নূরবাহার পর্ব -০৮

#নূরবাহার ( ৮ )
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )

কবিরাজ এসে নাড়ি পরিক্ষা করছে দিদিমার। ছোট্ট বাহার নিশ্চুপ মনে দেখে যাচ্ছে সবটা। একটিবারের জন্য দিদিমার পাশ থেকে সরে যায় নি। সারাদিনে ও বের হয়নি ঘর ছেড়ে। এমন উড়নচণ্ডী মেয়ে যেন এক নিমিষেই নিশ্চুপ হয়ে গেল। অন্নপূর্ণার মা আর তাহেরা বেগম এসে দু বেলা খাবার দিয়ে যাচ্ছে। দিদিমা অসুস্থ আজ বেশ কয়েকদিন ধরেই। জমিদার সাহেব খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন। কবিরাজ নাড়ি পরিক্ষা করে জমিদার কে জানালেন, –“সময় তো আর নাই জমিদার সাহেব, বুড়ির দিন শেষ হইয়া আইতাছে!”

মুখে প্রকাশ না করলেও কথাটায় বেশ বিরক্ত হলেন জমিদার সাহেব। কবিরাজিতে তার তেমন বিশ্বাস নেই। ডেকে পাঠালেন ডাক্তার বাবু কে।‌ ডাক্তার বাবুও যখন একই কথা বলল অনেকটা ভেঙে পড়লেন তিনি। যে বুড়ি এতো দিন নাতনি টাকে নিয়ে যুদ্ধ করে গেল তিনিই যদি এখন জীবনের কাছে হার মেনে যান তবে এই নাতনি কে দেখবে কে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করলেন জমিদার সাহেব। ডাক্তার বাবু খানিকটা আঁচ করতে পেরে বললেন, –“এখন ওই মেয়েটার কি হবে জমিদার সাহেব!

–“আমি জানি না ডাক্তার বাবু!

–“গাঁয়ের যেসব মানুষ শিয়ালের মতো ওঁত পেতে ছিল, এখন যে সুযোগ পেয়ে তারাই ঝাঁপিয়ে পড়বে। বুড়ি মা নিজের শেষ নিঃশ্বাস অবদি আগলে রাখছিল বাচ্চা মেয়েটাকে। এরপর কে দেখবে?

জমিদার সাহেব করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তার দৃষ্টিতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, তিনি অসহায়। কি করবেন তিনি এটা জানেন না। ডাক্তার বাবুর সাথে জমিদার সাহেবের সম্পর্ক অনেক গভীর। জমিদার সাহেব ডাক্তার বাবু কে অনেকটা আপন ভাবেন। সেই সম্পর্কের অজুহাতেই খুব বড় একটা কথা বলে ফেললেন ডাক্তার বাবু!

–“যদি কিছু মনে না করো, একটা কথা বলি।

–“কি বলবে?

–“মেয়েটার ভালো মন্দ কিছু হবার আগে মেয়েটাকে নিজের কাছে রাখো!

–“কি বলছো কি তুমি?

–“ভান ধরো না জমিদার, তুমি কিন্তু এতো অসহায় না। এ গায়ের জমিদার তুমি, তোমার কি কোন মর্যাদা নেই। তুমি যা বলবে এই গাঁয়ের লোক তাই মেনে নেবে, তাহলে আপত্তি টা কোথায়? আর এছাড়া..

বলতে গিয়েও ডাক্তার বাবু থেমে গেলেন। পরক্ষণেই মুখ ফুটে বললেন, –“তুমিই তো বলেছিলে তুমি প্রায়শ্চিত্ত করতে চাও। এখন যখন সুযোগ পেয়েছ তাহলে কেন ছেড়ে দেবে।

–“তুমি এসব কি বলছো ডাক্তার!

–“যা বলছি ভুল কিছু বলছি না। তুমি বুদ্ধিমান! আর বুদ্ধিমানরা বোকার মতো কাজ করে না!

বললাম উঠে দাঁড়ালেন ডাক্তার বাবু। যাবার পথে এক নজরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন জমিদারের দিকে। এর অর্থ স্পষ্ট!

জমিদার সাহেব ছোট্ট কুঁড়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন। বাহার দিদিমার পাশে বসে থাকতে থাকতে একসময় তাকে জড়িয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। রাত এখনো বাড়েনি এর আগেই ঘুমে তলিয়ে পড়েছে সে। অসুস্থ দিদিমা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। পর পর চোখের জল ফেলছে। জমিদার সাহেব কে দেখতে পেয়েই উঠতে চাইলেন কিন্তু অসুস্থ শরীরের কাছে হার মানতে হলো তাকে।‌ জমিদার সাহেব শুকনো মুখে বললেন, –“আমার কাছে কোন আর্জি আছে তোমার বুড়ি মা?

–“জমিদার সাব! আমার দিন শেষ হইয়া আইতাছে, আমি জানি। এতে আমার দুঃখ নাই, আমার দুঃখ তো এই হতভাগীরে নিইয়া!

–“তুমি কি চাও বলো,‌ আমি কথা দিচ্ছি সেই কথা রাখব।

–“আপনের দয়া জমিদার সাব। আমি মই’রা যাওনের পর শুধু এই মাইয়াটারে মাথা গোজবার একটু ঠাঁই দিয়েন। তইলেই আমার জীবন সার্থক হইবো।

–“ঠিক আছে, কথা দিচ্ছি তোমায়!

–“ভগবান আপনার মঙ্গল করুক জমিদার সাব!
বলতে গিয়ে থিতুনি বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল তার। মতি মিয়া কে এখানে রেখে বাড়িতে রওনা দিলেন জমিদার সাহেব! তার অর্ধাঙ্গিনী ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে তার। দোতলা ভবন করে স্বামী কে ফিরে আসতে দেখে তার চোখ জুড়াল। নিমিয়ে গেল সকল চিন্তাভাবনা।‌ রাতের খাবারের ব্যবস্থা করবার জন্য ছুটছেন তিনি। জমিদার সাহেব শীতল গলায় বললেন, –“কিছুই খাবো না আমি?

–“ওমা,‌এইটা কেমন কথা?

–“ইচ্ছে করছে না মুনতাহা। তুমি এসব নিয়ে যাও।

–“একগ্লাস দুধ নিইয়া আসি।

–“না কিচ্ছু আনবার দরকার নেই।

হতাশ হয়ে খাবার নিয়ে চলে গেলেন মুনতাহা। টেবিলের পাশ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বিছানায় নজর দিলেন জমিদার সাহেব। তার ছোট্ট রাজকন্যা ঘুমে তলিয়ে আছে।‌ আহ কি মায়া তার মুখে,‌ এই মায়াবিনী মুখ তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে বাহারের কথা। কষ্ট,‌যন্ত্রণায় বুক ফেটে যাচ্ছে তার।‌ঘরে ঢোকবার শব্দ আসে মুনতাহার। স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে আশ্বাসের প্রস্তাব দিয়ে মধুর স্বরে বলে, –“আপনের কি হইছে? শরীরটা কি ভালা না!

জমিদার সাহেব জবাব দিলেন না। শীতল দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। তার পাশে শুধু আছে এই একজন। তিনি ভুল করুক কিংবা ঠিক তবুও এই মানুষটা কখনো ছেড়ে যায় না তাকে। ক্লান্ত স্বরে জমিদার সাহেব বললেন, –“আমার কষ্ট হচ্ছে মুনতাহা!

–“কি কন, কই কষ্ট হইতাছে?

–“বুকের ভেতর,‌তীব্র যন্ত্রণা আঁকড়ে ধরছে।

তড়িখড়ি করে মুনতাহা হাত রাখলেন বুকের উপর। হাত বুলিয়ে বলেন, –“আল্লাহ মাফ করুক, বেশি কষ্ট হইতাছে। ডাক্তার বাবু রে খবর দিমু!

জমিদার সাহেব মাথা দুলিয়ে না করলেন। তার এই যন্ত্রণার অবসান কেউ করতে পারবে না। এই সাধ্যি কারো নেই। মুনতাহা কে কি বাহারের কথাটা একবার বলবে। না থাক! আরেকটু সময় যাক এরপর বলা যাবে!

যেই সময়টাতে পুজোর ঢাকে চারদিক মুখরিত ঠিক সেই খানেই দিদিমার মনে উধাল পাতাল শুরু হয় গেছে। তার মন বলতাছে সে আর বেশিদিন বাঁচবো না। মায়ের বিসর্জনের আগেই তার বিসর্জন দিতে হইবো। বাহার ডাক্তার বাবুর দেওয়া ঔষধ খুব যত্ন করে দিদিমা কে খাইয়ে দিল। তার গায়ে চাদর টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। দিদিমা করুণ দৃষ্টিতে দেখছে এই ছোট্ট মেয়েটিকে। কি হবে তার দিদিমা চলে গেল? আপন বলতে যে আর কেউই রইবে না, আগলে রাখবে না কেউ! কেউ বলবে না সারাদিন এতো ছোটাছুটি কিসের তোর মুখপুরী!

বাহার কে দেখতে দেখতে দু’চোখ ভরে উঠলো দিদিমার। চোখ সরিয়ে সামনে তাকাতেই বুঝতে পারলেন কেউ আছে সেখানে। উঠবার চেষ্টা করলেন তিনি। গলা দিয়ে স্বর আসছে না তবুও ডাকবার চেষ্টা করলেন কে ওখানে? অতঃপর যা দেখলেন তাতে চমকে উঠলেন দিদিমা। শক্ত করে আঁকড়ে ধরলেন চাদরের টুকরো খানি। দরজার ওপাশে যে রাজলক্ষ্মী কে স্পষ্ট দেখলেন তিনি। হাই হুতাশ করে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। ওটা রাজলক্ষ্মী’ই ছিল। লাল রঙের কাপড় পড়ে ছোটাছুটি করছে। লুকোচুরি খেলছে মায়ের সাথে। দিদিমা আঁত’কে উঠলেন। বাহারের হাত খানি শক্ত করে ধরে বললেন, –“আমারে মাফ কইরা দিস রে মা!

–“এসব কি কইতাছো দিদিমা?

–“আমার আর দিন নাই, শোন মাইয়া জীবনে সবাইরে বিশ্বাস করবি না ‌। কাউরে অন্ধ বিশ্বাস করবি না। তোর জীবন সবার মতো না। ভালা মানুষ সাইজা খারাপ মানুষ তোর চারদিকে থাকবো। ভালা মন্দ বুইঝা চলবি।

–“এগুলা কি কও? কিছুই তো বুঝি না।

–“বুঝা লাগতো না। মন দিয়া হুন। যখন‌ বড় হবি তখন মনে করবি তোর দিদিমার কথা।

–“কেন? আমি যখন বড় হমু তখন তুই কই থাকবি।

–“আমার দিন যে আর নাই রে মা। আয় আমার বুকে আয় তুই। শেষবারের মতো তোরে জড়াইয়া ধরি একটু!

বাহার চুপটি করে দিদিমার কাছে গেল। দিদিমা দুই হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। দিদিমার কোলে আরাম পেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল বাহার। রাত পেরিয়ে ভোর হলো। ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে দিদিমা কে ডাকছে সে। –“দিদিমা! ও দিদিমা!

জবাব দিচ্ছে না দিদিমা। বাহার বার বার দিদিমা কে ঠেলছে। একসময় তার অসাড় হয়ে গেল। দিদিমা যে কথা বলছে না। তার শরীর হাত পা সব কেমন ঠান্ডা হয়ে গেছে। বাহার উঠে দাঁড়াল। ছুটে ঘরের বাইরে চলে এলো। দাওয়ায় শুয়ে থাকা মতি মিয়া কে টেনে উঠাল। বিশাল দেহশালি মতি মিয়া কথা না বলে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইল। বাহার কাঁদতে কাঁদতে বলল, –“দিদিমা কথা কইতাছে না!

মতি মিয়া ছুটে গেল ঘরের ভেতর‌। দুদন্ড দাঁড়িয়ে বুড়ি মা কে দেখেই ছুট দিল বাইরে। –“ডাক্তার বাবুরে আনতে যাইতাছি, আপনে এহানেই থাহেন! বলেই ছুটতে লাগল। বাহার চোখের জল মুছতে মুছতে দিদিমা কে একবার দেখল। তার শিয়রে বসে কাদলো কিছুক্ষণ। আবার উঠে দাঁড়াল। অন্নপূর্ণার বাড়ি তো বেশি দূর না। বাহার এক ছুটেই যেতে পারবে। সে ছুট দিল!

সকালে পুঁটলি করে খই ভাজা নিয়ে বাহারের বাড়ির দিকে হাঁটছে নুহাশ। পথের মধ্যে বাহার কে দৌড়ে আসতে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল সে। বাহার একদিকে কাঁদছে অন্যদিকে চোখ মুছছে। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বাহার মুখ ফুটে বলল, –“দিদিমা আর কথা কইতাছে না আমার লগে নুহাশ, তুই চল আমার লগে!

নুহাশ হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। বাহার এগিয়ে এসে তার হাত ধরে টানছে। একসময় তার জ্ঞান হলো। বাহারের হাত ধরে ছুটতে লাগল সে।

ডাক্তার বাবু এসে নিশ্চিত করে গেলেন, বুড়ি মা আর বেঁচে নেই। ওই বাড়ির বড় দিদি, নতুন বউ, তাহেরা বেগম, অন্নপূর্ণার মা সকলে হাজির সকাল সকাল। ছোট্ট কুঁড়ে ঘরে আছে মানুষে গিজগিজ। একদিকে বসে কেঁদে যাচ্ছে অনেকে। ডাক্তার বাবুর পাশে ছোট বাহার অবিশ্রান্ত কেঁদে যাচ্ছে। ডাক্তার বাবু তার মাথায় হাত রাখলেন। –“আর কাঁদে না মা, এইবার থাম!” কিন্তু বাহার থামলো না।

দুপুরের মধ্যে দিদিমা কে বিদায় দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। বাহার দিদিমা কে যেতে দেবে না, কোনভাবে দেবে না। তাহেরা বেগম কোনমতে সেই মেয়েকে হাত ধরে আটকে রেখেছেন। বাহার চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে, –“দিদিমা, আমার ছাইড়া তুই যাইস না, যাইস না দিদিমা!” তার চিৎকার, আর্তনাদ, কান্না সব মিলিয়ে গেল। বিশাল আকাশ আজ শান্ত, খুব শান্ত!

সন্ধ্যার দিকে শ্মশা’ন ঘাট থেকে ফিরে এলেন ডাক্তার বাবু। মতি মিয়া দাঁড়িয়ে আছে বাহারের পাশে। তাকে খানিকক্ষণ আগেই গোসল করানো হয়েছে। অন্নপূর্ণার মা অনেক জোরজবরদস্তি করে গোসল করিয়ে দিয়েছেন। তার আধভেজা চুল গুলো থেকে এখনো টপটপ করে পানি পড়ছে। চোখের অশ্রু এখনো থমকে যায় নি। পাশে বসে থাকা অন্নপূর্ণা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বাহার নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ! তার শরীর দুর্বল, চক্ষু স্থির! ডাক্তার বাবু অন্নপূর্ণার মাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, –“দিদি, আমি ওকে আমার সাথে নিয়ে যাই!

অন্নপূর্ণার মা একবার ভাবলেন না করবেন। কিন্তু পরক্ষণেই মাথা দুলালেন। বাহারের এখানে একা থাকা ঠিক না ঠিক তেমনি তাদের সাথে থাকাও খুব বেশি সুবিধার বলে মনে হচ্ছে না। নুহাশ খুব করে বলল, –” না না বাহার আমাগো বাসায় যাইবো!”

তাহেরা বেগম ঘোমটার আড়ালে মুখ লুকান। ডাক্তার বাবু হাসলেন। কিছু বলতে নিলেন। তখন বাহার দাঁড়িয়ে উঠে বলল, –“না, আমি জমিদার সাহেবের বাড়িতে যামু!”

তার কথায় বিশাল এই জনগন নিশ্চুপ হয়ে গেল। কেউ কিছু বলছে না। বাহার ছুটে এসে মতি মিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, –“আমারে জমিদার সাহেবের বাড়িতে নিয়া চলো!

মতি মিয়া অদ্ভুত ভঙিতে তাকিয়ে রইলেন ডাক্তার বাবুর দিকে। ডাক্তার বাবু বললেন, –“নিয়ে যাও ওকে!” মতি মিয়া পা বাড়ালেন। ডাক্তার বাবু দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তার জানা নেই জমিদার তার কথা রাখবে কি না। ঠাঁই মিলবে কি না এই হতভাগীর। কিন্তু এই কথা সত্য! এখন থেকে তার জীবন বদলে যাবে, আর কেউ রইল ছায়া হয়ে!

পথের মধ্যে আকাশ অস্থির হয়ে গেল। কে জানতো এই শান্ত, বিশ্রান্ত আকাশ হঠাৎ করেই এমন অস্থির হয়ে যাবে। কি সেই ঝড়, কি তার গতি! বৃষ্টির‌ বড় বড় ফোটা গায়ে পড়তেই শিউরে উঠছে। এই ঝড়ের আগমন কিসের ইঙ্গিত, কে জানতো? বাহারের জীবনেও যে উথালপাথাল শুরু হবে এটা এই ঝড়ের ইঙ্গিত! প্রথমে শান্ত থাকবে, মাঝে ঝড়ের কারণে সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে যাবে আবারো শান্ত হবে। কিন্তু কখন? কখন হবে এই সময়!

মুনতাহা বেগম দোতলা থেকে মতি মিয়া কে বাড়িতে ঢুকতে দেখে জোরে হাঁক ছাড়লেন। বৃষ্টির গতি তখন খানিকটা কমেছে। হারিকেনের মৃদু আলোয় পাশে থাকা বাহার কে চোখে পড়ল না তার!

–“কে কে ওখানে?

–“খালাম্মা! আমি মতি মিয়া গো!

–“মতি মিয়া! তুমি এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে কোনখান থেইকা আইলা?

–“বাহারের বাড়ি থেকা গো!

মুনতাহা বেগমের কলিজা কেঁপে উঠলো। বাহারের দিদিমা মর’বার খবর পেয়েছেন তিনি। মতি মিয়া সেই মেয়েকে মরা বাড়িতে রেখে একা চলে এলো। সত্যি কি তাই! নাকি ওই অভিশপ্ত মেয়েকে সাথে করে নিয়ে এসেছে। বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, –“তোমার সাথে আর কেডা আছে?

–“বাহার আছে খালাম্মা!

চমকে উঠলেন মুনতাহা বেগম। তার শরীর রক্ত টগবগ করছে। রাগে থরথর করে কাঁপছেন তিনি। কতো বড় সাহস এই অলক্ষ্মীর ! তার বাড়িতে পা রেখে দিল। আল্লাহ মাবুদ এখন কি হবে? কোনদিকে যাবে সে? মানুষ টা তো বাসায় নাই। সে কোন ভোরে গেছে পাশের গায়ে। সেখানে মন্ডপে কি ঝামেলা মিমাংসা করতে। এই সময়ে এই হতভাগী এসে জুটল তার কপালে। আল্লাহ এতো মন্দ কপাল লেখলো তার। কর্কশ গলায় মুনতাহা বলে উঠলেন, –“তোমার সাহস কি করে হয় মতি মিয়া, ওই অলক্ষনী মাইয়ারে নিয়া তুমি আমার বাড়িতে পা রাখো!

–“খালাম্মা..

–“থামো তুমি, এই এখন এই মাইয়ারা কও বাড়ি থেকে বার হওয়া যাইতে। এই মাইয়া আমার বাড়িতে কোন সাহসে পা রাখছে। কোন অমঙ্গলের নিয়া আইছে!

–“খালাম্মা, মালিক তো কইলো?

–“তুমি থামো মতি মিয়া। যা কইতাছি এখুনি তা করো। বার হও এই মাইয়ারা নিয়া। দূর হও আমার বাড়ি থেকে।

মতি মিয়া অসহায় বোধ করতে লাগলেন। তার এই বিশাল দেহ থাকলেও ভাববার বুদ্ধি টুকু ছিল একটুখানি। বাহারের কানে এলো সমস্ত কথা। সেও‌ চট করে বলল, –“আমি কোনখানে যামু না, জমিদার সাহেব কই? তারে আমার দরকার আছে?

–“এই মাইয়া? কে তুই? এতো বড় বড় কথা কিসের তোর। বের হ আমার বাড়ি থেকে, এহনি বার হ!

–“আমি কোথথাও যামু না। জমিদার সাহেব, জমিদার সাহেব! বলে চেঁচাতে লাগলেন বাহার। মুনতাহা বেগম রাগে দাঁত কিরমির করতে লাগলেন। পাশের ঘর থেকে আয়েরা কান্নার আওয়াজে সেদিকে ছুটে গেলেন। বাড়ির এক কোনায় চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে বাহার। মতি মিয়া দাঁড়িয়ে না থেকে বেরিয়ে গেলেন। ছুটলেন ডাক্তার বাবুর কাছে।

আয়েরা কে শান্ত করতে ব্যস্ত মুনতাহা বেগম।কাজের মেয়ে কুলসুম ঘরে ঢুকতেই মুনতাহা বেগম তীক্ষ্ম কন্ঠে বললেন, –“মাইয়াটা গেছে কুলসুম?

–“না খালাম্মা, অনেক ত্যাড়া মাইয়া। বাইরে দাঁড়াইয়া ভিজতাছে। ঘর থেকে বার হয় না। বার বার কইতাছে জমিদার সাহেবের লগে কথা কইবো।

–“মুখপুরী এদিকে আইছে আমার ক্ষতি করতে। আল্লাহর লানত পড়ছে এই মাইয়ার উপর। এই মাইয়া না আছে এদিকে না আছে ওদিকে!

–“এখন কি করমু খালাম্মা?

–“ওই মাইয়া কি করতাছে?

–“বৃষ্টিতে ভিজতাছে!

–“ভিজুক! আল্লাহর গ’জব পড়ুক ওর উপর!
আয়েরা আবারো চিৎকার করে উঠলো।

বাইরে তুমুল বৃষ্টি! তাহেরা বেগম আর অন্নপূর্ণার মা ঘরের দাওয়ায় বসে আছে। অন্নপূর্ণা একপাশে চুপটি করে ঘুমাচ্ছে। তাহেমা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে করুণ স্বরে বললেন, –“আহ বাইরে কি বৃষ্টি গো!

–“ঠিক কইছো দিদি, অনেক বৃষ্টি!

–“বাহার জমিদার সাহেব গো বাড়িতে গেছে, ভালা করছে।

–“ঠিক কইছো দিদি, এহন জমিদার ছাড়া আর কেউ পারবো না তারে বাঁ’চাইতে। নুহাশ ফিরছে!

–“না এখনো আহে নাই, ওর বাপজান কি কইলো জানো?

–“কি কইছে?

–“গায়ের লোক নাকি আগু’ন হাতে বাহার গো বাড়ির দিকে গেছে। এই বাড়ি নাকি পু’ড়াইয়া ফেলবো।

–“হায় ভগবান! কি কও কি এসব!

–“যা কইতাছি সত্যি কইতাছি। ভাবো বাহার যদি এখন বাড়িতে থাকতো তার কি হাল করতো?

–“এই প’শু গুলা তো বাহারকেও সাথে কইরা..

বাকি কথা আর বললেন না অন্নপূর্ণার মা। তাহেরা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বলে উঠলেন, –“আল্লাহ বাচাইছে মাইয়াটারে।

–“ঠিক কইছো দিদি! ঠিক কইছো!

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here