার কথা। তবে এখন কিনতে চাইছেন না।
সেটা নিয়ে পার্টনার দের সাথে একটু দ্বন্ধ চলছে। যদি ও সেটা অতি সূক্ষ্ম আর অন্তর গস্ত। তবে দুশ্চিন্তা যে মরন ব্যাধির মতো।
অভিনবর ধ্যান অন্য দিকে। অহেদ ইশারা করতেই ইহরিমা উঠে দাঁড়ালো। দুজন দুপাশে বসে পরতেই অভিনবর ধ্যান ভাঙলো।
_ খুব বেশি চিন্তায় আছো মনে হচ্ছে ?
_ নো ডেড। আম ওকে !
_ মামাদের জানিয়ে দিলে ভালো হতো না ?
_ উহহুহ। মম ইউ নো দ্যাট কত বড় মনের দ্বন্দ্ব চলছে। এটা শুনলে ডিভোর্স পেপার রেডি করে ফেলবে। জানোই তো সবার মাঝে এক অদ্ভুত ধারনার সৃষ্টি হয়েছে।
তাই তাঁর আগে আমাদের এমন কিছু করতে হবে যার কারনে দু পরিবার একে অপরের আগের টান অনুভব করে।
অতি মনোযোগ দিয়ে কথা গুলো শুনলেন অহেদ আর ইহরিমা । বরাবর ই ছেলের সিদ্ধান্ত কে প্রাধান্যে দিয়ে এসেছেন। এতে করে লাভ ই হয়েছে। অভিনবর মস্তিষ্ক বেশ দূরন্ত আর খোলা মেলা।
চট জলদি সব সামলে নিতে পারে। অভিনব একটু হাসার চেষ্টা করলো।বাবা মা কে সান্ত্বনা দিলে ও মন কে বোঝাতে পারছে না।
প্রিয় মানুষ কে হারানোর ব্যথা অনুভব হচ্ছে। যে যন্ত্রনা একটু একটু করে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে।
তামিম এসে একটু আগে ডেকে গেছে। অভিনব কে নিয়ে গুরুত্বপূর্ন আলোচনা করবে। এতো রাতে আলোচনা করার একটাই কারন যাতে কেউ বুঝতে না পারে। গাঁয়ে জ্যাকেট জড়িয়ে হাঁটা লাগালো অভিনব। পায়ের গোড়ালি তে ব্যথা অনুভব হলো। ভ্রু দুটো বেঁকে গেল কারন গোড়ালি তে পিন ফুটেছে। পিন টা হাতে তুলেই বুক ভারী হয়ে গেল। ঝিলের সেপটি পিন এটা। চোখ যেন বর্ষন নামাতে চাইছে।
নিজের উনত্রিশ বছরে এসে অনুভব হলো একটা পিচ্ছি মেয়ের জন্য সে উম্মাদ হতে চলেছে।
ভালোবাসার এমন তেজ সত্যিই অবিশ্বাস্য। চোখের পানি কে বাড়তে না দিয়ে লাইব্রেরির দিকে রওনা হলো।
প্রচুর উত্তেজনা নিয়ে হাঁটাহাটি করছে তামিম আর সাদাদ। অন্য সময় হলে আরফান বিরক্ত হতো। তবে আজ হচ্ছে না। টকটবগে রক্তে নিজে ও দাঁড়িয়ে পরলো। বন্ধু মহলের দুষ্ট ছেলে সে। তবে প্রেম করা না হলে ওহ প্রেমের হেল্প করেছে বহুবার।
পুরনো দিন গুলো মনে হতেই মুখে হাসি ফুটে ।
অভিনব স্থির নয়নে সবার নির্লিপ্ত মুখে দিকে কিছুক্ষন তাকালো তারপর ই বললো
_ তোমাদের পায়চারি হয়েছে ?
_ নাহ !
_ তাহলে আমি গেলাম।
_ আরে অভিনব চলে যাচ্ছিস কেন ?
_ তো ?
_ আরে ভাইয়া শোনোই না ঝাক্কাস এক প্ল্যান করেছি। এবার পাখি ধরা দেবেই।
_ সাদাদ কাল কি একটা প্ল্যান বলেছিলি মনে আছে ?
_ স্যরি ভাইয়া । আসলে মুভি তে হয় না মাথায় বন্ধুক ধরলেই সব ঠিক হয়ে যায় তাই আর কি
সাদাদ কে বলতে না দিয়ে তামিম অভিনবর পাশে বসলো। চার ভাই মাথা কাছাকাছি করে প্ল্যান নিয়ে আলোচনা করতে লাগলো।
*
” মৌন আমি পারছি না সামলাতে। ওকে ছাড়া আমি বাঁচবো না রে। আমাদের বিয়ের কথা বললে পাপা রা কেলেঙ্কারি করে বসবে। দু পরিবার আবার বিবাদ করবে। আমাদের ডিভোর্স করিয়ে ছাড়বে। ”
_ এমন বলিস না তো। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। একটু সাহস রাখ দোস্ত।
ঝিল উত্তর দিলো না। হাঁটু তে থুতনি দিয়ে বসে রইলো। ঝিলের এমন অবস্থা দেখে মৌনতার কপালের চামড়ায় ভাঁজ সৃষ্টি হলো। ভেতর থেকে আসলো দীর্ঘশ্বাস। বুক ফাঁটা হাহা কার নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো ।
আজ সারাদিন ঝিল কিছু মুখে তুলে নি। এভাবে মানুষ বাঁচে ?
করিডোর দিয়ে নিচে নামার সময় রোহনের রুম থেকে আসা কন্ঠস্বরে থেমে গেল। কাউকে ইচ্ছে মতো বকা দিয়ে যাচ্ছে। কন্ঠস্বর এতোটাই তীব্র যে মৌনতা বার বার কেঁপে উঠছে।
হাতে থাকা ওয়াটার বোতল টা সাইট টেবিলের সাথে লেগে ঝনঝন আওয়াজ তুলে নিলো।
দ্রুত স্থান ত্যাগ করতেই হাতে টান অনুভব হলো।
_ কে !
_ আমি মৌনতা !
মৃদু আলো তে একটু ঝুঁকে নিলো রোহন। মৌনতা কে ভয় পেতে দেখে হাত টা ছেড়ে দিলো। খানিকটা কঠিন স্বরে বলল
_ এতো রাতে এখানে কি করছিলে ?
_ নাহ মানে আমি
_ তুমি কি ?
_ আমি আসলে ঝিলের জন্য খাবার নিতে কিচেনে যাচ্ছিলাম। ওহহ তো এখনো খায় নি।
রোহন কিছুক্ষন ভ্রু কুচকে তাকালো। সারা দিন বাসায় ছিলো না আজ। তাই ঝিলের খবর নেওয়া হয় নি। সুমার বাসায় গিয়ে ও সুমা কে পায় নি। মেয়েটা কে ভালোবাসাই ছিলো জীবনের সব থেকে বড় ভুল। আশে পাশের সব জায়গায় ঝিলের নামে বাজে মন্তব্য রটিয়েছে।
শুধু মাত্র ভালোবাসার খাতিরে বাসায় বিষয়টা জানতে দেয় নি।
তবে এর শাস্তি তো পেতেই হবে। রোহন কিছু বলছে না দেখে মৌনতা বিরক্ত হলো। যাবে কি যাবে না বুঝতে পারছে না। মিনিট পাঁচেক পর রোহন পেছন ঘুরে তাকিয়ে অবাক স্বরে বলল
_ এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন ?
_ আপনি তো যেতে বলেন নি ।
মৌনতার কথায় থতমত খায় রোহন। পেছন ঘুরে বলে
_ যাও খাবার নিয়ে আসো আমি ঝিলের কাছে যাচ্ছি।
সম্মতি পেয়ে এক সেকেন্ড দাঁড়ায় না মৌনতা। বাতাসের গতি তে ছুটে যায়। যেন কোনো ভয়ঙ্কর মানবের সামনে দাড়িয়ে ছিলো।
অন্ধকার রুমে বসে আছে ঝিল। রাত দুটো বেজে গেছে প্রায়। ঘুম যেন হারাম হয়ে গেছে। রাত্রি বড্ড কঠিন। কারো জন্য সুখের আর কারো জন্য দুঃখের। কেউ ভালোবাসায় মত্ত কেউ বা বিচ্ছেদের রেখা গড়তে। এভাবেই কালের আবর্তনে সবাই কে চলতে হয়।
ঝিল ও তাঁর ব্যক্তিক্রম নয়। সূক্ষ্ম ভাবনায় মনের ফাঁক ফোঁকরে গহীন ব্যথা অনুভব হলো।
রোহনের হাতের স্পর্শে ঝরঝরে কাঁদে। ভাই কে জড়িয়ে ব্যথা কমানোর চেষ্টা চালায়। আপন মানুষ নাকি ব্যথা কমায় কিন্তু ব্যথা কমছে না কেন ?
ব্যর্থতায় নুইয়ে যাচ্ছে ঝিল। পাপাদের সাথে কথা বলে না। তবু ও তাঁদের কঠোরটা যাচ্ছে না।
আজ মনে হচ্ছে খুব পর হয়ে গেছে। এভাবেই বুঝি সম্পর্ক ঠুনকো হয়ে যায় ?
মৌনতা খাবার নিয়ে আসে। রোহন খাবার হাতে নিতেই সরে যায় ঝিল।
কথা না বাড়িয়ে অভিনব কে ফোন লাগায়।
_ হ্যাঁ রোহন সব ঠিক আছে ?
_ খাচ্ছে না !
_ মানে, জোড় করো !
_ আমাদের কথা মানে ওহ ? আস্ত বেয়াদব হয়ে গেছে। আগে ভাই দের ভালোবাসতো এখন বাসে না।
রোহনের কথায় ঝিল কিছু বলে না। মনের ব্যথা সারানোর উপায় অভিনবর সাথে সান্নিধ্য । হাজার বছর দূরে থাকলে ও কষ্ট হয় না । যদি না বিচ্ছেদের রেখা সৃষ্টি হয়। মানুষ তো আশা নিয়েই বাঁচে।
_ আচ্ছা ফোন টা দাও আমি দেখছি।
ফোন দিতেই ঝিল নাকোচ করে দেয়। কথা বললে ব্যথা বাড়বে। মৌনতা বোঝায় অভিনবর ওহ তো কষ্ট হচ্ছে।
পরিশেষে ফোন কানে তুলে মেয়েটা।
রোহন ইশারা করে মৌনতা কে বাইরে আসতে। মৌনতার মধ্যে আড়ষ্ঠতা দেখে নিজেই হাত ধরে বাইরে নিয়ে যায়। দ্রুত গতিতে বলে
_ পাশের গেস্ট রুমে ঘুমিয়ে পরো। ঝিল একা থাকুক আজ।
মৌনতা মাথা ঝাঁকায় । রোহনে লম্বা কদম ফেলে নিজ রুমে এগিয়ে যায়।
কেউ কোনো কথা বলছে না। একে অপরের নিশ্বাস গুলো গুনে চলেছে। ভারী নিশ্বাসে প্রকৃতি ও যেন ছন্দ তুলেছে। অভিনবর অতি কাতর কন্ঠে ভেসে আসতেই ঝিলের চিত্ত কেঁপে উঠলো।
_ ঝিল !
_ হুম
_ কেন পাগলামি করছো তুমি ? এভাবে না খেয়ে শরীর খারাপ করবে আমার চিন্তা হবে না বলো ?
_ আমি পারছি না আর।
_ ভালোবাসো তো আমায় ?
_ অভিনব!
_ তাহলে কেন গুটিয়ে যাচ্ছো। দুর্বলতার পরিচয় দিয়ে কি বোঝাতে চাউ আমাদের ভালোবাসা কপূরের ন্যায় ?
_ আমি জানি না , কিচ্ছু টি জানি না আমি । তোমাকে না পাওয়ার বেদনা আমি মেনে নিতে পারছি না। কেন আমাদের দূরে যেতে হচ্ছে । কেন তুমি থেকে ও নেই। আমি যে তোমাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এই কয়েকটা দিন আমি আমার জীবনের সেরা মুহুর্ত উপভোগ করেছি। নিজ অনুভূতির সাথে পরিচিত হয়েছি। ভালোবাসি আমি , খুব ভালোবাসি।
ঝিলের কন্ঠে অভিনবর বুকে ব্যথা অনুভব হলো। সান্ত্বনার বুলি দিতে চায় না। তবে কাল যেহেতু দেখা করার সুযোগ মিলবে তাই বলতে ইচ্ছে হলো। তবে মনের গহীন থেকে সে ইচ্ছে টাকে দমিয়ে নিলো। যদি দেখা না হয় ।
_ সারারাত প্রেমালাপ করেছো কখনো ?
_ মানে ?
_ এই যে সারা রাত কথা বলা। যদি তুমি খেয়ে নাও তো আমি সারা রাত কথা বলবো। আই মিন ফোনের চার্জ শেষ না হওয়া অব্দি ।
থাকবে তো আমার সাথে ? একটু ভালোবাসার সান্নিধ্য দেবে তো আমায় ? নিশ্বাস গুনার সুযোগ দেবে আমায় ?
#ধূসর_রঙের_প্রজাপতি
#ফাতেমা_তুজ
#part_47
ক্যাফেটেরিয়া তে বিশাল সমাবেশ বসেছে। সমাবেশের প্রধান আকর্ষন মির্জা পরিবার আর শিকদার পরিবার। প্রচন্ড অবাকের সহিত দাঁড়িয়ে আছে অভিনব , ঝিল। সকালে প্ল্যান করে এসেছিলো অভিনব আর ঝিল । তবে যেটা হলো সেটার জন্য মোটে ও প্রস্তুত ছিলো না তাঁরা । ক্যাফে তে শিকদার পরিবার আর মির্জা পরিবার আগেই উপস্থিত ছিলো। এখন পিনপিন নিরবতা চলছে। অভিনবর হাত টা চেপে ধরে রেখেছে ঝিল। ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে।
অভিনবর দৃষ্টি বরাবরে মতোই স্থির। আজব লোক , এমন কঠিন পরিস্থিতিতে ও কি করে শান্ত আছে ?
_ তোমরা নিজেদের সিদ্ধান্তেই অটল থাকবে ?
_ জি !
_ আমাদের কথার কোনো মূল্য নেই ইহান?
_ অবশ্যই আছে বড় মামা। কিন্তু ঝিল ও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ন। আমি সবাই কে নিয়েই বাঁচতে চাই।
ইববান ভ্রু কুটি করে তাকালেন। ইকবালের দিকে তাকিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করলেন। দুটো পরিবারের ঝামেলা চলছে তাঁর উপর আরেক ঝামেলা। তাই এক গভীর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ওনারা। ছেলে মেয়েরা যখন নিজেদের মতামত কে গুরুত্ব দিচ্ছে তাই একটা সুযোগ দেওয়া দরকার।
ইকবাল ঝিলের পাশে এসে দাঁড়ালেন। মাথায় স্নেহের হাত রেখে বললেন
_ তোর কোনো ইচ্ছেই অপূর্ন রাখি নি। এটা ও রাখতাম না যদি না যাই হোক, তবে এর জন্য পরীক্ষা দিতে হবে।
_ পরীক্ষা!
কথা টা অবাকের সহিত বললো ঝিল । অভিনবর মুখে একটু চিন্তার ছাপ দেখা গেল। ঝিল ভাইদের দিকে তাকালো। ভাই রা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে । যখন পরিবারের কঠিন সিদ্ধান্ত হয় তখন ছোট রা কথা বলে না। তবে ঝিলের দৃষ্টি দেখে রোহন বলে ফেললো
_ কি পরীক্ষা বড় কাকা ?
_ জানতে পারবে তাঁর জন্য ধৈর্য্য ধরতে হবে।
আর পরীক্ষায় যদি পাস না হয় তো ওদের আলাদা হতে হবে।
_ কি পরীক্ষা বড় পাপা ?
_ পরীক্ষা টা হলো অভিনব মির্জা পরিবারে আগামী এক বছরের জন্য থাকবে । আর তুমি শিকদার পরিবারে।
_ হোয়াট ! আমি তোমাদের ছেড়ে
ঝিল কে বলতে না দিয়ে জাফর বললেন
_ তুমি তো তোমার সিদ্ধান্তে অটল। আমাদের ছেড়ে থাকার জন্য তুমি প্রশস্ত ওহহ তাহলে সমস্যা কোথায় ? তুমি যেমন পারবে আমরা ও পারবো।
শেষ কথাটা বলার সময় জাফরের গলা ধরে আসলো। চোখে পানি চিক চিক করছে। তবু ও তিনি কঠোর গলায় বললেন
_ ওদের কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সময় দেওয়া হোক।
একে একে সবাই বের হয়ে গেল। অভিনব আর ঝিল কে কথা বলার জন্য কিছু টা সময় দেওয়া হলো। অহেদের দিকে এক পলক তাকালো অভিনব। তিনি আশ্বস্ত করলেন। মুহুর্তেই পরিবেশ থমকে গেল।
আধ ঘন্টা পর দুজন এক মত পোষন করলো। যেহেতু পরিবারের সবাই কে নিয়ে থাকতে চায় তাই এই পরীক্ষা টা দিতেই হবে।
ঝিলের চোখ মুখ ফুলে গেছে। কারন শর্তে উল্লেখ করা আছে আগামী এক বছর কেউ কারো সাথে দেখা করতে পারবে না। অভিনব এতো বোঝানোর পর ও মেয়েটার মস্তিষ্ক মানতে চাইছে না।
দুজনে দু দিক ফিরে বসে রইলো। অভিনব বেশ কিছুক্ষণ ভেবে বলল
_ আমরা ফোনে যোগাযোগ রাখতে পারবো তো ।
ঝিল উত্তর দিলো না। অভিনবর মুখে আষাঢ়ের মেঘ জমে গেল। দু পরিবার এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে দিশা পাওয়া যাচ্ছে না।
ইসহ আজকে সবাই মিলে প্ল্যান করার কথা ছিলো। কিন্তু এরা সবাই আরো এক ধাপ এগিয়ে।
ঝিলের দু বাহু টেনে ধরতেই ফ্যাচ ফ্যাচ করে কেঁদে উঠলো ঝিল। মনের ভাঙচুরে ব্যথিত অভিনব। ঝিল কে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে নিজেই অশান্ত হয়ে পরলো।
দু হাতে নিজের চুল খামচে ধরলো। ঝিলের সে দিকে ধ্যান নেই।
হঠাৎ করেই অভিনবর বুকে মাথা রাখলো ঝিল। প্রশান্তি তে চোখ বুঁজে নিলো । অভিনবর হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে কয়েকগুন।
_ আমরা পারবো না ঝিল ? আমাদের ভালোবাসা কি এতো টাই ঠুনকো? সামান্য হাওয়া তেই যা ভেঙে যায় তাঁকে কি বলবে তুমি?
_ আমি নিজেকে সামলে নিয়েছি । আমাদের পারতেই হবে । চেষ্টা করে যাবো বাকি টা আল্লাহর ইচ্ছা।
ঝিলের এমন পরিবর্তনে হতবুদ্ধি হারিয়ে ফেলে অভিনব। একটু আগে যে মেয়ে বাচ্চা দের মতো ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদছিলো সেই মেয়েটা এখন পূর্ন বয়স্ক দের মতো কথা বলছে। আশ্বস্ত করছে সেই মেয়েটাই।
সবাই কে আসতে দেখে অভিনব ঝিলের থেকে দূরে সরে গেল। না জানি কি হতে চলেছে। কি আছে ভাগ্যে কে জানে। একটাই প্রার্থনা শেষ টা যেন সুখময় হয়। না হলে মৃত্যু যন্ত্রনা ভোগ করতে হবে। বিচ্ছেদের নীল ব্যাথা অনুভব করার শক্তি যে নেই।
*
ব্যাগ গোছানো শেষ মৌনতার। দুটো ব্যাগ গোছাতে গোছাতে তাঁর অবস্থা নাজেহাল। হাঁটু তে থুতনি গুঁজে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে ঝিল। আজ কেই শিকদার পরিবারে অবস্থান করতে হবে। এতো এতো মানুষের সাথে কি করে থাকবে আদৌ কি মানিয়ে নিতে পারবে সব মিলিয়ে চিন্তার শেষ নেই।
মৌনতা আরক্ত হয়ে বলল
_ এভাবে বসে থাকলে কোনো কিছু হবে ? জীবন টা তো থেমে থাকবে না !
_ তো ? কি করতে বলছিস ?
_ সঠিক ভাবনা ভাবতে বলছি , মনোবল বাড়া সাহস যোগাড় কর।
গা দুলিয়ে হাসে ঝিল। যার ভবিষ্যত ধোঁয়াশা তাঁর আবার মনোবল। মানুষ না হয়ে পাথর হলে না হয় নির্নিমেষ মনোবল বেড়ে যেতো। এখন কি করে সম্ভব ?
ঝিলের ভাবনার মাঝে উপস্থিত হয় রোহন আর আহনাফ। চোখে মুখে কালি জমেছে। সারা রাত ঘুমায় নি। মোট কথা মির্জা পরিবার কাল সজাগ ছিলেন। সব থেকে প্রিয় সদস্য কে বিদায় জানানো মোটে ও সহজ কার্য নয়।
_ ঝিল বনু এভাবে ভেঙে পরছিস কেন ?
মাথায় আহনাফের স্পর্শ পেয়ে চমকে তাকায়। কোটরে যাওয়া চোখ গুলো পিট পিট করছে। একটু হাসার চেষ্টা করে ভাইয়ের বাহু ধরে উঠে দাঁড়ালো । যেন শরীরে বিন্দু পরিমান শক্তি নেই। নিলাভ আকাশের বুকে যেমন মেঘ জমে ঠিক তেমনি মেঘ জমেছে তাঁর বুকে । অভিমানে কান্না চলে আসছে। নিজেকে সামলে নিয়ে রোহনের দিকে এগিয়ে যায়। একটু হাসে যেই হাসিতে ছেলেটার বুক ভারী হয়। অতি সাবলীল গলায় ঝিল বলে
_ এমন দিন দেখতে হবে জানলে মির্জা পরিবারে জন্মগ্রহণ করতাম না।
সুখ না থাকলে মানুষ সুখের পেছনে ছুটে। আমি ঠিক কিসের পেছনে ছুটছি বলো তো ?
ধোঁয়াশা অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে। একটু ভুল হলেই সমস্ত টা শেষ।
_ বোন
হাত উঁচিয়ে আহনাফ কে থামিয়ে দেয় ঝিল। চোখের পানি যেন বাঁধ ভেঙেছে। ভাইয়ের দু বাহু ঝাঁকিয়ে ঝরঝরে কেঁদে উঠে।
হঠাৎ করেই মেঝে তে বসে পরে। হাত পা ছড়িয়ে কাঁদে । অশরীরী মতো কান্নার আওয়াজের সাথে ভেসে আসে অভিমানের কন্ঠস্বর
_ এতো সুখ কেন দেখালে বলো তো ? আমি তো সুখী ছিলাম। যা চাইতাম তাই পেয়ে যেতাম। একটা ব্যথা ছিলো যে ব্যথা ভোলানোর চেষ্টা তোমরা করেছে। অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম আমি।
তবে এখন কেন ব্যথা ভোলানোর কেউ নেই ? সুখ দেখিয়ে কেন সুখ কেড়ে নিলে তোমরা।
উত্তর আছে তোমাদের ?
কারো মুখে কোনো কথা নেই। এরি মাঝে রোহন বেরিয়ে যায়। চোখ দুটো ব্যর্থ হয়েছে। বোনের সামনে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করে আরো দূর্বল অনুভব করাতে চায় না।
মৌনতা এক কোনে দাঁড়িয়ে হিচকি তুলে কাদছে। বেস্ট ফ্রেন্ড এর কষ্ট যেন ওকে নুইয়ে দিয়েছে। ছুটে চলে যায় সে। মিনিটের মাঝে চলে আসেন জাফর মির্জা। অত্যন্ত কঠোর তাঁর কন্ঠস্বর যা ক্ষনে ক্ষনে অবাক করে ঝিল কে।
যেই পাপা মেয়ের প্রতি টা কথা কে কথা হিসেবে নয় বরং কর্তব্য হিসেবে পালন করেছে সে আজ এতোটা পরিবর্তন। ঝিলের চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হলো মানুষ বদলায়।
গলায় এক দলা থু থু চলে আসলো। এমন পরিবার তাঁর ?
যে পরিবার নিজের শত্রুতা বহন করার জন্য মেয়ের সুখ কেড়ে নেয়। মুহুর্তেই রাগ অভিমান বিদ্রূপে পরিনত হলো।
নিজের জন্য ই বাঁচতে হয়। জীবনে একাই লড়াই করতে হয়। কেউ শেষ অব্দি পাশে থাকে না।
আহনাফের দিকে তাকিয়ে প্লাস্টিকের হাসি দিয়ে বলল
_ আমাকে গাজীপুর দিয়ে আসো ভাইয়া।
_ কিন্তু এখনো তো
_ কথা বাড়িয়ে ওহ না। চলে যেতেই হবে যখন তো আগে যাওয়াই ভালো।
কায়া দেখলে মায়া বাড়ে আমি চাই না মায়া বাড়াতে ।
সবাই আমাকে দৃরে ঢেলে দিতে পারলে আমি কেন পারবো না ?
কথা গুলো ধনুক থেকে ছোঁড়া তীরের মতো বুকে বিধলো। জাফরের চোখে অশ্রুর ঘন রেখা। ঝিল সে দিকে তাকালো না।
বেড়িয়ে আসলো, করিডোরে বড় পাপা আর মেঝো পাপা কে দেখতে পেল। সামান্য হাসলো , দোয়া নেওয়ার ইচ্ছে হলো না। তবু ওহ সবাই কে সালাম করে গেল। পাঁচ ভাই দাঁড়িয়ে, ঝিলের দিকে হাত বাড়াতেই ঝিল বলল
_ পর কে আপন করার চেষ্টা করো না। আসি, সবাই ভালো থেকো।
রোহন ভাইয়া মৌন কে সেফলি বাসায় পৌছে দাও।
বোনের শেষ ইচ্ছে টা দায়িত্ব নিয়ে না হয় পালন করলে।
রোহনের গলা ধরে আসে। আহনাফের সাথে হাঁটা লাগায়। এক পা দু পা করে শ পা পেরিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। সা সা করে ছুটে চলে গাড়ি। পেছন ঘুরে না ঝিল। প্রচন্ড মায়া , যে মায়া মানুষ কে অমানুষ করে তুলে। আবার যে মায়া অমানুষ কে মানুষ করে তোলে।
*
আহনাফ আর সাদাদ একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ঝিল আর অভিনব কে দেখা করার সুযোগ দিয়েছে। ঝিলের নির্লিপ্ত চাহনির সাথে মুখের ঘনঘটা অভিনব কে অবাক করে দিলো।
কেন যেন হাত বাড়াতেই উসখুস করছে তাঁর মন। অভিনবর আড়ষ্ঠতা দেখে ঝিল ই এগিয়ে আসলো। দু জনের চোখাচোখি হলো । ঝিল হাসলো সাথে অভিনব। বেশ সাবলীল গলায় বলল
_ আমি অপেক্ষা করবো অভিনব। জানি না কি হবে । তবে শেষ দিন অব্দি আমি তোমার ই থাকবো।
_ আমি ওহ
কথা টা পরিপূর্ন না করেই ঝিল কে জড়িয়ে নিলো। ঝিলের ঘাড়ে মুখ গুঁজে দিয়ে বলল
_ কি মোহ দিয়েছো তুমি ? আমি যে পাগল হয়ে গেছি।
আমাদের পথ এতো টা দুর্গম না হলে ও তো পারতো। যদি আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলি ?
_ কখনো ই না। না আমি তোমাকে হারাবো আর না তুমি আমাকে হারাবে। লড়াই করার আগেই হেরে যাবে ?
অভিনব উত্তর দেয় না। ঝিল কে একদম নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। অভিনবর চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরতেই ঝিলের অন্তর কেঁপে উঠে। খামচে ধরে অভিনব কে। হঠাৎ ই অনুভব হয় 365 টি দিন 8760 ঘন্টা 525600 মিনিট 31536000 সেকেন্ড দূরে থাকতে হবে।
বুকের ব্যথা তীব্র থেকে তীব্র হলো। ঝিল নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অভিনবর হাত দুটো মুঠো বন্দী করলো। মুহুর্তেই হেসে ফেললো। অভিনবর হাতের কাছে সে পিচ্ছি। অভিনব ভ্যাগা চাহনি তে ঝিল কে দেখে নিলো। ঝিলের কপালে শুষ্ক ঠোঁট ছুঁইয়ে হাসলো।
হাসি মুখে বিদায় দিতে চাইলে ও কান্না চলে আসলো। দু চোখ যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ঝিল দু হাত দূরে গিয়ে ঘুরে তাকালো । অভিনব কে পেছন থেকে জড়িয়ে বললো
_ ভালোবাসি খুব ভালোবাসি তোমায় !