নষ্ট_গলি
পর্ব: ২০
লেখা: মিম
.
সোহানের বাসার ড্রইংরুমে মাথা নিচু করে বসে আছে রুপম। মুখোমুখি বসে আছে মায়া আর সোহান৷ আলিশাকে বাসায় লক করে এসেছে রুপম। সাথে করে ছেলেটাকে নিয়ে এসেছে যাতে আলিশা বাচ্চাটাকে মারধর না করতে পারে। রুপম জানে আলিশা এখন বাসায় তুমুল ভাংচুর চালাবে। বাচ্চাটা দেখলে ভয়ে বেহুঁশ হওয়ার উপক্রম হবে। তাই সাথে করে নিয়ে এসেছে। সালমানের বেডরুমে বসে এখন ইউটিউবে কার্টুন দেখছে। সোহানকে কিছু বলতে চাচ্ছে রুপম। কিন্তু গলার ঠিক মাঝখানটাতে এসে ঠেকে যাচ্ছে কথাগুলো। প্রায় বিশ মিনিট যাবৎ এভাবেই বসে আছে সে। এর মাঝখানে সোহান দুইবার জিগ্গেস করেছে পানি খাবে কিনা। সেই উত্তরটাও গলা দিয়ে আসছেনা রুপমের। সোহানও খুব বেশি জোরাজোরি করছে না কিছু বলার জন্য। সে বুঝতে পারছে রুপমের মনের অবস্থাটা এখন কেমন হতে পারে? সোহান ফের রুপমকে জিগ্গেস করলো
– তোমাকে অনেক স্ট্রেসড দেখাচ্ছে। স্ট্রং কফি খাবে? দিতে বলবো?
কোনোমতে গলায় শক্তি জুগিয়ে উত্তর দিলো রুপম।
– নাহ। একগ্লাস বরফ মিশানো পানি দেয়া যাবে? গলা পুরোপুরি শুকিয়ে গেছে।
মায়া সোফা ছেড়ে ছুটে গেলো ডাইনিং রুমে। ফ্রিজ থেকে বরফ বের করে বড় একটা গ্লাস পানিতে তিনটুকরা বরফ ছেড়ে দিলো।
রুপমের দিকে গ্লাস এগিয়ে দিলো মায়া। হাতে গ্লাস নিয়ে খুব দ্রুত পানি গিলছে সে। দেখে মনে হচ্ছে বিগত এক সপ্তাহ ধরে বোধহয় সে পানি খায় না। রুপমের মুখ দেখে বড্ড কষ্ট হচ্ছে মায়ার। করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে মানুষটার দিকে। পানি খেয়ে খুব বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিলো রুপম। তার চোখে পানি ছলছল করছে। মায়ার দিকে তাকিয়ে বললো
– ভাবী আসলে….
গলায় কথা ধরে আসছে তার। থেমে গেলো সে। মায়া স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মানুষটার চোখে পানি৷ এবার তারও কান্না পাচ্ছে। বহু কষ্টে চোখে পানি আটকে রেখেছে মায়া। কোনোমতে গলার স্বরটা ঠিক করে ফের বলতে শুরু করলো রুপম।
– ভাবী আমার বাচ্চাটা রাতে কিছু খায়নি। ওকে রেস্টুরেন্টে খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলাম। খায় নি। ও আসলে ভয় পেয়েছে খুব আমাদের ঝগড়া দেখে। আপনি ওকে একটু খাইয়ে দিবেন প্লিজ?
মায়ারও গলা ধরে আসছে। মুখ ফুটে কিছু বললো না ও। উপরে নিচে মাথা ঝাঁকিয়ে রান্নাঘরের দিকে ছুটলো সে।
– রুপম?
– হুম?
– তুমিও তো বোধহয় খাওনি। হাত মুখ ধুয়ে আসো। আমি টেবিলে খাবার দিতে বলছি।
– প্লিজ সোহান আমি খাবো না। গলা দিয়ে খাবার নামবে আমার।
– যা হয়েছে ওগুলো আপাতত একটু সাইড করো। অল্প কিছু খেয়ে নাও।
– বিষ আছে ঘরে?
– কি ধরনের কথা বলছো?
– লজ্জায় কষ্টে আমার মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। চোখে মুখে অন্ধকার দেখছি আমি৷ মরে যেতে হচ্ছে। বাচ্চাটার কথা ভেবে এ ধরনের স্টেপ নিতে পারছি না। আমি মরে গেলে ছেলেটার কি হবে? আলিশার তো বাচ্চাটার দিকে কোনো খেয়ালই নেই।
– আসলে রুপম তোমাকে কি বলা উচিত এই মূহূর্ত্বে আমার জানা নেই। আমি যাস্ট চুপচাপ তোমার অভিযোগগুলো শুনতে পারবো। কিন্তু সলিউশন কি দিবো তা আমার জানা নেই।
– ওকে আমি প্রচন্ড রকমে ভালোবাসি সোহান। একতরফা ভালোবেসেই গেছি। ওর কাছ থেকে কখনো ভালোবাসা পাইনি৷ একজন ওয়াইফ তার হাজবেন্ডকে কিভাবে আগলে রাখে, কতটা যত্ন করে সেসব আমার জানা নেই। আলিশার কাছে কখনো সেসব পাইনি আমি। বিয়ের আগে খুব এক্সপেকটেশনস ছিলো আমার ম্যারিড লাইফটা একদম আদরে মাখামাখি টাইপ হবে। আমার ওয়াইফ আমার ছোটখাটো প্রতিটা বিষয় খেয়াল রাখবে। কিছুই হলো না জানো? কিচ্ছু পাইনি এই বিয়ে থেকে আমি। ওর প্রেগনেন্সির খবর যখন ও জানতে পারলো পুরোপুরি পাগল হয়ে গেলো এ্যাবরশন করানোর জন্য। নয়টা মাস ওকে যে কিভাবে কন্ট্রোল করেছি! উফফ! মনে হলে এখনো আমার দম আটকে আসে। প্রথম প্রথম ভাবতাম ও হয়তোবা আমার সাথে এডযাস্ট হতে আনকমফর্টেবল ফিল করছে। নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি ওকে নিজের করে নেয়ার জন্য। স্টিল নাউ চেষ্টা করেই যাচ্ছি ওকে আপন করে পাওয়ার জন্য। কিন্তু এই রুপমের দিকে তার একবারের জন্য ঘুরেও তাকাতে ইচ্ছে হয় না। মাঝেমাঝে নিজেকে রাস্তার কুকুর বিড়াল মনে হয়। নিজেকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করি, রুপম তুই কি মানুষ? নাকি রাস্তার ক্ষুদার্থ কুকুর যে কি না একটু ভালোবাসার আশায় এতগুলো বছর যাবৎ আলিশার পিছনে ঘুরেই যাচ্ছিস।
কথাটা বলেই হাউমাউ করে কান্না শুরু করলো রুপম। সালমানের রুমে বসে রুপমের ছেলেকে খাওয়াচ্ছে মায়া। বাচ্চাটা খুব তৃপ্তি সহকারে খাচ্ছে। খাওয়া প্রায় শেষের দিকে। মায়া ইতিমধ্যেই ভাব জমিয়ে ফেলেছে ওর সাথে। বাহির থেকে কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে। ভাত মুখে নিয়ে বসে আছে সে।
– কি হলো বাবা? খাচ্ছো না কেনো?
– আন্টি… বাবা কি কাঁদে?
মায়া আর সালমান একজন আরেকজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। বিছানা ছেড়ে সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালো সালমান। বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বারান্দার দিকে এগোতে এগোতে মায়াকে বললো,
– মায়া তুমি ওকে চাঁদ দেখিয়েছো?
– না তো।
– ধুর বোকা। তুমি আফিফকে চাঁদ দেখাওনি? কত্তবড় চাঁদ উঠেছে। একদম বড় গোল রুটির মতন দেখতে। চলো বাবা, আমরা চাঁদ দেখবো। তারা গুনবো। আর ভাত খাবো।
তারা গুনার কথা শুনে ব্যাপক খুশি আফিফ। ব্যাপারটা তার কাছে খুবই ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে। আজ পর্যন্ত তারা কখনো সে গুনে দেখেনি। সালমানের কোলে থেকেই লাফালাফি শুরু করেছে তারা গুনবে সেই খুশিতে।
রুপমের দিকে আরও এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলো সোহান। এবার খানিকটা থেমে থেমে পানি খেলো সে। গ্লাসটা টি টেবিলের উপর রেখে আবার বলতে শুরু করলো রুপম।
– এই যে আমার এত প্রপার্টি অর্থ-বিত্ত। লাভ কি এসবের? আমার তো ঘরে শান্তি নেই। আমার চেয়ে ভালো আছে আমার অফিসের পিওন। তুমি ওকে চিনো না?
– আনিস নাম যে ওর কথা বলছো?
– হ্যা। তুমি জানো ওর বউটা প্রায়ই সেজেগুজে বক্সে ভরে খাবার নিয়ে আসে। অফিসের একটা কোনায় বসে ওর বউ ওকে মুখে তুলে খাইয়ে দিয়ে যায়। আমি আমার রুম থেকে বসে দেখি ওদের। তুমি জানো আনিসের মুখটা ঐ মূহুর্তে আমি বসে বসে দেখি৷ ও যে সুখে আছে সেটা তখন ওর মুখটা দেখলেই আমি বুঝি। অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করে। আবার আফসোসও হয়৷ আনিসের জায়গায় থাকলে খুব সুখে থাকতাম জানো। ওর হতে পারে অঢেল টাকা নেই। কিন্তু ও আমার চেয়ে বড়লোক। ওর ঘরে সুখ আছে যা আমার ঘরে নেই।
বেডরুমে বসে সিগারেট ফুঁকছেন সোহানের বাবা। কিছুক্ষণ আগেই তার একজন ক্লাইন্ট ফোন করেছিলো। কথায় কথায় সেই ক্লাইন্টের কাছ থেকে তিনি জানতে পারলেন তার বড় ছেলে বিয়ে করেছে। কিছুদিন আগেই নাকি এক পার্টিতে পরিচয় করিয়েছে সোহান তার ওয়াইফকে। ভদ্রলোক বেশ প্রশংসা করলেন মায়ার। ছেলের বিয়ের কথা অন্য লোকের মুখে শুনে এতক্ষণে তুফান চালানোর কথা ছিলো। কিন্তু তিনি যথেষ্ঠ ঠান্ডা মাথায় বসে সিগারেট ফুঁকছেন। তিনি যতটুকু সোহানকে চিনেন তার ছেলে এতটাও বেপরোয়া না যে বাপ মাকে ন জানিয়ে বিয়ে করবে। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে সোহান বিয়ে করে নি। ঘটনা এখানে অন্যকিছু। আর যদি বিয়ে করেও থাকে নিশ্চিত মেয়ের মাঝে কোনো সমস্যা আছে। ফ্যামিলিকে জানিয়ে বিয়ে করতে গেলে বাবা অবশ্যই মেয়ের খেঁাজ নিবে সেটা সোহান জানে। নিশ্চিত এমন কোনো সমস্যা আছে যেটা বাবাকে জানানো যাবে না। তাই সে চুপচাপ বিয়েটা সেড়ে নিয়েছে। কিন্তু এখন সত্যিটা জানা খুব দরকার। সোহান কি বিয়ে করেছে নাকি করে নি? সোহানকে জিগ্গেস করে লাভ নেই। সত্যিটা বলার হলে অনেক আগেই বলে দিতো। খবরটা অন্যভাবে নিতে হবে। কাকে জিগ্গেস করবে? জাহিদকে? নাহ, সেও মুখ খুলবে না। সালমান? ওকে জিগ্গেস করা যেতে পারে। ছোট ছেলের নম্বরে ডায়াল করলেন তিনি। ফোন রিসিভ করছেনা সে।
চলবে,,,,,,