#নূরবাহার ( ২ )
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
—“হলুদ বুনিয়া গ্রামের একমাত্র রূপবতী মেয়ে কি ওই বাহার’ই আছে?
রাজেন্দ্র বাবু তীক্ষ্ণ কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে মারল নিজ পুত্র মহেন্দ্রের দিকে। খানিকটা বিরম্বনার পরে গেল মহেন্দ্র। বাবা কে রাগান্বিত মনে হচ্ছে তার। আবারো হুংকার দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, —“কি হলো, কথা বলছো না যে?
—“এতে তোমার কোন সন্দেহ আছে বাবা?
—“মূর্খের মতো কথা বলো না মহেন্দ্র? এ কি করে সম্ভব!
—“স্বচোখে না দেখলে তুমি বিশ্বাস করবে না, এ কথা আমার জানা!
—“তাহলে তুমি বলতে চাইছো একবার গিয়ে দেখে আসতে, তোমারে কি মতিভ্রম হলো নাকি। এতো বড় অপমানের পর তুমি এখনো তার আশা করছো?
নিম্নস্বরে মহেন্দ্র বলে উঠল,
—“আমি যে তাকেই বিয়ে করতে চাই বাবা!
রাজেন্দ্র বাবু রেগে দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন। ধমকের স্বরে বলে উঠলেন, —“তোমার এই অন্যায় আবদার আমি মেনে নেব, তুমি ভাবলে কি করে? তুমি কি জানো না, ওই মেয়ে আমাদের ধর্মের নয়?
—“এই কথা ভুল বাবা, আমি নিজে খবর নিয়েছি। ঠাকুরের পুজোর ফুল সেই মেয়ে নিজে তুলতে আসে!
বাবার মুখে মুখে ছেলের তর্ক শুনে হতভম্ব হয়ে গেল রাজেন্দ্র বাবু। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ছেলেকে সামনে থেকে চলে যেতে বললেন। তার ছেলের এ কি হলো? ওই টুকু একটা মেয়ের জন্য এতো অধৈর্য হয়ে উঠছে কেন সে? ওই টুকুনি মেয়ে এমন কি মায়া করল তার উপর। স্বচোখে সেই মেয়ে কে দেখবার তীব্র আশা করছেন সে। মুনসী ঘটক কে আবারো ডাক পাঠাতে গায়ে কাটা বিধবার মতো লাগছে তার কাছে। বাড়ি বয়ে এসে বলে গেছে মেয়ের ঠাকুমা এই সম্বন্ধ নাকোচ করে দিয়েছে। এরপরও কি এই নিয়ে বারাবারি তার ধর্মে সইবে। পায়ের নুপুড়ের আওয়াজে মনোযোগ নষ্ট হলো তার। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলেন তার পু্ত্রের মাতা চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন।
——-
ছোট্ট কুঁড়ে ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে জমিদার সাহেব। ভিতরে ঢুকবেন কি না এই ব্যাপারে চিন্তা করছেন। মতি মিয়া তার বিশাল দেহ নিয়ে সামনে এগিয়ে গেলেন। মালিকের আদেশের অপেক্ষা করছে সে। এরইমধ্যে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো ঠাকুমা। লাকড়ির যোগাড় করতে বাহার কে পাঠিয়েছে সেই কোন সকালে। এখনো সেই নবাব’জাদীর আসার খবর নেই। কে জানে আবার কোথায় মেতে আছে অলক্ষ্মী। দোষ নিয়ে জন্মানো মেয়ের এতো চাঞ্চল্য মানুষের চোখে লাগে সেই কথা কি এই মেয়ে বোঝে!
সদর দরজার জমিদার সাহেব কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মাথায় ঘোমটা টানলেন বুড়ি। জমিদার সাহেবও যেন একটু ভিমড়ি খেলেন। মুখটা আগের চেয়ে আরো গম্ভীর করে ফেললেন। ঠাকুমা বলে উঠল, —” একি সৌভাগ্য! জমিদার সাহেব যে, এই কুঁড়ে ঘরে আপনের পায়ের ধুলা দিলেন।
জমিদার সাহেব এবার কুড়ে ঘরে প্রবেশ করলেন। ঠাকুমা তড়িখড়ি করে ঘর থেকে একটা মোড়া নিয়ে এলেন। তুলসী তলার এক কোনে সেই মোড়া রাখলেন। এছাড়া আর জায়গা কোথায়? উঠোন যে এতো টুকুই। তবুও এই বুড়ি চারদিক কি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রেখেছে। জমিদার সাহেব মোড়াতে বসলেন। অভ্যাস মতো তার পাশে বিশাল দেহ নিয়ে মতি মিয়া দাঁড়িয়ে রইল ছায়ার মতো। ঠাকুমা এক গ্লাস পানি আনবার জন্যে ভেতরে যেতে যাচ্ছিলেন। জমিদার সাহেব তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, —“বসো বুড়ি মা, তোমার সাথে কথা আছে!
—” বুড়ি মা বইলা এই অলক্ষ্মী রে মাথায় তুইলেন না জমিদার সাহেব।
—“ও কি কথা? তুমি অলক্ষ্মী কেন হতে যাবে?
—“আমার চেয়ে হতভাগা এই গেরামে আর কে আছে জমিদার সাহেব। আপনার দয়ায় এহনো গেরামে টেইকা আছি। নইলে কবেই সবাই গেরাম ছাড়া করতো।
—“যা হয়েছে তাতে তোমার কোন দোষ নেই?
—“সব তো আমারই দোষ। নিজের মাইয়ারে মানুষ করতে পারি নাই। শেষে এক পাপ আমার উপর চাপাইয়া দিইয়া চইলা গেছে।
—“ওই লক্ষ্মী মেয়ে কে এমন কথা বলো না বুড়ি মা।
—“ওই মাইয়া লক্ষ্মী না জমিদার সাহেব। ওই একটা পাপ?
—“কোনো ধর্ম শাস্ত্রে শিশুকে অপবিত্র বলা হয়নি বুড়ি মা। ওই মেয়ে কেন নিজের পিতা মাতার দোষ নিজের ঘাড়ে নেবো?
পুরনো আঘাতের কথা চিন্তা করে বুড়ি গলা ভার হয়ে আসল। চোখের জল মুছে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সে।
—“জমিদার সাহেব! ওর বড় দোষ এই গরিবের ঘরে এতো রূপ নিইয়া জন্মানো। ওর এই রূপ ওই ধ্বংসের কারণ?
—“আহ্, আবারো এক কথা। তুমি কি বুঝতে পারছো বুড়ি মা, তোমার এই সব কথা বাহারের জন্য অভিশাপ!
—“অভিশপ্ত মাইয়ার গায়ে আর কোন অভিশাপ লাগে না জমিদার সাহেব।
—“বাজে বকা বন্ধ করো, বাহার কি বাড়িতে নাই?
—“না,সেই সকালে গেছে এহনো আহে নাই।
—“তোমার কি কান্ডজ্ঞান বুড়ি, ওইটুকু মাইয়ারে এতো সকালে তুমি একা একা ছাইড়া দিলা।
—“ওতোটুকু মেয়ের চাঞ্চল্য যে সহ্য করণ যায় না।
—“তাহলে মেয়েটার একটা ভালো ঘরে বিয়ে দিচ্ছ না?
—“কি কন জমিদার সাহেব, ওর উপর ক্ষো’ভ নাই এমন একটা মানুষ কি এই গেরামে পাওয়া যাইবো। এই ছোট্ট বয়সে মাইয়ার বিয়া দিয়া আ’গুনে ফালাইয়া দিমু, এমন অমানুষ তো আমি হই নাই।
খানিকক্ষণ চুপ থেকে গেলেন জমিদার সাহেব। সত্যিই তো, ওইটুকু ছোট্ট মেয়ে কি করে বুঝবে মানুষের প্রতি’হিংসার কথা। সে কি আর জানে, এখানে তলে তলে মানুষ তার ক্ষ’তি করার জন্য ওত পেতে আছে। গলার স্বর আরো গম্ভীর হয়ে দাঁড়াল। বুড়ি বলতে লাগলো,
—“মুনসী ঘটক রোজ রোজ আইতাছে সম্বন্ধ নিইয়া।
—“এবারের সম্বন্ধ খারাপ ছিল না। রাজেন্দ্র বাবুর বংশ যথেষ্ট উঁচু!
—“এ কি কন জমিদার, এ যে পাপ! এমন পাপ ধর্মে সইবে না।
—“তুমি এখনো তোমার কথার উপর থাকবা বুড়ি মা।
—“কসম লাগে আমার ঈশ্বরের। বাহার আমার ধর্মের না। আমার মাইয়া বিয়ার আগে আমার ধর্ম ত্যাগ করছে। বাহার রে আমি কেমনে বিয়া দেই অন্য ধর্মে।
—“বুড়ি মা, মানুষ যে বিশ্বাস করে না তোমার কথা!
—“না করুক, সারাজীবন আমার কষ্টে কাটছে, বাইচা থাইকা যেই নরকের ভেতর আছি, মরার পর সেই নরকে আমি যাইতে পারমু না। ওপরে একজন আছে, যে জানে সত্যি টা। মইরা গিইয়া কি আপনি আমারে শান্তিতে থাকতে দিবেন না।
দীর্ঘশ্বাসের শব্দ এলো। ঠাকুমা কাঁদছে। শাড়ির আঁচলে চোখের অশ্রু মুছে নিলেন। মতি মিয়া পাথরের ন্যায় দাঁড়ানো। সবটা দেখে যাচ্ছে কিন্তু বোঝার চেষ্টা কিছু্ই করছে না। এ তার কাজও না। জমিদার সাহেব আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ছুটতে ছুটতে বাড়ি এলো বাহার। হাতের লাকড়ি গুলা এই পাশে ফালাইয়া দৌড়ে ছুটে এলো জমিদারের সামনে। জমিদার সাহেব চোখ ফিরালেন এই কন্যার দিকে। হাওয়ায় দোলায় মাথার চুল গুলো উড়ছে তার। গায়ে মাখা ধুলো ময়লা। কিছুই ঢাকতে পারে নি তার সৌন্দর্য, তার মহিমা। চাঞ্চল্যকর চোখ গুলো বার বার এদিক ওদিক করছে। মুখে তার খুশি খুশি ভাব।
—“আরে জমিদার সাহেব যে, আইলেন কহন?
—“কেমন আছো বাহার?
—“ভালা আছি। আপনি ভালা আছেন তো?
—“হুঁ খুব ভালো।
—“আমাগো বাড়িতে কেন আইছেন জমিদার সাহেব?
জমিদার সাহেব জবাব না দিয়ে হাসলেন। এই কথা এখন অবদি কখনো কেউ জিজ্ঞেস করার সাহস পায় নি। এই গাঁয়ের জমিদার তিনি। আশপাশের আর পাঁচটা গাঁয়ে তার সম্মান সর্বোচ্চ। অথচ এই মেয়েটার চোখে সে নিতান্তই গায়ের আর পাঁচ লোকের মতো। ঠাকুমা পিঠে চড় বসিয়ে বললেন, —“মুখপুরী, কার সামনে কি কইতে হয় এখন অবদি শিখলি না তুই। আর এহন বাড়ি আসার সময় হইছে তোর, কখন পাঠায়ছিলাম দুটো লাকড়ি আনতে।
জমিদার সাহেবের চোখের ইশারায় ঠাকুমা থেমে গেলেন। তিনি শান্ত গলায় বললেন, —“এক গ্লাস পানি খেতে এসেছিলাম বাহার।
—“দাঁড়ান, আমি পানি লইয়া আইতাছি।
বলেই ঘরের দিকে ছুটলো সে। ঠাকুমা আঁচলে মুখ ঢেকে ক্ষমা চাইছেন। জমিদার সাহেব বলে উঠলেন, “বাহার কে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দাও বুড়ি?
—“কোথায় পাঠামু সাহেব, আমার গোত্র থেকে আমারে অনেক আগেই বাইর কইরা দিছে। এই অনাথ মাইয়ার প্রতি ওগো দরদ আইতো না।
—“বাহারের বাবার কোন আত্নীয়?
—“এই গাঁয়ের সবাই জানে তার কেউ ছিল না। শুধু আছিলো এক মামা। তার চরিত্র ভালা না, এই মাইয়ারা সেখানে দিইয়া আর কোন বি’পদে পড়তাম আমি!
জমিদার সাহেব আবারো গম্ভীর হয়ে গেলেন। বাহার পানির গ্লাস নিয়ে ছুটে এসে হাজির হলো। জমিদার সাহেব সেই গ্লাস হাতে তুলে নিলেন। বুড়ি মা নিজেরে ধন্য মনে করল। বাহারের স্বভাব বেশ চাঞ্চল্যকর। কোন কিছুতেই মুখ আটকায় না তার। স্বভাব মতো জিজ্ঞেস করে বসল, —“জমিদার সাহেব আজ দুপুরে আমাগো বাড়িতে খাইবেন?
—“কি রান্না হবে আজ!
—“নিরামিষ কিন্তু অমৃত। আমি কইয়া দেই আমার ঠাকুমা কিন্তু অনেক ভালা রাঁধুনি।
—“কিন্তু বাহার, মাছ ছাড়া যে আমার রুচে না।
—“আপনে রোজ মাছ খান!
তার স্বরে অবাক মিশ্রিত। জমিদার সাহেব হেসে বললেন, —“কেন? তুমি মাছ খাও না!
—“আমি খালি চোখেই মাছ দেখছি, খাইতে পারি নাই। আমাগো ঘরে মাছ রান্না হয় না। জানেন না আমার ঠাকুমা বিধবা।
কথাগুলো বলে উঠল বাঁধা ছাড়াই। জমিদার সাহেব অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন। মেয়েটার প্রতি এক আজানা মায়া কাজ করে তার। কি সুন্দর করেই না কথা বলে মেয়েটা। জমিদার সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। ঠাকুমা বাহার কে চেপে ধরলেন। জমিদার সাহেব মতি মিয়া কে বললেন, —“এই বাড়িতে বড় দেখে আমার পুকুরের রুই মাছ দিয়ে যাবা।
ঠাকুমা কৃতজ্ঞতা হাত জোড় করলেন। বাহার কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠল, —“না না, এ যে অবিচার হইবো!
—“কেন অবিচার হইবো?
—“বিধবা গো বাড়িতে মাছ মাংস আনা তো পাপ
—“মাছ তো আমি তোমার জন্য পাঠাবো বাহার?
—“কিন্তু সেই মাছ রাধবো কেডা? ঠাকুমা মাছ ছুইতে পারবো না। আর ঠাকুমার সামনে বইসা তারে দেহাইয়া আমি মাছ খাইতে পারমু না।
ঠাকুমা বাহারের মুখে হাত চেপে ধরলেন, —“চুপ , চুপ করে মুখপুরী!
জমিদার সাহেব হাসলেন। বলে উঠলেন, —“না না বুড়ি মা, বাহার তো ঠিক কথাই বলছে। তা বাহার তুমি কি খাবে বলো? কোন খাবার তুমি আর তোমার ঠাকুমা খেতে পারবে?
বাহার চট করে ঠাকুমার হাত সরিয়ে বলল, “দুর্গার বইন সেদিন আমারে দেখাইয়া দেখাইয়া রসগোল্লা খাইছিলো!
—“বেশ তো, মতি মিয়া। বাজার থেকে ভালো দেখে এক হাড়ি রসগোল্লা নিয়ে আসবে এই বাড়িতে।
—“কি সর্বনেশে কথা, সত্যি রসগোল্লা আইবো!
ছোট বাহারের চোখে উচ্ছাস দেখে কিঞ্চিত হাসলেন জমিদার সাহেব। ঠাকুমা হাত জোড় করে বললেন, —“আপনার দয়া জমিদার সাহেব!
_________
বাবার সাথে রাগারাগির পরদিনই হলুদ বুনিয়া গ্রামে হাজির হয়েছে মহেন্দ্র! সেবার পুজোয় ঠাকুর দেখতে এসে প্রথম বার বাহারের উপর চোখ পড়ে তার। সেই একপলকেই বাহার কে পাওয়ার এক অনাকাঙ্ক্ষিত তীব্র ইচ্ছা পোষণ করে মনে। আজ আবারো এসেছে সেই বাহার কে এক নজর দেখতে। বড় বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে মহেন্দ্র! বাহার আসবে, এই পথ দিয়েই জঙ্গলের দিকে যাবে ফুল তুলতে। সমবয়সী মেয়েদের সাথে সাথে ছুটতে ছুটতে বাহার আসছে এই দিকেই। আশ্চর্য! পৃথিবীতে এতো সুন্দর ফুল থাকতে এই ছোট্ট ফুলকেই চোখে পড়ছে মহেন্দ্রর। তরুণের মনে তীব্র বাসনা এই ফুল কে নিজের মনের আঙ্গিনায় সাজানোর।
#চলবে….