#নীরদের_বিষাদিনী – (৩)
“পরকীয়া ব্যাপারটিতে একটি লুকায়িত শব্দ আছে।সেটা হলো লোভ।দুজন পবিত্র বন্ধনে থাকার পরেও কিছু নর-নারীর উচ্চ মাত্রার শারিরিক কিংবা মানসিক লোভ থাকে।তাই এক্সট্রা ম্যারিটিয়াল রিলেশনে জড়িয়ে পড়ে।তবে আরো একটা কথা আছে।ধর নিজের পার্টনারের প্রতি দারুণ রকমের ঋ”ণা”ত্ম”ক মনোভাব রয়েছে।সে কিন্তু ইজিলি জলে ভেসে যাবে।জাবির ও রাফার বিয়েটা ভবিষ্যতে এমন হতো না তার কী গ্যারান্টি?আমি একশ পার্সেন্ট নিশ্চয়তা দিতে পারি এমনটা হতো।তাও রিনির সঙ্গেই। মানুষ নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি একটু বেশীই আকর্ষিত।”
নীরদের কথা থেমে গেলেও সিগারেটে রোহানের সুখটান থামেনি।আনমনে ঈষৎ তিমিরে ধোঁয়া মিশিয়ে চলেছে সে।
“চেনা জানা দুটো মানুষের ক্যারেক্টারে কালি লাগিয়ে দিলি নীরদ?আমার বোন দুটো না হয় তোর আপন নয়।কিন্তু জাবির?ও তো আমাদের দুজনের ছোট্ট কালের বন্ধু।বেশ চরিত্রবান।”
“আমি মিথ্যা কিছু বলিনি।রিনির সঙ্গে জাবিরের সম্পর্ক আজ থেকে দুই বছর ধরে।এরমধ্যে কতোবার দুজনে মিট করেছে খেয়াল রেখেছিস কখনো?জাবির যখন বিসিএসে টিকে গেলো তখন রিনিকে নিয়ে ফাইভ স্টার হোটেলে গিয়ে সেলিব্রেট করেছে।কলেজের পিকনিক কিংবা বান্ধুবীর বোনের বিয়ের নাম করে জাবিরের গ্রামের বাড়ীতে ঘুরে আসা এসবের দুই ইঞ্চি পরিমাণ জানিস না রোহান।এমনকি..। ”
নীরদ থেমে গেলো।ছেলেটির ঘুমঘুম চোখে হঠাৎ দ্বিধা এসে লুটোপুটি করতে লাগলো।আড়চোখে একবার গাড়ীতে ঘুমন্ত রাফার পানে তাঁকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে নিলো।না,মেয়েটা অনেক বেশী জ্বা”লা”ম”য়ী।রোহান উৎসুক হয়ে শুধালো,
“এমনকি?”
“কথাটা অনেক কঠিন।তবে মিথ্যা নয়।রিনি পাঁচ মাস আগে এ” বো”র”শ”ন আমার হসপিটালেই করিয়েছে।অনাকাঙ্ক্ষিত কনসিভ করে ফেলেছিল।”
রোহান আচমকা নীরদের টি শার্টের কলার চেপে ধরলো।হাতের জ্বলন্ত সিগারেট ছেলেটির ফর্সা গলায় গিয়ে লাগলো।
“মুখ ঠিক করে কথা বল নীরদ।রিনি এখনও আমার ছোট বোন।সেই পরিচয় কিন্তু মিথ্যা না।”
নীরদ বড্ড বিষন্ন হয়ে উঠলো।পানসে সুরে জবাব দিলো,
“আমি মিথ্যা বলিনা রোহান।বিশ্বাস কর।বাচ্চাটা জাবিরের ছিল।পরবর্তীতে রাফার সঙ্গে বিয়েটা ঠিক হয়েছিল আমি জানতাম না।চীনে ছিলাম।সাতদিন আগে এসে সবটা শোনার পর থেকে বড্ড য”ন্ত্র”ণা অনুভব হয়েছিল।জাবিরকে জিজ্ঞেস করলে ও বলল বিয়েতে হ্যা বলেছে।কিন্তু দ্বিধা আছে।রিনি কল করে কান্না শুরু করলো।আমি একবার ঠিক করলাম সব বলে দিবো।কিন্তু সেই ঘটনার পর থেকে তোর সাথে যোগাযোগ ছিলনা।একবিন্দুও আমার কথা বিশ্বাস হতো না তোর।তাছাড়া রিনিরও ভবিষ্যত ছিল।কিন্তু বিয়ের একদিন আগে জাবির ফোন করে বলে কিছু একটা বুদ্ধি দিতে।আমি কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিতে বলি।উইটনেস আমিই হয়েছি।সকলের জীবন নষ্ট হওয়ার থেকে এটা হওয়া ভালো ছিল।রাফা কিছুদিন কাঁদবে কিন্তু সামলে নিবে।হাতটা সরিয়ে নে।য” ন্ত্র”ণা হচ্ছে।”
রোহানের হাতটা ছাড়িয়ে নিলো নীরদ।বন্ধুর মনের ঝড় উপলব্ধি করতে পারছে সে।এক কালে দুজন তো ভাতও খেতো এক প্লেটে।কই সে টান কী এতোদিনের দূরত্বে কমেছে?নীরদ রোহানের কাঁধে হাত রাখলো,
“আমি খারাপ কিছু করিনি রোহান।যা বলেছি ব্যাপারটা ভুলে যা এখানে।সব মেনে নিয়ে ভেবেছিলাম রাফা যাকে চায় তার সঙ্গেই থাকুক।মাঝ খান থেকে জাবির অসময়ে সরে গেলো।ভুলে যা সব। রাফাকে সময় দে।ঠিক হয়ে যাবে।”
নীরদের স্বান্ত্বনা রোহানের শ্রুত হলো না।এখনও ধাক্কা সামলাতে ব্যস্ত সে।হঠাৎ জাবিরের উপর খুব রাগ হলো তার।এসব করেও কীভাবে রাফাকে বিয়ের জন্য হ্যা বলল?যদি রিনিকে বিয়ে না করতো তাহলে বিষয়টা কতোটা খারাপ হয়ে যেতো।এর বেশী ভাবতে পারলো না রোহান।ক্লান্ত পায়ে গাড়ীর কাছটায় এসে দাঁড়ালো।ভেতরের ঘুমন্ত রাফাকে দেখে চোখ দুটো অবাধ্য হয়ে গেলো।দুই বোনকে সমান ভালোবাসায় বড় করেছে সে।অথচ এই ঘটনার পর কখনো কিছু স্বাভাবিক হবেনা।রোহান নিজেকে সামলে নিলো।পিছন ফিরে বলল,
“সব বুঝলাম।অজানা অনেক কিছু জানা হলো।কিন্তু এখানে তোর নিজেরও স্বা” র্থ আছে নীরদ।সেটা আমি জানি।”
নীরদ হাসলো।রাস্তার হলদেটে আলোতে বড় সুন্দর দেখালো সে হাসি।
“স্বা” র্থ টা কী জোরে জোরে বলবি?”
“সেই ইচ্ছা নেই।কিন্তু একটা জিনিস খেয়াল করেছিস?অতীত নিজ থেকে পুনরাবৃত্তি হলো।তিন বছর আগে যে জায়গায় তুই ছিলি আজ সেই জায়গায় আমি।বোনটাও আমার।অতীতে তোর বোন ছিল।ভালোবাসা কতো য” ন্ত্র”ণা দেয়।বিচ্ছেদ কতোটা বিষাদময় সবটা এবার বুঝবি নীরদ।রাফাকে সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ।এ বাদে তুই ওর কেউ না কেউ না।”
রোহানকে জবাব না দিয়ে বিরস মুখে দাঁড়িয়ে রইলো নীরদ।হালকা সমীরণ বইছে বাতাবরণে।একটানে গাড়ী নিয়ে চলে গেলো রোহান।আর নীরদ?সে পূর্বের ন্যায় দুঃখ নিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে নিজ গাড়ীতে উঠে বসলো।আকাশপানে চেয়ে উষ্ণ শ্বাস ফেলে আনমনে বলে উঠলো,
“আমি বিষাদের ফেরিওয়ালা।পথে পথে ঘুরে বিষাদিনীর দুঃখ বিক্রি করে বেড়াই।”
(***)
নিজ চেম্বারে বসে নিরলসভাবে ঘেমে চলেছে নীরদ।এখন বিকেল চারটে বাজে।সেই সকাল এগারটায় রাফার নাম্বার থেকে ম্যাসেজ এসেছে তার ফোনে।আজ সে দেখা করতে আসবে।কিন্তু কেন তা সে জানেনা?রাফা আসবে দেখে নীরদের আয়োজনের শেষ নেই।বিকেলে কোনো রকমের রোগীদের দেখবে না সে।যতো প্রকার ইমার্জেন্সী হোক না কেন।এসি করা রুমে বাবুটি হয়ে অপেক্ষা করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছে এমন সময় কাঁচের দরজা একপাশে সরিয়ে একজন প্রবেশ করলো।সঙ্গে সঙ্গে নীরদ চোখ বুজে নিলো।এমন কেন মেয়েটা?সে কী নীল রঙের শাড়ী পরেছে শুধুমাত্র তাকে শে”ষ করার জন্য?মাথায় আবার বেলী ফুলের গাজরাও লাগিয়েছে।ইশ,মেয়েটা শুকিয়ে গিয়েছে।এবার কতোদিন পর তাদের দেখা হলো?এইতো ছয় মাস হলো।
রাফা টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসলো।নীরদ সেই হাসির ধাক্কা সামলাতে ব্যস্ত।কম্পমান কণ্ঠে শুধালো,
“কোনো কাজ আছে রাফা?অসুস্থ তুমি?কোনো রোগ হয়েছে?”
রাফা শান্তভাবে পাশ থেকে চেয়ার নিয়ে একদম নীরদের কাছে গিয়ে বসলো।সে খেয়াল করলো নীরদ কাঁপছে।
“কাঁপছেন কেন ডাক্তার?এনি প্রবলেম?”
“তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে রাফা।”
“ও এটা সমস্যা আপনার?তাহলে সাজটা নষ্ট করে ফেলি?”
নীরদ মানা করার পূর্বেই টান দিয়ে নিজের গাজরা ছিঁড়ে ফেললো রাফা।কয়েকটা ফুল মাটিতে অনাদরে পড়ে রইলো।
“কী বলেন তো ডাক্তার ইদানীং আপনার কলম অন্যের বিয়ের স্বাক্ষী দিতে খুব চলছে।কয়েকদিন আগে আমার বিয়েটা এভাবে ভাঙলেন আজ সকালে আমার বান্ধুবীর বিয়েতেও একই কাজ করলেন।”
হঠাৎ রাফা চোখ ছোট ছোট করলো।মেয়েটা শুকিয়ে গিয়েছে।তবুও চেহারার বিষাদ কমেনি।তার চাহনিতে ঘাবড়ে গেলো নীরদ।
“এভাবে তাঁকালে কেমন যেন লাগছে রাফা।”
“ইউ আর ব্লাশিং ডাক্তার।সেটাকে সাইডে রেখে বলেন তো।সবার বিয়ে ভাঙার দায়িত্ব নিয়ে রেখেছেন আপনি?”
“তেমন নয়।এবারও নিজের বন্ধুকে সাহায্য করেছি।আসলে ফ্রেন্ড সার্কেল অনেক বড় তো।”
নীরদের কথা বলার মাঝেই রাফা অনেকটা নিকটে এসে গেলো তার।আচমকা ফুঁ দিলো ছেলেটার মুখে।ভূত দেখার মতো লাফিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো নীরদ।মনে মনে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।ফিসফিস করে বলল,
“প্লিজ রাফা আমাকে সি” ডি”উ”স করো না।ওয়াদা দিচ্ছি কখনো কারো বিয়ের স্বাক্ষী হবো না।”
চলবে।
লেখাঃসামিয়া খান প্রিয়া