নীরদের বিষাদিনী পর্ব -০৪

#নীরদের_বিষাদিনী–(৪)

পুরুষ মানুষ কখনো কখনো বড় অদ্ভূত আচরণ করে।নিজ বিষাদিনীর অশ্রুতেই সুখকে খুঁজে নেয় তারা।নীরদ তো সেখানে প্রেমিক পুরুষ।রাফার নেত্র হতে বৃষ্টির মতোন ঝড়ে যাওয়া অশ্রু গুলোকে দেখে সুখ অনুভব হচ্ছে তার।মেয়েটা সামান্য ঝাল সহ্য না করায় কেঁদে ফেললো?অথচ নীরদ জানে কতো রাত এই বিষাদিনীর বিরহে সে কেঁপে কেঁপে উঠেছে।পুরুষ মানুষ বিধায় চোখের অশ্রুগুলো অহংকারবশত নিজ সীমারেখা অতিক্রম করেনি।

“ডাক্তার সত্যি করে বলেন তো আপনি ইচ্ছে করে খাবারে এতো ঝাল দিতে বলেছেন তাইনা?আপনার টাকায় খাচ্ছি দেখে এতো জটিলতা মনে?ছিঃ।”

রেস্ট্রুরেন্ট ফাঁকা থাকায় স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল নীরদ।মেয়েটা বেশ জোরে জিজ্ঞেস করেছে কথাটা।তিরস্কার করেও খাওয়া বন্ধ করলো না রাফা।নিজমনে খেয়ে যাচ্ছে।

“এতো ছিঃ বলার কিছু হয়নি রাফা।আমার টাকা আছে।তাই কাওকে খাওয়াতে কার্পণ্য করিনা।”

“বাহ!আমাকে নিজেদের বড়লোকী স্বভাবটা দেখালেন।নাকী বুঝালেন আপনার খুব টাকা।মস্ত বড় প্রাইভেট হসপিটালের ডক্টর।বাবা-মা তারাও ডক্টর।অঢেল টাকা।ইশ আমার সস্তা শাড়ী অগোছালো চুল দেখে নিশ্চয় লজ্জা পাচ্ছেন।”

নীরদ থমথমে মুখে শুধালো,

“রাফা এসব কেমন কথাবার্তা?”

“সত্যি তেঁতো হয় ডাক্তার।খুব খুব তেঁতো।”

নীরদ অবাক হয়ে নিজের প্লেটের পানে তাঁকিয়ে আছে।এতোক্ষণে মেয়েটার এখানে এসে রেস্ট্রুরেন্টে খাওয়ার আবদারের অর্থ খুঁজে পেলো সে।রাফা হয়তো পৃথিবীর প্রথম নারী যে কীনা সেজেগুজে এসেছে বিশেষ দো ষে দ ন্ডি ত আসামীকে অপমান করতে।ওদিকে রাফা তাকে অনেক বেশী আ”হ”ত করার জন্য বলল,

“আপনার নিজের বলতে শুধু টাকা পয়সা আছে।এ বাদে কী আছে বলতে পারবেন?দুজন রোবটের মতোন কাজ পাগল মানুষদের বাবা ও মা হিসেবে পেয়েছেন।যারা মন খুলে টাকা উড়িয়েছে আপনার পিছনে।সেই তো ছোট বেলায় মন খারাপ হলে আমার মায়ের আঁচল চেপে বসে থাকতেন।মেধার থেকেও খুব একটা ভালো ছিলেন না।অথচ দেখেন রোহান ভাই ও জাবির ভাইকে।দ্বিতীয়বারেই বিসিএসে টিকে গেছে। কতো সুনাম তাদের।অতীতে ক্লাসেও টপ করতো।ওইতো আপনার রেজাল্ট থাকতো ত্রিশ জনের পরে।বাবার টাকা ছিল তাই কোনমতন মেডিকেল এক্সামে নিজের অবস্থান তৈরী করে দেশ সেরা প্রাইভেট মেডিকেলে ভর্তি হয়ে সেই বাবার তৈরী হসপিটালে ডাক্তার সেজে বসে আছেন।হুহ,টাকা আছে বলে অন্যকে ছো ট করতে পারেন।তাছাড়া রিক্সা চালানোর স্কিলটুকুও নেই।”

“এভাবে বলছো কেন রাফা?”

নীরদের চোখেমুখে অপমানের র ক্তি ম আভা ছড়িয়ে পড়েছে।গলায় খাবার আঁ ট কে যাচ্ছে।নিজেকে শান্ত করা প্রয়োজন।উষ্ণ শ্বাস ফেলে চোখ থেকে চশমা খুলে নিলো স্বীয় কায়দায়।রাফা চোরা দৃষ্টিতে দেখলো।

“শুনো রাফা সকলের মেধা বা পড়া বিষয়টা সমান থাকেনা।কিন্তু মেডিকেল লাইফে পড়াশোনা না করে কেউ ডাক্তার হতে পারেনা।নিশ্চয় আমি চেম্বারে রোগী এলে তার হাতে টাকার বান্ডিল তুলে দিয়ে বলিনা একশ টাকা সকালে খাবেন,দুশো রাতে,তিনশ কাল সকালে।তাই বলি বলো?সেই তো ঔষধ দিতে হয়।মাথা খাঁটিয়ে রোগকে বুঝতে হয়।তাছাড়া রইলো কথা টাকার।রিযিকের উপর কোনো মানুষের হাত আছে?”

“আমাকে অপমান করছেন ডাক্তার?”

নীরদ খুব সুন্দর করে হাসলো।নিস্তেজ হয়ে যাওয়া বিকেলের পানসে আলো তার মুখের একপাশে এসে লাগছে।রাফা অবাক হয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো ব্যক্তিটিকে।সেই কিশোর নীরদ আজ কতো বড়।সুপুরুষ একদম।রাফার হঠাৎ মনে হলো চশমাটি না পরলেও চলতো।শুধু শুধু রুপ বাড়িয়ে কী লাভ?

“তুমি কী ইদানীং নে শা করা শুরু করেছো রাফা?”

“কীসব আ জে বা জে কথা।”

“অবশ্যই করে এসেছো।আচরণ গুলো কিন্তু খুব অস্বাভাবিক।দেখি কাছে এসো তো।”

রাফা বিব্রতবোধ করলো।কী সুন্দর কায়দা করে ছেলেটা উষ্ণ পরিবেশ শীতল করে দিলো।

“কী হলো রাফা এদিকে এসো।”

“আশ্চর্য।আমি আপনার কাছে কেন যাবো?”

“কিছু খেয়ে এসেছো কীনা সেটা দেখতে চাচ্ছি।আমি গন্ধ পেলেই বুঝে যাবো।এক মিনিট তোমার আসতে হবেনা।আমি নিজে দেখছি।”

রাফাকে অবাক করে দিয়ে নীরদ নিজেই উঠে এলো।এলোকেশী কন্যাটির থেকে ঈষৎ দূরে ঝু্ঁকে প্রাণভরে তার গায়ের সুভাস টেনে নিলো।এই ঘ্রাণ আগামী মুহুর্ত গুলোতে তাকে সজীব করে রাখবে।নীরদ চাচ্ছে থেমে যাক সময়।একদম থেকে যাক।এইযে অনেক মাস পর পর স্বল্প দেখা,এতো এতো বিরহ সহ্য করতে গিয়ে সে খুব ক্লান্ত।খুব।রাফা বিরক্ত হয়ে বলল,

“নিজ জায়গায় গিয়ে বসুন ডাক্তার।আপনি আমাকে বড্ড বিব্রত করে দিচ্ছেন।”

“তেমন নয় রাফা।”

চেয়ার টেনে গম্ভীর মুখে বসলো নীরদ। খানিকটা নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,

“অল্প কিছু বছর পূর্বে একটা ভুল করেছিলাম।তাতে ক্ষ”তি কিন্তু আমার বেশী হয়েছে।দ ন্ড এখনও শেষ হয়নি।এজন্য সব মানুষকে সাহায্য করি।কিন্তু সময় খুব বে ঈ মা নী করে রাফা।উদাহরণ হিসেবে তোমার আর জাবিরের বিয়েটা কিংবা আজকের কাহিনী ধরতে পারি।পরিশেষে বলতে পারি সাময়িক কিছু অর্থ কিংবা দীর্ঘশ্বাসের লস ছাড়া দিনশেষে সব মানুষ ভালো আছে এবং থাকবে।”

“নিজে ঠিক হোন।সময় ঠিক হয়ে যাবে।”

“কিন্তু নিজেও ঠিক করলে না রাফা।জানো আমি তোমাকে ভালোবাসি।প্লিজ মেয়ে এভাবে আমার অনুভূতিতে আ” ঘা”ত করার জন্য যখন তখন চলে আসবেনা।অপমানিত মনকে থামাতে পারি কিন্তু ভয়ংকর প্রেমিক পুরুষের মনকে কীভাবে থামাবো?”

কেঁপে উঠলো রাফা।তৎক্ষনাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।যেন তার অনেক বড় দোষ নীরদের সামনে কেউ মেলে ধরেছে তেমনভাবে ছুটতে লাগলো।তার খাওয়া আধখানা প্লেট নিজের কাছে টেনে নিলো নীরদ ব্যক্তিটা।একবার ফিরে বিষাদিনীর প্রস্থান দেখলো সে।উষ্ণ শ্বাস ফেলে এঁটোকে অমৃত ভেবে খেতে লাগলো।ইশ,কতো দিনের অভুক্ত ছিল সে।

(***)
রোহানের একমাত্র স্ত্রীর নাম হচ্ছে শায়লা।বর্তমানে তিন মাসের গর্ভিণী।ঈষৎ উঁচু পেট নিয়ে সবথেকে আদরের ননদীর রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো।রাফা উদভ্রান্তের ন্যায় মেঝেতে বসে আছে।ভর সন্ধ্যা বেলায় মেয়েটা গোসল করেছে দেখে একটু বিরক্ত হলো।সেই ঘটনার ছয় মাস হয়ে গেলো
অথচ সব এখনও ঠিক হচ্ছে না কেন?

“রাফা কফি করে নিয়ে আয় তো।শরীরটা ভালো লাগছেনা।”

ছোট্ট করে জবাব দিলো রাফা।

“ভাবী তুমি রান্নাঘর থেকে এখানে এসেছো কফি চাওয়ার জন্য?”

“কে বলল আমি রান্না ঘরে ছিলাম?”

“আমি জানি।”

“ইশ,তুই কী সব জানিস নাকী?তাহলে বল তো রিনি যে তাজমহলের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছে তখন কী রঙের শাড়ী পরেছিল?জাবির কীভাবে দেখছিলো ওকে?”

“আমি জানিনা ভাবী।”

“এইতো বললি সব জানিস।”

আচমকা শব্দ করে কেঁদে ফেললো রাফা।একদম বিলাপ করা কান্না।শায়লা তার মাথায় হাত বুলিয়ে শুধালো,

“সেই ঘটনার তো ছয় মাস হয়ে গেলো।এখন সব ভুলে যা।”

“ভাবী আজ আমি একটা ভু ল করে ফেলেছি।ভীষণ বড় ভু ল।”

“সেটা কী?”

“একজনকে অনেক অপমান করেছি।তার মেধা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি।”

“লোকটাকে তুই ঘৃণা করিস?”

“খুব।সবথেকে ঘৃণা করি।”

“তাহলে কষ্ট পাচ্ছিস কেন?”

রাফা কান্নার বেগ বাড়ালো।চোখ মুছতে মুছতে বলল,

“জানিনা।তবে ঘৃ ণা করি তাকে।কিন্তু কষ্ট লাগছে অনেক।এতো খারাপ কেন লাগছে ভাবী?”

চলবে।
লেখাঃসামিয়া খান প্রিয়া

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here