#নষ্ট_গলি
পর্ব-৫
লেখা-মিম
সোহানের দিকে এগিয়ে এসে বসলো মায়া। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে বলেই ফেললো,
-” অামি অাপনার হাতটা একটু ধরি?”
সোহান মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে মায়ার হাতটা ধরলো। হাত প্রচন্ড রকমে গরম ছিলো মায়ার। সোহান টের পাচ্ছে মায়ার জ্বরটা অাবার বেড়েছে। কপালে হাত রেখে দেখলো সত্যিই জ্বর বেড়ে গেছে।
-” মায়া তোমার তো জ্বর অাবার বাড়ছে। তুমি শুয়ে পড়ো। অার রাত জেগো না।”
-” অাপনি অামার হাতটা একটু ধরে রাখবেন প্লিজ? অামি ঘুমিয়ে গেলে অাপনি হাতটা ছেড়ে দিয়েন। অাপনাকে সারারাত এখানে বসতে হবে না।”
-” ঠিকাছে। অামি অাছি। তোমার হাত ছাড়বো না তুমি ঘুমাও।”
-” না না সারারাত ধরে রাখতে হবে না। অামি ঘুমান…….”
-” হয়েছে থামো। অামি বুঝেছি। এখন চোখ বন্ধ করো তো।”
সোহান একহাতে মায়ার হাত ধরে রেখেছে। অারেকহাতে ফেইসবুকিং করছে। মায়ার দুচোখে প্রচন্ড রকমে ঘুম ভর করছে। বহুবছর এমন চোখ জুড়ানো ঘুম পাচ্ছে তার। এই ব্যবসায় নামার পর থেকে এভাবে কখনো ঘুম ভর করেনি ওর চোখে। মিনিট দশেকের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো মায়া। মায়া ঘুমিয়ে গেছে টের পেয়ে খুব সাবধানে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো সে। নিজের রুমে এসে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে অাছে। ড্রেসিং টেবিলের উপর থাকা সিগারেটটা মুখে নিয়ে জ্বালালো। অন্ধকারে ধোয়াগুলো দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু পুরো রুমে বিশ্রি গন্ধ ছড়াচ্ছে ঠিকই। সিগারেট বেশি একটা খাওয়া হয়না সোহানের। খুব বেশি মন খারাপের মূহূর্তগুলোতে সে একটা দুটা সিগারেট ধরায়। মনটা অাজও তার খারাপ। অাজ তার ত্রিশতম জন্মদিন ছিলো। কেউ তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায়নি। শুধুমাত্র সালমান ছাড়া। যারা জন্ম দিয়েছে তাদেরও বড় ছেলের জন্মদিন মনে নেই। ফেইসবুকে তার অাসল জন্মতারিখটা দেয়া নেই। যেটা অাছে সেটা হচ্ছে ভুয়া। অাত্মীয় বন্ধুরা নোটিফিকেশন পেয়ে সেইমিথ্যা দিনেই তাকে শুভেচ্ছা জানায় খুব অান্তরিকতার সাথে। সব মিথ্যা। অাত্মীয়-বন্ধুরা মিথ্যা। জন্মদিনটা মিথ্যা। তাদের অান্তরিকতাগুলোও মিথ্যা। সবাই সোহানের সত্যিকারের জন্মদিন ভুলে গেছে। কেউ মনে রাখেনি। মনে রাখার প্রয়োজনটা বোধ করে না। গভীর ভালো সম্পর্ক কার সাথে অাছে তার? মনে পড়ছে না কারো নাম। প্রানপন চেষ্টা চালাচ্ছে সোহান। কে অাছে তার এমন প্রানের বান্ধব যে তাকে মন থেকে পছন্দ করে। সালমান ছাড়া অাপাতত খুঁজে পাচ্ছে না। অন্য দশটা মানুষের মতো তারও খুব ইচ্ছে হয় কেউ রাত বারোটা এক মিনিটে অনেকগুলো ফুল চকলেট হাতে নিয়ে ওর দরজার কলিংবেল চাপুক। এরপর সে এসে দরজা খুলে দেখবে কেউ একজন হাসিমুখে ফুল চকলেটগুলো ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলবে,
-” হ্যাপি বার্থডে সোহান। মেনি মেনি হ্যাপি রিটার্নস অফ দ্যা ডে।”
এরপর সে চোখে মুখে একরাশ খুশি এবং বিস্ময় নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে থ্যাংকস জানাবে। এই স্বপ্নটা স্বপ্নই রয়ে গেছে তার। অাজ অব্দি বাস্তবায়ন হয়নি। তিনজন প্রেমিকার একজনও কখনোই বারোটা একমিনিটে তাকে উইশ করে নি। বরাবরই তারা দশ পনেরো মিনিট লেইট ছিলো। এটা নিয়ে সোহানের ক্ষোভের শেষ ছিলো না। এই ক্ষোভে সে কোনো প্রেমিকার সাথেই তার জন্মদিনে দেখা করতো না। অাজ সেঁধে সেঁধে একজনের কাছ থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা নিতে ইচ্ছে হচ্ছে। মানুষটা হচ্ছে মায়া। জন্মদিনটা এখনও শেষ হয়নি। এখনও অাধাঘন্টা সময় অাছে। সোহানের মনে হচ্ছে ইচ্ছেটা পুরন করা উচিত। হাত থেকে সিগারেটটা ফেলে দিয়ে মায়ার রুমে গেলো সোহান। বেঘোর ঘুম ঘুমাচ্ছে মায়া। সবুজ রঙের ডিমলাইটে ওর মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দেখে মনেহচ্ছে বহুবছর ধরে জমানো ঘুমটা অাজ ঘুমাচ্ছে মায়া। এত অারামের ঘুমটা ভেঙে দেয়া কি ঠিক হবে? ডাকতে যেয়েও অার ডেকে তুলেনি সোহান। রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে। নাহ্ অার ভেবে কাজ নেই। জন্মদিন তো চলেই গেছে। কে উইশ করলো অার কে উইশ করলো না সেসব ঘেটে লাভ নেই। শুধুশুধু মন খারাপ হবে। যেখানে নিজের বাবা মায়েরই মন থাকেনা সেখানে অন্যের কাছে অাশা করাটা বোকামি। সবার ভাগ্যে সব থাকে না। ওর ভাগ্যে অান্তরিকতা,টান এসব নেই। এসব ভাবতে ভাবতে পাশে থাকা কোলবালিশটা জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে শুয়ে গেলো সোহান। প্রতিবছর সে এভাবেই নিজের মনকে স্বান্ত্বনা দিতে দিতে ঘুমিয়ে পড়ে। পরদিন সকালে উঠে অাগের দিনের শুভেচ্ছা না পাওয়ার কষ্টটা সে ভুলে যায়। কাল সকালেও হয়তো তাইই হবে।
ভোরের অালো ফুটতে শুরু করেছে । মায়ার জানালা ভেদ করে অালো ওর মুখে এসে লাগছে। ঘুমটা ভেঙে যাচ্ছে একটু একটু করে। অাধাখোলা চোখে অাশপাশের দেয়ালগুলো দেখছে মায়া। দেয়ালগুলো অপরিচিত। এটা কোথায়? চোখজোড়া কঁচলে নিয়ে ভালো করে চোখ মেলে তাকালো মায়া। এতক্ষনে দেয়ালটা পরিচিত লাগছে। এটা সোহানের বাসা। এত বছর একটা রুমকে ঘুম থেকে উঠে দেখেছে সে। অাজ রুমটা ভিন্ন। তাই ঘুম থেকে উঠেই অভ্যাসবশত সেই রুমটা দেখতে চেয়েছিলো মায়া। হুট করে নতুন বাসাটা চিনতে পারেনি সে। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মায়া। গতরাতে বেলকনিতে থাকা ছোটছোট গাছগুলো চোখে পড়ে নি মায়ার। গাছে তাজা ফুল ফুটেছে। সকাল সকাল চোখের সামনে তাজা ফুল দেখলে মন এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। বেলকনিতে যেয়ে ফুলগুলো ঘেটে ঘেটে দেখছে মায়া। এর অাগে ওর পাড়াতে দুবার ফুলগাছ কিনে এনেছিলো মায়া। দুবারই গাছ মরে গেছে। ওর মা বলেছিলো এটা নষ্ট গলি। এখানে ভালো জিনিস টিকে না। এরপর অার গাছ কিনেনি ও। পিছন থেকে সোহানের গলার অাওয়াজ পেয়ে চমকে গেলো মায়া।
-” কি ব্যাপার? এভাবে লাফিয়ে উঠলে কেনো?”
-” নাহ্। হঠাৎ ডাকলেন তো তাই।”
-” চা পছন্দ নাকি কফি?”
-” কফি তো কখনো খেয়ে দেখিনি। খেলে বলতে পারবো কোনটা বেশি ভালো।”
” ফ্রেশ হয়েছো?”
-” না।”
-” যাও ফ্রেশ হয়ে এসো। অামি কফি দিতে বলছি।”
মায়া ওয়াশরুমে চলে গেলো অার সোহান গেলো কিচেনে কফির ফরমায়েশ দিতে। কফি হতে হতে সোহান নিজেও ফ্রেশ হয়ে এলো। দুই মগ কফি নিয়ে মায়ার রুমে এসে দেখে মায়া মুখ মুছছে। সোহানকে দেখে মায়া বললো,
-” বারান্দায় বসি?”
-” বসো। এই রতন দুইটা চেয়ার দিয়ে যাও তো এখানে।”
বেলকনিতে বসে ধোঁয়া উঠা গরম কফির মগে চুমুক দিচ্ছে ওরা দুজন।
-” কি? কফির টেস্ট কেমন?”
-” হুম খুব ভালো।”
-” তো এখন বলো? কোনটা প্রিয়?”
-” লাল চা বেশি প্রিয়”
-” ঠিকাছে কাল থেকে তোমার জন্য লাল চা বানানো হবে।”
-” মাঝে মাঝে কফিও খাবো।”
-” ঠিকাছে। এখন শোনো, অামি চাচ্ছিলাম তোমাকে উন্মুক্ত স্কুলে ভর্তি করাবো। অামি চাচ্ছি পড়াশোনাটা অাবার কন্টিনিউ করো তুমি। বাসায় তোমার জন্য টিচার রেখে দিবো। তোমাকে এসে পড়াবে। অার ইংলিশ শিখানোর জন্য অালাদা টিচার রাখবো। সে তোমাকে ইংলিশে কথা বলা শিখাবে।”
মায়ার মনে হচ্ছে সে অাকাশ ভেঙে নিচে পড়ে যাবে। পড়ালেখা? আবার? ঠিক শুনছে তো?
-” অাপনি অামাকে পড়াবেন?”
-” হুম। কেনো পড়তে চাও না?”
-” সত্যিই পড়াবেন?”
-” মিথ্যামিথ্যি পড়ানো যায় নাকি?”
-” কেনো যেনো মনে হচ্ছে অাপনি অালাদিনের জ্বীন”
-” অামি মানুষ। কোনো জ্বীন টীন না।”
-” এখানে তো তাহলে অামাকে পার্মানেন্টলি থাকতে হবে।”
-” থাকবে। সমস্যা কোথায়?”
-” জোনাকি বুবু মানবে?”
-” সর্বক্ষন জোনাকি জোনাকি করো কেনো? কি করবে এই মহিলা তোমাকে? খেয়ে ফেলবে? ও মানবে না ওর বাপসহ মানবে। ”
-” রেগে যাচ্ছেন কেনো?”
-” কানের কাছে বারবার জোনাকির কথা বলো না তো। ভালো লাগেনা এই মহিলাকে অামার। কেমন যেনো চাড়াল টাইপ। অাস্ত একটা জাদরেল। ওকে দেখলেই অামার সেকেন্ড গার্লফ্রেন্ডের কথা মনে পড়ে যায়।”
মায়া শব্দ করে হাসছে সোহানের কথায়।
-” তুমি হাসছো কেনো?”
-” দ্বিতীয় প্রেমিকা অাপনাকে খুব জ্বালিয়েছে তাই না?”
-” অনেক বেশিই।”
-” অাপনার মুখ দেখলেই বুঝা যায়। ওর কথা বলার সময় অাপনার মুখটা দেখার মতো হয়।”
-” মজা লাগছে খুব তাই না?”
-” খুব বেশিই।”
-” তোমাকে নিয়ে স্টুডিওতে যাবো অাজকে। তোমার পাসপোর্ট অার স্ট্যাম্প সাইজ ছবি তুলতে হবে।”
-” কেনো?”
-” তোমার স্কুল ভর্তি অার পাসপোর্ট বানানোর জন্য লাগবে।”
-” অামার পাসপোর্ট?”
-” হুম।”
-” কেনো?
-” অামি বছরে দুই তিনবার দেশের বাহিরে যাই। তোমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবো এজন্য।”
এই মূহূর্তে সত্যি সত্যিই সোহানকে অালাদিনের জ্বীন মনে হচ্ছে মায়ার। মনে হচ্ছে এটা একটা স্বপ্ন। কিছুক্ষন পরই বোধহয় স্বপ্নটা ভেঙে যাবে।
(চলবে)