পরীজান পর্ব -৪২+৪৩+৪৪

#পরীজান
#পর্ব ৪৩
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌

নিস্তব্ধতা গ্রাস করছে পুরো জমিদার বাড়িতে। কোথাও কোন শব্দ নেই। ঝিঁ ঝিঁ পোকারাও মুখ বন্ধ করে রেখেছে। তারাও বুঝেছে এই পুরোনো আমলের বাড়িটি একটা মৃ*ত্যুপুরি। এই বুঝি কোন শব্দ হলো! এই বুঝি লা*শ পড়লো। নতুন খেলা শুরু হয়েছে যেন! বাঁচা ম*রার খেলায় জয়ী হবে কে? তা বলা বাহুল্য।
পরীর দিকে তাকিয়ে আছে শায়ের। পালককে কেন মেরেছে তার উত্তর সে দেয়নি এখনও। দিবে কিনা তাও শায়েরের ভাবান্তর দেখে বোঝা যাচ্ছে না। সে শুধু পরীকে দেখছে। প্রিয়তমার সৌন্দর্যে ঝলসে যাচ্ছে হৃদয়,চোখ জ্বলছে তবুও মন ভরছে না। পরীর নতুন রূপের দগ্ধ হচ্ছে সে। চোখ থেকে অশ্রু ঝরছে পরীর। সে পারছে না স্বামীর কাছে কঠোর হতে। এতো কিছু জানার পরেও ওর মনে হচ্ছে কোথাও একটা কিন্ত রয়ে গেছে। যা পরী এখনও জানে না। নওশাদ যে সম্পূর্ণ সত্য বলছে তার তো কোন প্রমাণ নেই। শুধুমাত্র নওশাদের কথার উপর ভিক্তি করে সে শায়ের কে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে? এটা হতে পারে না। পরী অশ্রুসিক্ত আঁখি মেলে শায়েরের দিকে তাকালো। কথার প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,’আমাকে ভালোবাসবেন মালি সাহেব?’

চমকে তাকালো শায়ের। পরী আবার তার মত বদলে ফেলেছে। খানিকটা দূরে দাঁড়ানো পরী। শাড়ির আঁচল টা বুক থেকে নামিয়ে পরী শায়েরের দিকে এগোতে লাগল,’আমার শরীরে অনেক ক্ষত মালি সাহেব। আপনার ভালোবাসা দিয়ে সব সারিয়ে দিন।
আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। আর সহ্য করতে পারছি না।’

দড়ি দিয়ে বাঁধার কারণে পেটে লম্বা দাগ হয়ে আছে। উ*ন্মুক্ত সেই স্থান নীলচে বর্ণ ধারণ করেছে। ফর্সা শরীরে তা জ্বলজ্বল করছে। এক পলক সেদিকে তাকিয়ে পরীর মুখ মণ্ডলে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে শায়ের। পেটের ক্ষতের থেকে পরীর চোখের ক্ষত আরো গভীর। যা সারানোর ক্ষমতা ওর নেই। পরীর মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াল শায়ের। শাড়ির আঁচলটা ঠিক করে দিয়ে পরীর চোখে চোখ রাখলো,’আপনি আমাকে ভালোবাসেন?’

হঠাৎই পরী শায়েরের বুকে সামুদ্রিক ঢেউ এর মতো আছড়ে পড়লো। শায়ের নিজেও কালবিলম্ব না করে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তার পরীজানকে। অল্প সময় আলাদা ছিলো দুজনে অথচ মনে হচ্ছে বহুকাল আলাদা ছিলো দুজনে। পরী নিজেও সমস্ত শক্তি দিয়ে ধরেছে শায়ের কে। ওরা দুজনেই খুব ভাল করে জানে ওরা একে অপরের থেকে দূরে থাকতে পারবে না কখনোই। শায়ের যত অন্যায় করুক না কেন পরী ওকে ছাড়তে পারবে না।
-‘আপনি কি পালককে সত্যিই হ*ত্যা করেছেন?’

শায়েরের বুকে মুখ গুঁজে বলে উঠল পরী। শায়ের দেরি না করেই জবাব দিলো,’আপনাকে মিথ্যা বলার সাহস আমার নেই পরীজান। হ্যা আমিই পালককে মে*রেছি।’

শায়েরের বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে পরী। চোখের জল মুছে বলে,’কেন মে*রেছিলেন তাকে? সে কি ক্ষতি করেছিল আপনার?’
-‘আপনার আমার মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি আমি পছন্দ করি না। তাই পালককে মরতে হয়েছে। শুধু তাই নয় শেখরকেও রাখি নি। ভবিষ্যতেও কাউকে আসতে দেবো না।’
বেশ শান্ত স্বরেই জবাব দেয় শায়ের। এতে কিছুটা রেগে গিয়ে পরী বলে,’এজন্য আপনি পালককে মারবেন কেন? ভালোবাসা চাওয়া কি অপরাধ? আপনিও তো বলেছিলেন মেয়েরা ফুলের মতো। তাদের শুধু ভালোবাসার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। লড়াই করার জন্য নয়। তাহলে আপনি কেন মারলেন তাকে?’

-‘আমি তার সাথে লড়াই করিনি। তাকে তার প্রাপ্যটুকু দিয়েছি। ভালোবাসা নিয়ে নোংরা খেলা আমি পছন্দ করি না।’
-‘কি এমন খারাপ দেখলেন তার মাঝে আপনি?’

-‘আপনার আমার মাঝে তৃতীয় ব্যক্তির আগমন আমি হতে দিবো না। আপনি ওই প্রসঙ্গ বাদ দিন। আমি আর এই বিষয়ে কোন কথা বলবো না।’

পরী মুখ ফিরিয়ে নিলো। বিতৃষ্ণায় ভরে যাচ্ছে মনটা।
সে আর শায়েরের দিকে তাকালো না। তখনই শায়ের কক্ষ ত্যাগ করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ফিরে এলো। হাতে করে সে একটা মলমের কৌটো নিয়ে এসেছে। কাছে এসে পরীর হাত ধরে বলে,’এদিকে আসুন মলম লাগিয়ে দিচ্ছি।’

যত রাগ শায়েরের উপর পরী দেখাক না কেন দিন শেষে শায়েরের স্পর্শ পেলে পরীর রাগ মিলিয়ে যায় নিমিষেই। এই পুরুষটিকে সে ফেরাতে পারে না কিছুতেই। পরীকে পালঙ্কের উপর বসিয়ে আঁচল সরিয়ে দেয়। শক্ত করে বাঁধার কারণে দাগটা হয়েছে। শায়ের হাত বুলায় নীলচে দাগে। তারপর মলমটা লাগাতে থাকে,’আপনাকে বেঁধেছিলো কে? নওশাদ??’

-‘নাহ কবির।’
-‘ওকে মে*রে ভালো করেছেন। নাহলে ওকে আমিই মে*রে দিতাম।’
-‘কেন?’
-‘আপনাকে ছুঁয়েছে সে। ওর বেঁচে থাকার অধিকার নেই।’
মৃদু হাসে পরী,’আমাকে ছুঁয়েছে বলে আপনি কবিরকে মা*রতে চান। আর কবির আমার আপাকে ছুঁয়েছে বলে আমি তাকে মে*রে দিয়েছি। আপনার আমার মাঝে অনেক তফাত তাই না?’

-‘আপনার আমার মাঝে তফাত আছে পরীজান। আপনি পবিত্র একটা ফুল। আর আমি ভুল,ভুল মানুষদের প্রিয় থাকতে নেই। তাই তো আমার প্রিয় আমার থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।’

-‘বলুন না পালক কি এমন পাপ করেছিল যে আপনি তাকে এই শাস্তি দিলেন?’

শায়ের দাঁড়িয়ে গেল,’বারবার একই প্রশ্ন কেন করছেন? এই প্রসঙ্গ বাদ দিন।’
-‘তাহলে বের হয়ে যান এখান থেকে।’

শায়েরের উত্তরের আশা না করে ওর হাত ধরে টেনে ঘর থেকে বের করে দিয়ে দরজা আটকে দিলো পরী।
দরজা ঘেষে মেঝেতে বসে পড়ল পরী। হাঁটুর উপর মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে নিলো। পানিতে ভিজে উঠল ঘন পাপড়ি গুলো। পরী বলে উঠল,’আপনার সাথে আর যেন কখনও না দেখা হয় মালি সাহেব।’

-‘আপনার জন্য আর কেউ আসুক বা না আসুক আমি আসব পরীজান। আমার ভালোবাসা একটুও কমবে না পরীজান।’

সারারাত ওভাবেই কেটে গেলো দুজনের। পরী দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি। সকাল হতেই সে ঘর থেকে বের হয়। দরজার পাশেই শায়ের কে হেলান দিয়ে বসে থাকতে দেখে। চোখ বন্ধ শায়েরের, বোঝাই যাচ্ছে সে ঘুমাচ্ছে। পরী ওখান থেকে চলে এলো। অন্দরের উঠোনে এসে পুরো বাড়িতে চোখ বুলালো।
পরীর মনে পড়ল সোনালীর কথা। কতো কানামাছি খেলেছে সে বোনের সাথে। সোনালীর চোখ বেঁধে পরী চারপাশে ছোটাছুটি করতো। সাথে রুপালিও এসে যোগ দিতো। তিন বোন মিলে মাতিয়ে রাখতো জমিদার বাড়ি। কিন্ত আজ সেই বাড়িকে মৃত্যুপুরি মনে হচ্ছে। সময়ের ব্যবধানে কতকিছু বদলে গেলো!
পরী রুপালির ঘরে গেল। পিকুল ঘুমাচ্ছে রুপালি বসে আছে। পরী ঢুকতেই রুপালি সোজা হয়ে বসে। পরী কিছুক্ষণ রুপালিকে দেখে বলে,’আব্বা কেন আমাকে মারতে চায় তা আমি পুরোপুরি জানি না আপা। তুমি কি জানো?’

-‘হুম।’
-‘আর কিছু না লুকিয়ে সব বলো আমাকে।’
-‘কাছে আয়,বস এখানে!’

পরী বসলো রুপালির পাশে।
-‘বড় আপা প্রাণবন্ত ছিলো জানিস পরী। সে না বলা কথা বুঝে যেতো। আম্মার মনের কথা সবচেয়ে বেশি বুঝতো বড় আপা। আপা যখন ছোট তখন সে দেখতো কাকা আম্মার সাথে খারাপ আচরণ করে। কিন্ত আব্বা কিছুই বলে না। সব জেনেও কেন আব্বা কিছু বলে না এটা আপার ভালো লাগেনি। সবসময় এসব চিন্তা করতো আপা। তবে তার উত্তর পেতো না। রাখালের সাথে প্রেম করার পর ওর প্রশ্ন গুলো চাপা পড়ে যায়। কিন্ত আবার সেই প্রশ্ন সামনে আসে যেদিন কাকা আম্মাকে বৈঠকে একা পেয়ে সুযোগ নেয়। ওইদিন আপা আম্মাকে বাঁচায়। সেদিন আব্বার সাথে আপার অনেক ঝগড়া হয়। যার ফল ভোগ করে আম্মা। আব্বা এখনও আম্মার গায়ে হাত তোলে। এজন্যই আম্মার শরীর সবসময় অসুস্থ থাকে। আমি এখানে না থাকলেও জানি,যে পালক সব জানতে পেরেছিল। আম্মার শরীরের দাগ গুলো দেখে পালকের বুজতে বাকি থাকে না এসব কিছু আব্বার কাজ। পরী আমাদের আম্মার ঘরে ঢোকা নিষেধের একটাই কারণ ছিলো তা হলো আমরা যেন এটা জানতে না পারি আব্বা একটা নর*পিশাচ। আমরা কোন ভুল করলে আব্বা আম্মাকে প্রচুর মারতো। ছোট আম্মাও কম মার খায়নি। জুম্মান কে আব্বা সাথে করে নিয়ে গেছে পরী। ওকেও আব্বা নিজের মতো তৈরি করবেন। তার প্রতিবাদ করতে গিয়ে ছোট আম্মা এখন নিজেই ঘরে বসে আছেন।’

-‘কি হয়েছে ছোট আম্মার?’

-‘জুম্মানকে সে খারাপ হতে দিবে না। এই প্রতিবাদই তার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আব্বা আঘাতে রক্তাক্ত করেছে তাকে। আম্মা এখন তার কাছেই আছেন। যাই হোক পরের কথায় আসি। পালক সব পুলিশকে বলে দিতো বিধায় তাকে মে*রে ফেলা হয়েছে।’

-‘আর সোনা আপাকে কেন মে*রেছে?’

-‘সোনা আপা সব সত্য জেনে গিয়েছিল। তুই জানিস বন্যার সময় অনেকে মারা গিয়েছিলো?’
-‘হুম।’
-‘ওরা অসুখে মারা যায়নি। ওদের মেরে ফেলা হয়েছিল। তারপর ওদের দামি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গুলো চড়া দামে বিক্রা করে দেন আব্বা। এইকাজ অনেক আগে থেকেই করে আসছেন তিনি। ডাক্তারদের ও নিজ আয়ত্বে রেখেছেন তিনি। ইতিহাসের কোন জমিদারের চরিত্র ভালো ছিল না। আজও নেই। তাদের দু চারটে র*ক্ষিতা না থাকলে চলেই না। আম্মা যে কি কষ্ট করেছে তা আমি বুঝেছি কবিরকে বিয়ে করার পর। মেয়েরা সবকিছুর ভাগ দিতে পারলেও স্বামীর ভাগ দিতে পারে না। এতে স্বামী যতোই খারাপ হোক না কেন? কবির যখন অন্য নারীর কাছে যেতো তখন আমি ওই রাতটা কীভাবে কাটাতাম তা তুই বুঝবি না পরী। তুই এমন একজন পুরুষ কে স্বামী হিসেবে পেয়েছিস যে শুধু তোর উপরেই আসক্ত। অন্য কোন নারীর দিকে সে চোখ তুলে তাকায়নি কখনো স্পর্শ তো দূরের কথা।

আব্বার এইসব জঘন্য কাজে আপা প্রতিবাদ করে। কিন্ত আব্বা তা মেনে নেয় না। তিনি আম্মার উপর জুলুম করে আপাকে থামাতে। এতে আপা ক্ষিপ্ত হয়ে আব্বাকে খুন করতে যায়। আরও অশান্তির সৃষ্টি হয় তখন। আম্মা তখন আপাকে দমিয়ে রাখে। তোর তখন চার বছর বয়স। কি বুঝবি অতটুকু বয়সে। আম্মা বুঝতে পেরেছিল যদি আপা বেশি কথা বলে তাহলে আব্বা আপাকে মারতেও দ্বিধা বোধ করবে না। তাই আম্মা আপাকে বাঁচানোর জন্য চুপ থাকতে বলে। কিন্ত তা আর হলো কই? রাখালের সাথেই পালিয়ে যাওয়ার সময় ধরা পড়ে যায়। রাখাল কে অনেক মারে তখন। আপা সেটা দেখে আব্বার উপর আক্রমণ করে। তাই আব্বা সেদিন আপাকে মেরে ফেলে। কিন্ত গ্রামের সবাইকে এটা বলে যে আপা পালিয়ে গেছে।

তুই প্রতিশোধ প্রবণ সেটা তুই ভালো করেই জানিস। আপাকে তুই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসিস। অস্ত্র হাতে নেওয়ার সাহস তোর আছে। আব্বা সেটা ভাল করেই জানে। শশীল কে তুই মেরেছিস সেটা জানতে পেরে আব্বার মনে ভয় ঢুকেছে। কারণ সে জানতো তুই একদিন না একদিন ঠিকই আপার মৃ*ত্যুর কথা জানতে পারবি। আর সেদিন আব্বাকেও ছাড় দিবি না তুই। এজন্য তোকে আগেই মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন। কিন্ত আম্মা তোকে এই বাড়ির ভেতর আগলে রেখেছেন বলে তোর কোন ক্ষতি হয়নি। আম্মা সবসময়ই অসুস্থ থাকে কি জন্য জানিস? তোকে বাড়ি থেকে বের করার জন্য বলতো আব্বা। কিন্ত আম্মা তা করতো না সেজন্য আব্বা খুব মারতো আম্মাকে। আমরা যাতে না জানতে পারি তাই আমাদের আম্মার ধারে কাছেও ঘেষতে দিতো না।

দাদীকে তুই খারাপ ভাবতি পরী। আমিও ভাবতাম কিন্ত একবারও ভেবে দেখিনি দাদী কেন এমন করতেন? দাদী নিজেও জমিদারের স্ত্রী ছিলেন। তাহলে সেও আম্মার মতোই কষ্ট পেয়েছেন। দাদী সবসময় আম্মাকে কাকার থেকে বাঁচিয়েছেন। শুধু কাকা নয় আরও খারাপ মানুষের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। সবার সামনে কঠোর থাকলেও আম্মার কাছে তিনি নিজের মা হিসেবে থেকেছেন। আমরা ভুল বুঝেছি দাদীকে।
জানি না এর শেষ কোথায়? আমার ছেলের ভবিষ্যত কি? কিন্ত পরী এখনও সময় আছে। শায়েরের সাথে চলে যা। তুই ওর সাথে ভালো থাকবি।’

পরী উঠে দাঁড়াল বলল,’একটা অপরাধীর সাথে আমি যেতে পারবো না। আব্বার সাথে সেও অপরাধ করেছে। শাস্তি তো তারও প্রাপ্য।’

-‘শায়ের অতোটা পাপ করেনি যা ক্ষমার অযোগ্য। তুই পারবি ওকে ক্ষমা করতে।’

-‘তাকে শাস্তি পেতে হবে তাহলেই সে ক্ষমা পাবে।’

কক্ষ ত্যাগ করে পরী। যাওয়ার সময় জেসমিনের ঘরে গিয়ে তাকে দেখে আসে। খুব বাজে ভাবে সে মেরেছে জেসমিন কে। যা দেখে রাগ দমাতে পারে না
পরী। তাই নিজ ঘরে চলে যায়। শায়ের কে সে আগের মতোই দেখে। তবে এবার সে জেগে ছিলো। পরীকে দেখেই সে উঠে দাঁড়াল।
#পরীজান
#পর্ব ৪৪
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌

সারারাত বিনা নিদ্রায় পার করে ভোরের দিকে চোখ লেগে এসেছিল শায়েরের। পরী ঘর থেকে বের হতেই
ঘুম ভেঙে যায় ওর। তাই সে পরীর ফিরে আসার অপেক্ষায় ছিল। পরী ফেরামাত্রই সে সেদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে ঘরে ঢুকলো পরী। শায়ের বাইরে দাঁড়ানো। পরীর অনুমতি ব্যতীত সে ঘরে প্রবেশ করবে না। পরীর কাছে ঘরে ঢোকার অনুমতি সে চাইলোও না। পরী সেটা খেয়াল করে। কিছুক্ষণ এভাবে কেটে যাওয়ার পর পরী অধৈর্য হলো। সে ভেবেছিল শায়ের তার সাথে কথা বলবে। কিন্ত তা যখন হলো না পরী নিজেই গেল শায়েরের কাছে। রাতে যেভাবে ওকে বের করে দিয়েছিল ঠিক সেভাবেই ভেতরে নিয়ে আসে। বলে,’আপনার সমস্যা কি?’

-‘আপনাকে একবার জড়িয়ে ধরবো?’

কন্ঠে এতোটাই মাদকতা ছিল যে পরীকে ভিশন টানছে। শায়েরের চোখে সে না তাকিয়ে পালঙ্কে বসে পড়ল। শায়ের পরীর পায়ের কাছে বসে পড়ল। হাঁটুর উপর হাত রেখে বলল,’চলুন না আমরা চলে যাই? আমি আপনাকে হারাতে চাই না। নিজেকে নিয়ে আমার ভয় কোন কালেই ছিল না। আমি শুধু আপনাকে চাই। দয়া করে ফিরে চলুন?’

-‘আমিও চেয়েছিলাম আপনার সাথে ছোট্ট সংসার সাজাতে। আপনি আমি একসাথে সুখে থাকতে। আপনার আলিঙ্গনে ঘুমাতে। সকালে আপনার উষ্ণ পরশে ঘুম থেকে উঠতে। আপনার ফেরার অপেক্ষা করতে। একটা মিষ্টি ভালোবাসায় জীবন কাটাতে। কিন্ত তা বোধহয় বাকি জীবনে আর হবে না।’

-‘আমাকে বেঁচে থাকতে একটু ভালোবাসা দিন পরীজান। মরার পর আল্লাহ আপনাকে আমার থেকে আলাদা করে দেবে।’

বিচ্ছেদের কথা শুনে পরী দৃষ্টি মিলায় শায়েরের সাথে। বুকে অদৃশ্য ব্যথা অনুভব করলো সে। এই খারাপ মানুষ টা তার থেকে দূরে থাকবে? পরী বলল,’পাপীরা আল্লাহ্‌র কাছ থেকে ক্ষমা পায়। আপনি কেন পাবেন না? পারবেন না তার কাছ থেকে ক্ষমা এনে আমার সাথে থাকতে?’

-‘আমি তো আপনার ক্ষমা পাচ্ছি না। আল্লাহ কি আদৌ ক্ষমা করবে?’
-‘আমার থেকে হাজার গুন বেশি দয়ালু তিনি। ক্ষমা তিনি অবশ্যই করবেন।’

শায়ের পরবর্তী কথা বলতে পারল না। তার আগেই কুসুমের গলার স্বর ভেসে আসে। আফতাব শায়ের কে ডেকে পাঠিয়েছেন। তাই শায়ের বৈঠকে গেলো। সেখানে শুধু আফতাব নয় আখির,নওশাদ ও আছে। শায়ের ঘরটাতে চোখ বুলিয়ে নিলো। তারপর নিজের চেয়ারে বসল। নিরবতা ভেঙে আফতাব বলে উঠল,’তুমি আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছো শায়ের। আমাদের সাথে কাজ করে আমাদেরই বিরুদ্ধে গেছো। এখন তুমি বলো এটা কেন করলে?’

-‘আমি বিশ্বাসঘাতকতা করিনি। আপনারাই নিজেদের মুখোশ খুলে সামনে এসেছেন। কেন আমাকে না জানিয়ে পরীজান কে এখানে নিয়ে এসেছেন আপনারা? কেন সব সত্য জানিয়েছেন? এখানে আমার কোন হাত ছিলো না।’

-‘তার কারণ তুমি খুব ভাল করেই জানো।’
ভারি হয়ে উঠলো শায়েরের কন্ঠস্বর। মৃদু চেঁচিয়ে বলে উঠল,’আমি বলেছিলাম না যে আমার স্ত্রীর থেকে দূরে থাকবেন। তার কোন ক্ষতি করার চেষ্টা করবেন না। আমি তো তাকে নিয়ে ভালোই ছিলাম। তাহলে আপনাদের এতো সমস্যা কোথায়?’

শায়েরের কথায় নওশাদ ও চিৎকার করে,’গলা নামিয়ে শায়ের। তুমি নিজেই পরীকে মা*রার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিয়ে করেছিলে। তাহলে তুমি মা*রলে না কেন?’

-‘তুমি আমি কেউই ভাল মানুষ নই। তাই আমার প্রতিশ্রুতি সত্যি ভেবে তুমি ভুল করেছো। আমি নই।’

-‘তাহলে এখন কি হবে? পরী তো আমাদের মা*রতে মরিয়া হয়ে উঠবে।’

শায়ের হাসলো,’একটা মেয়ের ভয়ে এতো কাবু তুমি?’

-‘পরী কতোটা ভয়ানক তা তুমি জানো শায়ের। পরী চাইলে তোমাকেও মা*রতে পারে।’

-‘আমি সেই মৃত্যু হাসিমুখে বরণ করে নেবো।’

এবার আখির মুখ খুলল,’তুমি পারলেও আমরা পারবো না। তুমি যাই বলো না কেন নিজেকে বাঁচাতে যদি পরীকে শেষ করতে হয় তাহলে আমরা তাই করবো।’

-‘আমার পরীজানের গায়ে একটা টোকাও আমি পড়তে দিবো না। প্রয়োজনে শতশত লা*শ পড়বে।’

-‘তাহলে আমরা কি করব? কবিরের মতো জীবন দেব?’
-‘আপনাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমি নিলাম। আপনাদের কোন ক্ষতি আমি হতে দিব না। তারপরও পরীজানের কোন ক্ষতি আপনারা করবেন না।’

নওশাদ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,’বড়ই অদ্ভুত প্রেমিক তুমি শায়ের। তোমার স্ত্রী আমাদের মা*রতে
চায় আর আমারা তোমার স্ত্রীকে। মাঝে তুমি ঢাল হয়ে দাঁড়াবে। এর পরিণতি কি হতে পারে ভাবতে পারছো? পারবে পরীর সাথে লড়াই করতে?’

শায়ের জবাব দিল না। বের হয়ে গেল সেখান থেকে।
নওশাদ বলল,’দেখছেন কেমন দাম্ভীকতা দেখালো? ইচ্ছা করছে ওকেও শেষ করে দেই।’

-‘নাহ,তা করা যাবে না। শায়েরের কাছে এমন প্রমাণ আছে যা আমাদের পতনের একমাত্র উপায়।’

আফতাবের কথায় বিরক্ত হলো নওশাদ বলল,’ও জীবিত থাকলে তো আমাদের ফাসাবে।’

-‘এমনি এমনি তোমাকে মূর্খ বলি না আমি। তোমার থেকে দ্বিগুণ বুদ্ধি শায়েরের। শায়ের খুব ভাল করেই জানে আমাদের কার্যসিদ্ধি হলেই আমরা লোকদের মে*রে ফেলি। শায়ের ও নিস্তার পেতো না। তাই সব কিছু তৈরি রেখেছে সে। ওর মৃত্যু হলেও সব প্রমাণ প্রকাশ্যে আসবে।’
নওশাদ চুপ করে গেল। আখির বলল,’পরীকে ছাড়লে চলবে না। আমি জানি পরী থেমে থাকবে না। শায়েরের উপর আমার এতটুকুও বিশ্বাস নেই।’

-‘তাহলে আমাদের পরিকল্পনা সাজিয়ে পরীকে মা*রতে হবে। শায়ের যেন টের না পায়। যদি শায়ের জানতে পারে তাহলে সে আমাদের ছাড়বে না।’

নওশাদ আখির আর আফতাব নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে লাগল।

শায়ের ঘরে ঢুকতেই পরীকে দেখতে পেলো। হাতে তার একটা ছু*রি। সেটাকেই পরী গভীর ভাবে দেখছে। হাত ঘুরিয়ে পরিচর্যা করছে কীভাবে এটা চালাবে সে। শায়ের কে দেখে হাত থেমে গেল ওর। এগিয়ে এসে শায়েরের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,’কি কাজ করে এলেন? আমাকে মা*রার নতুন কোন পরিকল্পনা করেছেন কি?’

মৃদু হাসে শায়ের,’আপনি তো সব শুনেছেন তাহলে আবার জিজ্ঞেস করছেন কেন?’
কথা বলল না পরী। ভাবলো শায়ের কি কোনভাবে ওকে দেখে ফেলেছিল? পরী ওদের কথা লুকিয়ে শুনছিল। শায়ের দেখলো কীভাবে?

-‘আপনার উপস্থিতি আমি চোখ বন্ধ করে বুঝতে পারি। আপনার শরীরের প্রতিটা লোমের সাথে আমি পরিচিত। কখনোই আমার থেকে নিজেকে লুকাতে পারবেন না।’
-‘আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়,যে মানুষ টা এতো ভালোবাসতে পারে সে কি করে প্রাণ নিতে পারে?’

-‘ভালোবাসা মানুষ কে সব করাতে পারে।’
কথাটার বলে আরেকটু কাছে এলো শায়ের। পরীর যে হাতে ছু*রি সে হাতটা উঁচু করে ধরে বলে,’আপনি ঠিক এই ছুরির মতো ধারালো পরীজান। আমার হৃদয়ে গেঁথে আছেন। সেই ধারালো ছু*রির ফাঁক গলিয়ে চুয়ে পড়ছে আমার ভালোবাসা। যা শুধু আপনার জন্য বরাদ্দ। না পারছি আপনি নামক ছু*রিটা বের করতে আর না পারছি ধরে রাখতে। বুকে থাকলে ব্যথা হয় আর বের করে দিলেই মৃ*ত্যু।
এখন আমার করণীয় কি পরীজান? আমার যে খুব কষ্ট হচ্ছে।’

হাত থেকে ছুরিটা আপনাআপনিই পরে গেল। উৎকন্ঠা হয়ে পরী বলে,’আমাকে দূর্বল করার চেষ্টা করবেন না। আমি কঠোর হতে চাই। আমি তাদের শেষ করতে চাই যারা আমার শ*ত্রু। আমি জানি আপনি এর মাঝে আসবেন। তবে একটু সাবধানে থাকবেন।’
-‘আপনি তো বললেন আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলে তিনি ক্ষমা করবেন। আমরা দূরে কোথাও গিয়ে আল্লাহর কাছে আর্জি জানাই?’

-‘বারবার একই কথা বলছেন কেন? আমি তো আপনাকে বলেই দিয়েছি আমি কোথাও যাবো না। প্রতিশোধ না নিয়ে আমি যাবো না।’

শায়ের থামলো। এসব নিয়ে আর কথা বলল না। সে কিছুক্ষণ পর বলে উঠল,’আপনাকে একবার জড়িয়ে ধরব পরীজান? অনেক তৃষ্ণা পেয়েছে আপনাকে আলিঙ্গন করার।’
পরী শায়েরের বুকে মাথা রাখে। আর শায়ের স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে নিজের তৃষ্ণা মেটায়। এ যেন বহুক্ষণের পিপাসা।
-‘আমার হাতে যদি ছুরি থাকতো আর সেটা যদি আপনার বুকে গেঁথে দিতাম তাহলে কেমন হতো মালি সাহেব?’

-‘সেটা আমার পরম সৌভাগ্য হতো পরীজান। আপনাকে বুকে নিয়েই দুনিয়া ত্যাগ করতে চাই আমি।’
-‘আর আমি আপনাকে এই দুনিয়া আরও দেখাতে চাই।’

আর কেউ কোন কথা বলল না। অনুভূতির সাথে মিশে গেল দুজনে। একদিকে ভালোবাসা আরেক দিকে প্রতিশোধ! কীভাবে সামলাবে পরী? আর শায়ের!! খারাপ মানুষ গুলোকে বাঁচাতে গিয়ে ওর কি হবে? পরী যদি নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে? যদি সে শায়ের কে আঘাত করে? যতোই সে শায়ের কে দূরে সরিয়ে দিক না কেন,শায়ের ছাড়া পরী অচল।
নিষ্ঠুর এই নিয়তি ওদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিলো। আলাদা করে দিলো দুজনকে। সময় কাকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে তা কেউই জানে না। কার ভাগ্যে কি আছে তাও জানে না। তবে শুধুমাত্র প্রার্থনার মাধ্যমেই মানুষ নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে।

রুপালি পিকুলকে কোলে নিয়ে উঠোনের এক কোণে বসে আছে। খুশি গ্রাস করে নিয়েছে এক অজানা কালো মেঘ। যার দরুন হাসি নেই কারো মুখে। তখনই অন্দরের দরজা পেরিয়ে একজন যুবক প্রবেশ করল। তাকে দেখেই কেঁপে উঠল রুপালির সর্বাঙ্গ। পিকুলকে শক্ত করে ধরে সেই পুরুষের দিকে তাকিয়ে রইল সে। পুরুষটি রুপালির নিকটে এসে বলল,’কেমন আছো রুপালি?’

ঈষৎ কেঁপে উঠল রুপালি। কতদিন পর এই কন্ঠস্বর সে শুনতে পেলো! সিরাজের চোখে চোখ রেখে দাঁড়াল রুপালি। কম্পিত কন্ঠে বলল,’ভাল। আপনি কেমন আছেন?’
সিরাজ হেসে বলে,’ভাল। তোমার ছেলে?’

পিকুলের দিকে তাকিয়ে রুপালি বলে,’হুম।’

-‘দেখতে তোমার মতোই হয়েছে। গায়ের রঙ ও তোমার মতোই সুন্দর।’
-‘এতোদিন পর কি মনে করে এলেন? সেই যে গেলেন তারপর আর তো দেখা দিলেন না।’

-‘জীবনের সবকিছু চলে যাওয়া মানেই তো জীবন যাওয়া। তাহলে দেখা দেই কীভাবে বলো?’

-‘তাহলে আজ দেখা দিলেন যে?’

-‘জানি না কেন এসেছি!! তবুও এসেছি।’

দোতলায় দাঁড়িয়ে পরী রুপালি আর সিরাজকে দেখছে। ভাবছে ওদের মিল হলে কত না সুন্দর হতো।
কবির নামক খারাপ মানুষের সাথে জীবন জড়াতো না রুপালির। এখন রুপালি সম্পূর্ণ একা। সবাই থেকেও নেই।
সেই মুহূর্তে শায়ের ওর পেছনে এসে দাঁড়াল। সিরাজ কে দেখে খানিকটা অবাক হয়ে বলে উঠল,’সিরাজ!
এখানে কেন?’

পরী পেছন ফিরে তাকালো বলল,’মনে হয় আপার সাথে দেখা করতে এসেছে।’
-‘ভুল ভাবছেন আপনি পরীজান।’
ভ্রু কুঁচকালো পরী,’ভুল ভাবছি মানে?’
-‘সব যখন জেনেছেন তাহলে এটুকু অজানা থাকবে কেন? সিরাজের থেকে আপনার বোনকে দূরে রাখুন।
এখন আপনার সাথে বিপদ অন্দরের সবার। তাই যথাসম্ভব অন্দরে থাকার চেষ্টা করুন সবাই।’

-‘কি বলতে চাইছেন আপনি? সিরাজ ভাইও!!’

-‘সেও আমার মতোই আপনার বাবার সাথে কাজ করত। বাকিটা আপনি বুঝে নিন।’

পরী ঘাড় ঘুরিয়ে সিরাজের দিকে তাকালো। বিশ্বাস হলো না ওর। কিন্ত শায়ের তাকে মিথ্যা বলেনি। সিরাজ ও ছলনার আশ্রয় নিলো! পরী এতে খুব বেশি অবাক হলো না। তবে ওর ভয় হলো রুপালিকে নিয়ে।
#পরীজান
#পর্ব ৪৫
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌

কুসুম আর শেফালি মিলে কিছু একটা নিয়ে আলোচনা করছে। দুজনেই ভয়ে জীর্ণশীর্ণ হয়ে আছে। কথা বলতেও তাদের গলা কাঁপছে। ওরাও জমিদার বাড়ির এই পরিণতি মানতে পারছে না। কখনও ভাবেও নি এসব ব্যাপারে। যেদিন আফতাব জেসমিনের গায়ে হাত তোলে ওইদিনই সব পরিষ্কার হয় ওদের কাছে। আফতাবের মুখোশ উন্মোচন হয় সকলের সামনে। কিন্ত ওদের তো করার কিছু নেই। ওদেরও প্রাণ সং*শয়ে। কখন জানি আবার মৃ*ত্যুর খেলা শুরু হয়ে যায়!
পরী জেসমিনের ঘর থেকে বের হয়ে নিজ ঘরে যাচ্ছিল। পথে কুসুম আর শেফালির কথোপকথনে থেমে যায়। এগিয়ে যায় ওদের কাছে,’কি হয়েছে কুসুম?’
কুসুম চট করেই জবাব দিলো,’কিছুনা আপা।’

-‘আমার থেকে কিছু লুকাবি না। তাহলে তোদেরই বিপদ। এই বাড়িতে একমাত্র আমিই তোদের সুরক্ষা দিতে পারব। বল কি হয়েছে?’
শেফালি বলা শুরু করে,’সবাই সবার আসল রূপ দেখাইছে আপা। ওই নচ্ছার বেটা এহন সুযোগ লইয়া আমার গায়ে হাত দেয়। আমি ডরে কিছু কইতে পারিনা আপা।’

-‘কে নওশাদ?’
-‘হ আপা।’
রাগ হওয়ার পরিবর্তে পরীর মুখে হাসি ফুটল। মাথায় যেন মুহূর্তেই বুদ্ধি খেলে গেল। পরীকে এভাবে হাসতে
দেখে চমকে গেল ওরা দুজনে। কুসুম জিজ্ঞেস করে, ‘কি হইলো আপা আপনের?’

-‘তোরা দুজনেই পারবি আমার উদ্দেশ্য সফল করতে। পারবি তো?’
দুজনের একজনও কিছু বলে না এমনকি কিছু বোঝেও নি পরীর কথা। পরী আবার বলে,’কুসুম শেফালি তোদের যা বলব তোরা তাই করবি। ওই নর*পিশাচদের দুনিয়া থেকে বিদায় করার জন্য তোরা থাকবি না আমার সাথে?’

-‘আপনে সাহসি আপা। ত*লো*য়া*র চালাইতে আপনে পারবেন কিন্ত আমরা তো পারমু না। ওগো সামনে গেলেই ডর করে।’
পরী কুসুমের বাহু ধরে বলে,’মৃ*ত্যু*র ভয় করলে ওরা বারবার মৃ*ত্যু*র ভয় দেখাবে। তোকে দূর্বল করে দেবে। সাহস রাখতে হবে কুসুম। তোকে ত*লো*য়া*র
চালাতে হবে না। শুধু আমার কথামতো কাজ করবি।’

দুজনেই রাজি হলো পরীর কথায়। পরীও খুশি হলো। দৌড়ে চলে গেল নিজ ঘরে। সোনালীর ঘরের চাবি নিয়ে সেদিকে ছুটলো। বহুদিন পর সোনালীর ঘরের তালা খুলল পরী। ঘরের আনাচে কানাচে মাকড়সার জালে ভর্তি হয়ে গেছে। বন্ধ থাকার কারণে ভ্যাপসা গন্ধ বের হচ্ছে। পুরো ঘরে চোখ বুলায় পরী। বিশাল বড় পালঙ্ক ঘরের অর্ধেক দখল করে আছে। আলমারি,টেবিল চেয়ার একপাশে পড়ে আছে। ধুলো
জমে আছে প্রতিটা আসবাবপত্রে। নিজের ঘরটা বেশ সুন্দর করে সাজিয়ে রাখতো সোনালী। ব্যক্তিগত কিছুতেই কাউকে হাত দিতে দিতো না সে। আজ সেই ঘরটার এই অবস্থা। পরী আলমারি খুলে দেখলো বোনের পোশাক গুলোতে ইঁদুরের বাচ্চারা ছুটোছুটি করছে। ওরা যেন উঠে পড়ে লেগেছে সোনালীর স্মৃতি নিশ্চিহ্ন করতে। পরী বন্ধ করে দিলো আলমারি। তারপর উঁকি দিলো পালঙ্কের নিচে। বড় একটা টিনের বাক্স বের করলো। ঢাকনা খুলতেই বাতাসে তার ভেতরের কাগজগুলো চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। লেখাগুলো সোনালীর নয় রাখালের। তার দেওয়া চিঠিগুলো যত্ন করে রেখেছে সোনালী। কিন্ত চিঠির প্রায় জায়গা কেটে ফেলেছে ইঁদুরগুলো। পরী বাক্স হাতড়ে কাপড় পেচানো একটা বস্তু বেরে করলো। সপ্তবর্ণে কাপড় সরাতেই সেটি মৃদু আলোয় চকচক করে ওঠে। হাতের ত*লো*য়া*র খানা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভাল করে দেখে। বহুদিনের পুরনো ত*লো*য়া*রে থেকে থেকে মরিচা ধরেছে। তাই পরী তাতে শান দিতে নিচে নিয়ে গেল। পাথরে ঘষে ঘষে ত*লো*য়া*রে ধার দিচ্ছে পরী। সেই শব্দে মালা আর রুপালি ঘর থেকে বের হয়ে এলো। এমতাবস্থায় মেয়েকে দেখে মালা এগিয়ে গিয়ে বললেন,’কি করস পরী তুই?’

-‘শত্রু থেকে রক্ষা পেতে হলে অ*স্ত্র প্রয়োজন।’

মালা বসে পড়ল মেয়ের পাশে। আতঙ্কিত হয়ে বলে, ‘আমি বড় মাইয়াডারে হারাইছি। তুই কি চাস তোরেও হারাই আমি?’

পরীর হাত থেমে গেল,চোখ তুলে সে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,’আপনার মেয়ে শহীদ হলে আপনার মাথা সবার সামনে উঁচু হবে আম্মা। এতে কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই।’
-‘তুই একটু থাম পরী।’

-‘ভয় পাবেন না আম্মা। শয়তানের শাস্তি না দিয়ে আমি মরব না।’

মালা চোখের জল ফেলেন। অন্দরের দরজা খোলার আওয়াজে পরীসহ সবাই সেদিকে তাকায়। আফতাব কে ভেতরে আসতে দেখে উঠে দাঁড়ায় পরী। পা চালিয়ে উঠোনে এসে বলে,’কোন সাহসে অন্দরে এসেছেন?’
-‘সাহস আছে বলেই এসেছি। আমার বাড়ি আমি যখন খুশি তখন আসবো।’

পরী হাসল বলল,’ভেতরে আসলে প্রাণ নিয়ে ফেরা মুশকিল হবে আপনার পক্ষে। তাই যেভাবে এসেছেন ঠিক সেভাবেই ফিরে যান।’

আফতাব গর্জন করে বলে,’এতো সাহস আসে কোথা থেকে তোর? আমার মুখের উপর কথা বলিস? মালা!!’
কেঁপে উঠলেন মালা। আফতাব এবার তার উপর অত্যাচার করবেন নিশ্চিত হলো মালা। আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলেন তিনি। আফতাব বলল,’তোমার মেয়ের সাহস বেড়েছে বুঝলাম। ওর কি জানের মায়া নাই? না নিজের মায়ের প্রতি ভালবাসা নাই?’

-‘খবরদার আমার আম্মার গায়ে হাত দিবেন না। এক আম্মাকে ঘরে ফেলে রেখেছেন কিছু বলিনি। এবার চুপ থাকব না। আপনার হাত হাতের জায়গাতে থাকবে না বলে দিলাম। ত*লো*য়া*র চালাতে আমি জানি!!’

-‘চুপ থাক পরী। অনেক হয়েছে,শুধু শায়েরের জন্য তোকে বাঁচিয়ে রেখেছি। তোকে তো তাড়াতাড়ি শেষ করে দেব।’

পরী গলা উচিয়ে বলে,’বের হন অন্দর থেকে নয়তো লা*শ পড়ে যাবে।’
পরীর চিৎকারে শায়ের সেখানে উপস্থিত হয়েছে। তবে পরীকে সে থামালো না। আফতাব শায়ের কে বকতে লাগল। কারণ শায়েরের জন্যই পরী বেঁচে আছে। আর এখন বাঘিনী হয়ে উঠেছে পরী। যখন তখন থাবা মারতে পারে। পরী বলল,’সবাই শুনে রাখো আজকের পর থেকে আমার অনুমতি ব্যতীত অন্দরে পুরুষ প্রবেশ নিষেধ। কোন পুরুষ আসতে পারবে না। সে যদি আমার স্বামীও হয় তাও না।’

কথাটা বলে আফতাবের দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকালো পরী। সে দৃষ্টি এতোটাই ধারালো ছিল যে আফতাবের সর্বাঙ্গে অদৃশ্য ক্ষতের দেখা দিলো। কিছু না বলে সে অন্দর থেকে প্রস্থান করে। শায়ের কিছু পল পরীকে দেখে চলে গেল। পরীর হুকুমে কুসুম দরজা বন্ধ করে দিলো।
প্রথম পরিকল্পনা সম্পন্ন হলো। পরী এটাই চেয়েছিল।পরীর আসল উদ্দেশ্য শায়ের কে অন্দর থেকে সরানো। অতি চতুর শায়ের পরীর পরিকল্পনা বুঝতে সময় নেবে না। তাই আফতাবের সাথে সাথে শায়েরের আসাও বন্ধ করে দিয়েছে। পরী শেফালিকে ডাকল। শেফালি আসতেই সে বলল,’যা বলেছি মনে আছে তো?’
মাথা নাড়ে শেফালি। পরী আবারও নিজের কাজে মন দেয়। ঘষে ঘষে চকচকে করে ত*লো*য়া*র টা।
যেটা সূর্যের আলোতে চিকচিক করে ওঠে। এটাই পরীর শেষ হাতিয়ার যেটা দিয়ে পরী শত্রুদের দমন করতে পারবে।

সিরাজ আর নওশাদ বসে আছে বৈঠকে। আফতাব রেগে আখিরের সাথে বের হয়ে গেছে। শায়েরের দেখাও নেই। আপাতত ওরা দুজন বসে আছে। নওশাদ বলে উঠল,’অনেক দিনের সফর শেষে আসলে। তা ব্যবসা কতদূর?’

সিরাজ আড়মোড়া ভেঙে বলে,’আরে ভাই কত কিছু দেখলাম কিন্ত সোনালীর মতো কাউকেই পেলাম না।’

দুজনে একসাথেই হাসলো। নওশাদ বলল,’আমি কিন্ত ভাই তোমার নাম পরীকে বলিনি। সব চেপে গেছি। যাতে তোমার উপর পরীর একটু বিশ্বাস থাকে।’

-‘আরে আস্তে বলো। পরীর কানে গেলে সব শেষ। যাই হোক আমার এখানে বেশিক্ষণ থাকা চলবে না। পরীর সন্দেহ হবে।’

ওদের কথার মাঝখানে শেফালির আগমন ঘটলো। সিরাজের জন্য নাস্তা এনেছে সে। শেফালিকে দেখে ওরা চুপ করে যায়। চোখের ইশারায় একে অপরকে সতর্ক করে। শেফালি চলে যেতে গিয়েও থেমে যায়। নওশাদ কে দেখে ঘৃণা হচ্ছে ওর। আজ সকালেই কু প্রস্তাব রাখে নওশাদ। শেফালি পরিমরি করে নওশাদের থেকে পালায়। ভয় করছে শেফালির কিন্ত পরীর কথা মনে আসতেই সাহস পেল সে। হঠাৎই নওশাদের পা ধরে বসে পড়ল শেফালি। কাঁদতে কাঁদতে বলল,’আমারে মারবেন না ভাই!! আমি আপনের সব কথা শুনব। দরকার পড়লে অন্দরের সব খবর দিমু। তাও আমারে মারবেন না। আমার ডর
করে অনেক। মারবেন না আমারে!’

শেফালির কান্না দেখে ভড়কে গেল নওশাদ। বোঝার চেষ্টা করল শেফালির মতলব। নওশাদ পা ঝারা দিয়ে বলে,’পা ছাড় আমার। তোর মতলব আমি বুঝি না ভেবেছিস? আমি জানি এসব পরী তোকে শিখিয়ে পাঠিয়েছে।’

-‘আল্লাহ গো ভাই কন কি?? আমার কি পরী আপার মতো সাহস আছে? জানের মায়া হের না থাকলেও আমার আছে। আমি বাঁচতে চাই ভাই। আপনে বড় কর্তারে কইলেই হেয় হুনব। ভাই আমারে রক্ষা করেন। তার লাইগা আমারে যা কইবেন তাই করমু।’

নওশাদ সন্দেহের দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ শেফালির দিকে তাকিয়ে রইল তার পর বলল,’আচ্ছা তুই এখন যা। যখন বলব তখন আসবি। পরী কি করে না করে সব বলবি এসে!!’

শেফালি দৌড়ে চলে গেল। নওশাদ বিশ্রী গালি দিলো শেফালিকে। সে বিশ্বাস করেনি শেফালির কথা। সে সিরাজ কে উদ্দেশ্য করে বলে,’মা** ঢেমনা আছে। ভেবেছে ওর কথা বিশ্বাস করে বসে আছি। যতসব ফকিরের দল।’

সিরাজ মাথা ঝুকে আস্তে করে বলে,’ওদের থেকেও সাবধান থেকো। কখন কি করে বসে কে জানে? আমি আসি আজ। সময় হলে ঠিকই আসব।’

সিরাজ চলে গেল। নওশাদ রয়ে গেল। এখানে পরী ওকে কিছু করতে আসবে না। বৈঠকে কয়েক জন রক্ষি আছে। পরী এখানে আ*ক্র*ম*ণ করতে পারবে না। তবুও আতঙ্কে থাকে নওশাদ। ভয়ে ঘুমাতে পারে না। কবিরকে সে বারবার স্বপ্নে দেখে। বিভৎস সেই চেহারাটা চোখের সামনে ভাসে ওর। এতদিন কোন ভয় ছিল না ওর। সেদিন পরীর হ*ত্যা*কাণ্ড দেখে ভয়ে আছে সে। তাই সবসময় সতর্কতা অবলম্বন করে। এমনিতেই সে পঙ্গু। ওকে মা*রতে পরীর এতটুকু শক্তির প্রয়োজন হবে না। তাই সর্বদা রক্ষী দের সাথে রাখে সে।

শেফালি অন্দরে ফিরে গিয়ে সব বলে দিল পরীকে। পরী জানতো নওশাদ এতো সহজে শেফালির কথা বিশ্বাস করবে না। তাই কীভাবে নওশাদ কে সব বিশ্বাস করাবে তাও ভেবে নিয়েছে পরী। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। এমন সময় রুপালির কন্ঠস্বর ভেসে আসে। সে ডাকছে পরীকে। তাই শেফালির সাথে দ্রুত কথা শেষ করে পরী রুপালির কাছে গেল।
বিধ্বস্ত অবস্থায় বসে আছে রুপালি। দেখে মনে হচ্ছে বহুক্ষণ অশ্রু বিসর্জন দেওয়ার জন্যই এই অবস্থা হয়েছে মেয়েটার। পরী নিঃশব্দে বোনের পাশে বসে বলল,’কি হয়েছে আপা?’

মুহূর্তেই চোখমুখ শক্ত করে নিল রুপালি। রাগে লাল হয়ে এলো ফর্সা চেহারাখানা। বোনের হঠাৎ রেগে যাওয়ার কারণ বুঝতে পারে না পরী। তবে কিছু জিজ্ঞেস ও করে না। যা বলার রুপালি নিজ থেকেই বলবে। নিজেকে যথাসম্ভব ধাতস্থ করে রুপালি বলে,’অনেক হয়েছে পরী আর না। আমি একজনকে নিজ হাতে খু*ন করতে চাই। তুই দিবি তোর ত*লো*য়া*র টা? আমি তাকে মে*রে আবার তোকে ফিরিয়ে দেব!’

-‘কাকে মা*র*বে আপা? কি হয়েছে তোমার?’

-‘বড় আপার আরেক খু*নি যার নাম তোর অজানা পরী।’
-‘কে সে?’
-‘সিরাজ!! আমাকে ঠকিয়েছে সিরাজ। ভালোবাসার ছলনায় আমাকে ফেলেছে পরী। সেইদিন কাকার সাথে হাত মিলিয়ে সিরাজই আমাকে শশীলের হাতে তুলে দিয়েছিল। সিরাজ বড় আপাকে পছন্দ করতো। তাই আপা মরার পর নওশাদ আর কবিরের সাথে সেও,,,’
কথা শেষ না করে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে রুপালি। ঘৃণায় গা গুলিয়ে আসছে ওর। পরী অবাক হলো। তাহলে নওশাদ ওকে একটা মিথ্যা কথা বলেছে। ওদের সাথে সিরাজ ও ছিলো। সে বোনকে বলে,’কেঁদো না আপা শক্ত হও। আমার ভালো লাগছে তোমার কথা শুনে। সিরাজ কে আমি তোমার হাতে ছেড়ে দিলাম। নিজের ক্ষোভ মেটাও। তবে আমি ঠিক যেভাবে বলব সেভাবেই করবে সব।’

-‘কিন্তু পরী আমার পিকুলের কি হবে? এতটুকু বাচ্চা!
আমার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে ওকে কে দেখবে?’

-‘সেই চিন্তা তুমি করো না। আমি শীঘ্রই ওর একটা ব্যবস্থা করব। তুমি শুধু তোমার ভেতরে রাগ জন্ম দাও। দেখবে শত্রুদের প্রতিহত করতে পারবে। আর ভয় পাবে না।’

রুপালির ঘর ত্যাগ করে পরী। ওর ভিশন খুশি লাগছে আজ। পরী ভেবেছিল সিরাজের আসল চেহারা সামনে এলে রুপালি নিজেকে সামলে নিতে পারবে না। কিন্ত রুপালি যে এভাবে নিজেকে সামলে নিবে তা পরী কল্পনাও করেনি। সবাই মিলে একসাথে কাজ করলে সফল হওয়া সম্ভব।

পরেরদিন সকাল বেলা। কুসুম ভয়ে ভয়ে পা রাখে বৈঠকে। পিঠা আর শরবত দিয়ে আসে সবাইকে। ওই
খারাপ লোকগুলোর সামনে গেলে মনে হয় এই বুঝি ঝাঁপিয়ে পড়বে ওদের উপর। তাই সে দৌড়ে পালিয়েছে। শায়ের বাদে সকলেই উপস্থিত সেখানে। নওশাদ যেই না শরবত খেতে যাবে তখনই শেফালি চিৎকার করে বলে,’শরবতে বিষ মেশানো আছে কেউ খাইয়েন না!!’

#চলবে,,,,
#চলবে,,,,
#চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here