#নক্ষত্র_বন্দনা
#পর্ব_২৯
#শেষাংশ (প্রথমভাগ)
#লেখায়_জারিন
১৭৪.
‘ আমাদের এখনো বিয়ে হয়নি রাফিদ। তুমি আমাকে এভাবে টাচ করতে পারো না।’ নিজেকে সামলে নিয়ে কড়া গলায় বললো মেহের। তার এই কথা যেন ঝটকায় রাফিদকে বাস্তবের মূলে ফিরিয়ে আনলো। তড়িৎ গতিতে মেহেরকে ছেড়ে দিয়ে তার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো সে। বিচলিত এবং অস্থির গলায় প্রশ্ন করলো মেহেরকে।
‘এই আজকে না তোমার বিয়ে?
‘হ্যাঁ তো!’ হাসি হাসি মুখে জবাব দেয় মেহের।
‘তাহলে তুমি এখানে কি করছো?’
‘দাঁড়িয়ে আছি।কেন দেখতে পাচ্ছো না?’ রসিকতার স্বরে বললো মেহের। ইরিন রাফিদের পেছনে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছে আর মিটমিটিয়ে হাসছে।
‘হ্যাঁ, তা পাচ্ছি। কিন্তু,না মানে বিয়ে তো…এখানে কিভাবে এলে তুমি?’ কনফিউজ হয়ে প্রশ্ন করলো রাফিদ।
‘নক্ষত্র ভাইয়ার সাথে এসেছি। ফ্লাইটে করে। ‘সাবলিল ভংগিতে বললো মেহের।
‘নক্ষত্র ভাইয়া?! ‘ অবাক স্বরে প্রশ্ন করে রাফিদ।
‘হু’। মাথা উপরনীচ করে নাড়িয়ে বলে মেহের।
‘মি. নক্ষত্রের কথা বলছো তুমি?’
মেহের পুনরায় মাথা নাড়িয়ে সায় দেয় রাফিদের কথায়। তারপর বললো, ‘বিশ্বাস না হলে ভাবীকে জিজ্ঞেস করতে পারো। ভাবী জানে সবটা।’
‘কোন ভাবী?’
রাফিদের প্রশ্নে মেহের আঙুল উঁচিয়ে ইশারায় ইরিনকে দেখালো। রাফিদ মেহেরের ইশারা অনুসরণ করে পেছনে তাকিয়ে ইরিনকে দেখে বোকা বনে গেল। সামনে ফিরে অবাক স্বরে মেহেরকে প্রশ্ন করলো, ‘ইরিন তোমার ভাবী হয় কি করে? ‘
‘তোমার ভাইয়ের বউ…তোমার ভাবী। তো….আমারও তো ভাবীই হবে তাই না?’
রাফিদ এবারে চরম বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে গেল মেহেরের কথায়। চমকের গোলকধাঁধাঁ আটকা পড়ে এখন মস্তিষ্কও কাজ করার ক্ষমতা থেকে অব্যাহতি চাইছে যেন। রাফিদ যখন গোলকধাঁধাঁর গোলযোগে নাজেহাল, আশেপাশে তাকিয়ে ভাবছে এসব নিয়ে…ঠিক তখনই কিছুটা দূরে চোখ গেল তার। চমক যেন এবার তার আকাশচুম্বী হলো।
১৭৫.
পড়নে জিন্স, শার্ট, ব্লেজার, পায়ে কালো জুতা। চোখে কালো সানগ্লাস। কানে ফোন ঠেকিয়ে একদম হিরোদের স্টাইলে কথা বলতে বলতে হেঁটে আসছে নক্ষত্র।রাফিদের কাছে তাকে আগে থেকেই তামিল হিরোদের মত লাগে। গায়ের রঙ কালো হলে কি হবে! চৌকস বুদ্ধিদীপ্ত চোখমুখ, তাতেও একটা অন্যরকম মায়া মায়া ভাব।একদম টানটান শক্তপোক্ত শারিরীক গঠনের কারণে ভীষণ সুন্দর দেখতে মানুষটাকে। উপরন্তু তার কর্মঠ ও চমৎকার ব্যক্তিত্ব তার এ সৌন্দর্যকে যেন গভীরভাবে ফুটিয়ে তুলেছে তার চেহারায়। রাফিদের মাঝে মাঝে অফসোস হয়, ইরিন তো সেই এই মুখ..এই মানুষটার প্রেমেই পড়লো, মায়ায় জড়ালো..ভালোওবাসলো। তাহলে শুরুতে এসব হলে কি হতো! ভাগ্যের ফের বোঝা সত্যিই ভীষণ দায়।
নক্ষত্র বেঞ্চের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে ইতোমধ্যে। তখনো ফোনে কথা বলছে সে। সেই কথোপকথন শুনেও আরেকদফা টাসকি খেলো রাফিদ।
‘হ্যাঁ….বোঝান উনাকে। রাজী হতে বলুন।নইলে আমাকেই নিজের বোনসম মেয়ের উকিল বাবা হতে হবে। তারপর, এই বয়সে এসে মেয়ের বয়সী নাতবউয়ের দাদা শশুড় হয়ে ঘুরবেন উনি। ‘
‘…….’
‘আপনি হাসছেন, আম্মু?’
‘…..’
‘হ্যাঁ….প্লিজ। এটুকু ম্যানেজ করে দিন একটু।’
‘………’
‘হ্যাঁ, এই তো রওনা দিবো আর কিছুক্ষণের মধ্যেই।’
‘আচ্ছা,ঠিক আছে। লাভ ইউ আম্মু। ‘
মিষ্টি হেসে বললো নক্ষত্র। তারপর ফোন পকেটে রেখে সানগ্লাসটা খুলে ব্লেজারের পকেটে গুঁজে দিতে দিতে ইরিনের পাশে এসে দাঁড়ালো সে। হাসিমুখে রাফিদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি অবস্থা মি. রাফিদ? ‘
রাফিদ নক্ষত্রের এ প্রশ্ন যেন শুনেও শুনলই না। অবাক গলায় প্রশ্ন করলো, ‘মি. নক্ষত্র..আপনি মেহেরকে এখানে এনেছেন?
‘হ্যাঁ।’
‘কিভাবে? ‘
‘তুলে এনেছি।’ একদম সাবলিল গলায় বললো নক্ষত্র। যেন বিয়ের কনেকে বিয়ে বাড়ি থেকে তুলে আনাটা খুব স্বাবাবিক ব্যাপার। কিন্তু বিপরীতে রাফিদ চেঁচালো।
‘কিহ!আবার?’
‘এই আবার মানে? তোমার কি আরও কারও সাথে রিলেশন ছিল নাকি? কজনকে তুলে আনছেন উনি তোমার জন্য?’
নক্ষত্র রাফিদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই অবাক হয়ে অস্থির, বিচলিত গলায় প্রশ্ন করলো মেহের।
‘এই না…আমার আর কারও সাথে রিলেশন নাই। মানে ছিলই না কখনো। আমি তো….তোমার কথা শুনে ভয় পাইছি…না..মানে…তোমার কথা শুনে না….মানে উনার কথা শুনে টাসকি খেয়েছি বোধয়… না মানে…ধুর!!’ কি দিয়ে কি বললে সেটাও গুলিয়ে যাচ্ছে রাফিদের।
‘উনি শুধু তোমাকেই ভালোবাসেন মেহের। পুতুলের বাবাই মজা করে বলেছেন এমন। ডোন্ট ওয়্যারি।’ ইরিন হেসে বললো।
‘তোমার রিটার্ন সারপ্রাইজ দেওয়া হলে এবার চলি এখান থেকে? শেখ ভিলায় সবাই অপেক্ষা করছে। আম্মু কল দিয়ে বলেছেন, সব আয়োজন শেষ।’ নক্ষত্র বললো ইরিনকে।
‘হ্যাঁ, চলুন। রাফিদ, মেহের এখন সব কথা থাক। চলুন আগে বিয়ের কাজটা শেষ করি। শুভ কাজে দেরি করতে নাই।’ তাদের উদ্দেশ্য করে বললো ইরিন।
‘কার বিয়ে?’ রাফিদ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।
‘আপনার আর মেহেরের। ‘ হাসিমুখে বলে ইরিন।
‘কিন্তু, এসব কিভাবে কি হচ্ছে…আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা। ‘ বিভ্রান্ত হয়ে অস্থির স্বরে বললো রাফিদ।
‘পরে বলি?’ ইরিন বললো।
‘না…এখুনি। আমার মাথা কাজ করছে না। মেহের নিজের বিয়ের দিন এখানে…মি. নক্ষত্র বলছেন তুলে এনেছেন। কাহিনী কি ভাই?!’ অস্থির গলায় বললো রাফিদ।
‘আমার বউয়ের ইচ্ছা হয়েছিল আপনাকে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ কিছু গিফট করবে।প্রথমে তা কোন ইউজেবল প্রোডাক্ট হলেও পরে ওর বাসায় দাওয়াতে গিয়ে রুনার কাছে আপনার আর মেহেরের কথা শুনে সে। তারপরেই তা আপনাদের শুভ পরিণয়ের..মানে বিয়ের আইডিয়াতে বদলে গেল। উনি আমার কাছে বায়না করলেন মেহেরকে এনে দিতে। আমি বেচারা আর কি করি ভাই! একটা মাত্র বউ আমার। শখ করেছে তার বন্ধুকে সারপ্রাইজ দিবে, ব্যবস্থা তো কিছু একটা করতেই হতো।
তাই গতকাল রুনার দেওয়া ঠিকানা নিয়ে বারাসাত পৌঁছাই। মেহেরের বাসায়। ওর বাবার সাথে কথা বলি। উনি ভাই আমার বউয়ের চাইতেও ঘাঁড়ত্যাড়া লোক। মানলেনই না আমার কথা। অগত্যা আমার মেহেরকে ধরতে হলো। ও নিজেও আরও একবার চেষ্টা করেও তা বিফল হলো। ওর বাবা জানিয়ে দিলেন, বিয়ে করলে তার ঠিক করা পাত্রকেই করবে নয় তো মেহের তার জন্য মৃত। বাবার এমন কথার পর মেহের আর নিজের অনিচ্ছাকৃত সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারলো না। পার্লার থেকে একাই বেরিয়ে এসে সোজা আমার গাড়িতে উঠে বসে, প্ল্যান মত। তারপর, বারাসাত থেকে কোলকাতা, এরপর ফ্লাইটে করে সোজা বাংলাদেশে। ‘ বেশ উচ্ছ্বসিত স্বরে হেসে বললো নক্ষত্র।
রাফিদ পুরো হা হয়ে গিললো তার বলা কথাগুলো শুনে। তারপর কিছুটা সময় চুপ করে ভাবলো কিছু একটা। পাশ ফিরে মেহেরের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কাজটা কি ঠিক হলো মেহের? ‘
‘ভুল হয়েছে? হোক! যে বাবা জন্ম দিয়ে আদর স্নেহে বড় করার প্রতিদানে আমার সুখের বলিদান চায় তাকে কি করে সম্মান দিতে নিজের সুখ সঁপে দেই? বাবা মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতায় অবলীলায় নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া যায় রাফিদ। জীবন দিলেও অতি তুচ্ছ সেটা। কিন্তু প্রতিদান চাইলে তা স্বার্থপরতা হয়ে ওঠে। বাবার কথাই তো মেনে নিয়েছিলাম, তারপরেও নক্ষত্র ভাইয়া যখন গেলেন ভাবলাম হয় তো এবার সে মানবে। কিন্তু, না। সে তার ইগো বাঁচাতে আমাকে মৃত বলে মানতেও যখন দ্বিধা করবে না, তো তাই হোক। যার কাছে সন্তানের ন্যায্য সুখের চাইতে নিজের জেদ বেশি মূল্যবান তার কাছে আমি মৃতই ভালো।
এখন তুমি বলো, তুমি আমাকে বিয়ে করবা নাকি আমি সত্যি সত্যি মরবো?’ মেহের বললো কাঁদোকাঁদো গলায়।
‘থাপ্পড় চিনো? দুই চারটা থাপ্পড় পড়লে মুখে দ্বিতীয়বার আর এই কথা আনার সাহস করব না,ফাজিল মেয়ে।’
রাগীস্বরে বললো রাফিদ। তারপর নক্ষত্রকে বললো, ‘মি. নক্ষত্র…চলুন তো প্লিজ। আগে বিয়েটা করে নেই। তারপর, এর মাথা থেকে এসব উল্টাপাল্টা চিন্তার ভূত নামানোর ব্যবস্থা করবো।’
‘হ্যাঁ…চলুন। ‘হাসতে হাসতে বললো নক্ষত্র। পেছন ঘুরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই রাফিদ আবার চেঁচালো।
‘এই…এক মিনিট।
তার কথায় নক্ষত্র ইরিন পেছন ফিরে তাকাতেই অস্থির গলায় রাফিস বললো, ‘আপনি একটু আগে ইরিনকে এত আদর সোহাগ দেখিয়ে বউ বলছিলেন কেন?’ আপনাদের না ডিভোর্স হচ্ছে?’
আচমকা রাফিদের চেঁচানোতে বাকিরা সহসা ভড়কে গেল একপ্রকার।ব্যাপারটা ঠিক কি সেটা বুঝতে কয়েকসেকেন্ড সময় নিল তারা। তারপর, বিরস গলায় ইরিন বললো, ‘ডিভোর্স আর ইচ্ছে কই! উনি ক্যান্সেল করিয়ে ছেড়েছেন।’
‘মানে?’ ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করলো রাফিদ।
‘আমাদের ডিভোর্স হচ্ছে না রাফিদ। পরী ফিরে এসেছে তার নক্ষত্রত্রের কাছে। ‘ শেষ কথাটা ইরিনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো নক্ষত্র। নক্ষত্রের চোখে চোখ পড়তেই ইরিনও লাজুক মুখে মাথানত করে মুচকি হাসলো।
ইরিনের এমন হাসি আর নক্ষত্রের কথায় দুয়ে দুয়ে চার মিলাতে আর অসুবিধা হলো না রাফিদের। আজ যেন তার চমকের রেশ কাটছেই না। সুখ প্রজাতিরা যেন অবাধ ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে তার মনের আকাশে।
আনন্দে উত্তেজনায় অস্থির হয়ে প্রশ্ন করলো, ‘ওও…আল্লাহ!!! কখন কিভাবে কি হইলো? আমাকে কেউ কিছু বললো না। কি অকৃতজ্ঞ সবাই! শেষবাক্যে অভিমানী অভিযোগের সুর ঢেলে বললো রাফিদ। তার কথায় হেসে ফেললো নক্ষত্র-ইরিন। মেহের কিছু বুঝতে না পেরে কৌতুহল চেপে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো রাফিদের পাশে।
‘এটাকে আপনার বিয়ের সারপ্রাইজ গিফট দিতে চেয়েছিল ইরিন । তাই বলেনি আগে কিছুই।আপনাদের বিয়ের পর বলে দিত আপনাকে । যতযাই হোক এর পেছনে আপনার অবদানটাই বেশি। Which make me grateful to you too!’ মুচকি হেসে বললো নক্ষত্র। তারপর তাড়া দিয়ে বললো, ‘বাকি কথা পরে হবে। এখন যাওয়া যাক, চলুন।
রাফিদ হেসে মাথা নাড়িয়ে সম্মত্তি দিল। তারপর,সবাই রওনা হলো শেখ ভিলার উদ্দেশ্যে।
১৭৬.
রাত নয়টা একুশ…..
ঘরোয়া ভাবে হলেও বেশ ভালোই আয়োজন করা হয়েছে শেখ ভিলায়। ঘরে বাইরের সাজে মানুষের আনাগোনায় একদম বিয়ে বাড়ির আমেজ তৈরী হয়েছে এখানে। রাফিদের আত্মীয়স্বজন বলতে কারও সাথে তেমন যোগাযোগ নেই। তাই রাফিদের কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ওর ছোটবোন রুনা, মারিয়া, ইরিনের মা,রিতু এবং নক্ষত্রের পরিবারের কয়েকজন মিলেই এই ঘরোয়া বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে।
মেহেরকে নতুন করে বউ সাজানো হয়েছে। শেখ ভিলায় আসার আগে রাফিদ নতুন করে শপিং করেছে। তার কথা অন্যের দেওয়া শাড়ি গয়নায় কেন মেহের তার বউ হবে! অগ্যতা নতুন করে সব কেনাকাটা করতে হয়েছে। আপাদত বিয়েতে যা যতটা লাগে তাই করেছে পরে বিয়ের রিসিপশনে ভালোভাবে সব আয়োজন করবে বলেছে রাফিদ।
গোল্ডেন কালার জরি পাথরের কাজ করা লেহেঙ্গায় সাথে ম্যাচিং সোনা ও হীরার নানান গয়নায় একদম সোনাবউ লাগছে যেন মেহেরকে। রাফিদ কালোর উপর গোল্ডেন সুতোর কারুকাজের শেরওয়ানি পড়েছে।
ইসলামিক নিয়মে বিয়ে পড়ানো হয়ে গেছে। এবার রেজিস্ট্রি পেপারে সই করার পালা। রাফিদ ও মেহের সই করার পর কাজী সাহেব বললেন, ‘ছেলে মেয়ের পক্ষ থেকে এবার সাক্ষীরা সই করুন। ‘
রাফিদের পক্ষ থেকে শেখ দম্পতি সাক্ষী হলেন। মেহেরের অভিভাবক হয়ে সাক্ষী হলেন তার মামা। মেহেরকে ভীষণ স্নেহ করেন তিনি। রাফিদকেও তার পছন্দ হয়েছে। কিন্তু, বোন জামাইয়ের সিদ্ধান্তের বাইরে কিছু বলতে পারেননি। যতই হোক মেয়ে তো উনারই। তাই মেহেরের সিদ্ধান্ত বদলের পর তার অনুরোধেই উনিও ইমার্জেন্সি টিকিট করে সন্ধ্যা নাগাদ এসেছেন এখানে।
রাফিদ ইরিনের বিয়েটা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলে সবাইকে মিষ্টিমুখ করানো হলো। নক্ষত্র রাফিদকে মিষ্টি খাইয়ে দিয়ে বললো, ‘কংগ্রাচুলেশনস মি. রাফিদ। এট লাস্ট ইউ আলসো গট ম্যারিড। ‘
নক্ষত্রের কথার বিপরীতে হুট করেই তাকে জড়িয়ে ধরলো রাফিদ। ভরাট গলায় বললো, ‘থ্যাংক ইউ ভাই। বড় ভাই না থাকার কমতি ফিল হতো মাঝেমধ্যে। কিন্তু আজ বুঝলাম আমার আর কখনো বড় ভাইয়ের কমতি অনুভব হবে না এ জীবনে। থ্যাংক ইউ সো মাচ ভাই।’
নক্ষত্র প্রথমে অপ্রস্তুত হয়ে গেলেও পরে হেসে ফেললো রাফিদের কথায়। নিজেও জড়িয়ে ধরলো তাকে। পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললো, ‘ভাই কখনো ভাইকে ধন্যবাদ দেয় না, রাফিদ। তাদের বন্ডিংটাই এমন, যেখানে ধন্যবাদ বলে কোন শব্দ খাটে না। ভালোবাসা খাটে। আল্লাহ তোমাকে ভালো রাখুক ইন শা আল্লাহ। নতুন জীবন সুন্দর হোক। আর হ্যাঁ, ভাই যেহেতু মানছোই তাহলে এবার থেকে তুমি করে বলবা আমাকে। ওকে?’
‘ইন শা আল্লাহ।’ নক্ষত্রকে ছেড়ে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হেসে বললো রাফিদ।
১৭৭.
কাজী সাহেবকে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য ডাকা হলে উনি যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াতেই রাফিদ বললো, ‘কাজী সাহেব…বসুন আরেকটু। আরেকটা বিয়ে পড়ানো বাকি। ‘
রাফিদের এমন কথায় উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে তাকালো তার দিকে। নক্ষত্র জিজ্ঞেস করলো, ‘ কার বিয়ে?’
‘আমার ভাই আর প্রিয় বন্ধুর।’
নক্ষত্র ভ্রু কুচকে তাকালে রাফিদ এগিয়ে গিয়ে তাকে হাত ধরে টেনে এনে সোফায় বসালো।তারপর, মেহেরকে ইশারা করতেই সে ইরিনকে এনে নক্ষত্রের মুখোমুখি সোফায় বসিয়ে দিল। কনক শায়লার বিয়ের লাল ওড়নাটা এনে ইরিনের মাথা দিয়ে তা মুখ পর্যন্ত টেনে দিল। পাতলা লাল ওড়ানাটা ভেদ করে আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে ইরিনের মুখটা। নক্ষত্র আঁড়চোখে তাকিয়ে দেখলো সেটা। মুগ্ধা খেলে গেল তার চোখের তারায়। ‘মাশাল্লাহ’ বলে মুচকি হাসলো সে। ইরিন লজ্জায় মাথা নীচু করে বসে আছে।
এরপর, রাফিদ কাজী সাহেবকে বললো, ‘কোন কাগজি ঝামেলা নেই। কেবল ইসলামিক নিয়মে এদের কবুল বলিয়ে বিয়ে পড়ান কাজি সাহেব।’
‘কিন্তু, এরা তো বিবাহিত, তাই না বাবা?’ কাজী সাহেন বিভ্রান্ত স্বরে প্রশ্ন করেন।
‘হ্যাঁ। কিন্তু, তখন আমি ছিলাম না। বড় ভাইয়ের বিয়েতে ছোট ভাই থাকবে না, এটা কখনো হয়? নিন.. আপনি বিয়ে পড়ান।’
মারিয়াও এতে সায় দিয়ে জোর গলায় বললো, ‘হ্যাঁ…একদম ঠিক। আমিও ছিলাম না সে সময়।আমিও মিস করেছি বান্ধুবীর বিয়ে। এবার যখন সুযোগ পেয়েছি মিস করতে চাই না। ‘
কাজী সাহেব রাফিদ বা মারিয়ার কথার মারপ্যাঁচ কিছুই বুঝলেন না। বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে দেখলেন চারপাশের সবাইকে। নক্ষত্র-ইরিনও কিছু বলছে না। তারাও বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে বসে আছে। শায়লা, কনক মিটমিটিয়ে হাসছে। তারা তো আগে থেকেই জানতো রাফিদের এই পরিকল্পনার কথা।
‘নিন…নিন…শুরু করুন। অনেক রাত হয়ে গেছে অলরেডি ।’ কাজী সাহেবকে তাড়া দিল রাফিদ। নক্ষত্র এবার মুখ খুললো।
‘নতুন করে বিয়ে পড়ানোর কি আছে মি. রাফিদ? কোন দরকার নেই এসবের।’
‘আহ…..নক্ষত্র। এমন হলেই বা সমস্যা কি! জাস্ট কবুলই তো বলবা দুজনে।’ শায়লা বললেন।
‘কিন্তু, আম্মু…’ ইরিন কিছু বলতে চাইছিল। কিন্তু রাফিদ সুযোগ দিল না। কাজি সাহেবকে তাড়া দিল আবার। অগ্যতা কাজী সাহেব আবারও বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন।
সকলের সামনে মৌখিকভাবে নক্ষত্রের সম্বন্ধে বিস্তারিত বর্ণার পর ১ টাকা মোহরানায় কাজী সাহেব প্রথমে ইরিনের সম্মতি চেয়ে কবুল বলতে বললেন।
ইরিনের কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। প্রথমবার নক্ষত্রের সাথে বিয়েতে যেমন কষ্ট আর ভয় হয়েছিল, এবার সেরকম কোন অনুভূতি হচ্ছে না। বরং কেমন শান্তি শান্তি, সুখানুভূতি হচ্ছে।লজ্জায় উত্তেজনায় বুকের ভেতর দামাডোল বাজাচ্ছে যেন কেউ। চুপ করে আছে সে। সেটা দেখে পেছনে দাঁড়ানো রাফিদ কিছুটা ঝুঁকে এলো ইরিনের কানের কাছে। আস্তে করে বললো,
‘আগেরবার তো কবুল বললেও সেখানে প্রাপ্তি ছিল কেবল। এবার নক্ষত্র বন্দনার অর্জন হিসেবে খুশি মনে কবুল করুন তাকে। ‘ রাফিদের কথায় ইরিন ছলছল চোখে তার দিকে তাকাতেই রাফিদ মিষ্টি করে হেসে চোখের ইশারায় সায় দিল। ইরিন আর সময় নিল না। চোখে জল ঠোঁটে হাসি মেখে নক্ষত্রের দিকে তাকালো। আস্তে করে বললো, ‘আলহামদুলিল্লাহ, কবুল…কবুল..কবুল।’
নক্ষত্রের বেলায় কাজী সাহেবের এক মূহুর্তেও সময় লাগেনি। তবে নক্ষত্র ইরিনের মুখোমুখি নয়, একদম তার পাশে বসে ইরিনের হাতনিজের হাতে মুঠো বন্দি করে নিয়ে ঝটপট আলহামদুলিল্লাহ বলে তিন কবুল বলে ফেলেছে।
ইরিন আজও কেঁদেছে। তবে, সেটা তার ভালোবাসার মানুষকে ভালোবাসা দিয়েই নিজের করে অর্জনের খুশিতে।
নক্ষত্রও শক্ত করে তার হাত ধরে আছে। হঠাৎ কানের কাছে মুখ নিয়ে সবার অগোচরে বললো, ‘কাঁদে না পরী। তোমার নক্ষত্র বন্দনা তো সার্থক। এবার আমার পালা। আমার প্রাপ্তিকে আমার আজীবনের অর্জন করে নেওয়া।আমি পারবো তো, না?’
ইরিন কিছু বলে না বিপরীতে। নক্ষত্রের চোখে চোখ রেখে মিষ্টি করে হাসে কেবল। যে হাসি জানান দেয় প্রবল ঝড়বৃষ্টি শেষে ছেয়ে যাওয়া হিমেল হাওয়ার মত স্বস্তির। ভরসা করে নিজের সবকিছু নক্ষত্রের কাছে উজাড় করে দেওয়ার সম্মতি। যে হাসিতে মিশে আছে আজীবন পরম নিষ্ঠার সাথে নক্ষত্রকে ভালোবেসে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি।
#নক্ষত্র_বন্দনা
#পর্ব_২৯
#শেষাংশ
#দ্বিতীয়ভাগ
#লেখায়_জারিন
১৭৮.
রাত এগারোটা প্রায়। মেহমান সব বিদায় নিয়েছে শেখ ভিলা থেকে। আজ শেখ ভিলাতেই রাফিদ ও মেহেরের বাসরের আয়োজন করা হয়েছে। একই সাথে চুপিসারে নতুন করে বাসরের আয়োজন হচ্ছে ইরিন-নক্ষত্রের জন্যও।
রাফিদ,মেহের, রুনা এখানেই থাকছে আজ রাতে।মারিয়াকে থাকতে বললেও সে থাকেনি। বাড়ি ফিরে গেছে। নীচে সবাই যে যার মত অনুষ্ঠান পরবর্তী গোছগাছের কাজে ব্যস্ত। এই ফাঁকে রাফিদ আর মেহের মিলে নক্ষত্র আর ইরিনকে প্রায় ধরে বেঁধে ছাদে নিয়ে এসেছে।
দুধের মত সাদা ধবধবে একটা চাঁদ উঠেছে আকাশের আঁধার চিরে। তারায় তারায় ঝলমল করছে পুরো আকাশ। বিয়ে উপলক্ষে বাড়ির ছাদজুড়ে করা হয়েছে ছোট ছোট সাদা ও হলুদ মরিচ বাতির আলোকসজ্জা। সেখানেই সিমেন্টের মসৃণ মেঝেতে মাদুর পেতে বসেছে তারা চারজন। আলোকিত ঝলমলে পরিবেশের শোভা যেন আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে তাদের সবাই হাসিমুখগুলো।
কনক গরম গরম ধোঁয়া ওঠা চা পাঠিয়েছে। সারাদিনের ক্লান্তি কাটাতে এই যেন ভীষণ জরুরি ছিল সবার জন্যই। সবাই যার যার মত স্বস্তি নিয়ে চায়ে চুমুক দিচ্ছে।আর নিজেদের মধ্যে টুকটাক কথা বলছিল।
এরমাঝেই রাফিদ চায়ে চুমুক দিয়ে বললো, ‘এখন বলুন ইরিন, কিভাবে কি এমন চমৎকার ঘটে গেল যে আপনার এতদিনের ডিভোর্সের ঘ্যানঘ্যানানি একেবারে ঘুচিয়ে দিল ভাই?
‘আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন রাফিদ। আমি মোটেও ঘ্যানঘ্যান করিনি। তখন যেটা ঠিক মনে হয়েছিল সেটাই করেছিলাম। এটা মোটেও ঘ্যানঘ্যানানির কিছু ছিল না।’ কপট রাগ দেখিয়ে বললো ইরিন।
‘ওকে…ওকে…আ’ম স্যরি। ভুল বলে ফেলেছি।মাফ করুন জনাবা। এখন বলুন কিভাবে কি হলো?’
‘উনি তুলে নিয়ে গেছিলেন আমাকে।তারপর…’
‘কিহ…আবার!!
‘হু।’ বিরস মুখে বললো ইরিন। বিপরীতে রাফিদ চেঁচালো।
‘এই আপনি কাকে বিয়ে করেছেন বলুন তো? এই লোক তো কথায় কথায় মেয়ে তুলে নিয়ে যায়!’
‘রাফিদ! হোয়াটস দিস ইয়াররর?? নিজের ভাবীর সামনে বড়ভাইকে নিয়ে কিসব বলছো তুমি?’ নক্ষত্র হুশিয়ারি দিয়ে বললো। এদের সম্পর্ক এক রাতেই এমনভাবে বদলে গেছে যেন এরা সত্যিকার অর্থেই ভাই। বছরের পর বছর ধরে পরিচিত একে অন্যের সাথে।
‘স্যরি ভাই। বাট তুমি যা করো তাই তো বললাম। ‘
‘সিরিয়াসলি, রাফিদ? আমি মেয়ে তুলে আনি?’
‘তা নয় তো কি?প্রথমবার বউয়ের জন্য মনিরাকে তুলে নিয়ে গেছিলে, এবার ভাইয়ের জন্য বউ তুলে আনলে আবার এখন শুনছি তুমি নিজের জন্য নিজের বউকেই তুলে নিয়ে গেছিলে। হোয়াটস দিস, ভাই??’
‘তো কি করবো! ভাইও একটা আর বউও একটাই। আমিও একটাই। তাদের আর নিজের ভালোর জন্য এটুকু করা কোন অন্যায় না। ‘ নিজেই নিজের পক্ষপাতিত্ব করে বললো নক্ষত্র।
‘হ্যাঁ, তা আর বলতে!’ রাফিদ বললো বিরস গলায়।
‘এই তোমরা থামো তো। যেটা শোনার জন্য আসছি সেটাই বাদ দিয়া কিসব আজাইরা প্যাঁচাল শুরু করে দিছো। ‘ রাফিদ ও নক্ষত্রকে উদ্দেশ্য করে বললো মেহের। তারপর ইরিনকে বললো, ‘তুমি বলো তো ভাবী। কোথায় নিয়ে গেছিল ভাইয়া তোমাকে?’
‘নক্ষত্রবাড়ি।’
‘মানে সিলেটে? আপনার বাড়িতে?’ রাফিদ উত্তেজিত স্বরে প্রশ্ন করলো।
‘হ্যাঁ। ‘
‘ও আল্লাহ! কিভাবে কি?’
‘সেদিন কোর্ট থেকে শপিং করার কথা বলে নিয়ে গেলেন, না? তারপর, শেখ ভিলায় না নিয়ে এসে সোজা সিলেটের রাস্তা ধরেছিলেন উনি।আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি। পরে যখন খেয়াল হলো এটা শেখ ভিলার রাস্তা নয় অন্য কোন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি ততোক্ষণে উনি ঢাকার রাস্তা ছেড়ে সিলেটের রাস্তা ছুঁই ছুঁই। ‘ বিরস মুখে বললো ইরিন।
পাশে বসে নক্ষত্র মিটিমিটিয়ে হাসছে। রাফিদ পুরো হা। মেহের অপেক্ষা করতে না পেরে তাড়া দিল।
‘তারপর…তারপর?? ‘
ইরিন লাজুক হাসলো। তারপর,আস্তে আস্তে বলতে লাগলো সেদিনের ঘটনা।
১৭৯ (১).
গাড়ি চলছে আপন গতিতে। নক্ষত্র চুপচাপ ড্রাইভ করছে। পাশের সিটে চুপচাপ বসে আছে ইরিন। গত ৩/৪ দিনে কেসের রায় নিয়ে চিন্তায়, উত্তেজনায়,সেই সাথে অফিসের কাজ সব মিলিয়ে ঠিকমত ঘুম হয়নি তার। আজ প্রায় দুপুর পর্যন্ত কোর্টেই কেটে গেল সময়টা। এতসব কিছুর ধকলে মাথা ব্যাথা করছে এখন তার হালকা বিস্তর। বাইরে দুপুরের কড়া রোদ। যদিও গাড়িতে এসি চালু থাকায় গরম লাগছে না। তবে,ইরিনের ভেতর ভেতর হাঁশফাস লাগছে। গাড়িতে এসি তার মোটেও ভালো লাগে না। কিন্ত, বাইরের এই কড়া রোদ আর ঢাকার ধূলোবালির মাঝে জানলা খুলে দেওয়ার কথা বলার সাহসও ইরিন পাচ্ছে না। তাই একহাতে মাথা কিছুটা চেপে ধরে চোখ বন্ধ করলো সে।আলগোছে মাথাটা এলিয়ে দিল জানলার ধার ঘেঁষে ।
নক্ষত্র মনোযোগ দিয়ে ড্রাইভ করছিল। ইরিনকে এত চুপচাপ পেয়ে এবার একনজর তার দিকে তাকালো। তারপর, সামনে তাকিয়ে ইরিনকে জিজ্ঞেস করলো, ‘মাথা ব্যাথা করছে ইরিন?’
এভাবে বসে থাকতে থাকতে হালকা তন্দ্রাভাব এসে গেছে ইরিনের। নক্ষত্রের প্রশ্নে সেই ঘুম জড়ানো কন্ঠে ছোট্ট করে জবাব দেয় সে, ‘হু’।
‘বেশি খারাপ লাগছে?’
‘না। হালকা একটু মাথা ব্যাথা জাস্ট। ‘
‘মেডিসিন নিবা? চা/কফি খাবা কিছু? ‘
‘উহু। লাগবে না। আচ্ছা, আর কতক্ষণ লাগবে পৌঁছাতে? ‘
‘এই তো আর ঘন্টা চারেক।’
নক্ষত্রের এমন জবাবে তন্দ্রাচ্ছন্ন ইরিন তড়াক করে চোখ মেলে তাকালো। সামনে তাকিয়ে ভড়কে গেল সে। হাইওয়ের মত লম্বা রাস্তা। তড়িঘড়ি করে সোজা হয়ে বসতে বসতে আশেপাশের বাইরের পরিবেশ দেখলো। অচেনা ঠেকলো সব। মস্তিষ্ক জানান দিল কোনভাবেই এটা শেখ ভিলায় যাওয়ার রাস্তা নয়। ইরিন অস্থির হয়ে উঠলো। বিচলিত গলায় প্রশ্ন করলো,
‘এই পুতুলের বাবাই….কই যাচ্ছেন আপনি? এটা তো শেখ ভিলার রাস্তা না। ঢাকার রাস্তাও মনে হচ্ছে না। কই এটা?’
ইরিনের এই অস্থিরতা দেখে মুচকি হাসলো নক্ষত্র। সোজা সাপটা সাবলিল গলায় বললো, ‘এটা সিলেট যাওয়ার রাস্তা। নক্ষত্রবাড়ি যাচ্ছি আমরা ।’
নক্ষত্রের কথায় মূহুর্তে মধ্যেই হতভম্ব হয়ে গেল ইরিন। কিছুসময় বোকা চোখে চুপচাপ নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে থেকে চেঁচিয়ে উঠলো সে।
‘তার মানে আপনি আমাকে মিথ্যা বলেছেন?’
‘হ্যাঁ।’ সহজ গলায় জবাব দিল নক্ষত্র।
‘কেনওওও? আর আপনি কবে থেকে মিথ্যা বলতে শুরু করেছেন, পুতুলের? আপনি তো এমন ছিলেন না!’ অনেকটা আহাজারি করে বললো ইরিন।
‘তোমার কি আমাকে সত্যবাদী যুধিষ্ঠির মনে হয় ইরিন? সিরিয়াল লায়ার না হলেও জীবনের প্রয়োজনে টুকটাক মিথ্যা কিন্তু বলতেই হয়। সবাই বলে কম বেশি। আমিও এর বাইরে নই।’
ইরিন ভীষণরকম হতাশ হলো নক্ষত্রের এমন হেয়ালি জবাবে। একই সাথে মেজাজ খারাপ লাগছে তার এখন। একরাশ বিরক্তি গলায় ঢেলে বললো,
‘এই…গাড়ি থামান। আমি যাবো না কোথাও আপনার সাথে।’
‘গাড়ি সোজা নক্ষত্রবাড়ি গিয়ে থামবে। এন্ড মিসেস.ইয়াসমিন রাওনাফ ইরিন….ইউ হ্যাভ টু গো উইথ মি। দ্যায়ার ইউ হ্যাভ নান আদার অপশন ফর ইউ।’
‘আপনি বললেই হলো?’
‘অবশ্যই!’
‘অবশ্যই না। আপনি গাড়ি থামান। আমি আমার বাসায় যাবো।’
‘তোমার বাড়িই যাচ্ছি ইরিন। ‘
‘ওটা এখন আর আমার বাড়ি নয়। আপনার দেওয়া সব কিছু ফিরিয়ে দিয়েই ডিভোর্স ফাইল করেছি আমি।’ জেদি গলায় বললো ইরিন।
‘আমার দেওয়া ভালোবাসাটুকু তো ফিরিয়ে দাওনি। সব কিছুর চাইতে দামী এবং অনেক বেশি ওটাই তো দিয়েছিলাম তোমাকে। তাই, ওটা ফেরত না দেওয়া পর্যন্ত তুমি তো ডিভোর্স নিতে পারবে না, মিসেস. নক্ষত্র।’
নক্ষত্রের এ কথার পরে ইরিন সহসা চুপ হয়ে গেল।সত্যিই তো এটা ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি তাকে। কি করেই বা দিত? ভালোবাসা কি ফিরিয়ে দেওয়া যায় কখনো কোন ভাবে? অনুভূতিটা অমূল্য। এটা কি করে ফিরিয়ে দিবে সে? অসম্ভব তার জন্য। হতাশ হয়ে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো ইরিন।আরও একবার নিজের কথা মানানোর চেষ্টা করে শান্ত গলায় বললো, ‘গাড়ি থামান, পুতুলের বাবাই। আমি নামবো। তারপর, আপনার যেখানে যাওয়ার আপনি যান।আমি যাবো না সাথে। ‘
‘গাড়ি তো এখানে থামবে না।তবে তুমি নামার চেষ্টা করে দেখতে পারো। দেখো…লক খুলে নামতে পারো কিনা! ‘ দুষ্টুমির স্বরে বললো নক্ষত্র।
ইরিনের এবার রাগ হলো। কিন্তু, সে নক্ষত্রের সাথে ঝামেলা করতে চাইছে না কোন। তাই রাগ চেপে অন্য পথ ধরলো। বাহানা করার সুরে বললো,
‘আমার বাসায় যেতে হবে, পুতুলের বাবাই। বাসায় রিতু একা।’
‘রিতু শেখ ভিলায়।ওখানেই থাকবে আজ।’
‘কিহ? ‘
‘হু।’
‘তারমানে আপনি সব আগে থেকেই প্ল্যান করে করেছেন?’
‘না। হুট করেই প্ল্যান করতে হয়েছে। কেস শেষে কোর্টের বাইরে দাঁড়িয়ে।’
‘মানে কি? আপনি এক্স্যাক্টলি কি করতে চাইছেন বলুন তো?’ চেঁচিয়ে বললো ইরিন।
‘এখন এত প্রশ্ন করো না তো পুতুলের আম্মু। আমাকে মনোযোগ দিয়ে ড্রাইভ করতে দাও। নইলে এক্সিডেন্ট হয়ে গেলে তোমার আর ডিভোর্সের দরকার পড়বে না। একেবারে মুক্তি পেয়ে যাবে আমার থেকে। তুমি কি সেটাই চাও, পুতুলের আম্মু?’
নক্ষত্রের এমন কথায় বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো ইরিনের। মস্তিষ্কে ব্যাপারটা টোকা দিতেই মূহুর্তেই কান্না জড়ো হলো চোখে। রাগে অভিমানে কান্না দমানো গলায় চেঁচালো সে আবারও।
‘এই…পুতুলের বাবাই, কিসব উল্টাপাল্টা কথা বলতেছেন আপনি? না মানে…মুখে যা আসে তাই বলবেন, নাহ? ভাল্লাগে না আমার আর এসব।’
ইরিনের কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পেরে একটা সূক্ষ সুখানুভূতি ছেয়ে গেল নক্ষত্রের ভেতরে। মুচকি হাসলো সে। ইরিনকে আরেকটু রাগিয়ে দিতে বললো, ‘আমারও ভাল্লাগে না আসলে। কিন্তু, যতদিন বাঁচবো আমার থেকে তোমার মুক্তি নেই। আর তোমার তো আমার থেকে মুক্তিই চাই তাই না? ‘
ইরিন আর কিছু বলতে পারলো না। কান্না চেপে যেতে এবার সত্যিই কষ্ট হচ্ছে তার। নক্ষত্রকে সে চিনে।খুব ভালোই চিনে। এ যাত্রা নক্ষত্রবাড়ি গিয়েই শেষ হবে। বুঝে গেছে সে। তাই চুপচাপ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল ইরিন। মাথা ব্যাথাটাও বেড়েছে আগের চাইতে। আবারও তাই চোখ বন্ধ করে মাথাটা এলিয়ে দিল সে। সাথে সাথেই বন্ধ চোখ বেয়েও নেমে এলো কিছু সিক্ত অভিমান।
ইরিনের থেকে কোন জবাব না পেয়ে পাশ ফিরে ইরিনকে দেখলো নক্ষত্র। কাঁদতে দেখেও বললো না কিছুই। আলতো হেসে সামনে তাকিয়ে পুনরায় ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিল সে।
১৭৯ (২).
গাড়ি যখন নক্ষত্রবাড়ির বিশাল গেইটের সামনে এসে দাঁড়ালো তখন সাঁজের আলোয় নিমজ্জিত প্রকৃতি। বাড়ির গেইটের দুপাশে জ্বলছে ঝলমলে গোলগাল বড় বড় দুটো সাদা আলোর বাতি।শ্বেতশুভ্র বিশাল দুতালা এ বাড়িটা দেখলে মনে হয় যেন সত্যিই একটুকরো নক্ষত্র খসে পড়েছে পৃথিবীর জমিনে। বাড়িটা এমন মনে হওয়ার পেছনে অবশ্য অবদানটা ইরিনেরই। বাড়ির নকশা নক্ষত্র করলেও বাড়ির রঙ আর টুকিটাকি সাজসজ্জা ইরিনের চাওয়া মতই করা হয়েছে। নক্ষত্র যখন জিজ্ঞেস করেছিল, বাড়ির নাম কি রাখবে? ইরিন নক্ষত্রের মুখপানে তাকিয়ে অতশত না ভেবেই বলেছিল, ‘নক্ষত্রবাড়ি।’
নক্ষত্র অবাক হয়েছিল খুব তার কথায়। হেসে বলেছিল, বাড়ি যখন ইরিনের তখন নামটাও তার সাথে সম্পর্কিত একটা নাম হওয়া উচিৎ। ইরিনের সেদিন কি হয়েছিল সে নিজেও জানে না। মিষ্টি হেসে বলেছিল, ‘আমার বাড়ি বলেই তো নাম হবে নক্ষত্রবাড়ি। যার প্রতিটা দেয়ালে, ইট পাথরের ছাঁচে ছাঁচে, বাড়ির প্রতিটা কোণায় কোণায় থাকবে নক্ষত্রের চিন্তা…কল্পনার..ভালোবাসার ছাপ।’
নক্ষত্র সেদিন বিশ্বাস করতে বাধ্যই হয়েছিল বলতে গেলে,প্রেয়সী তার সত্যি সত্যি গভীর প্রণয়ে মজেছে। আজীবন এভাবেই ভালোবাসবে তাকে।’ তাই ইরিনের ইচ্ছেতেই বাড়ি বাইরেটা সাদা রঙের এবং ভিতরটা ধূসর ও সাদার সংমিশ্রণে তৈরী করা হয়েছে। খুব অল্পসল্প আসবাব দিয়ে হালকা পাতলা তবে আভিজাত্যের ছোঁয়ায় সাজিয়ে তোলা হয়েছে এ বাড়িটাকে। সারাবছর রাখা হয় নিবিড় যত্ন ও পরিচর্যায়। যার জন্য দেখে বোঝার উপায় নেই যে এখানে মানুষজনের দৈনন্দিন বসবাস নেই।
সবুজে ঘেরা পাহাড়ি এলাকায় বিশাল জায়গা জুড়ে নির্মিত এই বাড়িটার সামনে লম্বা একটা লন, দু পাশে সবুজ ঘাসের রাস্তা। সাদা রঙের বিভিন্ন ফুল, নীল অপরাজিতা ও কালো গোলাপের বাগান আর নীল জলের মাঝারি আকৃতির একটা সুইমিংপুল দিয়ে সাজানো হয়েছে বাইরের অংশ।
দিনের বেলায় এ বাড়িটা যেমন মনের মাঝে একরাশ স্নিগ্ধতা জাগায়, মনে হয় সবুজের মাঝে মেঘ এসে থেমেছে জমিনে। তেমনি রাতের বেলাও ঝলমল করে এ বাড়িটা।ছোট বড় অনেক আকৃতির সাদা ও হলুদ আলোয় ভরিয়ে রাখা হয় বাড়িটা।দূর থেকে দেখতে নক্ষত্রের উজ্জ্বলতায় জ্বলজ্বল করছে বলে মনে হয় জায়গাটা।
ইরিন সেই যে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেছিল, সারা পথ সে ঘুমিয়েই এসেছে। নক্ষত্র যে এর মধ্যে দুবার গাড়ি থামিয়েছে সেটাও টের পায়নি সে। কিন্তু, বাড়ির বন্ধ গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে পর পর দু/তিনবার হর্ণ বাজাতেই ঘুম হালকা হতে শুরু করলো তার। নড়েচড়ে উঠতে উঠতেই ভেতর থেকে দুজন গার্ড টেনে খুলে দিল কালো রঙের নকশা করা বিশাল গেইটটা। নক্ষত্র গাড়ি ভেতরে নিতে নিতেই ইরিন ঘুম ঘুম চোখেই সোজা হয়ে বসলো সিটে। লম্বা লনটা পেরিয়ে বাড়ির সদর দরজার সামনে গিয়ে থামলো গাড়িটা। নক্ষত্র নিজের সিট বেল্ট খুলতে খুলতে বললো, ‘এবার তুমি নামতে পারো ইরিন। তোমার বাড়ি এসে গেছি।’
ইরিন অভিমানে মুখভার করে রেখেছে। নক্ষত্রের বিপরীতে তাই টু শব্দটি করলো না। নক্ষত্র দরজার লক খুলে নেমে গেল গাড়ি থেকে। ইরিনও আস্তে ধীরে নেমে এলো। কিন্তু, সোজা হয়ে দাঁড়াতেই মাথা ঘুরে উঠলো তার। কোন মতে গাড়ির খুলে রাখা দরজার পাল্লাটা ধরে দাঁড়িয়ে সামলে নিল নিজেকে। নক্ষত্র সেটা দেখে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো। ব্যতিব্যস্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
‘আর ইউ ওকে?’
‘হু।’
‘হেঁটে যেতে পারবা…নাকি হেল্প করবো?’
‘পারবো।’ কথাটা বলেই গাড়ির দরজাটা লাগিয়ে যাওয়ার জন্য আগাতেই আবারও ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো। নক্ষত্র দ্রুত এগিয়ে এসে ইরিনে ধরলো। তার এমন অবস্থা দেখে নক্ষত্রের মনে পড়লো, আজ সারাদিন তেমন কিছুই খাওয়া হয়নি ইরিনের। দুপুর অবধি প্রায় কোর্টেই সময় গেছে। তারপর আবার এত লম্বা জার্নি। দূর্বলতা থেকে এমন হচ্ছে তার বারেবার। নক্ষত্র আর ঝুঁকি নিল না। আচমকা পাঁজাকোলা করে তুলে নিল ইরিনকে।
ইরিন হকচকিয়ে গিয়ে ভারসাম্য রাখতে নক্ষত্রের গলা জড়িয়ে ধরলো। অস্থির গলায় বললো,
‘এই পুতুলের বাবাই, কি করতেছেন…নামান আমাকে। আমি হেঁটেই যেতে পারবো। ‘
নক্ষত্র ইরিনে কথা কানে নিল না। সোজা নিজের মত হেঁটে বাড়িতে প্রবেশ করলো।
পাহাড়ি রাস্তার মতই বাঁক তোলা সিড়ি ভেঙে সোজা দুতালায় উঠে গেল নক্ষত্র। করিডোর পেরিয়ে মাঝ বরাবর নিজের ঘরে এসে থামলো সে। ইরিনকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে বড় বড় করে কয়েকবার শ্বাস নিল।এমনিতেই এত দীর্ঘ পথ একটানা ড্রাইভ করে এসে ক্লান্ত ছিল ভীষণ। তারপর, আবার এভাবে ইরিনকে নিয়ে নিজের ঘর পর্যন্ত এসেছে। হাঁপিয়ে গেছে সে ভীষণ।
তাকে এভাবে শ্বাস নিতে দেখে মায়া হলো ইরিনের। কিন্তু এটাকে ছাপিয়ে সে তার অভিমানকে অগ্রাধিকার দিল। পৈশাচিক আনন্দ নিয়ে মনে মনে আউড়ালো, ‘ঠিকই আছে। আমাকে জোর করে তুলে আনার ফল। ভুগতো আব(ভোগ করো এবার)।’
নক্ষত্র নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে ইরিনকে বললো, ‘টায়ার্ড লাগছে খুব।ফ্রেশ হওয়া দরকার। তুমি আগে যাবা নাকি আমি যাবো?’
ইরিন কোন জবাব দিল না। মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো।নক্ষত্র বুঝলো ইরিন ইচ্ছা করে এমন ভাব নিচ্ছেন। সেও বা কম কি। ইরিনকে বললো, ‘এক কাজ করো।তুমি বরং রেস্ট নাও দশ মিনিট। আমি ফ্রেশ হতে আসি ঝটপট। তারপর তুমি যেও।’
ইরিন এবারেও কিছু বললো না। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে হতাশ হলো নক্ষত্র। কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ আলমারি থেকে নিজের জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।
১৭৯ (৩).
নক্ষত্র ওয়াশরুমের দরজা লাগাতেই ফোঁস করে একটা শ্বাস ছাড়লো ইরিন। যেন এতক্ষণ কেউ জোর করে তার নিশ্বাস আটকে রেখেছিল। মাথাটা এখনো ঝিমঝিম করছে তার। তাই হেঁটে গিয়ে বিছানায় বসলো সে। চুপচাপ মাথা নীচু করে ভাবতে থাকলো নক্ষত্রকে নিয়ে।
ইদানীং নক্ষত্রকে বেশ অন্যরকম লাগছে ইরিনের।ডিভোর্স দিতে সে শুরু থেকেই নারাজ। ইরিন ‘শেখ ভিলা ‘থেকে চলে আসার পরেও অনেকবার বলেছে পুতুলের জন্য তাকে ফিরে যেতে।
কিন্তু,সেদিন রাতে নিজের জন্য বন্ধু হিসেবে ফিরিয়ে নিতে চেয়েছে সে ইরিনকে। ইরিন ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না, আদতে কি চলছে নক্ষত্রের মনে। তবে কি নক্ষত্র চাইছে ইরিন ডিভোর্স ক্যান্সেল করে শেখ ভিলায় ফিরে যাক? নাকি ফিরে আসুক নক্ষত্রের জীবনে।কি চায় সে? যদি বা চায়ও তবে কি করবে ইরিন? ফিরে যাবে? নাকি ডিভোর্স ফাইনাল করে একাই থাকবে বাকি জীবন?
কোন সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনা ইরিনের মন। শেষে হাল ছেড়ে দেয়। যা হবে দেখা যাবে। আগে নক্ষত্র কি চায় সেটা জানা দরকার।
সব ভাবনা ছেড়ে ইরিন উঠে দাঁড়ালো।ঘরটাকে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো। আজ তৃতীয় বারের মত এ বাড়িতে এসেছে সে। প্রথমার এসেছিল নওরিনের আগমনের মাস দেড়েক আগে। বাড়ির কাজ শেষ করার পর সপরিবারে প্রথম পা রেখেছিল সে এই বাড়িতে। ওর যতদূর ধারণা নওরিনের আগমনের সূচনাও ঘটেছিল সেদিনই। তারপর,ইরিন যখন চার মাসের গর্ভবতী। দ্বিতীয়বারের মত ঘুরতে এসেছিল সিলেটে। তারপর আর আসা হয়নি বিগত কয়েক বছরে।
বেশি কিছু নেই ঘরে। একটা বড় খাট। দুটো বেড সাইড টেবিল, একটা আলারি, একটা ডিভান আর বিছানার মুখোমুখি দেওয়ালে টিভি ও ঠিক তার উপরে একটা দেয়াল ঘড়ি। ঘরের মাঝ বরাবর এক পাশে ওয়াসরুম, অন্যপাশে মাঝারি খোলা ব্যালকোনি। যেটা বাড়ির পেছন দিকটায় পড়েছে। সেখানে পাহাড়ি জঙ্গলে ঘেরা অনেকটাই। সকালে পাহাড়ের কোল বেয়ে নেমে আসা সূর্যের ঝলমলে আলো এসে পড়ে ব্যালকোনি জুড়ে। হিম শীতল স্নিগ্ধ বাতাস বয়ে চলে। রাতদিন শোনা যায় কিছু দূরের পাহাড়ি ঝরণার কলকলিয়ে নেমে আসার জলতরঙ্গে শব্দ ।
এর আগে মাত্র দুবার এসেছিল সে এখানে। অথচ এতেই কতশত স্মৃতি জন্ম নিয়েছে এই ঘরে।এই বাড়ির কোণায় কোণায়।তার ধারণা নওরিনের আগমনের সূচনাও এই বাড়িতে। এই ঘরেই। অথচ, এ বাড়িতে পা রাখার ভাগ্য তার হয়নি। এসব ভেবেই আপনমনেই স্মিত হাসলো ইরিন।
১৭৯(৪).
‘আলমারিতে তোমার জামা কাপড় রাখা আছে। যাও ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে নাও।’
আচমকা নক্ষত্রের গলার স্বরে ভাবনাচুত্য হয়ে চমকে উঠলো ইরিন। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘আমার জামা কাপড় এখানে কি করে?’
‘আমি এনে রেখেছি। খুলে দেখো।’
নক্ষত্রের কথায় ইরিন আলমারি খুলে তাজ্জব বনে গেল। আলমারি ভর্তি শাড়ি। ব্যক্তিগতভাবে নক্ষত্র তাকে শাড়িতে দেখতেই পছন্দ করে। কিন্তু, এসব শাড়ি একটাও তার নিজের না। ইরিন বিস্মিত স্বরে প্রশ্ন করে,
‘এগুলো কার শাড়ি?’
‘তোমার। তোমার জন্য কিনেছি একে সময়। কিন্তু, দেওয়া হয়নি কখনো। আমার আলমারিতে জায়গা হচ্ছিল না।তোমার আলমারিতে জায়গা দিতে চাইনি। তাই একবার যখন সিলেট এসেছিলাম তখন কয়েকটা এনেছিলাম। এরপর থেকে জায়গা না হলেই এখানে পাঠিয়ে দেই। রাইজু খালা গুছিয়ে তুলে রাখেন। দেখো..ম্যাচিং ব্লাউজ পেটিকোটও আছে বোধয় কিছু কিছু। ‘
‘কতগুলো শাড়ি এখানে?’
‘উমমম…সঠিক বলতে পারছিনা। হবে শ’খানিক।’
‘আপনি পুরাই একটা যা তা…পুতুলের বাবাই। ‘
‘বউ আমার একটাই। আমার সব শখ আহ্লাদও তাকে ঘিরেই।’
‘বউ! খালি মুখে মুখেই স্বীকার করেন। সত্যিকার অর্থে স্বীকৃতি আর পায় কই সে!’ তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো ইরিন। নক্ষত্র টি-শাট পড়তে পড়তে বললো, ‘ফ্রেশ হও…যাও। বাকি যা অভিযোগ, সেসব শোনার জন্য পুরো রাত পড়ে আছে।’
‘আমার কোন অভিযোগ নেই। ‘ সহজ গলায় অভিমান ঢেলে বলে ইরিন।
‘নেই?’ শান্ত চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করে নক্ষত্র।
ইরিন এর জবাব দেয় না। নতুন করে আর কি বুঝাবে তাকে? যে ব্যাপারগুলো নক্ষত্র নিজের জন্য ইরিনের অভিযোগ ভাবে, আসলে তা ইরিনের অভিমানের কারণ। এটা কেন বুঝে না সে?
ইরিন কথা বাড়ায় না। আলমারি থেকে একটা শাড়ি বেঁছে নিয়ে ওয়াসরুমে ঢুকে যায়। নক্ষত্র মুচকি হাসে ইরিনের নাজেহাল অবস্থা দেখে। মনে মনে আউড়ায়, ‘বেচারি! ‘
১৭৯ (৫).
ব্যালকোনিতে দাঁড়িয়ে আছে ইরিন। সদ্য ভেজা চুলগুলো থেকে এখনো পানি ঝরছে তার। পাহাড়ি স্নিগ্ধ শীতল হাওয়া এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে তাকে ক্ষণে ক্ষণে। শিহরণে জাগিয়ে তুলছে প্রতিটি লোমকূপ। ছড়িয়ে পড়ছে তার সর্বাঙ্গজুড়ে। কোমড় পর্যন্ত করা রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে ইরিন। চোখ বন্ধ করে অনুভব করছে পরিবেশটা।
হঠাৎ পিঠে কারও আঙুলের ছোঁয়া লাগতেই চমকে উঠলো সে। আরও কয়েকসেকেন্ড যাওয়ার পর সে বুঝলো এটা নক্ষত্রের স্পর্শ। পেছনে দাঁড়িয়ে ইরিনের চুল মুছছে সে। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ইরিন। নক্ষত্র চুল মুছে দুই একবার নিজ হাতে ঝেড়ে দিল। তোয়েলেটা রেলিং এর এক পাশে মেলে দিয়ে ইরিনকে বললো, ‘এক্সট্রা টাওয়াল নিয়ে গেলেই তো পারতে। এ বাড়িতেও তোমার কোন কিছুর অভাব আমি রাখিনি, ইরিন। ‘
‘আপনি আমার জীবনে আসার পর থেকে অভাব শব্দটাই আমার জীবন থেকে উধাও হয়ে গেছে প্রায়। শুধু একসময় স্বস্তির অভাব মনে হতো, আর এখন শুধু ভালোবাসার অভাব লাগে। এছাড়া, আর কোন অভাব নেই আমার জীবনে।’
‘এই অভাবগুলোর জন্য তুমি যতটা দায়ী আমিও ততোটাই দায়ী, ইরিন। শুরুতে আমি তোমার মনের অভাবটা বুঝতে পারিনি আর এখন বুঝেও পূরণ করতে ব্যর্থ।’
‘এ ব্যর্থতার দায়টাও তো আমারই।’
‘ঠিক তা নয়। আসলে কি জানো তো ইরিন, কোন সম্পর্কে বা কাজে যখন একের অধিক মানুষ জড়িত থাকে তখন কোন কিছুর জন্য একা কেউ দায়ী বা জয়ী হয় না। কমতি আমারও ছিল। আমি কষ্ট পেয়ে নিজেকে তোমার থেকে দূরে করে নিয়েছিলাম। আর তুমি অপরাধবোধে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলে আমার থেকে।’
‘তারপরও তো আমি কম চেষ্টা করিনি আপনার স্ত্রী হয়ে উঠার। কিন্তু আপনিই তো..’
‘স্ত্রী তো তুমি এখনো আমার। কিন্তু, তুমি কি কখনো আমার ভালোবাসার মানুষ হওয়ার চেষ্টা করেছিলে, ইরিন?’
নক্ষত্রের প্রশ্নে অবাক চোখে পাশ ফিরে চাইলো ইরিন। নক্ষত্র ইতোমধ্যে ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ইরিনের নিরবতায় নক্ষত্র মুচকি হাসলো কেবল। পাশ ফিরে ইরিনের অবাক চোখের বিপরীতে নিজের সহজ সরল মায়া চোখে তাকালো। সরল স্বীকারক্তির সুরে বললো,
‘আমি আজও তোমাকেই ভালোবাসি পরী। আগের চাইতেও বেশি ভালোবাসি। জীবনের প্রথম প্রেম…প্রথম ব্যক্তিগত ভালোবাসার নারীটিকে কি এত সহজেই ভালোবাসা ছাড়া যায়? আমিই বা পারতাম কি করে বলো তো! শুধু এতকাল নিজের বিশ্বাস ভাঙার জন্য দায়ী নারীটিকে ভালোবাসাতে কষ্ট হতো বলে সেই ভালোবাসাকে আমি হৃদয়ের কালকুঠুরিতে বন্দি করে রেখেছিলাম। কিন্তু, কেউ একজন যখন সেই কাল কুঠুরিতে এক ছটাক আলো ফেলে আমায় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো, যে নারীটিকে আমি নিজের আঘাতের জন্য দায়ী করেছি সেই আঘাত করার সাহস ও সুযোগ আমিই তাকে দিয়েছিলাম। তাই এ আঘাত…এ কষ্ট আমার প্রাপ্য। ভালোবাসতে কষ্ট হওয়াটা আমার শাস্তি।
তবে, আমি চাই আমার এই শাস্তি শেষ হোক। আর তোমারও। দুজনেই তো ভুগলাম ইরিন। আর কত? এবার আমারও যে মুক্তি চাই।’
‘মুক্তিই তো দিতে চাইছি। ডিভোর্সটা হয়ে গেলে নিজের যোগ্য কাউকে চাইলেই বিয়ে করতে পারবেন আপনি। যে আপনাকে আমার মত আঘাত করবেনা, কষ্ট দিবে না..’
‘ভালোওবাসবে না সে তোমার মত।’
‘অবশ্যই। আমি আপনাকে ভালোবাসার যোগ্যই ন…
শব্দটা পূর্ণতা পেল না। কথাটাও সম্পূর্ণ হলো না। তার আগেই নক্ষত্রের গাঢ় প্রণয়স্পর্শের অবরোধে ঠোঁটের ডগায় এসেও আটকে রয়ে গেল। অপ্রত্যাশিত এ মূহুর্তের জন্য অপ্রস্তত ইরিন পাহাড়ের মতই শান্ত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।তবে, দুচোখ বেয়ে পাহাড়ি ঝরণার মত কলকলিয়ে নেমে এলো শান্ত ভংগিমায় অবাধ অশ্রুধারা।
১৭৯ (৬).
ভেজা চুলের ভাঁজে ভাঁজে নক্ষত্রের আঙুলগুলো শক্তপোক্তভাবেই মিশিয়ে নিয়েছে ইরিনকে তার সাথে। অন্যহাতের আঙুলের ভাঁজে ইরিনের আঙুলগুলোও শক্ত করেই আঁকড়ে ধরা। খানিকসময় বাদে রাগ-জেদটা কিছুটা শান্ত হয়ে আসতেই ঠোঁটের অবরোধ ক্ষান্ত হয়ে এলো তার।কিন্তু, রাগ জেদের রেশটা পুরোপুরি ক্ষান্ত হলো না। অভ্যন্তরীণ উত্তেজনায় ভারী হয়ে আসা শ্বাসপ্রশ্বাসের চলাচল স্বাভাবিক করতে ইরিনের কপালে কপাল ঠেকেলো নক্ষত্র। ইরিন এখনো স্থির পূর্বের ন্যায়।নক্ষত্রও স্থির হয়ে মিশে রইলো তার সাথে। কিছু সময় পর চাপা রাগ মিশেল কন্ঠে বললো,
‘কাউকে ভালোবাসতে যোগ্যতা লাগে না। ভালোবাসাটা নিজের করে পেতে গেলে যোগ্যতা লাগে। তুই আমাকে ভালোবাসিস তোর অনুভূতিতে। আমাকে নিজের করার ক্ষমতা কেন তুই রাখিস না, তাহলে? নাকি ভালোবাসাটা অন্যকারো হয়ে গেছে তোর? তাই মুক্তির জন্য অহেতুক বাহানা করছিস?’
‘সন্দেহ করছেন?’ ঠান্ডা গলায় বললো ইরিন।
‘ভয় পাচ্ছি।’ বিপরীতে নক্ষত্রের সরল স্বীকারক্তি।
‘কিসের ভয়?’ ইরিন বিভ্রান্ত কন্ঠে প্রশ্ন করে।
‘তোকে হারানোর। ‘
‘আমি কে পুতুলের বাবাই? আপনি যে ইরিনকে ভালোবাসেন সে কবেই মরে গেছে। তাকে আবার হারানোর ভয় কিসের! আর এই যাকে আপনি এখন ছুঁয়ে আছেন সে কেবল আপনার বৈধ সন্তানের জন্মদাত্রী মা। ‘
‘আমাকে ভালোবাসিস, পরী?’
‘বাসি।’ শান্ত দৃঢ় স্বরে বলে ইরিন।
‘আরও একবার নক্ষত্রের হবি, প্লিজ? ভুলে ভুলে কাটাকাটি করে শূন্য থেকে শুরু করবি একটা জীবন?’
‘আমি তো সেই কবেই নক্ষত্রের হয়ে গেছি। নক্ষত্র বন্দনায় মরমে মরেছি। বারেবারে মরতে রাজি। তবে…
‘তবে..?’
‘তাকে অর্জন করতে ভয় হয়। আমার অগোছালো জীবনে যত্নে আগলে না রাখতে না পারার ভয়।তাই কেবল নক্ষত্র বন্দনাতেই মরে মরে বেঁচে থাকতে চাই।’
‘একলা পারবি না বলেই তো ভয় পাস।এবার না হয় দুজনে মিলেই আগলে রাখবো। ‘
‘এখানে কেন এনেছেন? ‘
‘তোকে চাইতে।’
‘মানে?’
‘একটা অন্যায় করবো আজ।তুই ভুল ভেবে মাফ করে দিস। না পারলেও তুই আমার হয়ে যাস।কথা দিচ্ছি…আমৃত্যু তোর হয়েই থাকবো।’
‘পুতুলের বাবাই আপনি…’
ইরিনকে কিছু বলার সুযোগ দিল না নক্ষত্র। একটানে কোলে তুলে ঘরের দিকে রওনা দিল।
‘এই কি হচ্ছেটা কি….নামান আমাকে। যখন তখন মন চাইলে কোলে তুলে নেয়া…আমাকে তুলে আনা…এত অধিকার কিসের আপনার?’
‘অধিকারের প্রশ্ন তুলছিস?’
‘হ্যাঁ..তুলছি। আপনার আমার ডিভোর্স হচ্ছে। এখন এত অধিকার কিসের আপনার?’
‘সত্যিই জানিস না তুই?’
‘যা নেই তা জানার কি আছে!’
‘আছে।’
‘কি?’
‘অধিকার।’
‘কিসের অধিকার? কোন অধিকার নেই আপনার।’
‘আছে তো।’
‘কিসের অধিকার আছে শুনি?’
‘তোর নক্ষত্র বন্দনার।’
ইরিন চোখ বড় বড় করে তাকালো নক্ষত্রের দুষ্টুমিভরা চোখের দৃষ্টিতে। বেশিক্ষণ তাকাতে পারলো না। খট করে নিভে গেল ঘরের উজ্জ্বল আলোর বাতিটা। ইরিন হকচকিয়ে গেল। পরিস্থিতি বিবেচনায় মস্তিষ্ক যথাযথ কোন প্রতিক্রিয়ায় পৌঁছানের পূর্বেই নক্ষত্রের ওষ্ঠদ্বয় ইরিনের কপাল ছুঁলো। আবাশে চোখের পাতা কার্নিশ ছুঁলো ইরিনের। নক্ষত্র মূহুর্তেটাকে এগিয়ে নিয়ে গেল গভীর থেকে গভীরতম স্পর্শের আদলে।
১৭৯ (৭).
নক্ষত্রের উন্মুক্ত বুকের মাঝে লেপ্টে আছে ইরিন।একদম চুপচাপ। নক্ষত্র পরম আদরে বিলি কাটছে ইরিনের আধভেজা চুলের ভাঁজে ভাঁজে। বিলি কাটতে কাটতেই বললো, ‘এরপর আর কখনো অধিকারের প্রশ্ন তুলবা,পরী?’
‘আপনি বরাবরই নিজের অধিকার খাটিয়ে গেছেন।
আমি স্ত্রী হয়ে তখনো বাঁধা দেইনি আর আজও না।’
‘অধিকারের জোরে অবলীলায় অধিকার পেয়েছিলাম বলেই তোমার মন পর্যন্ত পৌঁছাতে পারিনি। কখনো মনেই হয়নি এই নারীটি যেমন আমার স্ত্রী তেমনি একটা আলাদা মানুষও। স্পর্শে ভালোবাসার কমতিকে জড়তা ভেবে আরও বেশি ভালোবাসা মিশিয়ে গেছি প্রতিবার। অথচ কখনো ভাবিইনি ওটা জড়তা নয়, গ্রহণ করতে না পারার অস্বস্তি। তোমার নিখুঁত দায়িত্ব পালন, সাবলিল আচরণকে স্ত্রীর চরিত্র ভেবে স্বস্তিতে থাকা আমি কখনো তাতে ভালোবাসার অভাব অনুভব করিনি।
আপাতদৃষ্টিতে তোমার সব চাহিদা মিটিয়ে যাওয়া আমি কখনো মনের চাহিদার কথা জানতে চাইনি।বুঝতে চেষ্টা করিনি। আজও অধিকার দিয়েছো। কিন্তু, আজ শুধু স্ত্রী হয়ে নয়, ভালোবাসো বলেই দিয়েছো।
আজ এই অধিকার থেকেই আমৃত্যু এই ভালোবাসাটুকু নিজের জন্য দাবি করছি পরী।তোমাকে আবারও উজাড় করে ভালোবাসার সুযোগ চাইছি। প্লিজ ফিরিয়ে দিও না।’
ইরিনকে একহাতে যথাসম্ভব নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বললো নক্ষত্র। ইরিন এতসময় চুপচাপ থাকলেও নক্ষত্রের স্বীকার করা ভুলগুলো,তার প্রতিটি কথা ইরিনের ভেতরে অশান্ত ঝড় সৃষ্টি করছিল। অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা চেপে শুনে যাচ্ছিল সব। কিন্তু, শেষে নক্ষত্রের এমন আকুল দাবি সে ঝড়কে উত্তাল ঝড়ে রূপ দিল।নক্ষত্রকে একহাতে শক্ত করে জাপটে ধরে, তার বুকে মুখ গুঁজে সশব্দে কেঁদে ফেললো সে। নক্ষত্র বিচলিত হলো না এতে। মুচকি হেসে আগলে নিল তাকে। বেশ কিছুক্ষণ ইরিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। ইরিন ধীরে ধীরে ক্লান্তিতে শান্ত হয়ে এলো অনেকটাই। আরও কিছুটা মূহুর্তে কাটলো নিরবতায়। অতঃপর, নক্ষত্র তার
সিক্ত কন্ঠে হৃদয়ের সব প্রেম ঢেলে আলতো করে ডাকলো।
‘পরী।’
‘হু।’ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার স্বরে সাড়া দেয় ইরিন।
‘অনেক মুহুর্ত আমি ক্ষয়
করে ফেলে বুঝেছি সময়
যদিও অনন্ত, তবু প্রেম সে অনন্ত নিয়ে নয়।
তবুও তোমাকে ভালোবেসে
মুহুর্তের মধ্যে ফিরে এসে
বুঝেছি অকুলে জেগে রয় :
ঘড়ির সময়ে আর মহাকালে যেখানেই রাখি এ-হৃদয়।”
(জীবনানন্দ দাশ)
‘ভালোবাসি নক্ষত্র।’ নক্ষত্রের বিপরীতে ছোট্ট করে বলে ইরিন। আরও নিবিড়ভাবে মিশে যায় নক্ষত্রের বুকে। প্রেম কুড়ায়, সুখ এসে ছুঁয়ে যায় হৃদয়ের শিরায় শিরায়।
#নক্ষত্র_বন্দনা
#পর্ব_২৯
#শেষাংশ_শেষভাগ
#লেখায়_জারিন
ইরিন নক্ষত্রের পুনরায় এক হবার গল্প শেষ করতে গিয়ে রাত প্রায় ১২ টা বাজিয়েছে ওরা। এরপর, রুনা, কনক, রিতু, পুতুল, ইরিন আর নক্ষত্র মিলে রাফিদ ও মেহেরকে বাসর ঘরে রেখে গেছে। এর জন্য অবশ্য মোটা অংকের টাকাও খসিয়েছে ওরা রাফিদের কাছ থেকে। ওদের কথা ৫ লাখ টাকা নগদ মোহরানায় বিয়ে করা বউয়ের মুখ দেখতে গেলে কিছু নাজরানা (উপহার) তো তাদেরও প্রাপ্য। রাফিদ কোন কৃপণতা করেনি। তবে সামান্য চালাকি করেছে। দশ হাজার টাকার একটা বান্ডিল ধরিয়ে দিয়েছে ইরিনের হাতে। বলেছে, ভাগ বাটোয়ারার দায়িত্ব তার। কারণ রাফিদ জানে এখন যেমন তার পকেট কাটা যাচ্ছে একটু পরে নক্ষত্রেরও যাবে। তাই মোটের ওপর ভাগাভাগির কাজটা ইরিনই করে দিক। সে ঝামেলা বিহীন বাসর করুক।
এখন রাত ১২: ২০ বাজে। বাসর রাতের নফল নামায আদায়ের পর ফুলে ফুলে সজ্জিত বিছনায় কোলে বালিশ নিয়ে বসে আছে মেহের। ভাবছে সে কিছু একটা। রাফিদ বিছানায় ছড়ানো ফুলগুলোকে ঝেড়ে মেহেরের পাশে বসতে বসতে বললো, ‘কি ভাবতেছে মেহেরজান?’
‘এটা কি হলো বলো তো রাফিদ? ‘হতাশা ও মন খারাপের সুরে বললো মেহের।
‘কোনটা?’
‘এই যে ভাবী যে শুধু তাকে নক্ষত্রবাড়ি নিয়ে যাওয়ার কথাটাই বললো, মিল কিভাবে হলো সেটা তো বিস্তারিত বললো না। সোজা ‘বাকিটা ব্যক্তিগত ’ ট্যাগ লাগিয়ে গল্প শেষ করে দিল।’
‘কিছু করার নেই মেহের। ইরিন বরাবরই নিজের ব্যক্তিগত মূহুর্তের কথা কাট করে গল্প শোনায়। ‘ইরিনের পরিচিত স্বভাবে হতাশ হয়ে বললো রাফিদ।
‘তাহলে কাহিনী কি দাঁড়ালো? ‘ হিসেব মিলানোর মত করে প্রশ্ন করে মেহের।
‘কি আর!ভাই তাকে মিথ্যা বলে নক্ষত্রবাড়ি নিয়ে গেছিল। আর সেখানে গিয়ে এমন কিছু ভাই ঘটিয়েছে যেটার কাছে টিকতে না পেরে বন্ধু আমার সারেন্ডার করে দিয়েছে। তবে যত যাই বলো, ভাই কিন্তু আমার এ ব্যাপারে মাশাল্লাহ, ব্যাপক ট্যালেন্ডেট! ‘ খুশিতে গদগদ হয়ে বললো রাফিদ।
তার এ কথায় ভ্রু কুচকে ফেললো মেহের। অবুঝ গলায় প্রশ্ন করলো, ‘কোন ব্যাপারে?’
তার প্রশ্নে রাফিদের খুশি খুশি ভাবটা মূহুর্তেই ফুঁটে যাওয়া বেলুনের মত ফুস হয়ে গেল। হতাশ গলায় বললো, ‘পুরো গল্পই তো জানো। তারপরেও বুঝো না?’
‘না। কোন ব্যাপারে বলো তো?’ সরল স্বীকারক্তি মেহেরের। এটা দেখে চরম হতাশ হলো রাফিদ। পুরো গল্প জেনে যখন কেউ প্রশ্ন করে, সীতা কার বাপ? তখন হতাশ হওয়া ছাড়া আর উপায় কি!
মেহের তাড়া দিল। ‘ এই, বলো না কোন ব্যাপারে নক্ষত্র ভাইয়া এত ট্যালেন্টেড? ‘
‘বউ বশীকরণ। ‘ বিরস গলায় বললো রাফিদ।
‘মানে?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে মেহের।
‘বুঝো নাই এখনো?’ কঠিন স্বরে প্রশ্ন করে রাফিদ।
‘উহু।’ মেহের অসহায় স্বরে নিজের অপারগতা স্বীকার করে। এটা দেখে রাফিদের এবার হাসি পেল। কিন্তু, সে হাসি চেপে গেল। হাল না ছাড়ার মত করে বললো,
‘আচ্ছা….আসো আমার মেহেরজান, তোমাকে হাতে কলমে বুঝিয়ে দেই। ‘ কথা শেষ করে রাফিদ আর একমূহুর্তও দেরি করলো না। একহাতে মেহেরের কোমড় চেপে তাকে কাছে টেনে নিল। তারপর, অন্যহাতে ঘরের মৃদু আলোটুকুও নিভিয়ে দিল।
১৮১.
‘মাত্র দশ হাজার? এটা কিছু হইলো ভাইয়া?’ নারাজ গলায় বললো কনক।
‘এই পুচকের দল, একটু আগেই তো রাফিদের পকেট কেটে দশ হাজার টাকা খসিয়ে আনলি…আমার থেকেও নিচ্ছিস। এত টাকা দিয়ে করবিটা কি তোরা?’
‘বাবাই শপিং কব্বো। আন্নি, ফুপ্পি বলেছে তুমি টাকা দিলে ওরা আমাকে বেড়ু করতে নিয়ে যাবে। চকলেট আর ডল কিনে দিবে। তুমি টাকা দাও তো বাবাই।’ বাবার কাছ থেকে টাকা আদায় করতে এসে বলে পুতুল।
‘এরা তোমাকে শেষমেশ ঘুষ দিচ্ছে, পুতুল আম্মু?’ নক্ষত্র বললো।
‘এই…এটাকে ঘুষ বলো ক্যান ভাইয়া…এটা তো নাজরানা। খুশি মনে উজাড় করে দিতে হয়। ‘ রিতু বললো পুতুলের হয়ে।
‘হ্যাঁ….আর এই যে দেখো তোমার পুরান বিয়ের জন্য কেমন নতুন করে বাসরঘর সাজিয়ে দিয়েছি আমরা।এর জন্য খুশি হয়ে এমনিতেই তো বেশি বেশি দিবা তুমি। কিপটামি করো কেন?’রিতুর কথায় সঙ্গ দিয়ে বললো কনক।
রুনা আর ইরিন সবটা দেখে মিটমিটিয়ে হাসছে। নক্ষত্র বেচারা হার মানলো এই বোন ব্যাটিলিয়ানের কাছে। আরও দশ হাজার টাকার একটা বান্ডিল ধরিয়ে দিল পুতুলের হাতে। মিষ্টি হেসে বললো, ‘এই নেন আম্মু…আপনাদের নাজরানা। ‘
পুতুল নক্ষত্রকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘থ্যাংক ইউ বাবাই।’
নক্ষত্র মেয়েকে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিল। এরপর, সব এক এক করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তারা যেতেই নক্ষত্র দরজা আটকে দিয়ে ক্লান্ত পায়ে হেঁটে এসে ধপাস করে বিছানায় বসে পড়লো।
ইরিন দাঁড়িয়ে আছে কিছুটা দূরে খাটের এক কোণা বরাবর। ক্লান্ত নক্ষত্রকে দেখে ঘড়ি দেখলো সে । রাত ১২: ১৯ বাজে। আজ প্রায় দুদিন, বেশ ধকল গেছে নক্ষত্রের। তারও যে আজ কম ধকল গেছে তাও নয়। কিন্তু, ওর মনে অন্য কিছু চলছে। নক্ষত্রকে বলবে কি বলবে না ভাবতে ভাবতেই নক্ষত্র তার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ডোন্ট ওয়্যারি, ইরিন। নফল নামাযটা পড়বো আজও। যাও তুমি শাড়ি চেঞ্জ করে অযু করে আসো। আমি একটু রেস্ট করে তারপর যাই।’
নক্ষত্রের এমন কথায় ইরিন অবাক স্বরে প্রশ্ন করে, ‘আপনি বুঝলেন কি করে আমি এটা বলতে চাইছিলাম?’
‘ বন্ধুত্ব করেছি, মনের কথা বুঝবো না বলো? ক্লান্ত মুখেও মিষ্টি হেসে বললো নক্ষত্র।
ইরিনের মুখের ফুঁটে উঠলো প্রশান্তির হাসি। মনে মনে সৃষ্টিকর্তা ও রাফিদের প্রতি কৃতজ্ঞা প্রকাশ করলো। একই সাথে হৃদয়ে ভালোবাসার গভীরতায় আরও নিবিড়ভাবে জায়গা করে নিল তার জীবনের রাত দিনের নক্ষত্র।
১৮২.
‘আজকে কি দো’য়া করলা?’ -নামায শেষে জায়নামাজ ভাঁজ করতে করতে প্রশ্ন করলো নক্ষত্র।
ইরিন অবুঝ স্বরে পাল্টা প্রশ্ন করলো, ‘মানে?’
‘না….মানে আগের বার তো আমাদের ম্যারিড লাইফ নিয়ে একটুও দোয়া করো নাই। কারণ, তখন তো আমাকে তোমার পছন্দই ছিল না। তা এবার তো সোজা ভালোবেসেই বিয়ে করলে। তাই জিজ্ঞেস করছি…আজকে আমাদের ম্যারিড লাইফের জন্য কি দোয়া করলে?’ ইরিনকে ভেঙে চূড়ে বুঝিয়ে বললো নক্ষত্র।
ইরিন চোখ ছোট ছোট করে তাকালো নক্ষত্রের কথায়। সন্দিহান গলায় প্রশ্ন করলো, ‘আগেরবার কোন দো’য়া করিনি, এ কথা কে বললো আপনাকে?’
‘রাফিদ বলেছে।’ সোজাসাপটা উত্তর দেয় নক্ষত্র।
ইরিন পুরো বোকা বনে যায় তার জবাবে। রাফিদের উপর মেজাজ খারাপ হয়। এই লোক কি তার মান সম্মান কিছু রাখেনাই নাকি! সবই কি বলে দিয়েছে নক্ষত্রকে? মনের প্রশ্নটা চট করেই নক্ষত্রের কাছেও করে ফেললো সে।
‘আর কি কি বলেছেন রাফিদ?’
‘বলেছে তো অনেক কিছুই। আমার অলক্ষ্যে রয়ে যাওয়া ইরিনকে চিনিয়েছে আমাকে। আল্লাহর রহমতে ওর উছিলায়ই আমি আমার ভালোবাসাকে আবার ডানা মেলে উড়তে দিতে সক্ষম হয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ…আমার পরীকে আবার তার নক্ষত্রের কাছে নিয়ে আসতে পেরেছি আজীবনের জন্য।’ মায়া চোখে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললো নক্ষত্র।
ইরিনের মন ভিজে উঠলো নক্ষত্রের এমন সরল স্বীকারক্তি আর মায়া চাহনীতে। এ চাহনীতে কেবল ইরিনের জন্য হৃদয় নিঙড়ানো মায়া আর ভালোবাসা দেখতে পায় ইরিন। সব বিভৎস অতীত, কষ্ট যন্ত্রণার উর্ধ্বে তখন নিজেকে ভীষণ ভাগ্যবতী মনে হয় তার। এ যেন তার হৃদয়ের পরিশুদ্ধতার….নক্ষত্র বন্দনারই পরম পাওয়া।
স্মিত হাসে ইরিন।এগিয়ে যায় নক্ষত্রের দিকে। নক্ষত্র বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে। ইরিন তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তার পানে মুখ তুলে চাইলো নক্ষত্র। স্মিত হাসলো সেও। ইরিন তার চোখে চোখ রাখলো। তারপর ঝুঁকে তার কপালের মাঝ বরাবর ছুঁইয়ে দিল তার নিগূঢ় ভালোবাসা। অতঃপর নক্ষত্রকে বললো,
‘আমি আল্লাহকে বলেছি আমার জীবনের অন্তিত প্রহর পর্যন্ত যেন আমি এই নক্ষত্রের ছত্রছায়ায় থাকতে পারি এবং পরপারে গিয়েও যেন নক্ষত্রকে নিজের মাঝে ধারণ করে তার হয়েই থাকতে পারি।এই যেন তৌফিক তিনি আমাকে দেন।’
‘বাহ! কি স্বার্থপর গো তুমি!’
আচমকা নক্ষত্রের এমন কথায় থতমত খেয়ে গেল ইরিন। অবাক স্বরে প্রশ্ন করলো, ‘কেন?’
‘এই যে সব শুধু নিজের জন্য চাইলে। নক্ষত্রেরও তো তার পরীকে লাগবে আমৃত্যু। সেটার কথা একবারও ভাবলে না তুমি? ছিঃ ইরিন। ইউ আর ভেরি সেলফিশ।’ মেকি অভিমান দেখিয়ে বললো নক্ষত্র।
তার এ কথায় ফিক করে হেসে ফেললো ইরিন। নক্ষত্র ভ্রু কুচকে তাকালো। ইরিন তার চুলগুলোয় আঙুল চালাতে চালাতে বললো, ‘এমন স্বার্থপর হয়ে যদি এপার -ওপার সব জীবনেই নক্ষত্রকে নিজের জন্য পাওয়া যায় তবে আমি স্বার্থপরই ভালো। বাকি পরীকে চাওয়ার আর নিজের করে রাখার দায়িত্বটা নক্ষত্রের হোক। ‘
নক্ষত্রও এবার হেসে ফেললো ইরিনের কথায়। হাসি জড়ানো মুখে ইরিনের কোমড় ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে আনলো। ইরিনের মুখপানে চেয়ে বললো, ‘জো আপকি মার্জি মেরি, পারী।’
ইরিন মিষ্টি করে হাসলো তার কথায়। নক্ষত্র এবার বললো, ‘আমার বাসররাতের গিফট কই?’
ইরিনের হাসি মিলিয়ে গেল। এ কি বলে নক্ষত্র! সে কোন গিফট আনা তো দূর এভাবে নতুন করে বিয়ে, বাসররাতের জন্যও প্রস্তুত ছিল না। অথচ নক্ষত্র নিজ থেকে গিফট চাইছে। নিজ থেকে খুব কমই কিছু চেয়েছে সে আজ পর্যন্ত ইরিনের কাছে। কিন্তু এখন কি বলবে সে? কি দিবে তাকে?
ইরিন আমতা আমতা করে বললো, ‘গিফট তো নেই।’
‘প্রথম বাসরেও কিন্তু দাওনি কিছুই।’ চট করেই তাকে খোঁচা মেরে বলে বসলো নক্ষত্র। ইরিন এবার সত্যি সত্যি লজ্জায় পড়ে গেল। নিজেকে লজ্জা থেকে উদ্ধারের জন্য বললো, ‘আ..আমি তো আসলে জানতাম না….এভাবে এসব কিছু হবে।তাই গিফটও এরেঞ্জ করা হয়নি কিছু। ‘
‘তাহলে একটা কাজ করি চলো। দুজনে মিলে গিফট এরেঞ্জ করি।’ ইরিনকে এ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের উপায় হিসেবে বললো নক্ষত্র।
ইরিন বিভ্রান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো, ‘কিভাবে?’
নক্ষত্র ইরিনকে কোলে বসিয়ে কানে কানে কিছু বললো। ইরিন পুরো তাজ্জব বনে গেল নক্ষত্র গিফটের আইডিয়া শুনে। আপত্তি জানিয়ে বললো, ‘আইডিয়া খুবই বাজে। আর তাছাড়া এটা কোন গিফট হইতে পারেনা। আমি অন্য কিছু দিয়ে দিবো পরে আপনাকে।’
‘অন্যকিছু চাইনা আমার। এটাই লাগবে। দিবা না?কষ্ট কি বেশি হয়ে যাবে তোমার, ইরিন?’
ইরিন এবার ভীষণ অসহায়বোধ করলো। নক্ষত্রকে এই উপহার দেওয়ার সক্ষমতা ওর সত্যিই এখনো আর আছে কি না জানা নেই তার। তবে, নক্ষত্রের এমন চাওয়াকে উপেক্ষা করতেও তার কষ্ট হবে ভীষণ। ইরিন ভাবলো এই নিয়ে।
জীবন সামন্য ভুলের শাস্তিও কত সময় কত নিষ্ঠুরতার সাথে দেয় যা জীবন ভর বয়ে বেড়াতে হয়। পুতুলের জন্মের পর অনিয়মিত পিরিয়ড সহ বেশ কিছু সমস্যার জন্য যখন ড. সুব্রতর শরণাপন্ন হয় ইরিন,ডক্টর তখন রিপোর্ট দেখে জানায়
বিভিন্ন শারিরীর জটিলতায় ইরিনের সন্তান ধারণের ক্ষমতা কমে গেছে। যদি কন্সিভ করেও পুনরায় সন্তান জন্মদানও অনেক কষ্টকর হবে। এটা নক্ষত্র জানেনা। তাই আজ এতগুলো বছর পর অজ্ঞাত নক্ষত্র দ্বিতীয় সন্তান চাইছে।
একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার বুক চিরে। তারপরও,মুখে মিষ্টি হাসি জিড়িয়ে নক্ষত্রের উৎসুক চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘উহু। আল্লাহ চাইলে ইন শা আল্লাহ এটাই হবে আপনার উপহার।’
‘খুব ভালোবাসো আমাকে?’
‘বলতে পারছিনা। ভালোবাসার পরিমাপ তো করতে জানি না।’
‘আমি এমনি বলেছি। লাগবে না আমার এমন উপহার যেটার জন্য তোমাকে কষ্ট পেতে হবে। তাছাড়া, পুতুল তো আছেই। ‘
‘কিন্তু, আমিও যে এখন এটাই দিতে চাই। নক্ষত্রের অংশ আরেকটা নক্ষত্র! ‘
‘তুমি শিওর?’
‘ইচ্ছা যখন দুজনেরই তখন চেষ্টা করতে ক্ষতি কি!বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা।’ স্মিত হেসে বললো ইরিন।
‘কিন্তু তার আগে প্রস্তুতি নেওয়া লাগবে।আমি গতবারের মত ভুল করার রিক্স নিবো না আর। আচ্ছা, যাই হোক…এখন চলো তো।’
‘কই যাবো?’
‘ছাদে।’
ইরিন ঘড়িতে সময় দেখলো। রাত দেড়টা প্রায়। অবাক গলায় বললো, ‘এত রাতে ছাদে কেন? এই না তখন এলাম ছাদে থেকে।’
‘শুনেছি ভরা পূর্ণিমায় পরী নেমে আসে ছাদে।আমার ভীষণ শখ পরীর সাথে একটা রাত গল্প করে কাটাবো।’
‘মানে কি? কি সব বলতেছেন পুতুলের বাবাই?’
নক্ষত্র ইরিনের প্রশ্নের কোন জবাব দিল না।বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে ঘরের দরজা খুললো। ইরিন কি হচ্ছে তা বুঝার চেষ্টা করছে। তাকে অবাক করে দিয়ে নক্ষত্র তাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে বললো, ‘আমার ব্যক্তিগত পরী থাকতে পরপরীর সাথে গল্প করাটা অন্যায় হয়ে যায়। কিন্তু, শখ যখন হয়েছেই সেটা পূরণ তো করাই লাগে নাকি?! So…lets go.’
ইরিন প্রথমে অবাক হলেও নক্ষত্রের এমন পাগলামোতে হেসে ফেললো সে। নক্ষত্রের গলা জড়িয়ে ধরতেই নক্ষত্র পা বাড়ালো ছাদের দিকে।
১৮৩.
৪ বছর পর,
‘ভাবী…..তুমি কি শেষবার একবার ছুঁয়ে দেখবা না ভাইয়াকে? তাকে কিন্তু একটু পরেই নিয়ে যাবে। এই ভাবী…’
মেহের কথায় বিমূঢ় ইরিন একপলক তার দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। নিজের পেটের উপর হাত রেখে সামনে রাখা খাটিয়ার দিকে তাকালো।সাদা ধবধবে কাফনের কাপড় জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে নক্ষত্র। ক্ষত বিক্ষত মুখটাই দেখা যাচ্ছে শুধু। আজ আবারও এই শ্বেতশুভ্র এ রঙে নক্ষত্রকে দেখে ভয় হলো তার। বুকের ভেতর অনবরত কামড়ে যাচ্ছে কিছু একটা। যেন খুবলে খুবলে খাচ্ছে তাকে। কিছু দূরেই দু বছর বয়সী ছোট্ট ছেলেটার গলাফাটানো চিৎকার শুনতে পাচ্ছে ইরিন।বাড়িভর্তি এমন পরিবেশ আর এত মানুষ দেখে ভয় পাচ্ছে সে। মাকে খুঁজছে। কিন্তু, কেউ তাকে তার মায়ের কাছে যেতে দিচ্ছে না। রিতু পুতুলকে বুকে জড়িয়ে বসে আছে এক কোণায়। শায়লা হিমশিম খাচ্ছেন বাচ্চাটাকে সামলাতে।
দেড় বছরের চেষ্টা ও চিকিৎসার পর আবারও মা হয়েছে ইরিন।দুই সন্তানের পর, পুনঃরায় তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা এখন সে।।নক্ষত্রকে জানানো হয়নি এ কথা। এই তো দুদিন আগেই জানতে পেরেছে সে। নক্ষত্র দেশের বাইরে ছিল।ভেবেছিল বাড়ি ফিরলে জানাবে তাকে।
গতকাল দেশে ফিরেছিল। কিন্তু, ফেরা হয়নি ঘরে। নিজের পরিবারের কাছে। জানা হয়নি অনাগত সন্তানের কথা। এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি ফেরার পথে গাড়ি দূর্ঘটনার শিকার হয়।একটা ট্রাক খুব বাজেভাবে ধাক্কা দেয় তার গাড়িটিকে। ড্রাইভারের স্পট ডেথ। নক্ষত্রকে যতক্ষণে উদ্ধ্বার করে হাসপাতালে নেওয়ার পর তাকে লাইফ সাপোর্টে দেওয়া হয়। ডাক্তাদের অনেক চেষ্টার পরেও ৮ ঘন্টা পর সে মারা যায়। শেষ সময় ইরিন ছিল কাছে। কিন্তু, দূরে দরজার বাইরে। নক্ষত্রের জ্ঞান ফিরেছিল কিছু সময়ের জন্য। কিন্তু,কথা বলার অবস্থা ছিল না তার। শুধু ইরিনকে দেখেছিল নিস্তেজ চোখে। এই ছিল তাদের শেষ দৃষ্টি বিনিময়।
নক্ষত্র নেই এক কথাটা জানার পর থেকে একদম চুপ হয়ে গেছে ইরিন। মেহের বা কেউ কোনভাবেই কথা বলাতে পারছেনা তাকে দিয়ে। নক্ষত্রকে বাড়ি আনার পরেও একবারও তাকে ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখেনি ইরিন। নক্ষত্রকে নিয়ে যাওয়া হবে একটু পরেই। মেহের, রিতু, আম্বিয়া অনেক বলে কয়েও কিছুই বলাতে পারেনি তাকে। মেহের এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছে। ইরিন স্বাভাবিক হচ্ছে না কিছুতেই। সে সব দেখছে, শুনছে, বুঝতে পারছে কিন্তু কেউ যেন তাকে অবশ করে রেখেছে। গলা চেপে ধরেছে। টু শব্দটাও বের হচ্ছে না।
______________
‘লাশ তো নিয়ে যাবে এখনি। ওর গয়নাগাটি খুলো।সাদা শাড়ি পড়াও। আর কত এই সাজে বইসা থাকবে?’ ইরিনের বড় খালা শাশুড়ি বললেন। ইরিন তা শুনলো কিন্তু তাও কিছু বললো না। ওর মনে পড়ে গেল নক্ষত্রের বলা কথাটা।
নুপুরের স্বামী যখন মারা যায়….সম্পর্ক ছিন্ন করতে না পারার দায়ে তারা ও বাড়ি যায়। তখন নুপুরের বিধবা সাজ দেখে বাড়ি ফিরে সে ইরিনকে বলেছিল, ‘ইরিন….ফুপুকে যেভাবে বিধবা সাজানো হয়েছে এমন কোন নিয়ম কিন্তু ইসলামে নেই। এসব নাকফুল, চুড়ি খুলে ফেলা, সাদা শাড়ি পড়ার কোন বাধ্যকতা নেই ইসলামে। জীবনে এমন কোন পরিস্থিতি আসলে তুমি কিন্তু কখনোই এমন কু সংস্কার মানবে না। এখন যেমন আছো তেমনই থাকবা। তোমার সাজ সজ্জায় যেন কখনো মলিনতা না ছোঁয় তোমাকে।’
ইরিন সেদিন খুব রাগ করেছিল নক্ষত্রের কথায়। কিন্তু, এমন দিন, এমন পরিস্থিতি যে সত্যিই তার জীবনেও আসবে ভুলেও কখনো কল্পনা করেনি সে। অথচ আজ তাকেও কুসংস্কারে কূপে ফেলে দেওয়া হচ্ছে।
একজন মহিলা এসে ইরিনের চুড়িতে হাত দিয়েই নিরবেই হাত সরিয়ে নিল ইরিন। মহিলা বললো,
‘এগুলা খুলো বউ। এখন আর এসব পড়ার নিয়ম নাই। বিধবা হইছো….স্বামীর মান রাখো। ‘
‘আপনি এসব কি কথা বলতেছেন আন্টি? ইসলামে এমন কোন নিয়ম নাই। ‘ মেহের বাঁধা দিয়ে বললো।
‘তুমি দুইদিনের বাচ্চা মেয়ে তুমি কি জানো এসবের? ‘
‘ সঠিকটা জানার জন্য দুই দিন বা দুইশ দিন লাগে না আন্টি। ইসলামের যা নিয়ম তা সবার জন্য শুরু থেকেই এক। আপনারা সমাজ সংস্কারের নামে এগুলাকে বিকৃত করে ফেলছেন। ‘
‘মেয়ে তুমি কিন্ত..’
‘মেহের ঠিকই বলছে আপা। ইরিনের গয়না খোলার দরকার নাই। সাদা কাপড়ও ও পড়বে না। নক্ষত্র এসব মানতো না। ‘ কঠিন গলায় বললেন শায়লা।
তাদের কথার মাঝেই ইরিন আস্তে ধীরে উঠে দাঁড়ালো। দূর্বল শরীরে এগিয়ে গেল খাটিয়ার কাছে। রাফিদ তাকে ধরে নক্ষত্রের মাথার কাছে বসিয়ে দিল। মাথার কাছে সেলাই, চোখের কাছেও সেলাই পড়েছে। ঠোঁট কেটেছে। এছাড়াও সমস্ত শরীরে কম বেশি বেশ কিছু ক্ষত আছে। কাফনে মোড়ানো থাকায় কেবল মুখটাই দেখা যাচ্ছে। ইরিন হাত বাড়িয়ে নক্ষত্রের মুখটা ছুঁয়ে দিল আলতো করে। কপালে ছুঁয়ে দিল ভালোবাসাময় শেষ চুম্বন। কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে করে বললো,
‘শুনতে পাচ্ছেন নক্ষত্র? আরেক টুকরো নক্ষত্র আসছে আমাদের প্রেম জমিনে। খুশি হয়েছেন আপনি? শুনতে পাচ্ছেন তো আমার কথা? নক্ষত্র? এই নক্ষত্র….পুতুলের বাবাই….শুনতে পাচ্ছেন না আপনি?? কিছু বলছেন না কেন? এই নক্ষত্র? আপনার সন্তান আসছে….আপনি খুশি হয়নি? এপর্যায়ে প্রায় ফুঁপিয়ে উঠা কান্না তার আর্তনাদে রূপ নিল। চিৎকার করে ডাকতে থাকলো সে নক্ষত্রকে। মেহের ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো তাকে।
কনক, শায়লাও এবার আর নিজেদের ধরে রাখতে পারলো। ইরিনের মুখে তার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার কথা যেন মূহুর্তেই বজ্রাহত করে দিয়েছে তাদের নতুন করে। রিতু পুতুলকে জড়িয়ে কাঁদছে। পুতুল ভয়ে গুটিসুটি মেরে রিতুর বুকে মুখ লুকিয়েছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।রাফিদ কি করবে বুঝতে পারছে না। নক্ষত্রকে হারানোর কষ্ট তারও যে কম নয়।
গত মাসে ওয়াসিফ জেলে আত্মহত্যা করে। নক্ষত্র, রাফিদ ওই বাড়ি যাওয়ার পর নুপুর অনেক আজেবাজে কথা বলেছে তাদের। নক্ষত্রের উপর ভীষণ ক্ষিপ্ত ছিল সে। রাফিদের ধারণা নক্ষত্রের এমন এক্সিডেন্টের পেছনে নুপুর রায়হান জড়িত। যদিও কোন প্রমাণ নেই। তবুও, এক্সিডেন্টের ধরণ স্বাভাবিক নয় বলেই জানিয়েছে পুলিশ। ইরিনকে বলেনি এই কথা। তাকে এই কষ্টে দেখেই তার সহ্য হচ্ছে না তার। সত্যি জানলে সামলাবে কি করে সে নিজেকে?এই ভেবেই বলেনি। এত কষ্টেও দায়িত্ব থেকে পিছু সরে আসতে পারলো না সে। নক্ষত্রকে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিল।
______________
পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন মূহুর্ত, কষ্টের হচ্ছে বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ।নাফিজ শেখ সারাজীবন নক্ষত্রের সাথে থেকেও বাবা ছেলের সাবলিল সম্পর্ক গড়তে পারেননি। একটা সূক্ষ ও স্পষ্ট দূরত্ব বরাবরই ছিল তাদের মাঝে। নাফিজ শেখ নিজের অপরাগতায় অনুতপ্ত হয়েও কখনো ক্ষমা চাওয়ার সাহস করে উঠতে পারেননি নক্ষত্রের কাছে। তবুও, সম্পর্ক ও দায়িত্বের খাতিরে নক্ষত্র তাকে বাবার সম্মান ও অধিকার সবটা দিয়েছে। কেবল দেয়নি ভালোবাসাটুকু। শেষে একটা অপূর্ণ সম্পর্ক রেখেই ওপারের পথে পা রেখতে হয়েছে নক্ষত্রকে।
আজ নাফিজ শেখ ভাবেন, যদি একটাবার তার অহংকে পেছনে ফেলে নক্ষত্রের কাছে ক্ষমা চাইতো, তাকে কাছে টানার চেষ্টা করতো আজ হয় তো এতটা আফসোস নিয়ে ছেলেকে কবরের অন্ধকারে রেখে আসতে হতো না। এই জন্যই বলে সময় গেলে সাধন হয় না। স্রোতের মত সময়….তবুও বড্ড দামী এই সময়!
নক্ষত্রকে যখন নিয়ে যাওয়া হলো ইরিন তখন জ্ঞানহীন হয়ে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়েছিল। তার জীবনের নক্ষত্রকে শেষ যাত্রায় দেখা হয়নি তার। জ্ঞান ফেরার পর থেকেই আরও বেশি নিরবতা যেন জাপটে ধরেছিল তাকে।
রাফিদ, মেহের অনেক বুঝিয়ে স্বাবাবিক করেছে তাকে কিছুটা। কিন্তু, অতিরিক্ত স্ট্রেস…শারীরিক দূর্বলতা এবং হরমোনজনিত সমস্যার কারণে মাস গড়াতেই এক রাতে প্রবল রক্ত ধারায় মিশে বাচ্চাটাও মিসক্যারেজ হয়ে যায়।
নক্ষত্রের শেষ চিহ্নকে আগলে রাখতে পারার ব্যর্থতায় নিজেকে দায়ী করে নতুন শোকে জড়ায় সে। ডিপ্রেশন, শারীরিক সমস্যায় জর্জরিত হয়ে অসুস্থ থাকে দীর্ঘদিন। এ সময়টা মেহের, রিতু , রাফিদ, শায়লা মিলে সামলেছে তাকে। তার দুই সন্তানকে।
পৃথিবীতে মা এমন একটা স্বত্তা যে কখনো হার মানে না। সব বিপদ, দুঃখ কাটিয়ে ফিরে আসে সন্তানের টানে। ইরিনও নক্ষত্রের শোক নিয়েই ধীরে ধীরে তার রেখে যাওয়া অস্তিত্বদের জন্য নিজেকে সামলে নিয়ে জীবন যুদ্ধে নেমে যায়। পারিবারিক ব্যবসা সামলে, সন্তানদের আদর স্নেহে বড় করেছে।
সময়ের সাথে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন নাফিজ শেখ। শায়লাও বয়সের সাথে সাথে, সময়ের দেওয়া আঘাতে নুইয়ে গেছেন অনেকটা। তবুও, জীবন জীর্ণতা ঠেলে এগিয়ে গেছে স্রোতের মতই।
১৮৩.
১৩ বছর পর, এক সন্ধ্যায়…
‘আম্মুউউ!! তুমি এখনো এটা নিয়ে বসে আছো? নীচে সবাই ওয়েট করতেছে তোমার জন্য। তোমাকে ছাড়া তারা তো ফাংশন স্টার্ট করতে পারছেনা। নীচে চলো। ‘
ইরিনকে ডাকতে এসেছে ধ্রুব। ছেলের কথায় তার দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো ইরিন। ডায়রির পাতাটায় কলম গুঁজে দিয়ে বন্ধ করলো ওটা। আস্তে করে উঠে দাঁড়ালো চেয়ার ছেড়ে। ছেলের নির্লিপ্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছু সময়। মুখটা অবিকল বাবার মতই মায়ায় ভরা। চোখজোড়া যেন তার বাবার চোখের ছাঁচে গড়া। হাসিটাও নক্ষত্রের মতই উজ্জ্বল সর্বদা। কেবল গায়ের রংটা যদি ইরিনের মত না পেত তবে তাকে দ্বিতীয় নক্ষত্রই বলা যেত অনায়াসেই। ইরিনকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ধ্রুব আবারও তাড়া দিল।
‘আম্মু চলো না। মেহের চাচী ডাকতেছে তোমাকে।’তাড়া দিল ধ্রুব।
‘আমার ছেলেটাকে মাশাল্লাহ খুব হ্যান্ডসাম লাগছে।’ ইরিন বললো।
‘ বাবার মত?’
ছেলের এমন প্রশ্নে চোখে প্রাচীন বিষাদ ভিড় জমাতে শুরু করলো ইরিনের। কিন্তু, ছেলের উচ্ছ্বাসিত মুখের দিকে তাকিয়ে তাতে অবরোধে টানলো সে। মুখের হাসিটা বিস্তৃত করে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
‘হ্যাঁ, আব্বু। একদম বাবার মত।’
ধ্রুব স্মিত হাসলো মায়ের কথায়। খুব অল্প সময় বাবাকে নিজের জীবনে পেয়েছে সে।বাবার স্মৃতি মনেও নেই ঠিকঠাক মত কিছুই। তবুও বাবার প্রতি তার অগাধ শ্রদ্ধা, ভালোবাসা। এ ভালোবাসা আরও কয়েকগুণ বেড়ে যায় যখন সে রাফিদের কাছে তার বাবা মায়ের জীবনের গল্পটা শুনে। আর আজ সেই কাহিনীটাই ছাপা অক্ষরে বইয়ের পাতায় চড়ে পৌঁছে যাবে অন্য আরও অনেক মানুষের কাছে।
____
কয়েকমাস আগে পুতুলের খুব কাছের বন্ধু সৌরভ তার মুখে নিজের বাবা মায়ের ভালোবাসার গল্প শুনে সেটাকে বই আকারে প্রকাশ করতে চায়। সৌরভের বাবা একজন প্রকাশক। সেই সূত্রে সে কাহিনী নিয়ে হাজির হয় তার বাবার কাছে। উনি ছেলের ইচ্ছেতে সায় দেন। সৌরভ আসে ইরিনের কাছে। ইরিন রাজি হয় না।
পুতুলের সাথে তার বন্ধুর মত সম্পর্ক বিধায় তার জীবনের ছোট বড় সব কথাই কম বেশি শেয়ার করে পুতুলের সাথে। নক্ষত্রের ছত্রছায়া যেন এই পুতুল। তবে,এ বিষয়ে এভাবে অন্য কারও সাথে শেয়ার করায় ভীষণ নারাজ হয় ইরিন পুতুলের ওপর।
কিন্তু, সৌরভ নাছোড়বান্দা। তারভাষ্য মতে এমন একটা কাহিনী কোন অমর প্রেম কাহিনীর চাইতে কম নয়। জীবন আমাদের অনেক কিছু শেখায়। যা আমরা নিজের ক্ষেত্রে জেনেও বুঝিনা, অন্যের দৃষ্টিতে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ইরিন নক্ষত্রের বিবাহিত জীবনের গল্পটাও ঠিক তেমনই। এটা মানুষের কাছে তুলে ধরা উচিৎ। ইরিনও কম জেদি নয়। রাজি হয় না।
সৌরভ হাল ছাড়ে না। এভাবেই একদিন ধ্রুব সবটা জানতে পেরে ইরিনকে খুব করে অনুরোধ করে। ইরিন ধ্রুবর মায়া মায়া চোখের দিকে তাকিয়ে তার আকুল আবেদন ফেলতে পারে না আর। রাজি হয়।
লিখতে শুরু করে তার নক্ষত্র বন্দনার গল্প। আজ তারই মোড়ক উন্মোচনের অনুষ্ঠান।
_________
‘আম্মু, তোমার হয় নাই? সবাই নীচে ডাকছে তো..কথা বলতে বলতে ঘরে ঢুকেই থমকে গেল পুতুল।
রূপালী পাড়ের কালো বেনারসি, রূপার গয়না, কালো হিজাবে জড়ানো ফর্সা একটা মুখ। কাজলটানা টলমলে চোখ।এই নারীটিকে দেখে অনায়াসে একটা দুটো হার্টবিট মিস করে গেল পুতুল। মাঝে মাঝে তার মনে এত সাদা মাটা হয়েও এত নিখুঁত সৌন্দর্য্যের অধিকারী কেউ কিভাবে হয়! সে চাইলেও কখনো এত সুন্দর হতে পারবে না কখনোই। অবশ্য সেই চেষ্টাও যে সে করে তাও না।
তার মনে পড়ে, একবার একজন বলেছিল সে দেখতে কালো। মায়ের মত সুন্দর হয়নি সে। বয়স তখন সাত বছর তার। বাড়ি এসে খুব কান্না কাটি করে এই নিয়ে। তার অভিযোগ ছিল কেন সে তার মায়ের মত সুন্দর নয়। নক্ষত্র তখন তাকে বলেছিল , ‘তুমি কি কখনো পরী দেখেছো, পুতুল আম্মু? ‘
কান্নারত পুতুল তখন চুপ হয়ে অবাক স্বরে বলেছিল, ‘না তো। পরী কি সত্যি সত্যি হয় বাবাই?’
‘হ্যাঁ, হয় তো সোনা। এই যে তোমার আম্মু হচ্ছে একটা পরী। নক্ষত্র রাজ্যের পরী। তোমার যখনই পরী দেখতে ইচ্ছে করবে তুমি তোমার আম্মুকে দেখবা, কেমন?’
বিস্মিত পুতুল তখন জিজ্ঞেস করেছিল , ‘আম্মু পরী হয় কি করে বাবাই? আম্মুর তো ডানা নেই।পরীর মত সাজেও না আম্মু।’
নক্ষত্র তখন হেসে বলেছিল, ‘জমিনের পরীদের ডানা থাকে না আম্মু। কিন্তু, তাও ওরা ডানাওয়ালা পরীদের থেকেও বেশি সুন্দর হয়। ওদের খুব বেশি সাজতেও হয় না। একটুতেই অনেক বেশি সুন্দর লাগে।’
‘আম্মু কি ম্যাজিক জানে বাবাই? আম্মুর ম্যাজিক স্টিক কই?’
‘জমিনের পরীদের স্টিক থাকে না, পুতুলসোনা। তোমার আম্মুরও নেই। কিন্তু, তোমার আম্মুও ম্যাজিক করতে জানে।’
‘ওয়াও…আম্মু, সত্যিই ম্যাজিক জানে? কি ম্যাজিক বাবাই?’
‘আম্মু ভালোবাসতে জানে, পুতুলসোনা। ভালোবাসা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যাজিক। এটা দিয়ে যাই করবা তাই সুন্দর হবে।’
‘ আমি তো আম্মুর মত সুন্দর না বাবাই।তাহলে আমি কি পরী না, বাবাই?’
‘কে বলেছে তুমি সুন্দর না?’
‘বলেছে তো। এই যে দেখ আমি আম্মুর মত ফর্সা না। ‘
মেয়ের কথায় সেদিন খুব হেসেছিল নক্ষত্র। তাকে আদর করে বলেছিল, ‘ফর্সা কালো দিয়ে কেউ কখনো সুন্দর হয় না পুতুলসোনা। মানুষ সুন্দর হয় তার সুন্দর মন দিয়ে। চিন্তা দিয়ে। আর, তুমি হচ্ছো সবচেয়ে সুন্দর একটা পুতুল। তোমার আম্মু আর বাবাইয়ের ভালোবাসায় গড়া পুতুল।এটাকে যে সুন্দর বলবে না সে একটা ভূত। সুন্দর চিনে না।’
নক্ষত্রের কথায় পুতুল খিলখিলিয়ে হেসেছিল সেদিন। তারপর থেকে নিজের রূপ রঙ নিয়ে আর কখনো মন খারাপ হয়নি তার। নক্ষত্রের কথা স্মরণে রেখেই পরীর পুতুল হয়ে গড়ে তুলেছে নিজেকে। ইরিনও তাকে নক্ষত্রের ছত্রছায়ায় রূপ দিয়েছে। তাদের ভালোবাসার প্রথম পূর্ণ অস্তিত্ব যে এই পুতুলই!
__________
‘এই তো আম্মু। আমি রেডিই আছি। নীচেই আসতেছিলাম। ধ্রুবও ডাকতেই আসছিল।’ ইরিনের কথায় ভাবনাচুত্য হলো পুতুল। মিষ্টি করে হেসে বললো, ‘মাশাল্লাহ…কি সুন্দর লাগতেছে আম্মু তোমাকে! একদম নক্ষত্ররাজ্যের পরীর মত।’
ধ্রুবর সামনে এভাবে বলায় ঈষৎ লজ্জা পেয়ে গেল ইরিন। একদম বাবার মতই তাকে লজ্জায় ফেলতে ওস্তাদ এই মেয়ে।
মেয়েকে কপট শাসন করে বললো, ‘হয়েছে…একদম বেশি বলা শিখছো। ‘
‘আপ্পাই মোটেও বেশি বলছে না আম্মু। তুমি সত্যিই নক্ষত্ররাজ্যের পরী।’ ধ্রুব পুতুলের কথায় সায় দিয়ে বললো।
ইরিন মলিন হাসলো। এই রূপ সৌন্দর্যই বা আর কত দিন। এই তো ক’দিন পরেই ক্যামো থেরাপি শুরু হবে। চুল পড়ে যাবে।রেডিও থেরাপিতে চামড়া পুড়বে। তখনও কি তাকে পরী বলবে এরা?
জরায়ুর ক্যান্সারে ভুগছে সে। তৃতীয় ধাপের শেষ পর্যায়ে আছে এখন। চিকিৎসার পরেও কতদিন বাঁচবে জানা নেই। তবুও, সন্তানদের একটা সুন্দর ভবিষ্যতের ব্যবস্থা না করে দেওয়া পর্যন্ত এ লড়াই করতে হবে তাকে। বাকি হায়াত মউত সবই তো সৃষ্টি কর্তার ইচ্ছা।যদিও ইরিনের ধারণা সৌরভের সাথেই পুতুলের ভবিষ্যৎ জড়াবে। সৌরভকেও পছন্দ তার। বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা।
ধ্রুব এখনো কিছুই জানে না। বয়স মাত্র ১৫ বছর। এত কঠিন সত্যি মানতে কষ্ট হবে ওর। কেবল পুতুল, রিতু, মেহের আর রাফিদ জানে। নক্ষত্রের ভাই না হলেও ভাইয়ের মতই দায়িত্ব পালন করেছে সে। ইরিনের প্রতি বন্ধুত্ব পালন করেছে নিষ্ঠার সাথে। তার সন্তানদের আদর স্নেহ দিয়েছে, আগলে রেখেছে। মেহের নিজের বোনের মত ভালোবাসে ইরিনকে। রিতুকে নক্ষত্র যেভাবে আগলে রেখেছিল রাফিদ, মেহেরও সেভাবেই স্নেহ করেছে তাকে। নক্ষত্র তাকে ছেড়ে গেছে ঠিকই কিন্তু তৈরী করে রেখে গেছে অনেকগুলো সুন্দর সম্পর্ক আর এমন একটা পরিবার।
‘নীচে চলো আম্মু। দেরি হয়ে যাচ্ছে।’ মায়ের মলিন হাসির অর্থ বুঝতে পেরে পরিস্থিতি সামলে নিতে পুতুল তাড়া দিল।ইরিন মাথা নাড়িয়ে সাই দিল। তারপর, দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে নীচে নেমে গেল।
___________
নক্ষত্রবাড়ি আজ আরও বেশি আলোয় ঝলমল করছে। নীচের পুরো জায়গাটা জুড়ে আয়োজন করা হয়েছে অনুষ্ঠানের। নক্ষত্রের মৃত্যুর পর থেকে রিতু আর দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে এখানেই নতুন জীবন শুরু করে সে। রাফিদ, মেহেরও এখানেই থাকে। রিতুর বিয়ে হয়েছে তিন বছর। স্বামীর সাথে ঢাকা থাকে। এখানেও আসে প্রায়ই।আজও এসেছে স্বামী সন্তান নিয়ে।
ইরিন নীচে আসতেই রাফিদ তাকে খোঁচা মেরে বললো, ‘এতক্ষণে আসার সময় হলো আপনার ভাবীসাহেবা? আমি তো ভেবেছিলাম আজও বইখানা পড়ারই সুযোগ হবে না আমার।’
‘তো আপনাকে কে বলেছিল, এতসময় অপেক্ষা করতে? পাণ্ডুলিপি তো দিয়েইছিলাম পড়ার জন্য। আপনিই তো বেঁকে বসলেন, বই এলে তবেই পড়বেন। ‘
‘ছাপা অক্ষরের মলাটবদ্ধ গল্প পড়ার স্বাদই আলাদা। সে আপনি বুঝবেন না।’
‘গল্প তো আপনার জানাই। খোলা বই আমি আর নক্ষত্র আপনার কাছে। ‘
ইরিনের এ কথায় স্মিত হাসলো রাফিদ। মেহের এসে বললো, ‘ভাবী…মাহিন সাহেব স্টেজে যেতে বলেছেন। আসো। ‘
‘হ্যাঁ, চলো।’ ইরিন বললো।
———
এনাউন্সমেন্টের পর কালো ফিতায় বাঁধা, কালো যার্পিং পেপারে মোড়ানো বইটা তুলে দেওয়া হলো ইরিনের হাতে। ইরিন সেটা খুলতেই কালো মলাটের একটা বই বেরিয়ে এলো। একটি মেয়ের নক্ষত্র ছোঁয়ার ছবি আঁকা তাতে। সাদা কালির অক্ষরে বড় বড় করে লিখা, ‘ নক্ষত্র বন্দনা।’ নামটির ঠিক নীচেই ছোট করে লিখা, ‘প্রাপ্তি থেকে অর্জনের গল্পকথা।’ লেখিকার নাম, ‘ইয়াসিন রাওনাফ ইরিন।’
ইরিন পরম ভালোবাসায় হাত বুলিয়ে দিল নামটার উপর। টলমলে চোখের তারায় ভেসে উঠে মনে গাঁথা নক্ষত্রের মায়া মায়া মুখোয়ব। ইরিন মৃদু স্বরে আউড়ায়,
‘আমি ছুঁয়ে দেখিনি তার
গভীর তম কোনো অসুখের কথা,
দেখি শুধু তার অভিমানী নিষ্প্রাণ চোখে
না থাকার বোধ;
আমি কথা দেই তাকে বিশাখার মাঝ রাতে;
যখন সে ঘুমাবে শেষে, আমিও ঘুমাবো তার সাথে।’
(নক্ষত্র বন্দনা)
(মেঘদূত)
(সমাপ্ত)