নষ্ট গলি পর্ব ৪১ (শেষ)

#নষ্ট_গলি
পর্ব-৪১ & last
লেখা-মিম
আনিকার রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দাটা দক্ষিণমুখী। প্রায় সারাটাদিন ধরেই মাতাল হাওয়ার আনাগোনা থাকে এই বারান্দাটাতে৷ বিশেষ করে রাতের বেলায়। রাতের খাবার সেড়ে বারান্দায় বসে আছে আনিকা আর মায়া। খুব মনোযোগ দিয়ে আনিকার কথাগুলো শুনছে মায়া।
– বিশ্বাস করেছিলাম ওকে। এতটা করেছি যে নিজের সম্মানটুকু ওর হাতে তুলে দিতে দ্বিধা করিনি। কতটা বিশ্বাস করলে একটা মেয়ে মানুষ তার প্রেমিকের সামনে নগ্ন হতে পারে ভেবে দেখতো? আর ও কি করলো? বিশ্বাসটাকে পা দিয়ে পিষে ফেললো।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মায়া। চাইলে এই মূহুর্তে আনিকাকে কড়া গলায় বলতে পারতো, তোকে না করেছিলাম। কেনো গেলি?
এধরনের প্রশ্ন করাটা মায়ার কাছে অদ্ভুদ এবং অহেতুক মনে হয়। যা হয়ে গেছে তা তো আর বদলানো সম্ভব না। তাছাড়া তার কর্মফল তো সে ভুগছেই। নতুন করে তার কর্ম মনে করিয়ে দেয়ার কি আছে?
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলতে শুরু করলো আনিকা।
– ওর সাথে যতবার রুমডেটে গিয়েছি প্রতিবারই ওর কোনো না কোনো বন্ধুর বাসায় গিয়েছি। ওর বন্ধুরা জানতো ওর সাথে আমি……
জানিস সে মূহুর্তে এই কথাটা একটাবারের জন্যও মাথায় আসেনি বদ্ধরুমে আমি আমার প্রেমিকের সাথে কি করছি সেটা তো ওর বন্ধুরা জেনে যাচ্ছে। নিজেদের মধ্যে হয়তোবা আলোচনাও করছে। আমার আড়ালে হয়তোবা আমাকে নিয়ে নোংরা মন্তব্য করছে। আমার প্রেমিককে হয়তোবা জিজ্ঞেস করছে রুমডেট কেমন ছিলো? কেনো মাথায় আসেনি আমি জানিনা। সত্যি জানিনা৷ লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে বসেছিলাম একদম। আর এখন…. মনে হলেই গা কাঁটা দিয়ে উঠছে। কিভাবে পারলাম ওর বন্ধুদের সামনে দিয়ে ঐ রুমে যেতে? ওর বন্ধুরা জানতো কি কাজ করতে ঐ ঘরটাতে আমি যাচ্ছি। অনেক মানুষই হয়তো আমার নিকৃষ্ট কাজের গল্পটা জানে। রাস্তা দিয়ে যখন হেঁটে যাই তখন হয়তো আমার আড়ালে আমাকে নিয়ে বাজে কথা বলে। গা ঘিনঘিন করছে খুব। মনে হচ্ছে গায়ে আগুন লাগিয়ে দেই। কি করলাম আমি এটা? কেনো করলাম?
এতক্ষণ নিঃশব্দে কাঁদছিলো আনিকা। শেষের কথাগুলো বলে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো৷ মনে হচ্ছে যেনো চাপা কষ্ট আর অপরাধবোধটা ওর ফুসফুসটাকে দখলে নিয়ে নিয়েছে। কোনোভাবেই নিঃশ্বাসটা ফুসফুস অব্দি পৌঁছাচ্ছে না। দম আটকে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে।
রুমে যেয়ে পড়ার টেবিলের উপর থাকা পানির বোতলটা নিয়ে এলো মায়া। আনিকার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো
– একটু পানি খা। গলাটা বোধহয় শুকিয়ে এসেছে।
ধীরে ধীরে পানি খাচ্ছে আনিকা। গলাটা সত্যিই শুকিয়ে এসেছিলো। পানি খাওয়া শেষে জোরে একটা নিঃশ্বাস নিলো সে। এতক্ষণে মনে হচ্ছে নিঃশ্বাসটা ফুসফুস অব্দি একটু হলেও পৌঁছেছে।
– শোভন ভাই ব্রেকআপ কেনো করতে চায়? কিছু বলেছে?
– হুম।
– কেনো?
– আমাকে নাকি আর ভালো লাগছে না। আমার সবকিছুতেই নাকি বিরক্ত লাগে। আগের মত ম্যাজিক নাকি আর খুঁজে পায়না।
– আর?
– আমি আনস্মার্ট। ওর ভার্সিটিতে নাকি অনেক সুন্দর মেয়ে আছে। সেক্সি ফিগার। দেখলেই নাকি চোখ জুড়িয়ে আসে৷ ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকলেও একঘেয়েমি আসবে না। বন্ধুদের গার্লফ্রেন্ডগুলো নাকি আমার চেয়ে হাজারগুনে ভালো। তাদের সামনে আমাকে পরিচয় করাতে লজ্জা লাগে।
– তুই সুইসাইড করতে চাচ্ছিলি কেনো?
– কারনগুলো কি যথেষ্ট মনে হচ্ছে না? সারা শরীরে ঐ মানুষটার স্পর্শ লেগে আছে। অবৈধ সম্পর্কের নোংরা স্পর্শ। মনে হলেই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে। সেইসাথে কিছু মানুষের নজরে আমি “ইউজড মাল” নামে পরিচিত হয়ে গেছি। আমার ভবিষ্যত কি বলতে পারবি? বাবা মা কি আমাকে ঘরে বসিয়ে রাখবে? কোনোদিনও না। পাঁচ ছয় বছর পর ঠিকই বিয়ে দিবে। ততদিনে নিশ্চয়ই ঐ নোংরা স্পর্শ মুছে যাবে না। গায়ে লেগেই থাকবে। সেই সাথে ইউজড মাল তকমাটাও। আমার পরিবারের রক্ষণশীলতা দেখে আমার হাজবেন্ড হয়তোবা ভাববে আমি অতি মাত্রার সতী মেয়ে। আমাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াবে৷ রাস্তাঘাটে আমার সেই নোংরা ঘটনার সাক্ষ্যীরা আমাদের দেখবে। নোংরা হাসি হাসবে আর বলবে, আরে এই মালটারে তো আমার বন্ধু কবেই খায়া দিছে। আর সেই মানুষটা যদি কখনো জানে আমি তো সতী না। মিথ্যা ভ্রমে সংসার করে গেছে উনি। তখন কি হবে বল তো? ভবিষ্যত অন্ধকার। নূন্যতম আলা আমি দেখতে পাইনা। যত ভাবি ততই মনে হয় অন্ধকারের গভীরে তলিয়ে যাচ্ছি। এমন মানুষের বেঁচে থাকার কি আদৌ কোনো মানে আছে?
– ভবিষ্যত কি হবে তা তুই জানিস না আমিও না৷ সেটা তো ভাগ্যের উপর নির্ভর করে। তোর স্বামী মানুষটা কেমন হবে তা আমি জানি না। তবে এটা কি জানিস মানুষরুপি কিছু ফেরেশতা আছে। ফেরেশতাগুলো আমাদের জীবনে আসে একরাশ স্নিগ্ধ আলো নিয়ে৷ এমনও তো হতে পারে এমন একজন ফেরেশতা তোর জন্যও অপেক্ষা করছে।
– মিথ্যা আশায় আমি দিন কাটাতে রাজি না। এগুলো নেহায়েৎ মিথ্যা ছাড়া আর কিছু না।
– গল্প শুনবি আনিকা? আমার গল্প?
-কি গল্প শুনবো তোর? তুই যে কতটা সুখী তা আর নতুন করে কি শুনবো?
– সুখের আড়ালের ভয়ংকর সত্যিটা শুনবি না?
– মানে?
খানিকটা নড়েচড়ে বসলো মায়া। নিজের অতীতটাকে কখনো কারো সামনে মেলে ধরে না। মায়ার চকচকে দুনিয়ার সাথে পরিচিত মানুষগুলো জানেই না ওর অতীত কতটা কালো ছিলো। আজ অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেই কালো অতীতকে নাড়া দিতে হবে। কাছের মানুষটাকে যে সেই কালো অতীত থেকে অনেক কিছু শিখানোর আছে। খোলা চুলগুলো খোপা করে নিলো মায়া। বারান্দার বাহিরে তাকিয়ে বললো,
– আনিকা আমি একজন প্রস্টিটিউট ছিলাম। জন্মসূত্রে। আমার মাও ছিলো এই পেশায়।
আনিকার ভ্রু কুঁচকে মায়ার দিকে তাকালো। একরাশ বিস্ময় আর প্রশ্নের ছোটাছুটি করছে ওর চোখে। মায়ার মাত্র বলা কথাগুলো বড্ড দোটানায় ফেলে দিয়েছে ওকে৷ কথাগুলো কি সত্যি নাকি বাজে কৌতুক ছিলো সে হিসেব মিলাতে পারছেনা আনিকা। হুট করেই যেনো মনে হচ্ছে কান্নাটা আটকে গেছে। কষ্টের চাপ কমে গেছে। কি বললো মায়া এটা?
– অবাক হচ্ছিস খুব তাই না রে?
– কেমন কথা বললি এটা?
– সত্যি বলেছি। আমার ঝলমলে দুনিয়াটা দেখলে কেও বিশ্বাস করবে না আমার অতীত কতটা ফ্যাকাশে ছিলো।
– সিরিয়াসলি তুই…….
– নিজেকে নিয়ে, নিজের মা কে নিয়ে নিশ্চয়ই কেও এমন নোংরা মজা করবে না।
– সোহান ভাই কি জানে এসব?
– হুম। ঐ মানুষটা আমাকে ঐ পাড়া থেকে তুলে নিয়ে এসেছে। নিজের স্ত্রীর সম্মান দিয়েছে। আমাকে বাঁচতে শিখিয়েছে। তার বউ একজন প্রস্টিটিউট জানা সত্ত্বেও কোনো স্বার্থ ছাড়া অকারনে ভালোবেসেছে৷ আগলে রেখেছে। কখনো আমাকে নিয়ে এমন চিন্তা করেনি আমার শরীরে এর আগেও বহু পুরুষের হাত পড়েছে। সেই প্রথম দিন থেকে এখন পর্যন্ত মানুষটা যতবার আমার দিকে তাকায় ততবার সেই একই মুগ্ধতা খুঁজে পাই৷ তার চোখে তিল পরিমান মুগ্ধতা বা ভালোবাসা কোনোটারই ঘাটতি হতে দেখিনি।
প্রায় আড়াই বছর আগে গল্পটা শুরু হয়েছিলো। তখন ঐ পাড়াতে আমার চাহিদা আকাশচুম্বী৷ আতিপাতি কাস্টমারদের কাছে আমাকে নেয়া হতো না। মোটা অংকের টাকা যারা দিতে পারবে শুধু মাত্র তাদের কাছেই আমাকে পাঠানো হতো। একদিন এই মানুষটা এলো। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে আমাকে সাথে করে নিয়ে গেলো৷ উনার দেখা পাওয়ার আগ পর্যন্ত ধারনা ছিলো পুরুষ হলো মাংসখেকো৷ কিন্তু সেদিন মনে হচ্ছিলো আমি কোনো পুরুষের ঘরে আসিনি৷ আমি একজন মানুষের ঘরে এসেছি। সেই রাতে মানুষটা আমাকে বলেছিলো ঐ ঘরটা আমার ঘর। আমার সংসার। নিজের মতো করে যেনো আগলে রাখি। যত্ন করি। কথাগুলো কানের মাঝে ঘন্টার মতো বাজছিলো। একে তো জ্বর ছিলো। তার উপর এসব কথা। দুটো মিলিয়ে মনে হচ্ছিলো আমি আর এই জগতে নেই৷ বোধহয় স্বপ্নের রাজ্যে ভাসছি। ঘুমটা ভাঙলে বা জ্বরটা কমলেই একদম মুখ থুবড়ে এসে সেই নোংরা জগতে পড়বো।

– মানুষটা আমার শরীরের লোভ করেনি। আমার ভালোবাসা আর একটু যত্নের লোভ করেছিলো। উনি আমার কাছে আসেনি। আমি উনাকে কাছে টেনেছি। উনার সংস্পর্শে যাওয়ার আগ পর্যন্ত জানতাম মেয়ে মানুষ জাস্ট একটা মাংসের দলা। পুরুষ যেভাবে খুশি সেই মাংসের দলাকে কামড়াবে নখের আঁচড় দিবে। উনার কাছে যাওয়ার পর জানলাম মেয়ে মানুষ সবার কাছে মাংসের দলা না। কারও কারও কাছে মেয়েরা খুব যত্নের। খুব ভালোবাসার। পরম স্নেহে বুকে আগলে ধরার মতো।
– উনার ফ্যামিলি জানে?
– হুম জানে।
– উনারা এক্সেপ্ট করে নিলো তোকে?
– নাহ্।
– দেবর আর দেবরের বউ খুব স্বাভাবিক মেনে নিয়েছে। ওরা এমন ভাব নিয়ে আমার সাথে মেলামেশা করে মনে হয় যেনো কিছুই জানে না। শ্বশুড় অনেকটা বাধ্য হয়ে মেনে নিয়েছে। আর শ্বাশুড়ী আমাকে একদম সহ্য করতে পারে না। আমার শ্বশুড় দেবর আগে থেকে জানতো আমি কে? আমার অতীত কি? আমার শ্বাশুড়ী জানতেন না। উনাকে বলা হয়েছিলো আমার সাথে সোহানের এ্যাফেয়ার ছিলো৷ নিজেরা বিয়ে করে নিয়েছি।এটা নিয়ে ছেলের সাথে মায়ের বেশ কথা কাটাকাটি হয়েছিলো। দেড় বছর আগে আমার দেবরের বিয়ের জন্য চট্টগ্রামে প্রথমবারের মতো শ্বশুড়বাড়ি যাই। গায়ে হলুদের দিন আমার এক কাস্টমার আমাকে দেখে ফেলে। উনি আমার শ্বশুড়ের বন্ধুর ছেলে ছিলো। উনি যখন জানতে পারে আমি সোহানের বউ তখন সাথে সাথে সবার কাছে ছড়াতে লাগলো সোহান একটা প্রস্টিটিউট ধরে এনেছে। ব্যস শুরু হয়ে গেলো তুমুল সমালোচনা৷ আমার শ্বাশুড়ি তো কোমড় বেঁধে লাগলেন আমাকে ঘর থেকে তাড়াবেন৷ কত কি যে শুনেছি! ভিতর থেকে একদম দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিলো আমার। এত সমালোচনা নিতে পারছিলাম না। অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিলাম। আমার এখনও মনে আছে আমার দেবরের সাথে উনি একদিন রাতে বসে বলছিলো, কত চেষ্টা করলাম ওর অতীত ধামাচাপা দেয়ার। ওর সমস্ত রেগুলার কাস্টমারের মুখ বন্ধ করালাম। কোনো কাজ হলো না৷ কোন ফাঁকে এই একটা পিস রয়েই গেলো। ছোট্ট একটা মেয়ে। এত প্রেশার ও নিতে পারছে না। ওকে এভাবে চুপচাপ সারাদিন এক কোনায় পড়ে থাকতে দেখে মনে হয় বুকের হাড়গুলো বুঝি ভেঙে যাচ্ছে।
সেদিন উনার কথাগুলো শুনে আড়ালে যেয়ে খুব কেঁদেছিলাম। মানুষটা আমাকে এনেছিলো একটু সুখের আশায়। অথচ আমি উনাকে সুখী করতে পারছি না। প্রায় পনেরোদিন ঘরে বসেই কাটিয়ে দিলাম। এই কোনায় ঐ কোনায় পড়ে থাকতাম। ব্যবসায়ের দিকে কোনো নজর নেই। পড়ালেখা সব বন্ধ। নীরবে কান্নাকাটি করতাম। একদিন উনি এসে আমার পাশে বসলো। আমার ডানহাতটা খুব শক্ত করে ধরলো। বললো,
– আমার কতগুলো কথা শুনবে।
আমি বললাম হ্যাঁ শুনবো।
উনি আমার চোখে চোখ রেখে কথা গুলো বলতে লাগলো,
কেনো মন খারাপ করছো? কার কথায় মন খারাপ করছো? সমাজের লোক কি বললো সেসব শুনে? যারা তোমাকে নিয়ে সমালোচনা করছো তারা ভালো? তাদের সন্তানরা ভালো? জগতে কেও ফেরেশতা না মায়া৷ প্রতিটা মানুষের ত্রুটি আছে। আর আমাদের সোসাইটির তোমার বয়সি কয়টা ছেলে মেয়ে একদম ফুলের পবিত্র আছে দেখাও তো? স্কুলে থাকতেই তো মেয়েগুলো নিজের ভার্জিনিটি বিসর্জন দিয়ে আসছে প্রেমিকের কাছে। তোমার কি ধারনা কার ছেলে মেয়ে কখন কি করে সেসব আমাদের কানে আসেনা? আসে। কয়েকদিন তুমুল আলোচনা সমালোচনা হয়৷ এরপর সব শেষ। কে কি বললো সেসব নিয়ে মাথা কেনো ঘামাও? তুমি নিজে কেমন তা তো তুমি জানো। তুমি সেঁধে সেঁধে তো আর ঐ লোকদের সাথে শুতে যাওনি। তুমি পরিস্থিতির শিকার ছিলে। তুমি জানো তুমি ভালো। আমি জানি আমার বউ ভালো৷ দুনিয়ার সবাই তো এক মেন্টালিটির না। দুনিয়াতে যদি আমি সালমান শিমুর মতো মানুষ থেকে থাকে যাদের একজন প্রস্টিটিউটের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই তাহলে ধরে নিও আমাদের মতো আরও দশটা মানুষ সোসাইটিতে আছে যাদের তোমাকে নুয়ে কোনো মাথাব্যাথা থাকবে না। সমাজের একশটা লোকের মাঝে নব্বইজন তোমার বিপক্ষে কথা বলবে আর দশটা লোক তোমার পক্ষে কথা বলবে। তুমি সেই দশটা মানুষ নিয়েই নিজের একটা জগত তৈরী করে নিবে। দরকার নেই সেই নব্বই জনের। যারা তোমাকে বুঝে না কি দরকার তাদেরকে নিজের জগতে রাখার? আর কি কিছু প্রয়োজন? মাথা উঁচু করে হাসিখুশি ভাবে বেঁচে থাকতে কি তোমার এর চেয়ে আরো কিছু দরকার? এ ধরনের মানুষ প্রতিনিয়ত একটা মুখরোচক টপিক খুঁজে যেটা নিয়ে তীব্র সমালোচনা করা যায়। আজকে সমালোচনার শীর্ষে তুমি আছো কাল আরেকজন থাকবে। নিজেকে গড়ে তুলো মায়া। নিজের পায়ের তলা মাটিটাকে শক্ত করো। লোকে যখন তোমার যোগ্যতা দেখবে তখন আপনা আপনিই সবাই মুখে কুলুপ এঁটে রাখবে। তোমাকে হুজুর হুজুর করবে। ইটস অল এ্যাবাউট মানি এ্যান্ড পজিশন। তুমি সোহানের ওয়াইফ। সোহানের ওয়াইফ মাথা নিচু করে কেনো বাঁচবে? তোমার গায়ে লেগে থাকা ময়লাটা তোমাকে ঘষে মেজে উঠিয়ে ফেলতে হবে। উত্তর দিতে শিখো মায়া। সবসময় আমি থাকবো না তোমার হয়ে মানুষকে উত্তর দেয়ার জন্য৷ নিজের লড়াই নিজে লড়তে শিখো৷ মানুষ যখন দেখবে তুমি তোমার জায়গায় শক্ত আছো, তোমাকে কাবু করা এতটাও সহজ না তখন মানুষ চুপ হয়ে যাবে। তোমাকে নিয়ে আর এতটা মাতামাতি করবে না। তোমাকে কিছু বলার আগেও দশবার ভেবে চিন্তে এরপর বলবে। দুনিয়া উল্টেপাল্টে যাক একটা কথা মাথায় রাখবে জগতে এখনো একজন আছে যে তোমাকে নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে ভালোবাসে। তুমি ছাড়া মানুষটা নিঃশ্বাস নিতে পারে না। তুমি আছো তো সে আছে, তুমি নেই তো সেও নেই।
শেষের দুটো লাইন বলার মূহূর্ত্বে উনার চোখে পানি ছলছল করছিলো। উনি প্রচন্ড স্ট্রং একজন মানুষ। শত কষ্টেও উনি কখনো কাঁদে না। বা আমি কখনো উনার চোখে পানিও আসতে দেখিনি। সেদিনই প্রথম আর সেদিনই শেষবারের মতো উনার চোখে পানি ছলছল করতে দেখেছিলাম। পানি গড়িয়ে চোখের বাহিরে আসার আগেই উনি সেখান থেকে চলে গিয়েছিলো। হয়তোবা আমার সামনে বসে থাকলে কান্নাটা আর ধরে রাখতে পারতো না।
– এরপর?
– প্রায় পনেরো মিনিট ধরে উনার কথার প্রতিটা লাইন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাইয়েছি। ঠিকই তো ছিলো উনার কথাগুলো। একটা কথাও অযৌক্তিক ছিলো না। উনি যদি একটা প্রস্টিটিউটকে নিয়ে ঘর বাঁধার তাকে ভালেবাসার দুঃসাহস দেখাতে পারে তাহলে কেনো আমি এই লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে বাকি জীবনটা খুশি খুশি কাটাতে পারবো না? ছুটে গিয়েছিলাম উনার কাছে। খুব শক্ত করে উনাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম৷ কতক্ষণ ওভাবে উনাকে ধরে রেখেছিলাম জানি না। মুখ ফুটে শুধু একটা কথাই বলেছিলাম,
আপনাকে ভালোবাসি। আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে সব করতে পারি।
উনি প্রতিউত্তরে কিছু বলেননি। আমার মাথার উনার থুঁতনিটা রেখে আমাকে আরও যত্নে আগলে ধরেছিলেন। এরপর থেকে কেও কিছু বলতে আসলে একদম মুখের উপর উত্তর দিয়ে দিতাম। কিছুদিন বেশ চড়াই উতরাই দেখতে হয়েছে৷ এরপর সব স্বাভাবিক। তেমন ভাবে সমালোচনা কাওকে কখনো করতে শুনিনি। সমালোচনা হয় না ঠিক তা না। হয়। তবে আগের মতো না। আমি থাকি ঢাকায়। তাই এখানে অতটা ঝামেলা হয় না। প্রত্যেক ঈদে চট্টগ্রামে গেলেই গুনগুন শোনা যায় । যার যার উত্তর তাকে দিয়ে দেই। পারি না শুধু শ্বাশুড়ীর সাথে। শত হোক এমন একটা সন্তানকে জন্ম দিয়েছে যে আমার নজরে ফেরেশতা। তার সাথে খারাপ আচরন করি কি করে? আসলে ভিতর থেকে উনাকে উত্তর দেয়ার ব্যাপারটা আসে না। দেখা যায় ঐ বাড়িতে গেলে উনি রুম থেকেই বের হোন না। আমিও যতটা সম্ভব উনার কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করি। ঐ ঘটনার পর উঠেপড়ে লাগলাম ব্যবসা আর পড়ালেখার পিছনে। দুইবছরে ব্যবসা কতটুক টেনে এনেছি তা তো জানিসই। এর কিছুদিন পর আম্মাকেও উনি নিয়ে আসলো ঐ পাড়া থেকে। অন্য একটা ফ্ল্যাটে আম্মাকে রাখলো। সাথে দুটো কাজের মেয়ে দিয়ে দিলো৷ আম্মা হাতের কাজ খুব ভালো জানতো। তবুও আম্মাকে আবার নতুন করে ট্রনিং সেন্টারে ভর্তি করালো। আরও ভালোভাবে কাজ শিখলো। একদিন হুট করে আম্মাকে আর আমাকে ছোট একটা কারখানায় নিয়ে গেলো। সেখানে যেয়ে আম্মাকে বললো,
এটা আপনার কারখানা। বিশজন কর্মীও এপোয়েন্ট করা হয়েছে। দুইটা বুটিক হাউজের সাথে কথা হয়েছে। ওরা আপনাকে শাড়ী, সালোয়ার কামিজের ডিজাইনসহ অর্ডার করবে। আপনি সেগুলো তৈরী করে সাপ্লাই দিবেন।
আম্মা সেদিন একটা কথাও কারো সাথে বলেনি। পরদিন সকালে আমার বাসায় এসে উনার হাত ধরে কি কান্নাটাই না কেঁদেছিলো৷ আম্মার কারখানা এখন দিব্যি যাচ্ছে।
– রুপকথার গল্পের মতো লাগছে।
– হ্যাঁ অনেকটা এরকমই। উনি আমার জীবনে আসার আগ পর্যন্ত কল্পনা করিনি আমি কোনোদিন স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবো। কোনো পুরুষ তার সবটা উজাড় করে দিয়ে আমাকে ভালোবাসবে। আমার মাথায় হাত রেখে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখাবে। উনি এমন একটা মানুষ যাকে ভালো না বেসে থাকা অসম্ভব। সম্মানটা আপনা আপনি একদম মনের ভিতর থেকে চলে আসে। কখনো উনি আমার অতীত নিয়ে ঘাটাননি। সেদিন মাত্র কয়েকটা মূহূর্ত্বে আমার জীবনটা ঘুরে গিয়েছিলো। মাত্র কয়েকটা মূহূর্ত্ব……
জীবনে জোয়ার ভাটা থাকে। একটা ভুলকে কেন্দ্র করে গোটা জীবনটাকে আমি বলি দিয়ে দিবো তা কি ঠিক? কেনো আমি ধরে নিবো আমার ভবিষ্যত অন্ধকার। ভালোও তো হতে পারে। অন্ধকারের কথা ভেবে যদি জীবনটাকে শেষ করে দেই তাহলে আলোর দেখা মিলবে কিভাবে?
দীর্ঘশ্বাস নিলো আনিকা। গল্পটা অক্সিজেনের মতো ওর মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে। মনে হচ্ছে গায়ে যেনো স্বস্তির শীতল বাতাস লাগছে৷ প্রতিটা রাতের ভোর হয়। ওর জীবনের ভোরটাও বোধহয় সুন্দর স্নিগ্ধ আলোতেই হবে। হোক বা না হোক আলোর আশা করতে দোষটা কোথায়? ভালোভাবে বেঁচে থাকতে হলে তো আলোর আশা করতেই হবে। আর নয়তো জীবনটা অন্ধকারের মাঝেই থমকে দাঁড়াবে।
মুচকি হাসছে আনিকা। মায়ার হাত ধরে বললো,
– এত ভালোবাসিস। তবুও আপনি করে বলিস?
– হা হা হা,,,,,, আপনি বা তুমি তে কি আসে যায়? ভালোবাসার গভীরতা বুঝাতে কি তুমি করে বলাটা খুব জরুরী?
– তোর এ্যানিভারসারি ছিলো গতকাল। আমার জন্য ঠিকমতো সেলিব্রেটও করতে পারলি না।
– ধুর, বাদ দে৷ উনার সেলিব্রেশন সারাবছর ধরে লেগেই থাকে।
– কিছু গিফট করিসনি?
– হুম করেছি তো।
– কি?
– মোবাইল। যেটা হাতে নিয়ে উনি এখন গেমস খেলছে।
– তুই জানিস কিভাবে?
– আমার চোখের সামনেই বসে আছে।
– মানে?
– বারান্দার বাহিরে কাকে দেখছি এতক্ষণ ধরে? উনি সামনের বিল্ডিং এর বারান্দায় বসে আছে। ঐ যে দেখ মোবাইলের স্ক্রিনের লাইট জ্বলছে।
– উনি এখানে?
– হুম। উনার বন্ধুর ফ্ল্যাট। কি যেনো মনে হলো কে জানে? সাড়ে দশটার দিকে ফোন করে বললো আনিকার সাথে যদি গল্প করো তাহলে বারান্দায় বসে গল্প করবে৷ ল্যাম্পপোস্টের আলোতে সারারাত তোমাকে দেখবো। একরাতের জন্য প্রেমিক হবো। পাশের বিল্ডিংয়ের প্রেমিক।
মায়ার কথায় সজোরে হাসছে আনিকা। যে ভালোবাসার সে এমনিই বাসবে। শত ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও মানুষটার ভালো দিকগুলোই দেখবে। যে ভালোবাসবে না তাকে হাজারটা গুন দেখিয়েও লাভ হবে না। ত্রুটি সে বের করবেই। সোহান প্রথম শ্রেণীর আর শোভন দ্বিতীয় শ্রেণীর। কেউ পতিতার মাঝে ভালোবাসা খুঁজে আর কেও ভালোবাসার মাঝে পতিতা…..
the end…

গল্প টি কেমন লাগলো অবশ্যই জানাবেন।❤🍂🌷
এর পরে “আমার ভিনদেশী তারা” নামের চমৎকার রোমান্টিক গল্পটি পোস্ট করবো। গল্পটি পড়তে নিয়মিত ভিজিট করুন গল্পের ঠিকানায়।গল্পটিতে নায়ক বিদেশী আর নায়িকা বাংলাদেশী সুন্দরী তরুনি…কাল থেকে পোস্ট করা হবে ইনশাআল্লাহ

4 COMMENTS

  1. Oshadharon golpo…….sotti ai golpe oneke nijer osthitto khuje pabe….onek kichu sikhlam jebon e sothik vabe cholar jonno

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here