নিয়তি পর্ব -০১

১.
প্রথমদিন শ্বশুর বাড়িতে এসেই বুঝলাম, আমার স্বামী মহাশয় আমাকে ঠিক পছন্দ করেননি! তার হাবভাবে বেজায় বিরক্তের প্রকাশ, আমার সঙ্গে কথা বলা তো দূর,ফিরে তাকাতেও একরাশ অরুচি যেন! আমি মনমরা হয়ে একলা একলা বসে রইলাম রাত একটা অবধি। স্বামী নামক প্রাণীটির ছায়ার চিহ্নটাও দেখতে পেলাম না। চতুর্থ দফায় হাই তুলতে যাবো,ঠিক তখনই একটা লম্বা কালো অবয়ব ঘরের ভেতর প্রবেশ করলো। আমি ঘোমটার তলেই থমকে গেলাম। ভয়ে হাত-পা নিশপিশ করতে লাগলো, বুকের ভেতর হাতুড়ির বারি,মনে হচ্ছে এই বুঝি বেরিয়ে গেল রুহটা….
নিজেকে আরও গুটিয়ে নিয়ে মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে শুরু করলাম। লম্বা ঘোমটা থাকার কারণে তার চেহারা আমি দেখতে পেলাম না। তার পায়ের গতি দেখেই বুঝলাম, অনেকটা জোরের মুখে পড়েই আসতে হলো এঘরে। নিমিষেই মন খারাপ বেড়ে আকাশ ছুঁলো আমার‍! কী এমন কারণ? আমাকে মানতে পারছে না কেন সে! আমাদের বৈবাহিক ঘটনাটা সম্পূর্ণ পারিবারিক ভাবেই ঘটেছে। যেভাবে আর আট-দশটা মেয়েকে লোকে দেখতে যায়,সেভাবেই আমাকে দেখতে এসেছিল এনারা। এরপর পছন্দ,গুরুজনদের আলাপ-আলোচনা,দীর্ঘ দেড় মাস জুড়ে বিয়ের আয়োজনের পর আজ কাঙ্ক্ষিত দিনটি হাতে পেলাম। পাত্র-পাত্রীকে আলাদা ভাবে কথা বলতে দেওয়ার নিয়মটা আমাদের বেলায় না ঘটলেও তাকে জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেয়েছিলাম অন্তত, আমাকে কী পছন্দ হয়েছে আপনার?
উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘এখানে অপছন্দের কিছু নেই!’ এইটুকু বলেই উনি ফোন কেটে দিয়েছিলেন। আমি ধরে নিয়েছিলাম লজ্জা,এখন মনে হচ্ছে সংকোচ। হয়তো আমাকে দারুণ অপছন্দ তার,মুখ ফুঁটে বলতে পারেনি আমি কী ভাববো এই ভেবে!
সাতপাঁচ চিন্তারা মগজটাকে ঘোলাটে করে তুলছে। ছোট্ট দম ফালাবো- ঠিক এমন সময়েই উনার রুক্ষ কণ্ঠস্বর আমাকে কাঁপিয়ে তুললো।
‘ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।’
কথাটি স্বাভাবিক, সহজ-সরল, বেশ ভদ্রতার সঙ্গে বলা- অথচ ভীষণ কাঠিন্য যোগ করা। আমি বিস্মিত হয়ে রইলাম। কোনোভাবে মাথা হেলিয়ে ‘হ্যাঁ’ উত্তর প্রদানের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বেরিয়ে গেলেন ঘর ছেড়ে। আমি মূর্তির ন্যায় জমাট তখনো….
একটু একটু করে রাত বাড়ছে। একসময় ফুরিয়ে যাবে হাওয়াই মিঠাইয়ের মতোন, ফুঁটে উঠবে আলোকিত আকাশ। যেখানে চাইলে দুনিয়ার সব কষ্ট উবে যায়। ওই আসমানের কোথাও বসে আছেন যিনি, যার হুকুমে চলছে গোটা পৃথিবী, তিনি আমাকে দেখছেন,শুনছেন,আমার কষ্ট আর যন্ত্রণা গুলো উপলব্ধি করতে পারছেন। এই-তো ঢের! নিজেকে স্বান্তনা দেওয়ার জন্য এরচেয়ে বড় জাদুবাণী আর হয় না।

আমি গোসল শেষে ফজরের নামাজ আদায় করে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। কোমর সমান চুলগুলো মেলে গামছাটা তুলে নিলাম অন্য হাতে। ভোরের আলো ফুঁটেছে কিছুক্ষণ মাত্র। এরই ভেতর চারপাশ ফকফকে হয়ে উঠেছে। বাতাসে বিশুদ্ধতার ঘ্রাণ, গতকাল সারারাত একলা কেঁদেকেটে ঘুমোনোর অসহ্য ব্যথাটা এখন আর তাড়া করে বেড়াচ্ছে না এত। মনটা হালকা লাগলেও মুখটা ভার তখনো। আমার ভার মুখখান আরও ভার হলো পাশের বারান্দায় নজর পড়তেই। সেখানে এলোমেলো ভাবে উড়ছে ক্রিম রঙের শেরওয়ানিটি। এটিই গতকাল বিয়ের সময় আমার স্বামী পরে ছিলেন। সারারাত উনি আসেননি। তবে কী পাশের রুমেই ঘুমিয়েছিলেন! কিন্তু কেন এমনটা করছেন যখন আমাকে বিবাহ করতে কোনো সমস্যাই ছিল না উনার! তাহলে বিয়ের পর কেন আমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছেন! আমার থেকে দূরে দূরে থাকছেন। দুটো কথা বলছেন না,ভুল করে আমার চোখে চোখ পড়ামাত্র ফিরিয়ে নিচ্ছেন। কী লুকোতে চাইছেন উনি? কোনো মিথ্যা কথা নাকী ঘৃণিত অপরাধ? আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। কানের পাশ ঘেঁষে এক চিলতে বাতাস উড়ে গেল, আমি সম্বিৎ ফিরে পেলাম। বুক চিঁড়ে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাসকে আমি কোনোভাবেই আঁটকে রাখতে পারলাম না বরং সেকেন্ডের ব্যবধানে আমার চিত্ত অস্থির হয়ে উঠল। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করলাম। এ যেন নিজের সঙ্গে নিজেরই মৌন যুদ্ধ! ছোট বেলা থেকে বাবা-মায়ের ভীষণ আদরে বড় হওয়া আমি স্বামীর অবহেলার পাত্রী- তাও প্রথম দিনেই! একদমই বিনা কারণে… আফসোস টা এখানেই। অন্তত একবার আমাকে উনি বলতেন, আমি নিজে থেকে বিয়েটা ভেঙে ফেলতাম। আমার আব্বা-আম্মা কখনোই আমার অসম্মতিতে বিয়ে দিতেন না। মনের ভেতর থেকে কে যেন উঁকি মারলো। নরম মনের আমি একমুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, এই অবহেলা এবং দূরত্ব’র পেছনের কারণটা খুঁজে বের করব। যদি আমাদের ভেতর তৃতীয় ব্যক্তি থেকে থাকে তবে আমি বেরিয়ে আসবো। আমিই হয়তো উনার এবং অন্য কারো ভেতরে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে গেছি!

দরজায় টোকা পড়ল। চোখ মেলে ঘড়িতে সকাল আটটা আবিষ্কার করলাম। দ্রুততার সঙ্গে নিজেকে গুছিয়ে মাথায় আঁচল টেনে দরজা খুললাম। আমার স্বামীর মামাতো বোন অধরা এবং আমার ননাশ শাহরিন আপু দাঁড়িয়ে। তারা আমাকে নিতে এসেছেন। আমি স্মিতহাস্যে বেরিয়ে এলাম। আসার সময় অধরা আমার গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়াল। ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘চুল ভেজা কেন ভাবী?’
আমি প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়েও দিলাম না। তার ঠোঁটে দুষ্টু হাসি। আমার কাছে এর কোনোই উত্তর নেই। মলিন মুখের মৃদু হাসিখানা ছুঁড়ে দিয়ে আমি গটগটিয়ে এগিয়ে চললাম।

***

সারাদিনে কোনোপ্রকার কাজ না করলেও এখন বেশ ক্লান্ত আমি। কিছুক্ষণ আগেই সকল মেহমানদের বিদায় হয়েছে। বাড়িতে এখন আমি, আমার শ্বাশুড়ি, আমার দেবর লাবিব এবং আমার স্বামী। ওহ! এতক্ষণেও তার নামটা আমি উল্লেখ করিনি। মহাশয়ের নাম প্রহর। উনারা সৈয়দ বংশের, আর আমার নাম রূপ, ছোট্ট সোজা একটি নাম ‘রূপ’। আমিও এই নামের মতোই সহজ সরল ভাবেই জীবনটাকে ভাবতাম, কিন্তু এখন নিজেকে কুটিল এবং জটিল করে তুলতে ইচ্ছে করছে। কেননা এরই ভেতর আমি আবিষ্কার করেছি,ওই রুক্ষ মানুষটিকেই আমার প্রচন্ড মনে ধরেছে। তাকে নিয়েই স্বপ্নে সাজানো কাঙ্খিত সোনার সংসারটি সাজাতে চাই আমি। তার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য নিজেকে উজাড় করতে ইচ্ছে করছে। মাত্র একদিনের ব্যবধানে এতটা পাগল কী করে হলাম- ভাবতেই লজ্জারা ঘিরে ধরে আমাকে। একেই বুঝি বলে,বৈধ সম্পর্কের শক্তি! টান! আমার মা বলতো, যখন তোর বিয়ে হবে তারপর বুঝবি স্বামী কী জিনিস! মায়ের কথার মর্মার্থ এখন আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। সারাদিনে একটিবারের জন্যেও তার সঙ্গে কথা হয়নি আমার। নানান বাহানায় এদিক ওদিক ছিলেন, কিছুক্ষণ আগে আত্মীয়দের এগিয়ে দেওয়ার নাম করে বেরিয়ে গেলেন। এখনো আসছেন না। আমি ক্লান্ত শরীরটাকে বিছানায় মেলে ধরলাম। সারাদিন আম্মার ঘরেই কাটয়েছি আমি। সকালে সেই যে এই ঘর ছেড়ে বেরিয়েছি, তারপর এই আসলাম। অথচ ঘর গোছানো, আম্মা হয়তো কাউকে দিয়ে গুছিয়ে রেখেছেন। মনে মনে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। চুলের খোঁপার কারণে শুয়ে আরাম পাচ্ছি না বলে খোঁপা খুলে ফেললাম। বালিশ সোজা করতে গিয়ে অজান্তেই হাত পড়ল চাদরের একেবারে কোণার অংশে এবং সঙ্গে সঙ্গে আমি চমকে উঠলাম। ৬ ইঞ্চির মতো জায়গাটা রক্তে রাঙানো যদিও রক্তের দাগ শুকিয়ে গেছে ইতিমধ্যে। তবুও আমার ভেতরটা কাঁপছে, কার রক্ত এগুলো! আর এলোই বা কোথা থেকে? কী আশ্চর্য!

(চলবে)
গল্পের নাম- #নিয়তি
লেখিকা- #অলিন্দ্রিয়া_রুহি
পর্ব- #১

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here