প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব -৩০

#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্ব_৩০

“তোর মতো ইমোশনাল মানুষ আমার জীবনে দুইটা দেখি নাই। এমনিতেই যেই কাহিনী করেছিস, সেজন্য থা’প’ড়া’ই’তে ইচ্ছে করছে। এখন ভরা স্টেশনে বসে বসে বিলাপ করে কাঁদছিস!”

কর্কশ নারীকণ্ঠ শুনে প্রহর ভীষণ চমকালো। কন্ঠটা হুবহু মধুর কন্ঠের মতো। প্রহর চকিত দৃষ্টিতে চোখ মেলে সামনে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে তাকালো। নিয়নের হলুদ আলোয় মধুর বিরক্তি মিশ্রিত মুখটা দেখে প্রহর অবাক হলো। প্রহরকে এরকম ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে মধুর বিরক্তি আরেক ধাপ বাড়লো যেন! প্রহরের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

“বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে তারপর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকিস। সারাদিন সারারাত তাকিয়ে থাকিস। বাঁধা দিবো না। এখন তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়া। আশেপাশের লোকজন কেমন অদ্ভুত নজরে তাকিয়ে আছে।”

প্রহর মধুর কথা শুনেও শুনলো না যেন! মধুর হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো। কিন্তু নজর অন্য দিকে সরালো না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার প্রিয় মানুষটির দিকে। মধু ল্যাভেন্ডার কালারের থ্রিপিস পরেছে আজকে বহুদিন পর! গায়ে মোড়ানো সাদা চাদরটা ভালো মতো গায়ে জড়িয়ে নিয়ে হাতে হাত ঘষলো। প্রচুর ঠান্ডা পড়েছে। কুয়াশায় ডুবে থাকায় ঠান্ডায় মধুর নাক-গাল লাল বর্ণ ধারণ করেছে। কাঁধ পর্যন্ত কা*টা চুলগুলোও আদুরে ঠেকছে। সবমিলিয়ে মধুকে আগের রূপে আজ অপূর্ব লাগছে প্রহরের চোখে। আনমনে বললো,

“ল্যাভেন্ডারে আজও অপূর্ব লাগে তোমায়!”

মধু প্রহরের চোখের সামনে তুড়ি বাজাতেই প্রহর চমকে গেল। ঈষৎ প্রকৃতস্থ হতেই হতভম্ব হয়ে বললো,

“তুমি? এখানে? ট্রেন….!! তুমি যাওনি? মানে…. ”

“না, যাইনি। গেলে খুব খুশি হতি বুঝি?”

প্রহর শুকনো মুখে হাসলো। সেই প্রাণহীন হাসি বজায় রেখেই বললো,

“শ্বাস চলতো, কিন্তু দেহে প্রাণটা থাকতো! এমনিতেই দুটো বছর মুখে হাসির মুখোশ পরে প্রাণহীন ভাবেই কেটেছে আমার!”

মধুর চোখ টলমল করে উঠলো। কিন্তু সেটা বুঝতে না দিয়ে নিজেকে শক্ত রেখে বললো,

“এতো চাপা স্বভাবের মানুষ কেন তুই? সবসময় সবকিছু নিজের মধ্যে চেপে রাখিস! এরকম কোনো মানুষ হয়! নিজেকে এভাবে কষ্ট দেওয়ার কী প্রয়োজন?”

“বোকা আমি। এজন্যই! আমার কথা বাদ দাও। তুমি তো চলেই যাচ্ছিলে! না গিয়ে আবার ফিরে এলে কেন?”

মধু রাগে ফোঁস ফোঁস করে উঠলো। প্রহরের এসব খামখেয়ালি কথাবার্তায় মেজাজ ঠিক রাখা কঠিন! মধু তেড়ে গিয়ে প্রহরের কাছাকাছি দাঁড়ালো। ওর শার্টের কলার দু’হাতে আঁকড়ে ধরতেই প্রহর চোখ বড়বড় করে ফেললো। মধু অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

“আমি চলে গেলে খুশি হতি খুব? কেন চলে যাবো আমি? আরেকটু দেরী হলে সারাজীবনের মতো চলে যেতাম আমি। ট্রেনে বসে ফোন থেকে সিমটা খুলতেই নিচ্ছিলাম। ঠিক সেই মুহুর্তে অর্থী আপু ফোন দেয়। লোকেশন কানাডা দেখাচ্ছিল বলে আগ্রহবশত কলটা রিসিভ করেছিলাম। অর্থী আপু আমাকে সব বলেছে। একটা বার আমাকে জানাতে পারতি যে, আন্টির আর্জেন্ট ট্রিটমেন্টের জন্য দেশ ছেড়েছিলি সেদিন! আন্টির মৃত্যুর খবরটাও দিসনি আমাদের। এতো খারাপ তুই! শেষমেশ যখন দেখা দিলি, তখনও বললি না। এমন তো আর না যে, আমি তোর কোনো কথা শুনতে চাইনি! কেন কিছু বলিসনি আমাকে?”

প্রহরের হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। মধুর গাল বেয়ে পানি পরছে। তাদের দুজনের মাঝের দূরত্ব এক ইঞ্চির চেয়েও কম। প্রহর ঢোক গিলে নিজের মাথা পিছিয়ে দূরত্ব কিছুটা বাড়ানোর চেষ্টা করলো। কম্পিত কণ্ঠে বললো,

“তোমরাও আমার কাছে কিছু জানতে চাওনি। এতো দিন পর দেখা হওয়ার পরও ঘৃণায় দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছো। একবারও তোমাদের মনে আমার ব্যাপারে জানার কোনো আগ্রহ আসেনি। যেখানে তোমাদেরই কোনো আগ্রহ নেই, সেখানে আমার আগ বাড়িয়ে বলার কোনো লজিক দেখি না। তবুও বারবার তোমার পিছু পিছু ছুটেছি, তোমার কাছে ছোট হয়েছি। একটা আশায়! তুমি একবার আমার কাছে এসে জানতে চাইবে। কিন্তু তুমি তা করোনি! বারবার শুধু অপমান করেছো।”

মধু প্রহরের কলার টেনে আরো কাছাকাছি দাঁড়ালো। নাক টেনে ধরা কন্ঠে বললো,

“তোর কি মনে হয়? ভালো শুধু তুই-ই আমাকে বেসেছিস? আমি বাসি নাই? ‘আমি বলিনি, তুৃমি বোঝনি’- মার্কা ঢঙ করতে কে বলেছিল তোকে? গাধা একটা! এই যে, আমি কাঁদছি। একবার নিষেধ ও করছে না কান্না করতে, চোখও মুছিয়ে দিচ্ছে না। তোর কথা ভেবে আজকে তোর প্রিয় রঙ পরেছিলাম। ট্রেন থেকে নামার পর ভেবেছিলাম আমাকে দেখে তুই সেই পুরনো নামটায় ডাকবি। কিন্তু তুই কিছুই করিসনি! তুই আসলে আমায় ভালোই বাসিস না।”

মধু প্রহরকে ছেড়ে দিলো। চোখের পানি মুছে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে রইলো। প্রহর হাসলো। মেশেটা আগের মতোই রয়ে গেছে একদম। বাচ্চামো কোনো অংশে কমেনি। প্রহর মধুর মুখ নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে ওর চোখ মুছে দিলো। ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে বললো,

“তুমিও তো আমাকে তুইতোকারি করে বলা বন্ধ করছো না, ল্যাভেন্ডার! তবে এই রঙে তোমাকে দেখতে বরাবরই ভালোবাসি আমি। একদম ল্যাভেন্ডারের মতো লাগছে তোমায়। আদুরে!”

মধু ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে হাত দিয়ে নাক ঘষলো। হাতে হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে বললো,

“রেগে ছিলাম, তাই ‘তুই’ করে বলেছি। তোমার মধ্যে তো প্রেম বলতে কিছু নেই! আগের মতোই আনরোম্যান্টিক খাটাশ-ই রয়ে গেছো। নয়তো এতো বছর পর আমাদের মাঝের ভুল বোঝাবুঝি মিটলো। তুমি আমাকে একবার জড়িয়েও ধরলে না!”

প্রহর আশেপাশে তাকিয়ে বললো,

“এখানে? তুমি-ই না বললে আশেপাশের মানুষ কেমন অদ্ভুত নজরে তাকিয়ে আছে! তাহলে এখন জড়িয়ে ধরতে বলছো কেন?”

“এতোক্ষণ আমাদের মাঝে যা হলো, তাতে সবার বিস্ময় কেটে গেছে। দেখাদেখির পালাও শেষ! আর তোর আবার কবে থেকে আশেপাশের মানুষকে নিয়ে এতো মাথা ব্যথা শুরু হলো? আজব পাবলিক মাইরি!”

প্রহর মাথা চুলকে আশে পাশে তাকালো। সবাই এখনো তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। প্রহর এতো মানুষের সামনে ইতস্তত করতে লাগলো। মধু প্রহরের বিরক্তি মিশ্রিত চোখে তাকিয়ে সামনের দিকে হাটা দিলো। একে দিয়ে কিচ্ছু হবে না!

দু পা বাড়াতেই প্রহর মধুর হাত টেনে ধরলো। মধু হতভম্ব হওয়ার সুযোগও পেল না। প্রহর ওকে টেনে নিজের বুকে আগলে নিলো শক্ত ভাবে। আবেগে মধুর বন্ধ চোখ ছাপিয়ে উষ্ণ অশ্রুকণা বেরিয়ে এলো। সাথে কানে ভেসে এলো হাজারো করতালির শব্দস্রোত। রাতের এই স্টেশন, উপস্থিত লোকারণ্য, একটি চলন্ত ট্রেন ও এক আকাশ তারা সাক্ষী রইলো তাদের প্রেমিক সত্তার মিলনের। প্রহর হঠাৎই ফিসফিস করে বললো,

“এখানেই আবাস গড়ে নাও। এজীবনে আর এই বুক থেকে ছাড়া পাচ্ছো না, ল্যাভেন্ডার!”

৩৭.
সব ঝামেলা মিটিয়ে ভোরের দিকে ঘুম দিয়েছে তরী। মাঝরাতে মধুকে নিয়ে বাড়িতে আসার পর অনেক সময় নিয়ে মানিয়েছে মিস্টার রায়হান আর সুজাতাকে। এরপর এক প্রহর কান্নাকাটির পালা! তবুও এটা স্বস্তির যে, মধু এখন থেকে এবাড়িতেই থাকবে। মান-অভিমান, ভুল বোঝাবুঝি শেষ হতেই তরীর মাথার ওপর থেকে যেন একটা বোঝা নেমে গেছে। বেশ স্বস্তি নিয়ে ভোরের দিকে ঘুমিয়েছে তরী।

সৌহার্দ্যের ঘুম ভাঙলো সকাল আটটায় এলার্মের শব্দে। নড়েচড়ে উঠে বসলো সে। চোখে ঘুম থাকলেও আর শুয়ে থাকার অবকাশ নেই। হাসপাতালে যেতে হবে। এলার্ম বন্ধ করে পাশে শুয়ে থাকা তরীর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকালো সে। মুগ্ধতার হাসি খেলে গেল সৌহার্দ্য মুখশ্রী জুড়ে। ঝুঁকে তরীর গালে হাত ছোঁয়ালো সে। ফিসফিস করে বললো,

“থ্যাঙ্কিউ, চাঁদ! আমার জীবনে আরেকবার পূর্ণিমা নিয়ে আসার জন্য। ওয়েটিং ফর গিভিং সামথিং ভেরি স্পেশাল টু ইউ!”

সৌহার্দ্য রেডি হয়ে চলে গেল। সবাই এখনো ঘুমোচ্ছে। কাল অনেক ধকল গেছে সবার ওপর। সৌহার্দ্য আর কাউকে ডাকলো না সে জন্য। হসপিটালেই ব্রেকফাস্ট করবে ভেবে বেরিয়ে গেল। পার্কিং এর দিকে এসে দেখলো প্রহর নিজের গাড়ির সাথে গা হেলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

সৌহার্দ্য অবাক হয়ে বললো,

“তুই? এই সময়ে? মধু তো ঘুমাচ্ছে! তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভেতরে…. ”

“তোর বোনের জন্য দাঁড়াই নি। ও আজকে ভার্সিটি যাবে না, আমি ভালো করেই জানি। আমি তো তোর জন্য এসেছিলাম!”

সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,

“আমার জন্য? কিন্তু আমি তো এখন হসপিটালে যাবো। ডিউটি আছে আমার!”

“জানি। ব্রেকফাস্ট তৈরি করেছিলাম সকালে। ভাবলাম তুইও সকাল সকাল বের হবি। খাবার খেয়ে বের হতে পারবি না, যদি আন্টি ঘুম থেকে না উঠে। তোর অভ্যাস ভুলিনি আমি। তাই ভাবলাম তোর সাথে একসাথেই খাই!”

সৌহার্দ্য হাসলো। ছেলেটা বদলাবে না জীবনেও! প্রহর ভ্রু নাচিয়ে বললো,

“এখন কি এখানে দাঁড়িয়ে-ই থাকবেন? নাকি এই গরিবের গাড়িটায় নিজের পায়ের ধুলো দিবেন, ডাক্তার সাহেব?”

#চলবে……

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here