নূরবাহার পর্ব -০৭

#নূরবাহার ( ৭ )
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )

নুহাশ পুকুরে নেমে সাঁতার কাটছে। তার পাশেই বসা অন্নপূর্ণা আর বাহার। পা দুলিয়ে ঘাটে বসে পানিতে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখছে দুজন। অন্নপূর্ণা শাড়ির আঁচল থেকে কাঁচা তেতুল বের করে বাহারের দিকে এগিয়ে বলল, –“নে বাহার!

–“কাঁচা তেতুল! কে দিল তোরে? নুহাশ!

–“নুহাশ দিলে কি আমারে একা দিত নাকি, আমার সাথে সাথে তো তোরেও দিত।

–“তইলে? তুই পাড়ছিস?

–“না মানিক দাদা দিছে?

বাহার হেসে কাঁচা তেঁতুল কামড় বসাল। অন্নপূর্ণাও হেসে তেঁতুলে কামড় বসাল। সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে দিল। খুব টক তো! নুহাশ তাদের দিকে ফিরে পুকুরে ডু’ব দিল! বেশ অনেকক্ষণ পর বের হয়ে কইলো, –“দেখলি, আমি অনেকক্ষন পানিতে ডু’ব মাইরা থাকতে পারি কিন্তু!

বাহার হেসে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, –“তোর চেয়ে বেশি আমি পারি!

–“জানিস মানিক দাদা আরো অনেকক্ষণ ডুব দিয়া থাকতে পারে।

নুহাশ মুখ ভেংচি কেটে বলল,–“তোর মানিক দাদার ভালা মানুষী অনেক শুনছি এখন চুপ থাক!

বাহার হেসে উঠলো। অন্নপূর্ণা মুখ ভার করে রইল। সন্ধ্যা নামবার আগেই নুহাশ পুকুর ছেড়ে উঠে এলো। ঘাট ছেড়ে উঠে এলো বাহার আর অন্নপূর্ণা। তিনসঙ্গী পথ বেরিয়ে যাচ্ছে একসাথে। নুহাশের বাড়ির পথ উল্টোদিকে হওয়ায় আলাদা হয়ে গেল সে। অন্য পথ দিয়ে যাচ্ছে অন্নপূর্ণা আর বাহার। দুইসঙ্গী হাতে হাত রেখে লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে। অন্নপূর্ণার বাড়ির কাছে আসতেই অন্নপূর্ণা হাত ছেড়ে বিদায় নিল। বাহার এবার জলদি পা বাড়াল। কিন্তু কিছুদূর যেতেই সামনে মানিক দাদা কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দাঁড়িয়ে গেল। হেসে কইলো, –“আরে মানিক দাদা যে! কেমন আছো?

–“ভালো ! তুমি কেমন আছো বাহার।

–“খুব ভালা আছি।

–“শুনলাম তোমার হাত নাকি পু’ড়ে গেছে বাহার !

বাহার হাতখানি বের করিয়ে দেখাল। মানিক দাদার হৃৎস্পন্দন ধক ধক করে বাড়ছে। খুব সাহস করে হাত বাড়িয়ে দিল সে। এই তরুণের মনে বাহারের জন্য কম ভালোবাসা আছে কি না জানা নেই। তবে কিছু একটা দুর্বলতা তো আছেই। বাহার অভ্যাস মতো হেসে উঠলো।

–“মানিক দাদা খুব ভয় পাইছো নাকি, খুব পু’ড়ে নাই তো। দেহো না এখন ভালা হয়ে গেছে।

মানিক দাদা হেসে উঠলো। বাহারের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, –“তুমি তো খুব সাহসী বাহার!

–“হ খুব সাহসী আমি। তোমার মতো ভিতু না। তুমি তো ভুতের ভয়ে রাতে ঘর থেকেই বার হও না।

–“তোমাকে কে বলল অন্নপূর্ণা!

–“হুঁ! ওই একদিন নাকি… ( বলার আগেই জোরে জোরে হাসতে লাগলো )

–“হ্যাঁ হ্যাঁ ভুতের ভয়ে পুকুর ডু’ব দিয়েছিলাম। সেদিন কিন্তু সত্যি সত্যি ভূত ছিল!

কথার ছলে বাহারের হাত টা ধরে পু’ড়ে যাওয়া জায়গা টা নিখুঁত ভাবে দেখতে লাগল। বাহার মিষ্টি স্বরে বলল, –“দাদা, তুমি নাকি বড় ডাক্তার হবা!

–“হুঁ, কেন?

–“তোমার তো অনেক বুদ্ধি, অনেক পড় তুমি। আমারে একটু বুদ্ধি দিতে পারবা।

বাহারের হাত ছেড়ে দিয়ে হাসতে লাগলো মানিক দাদা! মানিক দাদা অন্নপূর্ণার মামাতো ভাই। আর্থিক সচ্ছলতার বেশ ভালো। মানিক দাদার বাবা নেই। একমাত্র মায়ের এই একটি ছেলে। মায়ের শখ চোখের মানিক কে বড় ডাক্তার বানাবে। মায়ের সেই স্বপ্ন পূরণে মানিক দাদাও নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিচ্ছে। অন্নপূর্ণার দাদা হওয়াতে বাহারের সাথে তার সম্পর্ক সহজ। কিন্তু এই বাহারের প্রতি এক ধরণের দুর্বলতা অনুভব করে সে। কি সেই দুর্বলতা এই নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় না। একটা লক্ষ্য যে স্থির হয়েই আছে। বিধবা মায়ের আশা পূরণ করতে হবে। কিন্তু এই গাঁয়ে এলে একবার বাহার কে না দেখতে পারলে আফসোসে তার বুকের ভেতর যে যন্ত্রণার সৃষ্টি হয় তাকে এড়িয়ে চলা যে তার পক্ষে সম্ভব নয়।

–“একটু বুদ্ধি নিয়ে কি করবে বাহার, তোমার বুদ্ধি কি কম নাকি?

–“মানিক দাদা, আমি জানি, যারা অনেক অনেক বই পড়ে তাগো বুদ্ধি অনেক। আর তোমার তো নাকি অনেক অনেক বই।

–“তাহলে আমি তোমাকে একটা বই দিয়ে যাবো। তুমি সেটা পড়ে বুদ্ধি বারিও, কেমন!

বাহার হেসে উঠলো। স্নিগ্ধ গোধূলি মূহুর্তে আর্ধ ডোবা সূর্যের কিঞ্চিত আলোয় এই রূপবতীর হাসির মায়া যে কি মারাত্মক হতে পারে মানিক তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতো না। দিদিমার মানিক দাদা কে ভারী পছন্দ বলে তাকে বাড়িতে যাবার আমন্ত্রণ জানালো বাহার। অন্যমনস্ক মানিক দাদা যেন বশ হয়ে গেল। পা বাড়িয়ে চলতে লাগল বাহারের সাথে সাথে। আগে আগে বাহার লাফিয়ে চলে যাচ্ছে। মানিক দাদা আসছে পিছু পিছু। দূর প্রান্তে একা দাঁড়িয়ে থাকা নুহাশের যেন একটু খারাপ’ই লাগল। ভেজা জামা কাপড় ছেড়ে ছুটে এসেছিল সে বাহারের কাছে। কিন্তু সে কি জানত, এরই মাঝে বাহারের একজন সঙ্গী জুটে গেছে। হলদে রঙের পাঞ্জাবি সাথে সাদা ধুতি পড়া এক তরুণ! মানিক দাদা কে অজানা ছিল না নুহাশের। বাহার যেন তাকে একটু বেশিই ভক্তি করে,‌বিষয়টা তার ভারী অপছন্দ! বন্ধুত্ব কখনো ভাগাভাগি হয় না। আর নুহাশ কখনো চায় না তার বন্ধুত্ব ভাগাভাগি হোক।

মানিক দাদা কে দেখে দিদিমা বেশ খুশি হলেন। নাড়কেলের নাড়ু, ঠাকুরের প্রসাদ এগিয়ে দিল মানিক দাদার পাতে। পাশে পা দুলিয়ে বসে আছে বাহার। আঁচলে থাকা আর্ধেক তেঁতুল টা বের করে খেতে লাগল সে। মানিক দাদা একটু একটু পরই সেদিকে চোখ ফিরাতে লাগল। দিদিমা বলে উঠলেন, –“এই বুড়ি দিদিমার কথা কি একটু মনে পড়ে না তোমাগো?

–“আরে দিদিমা কি বলেন? আপনাকে কি ভুলতে পারি। এই নাড়ুর লোভে যে বার বার আসতে হয়।

–“মায়ের খবর কি তোমার?

–“ভালো দিদিমা, আপনাদের আশীর্বাদে ভালো আছে।

–“মায়ের স্বপ্নটা রাহো বাছা। বেচারী একা একা বড় করল তোমারে।

–“তা কি আর অজানা দিদিমা! কিন্তু এইটা কি ঠিক হইলো দিদিমা। এতো বড় একটা কান্ড হয়ে গেল অথচ কেউ কিছু বলল না। এভাবে এতো বড় অবিচার!

–“ওই মুখপুরীর পোড়া কপাল বাঁছা! ভগবান দিছে এমন কপাল এহন কি করমু।

–“তাই বলে এভাবে!

–“থাক, ওই নিইয়া আর কথা বাড়াইয়ো না। তোমার মায়েরে কইয়ো আমার কথা। মরা’র আগে একবার যেন তার দর্শন পাই।

বাহার মুখ ফুটে বলে উঠলো, –“ওই কি দিদিমা, তুই মর’বি কেন?

–“কেন রে? তুই কি আমারে অমর কইরা রাখবি। বাচাইয়া রাইখা কষ্ট দিবি।

–“মর’লে বুঝি তোমার সব কষ্ট চইলা যাইবো।

–“ম’রলে আমি বাইচা যামু বুঝলি!
বাহার হা হয়ে তাকিয়ে রইল। মানিক দাদা বলে উঠল, –“রাখো তোমাদের ঝগড়া, আমারে কি আরো দুইটা নাড়ু দিবা দিদিমা।

–“সবুর করো, আনতাছি!

বলেই দিদিমা উঠে দাঁড়ালেন। বাহার নেমে চলে গেল ঘরের ভেতর। মানিক একা বসে রাতের আকাশের বাঁকা চাঁদ দেখছে। তার সামনে নিবু নিবু জ্বলছে কুপির আলো, বাতাসের বাঁধ মানতে না পেরে হুট করেই নিভে গেল সেটা।

মানিক দাদা কে এতো রাইতে বাহারের বাড়ি থেইকা বের হতে দেখল মুনসী ঘটক! কতো বড় সর্বনাশে কান্ড! ছিঃ ছিঃ পড়ে গেল গাঁয়ের মধ্যে। তাল কে তিল করতে সময় লাগলো না কারো। কথাটা শেষ অবদি জমিদারের কানেও গেল। দুদিন পর পর গাঁয়ের সকলে বাহারের‌ পিছনে পড়ে থাকে, কোন কি কাজকর্ম নাই তাগো। জমিদার মারাত্মক বিরক্ত হলো। কারো কথাই কানে নিলেন না তিনি। যে যা বলার বলে গেল,‌জমিদার শুধু তাদের কথা শুনেই গেলেন।

শরতের আগমনের সাথে সাথে মায়ের আগমনও চলে এলো। পুরো গায়ের মানুষ জুড়ে পুজোর তোড়জোড়। মায়ের মন্ডপ সাজানো , মূতি বানানো সেও যেন এক হুলস্থুল কান্ড। ছুটতে ছুটতে বাড়িতে এসে বাহার জোর গলায় বলতে লাগলো, –“দিদিমা ও দিদিমা!

–“কি রে মুখপুরী? চেচাস কেন এমনে?

–“তোর মারে সাজানো হইতাছে, তুই দেখতে যাবি না।

–“যামু রে যামু!

–“কয়েকদিন পর তোর মায়ের চোখ আঁকা হইবো। তুই কিন্তু তহন আমারে নিইয়া যাবি!

–“তোর ওহানে কাজ কি রে অলক্ষ্মী! দরকার নাই কোনখানে যাবার।

মুখ গুচিয়ে ফেলল বাহার। দিদিমা কথা না বলে ভাড়ার ঘরে ঢুকে গেলেন। পুরোটা দিন বাহার পিছু পিছু ঘুরছে। যে করেই হোক, দিদিমার সাথে পুজোর মন্ডপে যাবেই সে। দিদিমা কে রাজী করতাই হবে। রাতে দিদিমা যখন ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিচ্ছিলো, বাহার মুখভর্তি ভাত নিয়ে ওই কথাই বলতে লাগলো। দিদিমা পাত্তা দিল না। হার মেনে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে পড়ল বাহার। দিদিমা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে রাখলেন। মুখ তুলে তাকাল সে। কুপির নিস্তব্ধ আলোয় বাহারের মুখখানি দেখে প্রাণ জুড়াল দিদিমার। থিতুনিতে হাত রেখে চুমু খেয়ে কইলো, –“আমার মা যে তুই রে মা! আবার কোন মারে দেখতে যামু আমি!

–“অ্যা, আমারে অলক্ষ্মী কস, তুই যে বড় অলক্ষ্মী! কি কস এসব!

–“মা রে, আমার যে আর বেশিদিন নাই। আমি চইলা গেলে এই মুখপুরী রে তুই দেইখা রাখিস।

–“দিদিমা তুই কি কস এসব! কিছুই তো বুঝতাছি না।

–“আমার মা সব বুঝে রে সব!

বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন দিদিমা। বাহার অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কেন এই কান্না, কেন এই দুঃখ কিছু্ই জানে না সে। পরের দিনই ভারী অসুখে পড়ল দিদিমা। বিছানা ছেড়ে উঠবার শক্তি নাই তার শরীলে। বাহার দিন রাত পড়ে রইল অসুস্থ দিদিমার পাশে!

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here