নীলাঞ্জনা পর্ব -০৫

#নীলাঞ্জনা
#পর্ব_৫
#লেখনীতে_শুভ্রতা

সময় চিরবহমান। কারো জন্য অপেক্ষা না করে চলতে থাকাই তার কাজ। পৃথিবীতে সৃষ্টিকর্তার পরে হয়তো সময়ই একমাত্র যে কিনা কোনো ফাঁকিবাজি না করে নিজের কাজ ঠিকঠাক করে চলেছে। মানুষের জীবন যেমনই চলুক না কেনো, যতই সুখ-দুঃখ-বেদনা-হতাশা-প্রফুল্লতা আসুক না কেনো এর কোনো কিছুর প্রভাবই সময়ের ওপর পড়ে না। সে তার আপন গতিতে চলতে থাকে।

নীলাঞ্জনার জীবনও থেমে নেই। থেমে নেই তার জীবনের সাথে অতপ্রোত ভাবে জড়িত মানুষ গুলোর জীবন। তাঁদের জীবনের দিন গুলো যেন জলের মতো চলে যাচ্ছে। নভর সমাপনি পরীক্ষা শেষ হয়ে তার ফলাফল প্রকাশ হয়ে গেছে। সে জিপিএ-ফাইভ পেয়েছে। তাতে তার বাবা মা দুজনেই খুব খুশি। নভর চাচা নাফিজ সওদাগরও খুশি হয়ে তাকে সাইকেল কিনে দিয়েছেন। নীলাঞ্জনা এখন বেশিরভাগ সময় নভদের বাড়িতেই থাকে। আয়রা বেগম এর মতিগতি ঠিক না লাগায় নওশাদ শেখ মেয়েকে বন্ধুর বাড়িতেই রাখেন। বাড়িতে অজুহাত হিসেবে বলেন আয়রা নয়ন আর নীলকে একসাথে সামলাতে পারবে না। ফলে নীল অধিকাংশ সময় আনোয়ারা বেগম এর কাছেই থাকে।

পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ায় নভর কোনো কাজ নেই। এখন আর তাকে পায় কে? সারাক্ষণ নীলাঞ্জনার সাথে দুষ্টুমি করতে ব্যাস্ত থাকে। দুই ছেলে মেয়ের কথাদিন ঠ্যালায় আনোয়ারা বেগম এর বাড়িতে টেকা দায়। নীল তো এমনিতেই পাকা সাথে যোগ দেয় নভ। কেমন যেন পাখির মতো কিচিরমিচির করতে থাকে দুজন। এই তো সেদিন গালে হাত দিয়ে বিজ্ঞ লোকের ভঙ্গিতে নীল নভর সামনে গিয়ে বলে

“নবু নবু ছুনছো?”

নীলের মুখে নবু ডাক শুনে ভ্রু কুঁচকে ফেলে নভ। গম্ভীর ভাবে বলে
“তোকে কত দিন বলেছি আমি নবু নই, নভ?”

ঠোঁট ফুলিয়ে নীল বলে ওঠে
“নবুই তো বলেতি। বতা দাও তেনো?”

ধমকে নভ বলে
“না নভ বলিসনি তুই। নবু বলেছিস। নবু কি জিনিস হ্যাঁ নবু কি জিনিস?”

“তুমিই তো নবু!”

দাঁত বের করে বলা নীলাঞ্জনার বলা কথায় গা পিত্তি জ্বলে ওঠে নভ। না ভাই এর কোনো মানে হয়? কত সুন্দর একটা নাম এভাবে পঁচাবে?
“দেখ নীলময়ী আবারও বলছি তোকে আমাকে আর নবু বলবি না। ঠিকাছে?”

মাথা নেড়ে সায় দেয় নীল
“আত্তা।”

“এইতো গুড। এবার বল কি বলছিলি।”

“তুমি এতো জগলা কলো তেনো?”

“কিহ আমি ঝগড়া করি?”

“হুম কলোই তো। মনি তো জগলা কলে না, থালুজানও কলে না। তুমি তেনো তলো?”

“দেখ নীলময়ী ভালো হবে না কিন্তু। আর একবার যদি বলিস আমি ঝগড়া করি তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না বলে দিলাম।”

নভর কথা শুনে নীল হেসে বলে
“তোমাল তেকে খালাপ তো এমনিতেও তেও নেই। হিহিহি।”

নীলাঞ্জনার কথায় নভ তবে রে বলে তাড়া করতে শুরু করে। আর নীলও দৌঁড়াতে থাকে সারা বাড়িময়। অতঃপর নভর সাথে পেরে উঠবে না টের পেয়ে আনোয়ারা বেগমের পেছনে গিয়ে দুই পা জড়িয়ে ধরে বলে
“মনি মনি দেকো তোমাল তেলে আমাতে মালবে।”

আনোয়ারা বেগম নীলকে কোলে তুলে নিতে নিতে বলে
“কি ব্যাপার নভ? তুমি আমার নীল মামনিকে মারবে কেনো?”

নভ রেগে গিয়ে বলে
“আম্মু তোমার বোনের মেয়ে বলেছে আমি নাকি ঝগড়া করি। তুমি ঝগড়া করো না, বাবা ঝগড়া করে না আমি কেন শুধু ঝগড়া করি?”

ছেলের কথায় হেসে দিয়ে বলেন
“ঠিকই তো বলেছে আমার মামনি। তুমি এত ঝগড়া কেনো করো হ্যাঁ?”

“আম্মু তুমিও?”

ছেলের গাল ফুলানো দেখে আনোয়ারা গাল টেনে দিয়ে বলেন
“তুমি আমার মামনির মতো গাল ফুলাও কেনো নবু?”

নিজের মায়ের মুখে নীলময়ীর মতো নবু ডাক শুনে আম্মু বলে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে নভ। তার সাধের নামটাকে সবাই মিলে বেইজ্জতি করছে। এটা সে কিছুতেই মেনে নেবে না। এদিকে তাঁদের কান্ড দেখে নীল কোলে থেকেই হাসতে শুরু করে। সে হাসি যেন থামেই না। নীলের হাসি আবার নভর রাগ বাড়িয়ে দিতে আগুনে ঘি এর মতো কাজ করে। এ বাড়িতে আর থাকবো না বলে বেরিয়ে যায় নভ। তার মা আবার পেছন থেকে বলে
“এমন হুমকি কত এলো গেলো।”

বেশ কিছু দিন পরের কথা। নতুন বছর শুরু হয়েছে। নভ এখন ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। নিয়মিত স্কুলে যাওয়া আসা লেগে আছে তার। সেই সাথে চলমান আছে তার নীলময়ীর সাথের খুনসুটি। সে যেমন সুযোগ পেলেই নীলকে খোঁচা মারতে ছাড়ে না তেমনি নীলও তাকে ঝগড়ুটে বলতে ছাড়ে না। এ নিয়েই দুজনের তুমুল দ্বন্দ্ব। দুই বিচ্ছুকে সামলাতে হিমশিম খান আনোয়ারা বেগম আর নিহাল সওদাগর। নওশাদ শেখের সাথে নীল এর খুব কমই সময় কাটানো হয়। কাজ থেকে ফেরার পথেই যা মেয়েকে দেখে যান তিনি। তাছাড়া নীল তার মনির কাছেই থাকে। কিছু দিন হলো নওশাদ শেখের ফুফু বায়না ধরেছেন নীলকে দেখবে। নওশাদ শেখও ভেবে রেখেছেন মেয়েকে বাড়িতে নেবেন। এখন হয়তো আয়রা বেগম ভালো ব্যবহার করবে। হয়তো ওগুলো তার অসুস্থতার প্রভাব ছিলো।

বন্ধু নিহাল আর তার স্ত্রী আনোয়ারাকে বলে নীলকে বাড়ি নিয়ে যান নওশাদ শেখ। নভ গেছে নৌকা ভ্রমণে। স্কুল থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। নভর যাওয়ার সময় নীলের সে কি কান্না। সেও যাবে নভর সাথে নদী দেখতে। তারপর সবাই মিলে এই বলে ঠান্ডা করেছে যে কিছু দিন পরে তার জন্মদিনে সবাই মিলে যাওয়া হবে নৌকা ভ্রমণে। তখন নীল ইচ্ছে মতো নদী দেখবে। নওশাদ শেখও মেনে নিয়েছেন মেয়ের আবদার।

নীলকে বাড়িতে নিয়ে আসায় আয়রা বেগম যে খুব একটা খুশি হননি তা তার চেহারায় স্পষ্ট। নীল আম্মু আম্মু বলে কোলে উঠতে চাইলে কাজের বাহানায় এড়িয়ে গেছেন কৌশলে। বাকিরাও ভেবে নিয়েছে রান্না শেষে হয়তো মেয়েকে আদর করবেন আয়রা। নীল ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে তার দাদি আর ভাইয়ের সাথে খেলতে। ভাইয়ের ছোট ছোট হাত পা ধরে আধো বুলিতে কি যেন বিড়বিড় করে চলেছে সে। সবাই উপস্থিত থাকায় আয়রা বেগম খারাপ ব্যবহার করেননি ঠিকই তবে ছেলের কাছে নীলকে দেখে চোখ রাঙাতেও ভোলেননি।

দিন চলে গেছে ঝড়ের বেগে। আজ নীলের জন্মদিন। দাদি নিজের গলার স্বর্ণের চেইন খুলে পড়িয়ে দিয়েছে তার গলায়। নভ একটা লকেট সহ চেইন পড়িয়ে দিয়ে বলেছে

“এটা যেন কখনো না খোলা হয় নীলময়ী, এতে তোর নাম লেখা আছে।”

চেইনটা নভ তার বাবা নিহাল সওদাগরকে বলে স্পেশাল ভাবে বানিয়ে এনেছে। তবে এর সম্পূর্ণ বিশেষত্ব নীল জানে না। তবে সে অনেক খুশি তাকে আজ সবাই এত আদর করছে দেখে। অবশেষে তাঁদের নৌকা ভ্রমণে যাওয়ার পালা। নীলের খুশি যেন ধরে না। সে নদী দেখবে তাও কাছ থেকে। আয়রা বেগম নয়ন ছোট হওয়ায় তাকে নিয়ে যাবেন না। নভর পরিবার আর বাবার সাথে যাচ্ছে নীল। নভকে এটা সেটা জিজ্ঞেস করে জ্বালিয়ে মারছে।

“নবু নদী দেকতে তেমন হয়?”

এমন প্রশ্নে তাজ্জব বনে যায় নভ। নদী আবার দেখতে কেমন হবে? নদীর মতোই হয়। তা বললে তো আর নীল মানবে না তাই বলে

“অনেক সুন্দর হয়।”

“তোমাল মতো?”

অদ্ভুত! নদী নাকি নভর মতো। তবু কথা না বাড়িয়ে নভ তাকে কোলে তুলে নিয়ে বলে
“হ্যাঁ আমার মতো এবার চুপ থাক।”

নৌকা নিয়ে তারা কুলের কাছাকাছিই ছিলো। এরপরে নীল বায়না ধরলো আরো ওদিকে যাবে। মানে মাঝের দিকে গিয়ে ঢেউ দেখবে। কিন্তু আকাশে কালো মেঘ দেখে নওশাদ শেখ বারণ করেন। আনোয়ারাও বোঝান এখন গেলে ঝড়ের কবলে পড়ার সম্ভবনা আছে কিন্তু নীল তো নাছোড়বান্দা। কান্নাকাটি শুরু করলে বাধ্য হয়ে নৌকা মাঝ নদীতে নেওয়া হয়। আর ভাগ্যেরও কি পরিহাস তখনই শুরু হয় ঝড়ের সাথে তুমুল বর্ষণ। সেই সাথে নদীতে উত্থাল পাথাল ঢেউ। চারদিকে অন্ধকার হয়ে আছে মেঘের কারণে। হঠাৎ সবার দৃষ্টি এড়িয়ে নীল চলে যায় একেবারে নৌকার কিনারে। এদিকে ঢেউয়ের তালে নৌকা প্রচন্ড ভাবে দুলছে। নিহাল সওদাগর নীলকে নৌকার শেষ মাথায় দেখে তাকে আনার জন্য এগিয়ে যেতে থাকলে হঠাৎ এক বড় ঢেউয়ে নৌকা দুলে উঠলে নীলাঞ্জনা পড়ে যায় নৌকা থেকে। নিহাল সওদাগর নীলাঞ্জনা বলে চিৎকার করে উঠলে সবাই একে একে এগিয়ে আসে। ততক্ষণে তাঁদের চোখের মণি নীলের চিন্হ আর দেখা যাচ্ছে না। আমার আম্মা বলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন নওশাদ শেখ।

চলবে…?

[আস্সালামুআলাইকুম। আজ গল্প দেবো না বলেও দিয়েই দিলাম। আর বেশ বড় করেই দিয়েছি। আজ অন্তত কেউ নাইস, নেক্সট বলে লজ্জা দিবেন না। আর কালকে দেখলাম অনেকে আয়রা বেগম এর নীলের সাথে করা ব্যবহার নিয়ে কটাক্ষ করছেন। বলছি কি অপেক্ষা করুন জানবেন সব। আয়রা বেগম কেনো এমন করছেন তা তো আমরা জানি না তাই না? হতেও তো পারে তিনি নিজেই অনেক বড় মানসিক আঘাত পেয়েছেন। যাই হোক ধৈর্য ধরুন সব ধীরে ধীরে পরিষ্কার হবে। ধন্যবাদ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here