#পূর্ণশশী (রিপোস্ট)
পর্ব-১০& অন্তিম
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
______________________
“শরতের আকাশে পেঁজা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ ভাসছে। মেট্রিক পাশ করে কলেজে ভর্তির জন্য বাবার হাত ধরে রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে একটা মেয়ে। আমার জানার কথা নয় মেয়েটি কোথায় যাচ্ছে তবুও জেনে গেছি। কারণ সেই রাস্তার উল্টো পাশে আমিও হেঁটে কলেজ রোডে যাচ্ছিলাম৷ হঠাৎই চোখ পড়েছিলো রাস্তার অন্য পাশের মেয়েটির ওপর। পরনে কাঁচা হলুদ রঙের কামিজ৷ মাথার চুল গুলো দু’পাটি বেণী করা সাথে ছোট্ট ক্লিপও ছিলো অনেকটা বাচ্চাদের মত। আমি একবার দেখলাম আবার হাঁটতে লাগলাম। মনে হলো আরেকবার দেখতে চাই তাই আবারও দেখলাম৷ রাস্তা দিয়ে পরপর গাড়ি চলছে তাই ঠিকঠাক দেখা হচ্ছে না। একটু ভেবে রাস্তা পার হলাম। ইশ, এবার তো বাবা, মেয়েকে পেছন থেকে দেখতে হচ্ছে । মুখটা আর দেখা হলো না। চলতে লাগলাম চলতেই লাগলাম পথ কোথায় ফুরাবে জানি না। বাজার পেরিয়ে কলেজ রোডে আসতেই খেয়াল হলো বাবা আমায় বলেছে সাইকেল সারাই এর দোকান থেকে সাইকেলটা নিয়ে যেতে। কিন্তু মন কিছুতেই মানছে না। লম্বা আদলের হঠাৎ দেখা মুখটা আমায় বড্ড টানছে। আরেকটু দেখতে ইচ্ছে করছে। বাবার কাজ পরেও হবে আগে মনের ইচ্ছেটাই পুরণ হোক। আরেকটু এগিয়ে বুঝতে পারলাম মেয়েটি কলেজে ঢুকছে হয়তো ভর্তি হবে। বয়সটা আমার মতোই হবে। কিছু সময় কলেজের সামনে হাঁটাহাঁটি করতেই বেরুতে দেখলাম সেই বাবা মেয়েকে। যাওয়ার পথে আবারও তাদের পিছু নিলাম, কেন নিলাম জানি না। হাঁটতে হাঁটতে আগের জায়গা ছেড়েও আরেকটু সামনের স্ট্যান্ড এ পৌঁছুতেই তারা বাসে চড়ল। আমার তখন কি হলো জানি না৷ আমিও উঠে পড়লাম সেই বাসে। সম্মোহিতের মত আমি সেই মেয়ের পিছু করে গেলাম। কন্ডাকটর যখন তাদের জিজ্ঞেস করলো কোথায় নামবে মেয়েটির বাবা বলল ‘বটতলা’। আমিও সেই একই জায়গার নাম বললাম। মজার বিষয় হলো আমার পকেটে ছিলো মাত্র পঞ্চাশ টাকা সেখানকার বাস ভাড়া ছিলো ত্রিশ টাকা। যাওয়া তো আমার হয়ে গিয়েছিলো কিন্তু ফেরার পথে অর্ধেক পথের ভাড়া থাকায় মাঝ রাস্তায় নামতে হয়েছে। মেয়েটিকে দেখেছি ততক্ষণ যতক্ষণ না সে তাদের বাড়ির গেইটের ভেতর ঢুকেছে। আমার উপর তার সম্মোহন ঠিক তখনি শেষ হয়েছিলো। আর তখন থেকেই শুরু ভয় বাড়ি ফিরলে বাবা আস্ত রাখবেন না। মাঝ রাস্তায় যখন নামি তখন দিনমণিটা বিদায় নিচ্ছিলো। দিনের আলো পশ্চিমে মিলিয়ে অন্ধকারকে আহ্বান জানাচ্ছিলো। বাকিটা পথ হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরে যখন বাবার হাতে এক দফা মার খেয়েছি তখন মনে পড়লো সাইকেলটা কেন আগে নিয়ে নিলাম না! সেদিন থেকেই শুরু ভালোবাসার গল্পটার। একপাক্ষিক ভালোবাসার গল্প। বাবার হাতের সেদিনের মার আমার রাস্তা তৈরি করে দিয়েছিলো সেই মেয়েটিকে খুব কাছ থেকে দেখার। এক দিনের মার এক সপ্তাহের জ্বরে রুপান্তরিত হয়ে বাবাকে নরম করেছিলো। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নতুন ভর্তি হওয়া কলেজ ছেড়েছি। সেই মেয়েটির কলেজেই ভর্তি হয়েছি। একই ক্লাসে পড়লেও সাবজেক্ট ভিন্ন হওয়ায় সাক্ষাৎ খুবই কম তবুও হতো এই ঢের। দিন কেটে বছরও গেল অথচ আমি মেয়েটির নাম তখনও জানতে পারিনি। দূর থেকে শুধু দেখে দেখে ভালোবেসেছি। সেই ভালোবাসার কথা মেয়েটি জেনে এক দুপুরে আমায় কত্তো শাস্তি দিলো।কাঠফাটা রোদ্দুরে একঘন্টা দাঁড়িয়ে গায়ের রং কালো করে তবেই যেন তার সামনে দাঁড়াই। আমার গায়ের রং নাকি তার চেয়েও ফর্সা এটা অপরাধ। একটা ছেলের গায়ের রং কেন একটা মেয়ের চেয়েও ফর্সা হবে? সুন্দর থাকা শুধু মেয়েদের অধিকার।”
আমি এতটুকু পড়েই ডায়েরিটা বন্ধ করলাম৷ হাসি ছুঁয়ে যাচ্ছে আমার ঠোঁট। মনে পড়ে গেল কলেজের সেই সময় গুলো৷ এই ডায়েরিতে লেখা কথা গুলো আমার স্পষ্টই মনে আছে। হুম, আমিই বলেছিলাম পূর্ণকে তার গায়ের রং এত ফর্সা থাকা চলবে না। আমায় ভালোবাসতে গেলে কালো হয়ে আসতে হবে। এরপর সে ঠিক কি করেছে জানি না তবে গায়ের রংটা কালো না হলেও রোদে পোড়াই মনে হয়েছিলো কিছুদিন৷ সন্ধ্যের মন খারাপটা এখন আর নেই আমার। এই পুরনো সময় গুলো পড়ে মনটা ভালো হয়ে গেছে। ওই সময়েও আমি অংশকে চিনতান না৷ এই যা, যাকে নিয়ে ভাববো না বলি তার ভাবনাই ঘুরে ফিরে আমায় ঘিরে নেয়। ডায়েরিটা রেখে আলমারিটা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়লাম৷
আমার দিন চুপিসারে কেটে যাচ্ছে । আমার জবটাও হয়ে গেছে কয়েকদিন আগেই। এখন আর অংশের সাথে আমার দেখা হয় না তেমন। পূর্ণের সাথে দেখা শুধু রাতেই হয়৷ এর মাঝেই এক সকালে বাথরুমের সামনে দেখা হয় মৌশির সাথে৷ গোসল সেরে মাত্রই বের হয়েছিলো মেয়েটা৷ চোখাচোখি হতেই সে মিষ্টি করে হেঁসে চলে যাচ্ছিলো ঠিক তখনি তার আঁচল সরে গলার কাছে আঁচড়ের দাগ চোখে পড়লো। চোখ সরিয়ে নিয়েছি আমি তখনি। সময় পাল্টেছে তার প্রমাণ সেই এক আচঁড়েও প্রামাণিত। পূর্ণতা সবাই পাবে কেউ একটু আগে কেউ একটু পরে। ভালোবাসা শুধু মানসিক নয় দৈহিকও হতে হয়। মানসিক আর দৈহিক দু’দিকের মিলনেই পরিপূর্ণ হয় গল্পটা। হয়তো আমার ধারণা ভুল কিন্তু এটা সত্যি, “যেখানে মনের চাহিদা থাকবে সেখানে দেহের চাহিদাও জাগবেই।” কিন্তু যেখানে দেহের চাহিদা থাকে সেখানে কি মনের চাহিদাও বিদ্যমান? কি জানি কি ভাবছি আমি।
আমার জবটা হয়েছে ভালো পড়াশোনা করে কিছু তো উপকার হলো৷ প্রথম স্যালারি পেয়ে টুকটাক বাড়ির সবার জন্য কেনাকাটা করার ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু সবাইকে কি করে দেব তাই শুধু মৌশি,রানু আন্টি আর মায়ের জন্য তিনটা শাড়ি কিনেছি৷ পূর্ণের জন্য একটা পাঞ্জাবিও কিনেছি। তাকে আমি বরাবরই পাঞ্জাবী পড়তে দেখেছি শুধু অফিস টাইম ছাড়া। আর রাতে টি শার্টও দেখেছি৷ আচ্ছা পূর্ণের কি ইচ্ছে জাগে না তার বউকে কাছে পাবার? তবে সে চেষ্টা করে না কেন? কখনও তো কাছ ঘেঁষে দাঁড়ায় না পর্যন্ত।
আমি পুরনো বান্ধবীদের সাহায্যে থাকার মত একটা সিঙ্গেল ফ্ল্যাট খুঁজে নিয়েছি। আজকাল বাড়িতে রান্না বলতে শুধু সকালের নাস্তাটাই আমি তৈরি করি অনেকটা জোর করেই। দুপর,রাতে আমি করতে পারিনা রানু আন্টি করে আর মৌশি হেল্প করে৷ রাতটা আমার অর্ধেক কাটে পূর্ণের ডায়েরি পড়েই৷ কাল রাতেও পড়েছি আজও পড়বো। অপেক্ষা পূর্ণ কখন রুম ছেড়ে চলে যায়। পূর্ণ যেতেই দরজা লক করে বসে পড়লাম।
“বসন্তের প্রথম দিন ভার্সিটি জীবনের দ্বিতীয় বর্ষ। মেয়েটির নাম জেনেছিলাম কলেজের শেষ ক্লাসে। কি আশ্চর্য সময় কেটেছে আমার একই ব্যাচ হয়েও একটা মেয়ের নাম জানতে পারিনি৷ সত্যি বলতে চেষ্টাই করিনি। চঞ্চল, প্রাণোচ্ছোল স্বভাবের মেয়েটাকে দূর থেকে দেখেছি,কাছ থেকেও দেখেছি বহুবার। মনের কথা বলার সাহস ছিলো তবুও সাহস দেখাইনি৷ লিখেছি মনের কথা ডায়েরির পাতা জুড়ে, লিখেছি খাতার এপিঠ ওপিঠে। কতশত চিঠি লিখেছি তার নামে কখনও পূর্ণিমার রাতে কখনও শ্রাবণের বৃষ্টিমাখা দুপুরে। আজ অব্ধি কোন চিঠি তার কাছে পৌঁছায় নি৷ আমি পাঠাইনি। তার প্রেমে পড়ে আমি কবি হয়েছি, হয়েছি গল্পকার কখনো পাগল কখনো মিষ্টি তার হাঁসিতে নিজেকে হারিয়েছি৷ সকল ভালোবাসা আমার কলমের খোঁচায় কাগজে লেপ্টে ছিলো তবুও মাখায়নি তার মন কে। রোদ্রভাঙা দুপুরে আচমকা বৈশাখি ঝড়ের তান্ডব যেমন করে শুরু হয় ঠিক তেমন করেই আমার জীবনেও ঝড়ের আগমন ঘটেছিলো৷ সেই ঝড় আমায় ভেঙে গুরিয়ে আমার কুটির শূন্য করে দিয়ে গিয়েছিলো৷ আমার খাতায় দাগ কেটেছিলো নতুন এক চরিত্র । আমার কাছের আমার প্রিয় একজন মানুষ আমারই বড় ভাই৷ মনের ভেতর লালন করা আমার এত বছরের ভালোবাসা এক মুহুর্তে আষাঢ়ে বর্ষার মত ধুয়ে মুছে নিয়ে গিয়েছিলো ভাসিয়ে। এক বিকেলে হুড তোলা রিকশায় আমার ভালোবাসা আর আমার প্রিয় মানুষ দু’জনকে এক সঙ্গে দেখা। যতদূর জেনেছি মেয়েটি জানে আমি তাকে ভালোবাসি, মেয়েটি জানে না মেয়েটার ভালোবাসার মানুষটি আমারই কাছের কেউ।”
নাহ আজ আর পড়বো না তাই ডায়েরিটা রেখে দিলাম৷ শেষ পর্যন্ত পড়ার ইচ্ছে ডায়েরিটা কিন্তু কিভাবে পড়বো? কাল ছুটির দিন কালই পুরোটা পড়ে নিবো৷ ভালোবাসা দ্বিতীয় বার হবে কিনা জানি না। তবে পূর্ণের পাওনাটুকু তাকে দিয়ে যেতে হবে৷ আচ্ছা পূর্ণের পাওনা তো শুধু স্বামী হিসেবে তাহলে স্বামীর পাওনা কি? শারিরীক সম্পর্ক! আৎকে উঠলাম আমি একটা বিয়ে কি শুধু মাত্র শারীরিক সম্পর্ক গড়ার জন্য ? সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য নাকি আরো কিছু।
দিনটা শুক্রবার সকাল। পরিবারের সবাই আজ একসাথে নাস্তা করতে বসেছে। অংশও বসেছে আমিও আছি। আজও তাকাইনি আমি অংশের দিকে। শক্ত হয়ে আছি তবে বুঝতে পারছি আমায় স্বাভাবিক হতে হবে ঠিক অংশের মত করেই। পূর্ণ আমার পাশেই বসেছে৷ সবাই নাস্তা শেষ করে যখন উঠবো তখনই মেহমান এলো বাড়িতে। মৌশির বাবা আর দাদী এসেছেন৷ ভদ্রলোক এত সকালে এসে বিচলিত। হয়তো ভাবছেন আরো পরে আসা যেত৷ কিন্তু শুভ কাজ বলে কথা তাই নাকি দেরি করতে ইচ্ছে করেনি৷ অংশ আর মৌশির বিয়ের ব্যাপারে কথা বললেন। ধুমধামে একটা অনুষ্ঠান করতে চান শরিয়ত মোতাবেক আবারও বিয়ে দিতে চান তাদের। অংশ এবার খুশি মনেই সায় দিয়েছে। দূর থেকে সে আমাকেও পর্যবেক্ষণ করেছে কয়েকবার। তার দিকে না তাকিয়েও আমি ঠিক বুঝেছি৷ বড়রা কথা বলে দিন তারিখ ঠিক করেছে এক সপ্তাহ পরের। ততদিন মৌশি বাবার বাড়ি থাকবে তাই তার বাবা তাকে সাথে করে নিয়ে গেছে। বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান বলে কথা তাই পূর্ণকে তিনদিন আগেই ছুটি নিতে বলা হয়েছে। অংশও ছুটি নিবে এক সপ্তাহের । আমাকেও বলবে বলবে করে কেউ আর বলতে পারে নি। আমি নিজ দ্বায়িত্বেই ছুটি নিয়েছি তিন দিনের। ভাশুরের বিয়ে বলে কথা। দাওয়াত করা হয়েছে আমার বাবা মা’কেও৷ হলুদের দিনে আমিই নিজ হাতে সবটা গুছিয়েছি। পূর্ণ হয়তো ভেবেছে আমি ভেঙে পড়বো এসব দেখে। কিন্তু তার ধারণা ভুল করে দিয়ে মুখে প্লাস্টিকের হাসি ঝুলিয়ে সবটা করেছি। নিজেকে অনেকটা নারকেলের মত করে ভেতরটা যাই হোক বাইরেটা শক্ত আবরণে ঢেকে নিয়েছি৷ অংশের বাসরঘরও সাজিয়েছি পূর্ণকে সাথে নিয়ে। আমার শক্তির সমাপ্তি সেখানেই ঘটেছিলো৷ আমি ঢলে পড়েছিলাম পূর্ণের বুকে হাউ মাউ করে কেঁদেছি সেদিন৷ এই ছিলো শেষ কান্না প্রাক্তন প্রেমিকের জন্য৷ তার পরের কান্নাটা অন্যরকম৷ চাঁদ সবসময় অসম্পূর্ণ থাকে না। আমি শশী মানে আমি চাঁদ ছিলাম। আমিও পূর্ণ হয়েছি পূর্ণের বুকে পড়ে৷ অংশ আর মৌশিকে বাসরঘরে দিয়ে আমি নিজের ঘরে গিয়ে বের করেছিলাম পূর্ণের ডায়েরিটা। অসম্পূর্ণ ডায়েরিটা পূর্ণের হাতে দিয়ে বলেছিলাম পূর্ণ করো এটা। আজ রাতে তুমিও পূর্ণ হবে তোমার বউকে পেয়ে। পূর্ণ তখন তাচ্ছিল্যের হাঁসি হেসেছিলো। বলেছিলো, আমার ডায়েরির পূর্ণতা দরকার নেই। এমন পূর্ণতা যা শুধু দেহের হবে যা শুধু প্রাক্তনের প্রেমের দহনে পুড়ে হবে৷ আমার ডায়েরির পূর্ণতা কারো তিন বছরের প্রেমে ধোঁকায় জ্বলে কেন হবে? আমার ভালোবাসা সাত বছর সাড়ে নয় মাসের। এই অপেক্ষা আজীবন থাক পূর্ণতা আমার লাগবে না।”
পূর্ণ সেদিন আমায় চলে যেতে বলেছিলো, “চলে যাও তুমি যেখানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলে।” আলমারিতে গুছিয়ে রাখা আমার লাগেজটা যখন পূর্ণ সামনে রেখেছিলো বুঝেছিলাম পূর্ণ জেনে গেছে আমি এ বাড়ি ছেড়ে যাবো৷ বলার মত কিছু ছিলো না আমার কাছে৷ কিন্তু পূর্ণের কাছে ছিলো আমাকে দেওয়ার মত আর বলার মত কিছু৷
রেজিস্ট্রি পেপার দিয়েছিলো সেদিন আমার হাতে৷ উহুম, সেটা বিয়ের নয় সম্পত্তির। আমি যেদিন বিয়ের জন্য কল দিয়েছিলাম তাকে সেদিন বিয়ে নয় সম্পত্তির রেজিস্ট্রার হয়েছিলো আমার বাবার৷ পূর্ণ বর হিসেবে নয় সাক্ষী হিসেবে সাইন করেছিলো৷ আমি কত বোকা কবুল বলার সময়ও একটা বার খেয়াল করলাম না কাজি কেন পূর্ণকে কবুল বলতে বলেনি৷ সেদিন এও জানলাম আমার বাবার আনা ইন্জিনিয়ার পাত্র আর কেউ নয় পূর্ণ ছিলো। আমি হেরেছি নিজের কাছে হেরেছি পূর্ণের ভালোবাসার কাছে হেরেছি আমার বাবার ভালোবাসার কাছে৷ অংশের প্রেমে অন্ধ হয়ে ভুল বুঝেছি বাবার রাগ করাকে। নিজের ভুল বুঝতে পেরে আমি চলে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারিনি৷ সেই রাতে সেই পূর্ণিমার রাতে শীতল হাওয়ায় দাঁড়িয়ে পূর্ণ আমায় প্রপোজ করেছিলো৷ আমি ভালোবাসতে পারিনি তখন তাকে তবুও রাজি হয়েছিলাম তার জীবন সঙ্গিনী হতে৷ আকাশের পূর্ণচাঁদটাকে স্বাক্ষী রেখেই আমরাও হয়েছিলাম পূর্ণশশী। ভালোবাসা মনটাকে বড় হতে শেখায় এই কথাটা আমি মানি। মেনেছি অংশের সুখটাকে মৌশির সাথে৷ মেনেছি পূর্ণের ভালোবাসাটাকে। শুধু সময় নিয়েছি দ্বিতীয় বার ভালোবাসতে৷ পূর্ণকে আমি ভালোবেসেছি । হ্যা, দ্বিতীয়বার ভালোবাসার শুরুটা হয়েছিলো হাসপাতালের বেডে শুয়ে। আমার প্রথম সন্তানের জন্মের ঘন্টা খানেক আগেই আমি প্রেমে পড়েছিলাম পূর্ণের। পূর্ণ বলে আমি নাকি তার নয় তার কান্নার প্রেমে পড়েছিলাম৷ আমার ডেলিভারির সময় আমি কান্না করার আগেই পূর্ণ কেঁদেছিলো শব্দ করে। দেহের মিলন আমাদের হয়েছিলো আগেই মনের মিলন সেদিনই হয়েছিলো৷ পূর্ণ বলেছিলো তার পূর্ণতা লাগবে না। আল্লাহতা’আলা তাকে পূর্ণতাই দিয়েছিলো৷ আমাদের পূর্ণতা। পূর্ণশশীর পূর্ণতা’।
পূর্ণশশী- ইশতিয়াক আহমেদ পূর্ণ।
পূর্ণতা উপন্যাসটা পড়া শেষ করে চোখের পানি মুছলো। কান্না করেছে সে উপন্যাসটা পড়ার সময় তবে সেটা সুখের ।
“মামনি এই উপন্যাসের শেষটা খুব সুন্দর।”
পূর্ণতা বলল তার মা’কে।
” আর শুরুটা?” শশীর প্রশ্ন।
” শুরুটা কষ্টের তাই ভালো লাগেনি। পাপা কষ্ট পেয়েছে শুধু ।”
“শুধু পাপার কষ্টটা চোখে পড়লো?”
শশী আবারও মেয়েকে প্রশ্ন করলো।
” নাহ, তবে পাপার ভালোবাসায় একধরনের মুগ্ধতা আছে “।
” যেমন?”
” দীর্ঘসময় ভালোবেসে অপেক্ষার প্রহর সবাই গুণতে জানে না৷ অথচ পাপা সেই পরীক্ষাটাই দিয়েছে অপেক্ষার।”
“তাই! পাপার ভালোবাসায় মুগ্ধতা আছে?”
” অবশ্যই। আচ্ছা পাপা কখন আসবে? আমার এস এস সি’র রেজাল্ট আউট হবে কাল। আমরা কিন্তু দাদু বাড়ি যাবো কালই। মৌশিমা আমায় বারবার বলে দিয়েছে আমার জন্য কাল গাজরের হালুয়া বানাবে। দিদুনও আমার জন্য আর ইহান (অংশ আর মৌশির এডপ্ট করা সন্তান)ভাইয়ার জন্য স্পেশাল বিরিয়ানি করবে।”
“পূর্ণতা তোমার পাপা আজ রাতের ফ্লাইটে ঢাকায় আসবে। বাসেই আসতো কিন্তু উনার নাকি মেয়ের জন্য মন কেমন করছে তাই রাতেই চলে আসবে৷”
“ইয়াহু, গ্রেট তবে আমি প্ল্যান করি ভাইয়াকে ফোন করে৷ ঘুরতে যাবো আমরা এ বছর চাচ্চু কথা দিয়েছিলো।”
পূর্ণতার কথা শেষ হওয়ার আগেই কলিংবেল বেজে উঠলো। শশী দরজা খুলেই অবাক পূর্ণ দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। গায়ে সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট গলায় কালো টাই লুজ করা, গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি গুলোর ফাঁকে সাদা সাদা কয়েকটা দাঁড়ি। মাথার চুলেও দু’একটা পাকা চুল নজরে আসে৷ শশীর চুল এখনও পাকেনি অথচ বয়সে তিন মাসের ছোট তার বরের চুল এখনই পেকে যাচ্ছে ভাবতেই হাঁসি পেল তার। হাতে কোট আরেক হাতে কয়েকটা ব্যাগ৷ শশী পূর্ণকেই অবাক হয়ে দেখছিলো তখন পূর্ণ তাকে আরো অবাক করে দিয়ে টুপ করে কপালে চুমু খেয়ে ঘরে ঢুকে গেল।
পরিশিষ্টঃ পূর্ণ আর শশী বিয়ের পর আলাদা বাড়িতে চলে এসেছিলো। শশীর কথা ভেবেই পূর্ণ বাড়ি ছেড়েছিলো। এক বাড়িতে থাকলে স্বাভাবিক হওয়া কখনোই সম্ভব হতো না। সময়ে অসময়ে শশী কিংবা অংশের মনে অতীতের ঘা তাজা হতো৷ পরিবারের সবাইও ঠিক মনে করেছিলো। তাই আর কেউ বাঁধা দেয়নি৷ বিয়ের ছয় বছর পর জন্ম হয় পূর্ণতার।সুখের সংসার অংশ মৌশিরও আর পূর্ণশশীরও। কোন এক সময়ের ভালোবাসা সরে গিয়ে এখন শুধু সম্মানটুকুই বাকি অংশ আর শশীর মধ্যে।
_____________সমাপ্ত_______________
(বানানে ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন।আমি প্রত্যেকবারই চেষ্টা করি গল্পটা একটু আলাদা একটু ভিন্ন লেখার চেষ্টা করি কতোটা পারি জানি না৷ তবে এবার প্রথম ইচ্ছে করে কমন একটা থিম সিলেক্ট করছি। মাঝের কিছু পর্বে সবার মন্তব্য পেয়ে আমি ভুলে গেছি গল্পটা যে কাল্পনিক চরিত্র নিয়ে লিখছি। কয়েকজন বলছে তাদের লাইফের সাথে নাকি অনেকটাই মিলে গেছে। আমার গল্পের মাধ্যমে যদি কেউ কোন প্রকার কষ্ট পেয়ে থাকেন তবে আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। আর যারা অংশ শশীর মিল না হওয়া মনঃক্ষুণ্ন হয়েছেন বা লেখাটা ঠিক হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন তাদের বলছি বাস্তবে এর চেয়েও করুণ পরিস্থিতি আসে জীবনে৷ যাই হোক এটা বাস্তব কাহিনি নয় শুধুই মনগড়া এক গল্প। সবাই ভালো থাকবেন আপনজনদের ভালো রাখবেন আমি অসুস্থ 😐দোয়া করবেন। আল্লাহ হাফেজ)