নিবেদিতা- ২

0
440

নিবেদিতা- ২

সবে সন্ধ্যা নেমেছে। বিকেল থেকেই প্রচণ্ড ঝড়ে চারদিক লণ্ডভন্ড হবার দশা। ছেলেবেলার সই রেণুমালার সঙ্গে রোজকার মতো পান চিবুতে চিবুতে বারদালানে বসে সুখ দুঃখের গল্প করছিলেন কাননবালা। সন্ধ্যের আবছা আলোতে উঠোনে কারো আগমন টের পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই চমকে যান দু’জনে- এক জটাধারী সন্ন্যাসীমূর্তি দাঁড়িয়ে! ঝড়জলে একেবারে কাকভেজা হয়ে আছে, উস্কোখুস্কো জটাবাঁধানো চুল ঘাড় অবধি নেমেছে, মুখে যেন গত জন্মের না কামানো দাঁড়ি-গোফ। কে এ?

প্রচণ্ড শব্দে বজ্রপাত হয় কোথাও একটা। বিজলীর আলোয় সে সন্ন্যাসীর চোখখানা চোখে পড়ে কাননবালার। রক্তজবার লালিমা আঁকা চোখজোড়া চিনতে ভুল হয় না তার।

শশীভূষণ! কাননবালার আদরের শশী!

‘আমি আর ডাক্তারি পড়ব না মা! গয়া-কাশী কোথাও চলে যাবো! আশীর্বাদ নিতে এলাম…’- জটাধারী ততক্ষণে হুড়মুড়িয়ে এগিয়ে এসে কাননবালার পা ছুঁয়ে প্রণাম করে ফেলেছে। তারপর, তাঁকে জড়িয়ে ধরে খানিক্ষণ হু হু করে কেঁদে হনহনিয়ে ফিরতি পথ ধরল ছেলে।

এহেন আকস্মিক চমকের ঘোর সইতে না পেরে কাননবালা সটান মূর্ছা গেলেন। কালবৈশাখীর সমস্ত গর্জন ছাপিয়ে রেণুমালার ত্রাহি চিৎকার ভেসে এলো তারপর- ‘ও শশী রে! মা’টাকে বুঝি এবারে মেরেই ফেললি বাছা!’

জ্ঞান ফিরতেই শশীর চিন্তিত মুখখানা মাথার ওপর ঝুলতে দেখে আশ্বস্ত হলেন কাননবালা। কেউ কিছু বুঝে উঠবার আগেই ফট করে ছেলের হাতদুটো ধরে বললেন- ‘আমার মাথার দিব্যি শশী, এবেলা বিয়েথা করে সংসারী হবি নয়ত আমার মরা মুখ দেখবি!’

মায়ের মাথার দিব্যি গিলে মাতৃভক্ত শশীভূষণের আর সন্ন্যাসব্রত নেওয়া হয় না। কোথায় গেরুয়া বসন চাপাবার কথা, তা নয়, দিন সাতেক বাদে এক বিকেলে তাকে দেখতে পাওয়া যায় রায়বাড়ির বসবার ঘরে, ভারি কাজের ধুতি-আচকান গায়ে চাপিয়ে গম্ভীর মুখ করে বসে আছে। মায়ের তাগিদে দাঁড়ি-গোফ কেটে-ছেঁটে রীতিমতো ফুলবাবুটি সেজে মা’র সঙ্গে এসেছে, কনে দেখতে। কনেটি এখনও আসেনি, শশী বিব্রত মুখ করে ঘরময় চঞ্চল চোখ বুলাচ্ছে বসে বসে। তার ঠিক বিপরীতেই একখানা ছোট গরাদ দেওয়া জানালা। দু’ফালি আকাশরঙা পর্দা দু’দিক থেকে ঝুলছে। পর্দাগুলির ওপরে দু’টো তিড়িংবিড়িং খরগোশছানা সুতোয় এঁকে রাখা। বাঁয়ের দিকের পর্দায় আঁকা ছানাটার মুখে একফালি টুকটুকে কমলা রঙের গাজর, এক পা ওপরে তুলে দিয়ে ছানাটা নাচতে নাচতে এগোচ্ছে। ডানের পর্দায়, প্রথম ছানাটার ঠিক পেছনে, অপেক্ষাকৃত ছোট আরেকটি ছানা। তিড়িং করে লাফ দিয়ে শূন্যে ভাসছে, প্রথমটাকে ধরতে চাইছে বোধহয়। শরৎবাতাসে পতপত উড়ছে পর্দাগুলি, সেই সাথে চোখে তৈরি হচ্ছে বিভ্রম। মনে হচ্ছে, ছানাগুলি যেন জ্যান্ত লাফাচ্ছে। জড় অথচ জীবন্ত, নির্বাক অথচ বাঙময় এই দৃশ্যটুকু অনেকক্ষণ শশীর চঞ্চল চোখজোড়াকে আটকে রাখে।

কাননবালা খানিক পরপর ছেলের দিকে মুগ্ধনেত্রে তাকিয়ে দেখছেন। কলকাতার জল-হাওয়ায় চাঁদপানা মুখখানা আরো খোলতাই হয়েছে। এমন রাজপুত্রের মত ছেলে, বলে কিনা সন্ন্যাস নেবে! এইতো এমন অল্প বয়স, কী এমন দুঃখে ছেলে অতবড় কথাখানা বললো কে জানে! ঐ পোড়ারমুখো কলকাতায় নির্ঘাৎ কিছু একটা হয়েছে। যা হয়েছে হয়েছেই, ওসবে আর কাজ নেই। ভালয় ভালয় এবারে ছেলেটাকে সংসারে বেঁধে ফেলতে পারলেই হলো। বছর দুয়েক ধরে সইয়ের কাছে তাঁর এই নাতনিটির অনেক প্রশংসা শুনেছেন। প্রীতিলতা নাম। বয়স অল্প হলেও এরই মধ্যে নাকি একেবারে পাকা গিন্নি হয়ে উঠেছে! মা’কে প্রায় কোনো কাজ-ই করতে দেয় না, ঘরদোর সব নিজেই সামলায়। প্রীতিলতাকে ছেলেবেলায় দু’একবার দেখেছিলেন বটে কাননবালা, কিন্তু তখন ভারী দুরন্ত ছিল মেয়েটা। সারাক্ষণ ছুটে ছুটে বেড়াচ্ছে, একদন্ড শান্তি নেই। আর সে কী বাচালপনা! ছোট-বড়, গুরু-লঘু জ্ঞান নেই, কেবল কটকট কটকট করে কথা! তা, সইয়ের ভাষ্যমতে সে মেয়ে নাকি এখন ভোজবাজির মত পাল্টে গেছে!

খানিকক্ষণ বাদে আগাগোড়া গয়নার সাজানো ভারী বালুচরিতে প্যাকেটবন্দি মেয়েটিকে নিয়ে আসা হলো। বড় একটি জলখাবারের থালা হাতে নিয়ে সে প্রবেশ করল। ঠাকুমা রেণুমালা আর তার মা রাধিকা দু’দিক থেকে ধরে রেখেছে তাকে। থালাটা টেবিলে রেখে শশীভূষণের মুখোমুখি আসনখানা অলংকৃত করে বসল প্রীতিলতা। কাননবালা সরু চোখ করে মেয়েটিকে দেখলেন। ভারী সুন্দর মুখখানা, ছেলেবেলার চেহারার গড়নখানা আজও পুরোপুরি যায়নি।

-‘নে লো সই! তোরা আসবি বলে নাতনি আমার কত খাটুনি খেটে এতসব বানিয়েচে!’, বিগলিত হাসেন রেণুমালা।

-‘ওমা! এতসব আমাদের পিতি করেচে বুঝি? ভারী লক্ষ্ণী হয়েছে তো তবে! সেই ছেলেবেলায় যাকে দেখেছিলেম, এ তো তবে আমাদের সেই পিতিলতাটি নয়!’

কাননবালার বেশ মনে ধরেছে মেয়েটিকে। এমন লক্ষ্ণীমন্ত বউই পারবে বাউণ্ডুলে শশীটাকে আটকে রাখতে!

শশী বড় অস্বস্তি বোধ করছে। এ কাকে পছন্দ করেছে মা! দু একবার আড়চোখে মেয়েটিকে দেখে নিয়েছে সে, একেবারেই কম বয়স। বড়জোর নয় কি দশ হবে! অস্বস্তির ভাবটাকে কাটাতেই চোখের তারাটা এদিক-ওদিক নাচছে শশীর, আকস্মিক প্রীতিলতার নোয়ানো মাথাটার ঠিক পেছনের খোলা জানালা গলে একটা ভীষণ সুন্দর দৃশ্যে সেই চঞ্চল চোখজোড়া আটকে গেল।

জানালার পেছনে খোলা জমি জুড়ে বড় বড় ঘাস। একটা কালো গাভী সেখানে খুঁটিতে বাঁধা। শেষ বিকেলের সোনা রোদে দশদিক ভেসে যাচ্ছে। দশ-এগারো বৎসরের এক কিশোর দুধ দুইছিল। পটচিত্রে আরেকজনের আগমন ঘটল। এ মেয়েটিকে আগে দেখেনি কখনো শশীভূষণ। বয়স আঠারো কি উনিশ হবে বোধহয়, চোখের আন্দাজ সেরকমই বলে। চেহারাটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, তবে অবয়বটুকু স্পষ্ট। ছিপছিপে দোহারা গড়ন, মেটে রঙের পুরনো তাঁতের শাড়ি পরনে, আঁচলটা মাথায় ঘোমটার মত করে টেনে রাখা। কোথা থেকে দৌড়ে এসে ছেলেটিকে কীসব বুঝিয়ে সুঝিয়ে স্থানচ্যুত করে তার জায়গাখানা দখল করে নিল সে। একঘেয়ে কাজটা থেকে মুক্তি পেয়ে ছেলেটা দৌড় লাগাল। মুহূর্তেই ঘটল আরেক চমক।

তিড়িংবিড়িং করতে করতে ঘটনাস্থলে এসে হাজির হলো একটা কালো রঙের বাছুর।
চকিতে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে ঝট করে দুধের পাত্রটা সরিয়ে সেখানে বাছুরটাকে জায়গা করে দিল মেয়েটি। তারপর সযত্নে হাত বোলাতে থাকল ছানাটার মাথায়, ওটা তখন চোখ বুজে নিশ্চিন্ত মনে মাতৃদুগ্ধ পান করছে। পত্রচ্যুত ঝিকিমিকি রোদ খেলা করছে যুবতীর চোখেমুখে, সেই রোদের ঝলককে হার মানিয়ে দিয়ে তার হৃদয়ের আনন্দটুকু উপচে পড়ছে মুখচ্ছবি জুড়ে। দুধপান করতে করতেই ল্যাজ দুলিয়ে হালকা চালে তাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে বাছুরটা- বোধহয় ওর ভাষায় কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে! অনির্বচনীয় সৌন্দর্যমণ্ডিত এই দৃশ্যটুকু শশীভূষণের হৃদয়ের মাঝামাঝি কোথাও গিয়ে আসন গেড়ে জাঁকিয়ে বসল। মনের ভেতর চেপে বসে থাকা অস্বস্তিটুকু উবে গেল মুহূর্তেই।

শশীভূষণ কতক্ষণ ওভাবে তাকিয়ে ছিল, কে জানে! একটা তারস্বর, তীক্ষ্ণ চিৎকারে ধ্যান ভাঙল তার। ধুপধাপ শব্দে উঠোন পেরিয়ে দৌড়ে যেতে যেতে চেঁচাচ্ছে কোনো এক কচিকণ্ঠের মালিক- ‘ওরে পিতি! তোর উমাকে খুঁজে পেয়েচি রে! ভাঁড়ার ঘরে দোর দিয়ে রেখেছিল রে—’

প্রীতিলতার মায়ের মুখখানা পলকেই ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করল।

রেণুমালা ধরফরিয়ে বললেন- ‘তা পিতিকে কে তো দেখলিই সই, মেয়েটাকে এবারে নিয়ে যাক। ও রাধিকা মা, যা যা মেয়েকে নিয়ে… ‘

রেণুর কথা শেষ না হতেই অকুস্থলে এক অভিনব দৃশ্যের অবতারণা ঘটল। প্রীতিলতা- সেই সরলা, শান্ত, গিন্নিবান্নি মেয়েটি নিজের মাথার আঁচলখানা ছুঁড়ে মাটিতে ফেলে দিল। কোমরের কাছ থেকে শাড়ি টেনে খুলতে খুলতে উচ্চকণ্ঠে বলতে আরম্ভ করল- ‘পরেশ আমার উমাকে খুঁজে পেয়েচে! হতভাগী বুড়ি, পাজির পা ঝাড়া! ভেবেছিলিস আমার মেয়েকে নুকিয়ে রেখে আমায় বে’ দিবি? মিত্যেবাদী বুড়ি, এই সব খাবার আমি বানিয়েচি? নিবিমাসীকে দিয়ে দিনমান খাটিয়ে এখন লোকের কাছে নাতনির মিছে গুণ গাওয়া হচ্চে! তোকে যদি বাবলুদের পানাপুকুরে না ডুবিয়েচি তো নিজের নাম বদলে নাম রাখব বললুম!’

ততক্ষণে পুরো শাড়িটাই খুলে ফেলেছে প্রীতিলতা। নাতনির সাথে রীতিমতো জবরদস্তি করে জামার ওপর শাড়িটাকে কোনোরকমে জড়িয়ে দিয়েছিলেন রেণুমালা। ঝালর বসানো গোল জামা পরা প্রীতিকে এখন আরো কমবয়সী দেখাচ্ছে। রেণুমালাকে আচ্ছারকমে আরও দু-দশখানা কথা শুনিয়ে, রাধিকাকে আঁচড়ে কামড়ে দিয়ে উদ্দাম ঝড়ের মত দৌড়ে পরেশের পিছু ধরল সে। ওপাড়ার পরেশ তার খেলার সঙ্গী। নানা কায়দা কসরতের পর প্রীতিলতার আদরের কন্যা ‘উমা’কে খুঁজে পেয়ে একটু আগে সে-ই উচ্চকণ্ঠে তা ঘোষণাপূর্বক দৌড়ে পালিয়েছিল।

ছাদটাদ ফুঁড়ে ছোটখাট বজ্রপাত হলেও কাননবালা বোধহয় এতখানি অবাক হতেন না! রেণুমালা ধরফড়িয়ে ঘর ছেড়ে পালিয়ে বাঁচলেন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় রাধিকাও গুটি গুটি পায়ে মায়ের পিছু নিল।

পিনপতন নিস্তব্ধতায় দু’একটা মুহূর্ত কাটল মাতা পুত্রের, তারপর শশীভূষণের বিচলিত গলাটা বড় অস্বস্তিকর সুরে বাজল,
‘মা! চলো বাড়ি যাই!’

কাননবালা বিমূঢ়ের মতো ছেলের মুখপানে চেয়ে রইলেন। তারপর যেন সম্বিত ফিরে পেয়ে মাথা দুলিয়ে বললেন- ‘হু বাপ, হু! চল তাই যাই!’

যাবার বেলায় শশীর তৃষ্ণার্ত চোখজোড়া আরেকবার জানালা গলে তাকাল।

নেই!

মাঠভর্তি সতেজ ঘাস, খুঁটিবাঁধা গরু, তিড়িংতিড়িং লাফানো বাছুর- সমস্তটাই আছে। তবু যেন কিচ্ছুটি নেই!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here