#নূরবাহার ( ৬ )
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
–“আমার নাতনী’টা মইরা গেলো গো, মই’রা গেলো! কি ভাগ্য নিয়া জন্মাইলো ওই, একটু সুখ কি নাই কপালে ওর। কি দোষটা করছে ওই, এই ছোট একটা মাইয়া কার কি ক্ষ’তি করলো। মা! মা তুই আমারে উ’ঠাইয়া নিলি না ক্যান? ক্যান আমারে এতো কষ্ট দিতাছোস কেন?…. এমনই বিলাপ করে কাঁদছে দিদিমা! তার এই ছোট্ট কুঁড়ে ঘরের মানুষ ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে তাহেরা বেগম, অন্নপূর্ণার মা শান্ত করছে দিদিমা কে। কোলের কাছে বাহার কে ঝাটপে জড়িয়ে আছেন তিনি। নুহাশ একবার ভিতরে আসছে আবার বাইরে যাচ্ছে। জমিদার সাহেব এসেছেন কিছুক্ষণ আগেই। উঠোনে একটা চেয়ারে নিরব হয়ে বসে আছেন। তাকে ঘিরে গাঁয়ের আর পাঁচ টা মানুষ। ঘটনা যা ঘটেছে ছড়িয়ে যেতে সময় নেই নি। বিহারিনীর বাবা নির্মল বাবু মেয়েকে ইতোমধ্যে মায়ের সাথে নিজের দাদার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। রহিম মিয়া সবার হাতে চায়ের কাপ পৌঁছে দিচ্ছে। মুনসী ঘটক বেশ কিছুক্ষণ পর মুখ খুললেন, –“ঘটনা কি ঘটছে আমরা সকলেই জানি, কিন্তু বিচার নেবার আগে একটু বিবেচনা করবার দরকার নাহ!
–“কিসের বিবেচনা মুনসী ঘটক!
গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করলেন জমিদার সাহেব। মুনসী ঘটক কিছুটা কাশলেন। নির্মল বাবু বলতে শুরু করলেন, –“আমার মাইয়াটা অসুস্থ জমিদার সাহেব! মাথাটা খারাপ হইয়া গেছে, তাই এমন ভুলভাল কাজ করছে?
–“অসুস্থতার কথা বলে মেয়েকে শাস্তির হাত থেকে বাঁচাতে চান। ওই বাচ্চাটার হাল দেখেছেন। কিভাবে হাত টা পু’ড়ে গেছে দেখেছেন। আর সবচেয়ে বড় কথা ওর মনের কি হাল? এত টুকু ছোট বয়সে যেই ভয় সে পেয়েছে তা কি আপনি জানেন? নিজের চোখে দাঁড়িয়েই তো সবটা দেখেছেন? কি দেখেন নি!
–“জমিদার সাহেব আমি মানতাছি সব দোষ আমাগো। আমি মাইয়াটার সব খরচ দিতেও রাজি!
গায়ের আরেক মুরব্বি মাওলানা সাহেব বলে উঠলেন, –“আপনার কথাটাও আমরা বুঝতে পারতাছি। কিন্তু ঘটনা এই গায়ে ছড়াইয়া অন্য গায়েও কিন্তু চলে গেছে!
মুনসী ঘটক বলে উঠল, –“নির্মল বাবু কিন্তু এই গাঁয়ের একজন গণ্য মান্য লোক, যাই হইছে হঠাৎ কইরাই হইছে। আমার মনে হয় তার ব্যাপারেও একটা চিন্তা ভাবনা করার দরকার। তিনি যখন কইতাছে মাইয়া অসুস্থ, তাইলে অসুস্থ বললাই এমন করছে!
–“তাহলে আমাকে কিছু করতে বারণ করছেন আপনারা!
পাঁচজনের মাঝে সবাই চুপ হয়ে গেলেন। নির্মল বাবু হাত জোড় করে বললেন, –“রেহাই দেন বাপু! আপনাগো সকলের লগে আমার সম্পর্ক অনেক ভালা। আমার বাপ – ঠাকুররা এই গাঁয়ের লইগা কম কিছু করে নাই। তাদের অজুহাতে না হয় এইবারের লইগা…
জমিদার সাহেব মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। ঈশ্বর দাস বলে উঠলেন, –“নির্মল বাবুর কথা ঠিক জমিদার সাহেব! তারা আমাদের জন্য কম কিছু কিন্তু করে নাই।
–“আপনারা কেউ বাচ্চা মেয়েটার কথা ভাবছেন না তাহলে?
মুনসী ঘটক বলে উঠলেন , –“ওই মাইয়ারে নিয়া আবার কি ভাবার দরকার আছে জমিদার সাহেব! ওই মাইয়ার লইগা গ্রামে অমঙ্গল হইতাছে কিন্তু নির্মল বাবুর লইগা তো তেমন কিছু আর..
জমিদার সাহেব চোখ রাঙালেন। নির্মল বাবু বিনয়ের সঙ্গে বললেন, –“আমার মান সম্মানের কথা একবার চিন্তা করেন জমিদার সাব। আমি তো কইলাম মাইয়ার সব খরচ আমার। পো’ড়া জায়গা যতদিন না শুকায় ততোদিন এই মাইয়ারে আমি দেখমু! শুধু একটু দয়া করেন জমিদার সাহেব!
জমিদার সাহেব মত না দিলেও অমত দিলেন না। কিন্তু গ্রামের গণ্য মান্য মানুষ গুলো ঠিকই নির্মল বাবুর হয়ে কথা বলছে। খারাপ লাগছে বাচ্চা মেয়ে বাহারের জন্য।তবে কি বাপ মায়ের মতো তার কপালেও ন্যায় বিচার জুটল না। ডাক্তার বাবু ভেতর থেকে বের হয়েও জমিদার সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। জমিদার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, –“কেমন দেখলেন?
–“পো’ড়া জায়গায় ঔষধ দিয়া দিছি জমিদার সাহেব। খুব ভয় পাবার কারণে জ্ঞান এখনো আসে নাই। মনে হচ্ছে সকালের মাঝে জ্ঞান চলে আসবে। বেশি ভাবনা চিন্তার কিছু নাই।
–“দেখলেন তো আমি কইছিলাম এতো ভাবনা চিন্তার কিছু নাই! মাইয়া মানুষ গো হাত ওই রানতে বারতে গেলে একটু পুইড়া যায়। এই নিয়া এতো ভাবনা চিন্তার কিছু নাই!
ডাক্তার বাবু হেসে বললেন, –“তা ঠিক! কিন্তু নিজে পু’ড়ে যাওয়া একরকম আর কেউ পুড়ি’য়ে মার’,তে চাওয়ার ব্যাপারটা আলাদা। দুটোকে এক করবেন না।
মুনসী ঘটক কিছু বলতে গিয়েও চুপ হয়ে গেলেন জমিদার সাহেবের চোখ রাঙানিতে। জমিদার সাহেব ও কিছু বলতে গিয়ে বললেন না। এদের বিবেক বুদ্ধি বলতে আর কিছু নাই বলেও লাভ নাই। তিনি কিছু না বলে ঘরের দিকে অগ্রসর হলেন। নির্মল বাবু বিনয়ী স্বরে বললেন, –“ডাক্তার বাবু খরচ কতো হইলো?
–“তা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না, আপনি বরং মেয়েটার জন্য একটু দুধ ডিমের ব্যবস্থা করেন। এদের অবস্থা তো সবই জানেন। আর হ্যাঁ কিছু ঔষধপত্রের নাম লিখে দিচ্ছি, শহরে কাউকে পাঠিয়ে নিয়ে আসেন।
নির্মল বাবু মাথা দুলালেন। ডাক্তার বাবু হন হন করে হেঁটে চলে গেলেন। মনে মনে বলতে লাগলেন, –“এদের কেউর মাঝেই মনুষ্যত্ব বেঁচে নেই। ভগবান! এদের কু বুদ্ধি থেকে বাচ্চা মেয়েটাকে রক্ষা করো!
–“বুড়ি মা! বুড়ি মা! বাহারের খবর কি?
বলেই জমিদার ঘরের ভেতর ঢুকলেন। তাহেরা বেগম আর অন্নপূর্ণার মা ঘোমটা টেনে একটু দূরে সরে গেলেন। নুহাশ সাথে সাথে হন হন করে ভেতরে ঢুকল। বুড়ি মা আঁচলে চোখ মুছে কইলো, –“নিজের চোখেই দেখেন জমিদার সাহেব, আমার নাতনীটার কি অবস্থা!
জমিদার সাহেব তাকিয়ে দেখলেন কোলের মাঝে বাহার চুপটি করে শুয়ে আছে। হারিকেনের নিবু নিবু আলোয় এই ছোট্ট মেয়েটার মুখটানি অস্পষ্ট! জমিদার সাহেব বেশিক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রইলেন না। গাঁয়ের জমিদার হওয়া সত্ত্বেও আজ আজ প্রথমবারের নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে তার। কিছু করতে পারছে না এই ছোট্ট মেয়েটার জন্য কিছু না। নুহাশ বড় বড় শ্বাস নিতে নিতে কইলো, –“আপনে ওই বিহারিনী রে কিছু করলেন না ক্যান জমিদার সাহেব, বিহারিনী তো পালাইয়া গো!
জমিদার সাহেব জবাব দিলেন না। বেরিয়ে গেলেন। দিদিমা আবারো কান্নায় ভেঙে পড়লেন। এভাবেই তার উপর অন্যায় হওয়া সত্ত্বেও ন্যায় পেলো না বাহার। দুঃখিনী সে এখন না, আগেও ছিল। জন্মের পর পরই তার ভাগ্যে যেন দুঃখিনী লেখাটা পুরোপুরি ভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে গেছে। এই দুঃখিনী মেয়েটার এর পর কি আর সুখের দেখা পাবো কখনো। না কখনো পাবে না! গাঁয়ের একটি মাত্র লোক তার বিপদে তার পাশে থাকবে না। একা একাই তাকে লড়াই করে যেতে হবে। বেঁচে থাকার জন্য লড়াই! রুপের জন্য সব মেয়েদের ভাগ্য খুলে না, কিছু কিছু মেয়ের ভাগ্যটাই দুঃখে ভরে যায় রুপের জন্য। বাহারের ছেলেবেলার এই সময়েও বাহার বুঝতে পারল না তার রুপ তাকে ধ্বংস করে দেবে। এই ধ্বংসের চিহ্ন তার হাতের পোড়া দাগ থেকেই শুরু। এই দাগ আজীবন থেকে যাবে। প্রতি মুহূর্তে তাকে মনে করিয়ে দেবে তার ছেলেবেলার সেই নিশং’স পরিস্থিতির কথা, এমন এক ভয়ংক’র কথা যা তার মনে দাগ কেটে গেছে। দিদিমা কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়ে দেন এই দুঃখিনীর কথা ভেবেই। এই ঘটনার পর বাহারের চাঞ্চল্যতা যেন কয়েকদিন’ই নিশ্চুপ ছিল। এরপর আবারো সেই তার ছোটাছুটি। গাছে গাছে উঠে চড়া, দিনের দীর্ঘ সময় ধরে পুকুরে সাঁতার কাটা যেন তার নিত্যদিনের কাজ হয়ে বেড়াতে লাগল। তার সঙ্গী হয়ে থাকল নুহাশ আর অন্নপূর্ণা! কিছুদিনের জন্য দিদিমার বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া অন্নপূর্ণা এখানে এসে এসব কথা শুনতে চমকে উঠল। বাহারের পোড়া হাতের জায়গায় চুমু খেয়ে বলল, –“খুব লেখেছিল না তোর বাহার!
–“হুঁ খুবব!
–“থাক কাদিস না, আমি এখন থেকে সবসময় থাকমু তোর লগে।
–“আবার দিদিমার বাড়িতে যাবি না তো।
–“না না কখনো না!
মায়াবিনী বাহার হেসে উঠলো! তার হাসির আওয়াজ দূরের ওই নুহাশও শুনতে পেলো। সে মনে মনে ঠিক করে নিল, “বাহার কে আর কখনো সে একলা ছাড়বে না, কখনো না!”
#চলবে….